Sunday, May 5

রবীন বসুর গল্প






ডিলিট


রাকা যখন বাস থেকে নামল তখনও বৃষ্টি পড়ছে l ছাতা নিয়ে বের হলেও বাসস্ট্যাণ্ড থেকে বাড়ি— এই রাস্তাটুকু আসতে ভিজে একসা l আজ শনিবার, তাড়াতাড়ি স্কুল ছুটি l বিকেলে মাকে নিয়ে ডাক্তার বাবুর চেম্বারে যেতে হবে চেক-আপে l

বাড়ি ঢুকতেই মা বলল, জানিস রাকা রজত আজ ফোন করেছিল l

—কেন? সেসব পাট তো চুকিয়ে দিয়ে এসেছি l আমি ওর ব্যাপারে আর ইন্টারেস্টেড নই l

—বলল, তোর সাথে নাকি জরুরি দরকার l বিকেলের দিকে আসবে বলেছে l

রাকা আর কথা বাড়ায় না l  মাকে বলে, ভিজে গেছি খুব l একটু কড়া করে চা কর তো মা l

—তুই চেঞ্জ করে আয়, আমি চা বসাচ্ছি l


রজতকান্তি রায় l স্কুলমাস্টার বাবার প্রিয় ও মেধাবি ছাত্র l এম বি এ করার পর কর্পোরেট দুনিয়ায় মোটা বেতনের চাকরি l রাকা মাস্টার্স আর বি এড করে এস এস সি দিয়ে একটা স্কুল জয়েন করেছে l বাবা একদিন সান্ধ্যভ্রমণ সেরে বাড়ি ফিরে জানাল, রাকার একটা সম্বন্ধ করে এলাম l রবিবার ওকে দেখতে আসবে l

রাকার মা তো অবাক l

—কী বলছ তুমি? সম্বন্ধ, দেখতে আসবে l তুমি রাকার মত নিয়েছ? ও এখন বিয়েতে রাজি হবে?

—শোন, ছেলেটি আমার ছাত্র ছিল l ওর নাম রজত l ওর বাবা সুবিমল আমার কলেজবন্ধু l রাকাকে চেনে l ওর মেয়ে প্রিয়া, আমাদের রাকার সঙ্গে একই নাচের স্কুলে নাচ শিখত l রাকাকে সুবিমলের খুব পছন্দ,তাই ছেলের বউ করতে চায় l

এরপর একটু থেমে রাকার বাবা আরও বলেছিল, আর মাত্র এক বছর আমার চাকরি আছে l আমার তো কোন ছেলে নেই, আমার অবর্তমানে কে রাকার বিয়ে দেবে?

তাই আমি চাই, চাকরি থাকতে থাকতে রাকাকে পাত্রস্থ করতে l এখন তোমরা যদি অমত কর, তাহলে থাক l


রাকা বাবার দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মুখের দিকে তাকিয়ে মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিল l বিয়ে সে করবে l তবে শর্ত দিয়েছিল l বিয়ের খরচ সে ব্যাঙ্ক থেকে পার্সোন্যাল  লোন নেবে l মাসে মাসে তার মাইনে থেকে ইএমআই কাটা যাবে l বাবাকে সে নিঃসম্বল হতে দিতে পারে না l


বিয়ের দু’তিন বছর পর থেকে রজতের পরিবর্তন শুরু হল l সে শুধু কাজের জায়গায় প্রমোশন আর উপরে ওঠার সিঁড়ির খোঁজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল l অফিস মিটিং পার্টি l এরই মধ্যে অফিসের বস মিস বিয়াসের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ল l বিজনেস ট্যুর আছে বলে দিনের পর দিন বাইরে যেত l ড্রিংকের মাত্রাও বেড়ে চলল l প্রথম প্রথম রাকা বুঝিয়েছিল l

— কী দরকার অত টাকা আর প্রমোশনের পেছনে ছোটা l বেশ তো আছি আমরা l শুধু শুধু টেনশন নেওয়া l তার থেকে আমাদের দু’জনের মাঝে তৃতীয় কেউ আসুক l

ছিটকে গিয়েছিল রজত l  বিকৃত মুখভঙ্গি করে রূঢ়স্বরে বলেছিল, এই না হলে মাস্টারনি l যত্তসব ন্যাকামি l স্বপ্ন দেখতেই শেখেনি l রাবিশ l

রজতের এই রূপ রাকা ভাবতেই পারে নি l সেদিন মনে মনে শুধু আহত হয় নি, নারী হিসেবে অপমানিত বোধ করেছিল l

এরপর নিজেকে শামুকের মত গুটিয়ে নিয়েছিল l শক্ত  খোলসের আবরণে নিজের সব চাওয়া-পাওয়া আর স্বপ্নকে ঢাকা দিয়েছিল l রজত কিন্তু থামেনি l বাড়িতে পার্টি অ্যারেঞ্জ শুরু করল l অনেক রাত পর্যন্ত নাচ-গান হৈ-হট্টগোল l রাকার কোন আপত্তি কানে তুলত না l দিন দিন কেমন মরিয়া আর হিংস্র হয়ে উঠতে লাগল l মাত্রা ছাড়াল যেদিন মদ্যপ অবস্থায় বাড়ি ফিরে কয়েক লাখ টাকা চাইল l কারণ জেনে রাকা কঠিন হয়েছিল l বলেছিল, না, টাকা আমি দেব না l প্রথমত অত টাকা আমার কাছে নেই l আর দ্বিতীয়ত থাকলেও আমি হোটেলের বিল মেটাতে টাকা দেব না l

রজত খেপে গিয়ে হাতের কাছে থাকা কাঁচের গ্লাস ছুঁড়ে রাকার কপালে মারল l রক্তাক্ত রাকার ধৈর্যের বাঁধ ভাঙল l  সে সিদ্ধান্ত নিল আর না l এ সম্পর্ক থেকে মুক্তি চাই l

সুযোগও এসে গেল l কয়েক দিন পর মা ফোন করল, তোর বাবার খুব শরীর খারাপ l আমার কেমন ভয় করছে l বোধহয় হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে l তুই একবার আসবি, মা?

সেদিনই রাকা ও-বাড়ি ছেড়ে বাপের বাড়ি চলে এল l আর সে মাসেই পর পর দু’বার অ্যাটাক হয়ে বাবা চলে গেলেন l


সেই থেকে রাকা মায়ের কাছে l ফোনে শাশুড়িকে বলে দিয়েছে, সে সেপারেশন চায় l ও বাড়িতে আর ফিরবে না l

একদিনের জন্যও রজত মাকে ফোন করে নি l বাবার কাজের সময় ও নাকি বিদেশে ট্যুরে ছিল l বাবা চলে যাওয়ার পর আস্তে আস্তে মাকে অনেকটা স্বাভাবিক করেছে রাকা l এমন সময় কানে এল অনেক কথা l যাকে সিঁড়ি করে রজত কোম্পানীর শিখরে পৌঁছতে চেয়েছিল, সেই মিস বিয়াস তাকে পথে বসিয়ে অন্যতম এম ডি মিঃ চৌধুরীর কাঁধে ঝুলে পড়েছেন l রজতের প্রমোশন তো হলই না, উল্টে মিস বিয়াসের তছরূপ করা অনেক টাকার দায় ওর ঘাড়ে পড়েছে l মোটা ফাইন দিয়ে চাকরি বাঁচিয়েছে রজত l


মা চা দিতে রাকা কাপ হাতে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল l এখন আর বৃষ্টি নেই l গাছের মাথাগুলো বৃষ্টি-ধোওয়া হয়ে বেশি সবুজ দেখাচ্ছে l সাধারণ স্কুলমাস্টারের আটপৌরে মেয়ে জীবনে খুব বেশি স্বপ্ন দেখেনি, শুধু মর্যাদা নিয়ে বাঁচতে চেয়েছিল l  সেই মর্যাদায় আঘাত l অভিমানী রাকার চোখ জলে ভরে গেল l ঝাপসা চোখ নিয়ে সে দেখল, একটা গাড়ি দাঁড়াল গেটের সামনে l রাকা দেখল রজত নামছে l ও তাড়াতাড়ি নিচে নেমে এল l এসিটা অন করে রজতকে বসার ঘরে বসাল l ওকে কেমন কাহিল দেখাচ্ছে l অফিস থেকে সোজা এসেছে l রাকাকে এক পলক দেখে রজত বলল, কেমন আছো?

—ভালো l রাকা মুখ নিচু করে হাতের বলাটায় একবার হাত বুলিয়ে নিল l তা হঠাৎ কী এমন জরুরি দরকার পড়ল?

—জরুরি তো বটে, দরকারও l

—যা বলার তাড়াতাড়ি বল l মাকে নিয়ে ডাক্তারবাবুর কাছে যাব l

—শুনেছ তো নিশ্চয়ই l সব ব্যাপার l

—হ্যাঁ, তোমার মা আমার মাকে ফোন করেছিল l

—আমি আমার ভুল বুঝতে পেরেছি l সরি, বাড়ি ফিরে চল রাকা l

—তা আর হয় না রজত l অনেকটা সময় চলে গেছে l আমি আবার নতুন করে সবকিছু ভাবতে শুরু করেছি l তোমার মানসিকতার সঙ্গে আমার কোন মিল নেই l তাছাড়া মা এখন একা, আমাকে মায়ের পাশে থাকতে হবে l

রাকা সোফা থেকে উঠে দেয়াল আলমারির কাছে গেল l পাল্লা খুলে কিছু পেপার্স  বের করে রজতের সামনে রাখল l
—আমি ল-ইয়ারকে দিয়ে আমাদের মিউচিউয়্যাল সেপারেশনের ডিড করিয়ে রেখেছি l সইও করে দিয়েছি l তুমি সই করে কোর্টে জমা দিলেই হবে l আমার কোন ক্লেম নেই l তুমি তোমার মনের মত একজন গতিশীল অ্যাম্বিশাসী আধুনিকাকে বিয়ে কর l

—তা হয় না রাকা, প্লিজ ফিরে চল l

—কোন ভাবেই আমার সিদ্ধান্ত বদলাবে না l
—তুমি তাহলে তোমার জীবন থেকে আমাকে ডিলিট করে দিচ্ছ?

—হয়তো তাই l ইনবক্স ভরে গেলে লোক তো তাই করে l

টেবিল থেকে পেপার্সগুলো নিয়ে ঝড়ের বেগে ঘর থেকে  বেরিয়ে গেল রজত l ওর গাড়ি বের হবার শব্দ কানে যেতেই রাকা আকুল হয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ল l আজ সত্যি সে তার জীবন থেকে একটা অধ্যায়কে ডিলিট করে দিল l

                             

সুদীপ ঘোষালের গল্প




পারিজাতের কুটির


 সন্ধ্যার দিকে একটা  লোকাল ট্রেনে সুবোধ আর অপর্ণা রোজ  বাড়ি ফেরে।  স্কুল এক না হলেও কাছাকাছি।স্টেশন থেকে দূরত্ব অনেকটা। তাই অর্পিতা একা আসতে সাহস পায় না। মোবাইলে জেনে নেয় সুবোধের খবরাখবর। তবে সুবোধ কাজ থাকলে আগেই জানিয়ে দেয়। আজ যথারীতি দুজনেই স্কুলে এসেছিলো। এখন ফেরার পালা।

ট্রেন চলছে। ফাঁকা সিটগুলো মন খারাপের  সুরে চলছে। লোকজন খুব কম। অর্পিতা বললো,কি রে আজকে লোকজন কম কেন?  কোনো পুজো পরব     আছে না কি? সুবোধ বললো, না তো। জানা নেই।
অন্যদিন দুজনেই মোবাইলে ব্যস্ত থাকে। কিন্তু আজ ব্যাপারটা অন্যরকম। দূরে বসে আছে চারটে লোক। বেশ ফিসফিসিয়ে কথা বলছে। সাধারণত এত আস্তে কথা  কেউ বলে না।

অর্পিতার থার্ড আই সচেতন হলো। বললো,বুঝলি পরের স্টেশনে নেমে আমরা অন্য কামরায় বসবো।কিন্তু বিধি বাম। ট্রেনটা হঠাৎ মাঝ মাঠে থেমে গেলো। এখনও এক ঘন্টা লাগবে।

এতদূরে স্কুল। এবার দুজনেই আবেদন করেছে সরকারের কাছে। বাড়ির কাছে এলে সমস্যা মিটে যাবে  । 

ট্রেনটা থমকে দাঁড়িয়ে আছে।অর্পিতার মনে হলো, কতযুগ ধরে এখানে অন্ধকারে তারা আছে। সময় কাটতে চাইছে না। ঝিঁ ঝিঁ পোকাগুলো আলো ছড়ানো শুরু করেছে। কোন এক রূপকথার জগতে হারিয়ে যায় মন।

হঠাৎ সুবোধের আর্তনাদে সম্বিত ফিরে  এলো  অর্পিতার। লোক দুজন সুবোধকে ধরে এক ঠেলায় ফেলে দিলো আর দুজন অর্পিতাকে বেঁধে একটা বোরখার মত পোশাক পরিয়ে দিলো। এখন অর্পিতার কিছু করার নে। চারজন তাকে ঘিরে রেখেছে বাঁধা অবস্থায়।

প্রায় দশ মিনিট পরে ট্রেন ছেড়ে দিলো। সুবোধ পরে থাকলো আহত অবস্থায় জঙ্গলের মধ্যে।অর্পিতা ভাবে,এই রাতের অন্ধকারে সুবোধ বাড়ি ফিরে যেতে পারবে তো?

অর্পিতা   ভাবে সে কোথায় যাবে  । চাকরির কি হবে,?     এরা কি করতে চায় আমাকে নিয়ে। কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। এখনও অবধি এরা কেউ দেহের গুপ্ত স্থানে হাত দেয় নি। কথাবার্তা  বেশি শোনা যাচ্ছে না। অভ, ইতর স্বভাবের নয়। তাহলে এদের উদ্দেশ্য কি?

এইসব চিন্তা করতে করতে হয়ত কোনো ওষুধের প্রতিক্রিয়ায় ঘুমিয়ে পড়েছিলো অর্পিতা।

যখন ঘুম ভাঙলো তখন সে শুয়ে আছে জঙ্গলের মাঝে উঁচু একটা মাচানে। খড়,বিচুলি দিয়ে পাতা বিছানা। মাচানের মাথায়   হোগলা পাতার ছাউনি। চারিদকে বন, জঙ্গলে ঘেরা। সামনেইনএকটা ডোবা রয়েছে।

এখন অর্পিতার হাত মুখ বাঁধা নেই।মুক্ত স্বাধীন। বেশ একটা ভয় ভয় ভাব। কিন্তু সামনে কোনো পুরুষ    নেই। একটা দেহাতি মহিলা এলো। ভাঙ্গা বাংলায় কথা বললো।সে বললো,দিদি আপনি একোন হামাদের নজরবন্দি হুয়ে আছেন। পালাতে চেষ্টা কোরবেন না। বাঘ, ভাল্লুক আছে। ছিঁড়ে খেয়ে লিবে। এখন ইখানেই আপনার জিন্দেগি    কাটবে। 

অর্পিতা বললো,তোমার নাম কি?

মহিলাটি বললো,আমিও আপনার মত এখানে এয়েছি।কিন্তুক এরা লোক ভালো। নিজের কাজ লিয়ে ব্যস্ত থাকে। আমার নাম মঙ্গলি বাঈ।আমাকে সবাই মা বলে ডাকে।

অর্পিতা স্কুলে থাকতে মাঝে মাঝে ভাবতো, একটা জঙ্গলে একবার হারিয়ে গিয়ে দেখবে কেমন লাগে? একঘেয়ে জীবনে আনন্দ নেই। বিধাতা তাই হয়তো সেই সুযোগ দিয়েছে।

অর্পিতা ভাবলো হা পিত্যেশ   করে লাভ নেই। এরা কি চায় দেখা যাক। মরার আগে ভূত হয়ে লাভ নেই।

রাতে মা খাবার দিলো আর অর্পিতার কাছে শুয়ে পড়লো। ভোরবেলা থেকে পাখির আওয়াজে ঘুম ভেঙ্গে গেলো। মা সব ঘুরে ঘুরে অর্পিতাকে চিনিয়ে দিলো। অর্পিতা চালাকি করার চেষ্টা করলো না। দেখলো চারদিকে বিপদের হাতছানি। সাপ,কাঁকড়াবিছে, জোঁক কিছুরই অভাব নেই। তারপর বাঘ,শিয়াল,হায়েনা তো আছেই। শিক্ষিতা আধুনিক মেয়ে সে। বুঝতে পারলো সে এক ভীষণ শক্ত জালে বন্দি।                       
একদিন দুপুরের সময় আলোচনা সভায় নেতাদের আবির্ভাব হলো। এবার প্রথমে দলের ব য়স্ক   লোকটি বললো,মা তুমার ইখানে কোনো মানহানি হুয়েছে কি?

অর্পিতা নির্ভয়ে বললো, আমি এখন কোথায় আছি জানতে চাই। আর আপনাদের উদ্দেশ্য কি?  আমাকে আপনাদের কি প্রয়োজন।

বৃদ্ধ লোকটি বললো,তুমার অবস্থান আমরা বলবেক লাই।    আমরা না খেয়ে মরবো কেনে?  তার প্রতিকার চাই। আর তুমাকে আমরা আমাদের ছেলে মেয়েদের শিক্ষা দিবার লেগে এনেছি। তুমি শিখাই পড়াই দিবে। আমরা জানি তুমি ইস্কুলের মষ্টার। তাই তুকে তুলেছি। সারা দেশের নানা জায়গার লোক ইখানে আছে। আমরা মেয়ে মাষ্টার চাই।পুরুষ মানহষ এসে ইখানে মা বোনের ইজ্জত লিয়ে মরে। তুদের সভ্য জগতের পুরুষগুলাকে আমরা না পসন্দ করি।
আমি বিশি কুতা বলবেক লাই। তু কাজ শুরু কর। আমরা ডাকাতি করেখাবার লিয়ে আসি।

অর্পিতা দেখলো কোনো পথ নাই। হাতে এদের অস্ত্র। কি করে পায় এরা জানি না। পেটে ভাত নাই আর যুদ্ধের শখ। জন্ম থেকে এরা এই শিক্ষা পায়। সরকার তো চেষ্টা করে। কিন্তু একদিন কি আলো ফুটবে না এদের চোখে। অর্পিতা এদের মায়ায় পরে যায়। মনটা কেঁদে ওঠে আর জেদ চেপে যায়, করবো অথবা মরবো।

আলোচনা শেষে অর্পিতা মেয়েদের নিয়ে আলাদা করে বসলো। সে বললো,আমরা লেখাপড়া শেখার পাশাকাশি কাজ করবো।

মিনা বললো,কি কাজ রে দিদি।
অর্পিতা বললো,চাষ করবো। আমরা ফসল ফলাবো জঙ্গলের বুকে। তোরা আমার সাথ দিবি তো?

সব মেয়েরা সমস্বরে বললো, হুঁ দিবো। লিশ্চয় দিবো।

এইসব      ছেলে মেয়েরা    খাটতে জানে। কাজ করে খেতে জানে। শুধু এদের পরিচালনা করতে হবে সঠিকভাবে।

পরের দিন থেকে শুরু হয়ে গেলো অর্পিতার কাজ। সকালে পড়ানো। তারপর কাজ আর কাজ। মাঝে রান্নাবান্না করে একসাথে খাওয়া। এখানে বহুদূরে এক একটি গ্রাম আছে। তাদের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যম পায়ে হাঁটা জঙ্গলের সরু পথ। একটা নদীর ধারে জলপ্রপাত। জঙ্গল কবিতাময় মাকড়সাজাল। পথ হারালেই   বিপদ। বাঘ এখানে সহজে আসে না। তবে খট্টাস, খরগোশ  , বেজি,সাপ, শেয়াল দেখা যায় সবসময়। সবথেকে ভয়ংকর হলো হায়না। দলবেঁধে ঘোরে। একটা গোটা গরু     খেতে সময় লাগে কুড়ি মিনিট। কত মানুষ এদের খপ্পরে পড়ে প্রাণ হারিয়েছে।

আজ বাইশ মাইল দূরে একটা মালগাড়ি ট্রেন ছিনতাই করতে গিয়ে ধংলুর ডান পায়ে গুলি লেগেছে।

তবে ওরা বিভিন্ন শস্যের বীজ, ফসলের বীজ আর প্রচুর চালভর্তি বস্তা    ডাকাতি করেছে। অর্পিতার ভালো লাগলো না। সে বললো,আমার মত যদি নাও আজ থেকে চুরি বন্ধ করো।

----আমরা খাবো কি?
একজন প্রশ্ন করলো।
অর্পিতা বললো,আমরা নিজেরাই জঙ্গল কেটে বা পুড়িয়ে জমি তৈরি করবো ফসল   ফলাবো তোমাদের আনা এই বীজ দিয়ে।

একজন বললো,অত সোজা লয় রে। সোজা হাতে গুড় উঠবে না বাপ।
অর্পিতা জানে বাধা  আসবে। তবু সে এগিয়ে যাওয়ার জেদে অটল রইলো।
মঙ্গলী বাঈ অর্পিতাকে ভালো যত্ন করেন। বলেন, তু আমার বিটি। তুর কোনো অসুবিধা হতে দিবক লাই।
অর্পিতা দেখলো এদের পাঁচমিশালী ভাষা। কিছুটা হিন্দি কিছুটা সাঁওতালি আবার অনেকটা বাংলার মত।     

শুরু হয়ে গেলো চাষ। জলের অভাব নেই। জঙ্গল কেটে পুড়িয়ে বাড়তে থাকলো চাষযোগ্য জমি। মাটির বুকে ফসলের ঘুম, মনকে নাড়া দিলো অর্পিতার ভাবনা।

অন্ধকারে একটা বিশাল হায়েনা একটা ছেলের পা চিবোতে থাকে। তার চিৎকারে লোকের গোলমালে হায়েনাটা পালিয়ে যায়। এরা চুরি করে খড় এনেছে। সবার হাতে এক একটা জ্বলন্ত খড়ের আঁটি।আগুনের ভয়ে সব হায়েনা পালিয়ে গেলো।

অবধারিত মরণের হাত থেকে বেঁচে গেলো ছেলেটা কিন্তু পা টা তার অকেজো হয়ে গেলো। ছেলেটা সুস্থ হওয়ার পর থেকে পড়াশোনার প্রতি মন দিলো। আর দিদির স্নেহে সে বড় হতে লাগলো।

অর্পিতা তাদের সঙ্গে ছয়মাস হলো আছে। তাদের সংস্কার, ভাষা,অভ্যাস,বিশ্বাস ধীরে ধীরে জেনে গেলো। অর্পিতা তাদের মধ্যে জাগাতে থাকলো নতুনকে জানবার আগ্রহ, শান্তির বাণির সুস্থ ভাবধারা, অসির চেয়ে মসি বড়োর ধারণা আর মানুষকে বুঝবার ইচ্ছাশক্তি।   

স্বদেশে ফেরার লোভ বা মোহ যে একেবারেই ছিলো না তা নয়। অর্পিতা চাইলো এদের সঙ্গেই নিজের ভবিষ্যৎ জড়াতে।

কষ্টসাধ্য জীবন ও কর্মে অটল থেকে বন্য জীবনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে থাকলো তার জীবন। তৃষ্ণার জলের জন্য বালি খুঁড়ে জল জোগাড় করতো তারা। নানারকম ফল পাওয়া যায়  এই জঙ্গলে।

অর্পিতা  দেখতো এখানকার অধিবাসীরা  কোনো বিশেষ প্রাকৃতিক দৃশ্যের তোয়াক্কা করতো না। তার এখানকার পরিবেশে থেকেই বড়ো হয়েছে। কিন্তু অর্পিতা জঙ্গলের মধ্যে সুর খুঁজে পেতো। ছন্দে বিভোর হয়ে যায় তার মন। গানের সঙ্গে পাখির ডাক মিশে যেত।রঙিন মেঘ, সবুজ বনানি     , জলকণিকার স্নেহলিপি একাকার হয়ে পারিজাত কাননের ছবি আঁকতো তার মন। নদীর দুই তীরে কাশের কারসাজি লতা বিতান ও বিচিত্র সুগন্ধি ফুলের শোভায় তার মনপ্রাণ আচ্ছন্ন হয়ে থাকতো।

একটা ছোটো সুন্দর পারিজাতের বাগান অর্পিতার মনে ছবি হয়ে ধরা দিতো। পারিজাতের খেলাঘর বিধাতা তাকে দিয়েছেন। সে এতেই সুখী হতে চায়।     

অর্পিতার মনে বর্ষাকালীন ছবি এক অন্য ধারণা আনে। ভিজে ভিজে চারদিকের শীতল হাওয়া জলে ডোবা তার উপর খাদ্য দুস্প্রাপ্য। চাষ হলেও খাদ্য যথেষ্ট নয়। তার জন্য এক এক দিন একবার মাত্র খাওয়া হয়। সকলে অর্পিতাকে ভালোবাসেন। তার যত্ন করার চেষ্টা করে।বাঁশ আর বাখারি দিয়ে খাট বানিয়ে দেয়।

অর্পিতার ভালো লাগে, কেউ আর মালগাড়িতে ওয়াগন ব্রেকিং করে না। তারা বলে, একটা শহরের শিক্ষিতা    মেয়ে যদি খেটে খেতে পারে তাহলে আমরা পারবো না কেন?  তারা তাদের মূলধন বীজধান বা বীজগম সব খেয়ে নেয় না। ফলমূল খেয়ে বাঁচিয়ে রাখে মূলধন। এখন আর কেউ পুলিশের গুলিতে মারা যায় না। ছয় বছর হয়ে গেলো অর্পিতার জঙ্গলে । একদিনের জন্যও তার অপমানিত হয় নি। সভ্য সমাজের চেয়ে অনেক বেশি  বিবেকের কাছে তারা পরিষ্কার। মানুষের কল্যাণের কাজে লাগতে পেরে অর্পিতা অনেক বেশি খুশি। হয়তো এই ছয় বছরে তার বিয়ে হত একটা বা দুটি সন্তান হত। কিন্তু তা শুধু আত্মীয়দের ভালোলাগার জন্য।আর এখানে তার পুরো আকাশটাই নিজের নীল সংসার। সবাই সকলের জন্য। একের আনন্দে বহুর     সমাবেশ। এটাই তো মানুষের চিরন্তন সুর। মহতের বাণী।     কিন্তু অর্পিতা ভাবে যে বাবা মায়ের কাছ থেকে এই পৃথিবীর আলো দেখার সৌভাগ্য লাভ করেছে সেই বাবা মা কে কি ভুলে থাকা যায়। যদি আমাকে এরা হত্যা করতো তাহলে কি এইসব ভাবার সুযোগ পেতাম।ফিরে আসতে পারতাম স্বর্গের পারিজাতের কুটির ছেড়ে?  হয়ত পাড়ার লোক, বাবা,মা, সুবোধ ভাবছে আমি মরে গেছি। এতদিনে হয়তো ওরা শোক সামলে জীবনের নাটকে মত্ত। কি হবে এসব ভেবে। সে ভাবে, কোনো ক্ষতি নেই দু একজন যদি পরিচত সমাজ ছেড়ে সভ্যতার স্রোতের বিপরীতে ছোটে।           

অর্পিতা দেখেছে এখানকার শিশুদের অধিকাংশ ক্যালশিয়ামের অভাব,ফ্লুরোরাইডের বিষক্রিয়ায় দেহ শীর্ণ , ভিটামিন সি এর অভাবে নানারকমের রোগ হয়। এই জঙ্গলে হরেক ওষুধের গাছ আছে। যেমন শিউলি,কালমেঘ, থানকুনির পাতা, কুলেখাঁড়া, কলমি শাক আরও নানারকম শাক। নদীতে পানিফলের মত একরকমের ফল,শালুক, পদ্ম তো আছেই। এইসব সবুজের উপকার বুঝিয়ে বলে জঙ্গলের ছেলেমেয়েরা অনেক সুস্থ। তার সঙ্গে যোগাসন। অর্পিতাকে এইজন্যই ধরে আনা হয়েছে শহর থেকে। এদের সর্দার জানে শিক্ষিত হৃদয়বান মানুষ ছাড়া এখানকার উন্নয়ন অসম্ভব। তার জন্য তারা অপরাধ করতেও পিছুপা হয় না। তবে নিরন্ন অশিক্ষিত মানুষের সেবায় নিজেকে লাগাতে পেরে অর্পিতা আজ গর্বিত।

মিনা সবসময় অর্পিতার সঙ্গে সঙ্গে থাকে। সে অর্পিতার সঙ্গে ওঠে, বসে,শোয়, খায়। লেখাপড়া শিখেছে তার কাছে। এখন ছোটোখাটো শিশুদের পড়ানোর ভার নিয়েছে মিনা। মিনা চাষবাস দেখাশুনা করে। সকালে শিশুদের আসন করায়। ছোলা বাদাম খেতে দেয়। বন মুরগী আর বুনো হাঁসের ডিম ছেলেরা সকালবেলা নদীর ধারে জোগাড় করে। তারপর সিদ্ধ করে খায়। অর্পিতা তাদের বলতো তোরা একটাও পাখি মারবি না। ওদের ডিমও খাবি না। শুধু শাকসব্জী খেয়েই তো হাতির অত বড় শরীর।
কেউ কেউ লুকিয়ে চুরিয়ে ডিম খেতো। কিন্তু সংখ্যাটা কমে গেছে অনেক।

এখন তীর হাতে শিকারে যায় না তারা। মাঠে ফসল ফলায়। আর প্রয়োজনে বুনোমোষ পোষ মানিয়ে চাষ করায় আর গাভী মোষের দুধ খায়। কিন্তু জঙ্গলের একটা অংশে সে নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে কিছু মানুষের ভুল জীবনপ্রণালী। তার জন্য সে    নিজের  বাড়িতে বাবার কাছে শেখা সমস্ত বিদ্যা সে ঢেলে উজাড় করে দিয়েছিলো ভালোবাসার জঙ্গলের শিশুদের জন্য।      সমগ্র অংশের তো পারি নি। অর্পিতা ভাবে, কোনো মানুষের একার পক্ষে তা সম্ভব  নয়। একটা জিনিস সে করতে পেরেছে জঙ্গলকে ভালোবাসতে শিখিয়েছে তার কাছে থাকা শিশুগুলিকে। কেউ এখন তাকে ছাড়তে চায় না।

এবার পুলিশ প্রশাসন হয়ত জানতে পেরেছে কোনো এক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা নজরবন্দী হয়ে এই জঙ্গলে আছে। তারা এটাকে উগ্রপন্থীদের চক্রান্ত বলে সন্দেহ করে, তল্লাশি চালায় এখন রোজ। কিন্ত অর্পিতা আর এই জঙ্গল ছেড়ে যেতে চায় না। তার সামনে পাঁচজন বৃদ্ধ মারা গেছেন অসুখে।

এখনও অনেক বুড়ো বুড়ি আছে। তাদের আর সেই শক্তি নেই। এখন তারা ভালোভাবে বাঁচতে চায়। তাদের ইচ্ছার কথা অর্পিতা প্রশাসনকে জানাবে। আর একটা মানুষও যেন ভুল বেঝাবুঝির শিকার না হয়। সে বিধাতাকে ডাকে তাদের সাহায্য করার জন্য।

একদিন সকালে মিনা তার ছোট্ট কুটির ঘরে অর্পিতাকে নিয়ে গেলো। পারিজাতের কুটিরে মিনার মা, বাবা আছেন। অর্পিতাকে দেখে দেবির মত লাগছে। তার কাছে এসে পায়ে হাত দিতে গেলো। অর্পিতা বললো,আপনারা আমার চেয়ে বড়ো। আপনারাই আমার ভগবান,বিধাতা যা বলেন। সেখানে অর্পিতা নারকেল কোড়া খেলো তাদের খুশির জন্য।মিনার বাবা বললেন,সারা জঙ্গলে ঘরে ঘরে তুয়ার মত বিটি চাই। তবেই জঙ্গলের লোক বুঝবে নিজের ভাগ্য অন্য কেউ গড়ে দেয় না। পরিশ্রম করলে না খেয়ে পরাণটা যায় না।
অর্পিতা বললো,তোমার মেয়ে মিনা আবার দশটা মিনা তৈরি করবে। এইভাবে ছড়িয়ে পড়বে নব আগুনের ঢেউ। সেই আগুনে পবিত্র হবে মানুষের অন্তর। আলো ছড়িয়ে যাবে পারিজাতের কুটিরে কুটিরে  । জেগে উঠবে নতুন ভোর।

তারপর মিনাকে নিয় সে চলে এলো জঙ্গলে। একটা ছোটো  পাইথন,     জড়িয়ে ধরেছে অর্পিতাকে। মিনা চপ করে মুখটা চেপে ধরলো সাপটার তারপর পাকিয়ে খুলে ফেললো সাপের প্যাঁচ। সাপটা ছেড়ে দিলো নদীর ওপাড়ে গভীর জঙ্গলে। অর্পিতা দেখলো পুরোপুরি তৈরি মিনা। জীবন যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত তার মন।

অর্পিতা    বললো,পুলিশ আমাকে খুঁজছে। হয়ত আমাকে নিয়ে গিয়ে বাড়িতে দিয়ে আসবে। আমি না থাকলেও জঙ্গলের প্রাণ তোকে জাগাতে হবে। আরও শত শত মিনার প্রয়োজন এই জঙ্গলের।

মিনা বললো,আমার মনে থাকবে দিদি। আমি চেষ্টা করে যাবো আজীবন।

আজ ভোরে উঠই অর্পিতা দেখে পুলিশের জিপ হাজির। কাউকে না বলে সে জঙ্গলের অন্য আর একটা গ্রামের দিকে ছুট লাগালো। সে স্থির করে ফেললো আরও গ্রামে আমি  আলো জ্বালবো  । সে ছুটতে ছুটতে চলে গেলো আর একটি গ্রামে।

অর্পিতা একটু বিশ্রাম নিলো। তারপর ভাবতে   শুরু করলো কি করে অচেনা  গ্রামের লোক আমাকে চিনবে। জঙ্গলকে আমি চিনি কিন্তু নতুন অশিক্ষিত মানুষের কাছে আবার তার পরিচয় নতুন করে শুরু করতে হবে। নদীর ধার বরাবর দু চার মাইল দূরে এক একটা গ্রাম।সেই ধার বরাবর গিয়েএকটা বাড়িতে সে আশ্রয় নিলো। একজন বয়স্ক মহিলাকে   অর্পিতা বললো,আমি রাস্তা হারিয়ে এখানে এসেছি।যদি দয়া করে একরাত কাটাতে দেন আমি খুব উপকৃত হবো।

মহিলাটি বললেন,অতশত বুজি না বুইলি। তু একরাত থাকবি থাক।  এখন জল খা।

অর্পিতা আশ্বস্ত হলো। এখানেই থাকা যাবে। সে তালপাতার কুটিরে    ঢুকে শুয়ে পড়লো। ধীরে ধীরে রাত নেমে এলো। সবাই ঘুমিয়ে আছে। আর অর্পিতা ভাবছে বাড়ির কথা। সুবোধের কথা। এতদিনে বাবা মা হয়তো আমার আশা ছেড়ে দিয়েছে। সুবোধের ছেলেপিলে হয়েছে।  কিন্তু এসবের জন্যই কি মানুষের জন্ম। কোনো দায়িত্ব নেই জগতের কাজে, মানুষের কাছে। শুধুইএকটা স্বার্থপর গোলোকে নিজেকে শেষ করা। এই কি জীবনের ধর্ম। কি জানি আমি জানি না। অর্পিতা ভাবছে ছোটোবেলার কথা। কত কষ্টে মা তাকে বড়   করেছে,তার কথা।                                           

আমার নাম, ব্যবহার সকলেই পছন্দ করে বলে মনে হয় না । ছোটোবেলা থেকেই বন্ধুবান্ধব সকলেই আমাকে এড়িয়ে চলে।সংসারে আমাকে সকলে একটু অন্য চোখে দেখে। মাসি বলেন,ওকে আগে খাইয়ে দে দিদি, তারপর অন্যকথা।মায়ের মুখে শুনেছি শৈশবে আমি খুব কাঁদুনে স্বভাবের ছিলাম।কেউ কোলে নিয়ে আদর করতে চাইলে আমি প্রাণপণে মাটিতে গড়াগড়ি দিতাম। তারপর কোথাও বেড়াতে গেলে আমার কান্না আরও তীব্র হতো।এরপর বড় হতে লাগলাম।স্কুলে ভরতি হতে গিয়ে প্রথম বছর ভরতি হতে পারলাম না। পরের বছরে ক্লাস ওয়ানে ভরতি হলাম। পড়াশুনায় ভালো ছিলাম। পড়াশুনা ভালোই চলছিলো। তারপর হঠাৎ আমাদের সংসারের মেরুদন্ড প্রিয় কাকাবাবু মরে গেলেন। বাবা চাকরী ছেড়ে জমিজমা, বাড়িঘর দেখার জন্য চলে এলেন আমাদের জন্মভূমি গ্রামের বাড়িতে। বড়দা,মেজদা চাকরী পেলেন বাবার অফিসে।বেশ চলছিলো সুখের সংসার। আমার পড়াশুনা শুরু হলো গ্রামের পরিবেশে।আবার নতুন পরিবেশ, নতুন বন্ধু। সবকিছু নতুন। আমার সকলের সঙ্গে মানিয়ে নিতে সময় লেগেছিলো
কিন্তু যারা এতদিন বন্ধু হয়ে একসাথে খেলাধূলা করে তারা কি সহজে নতুন কাউকে পাত্তা দেয়। তবু তাদের সঙ্গে মেশার চেষ্টা করে গেলাম অনবরত। সকলে গ্রহণ করলো না। কোনোরকমে সময় কাটাতাম। তারপর বি,এস,সি পড়ার জন্য হাওড়া চলে এলাম। ক্লাস সেভেনে পড়তে পড়তে চলে গেছিলাম গ্রামে। আবার চলে এলাম শহরে। অনেকের মনে আছে
অনেকের মনে নেই। তবু সবাইকে পরিচয় দিয়ে মিলেমিশে থাকার চেষ্টা করলাম।

মনে পড়ে আমার মধু মাসিকে। ফুটপাতের পাতানো মাসি। আমি বলতাম, মাদার টেরেসা। তার জীবন সংগ্রাম আমি চোখে দেখেছি কিছুটা। মনে পড়ছে সেই মাসির কথা।  মধু মাসি বলেছিলেন তার জীবনের সংগ্রামের কথা।  মাসি ফুটপাতের এক কোণে কোনোরকমে থাকত। তার কোনো ছেলেমেয়ে নেই।একদিন ফুটপাতে কুড়িয়ে পেলো একটা শিশুকে।তাকে ভগবানের দান মনে করে মানুষ করতে লাগলো।তারপর মাসি আরও চারজন অনাথ শিশুর খোঁজ পেলো। মাসি ভিখারী হতে পারে কিন্তু তার পড়াশোনার যোগ্যতা, বুদ্ধি ভালোই ছিলো। শিক্ষিতা রুচিশীল মাসি কি করে ভিখারী    হলো, সে ঘটনা পুরো বলতে গেলে ইতিহাস হয়ে যাবে। যাইহোক স্বাধীনচেতা মাসি স্বামীর ঘর ছেড়ে ফুটপাতে আশ্রয় নিয়েছিলো বাধ্য হয়ে। মাসি এবার পাঁচ শিশুকে নিয়ে সরকারী অফিসে হানা দিতে শুরু করলো। একদিন এক সরকারী আধিকারিক বললেন,মাসি আপনার কোনো পরিচিতি   নেই।আপনার অনাথ আশ্রমের কোনো জমি নেই। কি করে আপনি অনাথ আশ্রয় গড়ে তুলবেন।আপনার অর্থবল,জনবল কিছুই নেই।মাসি বললো,কিন্তু আমার একটা জিনিস আছে, তা হলো ইচ্ছাশক্তি। আমি আশ্রম গড়ে তুলবোই।আপনি দেখে নেবেন। আমার সে মনবল আছে।

পাঁচ শিশুকে নিয়ে মাসির পথ চলা শুরু হলো। তিনি ভিক্ষা করে অই শিশুদের পরিচর্যার ব্যবস্থা করলেন।পাঁচ শিশুকে দেখে একদিন অমরবাবুর মায়া হলো। তিনি মাসিকে বললেন, আপনার শিশুদের থাকার জন্য আমি ঘর তৈরি করে দেবো। আমি জায়গা দেবো। আমার যতটা সাহায্য করা প্রয়োজন আমি করবো। আইনের ঝামেলা আমি দেখাশোনা করবো।
মাসি জোড় হাতে অমরবাবুকে নমস্কার জানালো। কেতুগ্রামের ফাঁকা জমিতে ঘর তৈরি হলো প্রথমে দুটি। তারপর শুরু হলো মাসির বিজয় যাত্রা। তারপর সমাজের বিভিন্ন  স্তরের মানুষের কাছ থেকে সাহায্য আসতে লাগলো। তৈরি হতে লাগলো আরও ঘর। বাউন্ডারি হলো। আর অনাথ শিশুর সংখ্যা বাড়তে থাকলো। প্রথমে শুকনো কাঠ কুড়িয়ে রান্না করা মাসি আজ গ্যাস ওভেনে রান্না করে নিজের শিশুদের জন্য।মাসিকে আর পিছন ফিরে তাকাতে হয় নি। কিন্তু বাদ সাধলো আর এক বিপদ। একদিন আশ্রম থেকে তিনটি শিশু চুরি হয়ে গেলো। মাসি পাগলের মত খুঁজতে শুরু করলেন শিশুদের। এক রাখালের কাছে খবর পেলেন, এক পাষন্ড তিন শিশুকে হাত পা বেঁধে রেখেছে চিলেকোঠার ঘরে। রাখালকে নিয়ে মাসি থানায় গেলেন। পুলিশের সাহায্যে ধরা পড়লো বিরাট শিশু পাচারকারী দল।রাখাল অই মালিকের কাছেই কাজ করতো। তিনজন শিশুকে কাঁদতে দেখে রাখালের সন্দেহ হয়। তারপর মাসি জিজ্ঞেস করাতে সব ছবি পরিষ্কার হয়ে যায়।রাখালকে মাসি অনাথ আশ্রমের এক অনুষ্ঠানে পুরস্কৃত করলেন।

এইভাবে মাসি এলাকার মানুষের কাছে মা বলে পরিচিত হলেন। তিনি এবার আর একটি আশ্রম গড়ে তুললেন শালারে। এইভাবে মাসির পাঁচ পাঁচটা আশ্রম চলছে সুন্দর পরিবেশে মানুষের সহায়তায়।   

অর্পিতার বাবা খুব দয়ালু লোক ছিলেন।তিনি একবার অর্পিতাকে বলছিলেন একটা অভিজ্ঞতার কথা। তিনি বলেছিলেন, একবার মহালয়ের সকালে আকাশের সাথে কাশফুলের রং ছড়ানো প্রতিযোগিতা চলছে ! এমন সময় শরতের মেঘ ঝরিয়ে দিলো রূপোলি বৃষ্টি।  চারদিকে মহা সমারোহ প্রকৃতির বুকে। পুজো আসছে কিনা।  তাই তাদের সময় নেই থমকে থাকার। পুজোর পাঁচটা দিন নদীর তীরে বসে থাকতে ভালোলাগে। কতকগুলো ঝুপড়ি বাসা জুড়ে অবহেলিত মানুষের বাস। পুজোর দিনে নগ্ন দেহমনে খিদের ছাপ। বসে আছি পুজোর প্রথম দিনে। আমার পরিধানে নতুন জামা দেখে আদুুল গায়ের দুটি শিশু কাশফুল চিবোচ্ছে আর অবাক চোখে নতুনের গন্ধ খুঁজছে জামার ভাঁজে ভাঁজে। আমার বমি আসছে। চিকেন পকোরা পেটের মধ্যে বিরোধ শুরু করেছে। হাল্কা হয়ে শিশু দুটিকে বসিয়ে গল্প শুরু করলাম।  দূর থেকে ঢাকের শব্দ ভেসে আসছে। শিশু দুটি মাথা দোলাচ্ছে। কাশ ফুলের গোড়া থেকে তখনও খাদ্যপ্রাণ শুষে নেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে দুজনেই।  থাকতে না পেরে বললাম, তোদের বাড়ি কোনটা?  চল আমাকে নিয়ে চল।
শিশু দুটির বাড়ি গিয়ে মাটির বারান্দায় বসলাম। তাদের মা বেরিয়ে এলো। গামছা জড়ানো গায়ে। কারণ শাড়িটি শতচ্ছিন্ন।  আমি বললাম, ওদের বাবা কোথায়? মুখে কথা না বলে ঈশারায় দেখিয়ে দিলো।  দেখলাম সকাল থেকে নেশা করে পরে থাকা মাতালের মতো ওর অবস্থা।  একবার মুখ তুলে দেখার ব্যর্থ চেষ্টা করে সে শুয়ে পরলো।  চোখে ঘুম নিয়ে ওদের জন্ম। না দেখাই ভালো।ওরা চোখ চেয়ে থাকলে বিপ্লব ঘটে যাবে রাতারাতি। ঘুম ওদের ভুলিয়ে রাখুক খিদের জ্বালা।
তারপর পাঁচশো টাকা দিয়ে মাকে বললাম, মা তুমি চাল ডাল মাছ এনে রান্না করো।  আমিও তোমাদের সাথে বসে খাবো।
আমার মা ডাকে গামছা দিয়ে চোখ মুছে সে দোকানের দিকে পা বাড়ালো।
পিছন থেকে আমি দেখলাম আমার দেশের মা তার শিশুদের আহারের ব্যবস্থা করার জন্য দৃপ্ত দুই পায়ে এগিয়ে চলেছে...


অর্পিতা মানুষ হয়েছে তার চেনা জগতে। ভোরের আজানের সঙ্গে সঙ্গেই তার বন্ধুর আম্মির মুখ দেখে শুরু হতো তার দিন। সারাদিন স্কুলে কাটতো ছেলেবেলার জগত।

 মনে পরে স্কুল থেকে এসেই ব্যাট হাতে বেরিয়ে পরতো ছেলে মেয়ে একসাথে ক্ষেত্রপালতলার মাঠে। খেলার থেকে গল্প হতো বেশি ৷ জাহাঙ্গীর,মতিউল্লাহ,সিরাজ,ইজাজুর,সামিম, সুদীপ্ত,বাবু,ভম্বল,বিশ্বরূপ,মিলু,অধির সব বন্ধুরা জড়ো হতো ক্রিকেট খেলবে বলে। খেলার শেষে বসে গল্প করতো। প্যান্ট না পরে ছেলেরা মাঠে না এলে   বকাবকি করতেন মিলুদা।পাজামা পরে খেলার অসুবিধা। বলতো,বিরাজুল। , বল লেগে একবার অজ্ঞান হয়ে গেছিলো এক বন্ধু। ধীরে ধীরে সকলের প্যান্ট পরে আসার অভ্যাস হয়ে গেলো। ম্যাচ খেলতে যেতাম অনেক জায়গায়। একবার বিল্বেশ্বর গ্রামের টিমকে হারিয়ে জিতেছিলাম এক হাঁড়ি রসগোল্লা। সুধীনবাবু ধরিয়ে দিলেন বিরাজুলের হাতে ক্যাপটেন হিসেবে। সবাই ভাগ করে খেলো। পুরস্কারের এই অভিনবত্বে অধুনা কানাডা বাসী মিলুদা খুব খুশি হয়েছিলেন। আমাকে কোনোদিন মেয়ে বলে মনে করে নি। বন্ধুর কোনো লিঙ্গভেদ করতো না তারা।    মাঠের বাইরে আমি তাদের বিজয়ের প্রার্থনা করতাম।
অর্পিতা ভাবছে তার ছাত্রী জীবনের কথা,
তখন ১৯৮০সাল। আমরা দশজন বিল্বেশ্বর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়েছিলাম। একটা রেকর্ড রেজাল্টে সবাই খুশি হয়েছিলেন সেবার। তারপর জীবন যুদ্ধে সবাই আলাদা হয়ে গেলো। কে যে কোথায় পড়তে গেলো কোনো খবর পেলাম না। কিন্তু পুরোনো অনেক ক্লাসমেটের সঙ্গে যখন দেখা হয়, মনে পরে যায় পুরোনো দিনের কথাগুলো।

,একবার স্কুল থেকে ছাত্রছাত্রীদ নিয়ে বেড়াতে গেছিলেন স্কুলের শিক্ষক মহিমবাবু। ঘুরে এসে অজয় নদীর ধারে যখন এলাম, তখন রাত্রি দশটা বেজে গেছে। নদীতে বর্ষার উদ্দাম গতি। কানায় কানায় ভর্তি জল। মহিমবাবু চিন্তায় পরে গেছেন, কি করে চল্লিশটা ছেলেমেয়ে নদী পার হবে। হঠাৎ আমরা অবাক হয়ে চেয়ে দেখলাম পাঁচজন সাহসী ছেলে হাফ প্যান্ট পরে খালি গায়ে লাফিয়ে পরলো জলে। আমরা সবাই হায় হায় করে উঠলাম ভয়ে। কিন্তু আমরা ভুলে গেছিলাম এই বাংলার দামাল ছেলেরা স্বাধীনতা কেড়ে নিয়েছিলো নিজের প্রাণের বিনিময়ে ওই লালমুখো বাঁদরদের কাছ থেকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখলাম, দুটো নৌকো নিয়ে তারা ছেলেদের নদী পার করছে। মহিমবাবু বললেন,মাঝিরা এলো না?  শ্যাম বললো,স্যার চিন্তা করবেন না। ওদের ঘুমের ব্যাঘাত না করে আমরা নৌকো নিয়ে এসেছি। ওরাও জানে শ্যাম থাকলে কোনো ভয় নেই।

মহিমবাবুর চোখে জল এসে গিয়েছিলো। দুহাত তুলে আশীর্বাদ করেছিলেন দামাল পাঁচ ছাত্রকে।

এই রকম খোলামেলা পরিবেশে মানুষ হয়েছিলো অর্পিতা। দানবীর খোলামেলা মানুষ অর্পিতার বাবা। তার রক্ত শিরায় শিরায় প্রবাহিত। হয়ত তার জন্যই অর্পিতা মানবসেবায়   ঝাঁপ দিতে চাইছে।

তা ভাবছে আর তৃতীয় নয়নে দেখছে, একদিকে হাসিখুশি জাঁকজমকের জীবন। একরাশ শিউলির হাতছানি। আর একদিকে কষ্ট, প্রবল বিপদের মত জীবন  নদীর স্রোত।  কোনটাকে বেছে নেওয়া উচিত অর্পিতার। সে বিবেকের কাছেই প্রশ্ন রাখছে। উত্তর দেবে আগামীদিনে  তার চলার পথ...