Wednesday, May 1

উওরবঙ্গের জনজাতি : সসীমকুমার বাড়ৈয়ের গল্প



কারানল


-মা ওরা এসেছে।
-কারা?
-মধুশিলা কাকারা।
-ঘরে আসছে না কেন? ডাক অদের।
-ঠিক আছে,, ডেকে আ-ন--তস্রায় যেতে যেতে থেমে গেল। পাঁজর কাঁপানো গুমগুম শব্দ করে একটি বাইক ক্রম আগুয়ান। বাইকটা এসে ঘরের  গা ঘেঁষে থামল।  সে বুঝল দাদা ফিরে এসেছে। মধুশিলাকে ডাকতে যাওয়ার তাড়া হারিয়ে সে বাবার মাথার দিকে চৌকির পাশে দাঁড়াল।

নির্মল ঘরে ডুকে চারদিকে চোখ বুলিয়ে বলল-মা, ফাদার আসবেন খানিক বাদেই। বাবার জন্য প্রার্থনা করবেন। জিনৌ, তুই  রৌন্তুক দেবদেবীর আসন পত্র সরিয়ে রাখ। কতবার বলেছি, আমাদের ঘরে যীশু বাদে আর কিছু থাকবে না। ফাদার এসব পছন্দ করেন না। তিনি এই জইন্য আমাদের বাড়ি আসতে চান না। বাবার অবস্থার কথা বলে কয়ে আজ রাজি করিয়েছি।

-আমরা ফাদারকে সম্মান করি। তোর বাবার জন্য প্রার্থনা করলে আমাদের ভালো লাগবে, কিন্তু আমাদের কোচদের দেবীকে সরানোর কী দরকার। খড়খড়ে গলায় তার মা হিরা রাভা বলল।
-মা, তোমরা অদিম বিশ্বাস থেকে কিছুতেই সরতে চাও না কেন। জঙ্গলি বিশ্বাস কি খাওয়ায় না পড়ায়? বাড়ি ঢোকার পথে দেখলাম মধুকাকা সঙের মতো দলবল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওরা অসুস্থ বাবার ঘরে আসর বসাবে নাকি?
-তোর বাবা মধুকে ডেকেছে।
-ওরা আবার কি করবে?
-মধুকাকা এলে তোর বাবা একটু শান্তি পায় রে বাপ। বৃদ্ধ মানুষটা এই আছে এই নাই। মানুষটার ইচ্ছা মিটাতে দে। মায়ের কথা শুনে নির্মলের মুখ ব্যাজার হয়ে গেল।

তস্রায় চট করে ঘরটা গুছিয়ে ফেলল। তাদের বাড়িটা অন্যদের বাড়ি থেকে অনেকটাই পরিস্কার পরিচ্ছন্ন, গুছানো। মাচার মতো পাটাতনের উপর দোতলা কাঠের বাড়ি। আগে খয়ের গাছের কাঠ দিয়েব বাড়ি বানানো হতো। বনবাসীদের বন্যপ্রাণী, বৃষ্টি বাদলের হাত থেকে রক্ষার প্রাচীন প্রচলিত পদ্ধতির ঘর। আজকাল কাঠের অভাবে কেউ কেউ ইটের বাড়ি বানাচ্ছে। কাঠ জোগাড় করা কঠিন, দামি। জঙ্গল নিঃশব্দে উজার হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু কাঠ বনবাসীদের অধরা। বনরক্ষীরা শ্যেণদৃষ্টিতে মাপে অদিবাসীদের গতিবিধি। পোষা কাঠচোর নিঃশব্দে সাবাড় করে দেয় জঙ্গল। রায়ডাকের স্রোতে সমতলে ভেসে যায় কাটা কাঠের গুড়ি। তারা বহুকষ্টে কাঠের বাড়িটা বাঁচিয়ে রেখেছে। বাকি দু’টো ঘরে দাদা-বৌদি আর ভাই থাকে। পাদ্রির জন্য বসার জায়গা থেকে অন্য সব কিছুতের তস্রায়ের হাতের জাদুতে পরিপাটি রূপ নিতে সময় লাগল না। সে অন্য ঘরে গিয়ে কাপড় চোপড় পালটে এলো। মেয়ের দিকে তাকিয়ে মায়ের চোখ আটকে গেল। ঊর্ধ্বাঙ্গে পড়েছে কাম্বাং আর  নিম্নাঙ্গে লৗফুন। উজ্জ্বল কোচ-রাভা পোশাকে মেয়েটাকে ফুল ফুলপরির মতো মনে হলো। মেয়েটা তার কাছে ফুলপরিই তো, মা-বাবাকে এতো চমৎকার বোঝে। তিন কিলোমিটার দূরে লোকনাথপুর ফ্রি প্রাইমারি স্কুলে সবার প্রিয় দিদিমণি সে। অনাদিবাসীরাও তাকে গুণগানে পঞ্চমুখ। চোখের সামনে হারিয়ে যাচ্ছে সব কিছুই আর মেয়েটা প্রাণপনে বাঁচাতে চায় হারানো সব। নিজের চেষ্টায় ‘কন্টং’ তাঁতে বুনতে শিখেছে  কাম্বাং-লৗফুন। তস্রায়ের পোশাক দেখে মায়ের মনে হল মেয়ে বিয়ের যোগ্য হয়েছে। নিজের পোশাক নিজেই বুনতে শিখে গেছে।  কিন্তু তাকে এই সাজে দেখে তড়াক করে  নির্মলের  মেজাজ বিগড়ে গেল-তস্রা, শাড়ি পরতে পারতিস না, এটা একটা ড্রেস হলো। সঙের মতো না সাজলে চলত না?
মা উত্তর দিল-তাঙি রামি কাপচা, বিয়ৌ সায়ি নাপচা। যে যুবতী কাপড় বুনতে পারে না, তাকে বিয়ের জন্য কেউ পছন্দ করে না। মেয়ে সমত্ত হয়েছে, এখন তো আমাদের পোশাকই পরবে। আমাদের কাপড়ে খারাপ লাগছে তোর জিনৌকে?
নির্মল কিছু বলল না কিন্তু তস্রায় বলল-দাদা, তুমি তো সার্ট প্যান্ট পরে আছো, আমি কিছু তো কিছু বলিনি। এ রাভা-পোশাক পরতে আমার ভালো লাগে। আদিবাসী পরিচয়ে আমার হীনমন্যতা নেই। আমরা কোচবিহারের রাজাদের কোচ বংশধর।

হিরা কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল তখনই ছোটছেলে সুরেন পাদ্রি লরেন্স প্রভাস কলিতাকে নিয়ে ঘরে ঢুকল। পাদ্রি কলিতা ষাটের দশকের শেষে আসাম থেকে এসেছিল। সেই থেকে বনবস্তিই তার বাড়িঘর। তখন জঙ্গলবস্তি ছিল ভয়ানক দুর্গম। ডুয়ার্সের অরণ্যবাসী ছোট ছোট আদিবাসী সম্প্রদায়ের চেনা জগতের সীমানা বনবাদাড় যেন খড়িরগণ্ডিতে ঘেরা। ঝিলটং, রায়ডাকবস্তি, ইন্দ্রবস্তি, আন্দুবস্তি, সরাকালচিনি, মেন্দাবাড়ির কোচদের  জীবন মরণ সবই জঙ্গল ঘিরে। বাইরের জগৎ একটু একটু করে খুলছিল মিশনারীদের হাত ধরে। পাদ্রি প্রভাস কালিতা রায়ডাকবস্তিতে একটি টালির ঘর বানিয়ে শুরু করেছিল যীশুর আশ্রম, এখন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ব্যাপটিষ্ট চার্চ। স্কুল, ছোটখাটো দাতব্য চিকিৎসালয়।

 বনবস্তির সর্বপ্রাণবাদী ধর্ম ছেড়ে অধিকাংশ কোচ –রাভারা বিভিন্ন চার্চের ছায়ায় যীশুর অনুসারী। রায়ডাক, ইন্দ্রেরবস্তি জুড়ে ভিন্নপন্থী মিশনের স্থাপনের প্রতিযোগিতা চলে আড়ালে আবডালে। সমতলের কোচ-রাভারা সর্বপ্রাণবাদ বিশ্বাসে অটল, কিন্তু ঢুকে পড়ছে হিন্দুয়ানী বৃত্তে। রায়ডাকের বয়স্ক মানুষের মনে ঝর্ণার মতো প্রায়সই কলকল করে ওঠে  সর্বপ্রাণ সত্তা। তস্রায় মিশনারী স্কুলে পড়লেও তার ভাল লাগে রাভা জনজাতির আলেক আচার।
ঘরটা চোখ ঘুরিয়ে দেখে নিল পাদ্রি।  তার মুখ গম্ভীর হয়ে গেল। চেয়ারে বসতে বসতে সে  নির্মল আর সুরেনকে উদ্দেশ্য করে বলল- মাই সন্স, ক্যান ইয়ু হেল্প মি?
সুরেন বলল-বলুন, ফাদার।
-তোমরা বাবাকে একটু উঠিয়ে বসিয়ে দাও।

হিরা আতঙ্কিত স্বরে বলে উঠল-না না, পুরো বসতে পারবে না। বসার ক্ষমতা নাই। মাথার দিকটা উঁচু করে দে তোরা।
আশি ঊর্ধ্ব বৗলাকে দুই ছেলে কোনোক্রমে উঠিয়ে ঠেস দিয়ে বসিয়ে দিল। তার বলিরেখায় ঝুলেছে কষ্ট। কষ্টের মধ্যেও দু’টি উজ্জ্বল চোখে পাদ্রির দিকে মিটমিট করে তাকাচ্ছে।

পাদ্রি বলল-বৌলা, ঈশ্বরের পুত্র যীশুর দয়ায় আপনি দীর্ঘ জীবন ভোগ করেছেন। আকাশ বাতাস, জল, সন্তান-সন্ততি সকলই তাঁর দান। মানুষ মাত্রেই পাপ করে। জীবনে যা কিছু অন্যায় করেছেন তা যীশুর কাছে স্বীকার করেন, ঈশ্বরের কারে প্রার্থনা করুন। ঈশ্বর আপনাকে বাকি জীবন কষ্টমুক্ত রাখবেন, স্বর্গে থাকবেন অনন্ত সুখে।

বৌলা বুঝতে পারল না সে জীবনে কী পাপ করেছে। বনবস্তিতে পরিবার প্রতি দুই একর করে জমি দিয়েছে সরকার। চাষবাস করেছে, বনবিভাগ ডাকলে বনের কাজ করেছে। পেটের প্রয়োজনে বা বায়খো উৎসবে শিকার করেছে জংলি শুয়োর, বনমোরগ বা ছোট হরিণ। তাও ত্রিশ চল্লিশ শিকার উৎসব প্রায় বন্ধ। তার পৃথিবীই বা কতটুকু? পাপের বোঝা খুঁজে না পেয়ে পাদ্রির মুখের দিকে খানিকক্ষণ ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল।
পাদ্রি তাগাদা দিল-কি হলো? কনফেস করো  বৗলা।

বৗলা ভাবল জঙ্গলে পশু শিকারই তাহলে পাপ। দোকান থেকে হাঁস মুরগি শুয়োরের মাংস কিনে খাওয়া পাপ নয়। সে দুর্বল গলায় বিড়বিড় করে বলল-আমরা পানীকোচ রাভা আদিবাসী মানুষ, দুর্গম জঙ্গলবাসী। খিদা আর আনন্দ-ফুর্তি বাদে আমাদের জীবনে কিছু ছিল না।

সিঙ্গারাবুড়ার পার্বণে সাগর-মাইচক  শিকার করছি জঙ্গলে, মাছ ধরছি রায়ডাক নদীতে, ঝর্ণায়। গাছ কাটছি রান্নার লাকড়ির জন্য, বাড়ি বানাইতে। সবার প্রাণ আছে। না বুঝে এতগুলা জীবন মারয়্যা মনে হয় পাপ করছি। ঋষিবায়, যীশু ভগবান, রৗন্তুক মা, মা তামায়,  আমারে ক্ষমা করে দাও। ঘরে রাখা রৗন্তুক দেবী আসনের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে সে প্রণাম করল।

পাদ্রি যান্ত্রিকভাবে উঠে পড়ল। তার পিছন পিছন নির্মল, সুরেন কাঠের সিঁড়ি দিয়ে দ্রুত উঠনে নেমে এলো। সুরেন বলল-ফাদার, বাবা রোগ ব্যধি, বার্ধক্যে বড় কষ্ট পাচ্ছে। তার জন্য প্রার্থনা করলেন না?
-মাই সন্স, তোমাদের বাবা, মা-বোনের মধ্যে এখনও আদিম জড়ত্ব রইয়েছে। ঈশ্বরের রাজ্যে যেতে হলে তাঁর ভালবাসার শরিক হতে হয়। তোমরা ঈশ্বরের পথিক হয়েও ওদের ঠিকঠাক বুঝাইতে পার নাই।  মৃত্যুর আগে যীশুর চরণে আশ্রয় নিতে বলো।

পাদ্রি চলে যেতেই তস্রায় মধুশিলাকে ডেকে আনল। সঙ্গে তার দোসর মারু আর অজয়। ঘরে ঢুকতে মধুশিলা ইতস্তত করছিল কিন্ত আজ সে পণ করে এসেছে বৗলা দাদার সঙ্গে কিছুটা সময় কাটাবেই। এই বাড়িটা ছিল তার প্রাণের দখিন দুয়ার। কয়েক বছরের বড় হলে বৌলা যে প্রাণের আত্মা। একবেলা না দেখা হলে পাহাড়ি শুকনো ঝরণার মতো রুখা শুখা হয়ে যেত অনুভূতি, এখন এ বাড়ির অদৃশ্য দেওয়াল টপকাতে আড়ষ্ঠ লাগে। তাদের দেখে নির্মল গজগজ করতে করতে তার ঘরে চলে গেল। মধুশিলা নির্মল, সুরেনকে ছোট থেকে নিজের ছেলের মত ভালবাসে। দুই ভাই ধর্মান্তিত হওয়ার পর সম্পর্কগুলোর মধ্যে কেমন যেন আলগা হয়ে গেছে। ভাইয়েরা তাকে পছন্দ করে না এ বোধ তার জন্মেছে, প্রথম প্রথম কিছুতেই খুঁজে পেত না তার মনেও কী অপছন্দের মেঘ জমেছে। হয়ত ধর্ম বিশ্বাস ভাঙায় মেলামেশার সুযোগ কমে গেছে, আবার সেই সুযোগে ভালবাসায় ফাটল বাড়ছে। তার মনে হল ধর্ম সংস্কৃতির বন্ধনটাই আসলে আলগা হয়ে গেছে। নির্মলের ওভাবে চলে যাওয়া দেখে মধুশিলার মনটা আরো বিগড়ে গেল।
মধুশিলা ঘরে ঢুকতেই বৗলা চনমনিয়ে উঠল।  সে সোজা হয়ে বসার চেষ্টা করতেই মধুশিলা এগিয়ে গিয়ে তাকে থামাল-না না আদা, তুমি ঠেস দিয়েই থাকো। কষ্ট হলে শুয়ে পরো।

বৗলা পূর্বাবৎ আধ শোয়া অবস্থাই রয়েছে। সে বলল-আজং, তুই আইছস তাতেই আমার বুড়া শরীলের ব্যথা কমে গেছে। তোরে দেখলে পরাণে নরম জলের মতো আরাম পাই। কতোকাল তুই এদিকে আসছ না ভাই। আগে একবেলা না আইলে তুই বাঁচতে পারতস? খক্‌খক্‌ খক্‌খক্‌-ই আজং ...
-আদা, তোমার লাইগ্যা পরাণের মধ্যে পরাণ লুকাইয়া কাঁদে। মাছ ধরা, শিকার করা, বিয়া থা, বায়খো উৎসবে চকৎ খেয়ে নেশায় আমরা চূড় হয়ে নাচতাম, গাইতাম। আমাগো জন্ম মিত্যু সব কিছুতেই আনন্দ, উৎসবের জন্য আলাদা করে বসে থাকতে হইত না। দাদা, নির্মলের বিয়া হলো গির্জায়। আমাগো আলেকা আচার, ৠষি ‘রসং কিছুই হইল না। ছোটখাটো অনুষ্ঠান হইলো বটে, সবই কেমন গির্জার গানের মতো ঠেকল। আমারা কোচা-রাভারা মরার দুঃখ পর্যন্ত ভুলে থাকি আনন্দে। আমার মনে হয় কী জানো দাদা,  ধর্ম মরে গেলে আচার বিচারও মরে যায়, গান শুকাইয়া যায়।
বৗলা হা করে শুনছি মধুশিলার কথা, ক্রমে তার বলিরেখায়  চিন্তার ভাঁজ দীর্ঘ হলো– আমি ওসব কিচ্ছু ভাবতে চাই না আজং। তোর বাঁশি না শুনে শুকনা ডাঙ্গায় মাছের মতো হয়ে রয়েছে শরীল মন। টের পাইছি জীবন একেবারে তলানিতে ঠ্যাকছে। খুব ইচ্ছা হয় তোর কারানলের সুর শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে যাই চিরতরে।

মধুশিলা আঁতকে উঠল-এ সব কি কও আদা!
-আজং, আমার বয়সের কথা, শরীলেরর কথা ভাব। বেশ কয়েক বছর ধরে বুকের মধ্যে কেমন শূন্য শূন্য লাগে, আনচান করে। প্রথম প্রথম বুঝতাম না, অস্থির লাগত। এখন বুঝি, সমাজ নমাজ হারিয়ে ফেলায় যন্ত্রণা। তুই আজকাল প্রায় আসস না, মন খুলে দু’টো কথাও বলতে পারি না। বাজা না আজং তোর বাঁশিখান।

বৗলার চৌকির গায়ে হেলান দেওয়া ছিল মধুশিলার বাঁশি। কারানল। ছয় থেকে আট ফু্টের ফুটহীন লম্বা পাহাড়িয়া নল বাঁশের বাঁশি। উপরে নিঃছিদ্র। ভিতরের গাটগুলো ফেলে দিয়ে এমাথা ওমাথা একটি মাত্র ছিদ্র করে নেওয়া হয়েছে। মধুশিলা কারানল তুলে নিল। বারোমাস শয়নে স্বপনে বাঁশিটি তার সঙ্গে থাকে। মাঠে গেলেও সঙ্গে  যায় কারানল। কাজের ফাঁকে বিশ্রামে বাজায়। তস্রায় প্লাস্টিকের বোতলে জল এগিয়ে দিল। কারানলের সরু দিকটায় খানিকটা জল ঢেলে দিয়ে বাঁশির ভিতরটা ভিজিয়ে নিল মধুশিলা। সে বাঁশিতে ফুঁ দিতেই পাশের ঘর থেকে নির্মল ছুটে এলো-কাকা, মাথাটা কি একেবারে গেছে, বে-আক্কেল হয়ে গেছে না কি? বাবা কতটা অসুস্থ সে বোধ আছে তোমার? চিরকাল আদিম থেকে যাবে?

হিরার  চোখে মুখে তীব্র একটি জেদি ভাব ফুটে উঠল। সবাইকে চমকে দিয়ে সে মোটা স্বরে বলল -তুই তোর বাবা ভিতরে ভিতরে কতটা অসহায় তা বোঝস? মিশন ইস্কুলে পড়তে গেলি আর নিজের সমাজ খোয়াইয়া আইলি। আমাদের বাড়িতে পুরানো কুটুম আসতে চায় না। আমরা রক্তের অভ্যাস হারিয়ে কোথায় যাম। তুই তোর ঘরে যা, মানুষটা আজ কাল চলে যাবেই, যাওয়ার আগে একটু শ্বাস নিতে দে।

-এই বাদ্য বাজনার আওয়াজ তো বাবার ক্ষতি করছে মা।
-যাবেই তো মানুষটা, সুরের মধ্যে যাউক। মধুশিলা বাজাবে।

নির্মল ভড়কে গেল। ঘরে উপস্থিত মানুষগুলোকে তার কেমন অচেনা মনে হলো। সুরেন বরাবরই একটু দমোনা মনের মানুষ। তস্রায় একেবারে মা ঘেঁষা।

 নির্মলের কাজে বাবা-মায়ের সায় নেই, তাদের উদাসিনতাই বলে দিত, কনোদিন মুখ ফুটে কিছু বলত না। ছেলে দু’টি মিশনের দয়ায় ছোটোখাটো কাজ জুটিয়েছে। মেয়েটা জেদি, নিজের চেষ্টায় সরকারি স্কুলে মাস্টারি পেয়েছে। নির্মল সবার পিছনে গিয়ে দাঁড়াল। তাকে বেশি অবাক করছে মধুশিলা কাকা। নিজে লেখাপড়া জানে না বলে শিক্ষিত লোকদের থেকে নিজেকে একটু দূরে রাখে। মধুশিলা কাকার চোখে মুখে খেলে যাচ্ছে উচ্ছ্বাস। সে করানলে ফুঁ দিয়ে বাজিয়ে যাচ্ছে, শ্বাস ফেলার ফুরসত নেই। বাঁশিতে আলাদা করে ফুটো নেই বলে শ্বাস নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। কারানল অবিরাম বেজে চলা বাঁশি, বাজতে শুরু করলে অনর্গল বেজে চলে। এখন অবশ্য কারানল বাদক ঝিলটং তো দূরের কথা আর কোনো বনবস্তি এলাকায় নেই বললেই চলে। কারও কারও বাপ দাদার বাঁশি স্মৃতি ফলকের মতো ঝুলে আছে ঘরের চালে। আর কে এমন কষ্ট করে বাজাবে কারানল? বড়দিনে যুবক যুবতি নাচে, অঙ্গ দোলায় ডিজের তালে বা পাঁজর কাঁপানো হিন্দি গানে। তস্রায় এসবের থেকে থেকে দূরে থাকে, বনবস্তির বাইরে যায় উৎসব, পার্বণে। সে ‘বেবাক রাভা ক্রৌরাং রুঞ্চুম’র সদস্য। সংগঠনের সদস্যদের সঙ্গে সেও প্রাণপনে চেষ্টা করে যাচ্ছে রাভাদের পরম্পরা বাঁচাতে। তন্দ্রায় কাম্বাং-লৗফন-এর ওপরে কোমরে পরে লবগ  হার। সাপের মেরুদণ্ড থেকে তৈরি লবগ হতো, এখন মেলানো কঠিন।

 বহুদিন হলো মধুশিলা কাকাকে বলেছে, মরা সাপের মেরুদণ্ড যোগাড় করে দিতে। হার মানেনি সে, এখন প্লাস্টিকের লবগ কোমর-বন্ধনী পরেই নাচে শস্য তোলার গানে, যুদ্ধের নাচে। স্বপ্ন দেখে হাঁড়ের লবগ পরে বাড়িতেই  তাদের দলবল নিয়ে বায়খো পরবে নাচবে। ডাকবে গ্রামের যুবক যুবতীদের। ইচ্ছা ছিল বাবাকে বলে বায়থানে আসর বসাবে। কিন্তু বাবা বয়সের ভারে নূহ্য, শয্যাশায়ী। তবু তস্রায় মানে, বাবা যতদিন বেঁচে আছে সে-ই এই গ্রামের সাঙতাঙ্গাম। গাঁওবুড়া। তল্লাটের কোচ-রাভাদের সমাজ চলত বাবার পরামর্শে, এখন নিজের ছেলেরাই তাকে মানে না। ঘরে যতই ঢুকুক চেরাজিভের অবিশ্বাস, সমাজ ভাঙা অবিশ্বাস, মায়ের হৌসুগ অনুসারে চলবে তাদের গোত্রধারা।   তস্রায়-র মন ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। যদিও একটা  চাপা ভয় কাজ করে তবু বিদ্রোহী মনকে সে চেনে। মানবে না সে পাদ্রির ফরমান।

-আঃ মধু, এখন আমার চলে গেলেও দুঃখ নাই। তোর পাহাড়ি ঝুমুর আমার রক্তে নেশা চাগাড় দিয়া উঠছে, খুব ইচ্ছা করছে মরার আগে এক চুমুক চকৎ খায়ে মরি। হিরা মায়রাং থেকে যা চকৎ বানাইতো না! এই কাজটা পাদ্রিবাবু ভালো করেছে, পোলাপানরে মদের নেশা ছাড়াইছে। আগে মদ বানাতেই চালের তিন ভাগের একভাগ চলি যাইত, নেশায় খাইয়া নিত আমাগো সুখ, আহ্লাদ। খক্‌খক্‌ ...অগো দেইখ্যা মুইও ঋষিবায় বাবার দিব্যি দিয়া মদ ছেড়ে দিছি। রক্তে নেশা চাগাড় দিয়া উঠলেও আর মুখে চকৎ তুলম না। মধু ওদের বল, কেউ একজন বংশ্রী বাজাক। তোমার মনে আছে হিরা, আমার বংশ্রীর কেমন সুর ছিল। খক্‌খ্‌ক, খ্‌কখ্‌ক। ও মা. .আ। কেশে কেশে বৌলার দমবন্ধ হবার দশা।

হিরা উঠে গিয়ে স্বামীর বুকে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল-তুমি অত কথা কইও না গো। কষ্ট বেড়ে যাবে। আমার সব মনে আছে।

মধুশিলা কারানলের মাথাটা সামান্য উঁচু করে শুনল কিন্তু উত্তর দিল না। জীবনের মতো আবিরাম বেজে চলা বাঁশিতে ছেদ দিতে চায় না সে। ছেদ বা বিরতি তো সুরের মৃত্যু, জীবন জানে শ্বাসের কত দাম। সে লম্বা বাঁশিটার মাথা দুলিয়ে মারুকে ইঙ্গিত করল। মারু দলে খাম বাজায় আর অজয় টেমাক বাজায়। ছেলেপিলে জোগাড় করতে পারলে তাদের বাইদং-এ হাতে খড়ি দেয় মধুশিলা। মারু মধুশিলার ঈঙ্গিত বুঝতে পারল। সে বলল-আদা’গদা, তুমি আমাদের দলের মাথা ছিলা। আহা, কী চমৎকার বংশ্রী বাজাইতা। তুমি অসুস্থ হওয়ায় মোরা কাউরে দলে নিই নাই। কেডা আছে তোমার ধারেকাছে বংশ্রী বাজায়। জঙ্গলবস্তিতে দুই চাইরজন খাম বাজাইলেও কেউ বংশ্রী শিখতে চায় না। ওটা নাকি কিষ্ণের বাঁশি তাই বারণ। তুমি বাঁইচা থাকতে আর কাউরে বংশ্রী বাজনদার নিম না আজং।

মারুর কথা শুনে হিরার বুকের মধ্যে খাঁ খাঁ করে উঠল। লোকটার বাঁশিই তো দংশেছিল তাকে। লোকটাই ছিল হৃদয় ঝাড়ার ওঝা। বৗলা তাদের বাড়ি এলো। কামিন হিসেবে। চাষাবাদ থেকে বাড়ির যাবতীয় কাজ করত। হেমাগুড়িতে বাড়ি, সেখান থেকে আসার রাস্তাঘাট দুর্গম। ছিল ঝড় বৃষ্টির রাতবিরেত। তবু সে জল কাদা ভেঙে ঠিক সময়ে আসত, প্রাণখোলা উদ্যমে কাজ করত, কোনো কিছুতে না ছিল না তার। হিরার বাবা গণাথ রাভা বৌলার কাজে বেজায় খুশি। সে বলেছিল, আমার বাড়িতেই থেকে কাজ কর। আপত্তি ছিল না বৗলারও, থাকতে শুরু করল হিরাদের বাড়ি। সারাদিন কাজের শেষে সন্ধ্যায় মালিক আর কামিন বসে চকৎ খেতে খেতে হারিয়ে যেত রাভাদের বাপ-দাদার চোদ্দ পুরুষের কাহিনিতে। বাবা বলত-বৗলা তুই হলি নৌঙ ননোঙি কাহিনির রাজা।
বৌলা হা করে থাকত। বলত-বৗলা রাজাটা আবার কে বৗতৗই?

-হা হা, বৗলা রাজার কথাই জানস না, আমাগো সৃষ্টিতত্ত্ব লেকা আছে রে ‘হাসং টাকৌ’ আর ‘হা-তাঙি’তে। বৗলাদেবই তো ধরতী বানালো।

 -আমি তো পৃথিবীর কিছুই চিনি না খুড়া।
-তুইও আস্তে, আস্তে চিনবি। মুই কি ছাই লেখাপড়া জানি। প্যাটের জোগাড় করতেই বুড়া হইয়া গেলাম। বাপ-দাদার মুখে মুখে শুনি শুনি এখন একটু আধটু জানি। আমি তোরে আমাগ কোচগো জগৎ চিনাইয়া দিম।

-খুড়া, আমারে একবার চাঁন্দরডিঙা পাহাড়ে নিয়া যাবা।

গণাথ হাত জোড় করে প্রণাম করেছিল-তোরে চাঁন্দরডিঙা পাহাড়ের কথা কেডা কইছে?
-আমাগো গাঁওবুড়া কইছিল।
-চাঁন্দরডিঙা কি এখানে রে বাপ, পুব দিকে আসামের ধুবুরী জেলায়।

 চান্দসাউদের  সপ্তডিঙা মধুকর ওখানে পাহাড়ের মতো উপুড় হইয়া আছে।

-সাত পাহাড়ের তলায় নাকি সোনা রূপা মোহর ঠাসা এখনও। আমরা খুব গরিব মানষি খুড়া, চাঁন্দরডিঙা পাহাড়ের ধনরত্ন কিছু যদি মেলে মোর ভাগ্যে। মোরা লেঙ-হৗসুগের মানুষ। চান্দসাউসও ছিল লেঙ-গোত্রের। আমাগো গোত্রের মানুষের বোয়াল মাছ খাওয়া নিষেধ। জানো খুড়া, ওই বোয়াল মাছটা সাক্ষাইত একটা রাক্ষস। রাক্ষসটা লক্ষিন্দরের মালাই-চাকি খাইয়া ফেলাইছিল।

-ধনরত্ন তো মিলতেই পারে, চান্দসাউদের ডিঙা বলে কথা, সোনা রূপার ভরা ছিল সপ্তডিঙা। এক মধুকরেই কত ছিল। কিন্তু লোভ করিস নারে বৗলা বাপ,  তোর বুদ্ধি আছে, গতর খাটতে পারস। দেখবি তুই একদিন গাঁওবুড়া হবি। লোভ করলে বিষহরি’র মা মনসার কোপে ছারখার হয়ে যাবি। অশোকাষ্টমিতে ব্রহ্মপুত্তুরে নেতা ধোপানীর ঘাটে হাঁড় বিসর্জন দিলে লক্ষিন্দরে মতো জীবন বাড়ে। সেই তিথীতে তোরে নিয়া যাম চাঁন্দরডিঙি পাহাড়ে।

 জমে যেত এক একটা সন্ধ্যা। হিরার মা’র বানানো মায়রং থেকে দেশি মদ চকতে মৌজ হয়ে যেত মুনিব-মুনিষ। শিশু বাদে সবাই মিলে এক পঙতিতে চকৎ খেতে বাধা নেই, কোনো দিন মা-মেয়েও বসত আসরে। চালের দেশী মদে বুঁদ হয়ে যেত সবাই। মাতাল মাতাল। হেঁড়ে গলায় গান গাইতে গাইতে গণাথ ঘুমাতে আসত আর বৌলা মাচায় বসে অন্ধকারে ভাসিয়ে দিত বাঁশির সুর। বৌলার বাঁশিতে নিবিড় হয়ে আসত অরণ্যবস্তির গভীর রাত-নাম্পার ফেয়ং ফেয়ং/ আনি তৗলৗই রৗম্বকি. . .বাতাস এসো এসো/ আমার অরণ্য মেঘে/ ওগো আকাশে উঁকি দেওয়া তারা। কিশোরী হিরার মনে গজাত প্রাজাপতি পাখা, চোখে ঘুম আসত না। বৗলা রাজার বাংশী তাকে একটু একটু করে যুবতী করে তুলছিল প্রতিরাতে। হিরার ভয় অন্য জায়গায়, সে বৌলার গোত্র জানে না। সমগোত্র হলে রাভা নরনা্রীর প্রেম অলঙ্ঘনীয়। মনকে শিকল পরাতে চেষ্টা করে, কিন্তু বেহায়া বাঁশি শিকলের আংটা ছোট করে দিচ্ছিল।
গণাথের মনেও খুব আনন্দ, সে বৌলাকে বলেছিল-বায়থানে লাগারে বেটা বায়খো পরব। তোর এলেম দেখি।

গণাথের পা ছুঁয়ে সটান বৌলা বলল-দেখ তবে খুড়া।

ষাটের দশকেও বায়খো উৎসবের ভাটা পড়েনি কোথায়ও। হিরা সবে টগবগে ষোড়শী আর বৌলা চব্বিশ পঁচিশের যুবা। তাদের বাড়িতে থেকে তিন চার বছরে গোটা বনবস্তি জয় করে নিয়েছে সে। ইতিমধ্যে গড়েছে একটা গান বাজনার দল। মধুশিলা বৗলার থেকে বেশ খানিকটা ছোট, সেই বালক প্রাণপনে চেষ্টা করে তার বাবার কারানল বাজাতে। তার লম্বা বাঁশিতে একটু করে ফুটে উঠত-ধতি-হি-হি-তি, হি-হি-হিতি। মাত করেছে বৗলা, সব বনবস্তির ছেলেবুড়ো গাঁ উজার করে জড়ো হয়েছে বায়থানে। বায়খো উৎসবে বাদ্যের আওয়াজ বনবস্তি ভাসতে ভাসতে মেখে যাচ্ছিল বন জঙ্গল। ডুং ডুং করে খাম বাজছে, সঙ্গে সমান তালে বাইদং, টেমাক বাজছে। সমস্ত সুরকে ছাপিয়ে যাচ্ছিল বৌলার বংশ্রী। নৃত্য-গীতরত রাভা যুবতীরা যত না উচ্ছ্বল তার চেয়ে বৌলা বেশি ফুটছে। মাতোয়ারা যুবক যুবতীদের মাঝে হঠাৎ বৗলা হিরার হাত ধরে বলেছিল-তুই আমাকে বিয়া করবি হিরা? বিদ্যুৎ বেগে স্পর্শানুভূতিতে শিহরিত হয়েছিল কিশোরীবালা। কিন্তু পরক্ষণে সে স্থির হয়ে গিয়েছিল- তোমার হৗসুগ?
-ভয় পাস না। মুই জানি তোর হৗসুগ, মোহতক। তোরা কাছিম খাস না। আমার গোত্র লেঙবারায়, আমরা বোয়াল রাক্ষসকে ছুঁয়েও দেখি না। বল হিরা বল, আমায় . . .
হিরার মুখে বুলি ফোটে না। মনে হচ্ছে তার কানে বৗলার বাঁশি বলছে, বল হিরা বল. . .
গাঁওবুড়া বায়খো উৎসবে পতি-পত্নী নির্বাচন মেনে নিয়েছিল। গোত্র এক হলে প্রেমের মৃত্যু হতো। রাভা সমাজ কিছুতেই মেনে নিত না। এক হৌসুগে যে বিয়ে অচল। বৌলা যেন তখন সবার ঘরের পোলা। বিয়ে হলো তাদের। মাতৃতান্ত্রিক সমাজের রীতি মেনে বৌলা থেকে গেল হিরাদের বাড়ি। মায়ের গোত্রে সন্তানের গোত্র পরিচয়। হিরার ভাইকে চলে যেতে হয়েছিল শশুরবাড়ি। ঘরজামাই হলেও বৌলার কোনো অসুবিধা হয়নি এবাড়িতে, সে একটু একটু করে জয় করেছিল সবাইকে। রায়ডাক বনবস্তি, আন্দুবস্তি। গাঁওবুড়া মারা যাওয়ার পর গোটা গ্রাম এক বাক্যে তাকে গাঁওবুড়া বাছতে সময় নেয়নি। শশুর গণাথ রাভা ফোঁকলা দাঁতে শিশুর মতো হেসেছিল-কি বৌলা রাজা, মনে পড়ে কইছিলাম, তুই একদিন সাঙতাঙ্গাম হবি।

মানুষটা এখন শুয়ে আছে মৃত্যুশয্যায়। বুকে একরাশ যন্ত্রণা। বনবস্তিগুলো প্রায় আস্তে আস্তে অধিকাংশ ধর্মান্তরিত হয়ে গেল। বৌলা দুঃখ করত, আমাদের সর্বপ্রাণবাদী ধর্মে আলেক আচার, লোকসংস্কৃতি লেপ কাঁথার মতো জড়িয়ে থাকে। আচার বিচার না বাঁচলে বিশ্বাস বাঁচে কি? গাঁওবুড়ার অস্তিস্ত্ব বলতে কিছুই নেই আর। মানুষটা যা আছে। পাদ্রির হাতে সমাজের চাবি কাঠি। মানুষটি নিজের ছেলেদের দেখে আরো গুটিয়ে যেত। ঘরের মধ্যে অদৃশ্য দেওয়ালের এপাশে থেকে নীরবে দেখে যেত সব। কারানলের বিরামহীন সুরটা কেমন বিষাদগ্রস্থ হয়ে উঠেছে। হিরার মনে হচ্ছে, ঋষিবায় দেবতা  অভিশাপে নলুয়াকে নলগাছ বানিয়েছিল, আদি অভিশপ্ত নলগাছের বুক চিরে করুণ সুর ঝরছে। নালুয়া-চালুয়া-গন্ধশ্রীকে ঋষিবায় পৃথিবীতে পাঠিয়েছিল রাভাদের নৃত্যগীত শিখাতে কিন্তু সুন্দরী যুবতীদের দেখে ভুলতে বসেছিল তাদের পৃথিবীতে আসার হেতু। ঋষিবায় অভিশাপ দিয়ে তাদের তিনটি বৃক্ষ বানিয়ে দেয়। নলগাছের বাঁশি কারানলে যেন এখন ভড় করেছে প্রবহমান কান্না।

ঘরের মধ্যে ঢুকেই জিমরী হাউমাউ করে কেঁদে উঠল-ও আদা গো, তুমি কেমন আছো? সে বিছনার কাছে গিয়ে দাদার হাত ধরে পাগলের মতো নিজের গালের সঙ্গে ঘষতে লাগাল।

কান্নার শব্দে হিরার সম্বিত ফিরল। সে মাথা তুলে দেখল ননদ জিমরী কাঁদছে। সে বৗলার ছোট বোন। অস্ফুষ্টস্বরে বৗলা জিজ্ঞেস করল-একা আইছ জিনৌ?
-না, সঙ্গে মেয়ে দেবকী আইছে।

-আ –আ-মি তোগো আশায় পরাণডা ধরয়্যা রাখছি।  জিনৌ একটু চিকা কি আইনছ? বড় সাধ তোগো হাতে চিকা খাইয়ে মরি। অঃ অঃ. . .খক্‌খক্‌ খক্‌. . .
-হ, মা মাইয়া মিলি পাহাড়ি ঝোরা থেকে এক ঘড়া জল আনছি। বিকালে তস্রায় ফোনে কইল- বাবার অবস্থা খুব খারাপ, পিসি জল নিয়া আসো। ইচ্ছা ছিল নদী থাকি চিকা আনি, কিন্তু  সন্ধ্যা হয়ে আইল, জলই আনতে পারব কিনা চিন্তায় আছিলাম। না হইলে কলাগাছ কেটে জল বার করে নিতাম।

এতক্ষণ নির্মল চুপচাপ ছিল। সে ফোঁস করে উঠল-এখানে চিকাবৌরৌই ঠরই হবে না। যত সব বুজরুকি।

তস্রায় বলল – হ, দাদা হবে।

-তুই কি মাতব্বর হইছস এই বাড়ির? এই সব অচল কুসংস্কার এখানে চলবে না। ফাদার বলেছেন, মৃত্যুর পর আর কেউ ফেরেনা। বাবাকে বল যীশুর নাম নিতে। তাঁর রাজ্যে জায়গা পাওয়ার জন্য আমরা সবাই বাবার জন্য প্রার্থনা করি।

-ঋষিবায়, রৗন্তুক দেবী, যীশু ভগবান সকলের কাছেই প্রার্থনা করেছি বাবা যেন শান্তি পায়। কিন্তু আমাদের চালু আচার বিচার ছাড়ব কেন? এই বাড়ির মালিক মা। তুই আমি ভাই মা’র গোত্রের সন্তান। আমাদের সমাজটা এভাবে না ভেঙে গেলে আমিই তো এই বাড়ির মালিক হতাম। বাবা, এখনও বেঁচে আছে, সে গাঁওবুড়া। বৗলা রাজ। তুই আমি ভাই বৗলা রাজার সৃষ্ট সন্তান। তাঁর ইচ্ছাকে মান্যতা দিতে হবে। বাবার তৃপ্তির জন্য যা যা করতে হয় আমরা করবই। তোর পছন্দ না হলে নাও মানতে পারস। আমাদের কিছু করার নেই। এভাবে বিশ্বাসকে মরবি না দাদা।

-মা, বোনের হাতে মাতব্বরি ছেড়ে দিছ নাকি? তোমার কি মত?
হিরা বলল-আমার আবার আলাদা কী মত হবে। তোর বাবার ইচ্ছা তো আমাদের কোচ-রাভাদের ইচ্ছা।
-এই সুরেন, তুইও কি শয়তানের পথে হাঁটবি নাকি?
সুরেন মিনমিন করে উত্তর দিল-আমি আর কী বলব। রাভা খ্রিস্টানরাও তো এখন আবার গোত্র মানতে শুরু করেছে। রক্ত আমাদের ভুলতে দেয় কিছু? বাবাকে আমারা সবাই ভালবাসি। তোর হৃদয়েও তো মায়া আছে দাদা।

ঘরে উপস্থিত সকলের চোখের ভাষা পালটে গেছে দেখে নির্মল পা দাপাতে দাপাতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। সুরেন বলল -মারু কাকা, চলো আমরা পুরুষেরা ঘরের বাইরে যাই। মেয়েরা থাক ঘরে, এটা তো মেয়েদের গোপন অনুষ্ঠান।

ঘরের মধ্যে তস্রায় আর তাদের মা থাকলেও জলদানে তাদের কোনো ভূমিকা নেই। মৃত্যুপথযাত্রীর শুধু মা বোন আর ভাগনি চিকাবৗরৗই-এ অংশ নেওয়ার অধিকার। কেউ না থাকলে গোত্রের অন্য কোনো মহিলা জলদানের অধিকারী। জিমরী আর দেবকী বৗলার গোত্রের মহিলা, আর  থাকতে পারত বৗলার মা। মা গত হয়েছে ছোটবেলায়। মা-মেয়ে ঘড়া থেকে বৗলার মুখে জল দিয়ে তার কানে ফিসফিসিয়ে বলল-আন্দু ঝোরার থেকে জল আনছি। ই-চিকা’ নৗঙিমৗন কৗঞ্চৗক সায়. . .এই জল পান করে তুমি তৃপ্ত হও। তোমার আত্মার মুক্তি হউক। আবার বান্ধা গোত্রে ফিরে এসো পৃথিবীতে, তোমার জন্য সব সুখ অপেক্ষা করে থাকবে। পৃথিবীর জল বাতাস মিষ্টি, নারীরা সুন্দরী।
বৗলার মুখে ফুটে উঠল ক্লেশহীন এক চিলতে তৃপ্তির হাসি।

মধুশিলা ঘর থেকে কারানল বাজাতে বাজাতে বেরিয়েছে। বাঁশিতে বিরাম দেয়নি। জ্যোৎস্না নেমেছে বনোবিথীর মাথা জুড়ে। বাইরে এসে মারু তার লম্বা ঢোলকের মতো লম্বা বাদ্যযন্ত্র খামে বোল তুলল- মৗর গৗঞ্জাং মৗর গৗঞ্জাং। চাকার নাকার, চাকের চাং. . .তা-ধিন’না-ধিন। খামের এই বোল শুনে উপস্থিস সকলের সর্বাঙ্গে আনন্দ উল্লাস ফুটে উঠল।

 মৃত্যুপথযাত্রীরও হৃদয়ে খামের বোল চুইয়ে পড়ছে মৃতসঞ্জিবনীর ফোটার মতো। অজয় ধরল টেমাক। বহুদিন কারানল বাজেনি এই বস্তিতে। সারা বনজুড়ে ফিরে এসেছে মোম জ্যোৎস্না মায়া। ভেসে যাচ্ছে দূর দুরান্তের চা বাগান গালিচা। বাজনা শুনতে শুনতে তিরতির করে উঠল সুরেনের ছোটবেলা। সে লাগাল দৌড়। দৌড়ে গিয়ে তার বাবার গুছিয়ে রাখা বংশ্রী নিয়ে এলো। সুরেন ছোটবেলায় একটু আধটু বাঁশি বাজাত। মাঝে মাঝে সুর কেটে যাচ্ছে তার কিন্তু অচ্ছেদ্য কারানল ভরাট করে দিচ্ছে কাটা সুর তাল। সুরটা একটু একটু করে দানা বাঁধছে তার হৃদয়ে। সুরেনের মনে হচ্ছে বাবা যেন মৃত্যুভয় ভেঙে উঠে এসেছে। কানের মধ্যে বৗলা রাজা বলে চলছে- বাজা রে বাজা বেটা। সুর কখনও মরে?

No comments:

Post a Comment