Wednesday, December 25

সুজয় চক্রবর্তীর অণুগল্প : লাগাম







সুজয় চক্রবর্তী
লাগাম


রিক্সা স্ট্যান্ডের প্রায় সবাই এখন টোটো কিনে ফেলেছে। শুধু নিত্য পারেনি। জমানো টাকা কিছুই নেই।

এখন টোটোরই বাজার! কয়েকবার ভেবেছে ভাড়ায় টোটো চালাবে। বাজারে প্রবোধ তোকদারের পাঁচটা টোটো খাটছে। আরও পাঁচটা নামাবে সামনের মাসে। কিন্তু মন সায় দেয়নি। হাজার হোক, রিক্সাটা তো তার নিজের! যাও না যাও কারও কাছে কোনও কৈফিয়ত দেওয়া লাগে না।

তবে টোটো আসাতে রিক্সা মার খেয়ে গেছে। আগে যখন সবার রিক্সা ছিল তখন দিনে তিনশ' সাড়ে তিনশ' নিয়েও বাড়ি ফিরেছে নিত্য। এখন দেড়শ'ও হয় না। কালই তো মোটে সত্তর হয়েছিল!

কেন নিত্য'র রোজগার ইদানীং কমে গেছে বউ মধুও জানে। কিন্তু ছেলে দুটো বুঝলে তো! আজ এটা দাও, কাল ওটা দাও। সব সময় কানের কাছে ঘ্যান ঘ্যান।

ছেলেগুলোর চাহিদার সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে যখন মুখ থুবরে পড়ে নিত্য, একমাত্র তখনই বউ মধুর মুখ আর 'মিষ্টি' থাকে না। খিচিয়ে ওঠে। যেমন আজ উঠেছে।

---- আমার তো কোনও শখ-আহ্লাদের কথাই বলি না। ওরাও কি মুখে লাগাম দিয়ে থাকবে? 

রেগে যায় নিত্য। বলে, 'হ্যাঁ, দরকারে লাগাম দিতি হবে।'

----- তা, জন্ম দেওয়ার সময় তুমিও তো দিতি পারতে!

নিত্য চুপ করে গেল । একেবারে চুপ। লাগাম দিলো মুখে!




অদিতি রায় : মৃত্যুই ধ্রুব জীবনের পরপারে - একটি রেপ ন্যারেটিভ







অদিতি রায়
মৃত্যুই ধ্রুব জীবনের পরপারে : একটি রেপ ন্যারেটিভ


সালটা ১৯৭৬, ক্যালিফোর্নিয়ার ক্ল্যারেমন্ট গ্র‍্যাজুয়েট ইউনিভার্সিটি। একজন ছাত্র তার পিএইচডি -র গবেষণাপত্র লিখছেন ধর্ষকদের মনস্তত্ত্ব নিয়ে। কিন্তু কীভাবে বিশ্লেষণ করবেন তাদের মানসিকতা? চাই কিছু ধর্ষকদের জবানবন্দী। লস এঞ্জেলসের পেপারে একটি বিজ্ঞাপন দিলেন তিনিঃ

ARE YOU A RAPIST?
Researcher Interviewing anonymously by phone to protect your identity.
Call- ********

সারাদিন বসে রইলেন ফোনের সামনে। রাত হয়ে গেল। কোনো ফোন এলোনা। অবশেষে তিনি যখন প্রায় নিরাশ সে সময় হঠাৎ বেজে উঠলো ফোন। ফোনের ওধারে একজন ধর্ষক স্বয়ং, যার মুখ থেকে জানা যাবে তাঁর মানসিকতা!  আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো ছাত্রের মুখ। এরপর একে একে আরো প্রায় ২০০ খানা ফোন তিনি পেয়েছিলেন। যাদের মধ্যে কেউ ধর্ষণ করেছে নিজের প্রেমিকাকে, কেউ পরিচিত কারো স্ত্রীকে, কেউ বা স্কুলের বাচ্চাকে। পেশায় এরা কেউ কম্পিউটার প্রোগ্রামার, কেউ চিত্রশিল্পী, কেউ ব্যবসায়ী কেউ বা আবার দারোয়ান। দেখে বোঝা যায়না তাদের স্বাভাবিক জীবনযাপনের আড়ালে লুকিয়ে রয়েছে কোন ধর্ষকাম প্রবৃত্তি।

তাহলে কীভাবে তারা হয়ে উঠেছে ধর্ষক? কী বা তাদের ধর্ষণের মানসিকতা? এদের মধ্যে থেকে পঞ্চাশজনের জবানবন্দি বেছে নিয়ে তার বিশ্লেষণ করে তিনি তৈরী করলেন তাঁর গবেষণাপত্র। কাজ শেষ হলো ১৯৭৮ সালে। বিখ্যাত সেই ডিজারটেশনের নাম হলো "The Undetected Rapist" আর ছাত্রটি হলেন প্রসিদ্ধ ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট ড. স্যামুয়েল স্মিথম্যান।

এ তো গেল ক্যালিফোর্নিয়ার কথা। বিজ্ঞানের কথা। কিন্তু সাহিত্যে? সাহিত্যিক তো স্বয়ং ঢুকে বসেন একজন চরিত্রের অন্তর সত্তায়।
তাই করলেন বাংলাদেশের অন্যতম সাহিত্যব্যক্তিত্ব  বিপ্রদাস বড়ুয়া। (জন্মঃ ১৯৪০)

ভাষা আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধ মধ্যবর্তী সময় পর্যায়ে কেটেছে তাঁর কৈশোর এবং যৌবন। এই তোলপাড় সময়ের সামগ্রিক রুপচ্ছবি প্রতিফলিত হয়েছে বাংলাদেশের সামগ্রিক সাহিত্যেই। এই রাজনৈতিক পালাবদলই বাংলাদেশের সাহিত্যের নিজস্ব ধারা সৃষ্টি করেছে, বলা ভালো একপ্রকার সাহিত্যের বুনিয়াদ গড়ে তুলেছে।
অন্যথা হয়নি বিপ্রদাস বড়ুয়ার ক্ষেত্রেও। অসামান্য দক্ষতায় "মৃত্যুই ধ্রুব জীবনের পরপারে" ছোটগল্পে এই সামাজিক পটভূমিতে তিনি মিশিয়েছেন মনস্তত্বের মশলা এবং জাদুবাস্তবতার সুগন্ধ।

সামরিকবাহিনী শাসিত বিধ্বস্ত বিচূর্ণ বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সামাজিক রাজনৈতিক উত্তাল পরিস্থিতির চিত্রপটে তিনি ফুটিয়ে তুললেন অনবদ্য এক রেপ ন্যারেটিভ। যেখানে কথক নিজেই একজন ধর্ষক এবং এক অর্থে একটি প্রাণের হত্যাকারী।

ভোলা অঞ্চলের একটি মেয়ে, গল্পের এক তৃতীয়াংশ অব্ধি যার কোনো নাম নেই, কারণ সে কেবলই একটি বস্তুদ্রব্য সম "মেয়ে", বরিশাল কলেজে সে ছিল পাঠরতা অর্থাৎ শিক্ষিত - বাবার কাছে টাকা নিতে এসে দাঙ্গার কবলে পড়ে তিন পরিচিত যুবক দ্বারাই অপহৃত হয় সে। কাকুতিমিনতি করে বা "দাদা" ডেকেও লাভ নেই জেনেও অসহায় আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছিল মেয়েটি। কেবল হাসি দিয়ে লঘু করতে চেয়েছিল নিজের ভয় তথা পরিবেশের বীভৎসতা এবং ক্রিয়াকলাপের ভয়াবহতা। হ্যাঁ, ভয়ই তো পেয়েছিল সে, যদিও সেই ভয় ফুটিয়ে তুলতে চায়নি প্রকাশ্যে আর সেই ভয়ই সে ক্রমে সঞ্চারিত করে দিয়েছে ধর্ষকদের মনে। আর তারপর তা সঞ্চারিত হয়েছে গল্পের বিগ্রহে, অজানা শিহরণ সংক্রামিত হয়েছে পাঠকের মননে।

প্রথমেই জানা যায় মেয়েটির উপমা তার চমৎকার ক্ষুরধার শরীর, গুচ্ছ খোঁপা, পিঠের তিল। রিক্সায় দুই পুরুষের মধ্যিখানে গাদাগাদি করে বসিয়ে নিয়ে আসা হয় তাকে। রিক্সাওয়ালা পর্যন্ত সোৎসাহে প্ররোচনা দেয় ঘটতে চলা এই অনৈতিক ভোগোল্লাসের ঘটনাটিতে।

"প্রথমজনের বেলায় সে হাসিখুশি ছিল। দ্বিতীয়জনের বেলায় একটু সবুর করতে বলেছিল। তৃতীয়জনের বেলায় পানি চেয়েছিল। তার বদলে ওকে আমরা চুমু খেয়েছিলাম। পরিত্যক্ত ঘরে কোনো কলসী ছিলোনা।"

মেয়েটি যে একজন সম্পূর্ণ মানবী, ধর্ষণের কালে তা খেয়াল হয়নি তিন ধর্ষকের। তার জলের জন্য আকুলতা, হাসিমুখে অথচ কান্নাভরা গলায় তিনজনকে ডাকা...তাদের কারো কানে পৌঁছায়নি। এমনকি তার "আমি আর বাঁচবোনা".. এই আর্ত কথাটুকুও বিচলিত করেনি কাউকে।

কিন্তু মেয়েটি শেষে মারাই যায় আর তার মারা যাওয়াটুকুই শেষ পর্যন্ত বিস্মিত ও ভাবিত করে তোলে ধর্ষকদের। কথক লিখেছেন, বাংলাদেশের দাঙ্গা পরিস্থিতিতে অসংখ্য মানুষের মৃত্যুর ঘটনার মধ্যে একটি সাধারণ মেয়ের প্রাণ যাওয়াও অতি তুচ্ছ ঘটনা৷ মেয়েটির বাবা মা ছাড়া এক্ষেত্রে তার জন্য কাঁদারও কেউ নেই। কিন্তু তবু, মেয়েটির মৃত্যুই কার্যত কথকের বেঁচে থাকাকেই মিথ্যে করে দিয়েছে।

মানসিক ও শারীরিক উন্মাদনা কেটে গিয়ে তিনজন যখন স্বাভাবিক চৈতন্যে ফিরেছে তখন তারা মৃতদেহটুকুর মধ্যে প্রাণ ফিরিয়ে আনার অসম্ভব আকাঙ্ক্ষায় অনুশোচনাবিদ্ধ হয়েছে। আর বারবার তাই আত্মসমালোচনার মাধ্যমে, কৃত কার্যের পুনঃ পুনঃ বিশ্লেষণের মাধ্যমে নিজেদেরকে অজুহাত দিয়ে শান্ত করতে চেয়েছে, প্রবোধ দিতে চেয়েছে। আর ততই তারা ক্ষতবিক্ষত হয়েছে আত্ম দংশনে।

" ওর মুখের হাসি হাসি ভাবটুকুই আমাদের বিভ্রান্ত করেছে। আমরা বুঝতে পারিনি ও এত তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে যাবে। আমরা আরো ভেবেছি ওর যৌবন ফুরাবার নয়। ওর মতো মেয়ের কাছে তিনজন যুবক কিছুই নয়।"

মারা যাওয়ার সময় মেয়েটি বলেছিল, "সমুদ্র তোমাদের নিয়ে যাবে।"

সে মুহুর্তে একথা তাদের কাছে হেঁয়ালী বলে মনে হলেও, এক অমোঘ অভিশাপের মতো এ কথা সত্যি হয়ে  ফলে গেছে। কাকতালীয়ভাবে হোক অথবা অখন্ডনীয় পরিণতি হিসেবে মেয়েটির কথাই তাদের জীবনে ধ্রুবক হয়ে উঠেছে।

মেয়েটি মারা যাওয়ার পর অনুশোচনার সাথে সাথে এক তীব্র ভয় এসে মেশে তিনজনের মনেও। কারণ গভীর প্রত্যয়ের সাথে মেয়েটি উচ্চারণ করেছিল কথাগুলো। তাছাড়া তারা কোনোভাবেই ভাবতে পারেনি তাদের অত্যাচারে মেয়েটির মৃত্যু পর্যন্ত ঘটে যাবে। তাই অন্ধকার রাত্রে কাছে দুরে থেকে আসা লুটপাট আর ঘর পোড়ানোর চীৎকারের সাথে সাথে তারা শুনতে পায় সমুদ্রের গর্জন। এমন করে রাতের চড়ায় সাগরের ডাক আগে কখনো শোনেনি তারা।

ত্রিভুজের মতো তারা মেয়েটিকে ঘিরে বসে, যেন নিভে যাওয়া যজ্ঞের চারিদিকে তিন যজ্ঞকর্তা। তাদের একান্ত ইচ্ছেতে, একনিষ্ঠ প্রার্থনায় যেন আবার সাগ্নিক হয়ে উঠবে হোম, প্রাণ ফিরে পাবে মেয়েটি। নিজেদের "কুৎসিত হিমশীতল অত্যাচার", ইডের ধ্বংসাত্মক প্রবৃত্তিকে আহুতি দিতে প্রস্তুত তারা সেই যজ্ঞে।

তারা ভাবে, মেয়েটি বেঁচে উঠলে তাদের পকেটে থাকা লুটের বিশ পঞ্চাশ হাজার টাকা, সোনাদানা সবকিছু তাকে তারা দিয়ে দেবে। এমনকি মেয়েটির দেওয়া যে কোনো শাস্তিও মেনে নেবে তারা নির্দ্বিধায়!

কিন্তু মেয়েটি স্পন্দনহীন! দয়াভিক্ষা না করে, হাসি মুখে, অবিচলিত ভাবে নেমেসিসের মতো একটি স্তোত্র উচ্চারণ করে সে মারা গেছে, সেই মৃত্যুর চেয়ে বড় শাস্তি আর নেই এই তিনজনের পক্ষে।

মেয়েটি বাধা দিলেও তারা হয়তো বল-প্রয়োগ ই করতো, তবু এ অবস্থায় তিন ধর্ষক মায়ার বশবর্তী হয়ে ছোটবোনের মতো তাকে পোশাক পরিয়ে দিয়েছে, মরদেহ কাঁধে তুলে নিয়েছে যথাসাধ্য যত্ন ও আয়োজন সহকারে, তারপর তারই কথা মতো সমুদ্রে ভাসিয়ে দিয়েছে তাকে।

তার তীব্র কঠিন আদেশে তারা যেমন বারান্দায় চলে গিয়েছিল ধর্ষনের শেষে, তেমনই মরে গেলে সে যে সমুদ্রে যাবে..তার সেই কথা আদেশের মতো অনুরণিত হয়েছে তাদের মনে। আদেশ পালন করেছে তারা কোনো এক অজানা আশঙ্কা থেকে, আবার বিবেকের দংশন থেকে, আবার হয়তো সহজাত এক মনুষ্যত্বের মায়া থেকে, ইডের উপরে জেগে ওঠা বলিষ্ঠ ইগো এবং সুপার ইগো থেকে।

এরপরই কথক জানান, মেয়েটির নাম নাম  "মালতী" এবং বলেন, "এরপরই ওর সব কথা ফলতে শুরু করলো"...
এখানে এসেই পাঠকের মনে পড়ে যেতে পারে রবি ঠাকুরের বাংলাদেশের সাধারণ মেয়ে মালতীর কথা, যারা ফরাসী জানেনা, জার্মান জানেনা, কেবল কাঁদতে জানে। কিন্তু তাদের মধ্যেই লুক্কায়িত যেসব অসাধারণত্বের স্ফুলিঙ্গ.. তাতে মালতীর গণিতে প্রথম হওয়ার ইচ্ছে পূরণ হয় কিনা তা জানা না গেলেও,  সেই আগুনেই এই গল্পের ধর্ষিতা মালতীর ইচ্ছে নিয়তির পরিহাসের মতোই ফলতে শুরু করে।

মাঝগাঙে ডুবে মারা যায় দুই ধর্ষক। সমুদ্রগ্রাস থেকে কোনোক্রমে  রেহাই পেয়ে যান কথক। আর তারপর থেকে তীব্র মৃত্যুভয় ধাওয়া করতে থাকে তাঁকে। মালতী মারা গেছে, সাথে নিয়ে গেছে কথকের ধর্ষক দুই সঙ্গীকেও। তিনি জানেন, এরপর হাঁটুজল নদীতে পরলেও আর প্রতিরোধের শক্তি তিনি পাবেননা। তার অবচেতনে কীভাবে যেন গেঁথে গিয়েছে, হয়তো তিনি সাঁতার জানেননা। মৃত্যু যে তার জলে ডুবেই হবে, দুই সঙ্গীর সলিল সমাধিতে সেই প্রত্যয় দৃঢ় হয়ে গিয়েছে তার মনে।

আর নিজের এই অনিবার্য পরিণতির কথা সম্পর্কে সুনিশ্চিত হয়ে গিয়েই বেঁচে থাকার প্রতিটি মুহুর্তই তার কাছে হয়ে উঠেছে মৃত্যুর অধিক। তিনি হয়ে উঠেছেন জীবন্মৃত।

"কৃষ্ণকান্তের উইল" -এ ভ্রমরের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে বঙ্কিমচন্দ্র দেখিয়েছিলেন, অনুতাপ অনুশোচনার চেয়ে বড়ো শাস্তি আর হয়না। আলোচ্য গল্পটির ক্ষেত্রে অনুশোচনার সাথে ভরাকোটালের জোয়ারের মতো এসে মিশেছে মৃত্যুভয়।

"আমার স্নায়ু স্নায়ুতন্ত্রীকে, ইন্দ্রিয় ইন্দ্রিয়কে, রক্তকণিকা রক্তকণিকা সমূহকে, কোশ কোশকলাকে ধ্বংস করে যাচ্ছে।"

অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের "নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে" উপন্যাসেও মালতী ছিলো এক তরুণী বিধবা নারী। সারা উপন্যাস জুড়ে অমলিন থাকা একটি চরিত্রকে শেষাংশে গণধর্ষিত, লাঞ্ছিত হতে হয় দেশভাগের বিক্ষুব্ধ দাঙ্গার পটভূমিকায়।
এ মালতী আসলে নির্দিষ্ট একজন মালতী নয়, এ আসলে "আত্মজা ও একটি করবী গাছ" এর রুকু, "মানুষের জন্য" গল্পের দুইভাইয়ের অসহায় মা তথা যুদ্ধবিদ্ধস্ত বুভুক্ষু  দেশের অসহায় নারী। বড় অর্থে বিত্রস্ত, লাঞ্ছিত বাংলাদেশ। অত্যাচারে মৃতপ্রায় বাংলাদেশ। হাসতে ভুলে যাওয়া বাংলাদেশ।

এই সমুদ্র হতে পারে সময়ের প্রতীক, হতে পারে পরিস্থিতির প্রতীক, অথবা শুধুই নিয়তি। ম্যাজিক রিয়ালিজমের আতসকাঁচে দেখলে এ আসলে ধর্ষিত অসহায় জীবনের অন্তর্নিহিত প্রতিশোধস্পৃহার গল্প, নেমেসিসের চূড়ান্ত প্রকোপের গল্প।

উইলিয়াম ফকনারকে উদ্ধৃত করে নোবেল পুরস্কার ভাষণে ম্যাজিক রিয়েলিজমের জাদুকর মার্কেস বলেছিলেন, ‘মানুষের অবসান মেনে নিতে আমি অস্বীকার করি। ’ তিনি বলেছেন, ‘সমস্ত দমনপীড়ন, নির্যাতন, লুটতরাজ, আত্মবিক্রয় সত্ত্বেও আমাদের উত্তর হচ্ছে- 'জীবন'। না বন্যা, না মহামারী, না বুভুক্ষা, না প্রলয়ঝড়, এমনকী শতাব্দীর পর শতাব্দীজুড়ে চিরকাল বয়ে চলা যুদ্ধবিগ্রহেও মৃত্যুর ওপর জীবনের নাছোড় প্রাধান্যকে হ্রাস করে দিতে পারেনি।"

এই দৃষ্টিভঙ্গিতে বিচার করলে, মালতীর সমুদ্র হয়ে যাওয়া এবং ধর্ষকদের পরিণতিও আসলে আলোকিত জীবনের জয়ধ্বনির কথাই সূচীত করে।
সমাজ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে রেপ ন্যারেটিভের পাশাপাশি অসামান্য প্রতীকি অর্থে এক আলো আঁধারময় ভাবনার প্রাঙ্গণ লেখক পাঠকদের জন্য রেখে যান গল্পটির ক্ষেত্রে। চৈতন্যের স্তর ভেদ করে মগ্নচৈতন্যের কড়া নাড়া দেয় গল্পটি।

গল্পটির কথনকৌশল অনবদ্য। উত্তমপুরুষ বয়ানে একজন ধর্ষকের জবানিতে এমন ধর্ষকাম মনোপ্রবৃত্তি এবং ধর্ষণোত্তর মানসিকতা প্রকাশক গল্প ভীষণই বিরল।

একজন মৃতাকে মাঝে রেখে তাঁর তিন প্রেমিকের আলাপ আলোচনা ও মনস্তত্ব নিঁখুত ভাবে লিপিবদ্ধ করেছিলেন কথাসাহিত্যিক বিমল কর "আমরা তিন প্রেমিক ও ভুবন" গল্পে।
এখানে একজন ধর্ষিতা নারীর মৃতদেহ সামনে রেখে অনুশোচনা ও আশঙ্কায় বিদ্ধ তারই তিন ধর্ষক পুরুষ। বাইরের আঙ্গিক এবং গভীর সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক নিহিতার্থের পাশাপাশি প্লট নির্বাচনের ক্ষেত্রেও অনবদ্যতার দাবি রাখে এই ছোট গল্প।

মৃত্যুই জীবনের পরপারে একমাত্র ধ্রুব। আর এ গল্পের ধর্ষক তথা কথকের জীবনে সমুদ্রগর্ভে মৃত্যুই অনিবার্য এবং ধ্রুব। তাই বরিশাল থেকে ভোলা গামী স্টিমারের পথে প্রতিটা মুহুর্ত আতঙ্কে এবং আশঙ্কায় পার করতে হয় বেঁচে যাওয়া ধর্ষককে।


সোমা ভট্টাচার্যের অণুগল্প : মাতৃত্ব






সোমা ভট্টাচার্য
মাতৃত্ব


রাস্তার পাশে ব্যথায় ছটপট করা এক  মানসিক ভারসাম্যহীন মহিলাকে তুলে নিয়ে এসে হাসপাতালে ভর্তি করে দিল  পুলিশ। নাম-পরিচয়হীন সেই মহিলা হাড়ভাঙা যন্ত্রনা উপেক্ষা করে অবশেষে ফুটফুটে এক ছেলের জন্ম দিল ।

গর্ভাবস্তা একজন নারী-র সবচেয়ে সুখের সময়। কিন্তু সেই সময় এই 'মা', না পেয়েছে কারোর ভালোবাসা , না পেয়েছে কোনো যত্ন , আদর ------- শুধু পেয়েছে কোনো এক বা একাধিক অজানা-অচেনা পুরুষের 'পুরুষত্বের' ছোঁয়া!

তবুও আজ্ সে 'মা'।

জন্ম দেওয়ার পরই ওই রক্তমাখা নবজাতকে এতটাই জাপটে জড়িয়ে ছিলো সে, কেউ ছাড়াতে পারেনি । ঠিক সেইসময় ভিড়ের ভেতর থেকে একজন প্রশ্ন করলো,' কি-রে তুই তো নিজেই পাগলি , বাচ্চাটা মানুষ করতে পারবি তো ?
------ কী! মা কি ক্ষেপি হয় নাকি?' বলেই আবার হাসতে শুরু করলো সে।

এটাই মাতৃত্ত্ব। এখানেই পৃথিবীর সব শক্তি হার মানায়। কেননা মা তো 'মা'-ই হয়।

'পুরুষত্ব' দেখানো লোকটির পৃতৃত্ব বহনের কোনো ক্ষমতাই নেই, কিন্তু এই 'পাগলি' মা দেখালো মাতৃত্ব কী জিনিস!

শোভন মণ্ডলের অণুগল্প : সমস্যা গুরুতর




শোভন মণ্ডল
সমস্যা গুরুতর


বিক্রমপুরের রাজা মহেন্দ্র সিংহ জরুরি সভা ডাকলেন। সমস্যা খুব গভীর। হন্তদন্ত হয়ে দশ মন্ত্রী  রাজসভায় হাজির। সকলের কপাল ভাঁজ। কী এমন সমস্যা, যে রাজার তলবী সভা ডাকতে হলো!
বহুদিন পর সভা। তাই সকলেই বেশ অপ্রস্তুত। কিন্তু ঠিক সময়ে চেয়ার গ্রহণ করলো সবাই।
রাজা রাজসিংহাসনে আগেই আসীন। মাথা হেঁট। কপালে হাত। গভীর চিন্তামগ্ন।
প্রধানমন্ত্রী শুধাল,  কোনো গভীর সমস্যা রাজামশাই?  যুদ্ধ-টুদ্ধর কোন খবর আছে?
প্রতিরক্ষা মন্ত্রী তড়াক করে লাফিয়ে জানালো,  মোটেই না,  এরকম কোন খবর নেই। সব কিছুই শান্তিপূর্ণ।
প্রধান মন্ত্রী বললো,  তাহলে কি খাদ্য সঙ্কট?
কৃষিমন্ত্রী আপত্তি জানালো,  খাদ্য এখনো উদ্বৃত্ত।
রাজা একবার সবাইকে দেখে বিরক্ত হয়ে আবার মাথা নিচু করলেন।
সারা সভা চুপ। কোখাও কোনো শব্দ নেই। কোলাহল নেই।
সবাই নিঃশব্দে একে অপরের মুখ চাওয়াচায়ি করতে লাগলো।
তাহলে রাজার কি শরীর খারাপ?
স্বাস্থ্যমন্ত্রী সে কথা জানতে চাইলো।  রাজা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা নাড়লেন।
তারপর সবার মুখের দিকে একবার করে দেখলেন।
মৃদুস্বরে বললেন,  কোথাও কোন সমস্যা নেই আমি জানি। আর সেটাই বড় সমস্যা।
সবাই যেন আকাশ থেকে পড়লো। রাজা একি বলেন !
আবার বললেন,  সমস্যা যদি না থাকে তবে আমার থাকার প্রয়োজনটা কী ?  আমার থাকা আর না-থাকার কোন মানে নেই।
এই বলে মাথা নাড়তে থাকেন।
প্রধানমন্ত্রী বললো, মহারাজ তাতে সমস্যাটা কোথায়?
রাজা বললেন,  সামনের বছর ‘ বৃহৎ সভা’। মানে ওইদিন জনসাধারণের মুখোমুখি হবো আমি। সব কিছু যদি ঠিকঠাক থাকে,  দেশে যদি কোন সমস্যাই না থাকে তবে সভাতে জনগনকে কী বলবো?  কী প্রতিশ্রুতি দেবো?
সবাই অবাক। তাই তো। ঘোরতর সংকট। জনগনকে তো প্রতিশ্রুতি দিতেই হবে।
সমস্যা, অভাব-অনটন - এই সব না থাকলে রাজার কী গুরুত্ব?
রাজা বললেন,  আর বেশিদিন নেই। হাতেগোনা কয়েকদিন। এই কটা মাস আপনারা ‘সমস্যা’ তৈরিতে মন দিন । কিছুটা অভাব আনুন। সংকট আনুন। মন দিয়ে কাজে লেগে পড়ুন।

সেইদিন থেকে প্রশাসন ‘ সমস্যা ‘ জিইয়ে রাখতে তৎপর হলো।

মণিদীপা দাসের গল্প : পাপ






মণিদীপা দাস
পাপ

(১)

বৃষ্টিটা একেবারে ঝেঁপে এল। অবশ্য অনেকক্ষণ ধরেই আসবে আসবে করছিল। আষাঢ়ের প্রথম সপ্তাহেই বেশ ঢেলে দিচ্ছে এবছর। নিতাই মন্ডলের মুদিখানা এখন লোকজনে ভর্তি। এমনিতেই এরকম সময় খদ্দের মাসকাবারি সদাইপাতির জন্য ভীড় করতে থাকে। তার উপর বৃষ্টির জন্য যে যেখান থেকে পারে ছুটে এসে ঠাঁই নিয়েছে। সাঁতরাদের মেজো মেয়ে বুলা একঘন্টা আগে থেকে দাঁড়িয়ে আছে। ওকে নিতাই ইচ্ছে করেই দাঁড় করিয়ে রাখে। মিশকালো পেত্নী একটা! চল্লিশ পার হয়ে গেছে। বিয়ে হয়নি। বাপের বাড়ি ঝি গিরি করে কাটায়। কেই বা নেবে ওকে? লম্বা হাড়গিলের মত। ইদানীং আবার গায়ে মাংস লেগেছে কিকরে যেন! রং - চটা চুড়িদারের ভেতর থেকে ভরা বুক চোখে বড্ড বেশী লাগছে। নিতাইয়ের সত্তর পার হওয়া বুড়ো শরীর ভেতরে ভেতরে জেগে ওঠে।

আড়াইটা নাগাদ বৃষ্টি থামল। হাতের মুঠোয় ধরা ফর্দটা আর একবার মিলিয়ে নিল বুলা। দুটো ব্যাগই ভর্তি হয়ে গেছে। যথেষ্ট ভারী ।জর্জেটের ওড়নাটা বাঁ কাঁধ ঘিরে কোমরে বেঁধে নেয় সে। তারপর বাড়ির দিকে রওনা দেয়।

(২)

জলে থইথই দোকানের সামনেটা। পুরোনো ইঁটের রাস্তার ধারে বলে নীচু টুকরো জমি জলে ভরে যায়। বর্ষা বলে শুকিয়ে যেতে পারে না। বুলার হাওয়াই চপ্পলটা একেবারে চলার যোগ্য নয়।  জলের গর্ত এড়ানোর জন্য যেই একটা পা একটু বেশী বাড়িয়েছে টান লেগে একটা স্ট্র্যাপ খুলে গেল। বিচ্ছিরি অবস্থা। আর একটু হলে পা টা পিছলে যেত কিন্তু অনাদিদার ভাইপো সুরঞ্জন হঠাৎ করে ধরে ফেলল বুলাকে। হাঁ করে সবাই তাকিয়ে দেখল, সুরঞ্জন বুলার হাত থেকে বড় বড় দুটো ঝোলা নিজের হাতে তুলে নিল। বুলার মাথাটা অস্বস্তিতে ঝুঁকে গেছে। সুরঞ্জনের পেছন পেছন ছেঁড়া চপ্পলটা আর না ছেঁড়া একপাটি দুটোই হাতে ঝুলিয়ে মাথা হেঁট করে হাঁটতে লাগলো বাড়ির দিকে।

(৩)

"কি কেস রে লালটু?" - দোকানের মধ্যে থেকে পাড়ার ক্লাবের স্বপন বলে ওঠে।

"কি জানি স্বপনদা.. কিছুই তো বুঝতাছি না। সুরোর মাথাটা গেল নাকি একেবারে?"

"দেখগা কিছু লটঘট আছে নাকি?"

"কিন্তু সুরোর তো এই দোষ ছিলনা স্বপনদা। বুলা তো পাড়ার মাইয়া.."

"ওইসবের জন্য পাড়া - বেপাড়া লাগেনারে ভাই.. তয় বুলারে তো কোনদিন কারোর দিকে চোখ তুইলা তাকাইতে দেখি নাই। সবাইরে তো এহনো দাদা কাকা বইলাই ডাকে। "

" এখনো আবাগীর সবকিছু শুকায়নি তো তাই.. "চাপা গলায় হিসহিসিয়ে বলে ওঠে নিতাই মণ্ডল। এতক্ষণ বাকি সবাই স্বপন আর লালটুর কথা শুনছিল। এখন নিতাইয়ের মুখ থেকে যে কথা বেরোলো তাতে একটা হাসির রোল উঠল।দোকানভর্তি সব পুরুষমানুষ।

(৪)

বাড়িতে পৌঁছে যাওয়ার আগেই সুরঞ্জনের কাছ থেকে ব্যাগগুলো প্রায় কেড়ে নেয় বুলা। সুরঞ্জনের জানা আছে কেন ওরকম করল বুলা। শুধু চলে যাবার আগে একবার চারচোখ এক হয়। অনেক না বলা কথা বলা হয়ে যায় যেন।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সুরঞ্জন নিজের বাড়ির দিকে এগোয়। বুলা বড় বড় পা ফেলে ঢুকে পড়ে বাড়িতে। চটি দুটো উঠোনে ছুঁড়ে দিয়ে ব্যাগ নামিয়ে একটু হাঁফিয়ে নেয়। বুকটা বড্ড ধকধক করছে। ভয় আর ভালোলাগা একসাথে মিশে গিয়ে উত্তেজনা বাড়িয়ে দিয়েছে। বড় বৌদির গলার আওয়াজ পেয়ে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয় সে।

চুড়িদারের পায়জামাটাতে কাদার ছিটে লেগেছে ।ওটা ছেড়ে মেঝেতে রাখে। ওপরের জামাটাও খুলে ফেলে। পুরোনো কাঠের আলমারির প্রায় নষ্ট হয়ে যাওয়া আয়নাতে নিজেকে দেখে বুলা। কালো রঙের ব্রা পরা সুন্দর বুকের দিকে তাকিয়ে মনে মনে ভাবে, ভগবান শুধু ওটুকুই দিয়েছেন তাকে। সুরঞ্জনের মুখটা ভেসে ওঠে। চোখ বুজে ভাবনার ঘোরে তলিয়ে যায় সে।

(৫)

বিকেল পেরিয়ে রাত নেমে গেছে অনেকক্ষণ। নটা নাগাদ আজ নিজের ঘরে তক্তাপোষের উপর শুয়ে এক পা অন্য পায়ে তুলে হাত দিয়ে চোখ আড়াল করে একমনে ভেবে যাচ্ছিল সুরঞ্জন ওবেলার কথা। ঘরটা অন্ধকার। আজ আড্ডায় যেতে ইচ্ছে করেনি। আজকাল সুরো প্রায়ই আর আড্ডা মারতে যায়না। কেমন যেন ভালো লাগেনা। একলা ঘরে বড্ড ফাঁকা ফাঁকা লাগে। আর একটা মানুষ যদি থাকত! মানুষ নাকি মেয়েমানুষ? হুম্।মেয়েমানুষই।যে তার একান্ত নিজের।আর কতকাল এভাবে চলা যায়? ভালো লাগলো একদম। বুলার মুখটা ভেসে ওঠে। মেয়েটা কালো কিন্তু মুখটা বড্ড মায়াভরা। ওকে বড্ড আপন করে পেতে ইচ্ছে করে।

কাকা অনাদি ঘোষের একতলার তিনটে ঘরের দুটোতেই একটা পরিবার ভাড়া থাকে। একপাশের ছোট ঘরটা সুরোর জন্য বরাদ্দ। বাপ মা হারা ছেলে। কাকার ব্যবসার জন্য মালপত্র আনাটাই তার কাজ। অনাদি ভাইপোকে নিজের ব্যবসাতে ঢোকায়নি। পাছে ভাগ চেয়ে বসে। তার চেয়ে কিছু কাজ করে দিক। বিনিময়ে দু'বেলা থাকা - খাওয়া আর বাড়ির যত বেগার খাটা ভাইপোকে দিয়ে করিয়ে নেয়। সুরোর বয়সও পঁয়তাল্লিশ ছাড়িয়েছে এবছর ।

(৬)

"আজকে অনাদিদার ভাইপো নাকি তোর ব্যাগ বয়ে দিয়ে গেছে?" বড়বৌদির গমগমে গলায় প্রশ্নটা শুনে পেছন থেকে চমকে উঠল বুলা।সে তো এই ভয়েই কাঁটা হয়ে ছিল। কিন্তু বাধা দিতে পারেনি সুরঞ্জনকে।

আমতা আমতা করে অন্যদিকে তাকিয়ে বলল, "হ্যাঁ"

"কেন? এত দরদ কিসের? তুই না করতে পারলিনা? "

মাথা নীচু করে ঢোঁক গিলে ছেঁড়া জামাটা সেলাই করতে থাকে বুলা।

"শোন, এসব যেন আর না হয়। পাড়ায় কথা উঠেছে। তোর বড়দা এসে বলল। এরপর ওর সাথে দেখা হলে এড়িয়ে যাবি।"

চুপচাপ সেলাইটা চালিয়ে যায় বুলা। বুকের ভেতর বড্ড ভয় করছে। এর আগের দিনের ঘটনাটা তো কেউ জানেই না। সেই যে সেদিন রাত আটটায় রাস্তার ধারে সুরঞ্জনের সাথে তার দেখা হয়েছিল। সুরঞ্জন তাকে টেনে নিয়ে গেছিল অন্ধকার ফাঁকা জমিটার পাঁচিলের গায়ে। না, গায়ে হাত দেয়নি। শুধু হাত দুটো ধরে বলেছিল, "আমায় বিয়ে করবে বুলা? হতভম্ব ভাবটা কাটিয়ে উঠতে কয়েক মুহূর্ত লেগে গিয়েছিল। তারপর অনেকটা অস্বস্তি। কিন্তু আরো অনেকটা ভালোলাগা। কেউ তো আছে যে তাকে বউ করতে চায়। চোখে জল এসে গিয়েছিল। কিন্তু অনেক বাধা। অনেক ভয়। বাড়িতে জানলে রক্ষা নেই যে!

(৭)

"কি সব শুনছি সুরো? তুই নাকি ওপাড়ার বুলার ব্যাগ বয়ে দিয়েছিস পরশু দিন? হঠাৎ করে কি হল? তোর তো মেয়েছেলের দোষ ছিল না! আমার বাড়িতে থেকে এসব চলবে না বাপু বলে দিচ্ছি.."-দুদিন পর অনাদি ঘোষ ভাইপোকে সমঝে দিতে এল।

"মেয়েছেলের দোষ আবার কি? আমি ওসব করিনা। তাছাড়া বুলা তো পাড়ার মেয়ে। তোমরা তো ভালো করেই জানো ওকে। "

" বাব্বা খুব বুলি ফুটেছে দেখছি! ওই কেলে কুচ্ছিত মেয়েটার ওপর এত দরদ হল কিকরে? তোর ব্যাপার কি রে? তুই কি বিয়ে-টিয়ের চিন্তা করছিস নাকি? তা দুটো পেট চালানোর ক্ষমতা আছে তো? ওর তো মা বাপ কেউ নেই। দাদা বৌদিরা দয়া করে খেতে দেয়। "

একটু চুপ করে থাকে সুরঞ্জন। কি বলবে সে? বুলা তো পাকা কথা কিছু দেয়নি। অবশ্য দেবেই বা কিকরে? সবসময় ভয়ে মরে থাকে আর সংসারের যাবতীয় খাটুনি খেটে অনেক রাতে ঘুমাতে যায়।

" শোন সুরো, যা তা একটা মেয়ের খপ্পরে পড়লেই হলনা।তুই বড় হয়েছিস ঢের। ভুলভাল কিছু করার আগে দশবার ভাববি। আর.. তোর বাপ মা যে তোর জন্য কিছুই রেখে যায়নি সেটা তুই জানিস। আমার ছেলেমেয়েদেরকে দিয়ে থুয়ে তোর জন্য আর কিছু দিতে পারব না। আমারও বয়স হয়েছে।" গম্ভীর মুখে ভাইপোকে সাবধান করে দিয়ে অনাদি নিজের ঘরে চলে যায়।

(৮)

মশার কামড়ে অস্থির লাগছে। তবু আওয়াজ করার উপায় নেই। আজ সুরঞ্জন যে ছাড়বে না তা বুঝতে পারছিল বুলা। কিন্তু সে কি করবে? দাদা - বৌদিরা জানতে পারলে শেষ করে দেবে যে!

"শোনো, আর বেশী সময় নেই। সামনের সপ্তাহের মধ্যে নিজের জিনিসপত্র গুছিয়ে নাও। ওরা জানতে পারলে তোমাকে আটকে রাখবে। খুব সাবধানে চলতে হবে।"

"তুমি সত্যিই আমাকে বিয়ে করবে? কিন্তু.. আমি তো খুব খারাপ দেখতে.. আমার তো পয়সাকড়ি কিছুই নেই.. তাছাড়া পাড়ার কেউ মেনে নেবে না। বিয়ে করলে কোথায় থাকব? কি খাবো? "

" আমি শিয়ালদায় একটা আলাদা বিজনেস শুরু করেছি। ওখানেই থাকার ব্যবস্থা হবে। মন্দিরে গিয়ে বিয়ে করে নেব। আমার দু'একজন বন্ধু আছে। "

" কিন্তু আমি.. কিছু বুঝতে পারছি না.. তুমি আমাকে ফেলে পালিয়ে যাবে না তো? তুমি কি সব সত্যি বলছ? "

" এতদিন তো আমাকে চেনো। কখনো খারাপ কিছু দেখেছ?"

সংশয়ভরা মুখে চুপ করে তাকিয়ে থাকে বুলা। বিশ্বাস - অবিশ্বাসের দোলাচলে কি বলবে জানে না সে।

" বিয়ে করতে ইচ্ছে করে না বুলা? আমাকে কি পছন্দ নয়? তবে আমার কেন আজকাল মনে হয় তুমি আমাকে পছন্দ করো? "

অন্ধকার ঝোপের আড়ালে সুরঞ্জনকে জড়িয়ে কেঁদে ফেলে বুলা। মুখের কথা মনের কথা কান্নাতে মিশে বেরিয়ে আসে দ্রুত।

(৯)

"দাঁড়া..কোথা থেকে এলি তুই?" কোমরে হাত দিয়ে বড়দা দাঁড়িয়ে আছে। বুলা কেঁপে ওঠে।

"কিরে? বল? এই রাতের বেলা কোথায় গেছিলি?"

"মিতাবৌদি একটা সেলাই দিয়েছিল অনেক দিন আগে.."হঠাৎ করেই একটা মিথ্যা কথা বলে দিয়ে দ্রুত কলঘরের দিকে চলে যায় বুলা।

ফিরে আসার সময় কান পাতে বড়বৌদির ঘরে। বৌদি ফিসফিস করে দাদাকে বলছে, "এটা তোমার মা লুকিয়ে রেখে গিয়েছিল। আজ পেলাম পুরোনো আলমারিতে ।আমি ঠিক জানি ওটা বুলার বিয়ের জন্য রেখে গেছিল.. "

" আরে.. বেশ ভারী তো হারটা.. তোমার কাছে রেখে দাও। ভুলেও বুলাকে দেখিও না।"

"পাগল? আমার মিনু আর তনুর জন্য অনেক গয়না লাগবে। আমি তো যত সব সোনাদানা ছিল আগেই সরিয়েছি। শুধু এটাই কিভাবে যেন দেখিনি এতদিন.. "

একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ে। বুলা সব জানে। মা বাবার চলে যাবার পর সে যে কিভাবে এই সংসারে বেঁচে আছে তা তার থেকে ভালো আর কে জানে? নিজের ঘরের দিকে এগোয় সে।

(১০)

"কি গো দেখলে?"

"না না কোথ্থাও নেই গো.. কোথ্থাও খুঁজে পেলাম না।"

"তাহলে ভোলাদার কথাই ঠিক।ওই অনাদিদার ভাইপোটাই সব নষ্টের গোড়া।"

"আমি ভাবতেও পারছি না গো.. এত তাড়াতাড়ি কি সব হয়ে গেল!"

"পাপ পাপ.. এর ফল ভুগতে হবে ওকে দেখে নিও তুমি.."

রাত সাড়ে দশটা নাগাদ সবার আড়ালে বাড়ি ছেড়েছে বুলা আর সুরঞ্জন। বৃষ্টি হয়ে যাবার পর রাস্তায় লোক প্রায় নেই। বেশীরভাগ বাড়ির জানলা বন্ধ। বুলা রাতে খাবার পর কলতলায় এঁটো বাসন মাজার নাম করে গেট খুলে বেরিয়ে আসে। আগেই রেডি ছিল। বৌদি এইসময় টিভি সিরিয়াল দেখে।ভাইঝিরা ঘুমিয়ে পড়েছে। বড়দা বাথরুমে আর ছোড়দা ছোটবৌদি বেড়াতে গেছে।

দুজনে আলাদা রাস্তা ধরে খানিকটা হেঁটে স্টেশন পৌঁছে দ্রুত শিয়ালদহগামী ট্রেনে উঠে পড়েছে। অল্পই লোকজন এসময়। সামান্য জিনিসপত্র নিয়ে পাশাপাশি বসল দুজনে। এতক্ষণ ভয় ছিল খুব। কিন্তু এখন অনেকটা ভালো লাগছে। সুরঞ্জনের গাঁ ঘেঁষে বসে বুলা। সে ডান হাত দিয়ে বুলাকে আগলে রাখে। বাঁ হাতটা ধরে আছে বুলার বাঁ হাত। ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। নতুন গন্তব্যের উদ্দেশ্যে।

শ্যামল সরকারের গল্প : সময় ফুরিয়ে যায়





শ্যামল সরকার
সময় ফুরিয়ে যায়



নিধু বিয়ে করতে যাচ্ছে । বরযাত্রী সাথে  দু’জন ------ নিধুর দিদি মনোরমা আর জামাইবাবু বিমল । বিমলের বাই-সাইকেলের পেছনের ক্যারিয়ারে পা দুলিয়ে বসেছে মনোরমা । নিধু বিমলের ধুতি আর পাঞ্জাবী পড়ে  বর সেজেছে । দীর্ঘদিন বাক্সে ভরা ছিল ওগুলো । তাড়াহুড়োতে আর ধুয়ে নেবার সময় হয় নি । গলায় একটি গাঁদা ফুলের মালা । বাড়ীতেই ফুটেছে রাশি রাশি পেচি গাঁদা ।  নিধু নিজের বাইসাইকেলে একা । ঢ্যাঙ্গা জামাইবাবু বিমলের পাঞ্জাবির ঝুল বেটে খাটো নিধুর প্রায় পা পর্যন্ত নেমে এসেছে । মনোরমা বলল ---- এটাই ভাল হয়েছে, ময়লা কোঁচকানো ধুতিটা আর দেখা যাচ্ছে না । প্রায় তিন মাইল পথ পেরিয়ে পাশের গাঁ কেস্টপুরে গুলতিদের বাড়ী ।  সাইকেল চলছে ।  ভাঙাচোরা পথ । বিমল তাড়া দিচ্ছে ---- তাড়াতাড়ি সাইকেল চালা নিধু, সন্ধ্যার আগেই পৌঁছতে হবে বিয়েবাড়ি । শুক্লপক্ষের পঞ্চমীর প্রথম রাতের গভীর অন্ধকারে ঐ দুর্গম এই পথে যাওয়া সম্ভব নয় । সান্তনা দেয় সে ---- বিয়ে শেষ হতে হতে জ্যোৎস্না ফুটবে । তখন আর রাধাপুর ফিরতে অসুবিধা হবে না । বিয়ের পর শেষ রাতের জ্যোৎস্নালোকে নিধুর সাইকেলের ক্যারিয়ারে চেপে প্রথম শ্বশুরবাড়ি যাবে  বালিকা বধূ গুলতি । নিধুর মনটা বেশ ফুরফুরে লাগছে । গুলতিটাকে কী সুন্দর লাগছিল গতকাল যখন ও বাড়ীতে মেয়ে দেখতে গিয়েছিল । হাসি হাসি মুখ । নাদুস নুসুস চেহারা । কী সুন্দর তেলতেলে শরীর । ঘটক বলছিল ---- এখন এই যে কালো দেখছ, বিয়ের জল পড়লেই দেখো, টকটকে ফর্সা হয়ে যাবে । নিধু মনে মনে গুলতির ফর্সা চেহারাটাও যেন দেখতে পাচ্ছিল । কী সুন্দর !

    সাইকেলের ক্যারিয়ারে বসে আছে নতুন বৌ । ঘোমটায় মুখ ঢাকা ।  নিধুর বড়ো ইচ্ছে করছিল বউয়ের মুখটা দেখতে । কিন্তু লাজুক মেয়েটি শুভদৃষ্টির সময়ও মুখ তোলে নি ।  নিধু বলেছে কোমরটায় জড়িয়ে ধরে রাখো । উঁচুনিচু রাস্তা, পড়ে যাবে । আকাশে কী সুন্দর চাঁদ উঠেছে । চাঁদের আলোয় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে রাস্তা । বিমল মনোরমার সাইকেল সামনে ।    পিছু পিছু নতুন বর-বৌ । নিধু ভাবছে --- অমনই চাঁদমুখ গুলতি তাকে পেছন থেকে জড়িয়ে আছে । কী সুন্দর নরম স্পর্শ । ভেবে ফেলেছে --- আজ রাতে আর ঘুমোবে না । কালরাত্রির বিধিনিষেধও মানবে না কিছুতেই ।

    ওরা বাড়ী পৌঁছল এক সময় । মেয়েলি আচারের পর অন্য ঘরে বউয়ের শোবার আয়োজন থাকলেও তাকে নিজের ঘরে নিয়ে গেল নিধু  । এতক্ষণে  ঘোমটা সরল বউয়ের । বয়সের ভারে চামড়া কুচকে যাওয়া, দাঁত ফোকলা স্ত্রীর মুখ দেখে অবাক নিধু । জিজ্ঞেস করল ---- কে তুমি ? তুমি তো গুলতি নও ! বৌ বলল ---- আমি রিতু । গুলতি আমার নাতনী, ভাইপোর মেয়ে । সবাই ওকে রসিকতা করছিল তোমার হবু বৌ বলে । আর দেরি করল না নিধু, একটি গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে শুয়ে পড়ল তক্ষুনি । হাই তুলে বলল --- আজ কালরাত্রি, তুমি ওঘরে শুতে যাও । বাঁশের ঘরের ফাঁকফোকর দিকে উঁকি দেওয়া চাঁদ ততক্ষণে হারিয়ে গেছে মনখারাপের মতো একখণ্ড মেঘের তলায় ।

    আসামের চা বাগানে কাজ করে নিধু ----- তেজপুর । সরদারের কাজ । কুলিকামিনরা কত মান্যি করে । বিছানায় শুয়ে মনে মনে ভাবছিল নিধু ওদের কথা । ঘুম আসছিল না কিছুতেই । একটা চরম কষ্ট মনের ভেতর ভিড় করে আসছে । নিজের গালেই চাপড় মারতে ইচ্ছে করছে চরম বোকামোর জন্য । একটা অন্য কথা মনে এল । তেজবাহাদুরের মেয়ে টগরীটার সাথে ওর ভাব হয়ে গিয়েছিল ।  একদিন চলে এসেছিল টগরী ওঁর ঘরে কিসের যেন এক ছুতোয়, আজ আর মনে নেই । ওর ভরাট শরীর, মিষ্টি হাসি দেখে নিজেকে আর সামলাতে পারে নি । সেইই প্রথম মনের ভেতর উথাল পাথাল অবস্থা । ঘরের ভেতরে ডেকে এনেছিল ।  জামা খুলেছিল টগরী, ভেতরের ছোট জামাও । ঘোর লেগে গিয়েছিল তখন নিধুর । সারা শরীরে একটা প্রবল উত্তেজনা । বেড়ে গিয়েছিল বুকের লাবডোব । মাথা ঘুরছিল । হঠাৎ কী যেন হয়ে গিয়েছিল তার ---- আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারে নি । কাত হয়ে পড়ে গিয়েছিল বিছানায় । অচেতন । একটু বাদে জ্ঞান ফিরলে দ্যাখে ----- কী সব বিশ্রী গাল পাড়তে পাড়তে টগরী মিশে যাচ্ছে সবুজ বাগিচার গহীনে । টগরী আর ফিরে আসে নি কোনদিন । শুনেছে কোন এক বাগিচা শ্রমিকের সাথে ঘর বেঁধেছে সে ।  এরই মাঝে রিতুর মুখটা ফিরে এল মনের মধ্যে । একটু বেচারি বেচারি চেহারা । বেশ বয়স হয়েছে । অনটনের চাপ বয়সটাকে একেবারে ঘেঁটে দিয়েছে । কিছুতেই ওটা আন্দাজ করা যাচ্ছে না । ত্রিশও হতে পারে, ষাটও হতে পারে ।  রাত শেষ হয়ে আসছে ।  নিধুর মনের চঞ্চলতাও ধীরে ধীরে থিতু হয়ে আসছে । কোথায় যেন শুনেছিল জন্ম-মৃত্যু-বিবাহ --- এই তিনের উপর মানুষের কোন হাত নেই । এসব ঈশ্বরের ঠিক করাই থাকে । মন বলছে নিধুর --- রিতুকে অস্বীকার করা তো ঈশ্বরের ইচ্ছেকে অস্বীকার করা । এভাবে ভেবে একটু শান্তি পেল নিধু । স্থির করে ফেলল ---- না, কিছুতেই নয়, রিতুকে অস্বীকার করবে না । তখন চোখে ঘুম নেমে এল । স্বস্তির ঘুম । অনেক বেলা পর্যন্ত ঘুমালো সে ।

     দুপুরবেলা নিয়মরক্ষার  ভাতকাপড় আর বৌভাত হল । বিকেলে ট্রেন ধরল দু’জন । আসামের ট্রেন । জেনারেল কম্পার্টমেন্টের একটু খানি সীটে গাদাগাদি করে বসল নিধু-রিতু । ট্রেন চলছে । রিতু বলল ---- আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ গো ? নিধু বলল ---- বহুদূর ।  নিজের বাড়ী যেতে হবে না ?

রিতু কিছু না বলে বরের ঘাড়ে মাথা রাখল । চোখ বোজা । যেন সে সঁপে দিয়েছে নিজেকে পুরোপুরি পরম বিশ্বাসে ।  বড়ো ভাল লাগছে নিধুর । সে জীবনে কোনদিন কারো মনের এত কাছে যেতে পারে নি ।  কারো কাছে এত বিশ্বাসের পাত্র হয় নি জীবনে । নিধু মুখের খুব কাছে মুখ এনে বলল ---- ভয় পাচ্ছ ?

রিতু চোখ বুজেই বলল --- তুমি তো আছ । ভয় কিসের । নিধুর মনে বড় বিস্ময় জাগল ---- সামান্য কটি মন্ত্রতন্ত্রের এত জোর ! যদিদং হ্রদয়ং তব, তদিদং হ্রদয়ং মম ...... ।  এতেই দুটো অপরিচিত মানুষের মনে জন্ম নিল অপরিসীম নির্ভরতা ! এত ভাললাগা ! প্রশ্ন জাগল মনে ---- কী করে হয় এসব ?  তক্ষুনি আসামগামী ট্রেনটি প্রবল ঘট ঘট শব্দ করে একটি রেলসেতু পেরোল ঝড়ের বেগে  । রিতু প্রায় চেপে ধরেছে নিধুকে । নিধু বলল । একটু ঘুমিয়ে নাও । রিতু মাথা রাখল নিধুর ঘাড়ে । মুদ্রিত চক্ষু, স্থির ।



       আসামের চা-বাগানে পৌঁছে গেছে তারা । তখন সকাল । চারপাশ ভেসে যাচ্ছে প্রভাতের নরম রোদ্দুরে । সেখানে জনবসতি খুব হালকা ।  চার দিকে বিস্তৃত সবুজের সুবিন্যস্ত সমারোহ দেখে রিতু অবাক । সে বলল ---- এত সুন্দর জায়গায় কাজ করো তুমি ! আমরা এখানে থাকব ? নিধু বলল ---- হুম । আমরা এই সবুজের সন্তান । বাগিচা বাগান আমাদের মা ।  আমাদের অন্নদাত্রী । আমরা দু’জন এই মায়ের কোলে কাটিয়ে দেব বাকী জীবন ।  নিধুর কথায় যেন আলো ফুটেছে রিতুর মুখে । নিধু স্থির  চোখে তাকাল রিতুর চোখে চোখ রেখে ।  হঠাৎ সে দ্যাখে ---- প্রবীণা রিতু ঐ নির্মল অরুণালোকে বদলে গেছে আচমকা । নিধুর সামনে  দাঁড়িয়ে কিশোরী গুলতি তখন মিটিমিটি হাসছে  সকালের সূর্যের মতো । বিস্ময়ে বিমূঢ় ।  নিধুকে তখন তাড়া দিল কচি নববধূ  --- কই, নিয়ে চলো তোমার ঘরে, চটপট । প্রবল উচ্ছাসে তখন তারা প্রায় দৌড়াতে শুরু করেছে বাঁধন হীন স্রোতের মতো ---- উচ্ছল, ছলছল । পাশ থেকে কে যেন চিৎকার করে উঠল ----  কত গই আছা নিধু, কিয়  দৌড়ি আছা ?

উত্তর দিল নিধু ছুটতে ছুটতেই ----- সংসার করতে যাই কাকা,  ছোট্ট জীবন, সময় ফুরিয়ে যায় যে  চোখের নিমেষে ।



আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ছোটগল্পে নারী : জয় দাস





আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ছোটগল্পে নারী
জয় দাস

‘মাটি জল বায়ু অগ্নি এবং মানুষ
ভারতবর্ষ তোমাকে প্রণাম করেই
সেই ইতিহাসে কোণঠাসা নারী আমরা
শুরু করলাম কথামানবীর ভাষ্য’
মল্লিকা সেনগুপ্ত১

ভারতবর্ষ কেন পৃথিবীর যে কোনো দেশের ইতিহাসেই নারীরা দীর্ঘ সময় ধরে হয়েছে উপেক্ষিত, নির্বাসিত। অসভ্যযুগে যৌথবিবাহ(Group Marriage), বর্বর যুগে জোড় পরিবার(Pairing Marriage) এবং সভ্যযুগে একনিষ্ঠ বিবাহ(Monogamy) পদ্ধতির মাধ্যমে যেভাবে সমাজ রূপ পায় মাতৃতান্ত্রিকতা থেকে পিতৃতান্ত্রিকতায় ও সামাজিক শিক্ষা, সংস্কৃতি, মানসিক চিন্তাধারা থেকে নারীরা বঞ্চিত হয়ে স্থান পায় রান্নাঘর ও আঁতুড় ঘরের একঘেয়ে দাসত্বজীবনে। সেই দাসত্বজীবন প্রথম প্রশ্নের সম্মুক্ষীণ হয় শিল্পবিপ্লবের মাধ্যমে। কারণ এই প্রথম নারীরা অর্থনৈতিক উৎপাদন ব্যবস্থায় সরাসরি অংশগ্রহণ করে।২ সেইসময় যে বইগুলি লেখা হয় ‘Declaration of the Rights of Women’(Olympede Goleges : 1791) ও ‘Vindication of the Rights of Women’(Mary Wollstone Craft : 1792) – বইগুলিতে প্রতিবাদের কারণ ছিল অধিক কায়িক শ্রম করে পুরুষদের তুলনায় কম বেতন পাওয়ার ক্ষোভ আর সরকারের চোখে, আইনের চোখে ও শিক্ষার ক্ষেত্রে মেয়েদের সমান অধিকারের দাবী।৩ আমাদের ভারতবর্ষে কিন্তু নারীমুক্তি কথাটি নিয়ে আসেন ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত কিছু জ্ঞানাণ্বেষী ব্যক্তিরা। আমাদের দেশে নারীরা অর্থনৈতিক স্বাধীনতা নিয়ে লড়াই করেছেন আরও কিছুদিন পরে। কাদম্বিনী গাঙ্গুলি, বেগম রোকেয়া প্রভৃতি মণীষী নারীদের কথা উল্লেখ করেও বলা যেতে পারে ভারতবর্ষে দুই বিশ্বযুদ্ধের টানাপোড়েন, দ্বন্দ্ব, মূল্যবোধের অবক্ষয়ের দিনগুলিতে ভারতবর্ষের নারীরা নিজেরা নিজেদের বাঁচাতে শেখে, ঘরের অন্তঃপুর থেকে বাইরে বেরিয়ে আসে। কিছু বুভুক্ষু পুরুষের চোখে নারী কিন্তু শরীর ছাড়া আর কিছু নয়, তাই দুর্ভিক্ষ(১৯৪৩) দাঙ্গা(১৯৪৬) দেশভাগ(১৯৪৭) ঘটনা যাইহোক না কেন সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত, ধর্ষিত, আহত হতে হয় নারীদের। তবু হার না মানা নারীরা ’৫২-এর ভাষা আন্দোলনে পুরুষদের সাথে তাল মিলিয়ে চলে, ’৬৯-এর গণ আন্দোলন কি নারীদের ছাড়া এমন বড় ‘গণ’ হতে পারত ? আবার ’৭১-এ চরম নির্যাতিত হতে হতে এই নারীরাই শেখে মড়া থেকে মারা। এ বিদ্রোহ অন্তহীন কেননা আধুনিকতার আভরণে সমাজ আবার সেই নারীদের পড়ায় শৃঙ্খল। যেমন নারীরা শিক্ষিত হয়েছে কত সংগ্রামের মধ্যদিয়ে সেই শিক্ষিত নারীদের ‘শিক্ষা’ আজ বিয়ের একটি উল্লেখযোগ্য বিশেষণে কি দাঁড়ায়নি ?
বিভিন্ন পত্র পত্রিকার বিজ্ঞাপন গুলি সেই কথাই কিন্তু বলে। তবে কিছু কিছু পুরুষেরা যেমন নারী মুক্তির পথে বাঁধা তেমনি কিছু কিছু নারীরাও - সংস্কারের দ্বন্দ্ব, বিজ্ঞাপনের চমক প্রলোভনে কিছু নারীরা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য থেকে পৌঁছে যায় ব্যক্তিসর্বস্বতায়। সেখানে পোশাকে হয়ত আধুনিকতা আসে কিন্তু মননে নয়।
‘আসলে সেই পুরোনো তত্ত্বেই ফিরে যেতে হয় – সমাজ বদল। এর কোনও বিকল্প নেই। কী বর্জন করবে, কে বর্জন করবে, কেন বর্জন করবে এ বিষয়ে পরিস্কার ধারণা না জন্মালে কেবল পোশাকই বর্জিত হবে, ঘুণে ধরা পুরোনো সংস্কার গুলো লেপটে থাকবে সারা গায়ে। ওগুলো বর্জন করতে জ্ঞান, চিন্তাশক্তি দরকার হয়, ওটা হেয়ার রিমুভারে হয় না।’৪
আর তাই-
‘জিনসের প্যান্ট, স্কিন টাইট টপ অথবা মিনিজ এবং টিশার্ট পরিহিতারা আধুনিক সাজে সজ্জিত হয়ে, আটশ টাকার জুতো, বারোশ টাকার অত্যাধুনিক বিদেশি সানগ্লাস পরে ঘটিতে দুধ নিয়ে গনেশকে খাওয়াতে ছোটে।’৫
ছোটগল্পকার আখতারুজ্জামান ইলিয়াস(১২-ই ফেব্রুয়ারি ১৯৪৩ – ৪ জানুয়ারি ১৯৯৩) শুধু বাংলাদেশেরই একজন শ্রেষ্ঠ অন্যতম গল্পকার নন, বিশ্বের অন্যান্য দেশেও তিনি সমাদৃত। তাঁর নির্মম কৌতুকবহ বাচনভঙ্গী, সরস নির্মোহ ভাব লেখনীর ক্ষেত্রে তাঁকে অনন্য করে তোলে। তিনি তাঁর গল্পের বয়ানে ব্যবহার করেন পর্যাপ্ত ডিটেলস, তাই দিয়ে ফুটিয়ে তোলেন স্বপ্নের জগৎ, কুসংস্কার, যৌন জীবনযাপন এবং প্রায় সবকিছুই, তিনি সাহিত্যে জুড়েন। সেখানে বাদ যায়না প্রতিদিনের ব্যবহৃত তথাকথিত অশ্লীল ভাষাও। যার ফলে বাংলাদেশের অন্যান্য শ্রেষ্ঠ গল্পকার থেকে তাঁকে আলাদা করে চিনে নিতে আমাদের কোন অসুবিধে হয় না।
আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের পাঁচটি ছোটগল্প গ্রন্থে প্রকাশিত হয় মোট ২৩টি ছোটগল্প৬ । কিন্তু ঢাকার মাওলা ব্রাদার্স থেকে খালিকুজ্জামান ইলিয়াসের সম্পাদনায় আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের যে রচনাসমগ্র বার হয় চারটি খন্ডে তার এক ও চার নম্বর খণ্ড মিলিয়ে আমরা মোট ৩২টি (রচনাসমগ্র১ – ২৩টি গ্রন্থিত গল্প + রচনাসমগ্র৪ ৯টি অগ্রন্থিত ছোটগল্প) ছোটগল্প হাতে পাই। ইলিয়াসের নারী নিয়ে ছোটগল্পের সংখ্যা হাতে গোনা। তিনি বাস্তবধর্মী লেখক তিনি বাস্তবকে যেমনটি দেখেছেন তেমনটি(বাইরে ভিতরে) তাঁর কলমের আঁচড়ে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। সাহিত্য বাস্তব ছাড়া নয়, বাস্তব মানবসম্পদ ছাড়া নয় আর মানবসম্পদে নারী-পুরুষ দু’জনেই অংশী। ইলিয়াসের ছোটগল্প গুলি থেকে নারীর মাতৃত্বের দিক, ফ্রয়েডিয়ান যৌনতার দিক, মুক্তিযুদ্ধের প্রতি বিশ্বাসের দিক, গ্রামে প্রতারিত নারী, লোভাতুর নারী – ভালো খারাপ নির্বিশেষে সবকিছুই ফুটে ওঠে। এক নির্বিকারত্ব দৃষ্টিভঙ্গি থেকে।
‘আমি(আখতারুজ্জামান ইলিয়াস) নির্দিষ্ট কোনো Philosophy মাথায় রেখে reality দেখি না। Reality –কে আমি ভেতর থেকে দেখতে চাই। কিন্তু আমি তো  Journalist না,  reality মানে যা আমি দেখতে পাচ্ছি কেবল তাই নয় -  এর ভেতরকার স্বপ্ন সাধ সংকল্প সংস্কার কুসংস্কার সবই reality-র ভেতরকার reality’৭
ইলিয়াসের ‘যোগাযোগ’(গল্পগ্রন্থ- ‘অন্যঘরে অন্যস্বর’, মে,১৯৭৬) গল্পটি বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে রচিত হলেও এটি একটি বিশ্বজনীন সমস্যায় রূপান্তরিত হয়। মাতা ও সন্তান-এর মধ্যে সন্তান বড় হবার সাথে সাথে সম্পর্কের যে ব্যবধান বাড়তে থাকে ‘যোগাযোগ’ সেই সমস্যার গল্প হয়ে ওঠে। রোকেয়া তার খোকন কে রেখে যায় বাপের বাড়ি অনেকদিন পর সেখানে গিয়ে সে হারিয়ে যায় শৈশব স্মৃতি মধুরতায়, কিন্তু খোকনের ঘটে বিপত্তি, সে দোতলার কার্নিশ থেকে পড়ে গিয়ে পা ভেঙ্গে ফেলেছে। রোকেয়া ভাবছে তার সন্তানের এই বিপত্তি তার বাড়িতে না থাকার দরুন। আবার এও ভাবছে যে তার খোকন যদি তাকে দেখে তাহলে তার সব ব্যথার উপশম হবে। কিন্তু বাস্তবে তা ঘটে না । হাসপাতালে রোকেয়া গেলেও ‘রোকেয়ার হাতের তালুর নিচে খোকনের জ্বরের তাপ বাড়ে শুধু’৮। লেখক নিজের গল্প সম্পর্কে জানান আমাদের-
‘আমি বলতে চাইছিলাম একজন মা- with her all affection, motherhood, বাৎসল্য- একটা পর্যায়ে ছেলের সব কষ্ট লাঘব করতে পারে না। রোকেয়া ছেলের অসুস্থতার কথা শুনে ফিরেছে। ...সে যখন ছেলের কাছে পৌঁছাচ্ছে তখন তার গাঁয়ে ১০৩০ জ্বর কম্বলের মত জড়িয়ে। রোকেয়া হাত দিচ্ছে কিন্তু সে-হাত ঐ কম্বল ভেদ করে ছেলের কষ্টের কাছে পৌঁছাচ্ছে না। ...ছেলে যখন বড় হতে থাকে মায়ের সাথে এক পর্যায়ে আর যোগাযোগ ঘটে না। যে মায়ের উপর তুমি দারুণ dependent ছিলে একসময় , এক পর্যায়ে তার সাথে তোমার সব কষ্টের আর যোগাযোগ ঘটছে না। তুমি তোমার সব problem আর share করতে পারছ না। হয়তো তোমার প্রেমের সমস্যা বা কোনো philosophical crisis দুজনের সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও তা হয় না, এটা দুজনের জন্য খুব বেদনাদায়ক। তবু এটাই সত্য।’৯
এটা গল্পে যে রোকেয়া ও তার খোকনের মধ্যে হয়েছে তা নয়, এটা হয়েছে স্ত্রী হারানো সোলায়মান আলী(রোকেয়ার বাবা) আর রোকেয়ার মধ্যেও। খোকনের খবর শোনার পর ট্রেনে বিরতিহীন রোকেয়ার কান্না দেখে সোলায়মান আলীর মনে হয়-‘এতো আদর এতো ভালোবাসা ওর কষ্ট কি একটুও কমেনা ?’(‘যোগাযোগ’, পৃষ্ঠা- ৫৪)। এ গল্পের যে সমস্যা তা অনেক পুরোনো। যে কারণে কার্তিক ঠাকুরের সাথে উমার বিয়ে হয়নি, ও কার্তিক চিরকুমার। কারণটি মা দুর্গার অভিমান, পাছে বৌ আসলে মায়ের আদর কমে। কিন্তু দেখবার বিষয় বিবাহ নামক ব্যবস্থায় মধ্যবিত্ত বাঙালি নারীকে, যে চাকুরীরতা নয়, তাকে সর্বদা সময়ের ব্যবহার করতে হয় সংসারে। এই সংসারে তাদের  সর্বাধিক অধিকার ফুটে ওঠে দুটি সম্পর্কের মাধ্যমে-

এই নারীর প্রণয়ী ও মাতৃত্বের দ্বন্দ্বের চরম অভিঘাত লক্ষ্য করি আমরা বনফুলের ‘বুধনী’ গল্পের মাধ্যমে। তাহলে যে নারীর এতটা সময় পার হয় ‘মাতৃত্ব’ সম্পর্কের মাধ্যমে তার অধিকার হঠাৎ করে অন্য কেউ যখন নেয় তখন দ্বন্দ্ব অবশ্যম্ভাবী। সুতরাং শাশুড়ি ও বৌ –এর সম্পর্কের এই গুপ্ত টানাপোড়েন শুধুমাত্র নারী সম্পর্কের মিথ বলে উড়িয়ে দেওয়া চলে না। তার ভুল-ভ্রান্তি খুঁজতে হবে আমাদের গভীর সামাজিক সম্পর্কের মানসিক টানাপড়েন গুলিতেই। না হলে ‘চোখের বালি’(১৯০৪) উপন্যাসের মত সংসারের সমস্ত সম্পর্কের টানাপোড়েনের দোষ ‘মাতৃ-ঈর্ষা’র উপর পড়তে বাধ্য, আজও। এও পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় নারীর চরিত্রের চরম অবমাননা ছাড়া আর কি?
ইলিয়াসের সেপ্টেম্বর, ১৯৮২ সালে প্রকাশিত ‘খোঁয়ারি’ গল্পগ্রন্থের একটি উল্লেখযোগ্য গল্প হল ‘তারাবিবির মরদ পোলা’। এটি একটি ফ্রয়েডিয়ান যৌন মনস্তত্ত্বের গল্প। রমজানের দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী তারাবিবি। বয়সের ব্যবধানের দরুন তারাবিবির দাম্পত্য স্বাদ কিছুটা তিক্ত- ‘তুমি (রমজান) তো একখান মরা মানুষ! তামামটা জিন্দেগী ভইরা খালি বিছানার মইদ্যেই পইড়া রইছ, একটা দিন বুঝবার পারলা না আমি ক্যামনে কি পেরেশানির মইদ্যে ঘরবাড়ি চালাই।’(‘তারাবিবির মরদ পোলা’,পৃষ্ঠা-১৩৪) আর সেই কারণে তারাবিবি তার ছেলে গোলজার কে অহেতুক সন্দেহ করে। এবং গোলজার ও তার স্ত্রী সখিনার মধ্যে সর্বদা লড়াই বাধানোর চেষ্টা করে। কিন্তু যেদিন সত্যি গোলজার পরকীয়ায় যায় সেদিন এই তারাবিবি-ই বলে তার স্বামীকে- ‘পোলায় আমার জুয়ান মরদ না একখান? তুমি বুইড়া মড়াটা, হান্দাইয়া গেছো কব্বরের মইদ্যে, জুয়ান মরদের কাম তুমি বুঝবা ক্যামনে?’ (‘তারাবিবির মরদ পোলা’,পৃষ্ঠা-১৪৭) তারাবিবির মধ্যে দ্বন্দ্ব এভাবেই কাজ করে। তারাবিবির এই দ্বন্দ্ব   দুটি সম্ভাব্য কারণ দিয়ে দেখা যেতে পারে-
এক। তারাবিবি নিজের অদম্য ইচ্ছে(id) সরাসরি পূরণ করতে পারছে না, সামাজিক বিধিনিষেধের(Ego, Superego) জন্য তাই সেটি সে পূরণ করতে চাইছে অন্য পথে, পুত্র গোলজারের হাত ধরে।
দুই। যেহেতু তারাবিবি নিজের দাম্পত্য জীবনে সুখী নয়, তাই তার পাশাপাশি নিজের ছেলের সুখী গৃহকোণ তার চোখে জ্বালা ধরাবে সেটাই তো স্বাভাবিক।
তারাবিবির এই মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব কে ফ্রয়েডিয়ান ভাষায় বলা হয় ‘ডিফেন্স মেকানিজম’। এর অনেকগুলি ভাগ। তারাবিবি’র যেটি তাকে বলা হয় ‘Projection’ অর্থাৎ নিজের অদম্য ইচ্ছে গুলিকে অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে তাকে দোষারোপ করা –
‘This involves individuals attributing their own unacceptable thoughts, feeling and motives to another person’১০
তারাবিবির এই দ্বন্দ্বের কারণ লুকিয়ে আছে মূলত পুরুষ তান্ত্রিক সমাজেই কারণ আমাদের সমাজে আজও পুরুষের পরকীয়া বা দুটি বিয়ে দোষের হয় না, দোষটা হয় মেয়েদের বেলাই। তাই রমজান বৃদ্ধ বয়সে (নিজের সাধ্যের বাইরে বেরিয়েও!) তারাবিবিকে বিয়ে করতে পারে। কিন্তু তারাবিবিকে তার অদম্য ইচ্ছে পূরণের জন্য ব্যবহার করতে হয় ‘Projection’-এর চোরাপথ। ইলিয়াস কিন্তু নর-নারীর প্রেম কে বিয়ে নামক প্রতিষ্ঠানে না বেঁধে স্বাধীনভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রত্যাশা রাখতেন।
‘একজন সভ্য নারী আর পুরুষের পরস্পরের প্রতি যদি অনুমোদন থাকে সেখানে তাদের মিলনে কোনো সংস্কার, অপরাধবোধ, পাপবোধ যেন বাধা হিসেবে না-আসে, সে-রকম সোসাইটি কোনোদিন আসবে কি না জানি না, কিন্তু যা আসবে না তাকে প্রত্যাশা করব না কেন?’১১
গল্পগ্রন্থ ‘দুধেভাতে উৎপাত’-এর (ফেব্রুয়ারি,১৯৮৫) একটি খুব সুন্দর গল্প হল ‘মিলির হাতে স্টেনগান’। গল্পটি মুক্তিযুদ্ধের পরের স্বপ্নভঙ্গের গল্প। বাংলাদেশের সাথে জড়িয়ে আছে মুক্তিযুদ্ধের(১৯৭১) রক্তদাগ। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের পরের ইতিহাস আলাদা। মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে ইলিয়াস মনে করতেন  যে-
‘মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমাদের দারুণ স্বপ্ন ছিল। ...এত স্বপ্ন দেখার তো কোনো মানে ছিলনা। মুক্তিযুদ্ধ তো তেমন organized কিছু ছিল না, তা ছাড়া এর definite কোনো goal-ও ছিল না। সাধারণ মানুষ কৃষকেরা যে যুদ্ধ করেছিল তা তো কোনো আদর্শ থেকে করেনি। করেছে, কারণ না-করলে তারা মারা পড়ত। আর মুক্তিযুদ্ধের পরের সময়টা তো চরম স্বপ্নভঙ্গের কাল। ...Positive হলো মানুষের প্রতিরোধ করার সংকল্প, মানুষের সাহস।’১২
মিলি তবু আশা রাখে আব্বাস পাগলার উপর। তার পাগলামি শুরু মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে। আব্বাস পাগলা মনে করে দুশমনেরা এখন আকাশ, চাঁদ সব দখল করে নিচ্ছে, আব্বাস পাগলা তাদের আটকাতে পারে কিন্তু তার জন্য চাই স্টেন গান। তাই মিলি আব্বাস পাগলা কে অন্য সকল থেকে আলাদা করে চিনতে পারে। মিলির দাদা রানা একসময়ের মুক্তিযোদ্ধা এখন অপরাধ মূলক কাজ করে, রাজনৈতিক নেতাদের সাহায্যে উঠতি বড়লোক। মিলির দাদার বন্ধুরাও তাই। মিলির মা তাদের মধ্যে কোনো পয়সাওয়ালা দাদার বন্ধুর সাথে মিলির বিয়ে দিতে চায়। কিন্তু মিলি তাদের আলাদা করতে পারে না। সে তাদের মধ্যে আলাদা করতে পারে একমাত্র আব্বাস পাগলা কে। এই আব্বাস পাগলাই শেষে ভালো হয়ে যুদ্ধ ভুলে যায়। রানার কাছে আসে কাজের সাহায্য চাইতে। মিলির কাছে তখন আব্বাস পাগলাও সকলের সাথে ভিড়ে মিশে যায়। মুক্তিযুদ্ধে অনেক মেয়েরাও শহীদ হয়। মিলি আব্বাস পাগলার মাধ্যমে সেই লড়াইয়ের মধ্যে মিশে যেতে চায়, তাই তো সে  শেষে দাদার স্টেনগান চুরি করে আব্বাস পাগলা কে দিতে চায়, কিন্তু আব্বাস পাগলা তখন সুস্থ আর বাংলাদেশের মত মিলিরও হয় স্বপ্নভঙ্গ কেননা আব্বাস পাগলাও সকলের সাথে ভিড়ে হারিয়ে যায়।
এখন সময়ে বিত্তই করে মান বিচার। বিশেষণে হারিয়ে যায় বিশেষ্য। ‘মিলির হাতে স্টেনগান’ গল্পে আমরা দেখি মিলির মা’কে, তিনি গাড়িওয়ালা ছেলেটিকেই মিলির সাথে বেশি পছন্দ করেন বিয়ে দিতে, তিনি জানেন রানা সৎ পথে উপার্জন করছেন না, তবু তার উপরই ভালোবাসা উগরে দিচ্ছেন। এমন আরো একটি চরিত্র দেখি ইলিয়াসের ‘কীটনাশকের কীর্তি’ গল্পে (গল্পগ্রন্থ-‘দোজখের ওম’, ১৯৮৯)। আমরা পাই রামিজ আলির বোন আসিমুন্নেসা কে। যে নিজেকে সঁপে দেয় গ্রামের বিত্তশালী হাফিজুদ্দির ছেলে ‘ম্যাট্রিক পাসের’ কাছে। গল্পে কোথাও নেই বিশেষ্যের নাম।  এ প্রসঙ্গে আমাদের মনে পড়ে রমাপদ চৌধুরীর ‘রত্নকূট’ গল্পের কাঞ্চনের কথা, যে শেষ পর্যন্ত জয় করে লক্ষপতি মোহনলালকে। এই বিত্তশালীদের কাছে সঁপে দেওয়া ছাড়া কি উপায় আছে কাঞ্চনদের, ও রমিজের বোনদের? রমিজের বোনের সেই সম্পর্কের উপরেই তো নির্ভর করত একদা পরিবারের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য। বলতে গেলে আয় ভোগস্পৃহা সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য চায় সবাই আর সেই আর্থিক দুর্বলতায় অনেক কাঞ্চনরাই বাধ্য হয় নিজেদের সঁপে দিতে বিত্তশালী মোহনলালদের কাছে।
ইলিয়াস এভাবে নারীর দোষ গুন সব মিলিয়ে তুলে ধরেন, সেখানে বাদ যায় না কিছুই। যেমন- আমাদের মায়েরা অসুখ কে একটু বাড়িয়ে বলতে ভালোবাসে। সেই রকম-ই একটি গল্প হল ‘অসুখ-বিসুখ’ গল্পটি। আতমন্নেসা সর্বদা অসুখ বিলাসি। নিজের মেয়ের অসুখকে সে হিংসা করে। সে চায় তার ঘরেও মেয়ের মত নানা রঙের বোতলে সাজানো ঔষুধ থাকুক। তার জন্য  সে সবাইকে তার শরীর খারাপের কথা বলে। গল্পের পরিনামটি কিন্তু কষ্টের গল্পের শেষে সত্যি আতমন্নেসা’র বড়ো রোগ হয়, ক্যান্সার, সে বোঝে কিন্তু সে সুখী তার টেবিলে দামী ঔষুধ সাজানো দেখে আর তাকে নিয়ে তার পরিবারের ব্যস্ততা দেখে।
‘দুধেভাতে উৎপাত’-গল্পে আমরা দেখি ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধেভাতে’ বাঙালি নারীর চিরন্তন মাতৃত্বের বাণীটিকে। জয়নাব হত দরিদ্র গ্রামের বৌ, সে এখন মৃত্যু পথযাত্রী তার একমাত্র ইচ্ছে তার সন্তানেরা যেন তার সামনে একটু দুধভাত খেতে পারে। কিন্তু তার আশা পূর্ণ হয়না। গরিবের দুধের আশা পূর্ণ হয় চালের গুড়ো দিয়ে। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘অভাগীর স্বর্গ’ গল্পে অভাগী পারেনি তার মায়ের আশা পূর্ণ করতে তেমনি ’৪৭,’৫২,’৭১ পেরিয়ে যাওয়া বাংলাদেশে ওইদুল্লা’ও পারেনা তার মায়ের আশা পূর্ণ করতে। অগ্রন্থিত গল্পে ইলিয়াসের এমনি একটি গল্প হল ‘ঈদ’ যেখানে রজব কে অন্যায়ের প্রতিবাদ করার জন্য নিজের মায়ের কাছে মার খেতে হয় কেননা রজব যাদের অন্যায়ের প্রতিবাদ করছে তারা মালিক পক্ষ, তার মা সে বাড়িতে কাজ করে। রজবের মা ফতিমার অসহায়ত্বের সঙ্গে মমতার দিকটি খুব নিখুঁত লেখনীতে তুলে ধরেন ইলিয়াস এই গল্পে।
ইলিয়াসে গ্রন্থিত একটি গল্প হল ‘প্রেমের গপ্পো’(গল্পগ্রন্থ-‘জাল স্বপ্ন, স্বপ্নের জাল’, জানুয়ারী ১৯৯৭) সেখানে নিজের স্ত্রী বুলা’র কাছে নিজের দর বাড়াতে জাহাঙ্গীরকে সাজাতে হয় তার মিথ্যে প্রেমের কিছু গল্প। সেই গল্পগুলিতে জাহাঙ্গীর সব নারীকে প্রত্যাখিত করেছে। বুলা বোঝে, কেননা একই গল্প অন্যদিন বলবার সময় প্লটের পরিবর্তন করে। বিবাহিত জীবনের স্বামী-স্ত্রী’র মানসিক টানাপোড়েন, সেইসঙ্গে জাহাঙ্গীরের মানসিক একাকীত্বের মিথ্যে গল্প ফানুস সুন্দরভাবে তুলে ধরা আছে। চিরন্তন পুরুষত্ব নিজের স্ত্রীর কাছেও নিঃসঙ্গতার ঝাঁপি খুলবেনা তার বদলে তৈরি করবে মিথ্যে প্রেমের আষাঢ়ে গপ্পো।
এভাবে ইলিয়াস ভালোমন্দ সবমিলিয়ে তাঁর গল্প ভুবনে নারীদের তুলে ধরেন, তারা হয়ে ওঠে আমাদের চেনা জগতের রক্ত-মাংসে গড়া মানবী। যারা এই আবহমান কালে নিস্তব্ধে তদের যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে।
‘টুম্পারানীর একটুও নেই ভয়
একবার যা সত্য ভাবে তাইতে নিঃসংশয়।
টুম্পা যখন বড়ো হবে, রইবে না আর খুকী
নিজের সত্য অটল রাখতে নেবে অনেক ঝুঁকি।
সেনাপতির হাতে বাজুক অস্ত্রের ঝঙ্কার
টুম্পারানীর চোখে মুখে ছাপ নেই শঙ্কার

রাজা রানী উজির নাজির দ্যাখাক প্রলোভন
টুম্পা নেবে মুখ ফিরিয়ে, টলবে না তার মন
টুম্পা রইবে অটল নিজের শক্তি ও বিশ্বাসে
জনপ্রাণী থাকুক কিংবা নাইবা থাকুক পাশে।’
- আখতারুজ্জামান ইলিয়াস১৩


তথ্যপঞ্জি—
১। মল্লিকা সেনগুপ্ত, ‘নান্দীমুখ’(কথামনবী), মূলগ্রন্থ – “মল্লিকা সেনগুপ্ত কবিতা সমগ্র”, সম্পাদনা- সুবোধ সরকার, আনন্দ, কোলকাতা, জুন২০১৩, পৃষ্ঠা-২০৫।
২। কনক মুখোপাধ্যায়, ‘মার্কসবাদ ও নারিমুক্তি’, মূলগ্রন্থ – “নারী নির্যাতন নারী আন্দোলন”, ড. চিত্ত মণ্ডল সম্পাদিত, নবজাতক প্রকাশক, কোলকাতা, ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০০৬, পৃষ্ঠা-১৭৬-১৭৮।
৩। শেফালী মৈত্র, ‘নৈতিকতা ও নারীবাদ’, নিউ এজ, কোলকাতা, জুন ২০০৭, পৃষ্ঠা-২১-২২।
৪। সেরিনা জাহান, ‘মেয়েলি শরীর : শরীরী মেয়ে’, মূলগ্রন্থ – ‘লৌকিক উদ্যান মানবী সংখ্যা’, দশমবর্ষ পূর্তি সংখ্যা ১৯৮৯-১৯৯৯, সম্পাদক- প্রেমেন্দ্র মজুমদার, ইউ বি আই স্টাফ ওয়েলফেয়ার এণ্ড কালচারাল সোসাইটি কর্তৃক প্রকাশিত, কোলকাতা, শ্রাবণ ১৪০৬, আগস্ট ১৯৯৯, পৃষ্ঠা-৩৩।
৫। ঐ, পৃষ্ঠা-২৩।
৬। খালিকুজ্জামান ইলিয়াস, ভূমিকা, রচনাসমগ্র।১, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, মাওলা ব্রাদার্স।।ঢাকা, ফেব্রুয়ারি ১৯৯৯, পৃষ্ঠা-তিন।
৭। শাহাদুজ্জামান, ‘জীবনের জঙ্গমতা ও লেখকের উপনিবেশ আখতারুজ্জামান ইলিয়াস’(সাক্ষাৎকার), পৃষ্ঠা-৩৭।(বইটি প্রতিলিপি রূপে আমার কাছে সংরক্ষিত তাই পুরো তথ্য দেওয়া গেল না)।
৮। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, ‘যোগাযোগ’, মূলগ্রন্থ- “রচনাসমগ্র।১ আখতারুজ্জামান ইলিয়াস”, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা-৫৮।
৯। শাহাদুজ্জামান, ‘জীবনের জঙ্গমতা ও লেখকের উপনিবেশ’, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা- ৬৬-৬৭।
১০। Internet Search ‘www.simplypsychology.org’ ।
১১। শাহাদুজ্জামান, ‘জীবনের জঙ্গমতা ও লেখকের উপনিবেশ’, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা- ৫৬।
১২। ঐ, পৃষ্ঠা – ৭৪।
১৩। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, ‘টুম্পারানী’, মূলগ্রন্থ – “রচনাসমগ্র।৪ আখতারুজ্জামান ইলিয়াস”, মাওলা ব্রাদার্স।।ঢাকা, ফেব্রুয়ারি ২০০৭, পৃষ্ঠা- ২০৪।

সুমন্ত কুন্ডুর অণুগল্প : ছেষট্টি পাতার কবি







সুমন্ত কুন্ডু
ছেষট্টি  পাতার কবি


পত্রিকাটি প্রকাশ পেয়েছে । এটুকু খবর শুধু পেয়েছিল, তাও অনেকদিনের প্রতীক্ষার পর । ফেসবুকেরই কোন এক পেজে লেখা আহ্বানমূলক বিজ্ঞাপন । কাঁপা কাঁপা হাতেই নিজের একাকী ঘরে লেখা একখণ্ড কবিতা নিজের নাম সহ পাঠিয়ে দিয়েছিল । সেই শুরু প্রতীক্ষার । তারপর আর কোন খোঁজ নেই – না পত্রিকার না কবিতার ।

 অবশেষে একদিন জানা গেল পত্রিকা প্রকাশ হয়েছে । কিন্তু হাতে পাওয়া গেল না । পত্রিকা দপ্তর থেকে বাড়ি অনেক দূরে, একদিন সময় করে বইপাড়া ঘুরে সংগ্রহ করবে তাও হয়ে ওঠে না । খুঁজে খুঁজে ব্যর্থ হতে হয় । পত্রিকা দপ্তর প্রদত্ত প্রাপ্তিস্থানে রঙিন কাগজের ঝলমলে প্রদর্শনী । সে রঙের সমারোহে সাদা কালো  লিটল ম্যাগাজিনটি অবহেলার কোন ফাঁকে যে পড়ে থাকে, খুঁজেই পাওয়া যায় না ।  বাইপোস্টে আসবে সে সম্ভবনাও ক্ষীণ ।

অতএব আবারও প্রতীক্ষা ।

ফেসবুকেই খোঁচাখুঁচি । নতুন কবির বুকে শিহরণ ! তার লেখাটা কি আছে ? সত্যিই পৃথিবীবাসী দেখে ফেলেছে নাকি তার সৃষ্টিকে ! খবর পাওয়া গেল, লেখাটি নাকি আছে , ছেষট্টি পাতায় । কনফার্ম নয় তবে কোন সহৃদয় সম্পাদকমণ্ডলীর বন্ধুর বন্ধুর কোন এক স্বল্প পরিচিত কবিবন্ধুর কাছ থেকে আভাস পাওয়া গেল কবিতাটি থাকার কথা । নতুন কবির বুকে শিহরণ বাড়ল আরও, কবে হাতে পাব পত্রিকা । আবার প্রতীক্ষা ।

প্রায় বেশ কয়েকটি নির্ঘুম রাতের পরে, নতুন কবির মনে আত্মতৃপ্তির এক সীমাহীন সুখের পরশ বুলিয়ে অবশেষে পত্রিকাটি হাতে এল ।

সাগ্রহে পত্রিকাটি নিয়েই সটান ছেষট্টি পাতায় । যাহ্‌, চৌষট্টি পাতাতেই শেষ তো ! গোটা পত্রিকাটি জুড়ে কেবল প্রতিষ্ঠিত কবিদের কলমের আঁচড় । তার পরে ব্যাক কভার । তারা মা হার্ডওয়ার্স আর হারাণ মণ্ডল এল আই সি-র ভাগাভাগি বিজ্ঞাপন । কোথায় নতুন কবির ছেষট্টি নং পাতা !

না নেই ! ছেষট্টি নং পাতাটা ব্যক কভারের আগে স্থান করে নেয়ার উপায় নেই ! নতুন কবিকে আরও অপেক্ষা করতে হবে । আরও অনেক ছেষট্টি নং পাতা পেরিয়ে আসতে হবে।




শওকত আলীর গল্প : মানবতার এক অন্য নামান্তর - পুরুষোত্তম সিংহ






শওকত আলীর গল্প : মানবতার এক অন্য নামান্তর
পুরুষোত্তম সিংহ

দেবেশ রায় ‘উপন্যাস নিয়ে ‘ গ্রন্থে লিখেছিলেন –“দুনিয়ার খবর রাখতে গিয়ে নিজেদের খবর আমাদের বড় একটা রাখা হয় না, নিজেদের লেখা ভাল করে পড়াও হয় না, নিজেদের লেখা ভাল করে বুঝে নেয়ার জন্যে নতুন নতুন দিক থেকে চিন্তার সময় সুযোগও ঘটে না।“ (দে’জ, পৃ. ৪২ ) সত্যি আমরা আমাদের শিকড় সন্ধান বুঝি ভুলে যাচ্ছি। শওকত আলী (১৯৩৬) আমার জেলার মানুষ (রায়গঞ্জ )। আমরা ভুলেছিলাম সে সত্য। তিনি নিজেই জানিয়েছেন রায়গঞ্জের করেনেশন স্কুলে পড়েছিলেম। দেশভাগের আগে ওপার বাংলায় চলে যান। শওকত আলীর কাছ থেকে আমরা বেশ কিছু গল্পগ্রন্থ পেয়েছি। ‘উন্মুল বাসনা’ (১৯৬৮ ) দিয়ে সে যাত্রা শুরু, পাশাপাশি রয়েছে ‘লেলিহান স্বাদ’ (১৯৭৮ ) ‘শুন হে লখিন্দর’ (১৯৮৮ )। গল্প উপন্যাসে তিনি কী লিখতে চান ? নিজে দেখেছেন দুই শ্রেণির মানুষের যাওয়া আসার চিত্র। এপারের মুসলিমরা উদ্বাস্তু হয়ে ওপারে গিয়ে নতুন বাসস্থান খুঁজছে, ওপারের হিন্দুরা সর্বস্ব হারিয়ে শুধুমাত্র স্মৃতিকে সঙ্গী করে পাড়ি দিচ্ছে নতুন দেশে। এই সর্বস্ব হারা উদ্বাস্তু মানুষগুলির যন্ত্রণা, প্রেম, বেদনা, হাহাকারই তিনি লিপিবদ্ধ করতে চাইলেন। তবে এই ধ্বংস লীলার মধ্যেও যে বেঁচে থাকার ফুল ফুটে উঠতে পারে তা তিনি দেখাতে চেয়েছেন। জীবনের নঞর্থক দিকগুলি ভুলে গিয়ে জীবনসমুদ্র মন্থন করে অমৃত পান করতে চেয়েছেন তিনি গল্পে –
“তবে আমার উপলব্ধি এই রকম যে মিথ্যাচার, লোভ, দমন পীড়ন, জিঘাংসা হত্যা –তেই জীবনধারার অবসান হয় না। সমস্ত রকম ধ্বংস ও বিপর্যয়ের পরও জীবনের ধারা অনবরত বয়ে চলে এবং সৃজনশীলতার ফুল ফোটায়। জীবনের কথাই যদি সাহিত্যের কথা হয়, তাহলে পাশবিকতা ধ্বংস ও বিপর্যয় যেমন বাস্তবতা ও সাহিত্যের বিষয়, তেমনি ঐ সবের পাশাপাশি ফুল ফোটানোর বাস্তবতাও সাহিত্যের বিষয়।“ ( ভূমিকা, গল্প সমগ্র, দ্বিতীয় মুদ্রণ ২০১৬, অরিত্র, ঢাকা ১১০০, পৃ. ৩ )
 এই বোধ থেকেই তিনি গল্প লিখে বসেন। রবীন্দ্রনাথ, তারশঙ্কর, ওয়ালীউল্লাহের গল্পের যে করুণা তা লেখককে আকর্ষণ করেছিল। সেই করুণা থেকেই তিনি গল্পে মানবিকতার ওপর জড় দেন। নিজেই জানিয়েছেন –“ মানবিকতা বোধকে জাগ্রত না করলে কোনো গল্পকে সাহিত্যকর্ম বলতে আমার বাধে’ ‘ (তদেব, পৃ. ৪ )। তবে সে প্রকরণ ভিন্ন। ক্রোধ, প্রতিরোধ, আবেগ, ঘৃণা, লাঞ্ছনা, হত্যার দৃশ্য ঘটিয়েও তিনি চরিত্রকে এক অন্য জগতে নিয়ে যেতে চান। চরিত্রের আত্মসমীক্ষণে চরিত্রকে বিবেকবোধের আলোয় উজ্জ্বলিত করেন। আমরা শুধু শওকত আলীর মুসলিম জনজীবন নিয়ে লেখা গল্পগুলির দিকে নজর দেব।

‘জানোয়ার’ গল্পে পশুর ধর্মের সঙ্গে মানুষের ধর্মকে মিলিয়ে দিয়েছেন লেখক। আসলে মানুষও কখনও কখনও পশুর পর্যায়ে নেমে যায়, সেই বোধেই লেখক আমাদের নিয়ে যান। শওকত আলী গল্পে সবসময় মানবতাবোধের ওপর জোড় দেন। ঘটনাকে সামনে রেখে তিনি মানুষের চেতনাকে জাগিয়ে তোলেন। মানবসভ্যতা আজ ভয়ংকর সংশয় ও প্রশ্নের মুখে দাঁড়িয়ে। সেখান থেকে তিনি মানুষকে জীবনচেতনায় দীক্ষিত করতে চান। এ গল্প যেন চরিত্র চিত্রশালা। অনেকগুলি চরিত্রকে সামনে রেখে একটি নির্দিষ্ট ঘটনাকে কেন্দ্রে রেখে লেখক তাঁর গন্তব্য পথে এগিয়ে গেছেন। সেলিম সাহেবকে হাতে রেখে জমীর চৌধুরী সব কাজ হাসিল করে নিতে চায়। তেমনি সেলিম হাসেবকে নিয়ে গেছে দরিদ্র বিন্দাবন হাড়ির বাড়িতে। বিন্দাবনের বাড়িতে আছে  কলাবতী ও মনোহরের বউ। এই দুই নারীর প্রতি সেলিমের দৃষ্টিকে আকর্ষণ করে সব কাজ গুটিয়ে নেওয়াই লক্ষ জমীর চৌধুরীর। তেমনি বিন্দাবন দরিদ্র বলে সেও নারী মাংসকে সামনে রেখে কিছু অর্থের সুবিধা করতে চেয়েছে। তবে এসব ধরা পড়ে যায় রহমত বুড়ার চোখে। সেলিম সাহেবের ইচ্ছা বাঘ শিকার করবে। টোপ হিসাবে কখনও ছাগল, কখনও কুকুর নেওয়া হয়েছে। বাঘ শিকার যে আদৌও হবে না তা আমরা জানি। শিকারকে বাঁচিয়ে রাখতে টোপ হিসাবে যেমন ছাগল, কুকুর ব্যবহৃত হয়েছে তেমনি সাহেবের টোপ দুই নারী। জানোয়ার শুধু পশু নয় মানুষের বিবেক বোধও যেন আজ জানোয়ার হয়ে গেছে। তবে যুগে যুগে চেতনা জাগরণকারী মানুষ ছিল, থাকবে, তবে সংখ্যায় হয়ত তা নগণ্য। এ গল্পে আছে রহমত বুড়া। সে সত্যের পথে এগিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছে। কিন্তু এই সংশয়ের বিশ্বে মানুষ তো সত্যকে চাপা দিয়ে মিথ্যাকে আশ্রয় করেই বাঁচতে চায়। আর গরিব মানুষের কাছে বিবেক বোধের মূল্য কতখানি ? দরিদ্র মানুষের পক্ষে মূল্যবোধ রক্ষা করা সম্ভব নয়। তাই বিন্দাবনরাও সে মূল্যবোধ বাঁচিয়ে রাখতে চায়নি। তবে রহমতের চেতনা জেগে আছে। সেই ধ্রুব সত্যেই লেখক আমাদের নিয়ে যান।

মানুষের চেতনা সর্বদা ঠিক থাকে না বা থাকা সম্ভবও নয়। নিরীহ শান্ত ভদ্র মানুষটিও কখন যেন রাগান্বিত হয়ে ওঠে। বিশেষ পরিস্তিতি, খণ্ড মুহূর্তই যেন মানুষকে নিয়ে যায় এক বিশেষ স্তরে। সেই খণ্ড মুহূর্তে ঘটে যাওয়া ঘটনার জন্য চরিত্রকে হয়ত দায়ী করা যায় না কিন্তু মানুষের দৃষ্টিতে সে অপরাধী। একটি মানুষ খুনি –এই সত্য মানুষ বহন করে চলে কিন্তু কেন খুন করল তা বহন করে চলে না। তেমনই একটি গল্প হল ‘ফেরতা’।গুলশান ও জয়নালকে নিয়ে এ গল্প গড়ে উঠেছে। দাঙ্গার সময় অনাথ এক মেয়ে শাহজাদীকে বাড়ি নিয়ে এসেছিল শুলশানের পিতা হায়দর আলি। পিতার মৃত্যুতে দরিদ্র সংসার চালাতে গুলশানকেই পথে নামতে হয়। অর্থ রোজগারের আশায় সে বর্ডার থেকে মাল পারাপার করে। নিজের ভাইয়ের সঙ্গে শাহজাদীকেও সমান ভালোবাসতো গুলশান। এই শাহজাদী একদিন পালিয়ে যায় বেলায়ত চৌধুরীর সঙ্গে। যা মেনে নিতে পারেনি গুলশান। সে আজ বেরিয়েছে শাহজাদী ও বেলায়েত চৌধুরীর খোঁজে। জয়নাল জানে ওস্তাদের রাগের কথা। সে বরাবার সবধান করেছে কিন্তু গুলশান শোনেনি। ফলে জয়নাল নিজেই গিয়েছে গুলশানের সঙ্গে। যে গুলশান বেলায়তকে অপদস্ত করতে বাড়ি থেকে এসেছিল সেই গুলশান শাহজাদীর কথা শুনে আজ কিছু করতে পারেনি। তবে বেলায়ত আজ নানাভাবে গুলশানকে বিরক্ত করেছে। তবে শাহজাদীর কথা ভেবে গুলশান সমস্ত সহ্য করে গেছে। বেলায়েতের বক্তব্যের কিছু অংশ তুলে ধরা যাক –
“যা যা ! বিরক্ত হয়ে যেন মাছি তাড়ালো বেলায়েত চৌধুরী। তারপর মুখ বাঁকিয়ে বিদ্রুপের বিষ ঢেলে ঢেলে বলতে লাগলো, যে নফর হবার যুগ্যি নয়, তাকে অমন একটা শিক্ষিত মেয়ে বিয়ে করতে যাবে। তোর ওস্তাদের আশা কত ! সেই মেয়েকে আমি উদ্ধার করেছি, বিয়ে করেছি। এখন ভয় করতে যাবো ঐ হাআরামজাদাকে, দু পয়সার মুরোদ নেই যায় !  আসুক না  আমার সমানে , দেখি তার কত সাহস !” ( তদেব, পৃ. ১০৩ )
গুলশানও রাগ প্রকাশ করে কখনও বলেছে -
“গুলশান দু’পা এগিয়ে গেল। বললো, বললাম তো চুপ কর। যেন চাপা গলার বিড়বিড় করছে লোকটা। অস্পষ্ট বললো, চুপ করে যা, আমি তোকে খুন করতে চাই না। চুপ করে যা, তোর শাহজাদীর কথা ভেবে চুপ করে যা। চুপ কর তুই, নইলে জান নিয়ে নেবো।“ (তদেব, পৃ. ১০৪ )
তবে গুলশান নিজেকে সামলে রেখেছে। কিন্তু একটি মানুষের ধর্যের বাঁধ আর কতক্ষণ থাকে ? শেষ পর্যন্ত নিজেকে সংযত রাখতে পারেনি গুলশানও । শেষ পর্যন্ত ক্রোধের কাছে পরাজিত হয়ে খুন করে ফেলে বেলায়েতকে। মানুষ চরিত্রকে সবসময় ধরে রাখতে পারে না। গুলশানও পারেনি। তবে এই খুনের জন্য তাঁর অনুশোচনা আছে। ফেরার সময় গাড়িতে ঘুমিয়ে পড়েছে সে। এক অপরাধপ্রবণ মন নিয়েই সে ফিরে চলেছে বাড়িতে। এ যাত্রা সুখের বা আনন্দের নয়। নিজের সমস্ত ক্রোধকে দমন করা সম্ভব হয়নি তাঁর পক্ষে। লেখক শওকত আলীও গল্পের স্বাভাবিক পরিণতির দিকেই নজর দিয়েছেন।

এক অদ্ভুত নারী নূরবানুকে নিয়ে গড়ে উঠেছে ‘রাস্তার দৃশ্য’ গল্পটি। নূরবানুকে সামনে রেখে লেখক সরকারি অর্থনীতি, দুর্ভিক্ষ দমনে সরকারের ব্যবস্থা, সরকারের প্রকৃত অবস্থা কেমন ও সাধারণ মানুষ সরকারকে কোন চোখে দেখেছে তা তুলে ধরেছেন। স্টেশনে মারা যায় নূরবানুর স্বামী সদরালি। স্বামীর মৃত্যুতে তাঁর সব বোধ দিশেহারা হয়ে যায়। নূরবানুকে কেন্দ্র করে স্টেশনে সরকারি লোক সহ সাধারণ মানুষের কোলাহল নিয়েই এ গল্প গড়ে উঠেছে। কেউ নুরবানুর দুঃখ বোঝেনি। সকলেই দায়িত্ব সামলাতে চেয়েছে, কেউ সহানুভূতি বা করুণা প্রকাশ করেছে। তবে লেখক নূরবানুকে বড় কঠিন করে গড়ে তুলেছেন। স্বামীর মৃত্য উর পর সে একটি কথাও বলেনি। এমনকি নিজের কন্যা ফুলবানু কোথায় চলে গেল সেদিকেও নজর নেই। এই নূরবানুকে কেন্দ্র করে স্টেশনে রীতিমত নাটকীয় অবস্থা শুরু হয়েছে। পুলিশ এসেছে জিজ্ঞাসাবদের জন্য কীভাবে মারা গেল স্বামী, তবে নূরবানু মুখ দিয়ে একটি শব্দও উচ্চারণ হয়নি। স্টেশনের জনগন, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার দেওয়া খাদ্যের প্রলোভন, সাধারণ মানুষের দেওয়া খাদ্য ও টাকা সে কিছুই গ্রহণ করেনি, শুধু মুখ ঘুরিয়ে বসে আছে। এমনকি এক ব্যক্তি টাকা ভিক্ষা দিতে চাইলেও সে নেয় না অথচ ভিক্ষারিদের কোলাহলে সে পদপৃষ্ট হয়েছে –
“নূরবানু  ধাক্কা খেয়ে পেছনে ছিটকে যায়। সেখান থেকে কে যেন আবার তাকে সামনের দিকে ঠেলে দেয়। তাতে হুমড়ি খেয়ে পড়তে হয় তাকে। কার পায়ের চাপে ভিক্ষের থালাটা মচ মচ শব্দ করে দুমড়ে যায়। কে একজন তার পায়ের ওপর ভর দিয়ে চলে যায়। কারো পা তার পেটের ওপর পড়ে, কেউ পিষে দেয় তার নাকমুখ।

এবং কিছুক্ষণ পর ভিড়টা সরে গেলে নূরবানু চৌরাস্তার মোড়ে কাত হয়ে পড়ে থাকে। তার দেহটিও, তখন ঐ দিনের বেলা, দুপুরের রোদে অদ্ভুত একটি দৃশ্য হয়ে ওঠে। কেননা আল্লাহর দুনিয়ায় তখন সূর্য একেবারে মাথার উপরে।“ (তদেব, পৃ. ১৩৬ )
স্বামীর মৃত্যুতে নুরবানুর সমস্ত চেতনা লোপ পেয়েছে। অথচ নূরবানু দুঃখ কেউ বোঝেনি। আজ ব্যস্ত সময়ের কাছে মানুষের প্রয়োজনই হয়ত বড় হয়ে উঠেছে। অপরের দুঃখে আমরা  হয়ত কিছু অর্থ বা সহানুভূতি প্রকাশ করতে পারি আর কিছু নয়। লেখক আত্মবিধ্বংসী সময়ের মুখোমুখি আমাদের দাঁড় করিয়ে দেন। যে সময় নিজেই আমাদের মুখে চাবুক মারে। শওকত আলীর গল্প যেন আত্মদর্শনের প্রতিচ্ছবি। সে দর্শনে পাঠক মগ্ন হয়ে নিজেই বিবেকবোধের জাগরণে জাগরিত হয়।

মুসলিম জীবনের প্রেম রোমান্সকে কেন্দ্র করে এক রোমান্টিক গল্প হল ‘সন্ধ্যায় সাক্ষাৎ’। প্রতিটি মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার যেমন আছে, তেমনি আছে ভালোবাসা ও প্রেমের অধিকার। সে অধিকার বয়স, শরীর মনের কোন ব্যবধান নেই। আসলে জীবনে বেঁচে থাকাটাই প্রধান কথা। শওকত আলীর গল্পে যৌনতার প্রাধান্য তেমন দেখা যায় না। তিনি বিভিন্ন দিক থেকে জীবনের ওপর আলো ফেলতে চান। ফলে এক সহজাত সহজ সরল প্রবণতা তাঁর গল্পে লক্ষ করা যায়। এ গল্প সিরাজ ও সাহানাকে নিয়ে এক প্রেমের গল্প। দুজনেরই বয়স অতিক্রান্ত। তবুও তাঁরা মিলিত হয়েছে জীবনের দাবি নিয়ে। এই সাক্ষাতে বা মিলনে যৌনতার কোন  ইঙ্গিত নেই। আসলে জীবনের নিঃসঙ্গতা কাটাতে তাঁরা মিলিত হতে চেয়েছে। সিরাজ স্ত্রীকে হারিয়েছে, সাহানাও স্বামীকে হারিয়েছে। সিরাজের ছেলে আছে, সাহানারও মেয়ে আছে। তবুও তাঁরা ছিল নিঃসঙ্গ, ক্লান্ত , বিষন্ন। সিরাজের নানা বন্ধু, আত্মীয় ছিল কিন্তু স্ত্রীর মৃত্যুর পর কাউকেই উপযুক্ত সঙ্গী বলে মনে হয়নি। তাই নিজের নিঃসঙ্গতা কাটাতে সে বন্ধুর জন্য আবেদন জানিয়ে খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়েছিল। ফলে বন্ধু হয়েছে সাহানা। এতদিন পত্রালাপে কথাবার্তা চললেও আজ তাঁরা দেখা করেছে। যদিও সাহানার আসতে অনেক দেরি বলে সিরাজ বাড়ি চলে যেতে চেয়েছিল। তবুও শেষ পর্যন্ত দেখা হয়েছে। মুখোমুখি বসে দুজনে নিজেদের প্রেম-প্রেমহীনতা, সংসার, একাকিত্ব নিয়ে নানা গল্পে মেতে উঠেছে। সিরাজ যৌনতার ইঙ্গিত দিলেও সাহানা তা প্রত্যাক্ষান করেছে। আসলে সমস্ত কিছু জীবনে বয়ে নিয়েও যে বাঁচতে হয়, সেই বাঁচার দাবি নিয়েই তাঁরা এগিয়ে এসেছে –“সিরাজকেও চুপচাপ থাকতে হলো। জীবনের এই একটা জায়গা সর্বক্ষণ থাকবে –শোকের জায়গা, নিঃস্ব হওয়ার জায়গা –যাই বলা যাক, এটা চিরকাল থেকে যাবে। কারণ এটা তো অস্তিত্বেরই একটা অংশ। এ জায়গাটুকু বাদ দিলে নিজেকেই বাদ দিয়ে দিতে হয়।“ (তদেব, পৃ. ১৪৮ ) সমস্ত না থাকার মধ্যেও তাঁরা বাঁচতে চেয়েছে। জীবনের দাবি নিয়ে নতুন স্বপ্ন দেখেছে, আর সেই স্বপ্নেরই কারিগর লেখক শওকত আলী।

জীবনের পাশাপাশি আছে মৃত্যু, সেই মৃত্যুকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে ‘অচেনা ঘাতক’ গল্প। শওকত আলী গল্পে বারবার মানবতার ওপর জোড় দিয়েছেন। ফলে তাঁর গল্পে মানুষই বড় হয়ে উঠেছে। এ মানুষ প্রবৃত্তি সর্বস্ব মানুষ নয়।  মানুষের যে বিবিধ অবস্থা, মনস্তাত্ত্বিকতা, একটি মানুষ কোন অবস্থার সম্মুখীন হয়ে ঘাতক হয়ে ওঠে সে পরিস্তিতির ওপর জোড় দিয়েছেন ‘অচেনা ঘাতক’ গল্পে। এই আঘাতের জন্য তিনি চরিত্রকে দায়ী করেননি, দায়ী করেছেন পরিস্তিতিকে। মহাতাব ভাল গান গাইতো, সে ছিল দিলওয়ারের বন্ধু। এই মহাতাব একদিন হায়দারকে দেহাতী ভূত বলায় সে আঘাত করেছিল ফলে মারা যায় মহাতাব। এই ঘটনার সাক্ষী ছিল দিলওয়ার। দিলওয়ারের চোখে অপরাধী হায়দার। হায়দারের ও দিলওয়ার সংলাপ নিয়ে গল্প গড়ে উঠেছে। তাঁর অপরাধ, ঘটনা, অনুশোচনা সব মিলিয়ে গল্প এগিয়ে যায় পরিণতির দিকে। কিন্তু আজ হায়দারের মনে হয়েছে দিলওয়ার মনে হয় তাঁকে পুলিশে ধরিয়ে দেবে, তাই সে দিলওয়ারের কাছ থেকে পালাতে চেয়েছে। তখনই দিলওয়ারের আঘাতে মৃত্যুশয্যায় চলে যায় হায়দার। দিলওয়ার চোখে অপরাধী ছিল হায়দার, আজ সে নিজেই অপরাধী হয়ে যাচ্ছে। একটি মৃত্যুকে সামনে রেখে লেখক আরকটি মৃত্যু ঘটিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছেন মৃত্যুর জন্য হিংসা , রাগ ক্রোধ দায়ী নয়। দায়ী পরিস্তিতি। আসলে মানবমনের নানা জটিলতা, বহু রিপু, মনস্তাত্ত্বিকতা ও অবস্থা নিয়ে বর্তমান। আসলে মানুষ অবস্থার দাস। ফলে যেকোন মুহূর্তে চরিত্রের নৈতিক পতন ঘটতে পারে, তার জন্য চরিত্র কোনভাবেই দায়ী নয়।

এক চুরির ইতিবৃত্ত নিয়ে গড়ে উঠেছে ‘অচেনা’ গল্পটি। তবে এ চুরি ধরা পড়েনি। তবে বিবেকবোধে আঘাত দিয়েছে। তবে চুরি ছাড়া কোন উপায় ছিল না। আসলে মানুষকে বেঁচে থাকতে নানা উপায় অবলম্বন করতে হয়। আর দরিদ্র নিম্নবিত্ত জীবনে সে সংগ্রাম ভয়ংকর। দরিদ্র মানুষকে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে যেতে হয় জীবনযুদ্ধে টিকে থাকতে। আর সেই টিকে থাকারই গল্প লিখেছেন শওকত আলী। কিসমত আলী অভারের তাড়নায় হারিয়েছে স্ত্রীকে। সামান্য খাদ্যের জন্য ভিটেমাটি বন্দক দিতে হয়েছে। ফলে মহাজন চৌধুরী বাড়িতে আজ সে চুরির পথ বেঁছে নিয়েছে। আগেও চুরি করেছে তবে তা সামান্য। কখনও শাবল, কখনও সামান্য সরষে। কিন্তু আজ অভাবই তাঁকে এ পথে নিয়ে গেছে। প্রথমে চুরি নিয়ে দ্বিধা থাকলেও আজ সব দ্বিধা কেটে গেছে। কিসমত আলী আজ এসেছে চৌধুরী বাড়িতে চুরি করতে। কিন্তু সহজেই তো কেউ ঘুমায় না, ফলে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়েছে। শেষে যখন সে ধান বস্তা ভর্তি করে চলে যাবে তখন ঘুম ভেঙে গেছে দাসী জয়গুনের। কিসমতও মতিচ্ছন্ন হয়ে বাড়ির পিছন দিক দিয়ে না গিয়ে উঠোন দিয়েই গেছে। দৈবক্রমে আকাশের চাঁদ তখন মেঘে ঢেকে গেছে। কিসমতকে দেখেছে চৌধুরী বাড়ির বড় ছেলে ও জয়গুন। বড় ছেলে চিনতে না পারলেও জয়গুন বোধহয় চিনতে পেরেছিল। কিন্তু এই কিসমত ও তার অভাবী ছেলেদের জন্য জয়গুনের সহানুভূতি আমরা আগেই দেখেছি। বোধহয় সেজন্যেই সে কিছু বলেনি। লেখকের লক্ষ কিসমত চরিত্র। সামান্য ধানের জন্য গোটারাত তাঁকে অপেক্ষা করতে হয়েছে। সে মহাজনের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ বা বিদ্রোহ করেনি, চুরির পথ বেঁছে নিয়েছে। এই চুরিতে অপরাধবোধ বা অনুশোচনা আছে তবে পরক্ষণেই মনে হয়েছে –“  ই বড় পাপ বাহে – তার কানের কাছে তখন মুহুর্মূহু বলে যেতে থাকে অচেনা –অজানা একটা স্বর – ই বড় পাপের কাম,  ই কাম ভালো নহে। কথাটা সে শুনতে পায় এবং মাথা নাড়ায় – না, পাপ নহে, পাপ কিসের ? পাপ ক্যানে হোবে ?” (তদেব, পৃ. ১৬৫ ) এই পাপবোধ লুপ্ত হয়ে যায় অভাববোধের কারণেই। দরিদ্র মানুষের প্রতি এক সহানুভূতির দৃষ্টি নিয়ে শওকত আলী এইসব চরিত্র এঁকেছেন। ফলে চরিত্রের স্বাভাবিক প্রবণতা খুব সহজেই ধরা পড়ে।

আকরাম ড্রাইভার ও কাশেম ড্রাইভারকে নিয়ে গড়ে উঠেছে ‘কুলায় প্রত্যাশী’ গল্প। এ গল্প এক যাত্রাপথের গল্প। আকরাম ড্রাইভার চলেছে এক বোবা মেয়েকে নিয়ে। সেই যাত্রাপথের বিবরণ, আকরামের চেতনায় নানা ভাবনা, কাশেম সম্পর্কে নানা কথা, সেই বোবা মেয়েকে ঘরে নিয়ে আসা, তার ওপর ভালোবাসা জন্মানো , আবার সেই মেয়ের পালিয়ে যাওয়া এবং তার খোঁজে আবার আকরামের বেরিয়ে যাওয়া, সব মিলিয়ে একটি সুখপাঠ্য গল্প । জাহিদ ও মেজর আহসানকে নিয়ে গড়ে উঠেছে ‘প্যাট্রিজ’ গল্প। মেজর আহসান জাহিদকে শুনিয়েছে পাখি শিকারের গল্প। শিকারের রহস্যময়তা, আনন্দ, উন্মত্ততা সব মিলিয়ে শেষ পর্যন্ত শিকার হয়েছে নারী। নারীও যেন পুরুষের লালসার কাছে এক শিকারের বস্তু। আর সে শিকারের জন্য পুরুষের বক্র দৃষ্টি ক্রমাগত ধাবিত হয়।

‘জ্যোৎস্না রাতে দাও বন্দুকের খেলা’ গল্প গড়ে উঠেছে কিছু দরিদ্র মানুষের ডাকাতি কেন্দ্র করে। শওকত আলী ঘটা করে কখনই মুসলিম জীবনের ইতিবৃত্ত লিখতে বসেননি। তাঁর অভিজ্ঞতা মুসলিম জীবনকেন্দ্রিক বলে গল্পে মুসলিম জীবন এসেছে। আর সেদেশে সংখ্যা গুরু মুসলিম বলেই এমনটা হয়েছে। মুসলিম জীবনের পাশাপাশি বাঙালি হিন্দুও এসেছে। আসলে তিনি মানুষের গল্প লিখতে চেয়েছেন, মানবতার মেলবন্ধন ঘটাতে চেয়েছেন। ফলে তাঁর গল্পে মুসলিম জীবনকে পৃথক করে দেখার কোন দৃষ্টিভঙ্গি হতে পারে না। এ গল্পে হিন্দু মুসলিম কিছু চরিত্রকে সামনে রেখে তিনি দরিদ্র মানুষের বেদনা, আত্মযন্ত্রণার ভাষ্য রচনা করতে চেয়েছেন। আব্দুল, গোবিন্দ, মানু বিশ্বাস ও আইয়ুবালী এঁরা সবাই ডাকাতি করে। এঁদের মধ্যে আব্দুলের বন্দুক আছে বলে একটু বাড়তি খ্যাতি পায়। একদিন ডাকাতিতে গিয়েছে, আব্দুল না খেয়ে যাওয়ার জন্য প্রচন্ড ক্ষুধায় সে কাতর। ডাকাতিতে তাঁরা সফল হয়নি, ফলে বাড়ি ফেরার সময় হামলা করে শুকবর মিঞার বাড়ি। শুকবর মিঞা এমনিতেই গরিব সেখানে কী পাবে ডাকাতের দল ! কিন্তু আব্দুল এখানে ভাত খেতে চেয়েছে। পোহাতু পান্তা ভাত এনে দিয়েছে, জ্যন্ত মুরগি ধরেছে। এই ডাকাত দলের ইতিবৃত্ত দেখলে পাঠকের আপাত হাসি পাবে, কিন্তু উভয়ই যখন দরিদ্র তখন ডাকাতি তো এমনই হবে। আসলে দরিদ্র মানুষের কোন ধর্ম নেই, রীতি, নিয়ম, প্রথা নেই। তাই আব্দুলরা ক্ষুধার কাছে ভুলে গেছে যে তাঁরা ডাকাত। আইয়ুবালীরা ডাকাতিতে গিয়ে নারী ধর্ষণে যুক্ত থাকলেও আজ নূরবানুকে কিছু করেনি। গর্ভবতী নূরবানুকে গোবিন্দ আঘাত করতে গেলেও প্রতিরোধ করেছে আব্দুল। হয়ত নিজের স্বজাতি বলেই। সে ডাকাত কিন্তু গর্ভবতী মহিলাকে খুন করা তাঁদের ধর্ম নয় তা বুঝিয়ে দিয়েছে আব্দুল।

‘শিকার’ কয়েকটি মুসলিম যুবক যুবতীর রহস্য অভিযানের গল্প। শিকারে বেরিয়েছে মহিউদ্দিন, আহসান, শহর আলি, মাসুদরা। এক তরতাজা মন নিয়ে আনন্দের আমেজে ভোররাতে শিকারে চলেছে সবাই। বন্যপ্রাণী ধ্বংস হয়ে যাওয়ার দিকে লেখক নজর দেননি। শিকারকে সামনে রেখে তিনি মাসুদ ও নীলার অবৈধ প্রেমের দিকে নজর দিয়েছেন। মুসলিম জীবনে এই অবৈধ প্রেম আরও ভয়ংকর। তবে এ প্রেমের জন্য মাসুদ ও নীলার কোন ভয় বা সংকোচ নেই। কিন্তু অবৈধ প্রেমকে সমাজ সর্বদা দেখেছে ব্যঙ্গের চোখে। তাই এ প্রেম কথকের দৃষ্টিতে মনে হয়েছে অনৈতিক। তবে একটি প্রেমকে কেন্দ্র করে রমণী ও পুরুষ যদি মিলিত হয় সেখানে নৈতিকতা বা অনৈতিকতার কোন প্রসঙ্গ নেই, সরল দুটি হৃদয় মিলিত হয়েছে লেখকের দৃষ্টি সেদিকে। আর এই প্রেম সহজাত নয় লেখকের মতে পরিস্তিতির শিকার। তবে কথকের মনে হয়েছে –“অন্যের প্রেমিকা যে বউ , তার সঙ্গে যে স্বামী সংসার করে তার মতো মূর্খ কে আছে !” (তদেব, পৃ. ১৩৩ ) তবে মাসুদেরও স্ত্রী রয়েছে, নীলারও সংসার রয়েছে। তবুও তাঁরা মিলেছে, মিলনের আনন্দ উপভোগ করেছে। আর এই মিলনকে লেখক নিয়ে গেছেন শিকারের মাধ্যমে প্রাকৃতিক পরিবেশে। যে সজীব মন নিয়ে ভোরে তাঁরা শিকারে গিয়েছিল বাড়ি ফিরেছে ক্লান্ত বিদ্ধস্ত হয়ে।

উনিশ শতকের শেষভাগ থেকে আজ পর্যন্ত কত গল্প লেখা হয়েছে আর লেখা হবে লক্ষ থেকে লক্ষাধিক কিন্তু মানুষের চেতনাকে আঘাত করতে না পারলে হয়ত সব চেষ্টাই ব্যর্থ হবে। সমাজ সংশোধন বা সমাজের কল্যাণের জন্য লেখক কলম ধরবেন এমন কোন দাসখত রাষ্ট্রের কাছে দিয়ে বসেননি। তবে শৌখিন মজদুরি হবেন এও বুঝি কাম্য নয় ! কেননা আজ রাষ্ট্র,সময় , সমাজ , মানুষ এক ভয়ৎকর বিপদের সম্মুখীন। সেখান থেকে বাঁচার রসদ, সঠিক পথ, মানুষে মানুষে সৌভ্রাত্বের বন্ধন লেখককেই গড়ে তুলতে হবে। সেদিক থেকে শওকত আলীর গল্প আজ অবশ্যই পাঠ্য।

বাংলা লিটল ম্যাগাজিনের স্থানাঙ্ক নির্ণয় : অলোক গোস্বামী






অলোক গোস্বামী
লিটল ম্যাগাজিনে সৃজন সাহিত্যের ধারা


সাহিত্য অকাদেমি এবং কলিকাতা লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি এবং গবেষণা কেন্দ্রের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত,“বাংলা সাময়িক পত্রের ২০০ বৎসর পূর্তির মুহূর্ত্বে বাংলা লিটল ম্যাগাজিনের স্থানাঙ্ক নির্ণয়” আলোচনাচক্রে উপস্থিত স্বজনদের আমার শ্রদ্ধা জানাই।
বিশিষ্ট জনকে প্রথামাফিক সম্বোধনের পরিবর্তে ‘স্বজন’ সম্বোধন করছি কারণ দুদিন ব্যাপি এই আলোচনা অনুষ্ঠানের মূল বিষয় যেহেতু বাংলা লিটল ম্যাগাজিনের স্থানাঙ্ক নির্ণয় সুতরাং বলাবাহুল্য যাঁরা এই অনুষ্ঠানে বক্তা কিংবা  শ্রোতা হিসেবে উপস্থিত হয়েছেন এবং হবেন, তাঁরা প্রত্যেকেই লিটল ম্যাগাজিনের সঙ্গে কোনো না কোনো ভাবে যুক্ত। সেটা সম্পাদনার দিক থেকেই হোক কিংবা লেখা কর্মের দিক থেকেই হোক কিংবা পাঠক হিসেবেই হোক। মূল কথা হলো লিটল ম্যাগাজিন তাঁদের চিন্তনে উজ্বল স্থান দখল করে আছে। সেই আকর্ষণেই তারা আজ এসেছেন। জানি, আগামী কালও আসবেন। সুতরাং তাঁরা স্বজন ছাড়া আর কী হোতে পারেন! কিন্তু আমি কিভাবে তাদেরও স্বজন, সেটাও তো ব্যাখ্যা করা উচিৎ। সুতরাং এ প্রসঙ্গে নিজের পরিচয় দেয়াটাও খুবই জরুরি হয়ে পড়ছে, আশা রাখি এহেন প্রয়াসকে কেউ আত্মপ্রচার ভাববেন না।
 
লিটল ম্যাগাজিনের সঙ্গে নিজের সম্পর্ক বিষয়ে কথা বলতে গেলে একটা উপমার সাহায্য নিতে হবে। যেমন ধরুন, আমরা জানি যে কই মাছ বিশেষ পরিস্থিতিতে গাছ বেয়ে বেশ খানিকটা উঠে পড়ে কিন্তু তাবলে আমরা কেউ ভাবি না যে ,কই মাছ বৃক্ষবাসী। আমরা জানি, জলই তার সংঘারাম। তেমনই আমিও লিটল ম্যাগাজিনের মাধ্যমে সাহিত্য জীবন শুরু করার পর এমন কিছু পত্র-পত্রিকায় লিখেছি এবং লিখছি যেগুলোকে তথাকথিত বাণিজ্যিক পত্রিকা বলা হয়ে থাকে। অথচ আজও নিজেকে লিটল ম্যাগাজিনের সামান্য একজন অক্ষরকর্মিই মনে করি। এই মনোভাব নিছকই যে বিনয় নয় তার প্রমাণ লিটল ম্যাগাজিনের সম্পাদকের তরফ থেকে লেখার আমন্ত্রণ পেলে আজও গর্ববোধ করি। লিটল ম্যাগাজিন সংক্রান্ত অনুষ্ঠানের কথা জানতে পারলে অনাহুত ভাবেও ছুটে যাই। সর্বোপরি,এতটা বয়স পেরিয়ে আজও লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদনার কাজেই যুক্ত আছি এবং পত্রিকাটির মান কিভাবে উন্নততর করা যায়, তা নিয়ে ভাবনা চিন্তা করি। সুতরাং এরপর উপস্থিত গুণী মানুষদের সঙ্গে যদি একাত্মতা বোধ করি,যদি স্বজনবোধে আপ্লুত হই, আশা রাখি সেই আচরণ ঔদ্ধত্ব হিসেবে বিবেচিত হবে না।
দুদিন ব্যাপী এই আলোচনা অনুষ্ঠানে আমাকে যে বিষয় বরাদ্দ করা হয়েছে সেটা হলো,“ লিটল ম্যাগাজিনে সৃজন সাহিত্যের ধারা।” কিন্তু সে প্রসঙ্গে আলোচনা করার আগে আমি কয়েকটা কথা বলে নিতে চাই।
বাংলা সাময়িক পত্রের তালিকা থেকে আলাদা করে ‘সবুজপত্র’কে যদি প্রথম লিটল ম্যাগাজিন হিসেবে শনাক্ত করি তাহলে সেটার প্রকাশকাল ছিল ১৯১৪। অর্থাৎ অনুষ্ঠানের শিরোনাম অনুযায়ী সাময়িক পত্রের বয়স যদি ২০০বছর হয় তাহলে দেখা যাচ্ছে লিটল ম্যাগাজিনও এমন কিছু কচি নয়, রীতিমত ১০৪বছরের তরুণ। সবুজপত্রকে লিটল ম্যাগাজিনের শিরোপা দিতে যদি কারো আপত্তি থেকে থাকে তাহলে ‘কল্লোল’ পত্রিকাকে বেছে নিতে পারি। তার প্রকাশকালও ১৯২৩। যদি ‘প্রগতি’ পত্রিকাকে নির্বাচন করি তাহলে সালটা দাঁড়ায় ১৯২৬। ‘কবিতা’ পত্রিকার ক্ষেত্রে সালটা ১৯৩৫। অহেতুক নামের সংখ্যা বাড়িয়ে লাভ নেই। মূল কথাটা হলো,অনেক বাছাবাছির পরও লিটল ম্যাগাজিনের বয়স ৮৩ এর চে’ কমানো যাচ্ছে না।
এবার আসা যাক সাহিত্য অকাদেমি এবং লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি এবং গবেষণা কেন্দ্রের বয়স প্রসঙ্গে। সাহিত্য আকাদেমি গঠিত হয়েছিল ১৯৫৪তে। অর্থাৎ ৬৪ বছর আগে। লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি এবং গবেষণা কেন্দ্রের শুরু ১৯৭৮। অর্থাৎ বয়স ৪০ বছর।
আমার এই বয়স সংক্রান্ত কচকচিতে অনেকে বিরক্ত হোতে পারেন,মনে হোতেই পারে ধান ভানতে শিবের গীত গাইছি,সেক্ষেত্রে আমার বিনীত কৈফিয়ৎ এটাই,কোথাও না কোথাও,কেউ বা কাহারা, ধান ভানতে গিয়ে শিবের গীত নির্ঘাৎ গেয়েছিল,গাওয়ার গুরুত্বটা অনুভব করেছিল নাহলে তো এই প্রবাদটার জন্মই হোত না। আমার বক্তব্য থেকে আশা রাখি বুঝিয়ে দিতে পারবো কেন শিবের গান গাইছি।
তো এবার আপনারা নিজেরাই হিসেব করে দেখুন,কতগুলো বছর পেরিয়ে আসতে হলো এই দুটো সংস্থার যুক্ত হয়ে এরকম একটা মহৎ অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে! 
তবে সময় যতই লাগুক,ঘটনাটা ঘটলোই।‘যা হয়নি তা কখনও হবেনা’ এই চালু গুজবটাকে মিথ্যে প্রমাণ করে দিলো দুদিন ব্যাপী এই অনুষ্ঠানের আয়োজন এবং এই আয়োজন নিঃসন্দেহে  লিটল ম্যাগাজিনের ঊষ্ণিষে একটি দৃপ্ত পালক যুক্ত করলো।
এবার মূল বক্তব্যে আসা যাক। যদিও জানিনা আমার জন্য  বরাদ্দ বিষয়ে কতটা থাকতে পারব! কেননা মাঝে মধ্যে শিবগীতি গেয়ে ওঠার পুরোনো অভ্যেস তো রাতারাতি মুছে ফেলা যায় না। সুতরাং আশা রাখি স্বজনবৃন্দের প্রশ্রয় পাবো।
বক্তব্যের শুরুতে যে সংশয়টা তুলে ধরেছিলাম শোতৃবৃন্দকে অনুরোধ করবো সেটা আরেকবার স্মরণ করতে। যদি ইতিমধ্যে ভুলে গিয়ে থাকেন তাহলে মনে করিয়ে দিচ্ছি, কোন পত্রিকাকে লিটল ম্যাগাজিন বলা যাবে! আমি যেটাকে লিটল ম্যাগাজিন আখ্যা দেব সেটা কি অন্যের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে? সেই সংশয় থেকেই আলোচনার শুরুতে পরপর বেশ কয়েকটি পত্রিকার নাম উচ্চারণ করে আপনাদের ওপরে দায়ভারটা চাপিয়ে দিতে চেয়েছিলাম, আপনারাই ঠিক করে নিন কোন পর্বটাকে শুরুয়াৎ হিসেবে ধরবেন। আমি কোনো সাতেপাঁচে থাকবো না। কেননা স্বীয় অভিজ্ঞতা মারফত এটুকু বুঝেছি যে বিষয়টা বেশ বিপজ্জনক। কবিতার সংজ্ঞা নির্ধারণ নিয়ে যেমন নানা মুনির নানা মত আছে তেমনি মতবিরোধ আছে লিটল ম্যাগাজিনের সংজ্ঞা নির্ধারণের ক্ষেত্রেও। এ প্রসঙ্গে নানা রকম সংজ্ঞা ব্যবহৃত হোতে দেখেছি। কেউ বলেছেন, যে পত্রিকা দীর্ঘজীবি সেটা লিটল ম্যাগাজিন নয়। কারো মতে, যে পত্রিকা আকৃতিতে ঢাউস এবং বিক্রয়মূল্য অধিক হওয়া সত্ত্বেও যার প্রতিটি কপি বিক্রি হয় তা কখনোই লিটল ম্যাগাজিন হোতে পারে না। কারো মতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে সেই লিটল ম্যাগাজিন জাতিচ্যূত হয়ে পড়ে।
 এরকম আরও অজস্র শর্ত আরোপিত হোতে দেখেছি। তবে সব শর্ত ভেঙে মূল যে নির্যাসটা পেয়েছি সেটা হলো, বেশীর ভাগ সম্পাদকের কাছেই একমাত্র তাঁর পত্রিকাটিই আগমার্কা লিটল ম্যাগাজিন। বাদবাকি সব আরূঢ় ভণিতা মাত্র। অবশ্য কখনও সখনও আরও দুয়েকটি নামকে স্বীকৃতি দিতে দেখেছি কিন্তু সেই ঔদার্যের পেছনে চক্ষুলজ্জা কিংবা অন্য কোনো শর্ত কাজ করছে কিনা সেটা জানার দুঃসাহস হয়নি।
তবে মতবিরোধ যতই থাকুক, একটি সংজ্ঞার ব্যাপারে অধিকাংশ সম্পাদককে একমত হোতে দেখেছি, সেটা হলো লিটল ম্যাগাজিন হলো সাহিত্যের আঁতুড়ঘর। এখানে লেখক জন্মাবে, হাঁটতে শিখবে, তারপর দৌড়ে গিয়ে ঢুকে পড়বে প্রতিষ্ঠিত পত্রিকার ঘরে। ওপরে উঠতে হলে যেহেতু পিছুটান রাখতে নেই তাই লিটল ম্যাগাজিনের আঙিনায় তার আর কোনোদিন ফেরা হবে না। বড়জোর সাক্ষাৎকারে লিটল ম্যাগাজিনের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাবে।
সবচে যেটাতে বিস্মিত হয়েছি সেটা হলো ওই সামান্য স্বীকৃতিটুকুতেই বাঘা সম্পাদকদের চোখেমুখে চরম তৃপ্তি ফুটে উঠেছে! ক্ষোভ, অভিমান কিংবা অপমানিত বোধ করার কোনো লক্ষণই তাদের ব্যবহারে ধরা পড়েনি। 
শুধু এটাই নয়, আরও একটা বিষয়কে  লিটল ম্যাগাজিন জগতে প্রাধান্য পেতে দেখেছি সেটা হলো, কোনো একটি বাণিজ্যিক পত্রিকাকে প্রতিদ্বন্দী হিসেবে বেছে নিয়ে আবার তাকেই মডেল করে এগিয়ে চলতে। ফলতঃ বিশুদ্ধ সাহিত্য চর্চার পরিবর্তে সেখানে পাঁচমিশেলি বিষয়কেই প্রাধান্য পেতে দেখেছি। যেন কোনো মনিহারি বিপনি, শোকেসে বিবিধ পণ্য সাজিয়ে রেখেছ যাতে কোনো ক্রেতাকে বিফল হয়ে ফিরে যেতে না হয়।
তাবলে বাংলা লিটল ম্যাগাজিন জগতের সামগ্রিক চিত্রটাই যে এরকম এবং সেটা অদ্যাবধি প্রচলিত রয়েছে তা কিন্তু বলছি না। বলার স্পর্ধাও রাখিনা কারণ আমার জন্ম কর্ম সবকিছুই কোলকাতা থেকে ছশো কিলোমিটার দূরের একটা শহরে। যখন লিটল ম্যাগাজিন জগতে প্রবেশ করেছিলাম তখন আমার শহরে এবং পাশ্ববর্তি শহরগুলোতেও ওরকম ধ্যান ধারণারই অহরহ প্রকাশ দেখতাম।
তবে কোনো ধ্যান ধারণাই তো আকাশ থেকে পড়ে না, পারিপার্শ্বিক থেকেই গড়ে ওঠে। আর বাঙালি মননে সবচে প্রভাব বিস্তারকারী মহানগরটির অমন ধ্যান ধারণা গড়ে দেয়ার ক্ষেত্রে কোনো ভূমিকা ছিল কিনা, সেটা বলতে পারব না।
সে যা-ই হোক, কেন জানিনা, ওই  ধাত্রি পান্না বৃত্তি আমার কাছে অস্বস্তিকর ঠেকেছিল। স্ফুলিঙ্গে বাতাস জুগিয়েছিল কিছু ব্যতিক্রমী লেখাপত্র যে সবের মারফত বুঝেছিলাম, লিটল ম্যাগাজিনের দায়িত্ব কখনওই প্রতিষ্ঠানে লেখক/কবি সাপ্লাই করা নয়। লিটল ম্যাগাজিন কোনো লঞ্চিং প্যাড নয়। লিটল ম্যাগাজিন মানেই সাহিত্য আন্দোলন কারণ সে পাঠক রুচির তোয়াক্কা রাখে না। পাঠকের মনোরঞ্জনের দায় তার নেই বরং তার একমাত্র কাজই হলো স্থায়ী রুচির বদল ঘটানো। সাহিত্যের পরিধিটাকে বিস্তৃত করা।
এরপর আমি এবং আমার বন্ধুরা নিজেদের লিটল ম্যাগাজিনগুলোর ঝাঁপ বন্ধ করে শুরু করেছিলাম নতুন একটি পত্রিকা। নাম রেখেছিলাম ‘কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প।’ এবং সেটি ছিল যৌথ সম্পাদিত। সেখানে কোনো সম্পাদকের নাম নয়, মুদ্রিত হোত শুধুই যোগাযোগের ঠিকানা। আমাদের আগে এমন পত্রিকা বাংলাভাষায় প্রকাশিত হয়েছে কিনা সেটা আজও জানা নেই।
 কর্মকাণ্ড এখানেই থেমে থাকেনি, লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরী এবং গবেষণা কেন্দ্রের আদলে আমার শহরেও গড়ে তুলেছিলাম লিটল ম্যাগাজিন এবং লিটল ম্যাগাজিনের লেখকদের বইপত্র নিয়ে একটি প্রদর্শনী তথা বিক্রয়কেন্দ্র। নাম রেখেছিলাম-সেমিকোলন।একটা পোস্টকার্ড মারফত আমন্ত্রণ পেয়েই নিজ খরচে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ছুটে গিয়েছিলেন মাননীয় শ্রী সন্দীপ দত্ত।
 যদিও আমাদের পত্রিকাটিও, হয়ত চালু সংজ্ঞাকে মান্যতা দিতেই,বছর পাঁচেকের মধ্যেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল এবং জনগণ তো বটেই, আমাদের বিপ্লবীয়ানা শহরের লেখক, কবি, সম্পাদকবৃন্দের অনাগ্রহের কারণ হওয়ায় সেমিকোলনেরও অকাল প্রয়াণ ঘটেছিল।
সেদিন যতই অভিমান জাগুক, এখন, ত্রিশ বছর পেরিয়ে নিজেদের কর্মকান্ডে গর্ববোধই করি। কেননা যে ক’দিনই হোক, যতটুকই হোক, লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনকে এগিয়ে যেতে সাহায্য তো করেছিলাম। অনুপ্রাণিত করতে পেরেছিলাম আরও কিছু অনামী অচেনা মানুষকে যারা একই ভাবে কাজ করতে এগিয়ে এসেছিলেন। তারা থেমে যাবার পর এসেছে অন্যরা। সময়ের ফারাক থাকা সত্ত্বেও এই পদক্ষেপগুলো আদৌ বিচ্ছিন্ন নয় বরং সম্মীলিত। এই সম্মীলিত পদক্ষেপের ফলেই লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের গতিবেগ বৃদ্ধি পেয়েছে। ভুল পদক্ষেপগুলোও পারেনি গতিরোধ করতে। আর তাই লিটল ম্যাগাজিনকে কে বা কাহারা সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করেছে, সেই তথ্য আজ আর প্রাধান্য পায় না। তার পরিবর্তে উঠে আসে সোমেন চন্দ, দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, কমলকুমার মজুমদার, অমিয়ভূষণ মজুমদার,শৈলেশ্বর ঘোষ,সুভাষ ঘোষ,বাসুদেব দাশগুপ্ত,মলয় রায়চৌধুরী,উদয়ন ঘোষ,অরূপরতন বসু,কৃষ্ণগোপাল মল্লিক,সুবিমল মিশ্র,সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়,দেবেশ রায় এবং এরকম আরও অসংখ্য নাম। এদের ব্যতিক্রমী চিন্তাভাবনাকে পাঠকের সামনে প্রথম তুলে ধরেছে লিটল ম্যাগাজিনই। গড়পড়তা সাহিত্যের পরিবর্তে পাঠককে আগ্রহী করেছে নতুন রচনারীতির স্বাদ গ্রহণ করতে। সেই প্রচেষ্টা যে বিফল হয়নি তার প্রমাণ,পরবর্তিতে বাণিজ্যিক পত্রিকাগুলো বাধ্য হয়েছে নিজেদের ছাঁচ থেকে বেরিয়ে ওদের কারো কারো লেখা ছাপতে। সবার ক্ষেত্রে অবশ্য অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া কার্যকরী হয়নি। সেসব লেখকেরা জনপ্রিয়তার তোয়াক্কা না রেখে শুধু মাত্র লিটল ম্যাগাজিনকেই তাদের রচনা প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছেন। লিটল ম্যাগাজিন শুধু তাদের লেখাই প্রকাশ করেনি, সীমিত সামর্থ সত্বেও সেসব লেখকেদের বইপত্রও প্রকাশ করেছে। করে চলেছে।
সুতরাং থোড় বড়ি খাড়া সাহিত্যের চর্চা করার পরিবর্তে ব্যতিক্রমী এবং নিরীক্ষা মূলক সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা করে  বাংলা সাহিত্যের সৃজনীধারাটাকে সজীব রেখেছে যে একমাত্র লিটল ম্যাগাজিনই সেটা আজ আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
 লিটল ম্যাগাজিন যদি এই দায়িত্ব পালন না করতো তাহলে বাংলা সাহিত্যের দশা কী হোত তার প্রমাণও হাতের কাছে মজুত আছে। বাণিজ্যিক সাহিত্য পত্রিকাগুলো পাঠক মনোরঞ্জনের ফাঁদে আটকা পড়ে রীতিমত ধুঁকতে শুরু করেছে। একদা হুড়মুড়িয়ে বিক্রি হওয়া দুর্গাপুজো সংখ্যাগুলো এখন পরিণত হয়েছে বিশ্বকর্মা পুজো সংখ্যায়। তাতেও যেহেতু সামাল দেয়া যাচ্ছে না তাই এখন সাহিত্য সম্ভারগুলোর সঙ্গে বিনামূল্যে চামচ, শুকনো লঙ্কার গুঁড়ো, শ্যাম্পুর স্যাসে বিতরণ করেও লোক টানতে হচ্ছে। এরপর আগামীতে যদি পুজো সংখ্যাগুলো জন্মাষ্টমী সংখ্যায় পরিণত হয় এবং বাই ওয়ান গেট ওয়ান ব্যবস্থা চালু হয় তাতেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। যেহেতু চক্ষুলজ্জা বশতঃ প্রসাদ কবির সুরে স্বখাত সলিল সংক্রান্ত গানটা ওরা গাইতে পারছে না তাই নিজেদের ব্যর্থতাকে ঢাকতে অজুহাত দিচ্ছে বাঙালি পাঠকের উদাসীনতাকে।কিন্তু সেই অজুহাত যে কতটা মিথ্যে তার জলজ্যান্ত প্রমাণ, লিটল ম্যাগাজিনের প্রতি পাঠকের আগ্রহের উত্তরোত্তর বৃদ্ধি। আমার বক্তব্যকে কারো যদি অতিশয়োক্তি মনে হয় তাহলে তাকে অনুরোধ করব বইমেলায় কিংবা লিটল ম্যাগাজিন মেলায় গিয়ে লিটল ম্যাগাজিন বিক্রির পরিসংখ্যানটা জেনে নিতে।
এই জনপ্রিয়তাও শুধু নতুন রীতির গল্প কবিতা প্রকাশের কারণে বৃদ্ধি পায়নি, সাহিত্য সংস্কৃতি সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে যে ধরণের চর্চা লিটল ম্যাগাজিন করে চলেছে সেসব বাণিজ্যিক পত্রিকার কাছে কল্পনাতীত। এমন কী যে লেখকদের ভাঙিয়ে প্রতিষ্ঠান চিরকাল ব্যবসা করে এসেছে তাঁদের সাহিত্যের মূল্যায়ণ করার দায়িত্বটাও লিটল ম্যাগাজিনই স্বেচ্ছায় কাঁধে তুলে নিয়েছে। বলাবাহুল্য এই দায়িত্ববোধ সম্পূর্ণভাবেই সাহিত্যের স্বার্থে, পাঠকের স্বার্থে।
এ প্রসঙ্গে তিনজন সাহিত্যিকের কথা বলে এই বক্তব্য শেষ করবো যারা বিগ হাউসগুলোতে চিরকাল লেখালিখি করা সত্বেও লিটল ম্যাগাজিনের সংশ্রব এড়াতে পারেননি। শুধু লেখালিখি নয়, লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদনাও করেছেন। তাঁরা হলেন বিমল কর,সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এবং সদ্য প্রয়াত রমাপদ চৌধুরী। কেন এই দায় ওঁরা অনুভব করেছিলেন সেটা বলতে পারব না তবে এটা জানি যে আগামীতে তাঁদের চিন্তা এবং সাহিত্যকর্মের সঠিক মূল্যায়ন করার দায়িত্ব কোনো বাণিজ্যিক পত্রিকা নয়, পালন করবে লিটল ম্যাগাজিনই।
পরের কথা পরে, আপাততঃ এটুকুই বলতে চাই যে ওই মানুষগুলো প্রকৃতই দূরদৃষ্টি সম্পন্ন ছিলেন।
নমস্কার।     

(নিবন্ধটি ৪ই অক্টোবর ২০১৮,সাহিত্য অকাদেমি সভাঘরে প্রদত্ত বক্তব্যের লিখিত রূপ)

মানসী রায়ের অণুগল্প : চৌকাঠ








মানসী রায়
চৌকাঠ

মন্দিরা তৈরি হচ্ছিল। পিতৃশ্রাদ্ধ মিটিয়ে ছেলে আবার দিল্লি ফিরে যাবে। এয়ারপোর্টে তাকে বিদায় জানাতে সে-ও উপস্থিত থাকবে। যদিও ছেলে বারবার বারণ করেছিল এইরকম শোকের সময়, মানসিক বিপর্যয় নিয়ে তাকে বাইরে না বেরোতে। মন্দিরা শোনেনি। সত্যিই, এত আকস্মিক ভাবে সবকিছু ঘটে গেল! স্বাস্থ্য নিয়ে সুকল্যাণের কখনওই তেমন কোনও অভিযোগ ছিল না। তারপরও... ডাক্তার বলছিলেন ম্যাসিভ এটাক নাকি কোনওরকম পূর্বলক্ষণ ছাড়াই হতে পারে! তবে শেষ ক'দিনে বাড়ি ভর্তি লোকজনের মধ্যে থেকে মন্দিরার প্রাথমিক দিশেহারা ভাবটা অনেকটাই কেটেছে। সে জানে তার আসল সমস্যা শুরু হবে এর পর থেকে। একমাত্র সন্তান বাইরে পড়াশোনা করে। স্বামীহীন একার জীবন খুব স্বস্তির হয়তো হবেনা।

       বিশাল আয়নাতে নিজেকে অপাঙ্গে দেখছিল মন্দিরা। বিছানার পাশের টেবিলে সুকল্যাণ আর ছেলের সর্বশেষ ছবিটা ফ্রেমবন্দি করে রেখে দিয়েছে ছেলে। ছবিটার দিকে তাকিয়ে সামান্য থমকাল মন্দিরা। বাইশটা বছর প্রেমে-অপ্রেমে কীভাবে যেন কেটে গেল! অথচ সুকল্যাণ কোনওদিনই তার সেই কল্পনার পুরুষ ছিলনা। বয়ঃসন্ধির সময় থেকেই তার মনশ্চক্ষে যার আনাগোনা, সে বাস্তবে সত্যি সত্যি তার সামনে এসে হাত বাড়িয়ে দিল কই? ভিড়ের মধ্যে, নির্জনে, সমুদ্রে, পাহাড়ে...সব জায়গায় মন্দিরা কেবলই খুঁজে বেড়াত একটা নির্দিষ্ট কল্পিত মুখ আর তার কাল্পনিক চরিত্র! তার প্রাক্তন প্রেমিক বা সুকল্যাণ- কারুর সঙ্গেই বহু চেষ্টা করেও মন্দিরা যাকে মেলাতে পারেনি!  অন্যদিকে ছেলে যত বড় হতে থাকল, সে অপার বিস্ময়ে, অবিশ্বাসে ধীরে ধীরে বুঝতে পারল তার সেই প্রবল অস্তিত্বহীন, আকাঙ্ক্ষিত পুরুষকে সে শেষপর্যন্ত নিজের গর্ভে ধারণ করে ফেলেছে!  সেই মুখ, সেই চেহারা, সেইরকমই কাঙ্ক্ষিত স্বভাব...। ছবিতে পাশাপাশি দুজন। বাবা-ছেলে? কল্পনা-বাস্তব? না প্রতিদ্বন্দ্বী?
     
        সাদা নয়, মাঝবয়সী মন্দিরা নিজেকে তার প্রিয় রঙে সাজাচ্ছিল। প্রার্থিত পুরুষের কাছে এটাই হবে তার প্রথম এবং শেষ নিজেকে প্রকাশ করার অছিলা। অব্যক্ত, অনুচ্চারিত। তারপর হয়তো কোনও বৃদ্ধাশ্রম - মন্দিরা ছকে রেখেছে।

ছেলে ডাকছিল ঘরের বাইরে থেকে। মন্দিরা অভ্যেসবশে সাড়াও দিল। কিন্তু সে চৌকাঠটা কিছুতেই ডিঙোতে পারছিল না!

প্রগতি মাইতির অণুগল্প : শূন্য





প্রগতি মাইতি
শূন্য


ছোটবেলার একটা ঘটনা মনে পড়ে গেল। একদিন আমার রেজাল্ট দেখে বাবা চুপ। বাবাকে গম্ভীর মুখে দেখলে আমার খুব ভয় হয়। তখন আর কোনো কথা বলা যাবে না। কিছুক্ষণ পর বাবা বললো, তোর প্রত্যেকটা সাবজেক্টে নম্বরের বাঁদিকের শূন্য কবে ডানদিকে বসবে বলতে পারিস ? সেদিন আমি শূন্য থেকে শুরু করেছিলাম।

সুকুমার সরকারের অণুগল্প : বহিত্র




সুকুমার সরকার
বহিত্র

কফি খেতে খেতে আড্ডাস্থল থেকে বেরিয়ে এলো সায়ন্তন । বেরিয়ে এসে দরজার বাম পাশে রাখা ডাইনোসরের মতো হা করা ডাস্টবিনে কাগজের কাপটি ফেলে দিয়ে হনহন করে সিঁড়ি বেয়ে নিচের দিকে নামতে লাগলো । কয়েক ধাপ নামতেই পেছন থেকে খপ করে জামার কলার টেনে ধরলো আয়েশা । বললো , কী ব্যাপার ! কাউকে কিছু না বলে উঠে এলে যে ? আড্ডা ভালো লাগছে না বুঝি ?

এমন ভাবে আয়েশা সায়ন্তনের জামার কলার ধরেছে যে , অনিচ্ছাতেও সায়ন্তনকে ঘুরে দাঁড়াতে হলো । আয়েশা দু'স্টেপ ওপরে , সায়ন্তন দু'স্টেপ নিচে । আয়েশার পরনে জিন্সের হটপ্যান্ট আর ওপরে একটি ছোট্ট গেঞ্জি মতো কিছু । প্যান্ট আর গেঞ্জির মাঝখানে আট ইঞ্চির মতো ফাঁকা অংশ দিয়ে আয়েশার শাদা চামড়ার নরম সেক্সি কোটিদেশ দেখা যাচ্ছে ।

দু'স্টেপ ওপরে দাঁড়িয়ে থাকা আয়েশার সেই সেক্সি কোটিদেশ সায়ন্তনের মুখ বরাবর । মুহূর্তে সায়ন্তনের মাথা ঘুরে গেল । নিজেকে সামলাতে না পেরে আয়েশার সেই বেরিয়ে থাকা কোটিদেশ দুই হাতে জড়িয়ে ধরে গভীর একটি চুমু দিল । আয়েশা চোখ বন্ধ করে সায়ন্তনের চুম্বন গ্রহণ করে একটু যেন শিহরিত হয়ে ওঠলো । এই মুহূর্তের করণীয় কী সেটা আয়েশা জানে । জামার কলার ছেড়ে এক হাতে সায়ন্তনের মাথা নিজের কোমরের সঙ্গে চেপে ধরলো । আরেক হাতে সায়ন্তনের মাথার চুল বুলাতে লাগলো । পাশ দিয়ে বয়স্ক কেউ একজন ওপরে উঠছিলেন । দৃশ্যটি তাঁর চোখে পড়ল । সায়ন্তন আর আয়েশা সে দিকে ভ্রূক্ষেপ করলো না ।
-- হঠাৎ রাগ করে উঠে যাচ্ছিলে কেন ? আয়েশা বলে উঠল ।
-- রাগ করে নয় , এমনি !
-- ওটুকু বুঝি ! এমনি নয় !
-- বোঝোই যখন , কারণ জিগ্যেস করছো কেন ?
-- চলো , অন্য কোথাও যাই !
-- অন্য কোথাও মানে ?
-- চলো প্রিন্সেপ ঘাটে চলো । ওখানে গঙ্গার ধারে বসবো । নৌকায় উঠে নদীতেও ঘুরতে পারি ।
-- হঠাৎ এতটা একলা হতে চাইছো কেন ?
-- তুমি তো তাই চাও ! বন্ধুদের সঙ্গে আমাকে দেখলেই তো তোমার মাথা গরম হয়ে যায় !
-- বোঝোই যখন তখন অন্যের সঙ্গে মেশো কেন ?
-- আরে বাবা , ওরাও তো আমার বন্ধু , না কি ! এক সঙ্গে পড়ি । তা ছাড়া , তুমি তো তখনো এসে পৌঁছাওনি । তুমি অমন করলে ওরা কী ভাববে বলো তো ?
-- ওরা কী ভাববে সেটা ভাবছ ! ওদের সঙ্গে তুমি ইয়ার্কি ফাজলামি করলে , কথা বললে আমার কী হয় সেটা বোঝো না ? আমার ভেতরটায় অস্থির অস্থির লাগে ! গা হাত পা কেমন জ্বালা করে !
-- তুমি আসলেই একটা পাগল ! বিকৃত মনের ? এমন করলে তো তোমার সঙ্গে সম্পর্কই টিকে রাখা যাবে না !
-- বোঝোই যখন তখন ওদের সঙ্গে মেশো কেন ?

সায়ন্তনের এই কথার কোনো উত্তর দিল না আয়েশা । মনে মনে ভাবল , এই বিকৃত মানসিকতার ছেলের সঙ্গে কেন প্রেমে জড়িয়ে পড়লাম ! এই ধরনের ছেলেদের হাত থেকে নিস্তার পাওয়াও কঠিন ! এরা কোনো কিছুকে নিজের ভাবলে সেই জিনিসকে অন্যকে ছুঁতে পর্যন্ত দেয় না !
সায়ন্তন আয়েশার চুপ করে থাকা দেখে আবার বলে উঠল , সারাটা জীবন তুমি শুধু আমাকে ছাড়া অন্য কারও কথা ভাববে না ! কারও সঙ্গে মিশবে না !
আয়েশা সায়ন্তনের এই বিকৃত মানসিকতার সরাসরি উত্তর না দিয়ে বলে উঠলো , পোশাক আশাকে তো নিজেকে কেতাদুরস্ত আধুনিক মনে করো ! কাউকে তোয়াক্কা না করে কলেজের সিঁড়িতেই প্রেমিকার কোমর জড়িয়ে ধরতে পারো ! অথচ প্রেমিকার স্বাধীনতার ব্যাপারে এখনো মান্ধাতা আমলের রয়ে গেছ ! প্রেমের বেলাতেই এমন ! বিয়ে করলে কী করবে ?
-- পোশাকে তুমি তো আমাকেও ছাড়িয়ে গেছ !
-- সে তো তোমার জন্যই ! তুমিই বলো , সালোয়ার কামিজ পড়ে এলে আমাকে ব্যাকডেটেড লাগে ! আসলে মনের দিক থেকে তুমি নিজেই ব্যাকডেটেড ! পোশাকের খোলা মেলা আসলে সেক্সয়ের জন্য । সেক্স ছাড়া তুমি কিচ্ছু বোঝো না ! তাই আমি অন্য কারও সঙ্গে কথা বললেই তোমার খারপ লাগে ! সবাইকে নিজের মতো ভাবো !
-- এখানেই বকবক করবে , না কি এই যে এক্ষুণি বললে গঙ্গার ঘাটের দিকে যাবে , তো চলো ? অস্থির সায়ন্তন বলে উঠলো ।
আয়েশা সায়ন্তনের বেষ্ঠিত বাহুর থেকে নিজেকে ছড়িয়ে নিয়ে সায়ন্তনের হাত ধরে সিঁড়ি থেকে নিচের দিকে নামতে বললো , তা হলে বেশ ভালোই হয় না ? নদীর ঘাটে গিয়ে গঙ্গা বক্ষে নৌকার ছইয়ের আড়ালে নিজের সেক্সটাও মিটিয়ে নিতে পারো !
আয়েশার হাত ধরে নামতে নামতে সায়ন্তনও বলে উঠলো , আমি কি তোমার সঙ্গে জোর করি ? তুমি মজা পাও না ?
আয়েশা সায়ন্তনের এই কথার কোনো উত্তর দিল না ।

সায়ন্তনের হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে মনে মনে ভাবলো , এ সবের পরিণতি কী ? শরীর সর্বস্ব এই প্রেমের আদৌও কি কোনো পরিণতি আছে ! নিজেকে একটু নিয়ন্ত্রণে রাখলে কি ভালো হতো না ! নিজেকে নষ্ট করে সভ্যতার ভিন্ন গলিতে ঢুকে পড়ে এ কোনো সভ্যতার জন্ম দিচ্ছি আমরা ? কিন্তু ফেরারও কি পথ আছে ? নাকি চাকাহীন বহিত্র যানের মতো সময়ের ভিন্ন স্রোতে কেবলি ভাসতে থাকবো ?

যুগান্তর মিত্রের অণুগল্প : না ফেরার গল্প





যুগান্তর মিত্র
না ফেরার গল্প


~ হ্যারে লখা। তু উখানে চান করতি?
~ ইটা ক্যামন কতা রে বসু। চান করব নাই ক্যানে?
~ ওখেনে জল আচে? শুনি যে পুক্কুর নাই, লদী নাই, ডুবাও নাই। 
~ লদী, পুক্কুর নাই বটে। কিন্তুক জল আচে ম্যালা। মাটি থিকা একঠো মোটাপানা পাইপ দি লগবগা জল উটে। সিখানিই চান করলম। তাপ্পর হোটেলের এক বাবু কাজ দেল। শুতে দেল দুকানঘরেই। দুবেলা পেট পুরি খেতি দেয়। আর কিচু দেয় না। আমিও চাই না রে।
'পাট্টির মিটিনে' গিয়েছিল অনেকের সাথে লখিন্দরও। মঞ্চ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেনি সে। লোকে লোকারণ্য। বড় বড় বাড়িঘর, নানা গাড়ি, ম্যালা লোকজন দেখতে দেখতেই নজর পড়ল তার গ্রামের কেউ আশেপাশে নেই। অনেককে জিজ্ঞাসা করেও হদিশ পায়নি তাদের। নিজের জেলা, সাকিন তার জানা নেই। গ্রামের নামও কেউ শোনেনি। তাই বাড়ি ফেরার কোনও সূত্র পাওয়া যায়নি। সেই থেকে লখাই কলকাতাতেই আছে। তবে মনে রেখেছে বসুমতীর কথা, যাকে সে ভালোবাসে আজও। বাড়ি ফিরলে বসু তাকে কী কী জিজ্ঞাসা করতে পারে, সেসব ভাবে সে দিনরাত।
আজ অনেকদিন পর প্রচুর লোক আসছে শহরে। লোকজনের হাতে হাতে ঝাণ্ডা। লোকনাথ ভাতের হোটেলের দরমার বেড়ার ফাঁক দিয়ে এসব দেখেই লখাই বুঝতে পারে সেদিনের মতোই কোনও 'পাট্টির মিটিন' আছে। কাজ ফেলে ছুটতে থাকে লখাই, আর চিৎকার করে বলে, 'তুমরা পলাও। ইখিনি হারাই গেলি আর ফিরা লাগবে না ঘরে। পলাও।'
'এইসব পাগল-ছাগলদের জন্য ওপরওয়ালার ধমক' শুনতে হবে পুলিশদের। তাই পুলিশের বড়বাবুর নির্দেশে লখাইকে ভ্যানে তোলা হল।
'~ ও পুলিশ কাকারা। আমি কিচু দোষ করি নিই গো। অরা মিটিনে এইচে। আর ফিরি যেতি পারবেনি। মিটিনের লুকেরা আনে শুদু, ফিরায় নেয় না গো।
ভ্যান ক্রমশ অদৃশ্য হয়ে যায়। আর হারিয়ে যেতে থাকে লখাইয়ের কথাগুলো।

অমিত মুখোপাধ্যায়ের গল্প : খানিকটা খাবার







অমিত  মুখোপাধ্যায়
খানিকটা খাবার


সেই কবে থেকে বাগানের বাইরে যেতে চায় গোন্দু।চা আঁকড়ে বাঁচার ইচ্ছে একটুও তার নেই।সারা জীবন ধরে চ্যাপ্টা-মাথা সবুজ বামনদের ছাউনি আর বনবাদাড়ি দিগন্ত দেখে তার চোখ পচে যেতে বসেছে।ওই সব হাত-পা-খোয়ানো, ঘাড়হীন, সার-দেওয়া সমান মাপের চেহারাগুলো কখনো সখনো আদৌ জীবন্ত বলে মনে হয় না।বুঝি নিষ্প্রাণ গালিচা পাতা রয়েছে সব দিকে !ভোরবেলা থেকে তাদের জল, সার, ওষুধ দিয়ে সেবা কর।পাশে কোথাও নতুন বাচ্চার দলকে তৈরি কর,বড় কর,নিয়ে এসে নতুন ইস্কুল বসাও। তারপর বৃষ্টি ঠাণ্ডা গরম এসব বুঝে পাতার বাড় দেখে দু’বার কি তিন বার চুল আর কান ছাঁটতে যাও।তার জন্য স্থায়ী শ্রমিকে কুলোবে না, ফালতুদের লাগাও। ...তবু তখন একঘেয়ে সবুজের মাঝে নানা জামাকামিজের রঙ দেখতে ভালো লাগে।যত মাথা কাটো,তত বেঁটে গাঁটু ছাত্রের দল বাধ্য কান আর ঘাড় মেলে গোল পাকিয়ে থাকবে।

এমন ম্যাদামারা জীবন মোটে পছন্দ নয় গোন্দুর।ঝাঁক বেঁধে সবাই একই কাজে জীবন খতম করে দিচ্ছে।তারপর বেশির ভাগ মরদ ছুটবে নেশা করতে।দিন না-ফুরোতে ডেরায় গিয়ে ঢোকো।চিতা বেরিয়ে এসে চিত করে দেবে।ছিনিয়ে নেবে গরু-ছাগল, নিদেন মুরগি !বাড়াবাড়ি করলে বনকর্মীরা খাঁচা পাতবে। হাতি হাতিয়ে নেবে চাল আটা কলা কাঁঠাল।শুঁড়ে চালান করবে চোলাই।গুঁড়ি মেরে থাকবে অজগর,যা পাবে গিলবে।চিতা বা অজগর ধরা পড়লে তবু জঙ্গলে চালান যায়।তাতে যতই জঙ্গল ভরে উঠুক না কেন!কিন্তু গণেশ বাবাজিদের ঢোকাবে কোথায়?বেশি জ্বালালে ভেঙেচুরে দলে দেবে পায়ে।

ঘাপটি মেরে থাকে বাগানের মালিকরাও।বুনো জীবদের মতো এরাও একের পর এক ক্ষতি করে কখন পালিয়ে যায়।জমি, বাগানের অংশ, আসবাব এসব সম্পত্তি বেচে দেয়।মাইনে,অন্য সুবিধা বন্ধ করে,ফি পুজোয় বোনাস দেওয়া নিয়ে নখড়া করে।চাঁটি খেয়ে আরও মুখ থুবড়ে পড়ে বাগান।কখনো বাগান একেবারে বন্ধ হয়ে গেলে তো সর্বনাশ!বেকার হয়ে যাওয়া লোক তো চারপাশের জগতের কিছু জানে না!মদেশিয় ভাষায় কথা বলে নানা প্রদেশ থেকে আসা নানা ভাষা-বলা নিজেদের লোকের সাথে।পুরুষের পর পুরুষ নিজেদের বাগান আর লাইনে বন্দী করে ফেলেছে যে!অন্য কাজও বিশেষ জানে না।কম খেতে পাওয়া দুবলা শরীর নিয়ে ইটভাঁটিতে, পাথরভাঙা বা কোথাও গুদামের মাল ওঠা-নামানোর কাজ বেশি করতে পারে না।ছেলেরা ছোটে ভূটান থেকে কাশ্মীর।মেয়েরা নিখোঁজ হতে থাকে।...বাপু যতই বোঝাক, এমন জগতে সে পড়ে থাকবে কেন !

আরে বাবা, সে তো পড়ালেখা কিছু করেছে!বারো কেলাস কিছু কম হলো!.বাপু জোর করে থামিয়ে দিতে চায়।বোঝাতে চায় যে গোন্দুকে তো আর পাতা-শ্রমিকের কাজ করতে হচ্ছে না!বাপু যেহেতু মানিজারের কাজ করে, তার কিছু কথা সাহেব রাখে।সে নাকি গোন্দুকে পাহারাদার রাখতে রাজি হয়েছে।...আরে সে তো বুধুয়া অচানক মরে গেল বলে।মানিজার ভাবছে ভীতু বাপের ছেলেও নরম হবে।সবাই নিজের পেটোয়া লোক চায় কিনা!...কিন্তু মানিজার নিজে চলে গেলে!ওরা তো আকছার কাজ ছেড়ে বেশি মাইনেয় অন্য বাগানে দৌড়ায়।তখন কি হবে?বাপুর কপাল ভালো বলে এসকল সমঝতেই চায় না।

চুপিচুপি নানা জায়গায় চাকরির চেষ্টা জারি রেখেছে সে।শহরে কত রকম কাজ!কত সুযোগ সুবিধে! এখানে কারও শরীর খারাপ হলে ডাক্তার আর দাওয়াই জোগাড় করতেই বিমার-আদমি আর বাড়ির লোক-দুতরফেই  জান নিকলে যাবার দশা হয়।বাগানের ডাক্তার তো যা-ই বিমার হোক,এক কিসিমেরই ট্যাবলেট দেয়!কোম্পানি হয়ত আর কিছু দেয়ই না তাকে!

তা বাদে শহরের জীবনে কত রকম মজা থাকে।কত আজব কিসিমের চিজ ছড়িয়ে থাকে।ওর বন্ধু উইলিয়ম টোপ্পো বলে যে এনজয় করা কাকে বলে তা শহরেই বোঝা যায়।টোপ্পোর বাপ বাগানের স্টোর দেখাশোনা করে।বহুত পয়সা।অনেক খরচা করে ছেলেকে পড়তে শহরে পাঠিয়েছে।কয়েক দিনেই তার চুল রঙদার, চামড়া চকচকে,হাত উল্কিভরা হয়েছে।জামাকাপড় বাহারি আর মুখ নায়কের মতো দেখায়।খালি বলে,তুই চলে আয়, তামাশা কাকে বলে দেখবি।কত কায়দার সব মজা লোটা!না এলে সব বলা যাবে না।...তারপর থেকে অস্থির হয়ে আছে সে।

                                                 ******      দুই      ******

বাপু বলে, চল,জমিটুক দেখে আসি।কাল যাওয়া হয় নাই।সামান্য জমি, কিন্তু ধানি জমি তো!তোর যে জমির টান নাই।দেখভাল করতে পাঠাতেই পারি না।ধান,সবজি যে-টুক হয়,মাগ্গির দিনে তা-ই লাভ!চা-ঝোপের মাঝখান দিয়ে যেতে দূরে জঙ্গলের গায়ে খানিক নামো জমি।অন্যদেরও তেমন আছে পাশে।জল-কাদা কাজে লাগিয়ে চাষ।বাপুই বেশির ভাগ কাজ করে।জোর করে সাথে নিলে তবে সে যায়।একা যেতে তার অল্প ভয়ই করে।কখন বন থেকে চিতাবাঘ লাফ দিয়ে পড়ে!বা হাতি এসে পিষে দেয়!হেঁটে চলার পথে সে বোঝে যে বাপু তাকে আজ নিয়ে চলেছে  বোঝাবার জন্যে।সে যাতে পাহারাদারের কাজটা নেয়।অনেক সব সুবিধের কথা বলে চলেছে।নিজের বাড়িতে সকলের সাথে থাকতে পারবে।চেনা জায়গায় চেনা মানুষের সাথে করা অনেক সহজ।এমন সুযোগ সকলে পায় না।তা ছাড়া বাপুর ছেলে হবার জন্যে পরিচিতি,...বাড়তি সুবিধে...এই সব আর কী!

বাপুকে দোষ দেয় না গোন্দু।তার হাতে পয়সা নেই,অন্য উপায় নেই।এই বাগিচাই বাপুর দুনিয়া।পাকা নোকরি,বাসা,জল,আলো,কম খাজনার চাষজমি,অন্য কিছু সুবিধে- এ সব পেয়েছে সততা আর খাটুনির জোরে।কেবল মালিক আর মানিজারকে সে ভয় পায়।বাড়তি মান্য করাটা তাই চোখে লাগে।যে ব্যাটারা পাতা-শ্রমিকদের দাস বানিয়ে রেখে আলাদা রাজত্ব চালায়,যখন তখন মাইনে বাকি রাখে,বাগান বন্ধ করে দেয়,তাদের আবার অত ভক্তি করা কেন?চাকরি করছ ঠিক ভাবে,তা-ই তো যথেষ্ট,অত কাছে ঘেঁষতে যাওয়া কেন?মাটি ছিটিয়ে সে জমি কোপায় আর দেখে বাপুর কিন্তু তার মতো অত জোরে শ্বাস পড়ছে না!তা হলে সে কি বেশি হাঁপিয়ে পড়ছে!

ফেরার পথে  কলমি, বতুয়া, ঢেঁকি শাক, গিমা শাক, খারকোন, কচু – আগাছার মাঝে যা মেলে তুলে আনে বাপু।চারদিকে আরও কত শাক-পাতা বেড়ে ওঠে এখানে!বাপুর কাছ থেকে চিনে নিতে হবে।



                                                             ****** তিন ******

চায়ের চেহারা কাজে লাগাতে সিনেমার দল এসেছে।চায়ের চাদর,চায়ের গালিচা – এসব কত ভালো কথা বলে হাসাহাসি করছে।লজেন চকলেট দিচ্ছে বাচ্চাদের।হিরোইনটা ঝক্কাস সেজে নাচ দেয়। ব্যস্ততা,হইচই,আলো সাজানো,পেছন দিক খালি করার জন্য চেঁচানো,হঠাৎ তারপর সব চুপ।ছবি নিবার তরে লোকটা ঝুঁকে পুরো কুঁজো হয়ে যায়।ক্যামেরা চালু হতেই হিরো হিরোইনটা কেমন কলের পুতুল হয়ে যায়। ...অত লোক জমেছে, তার মাঝে গোন্দুকে এটাসেটা কাজ দেয় সিনেমাওলারা।পিঠ চাপড়ে দেয়।যাবার আগে টাকাও দেয়।ওদের দলে চাকরির কথা তখন তোলে গোন্দু।

আররে, চাআকরিই !ভাইটি জানিস না, এ এক আজব দুনিয়া।আজ আছে কাল নেই।দিব্যি জায়গা তোদের, নিজের মুলুক ছেড়ে যাবি কেন রে!যা পারিস এখানে করে নে!বাইরে সব কিছু ছিবড়ে হয়ে গেছে ভাইটি!নতুন কাজ ছেড়ে দে,পুরনো লোক কাজ রাখতে জেরবার হয়ে যাচ্ছে!সব সময় গেল গেল ভয়ে মরছে!

কাজে লাগতেই হয় গোন্দুকে।শালো,এত জায়গায় এত দিন ধরে চেষ্টা করেও একটা চাকরি বাইরে কোথাও জোটাতে পারল না!কম সে কম পরীক্ষা বা ইন্টারভ্যু তো নিতে পারতিস!নইলে বুঝবি কেমন করে!নাকি ধরে নিলি চা-পাহাড়িয়ার দেশের ছেলের দম নেই!বাড়ির হাল এদিকে খারাপ।ভাই আর বোনের পড়ার খরচ বাড়ছে।জিনিসের দাম লাফ দেয়।গত ঝড়ে বাসার চাল উড়ে গেল।কোম্পানি কাউকে কিছু দিল না।বাপুর এতদিনের কষ্টে জমানো টাকা বেরিয়ে গেল। ...তাই ঢুকে পড়তেই হলো তাকে। ...আর প্রথম রাতেই নাটক !

সাথে আরেক নাইট গার্ড ফুকনদা আছে।প্রথম দিকে শেখাতে হবে তো গোন্দুকে!মানিজার-বাংলোর গেটের পরে বাঁয়ের গুমটি ঘরে দুজনে বসে আছে।পাখা আছে যে ওখানে!বাইরে তখনো গরম হাওয়া।কী দিনকল পড়ল রে গোন্দু!ফুকনদা বলে,রাতভর পসিনা ঝরানোর মাফিক সিনা তৈয়ার করতে হবে।গরমি কা টেম পুড়বি পুরা মরসুম,জাড় কা টেম জমে যাবি রে! ছোড়ো উ সব, শুনো, অব হম শোতে হেঁ,তুম খয়াল রখখো।যো বতায়া সো ইয়াদ রখখো।এক বাজে তক্ উঠ যায়েঙ্গে।তব হমারে জম্মিদারি।...বলে দুম করে ঘুমিয়ে পড়ে ফুকন। ... বারোটা নাগাদ কিসের শব্দ!বাংলোর পেছন দিকে মনে নেয়!ধুপ্ করে ফের শব্দ! ...ও ফুকনদা,উঠ্! ও দিকে আওয়াজ হয়! ...আঁ উঁ করে পাশ ফিরে সে বলে,আরে কৈসা আওয়াজ!পাখা বন্ধ করে দুজনে কান খাড়া করে থাকে।নাঃ, কিছু তো শোনা যায় না!

-ছোড়ো, কেয়া উল্টা সিধা শুনা!পহেলা ডিপটি হ্যায় না! ডর লগা তুমহে !

-আরে নেহি,  দো দফে শুনা !

তবু দুজনে গুমটির বারান্দায় দাঁড়িয়ে গরমে ঘামতে থাকে।...কয়েক মুহূর্ত পরে বাংলোর বাঁ দিক থেকে পচা গন্ধ ভেসে আসে।অভিজ্ঞ ফুকন তখনি সতর্ক হয়ে যায়।আঁধারের মাঝে ঘনতর কালো কিছু নীরবে সরে যায় ওদিকের লোহার গেটের দিকে।হাতি !বিশাল মাপের গজরাজ!কতগুলো আছে! বোঝার আগেই লোহায় ঘা পড়ার শব্দ!...ফের আরও জোরালো ঘা!বিরাট ধাতব শব্দে ভেঙে হুড়মুড় করে পড়ে কাঠামো।কালো পাহাড় বুঝি হাওয়ায় ভেসে সরে যায়।না, আর কিছু  দেখা যায় না।তা মানে একটাই হাতি ছিল।

-চল ছুট,পিছে দেখতেঁ হ্যায়।

-আরে ইয়ে দেখিয়ে দাদা পিছে কা দিবার তোড় দিয়া !

বোঝা গেল বন থেকে বেরিয়ে এদিক দিয়ে যাবার সময় গণেশজী পাকা কাঁঠালের গন্ধে মাথা ঠিক রাখতে পারে নি।দেওয়ালের বাধা চুকিয়ে জমিয়ে ফলাহার করে আর পেছনে তাকাতে চায় নি।সোজা পথের কারবারি সামনে হেঁটে আরেক বাধা পেরিয়ে নৈশযাত্রায় ফের গেছে।

সেরাতে আর ঘুম হয় নি দুজনের।মানিজারকে একই রকম জবান দিতে হবে,যাতে বোঝা যায় সম্পত্তি নষ্টে তাদের কোন দোষ ছিল না।বাকি রাত ধরে ফুকন জংলি প্রাণীদের চলাফেরার নানা রকম সকম বোঝায় নয়া পাহারাদারকে।বন্ধু হয়ে যায় দুজনে।

                                                          ****** চার ******

বাসায় ফিরছে গোন্দু।বাপু কাজে পাঠিয়েছিল কালচিনিতে।অনেক বেশি সময় লেগেছে কাজ  সারতে। তারপর বাসও এসেছে দেরিতে।বাগানের কাছে নামতে রাত হয়ে গেছে।অথচ আজ রাতে পাহারা দেবার আছে।বাসায় ঢুকে খাবার সময়টুকু পাবে না হয়ত।এখনো অনেকটা পথ।জোর হেঁটে সবে বাগানে ঢুকেছে।এক জায়গায় আগের মতো পচা গোবরের মতো গন্ধ পায়।ভয় পায় কি সে!না না, কেবল সতর্ক হয়ে নজর রেখে চলে।চা-ঝোপের মাঝ দিয়ে আরও কিছু পথ এগোতে তার মনে হয় ওখানে সামনে ওই গাছদুটো তো ছিল না!ফুকনদা বলেছিল রাতে হাতিকে আঁধার কোন গাছের মতোই দেখায়।সন্দেহজনক কালো কিছু দেখলে সতর্ক হতে হবে।পচা গন্ধ বলছে গণেশজী হবে!দাঁড়িয়ে পড়ে সে।একটা গামার গাছ ছুঁয়ে অপেক্ষা করতে থাকে।তেমনই বলেছিল ফুকনদা।আর সত্যিই মাঝারি গাছটির সেই গুঁড়ি তাকে অচেনা আশ্বাসের ছোঁয়া দেয়।

কত অনন্ত সময় চলে যায়।বনের জানোয়ারের কী বিস্তর ধৈর্য রে বাবা!ও কি পাতা খেয়ে চলেছে,নাকি গোন্দুকে দেখে থমকে গিয়ে বুঝে নিতে চায়! গোন্দুর পা টনটন করে।ঘুম ঘিরে আসে।...আরে কখন নিঃশব্দে অদৃশ্য হয়ে গেল গণেশজী!আর কয়েক মিনিট দেখে পা টিপে টিপে এগোয় সে।রাত কি মাঝখানে পৌঁছে গেছে ! পাহারার চিন্তা তার মাথা থেকে বেরিয়ে গেছে।...খাবার চাই,যা হোক কিছু খাবার !পেট কেমন করে।ক্লান্তিতে জোর কমে আসে।খুব একটা বেশি পথ যেতে পারে নি তখনো ...হায় রে,সামনে ও কী জ্বলে !জোড়া চোখ !ফুকনদা শিখিয়েছে যে বাগানে আঁধারে কিছু জ্বললেও থেমে লুকিয়ে পড়তে হবে।স্থির দাঁড়ালে হয় ওরা খেয়াল করবে না,নইলে অচেনা ঝামেলা এড়িয়ে অন্য দিকে চলে যাবে।নড়াচড়া দেখে সে,  ...বাপ রে চিতা !...ফের দাঁড়াও। মাথা নিচু করে চায়ের গন্ধ শুঁকতে থাক আর খেয়াল রাখো।...আবার আরেক জন্ম কেটে যায়।চিতাবাঘ অতি ধীরে পাশের লাইনে ঝুপড়ির দিকে যায়।এদিক ওদিক সাবধানে দেখে,পা টিপে,থমকে কান পেতে, চোরের মতো। তা দেখে ঐ দশাতেও ওর হাসি পায়।লাইনে গিয়ে সিঁদ কাটার মতো বেড়া কাটে চিতা।তখনি ছাগলের আর্ত চিৎকার জাগে।ঢিল ছোঁড়ে সে।ঝোপ-নাড়ানো,মাটি-কাঁপানো শব্দে বাঘ পালায়।তখনি আরেক চিন্তা তার মনে জাগে।আজ রাতে বেচারার আর খাওয়ার মতো কিছু জুটবে কিনা কে জানে !বনের হরিণ,খরগোশ,শজারু থেকে বুনো শুয়োর তক্ সাফ করে দেয় মানুষ।ওরা পেটের টানে ঝুঁকি নিয়ে বন থেকে বেরোতে যে বাধ্য হয়!বিপুল লাফ দিয়ে অবিশ্বাস্য জোরে ছোটা সেরা শিকারির কী দশা!চুরি করে পেট চালাতে হয়!খাঁচায় ধরা পড়তে হয়।সমান মরিয়া গরিবদের হাতে মার খেতে হয়!

এগিয়ে চলে গোন্দু।আজ দুপুর অবধি সে ভেবেছে  বাইরে কাজ পেলেই এ বাগান ছেড়ে চলে যাবে। এখন, এখুনি তার মনে হচ্ছে সে সাবালক হয়েছে, নিজের মাটি ছেড়ে যাওয়া কি ঠিক হবে?সবাই তো শুধু খাবারের খোঁজে জঙ্গল ছেড়ে আসছে।...বাইরের দুনিয়াতেও সেই রুজি নিয়ে, খাবার নিয়ে কাড়াকাড়ি, মারামারি।সে তো আজ কালচিনি থেকে শুনে এল কী হাল হয়েছে দীন দুনিয়ার। নাঃ মন বদলে গেছে তার।বাইরের ওই দুনিয়ায় পেটে দেবার কিছু জুটছে না!রুজি নেই।আরও ভয়ের নাকি যা-আছে তা কেড়ে নেবার জন্য কত রকম নতুন কল-কায়দা হচ্ছে।প্রতি দিন নতুন সব কার্ড নিতে বলা হচ্ছে।শেষ পর্যন্ত হয়ত পরিচয় আর দেশ অবধি মুছে ফেলে দেবে!হাজার শহুরে মজার ব্যবস্থা করে রেখেছে এসব ফাঁদগুলো লুকানোর জন্য!ওই জীবন টোপ্পোদের জন্য,যারা সব জমানা থেকেই সুবিধে নিয়ে চলবে।এরা কখনো অন্যদের কথা ভাবে না,ভাববে না।

আজ কালচিনিতে লোকেদের দেখে সে অবাক হয়ে গেছে।কত যে দুশ্চিন্তায় আছে সীমান্ত চা-বাগানের মানুষ!অনেকেই কিছু বুঝে উঠতে পারছে না।বড় আর বুড়ো মানুষগুলো ক্লাসে পড়া না-পারার ছাত্রের মতো ভয়ে ছোট হয়ে গেছে।এইসব দেখার সাথে সাথে গোন্দুর স্বপ্নের বড় দুনিয়াটাও যে কখন ছোট হয়ে গেছে! ... গোন্দু বাংলোর দুয়ারের আলো দেখতে পায়, মনে হতে থাকে নতুন দুয়ার খুলে গেছে তার।যা লড়াই করার, নিজের জায়গা থেকেই করবে!সাথে অন্য কিছু করতে বাড়তি খাটবে।...তা ছাড়া সে তো বুনোদের সাথে সহাবস্থানের মন্ত্র শিখে ফেলেছে !