Thursday, May 2

উত্তরবঙ্গের জনজাতি : অভিজিৎ দাশের গল্প



তবুও


কোচবিহার রাজবাড়ি পার্কে বসে আছে মালতি। মালতি তজু। তাঁর ফর্সা মুখমণ্ডলে দুশ্চিন্তার অভিব্যক্তি ফুটে উঠেছে। আলো আর অন্ধকারের খেলা চলেছে বড়ো বড়ো টানা চোখ দুটিতে। বারা বারে ঘড়ি দেখছে।  মন বলছে, “শ্যাম আসবে, শ্যাম আসবে।” স্বীকৃতি দিয়ে সত্যিই শ্যাম এলো। আর মালতির মুখ হাসিতে উপচে উঠল।

— এতো দেরি করলে কেন ?

— সরি, আজকেও হেড মাস্টারমশাই একটি কাজ দিলেন, না করতে পারলাম না।

আর আমার কথা ভুলে গেলে ? আমি সেই এক ঘন্টা ধরে তোমার জন্য বসে আছি। আম্র কথা ভাব্লে না ?

আরে বাবা, ভেবেছি বলেই তো ছুটতে ছুটতে চলে এলাম। কেউ কি আর তাঁর ‘জান’কে ভুলতে পারে ?

‘আর বলতে হবে না। বসো।’ অভিমানে মালতির ঠোঁট দুটো ফুলে ওঠে।
বাড়িতে বলে এসেছ টো ?

হ্যাঁ বাড়িতে বলি আমি করতে যাচ্ছি। বাবা এই বিয়ে মেনে নেবে ভেবেছ ? আচ্ছা, তোমাদের বাড়িতে আমাকে মেনে নেবে তো ?

নেবে , নিশ্চই নেবে। আমরা দুজনেই তো প্রাপ্ত বয়স্ক। আর তোমার বাবা তো ছিলেন দেশের সৈনিক। দেশের নানা জায়গায় ঘুরেছেন। নানা রকম মানুষের সঙ্গে ঘুরেছেন। নানা রকম মানুষের সাথে মিশেছেন। নিশ্চয়ই তিনি আমাদের আটকাবেন না।

মনে তো হয়। দেখা যাক। চলো।

রাজবাড়ি পার্ক থেকে তারা সরাসরি মদনমোহন বাড়িতে চলে আসে। ফোন করে মালতি তাঁর প্রিয় বান্ধবিকে ডেকে নেয়। তাঁকে আগেই বলে ছিল। শ্যাম তাঁর বন্ধুদের ডেকে নেয়। মদনমোহনদেবকে সাক্ষি রেখে শ্যাম ও মালতির বিয়ে করে।

শ্যাম রায় একটি উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে সম্প্রতি কাজ শুরু করেছে। আর মালতি বি. এ পাশ করেছে। এই সে দিন মালতি ছিল কলেজ ছাত্রী। আর শ্যাম ঐ কলেজে আংশিক সময়ের অধ্যাপক হিসেবে পড়ানো শুরু করেছিল। প্রথম দর্শনেই টুক্টকে ফর্সা মালতির মুখটি শ্যামের মন কেড়ে নিয়েছিল। আর সেও দেখছে তাঁর ক্লাসে একেবারে প্রথম বেঞ্চে প্রতিদিন মালতির নিষ্পলক উপস্থিতি। শ্যামের এক বন্ধুর মাধ্যমে তারা একে অপরের কাছে মন উজার করে দেয়। দিন যত এগিয়ে চলে তাঁদের ঘনিষ্ঠতা তত বাড়ে।

মালতি বলেছিল, “ আমি বি. এ পাশ না করলে কিন্তু বিয়ে করব না।” শ্যাম বলেছিল, “ আমি চাকরিটা পাই আগে । তারপর তোমার দায়িত্ব নেব। মালতি অবশ্য জানে তাঁদের সমাজে মেয়েরাই বরের দায়িত্ব নেয়। বরেরা স্ত্রীর মায়ের বাড়িতে থাকে। কিন্তু শ্যাম তা মানতে চায়নি। তাই আলাদা ঘর বাঁধার স্বপ্ন দুজনের মনে।

মালতি চলে আসে শ্যামদের বাড়ি। দেবেন বুড়ো খবর পেয়ে ছুটে এসেছেন। মালতির বন্ধুরাই খবর পৌঁছে দিয়েছে। তিনি নোক্‌রমকে দেখে খুব খুশি। মন কিছুটা খারাপ হয়েছে নিজেদের সমাজের কথা ভেবে। আবার ওদের মেনে নিতে দ্বিধা করেননি। মালতি তাঁর নোকনা। দেবেন বুড়োর একটি ছেলে। মেয়ের মা হতে খুব ইচ্ছা ছিল পূর্ণিমার। তাঁর দুজনে এই ভাবনাকে রূপ দেয়ার জন্য চেষ্টার ত্রুটি করেননি। কিন্তু লাভ কিছু হয়নি। তাহলে পূর্ণিমা কাকে দিয়ে যাবেন সম্পত্তি। তাঁদের সমাজে মেয়েরাই সম্পত্তির অধিকারী হয়। তাই পূর্ণিমার মৃত্যুর পর দেবেন বুড়ো পূর্ণিমার ছোট বোনের মেয়ে মালতিকে দত্তক নেয়। সে হয় তার নোক্‌না। ফলে সম্পত্তির উত্তরাধিকারের প্রশ্ন আর থাকে না। মালতি ছোট থেকেই দেবেন বুড়োর স্নেহ নেওটা। উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্রী মালতির দেবেন বুড়োকে তবুও কোথাও বাঁধেনি দেবেন বুড়োকে বাবার আসনে বসাতে।

আজ মালতিই নিজে নিজে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তার জীবনের সবচেয়ে বড়ো সিদ্ধান্ত এটি। বাবাকেও আগে বলতে সাহস পায়নি। তিনি কিন্তু খবর পেয়েই ছুটে এসেছেন।




সত্তরোর্ধ্ব বৃদ্ধ দেবেন চিসিক নিজের ঘরের দাওয়ায় বসে শীতের ওম নিচ্ছিলেন। আজ মালতি ঘরে নেই। তবু তার মন খুশিতে ভরপুর। তিনি নিজে তার মনের মানুষকে বিয়ে করতে পারেননি। তাই করেছে মালতি। অবশ্য শ্যাম গারো নয়। শ্যামদের সমাজে স্ত্রী বিয়ের পর বরের বাড়ি যায়। মালতিও শ্যামদের বাড়িতে গিয়েছে। আবার মালতি তার পলক পিতারর কাছেও মাঝে মাঝে থাকবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। শ্যামও রাজি। তার স্কুল তো পাশের গ্রামেই।
বসে থাকতে থাকতে চোখ বুজে আসছিল দেবেন বুড়োর। এক সময় ভারতীয় সৈনিক হিসেবে দেশ রক্ষার কাজ করেছেন তিনি। অবসর নেওয়ার পর বহুদিন দেওয়ানহাট গ্রাম পঞ্চায়েতের সদস্য ছিলেন। সত্যিকারের জন সেবক বলে যে বিরল প্রজাতি এখনও টিকে আছে তিনি তাঁদের একজন। পাড়া –প্রতিবেশি সবার মুখে এখন এক কথা, “ দেবেন বুড়োকে কখনও লোভ করতে দেখা যায়নি।” মানুষের বিপদে প্রকৃত সেনার মতো তিনি আজও ঝাঁপিয়ে পড়েন। মুখে তার বয়সের ছাপ স্পষ্ট। কিন্তু চোখ ঝক ঝক করছে। দু বছর আগে মোটর সাইকেল দুর্ঘটনায় আহত হয়েছিলেন। তাই তার কোমর এখন পুরোপুরি সোজা করতে পারেন না। তবু কারও বিপদের কথাশুনলে তিনি ঠিকই হাজির হন। মনের ঝোরে আজও তিনি যুবক।

দেওয়ানহাট গারোপাড়ার গারো, ওঁরাও, রাজবংশী ও উদ্বাস্তু বাঙালিরা পাশাপাশি বাস করেন। পাড়ায় দুটি গির্জার চূড়ার লোভনীয় হাতছানিও দেবেনের পরিবারের মনের আদি ধর্মের ভিত টলাতে পারেনি।

দাওয়ার উপর পাটী বিছানো ছিল। ঝিমোতে ঝিমোতে চোখ বন্ধ করে চাদর জড়িয়ে তার উপরই শুয়ে পড়লেন। শুয়ে পড়তে ঝিমুনি কেটে গেল। ঘুম আসছে না। মালতির কথা ভাবতে ভাবতে মালতির মুখটা পাল্টে গেল অন্য আর একটি মুখে। তিনি দু হাতে চোখ রগড়ালেন। না , ভুল দেখছেন না। এতো দিন তো তাকে মনে পরেনি। আজ হঠাৎ.........

চোখে ভেসে উঠছে সেদিনের উৎসব মুখর দিনের ছবি। চলছিল অয়াংগালা উৎসব। তখন কৈশোর পেরিয়ে যৌবন সবে উঁকি মারছে। উৎসবের অঙ্গ ‘চু’ পান। ছোট- বড়ো সবাই চু পান করছে। এই নেশার পানীয় না হলে উৎসবের রং যে ফিকে হয়ে যায়। কতকগুলি ছেলে ও মেয়ে নেচে চলেছে। অন্য কোনো দিকে তাদের হুশ নেই। এই দলে যুবক দেবেন আছে। তার নজর আটকে গেছে তার বিপরীত দিকে নাচতে থাকে টানা টানা দুটি চোখ ও দুটি গোলাপী ঠোঁট। এখানকার মেয়ে নয় সে। জলপাইগুড়ি জেলার গারোপাড়া থেকে পাশের বাড়িতে বেড়াতে এসেছে সে। ফর্সা, পাতলা শরীরটা। দেখলেই কাছে টেনে নিতে ইচ্ছে হয়। নাচতে নাচতে বারে বারেই তার চোখ চলে যাচ্ছিল মেয়েটির দিকে। আর এই উৎসবে ছেলেমেয়েদের তো মেলামেশার সুযোগ থাকে। তারা পরস্পরকে প্রেম নিবেদন করতেও কসুর করে না। দেবেন দেখে মেয়েটিও তার দিকে তাকিয়ে আছে। মাঝে মাঝে চোখ সরানোর ভান করলেও দুজনে যে দুজনকেই দেখছে তা তারা বুঝতে পারে। চোখে চোখেই যেন ভালোভাসা গড়ে ওঠে। শুধু ঐ দিনই নয়, যে কদিন মেয়েটি এখানে ছিল দেবেন নাওয়া খাওয়া ভুলে গেছে। নদীতীরে লুকিয়ে তাদের দেখা হয়েছে। পরস্পর প্রেম নিবেদন করেছে।

যেমন হঠাৎ এসেছিল, তেমনি হঠাৎ করেই মেয়েটি চলে গেছে। দেবেন ঠিকানা আগেই নিয়ে রেখেছিল। সে ওদের বাড়িতে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু যাওয়া হয়নি। শুনেছে পিস্‌তুতো দাদার সাথে দুদিন পরেই মেয়েটির বিয়ে হয়ে গেছে। তাই, গিয়ে আর কী লাভ ?

চোখের সামনে দৃশ্য পাল্টে যায়। বুঝে থাকা চোখে ভেসে ওঠে অন্য দুটি চোখ। এ চোখ জোড়া তো তার খুবই পরিচিত। ছোট বেলা থেকে দেখে আসছেন।

 পূর্ণিমা। পূর্ণিমা তার মামাতো বোন। মামা একদিন তাকে ডেকে বললেন, “ শোন তুই তো ডাগর হইচিস। পূর্ণিমাও তাই। দুই ঝনের বিয়া দিয়া দেই।” তিনি হ্যাঁ বা না কিছুই বলতে পারেননি। মনে তার আর একটি মেয়ের ছবি। কিন্তু চোখের সামনে বেড়ে ওঠা পূর্ণিমাকেও অস্বীকার করা যায় ? আবার মামার কথার উপর কথা বলতে সাহস হয়নি তার। তাদের সমাজে এটাই তো রীতি। এজন্যই তো তিনি প্রেমিকাকে পাননি। সেই গানটি গুণগুণ করে গেয়ে ওঠেন তিনি— “ বল গংসি গোংগাং-খো শলজা আংগা নাংগিরি। / মামা রেমাং গিজাদে শলজা অংগা নাংগিরি।” এদিকে বিয়ের তোরজোর চলতে থাকে। এ বিয়েকে বলে ‘ দোবিকদোকা’। মামা প্রাইমারি স্কুলের মাস্টার। তাই ধুমধাম করেই বিয়ে দেবেন।

বিয়ের দিন ছবি এবার তার অক্ষিপটে। সকাল থেকেই দেবেন বাড়ির বাইরে ঘুরছে। বাড়ির কাছেই যে ছোট্ট নদীটি, এক সময় তার ধারে গিয়ে সে বসে পড়ে। তাকে বাবা ও মা বলছে, এদিন বাড়িতে না থেকে একটু দূরে দূরে থাকতে হয়। নদীর ধারে বসে পূর্ণিমার কথাই ভাবছিল একমনে। আর দেহ মনে এক শিহরণ জাগছিল। পূর্ণিমার মুখে প্রেমিকার মুখই মিশে যেতে দেখেছিল সে। মাত্র কয়েক দিনের দেখা। না, একটুও ভুলতে পারেনি। ভোলা যায় না সেই চোখ, সেই মুখ। বিয়ের লগ্নে বন্ধুরা তাকে বাড়িতে নিয়ে আসে। তারা প্রথা মেনেই চিৎকার করে ওঠে, “ মামা, নোক্‌না চাওয়ারি হাই।” এক সময় দেখে পুর্ণিমা ও সে একই ঘরে বন্দী। আসলে তাকে বাড়ির বাইরে থাকতে বলে পুর্ণিমাকে তাদের বাড়িতে নিয়ে আসা হয়েছে। আর ঘরটাও তারই শোবার ঘর। লজ্জাবনত পুর্ণিমাকে দেখে কিছু বলতে পারেনি সে। পরদিন আলো ফোটার আগেই সে ঘর থেকে পালিয়ে যায়। তাকে আগের মতোই বন্ধুরা ধরে নিয়ে আসে আর পূর্ণিমার সাথে বন্দী করে রাখে। লজ্জা ও জড়তা মিশ্রিত পূর্ণিমার চোখ দুটিতে যে কী ছিল ? পূর্ণিমাকে রেখে তার পালাতে ইচ্ছা করছিল না।  কিন্তু পালাতে যে হবেই। রীতি মানতে হবেই। এদিনও সে পালিয়ে যায়। পরদিন বন্ধুরা আবার তাকে ধরে আনে। এর পরদিন কিন্তু আর সে পালায়নি। তাহলে বিয়েটা আর হত না। সে রাত তাদের আনন্দেই কাটে। একটা আচ্ছন্ন ভাব দুজনের মনে। সকাল থেকেই বিয়ের নানা আয়োজন চলে। বিয়ের আসরটা  এবার দেখতে পান তিনি। বিয়ে করানোর জন্য খামাল মামা এসেছেন। তার হাসি হাসি মুখটি স্পষ্ট দেখতে পান তিনি।

তাদের গোষ্ঠী পূর্ব-বাংলার সুসোই থেকে এখানে এসেছে। তাই তাদের ভাষার মধ্যে বাংলা ডূকে গেছে। আর বাংলায় পড়াশুনা করতে করতে তার নিজেদের ভাষা প্রায়ভুলেই গেছেন। খামাল মামার মুখে অনেকদিন পর গারো ভাষাতেই মন্ত্র শুনল সে। একটি মুরগি ও একটি মোরগের মাথা কেটে কাটা মুণ্ডু দুটি পাশাপাশি রাখা হয়েছিল। দেবেন বুড়োর চোখে এখন দুটি কাটা মুণ্ডু। মুণ্ডু দুটি লাভাচ্ছে। তিনি সহ্য করতে পারছেন না। কিন্তু কাতা মুণ্ডু দুটি কোথায় যায় তা যে দুজনকেই দেখতে হবে। এর উপর নির্ভর করছে তাদের বিয়ের ভবিষ্যৎ। পূর্ণিমার দিকে চোখ পড়তে দেখে সেও নিষ্পলক তাকিয়ে সেদিকে। না, মুণ্ডু দুটি দূরে সরেনি। পাশাপাশিই থেকেছে। বিয়ের বন্ধন দৃঢ় হবে। খামাল মামা আশীর্বাদ করলেন। তার আশীর্বাদ বৃথা যায়নি।
না, আর ভাবতে পারছেন না। একটু খুমের জন্য ছটফট করতে থাকেন। ঘুম আসে না। আজ যে তার কি হল ? আবার ! আবার ছবি ভাসে চোখে। এ যেন আস্ত একটি সিনেমা। আর সিনেমাই বা বলেন কী করে ? এর সবটাই বাস্তব। তার জীবনের ফেলে আসা দিনের ছবি।

দিনটা বিয়ের ২৫ বছরের পুরণের দিন। এই বিশেষ দিন্টির জন্য তিনি ছুটি নিয়ে বাড়ি এসেছেন। নানা রকম আয়োজন করেছেন। পূর্ণিমাকে সারপ্রাইজ দেবেন। তার পাকা ব্যবস্থা করেছেন। আর চাকরি থেকে অবসরের দিনও ঘনিয়ে এল।

ভোরে একটি গোঙানির শব্দে তার ঘুম ভেঙে যায়। চোখ বুজেই কান পাতেন। দেখেন পূর্ণিমার দিক থেকেই শব্দটি আসছে। আলটা জ্বালান। দেখেন পূর্ণিমার মুখ ফেনায় ভরে উঠেছে। মুখ দিয়ে একটি চিৎকার বেরিয়ে এসেছিল। পাশের ঘরে সদ্য যুবক ছেলে ঘুমাচ্ছিল। নিমেষে সে উঠে আসে। ততক্ষণে পূর্ণিমা সারপ্রাইজ দিয়ে নিথর হয়ে গেছে।

 পূর্ণিমাকে দাহ করা হয়। এতক্ষণ বাবা ও ছেলে কান্নার প্রবল শ্রোত বুকে চেপে সব কাজ সেরেছে। এবার তারা কান্নায় ভেঙে পড়লেন।



আজ তিনি একা। ছেলে শাশুড়ির বাড়িতে। একদিন তিনিও বাবা-মাকে ছেড়ে পূর্ণিমাদের বাড়িতে উঠে এসেছিলেন। মাতৃতান্ত্রিক সমাজে এটাই হয়ে আসছে চিরকাল। মালতি আজ আসবে। সে গারো সমাজের প্রথা ভেঙেছে। এটাই কী সমাজের ভবিতব্য ? এ প্রজন্ম যেন নিয়ম রীতিগুলিকে ভেঙে দেওয়ার জন্যই জন্ম নিয়েছে। তাহলে তাদের স্বাতন্ত্র্য বজায় থাকবে কী করে ? ভাবতে থাকেন।

তবে মানবিকতার আবেদন যে অনেক বড়ো। এক সময় সমস্ত ভাবনাকে ঝেড়ে ফেলে প্রতিক্ষা করেন মালতিও শ্যামের আগমন প্রত্যাশায়।

   

দেবায়ন চৌধুরীর অণুগল্প





যেখানে বিচ্ছেদ


হাতের মোবাইলটা নিয়ে মাঝেমাঝে বসে থাকে বিতান। সারাদিন কাজের পরে দু’দণ্ড কথা বলতে ইচ্ছে করে। কিন্তু সবাই যে যার কাজে ব্যস্ত। কেমন আছিস, ভালো আছি, দেখা হবে, ফেসবুকে পোস্ট দিস—গতানুগতিক শব্দবন্ধ। কারো কাছে মন উজাড় করে দেবে তো, সেই একদিন দুর্বলতাগুলিকে খোরাক করবে। খোরাক শব্দটি বিতান শিখেছিল ইউনিভার্সিটি লাইফে।


বন্ধুরা এখন সবাই প্রতিষ্ঠিত। সবাই খেয়েপরে আছে। কিন্তু সেই আন্তরিকতার স্পর্শ খুঁজে পায় না কারো কাছেই। এমনি করেই তো মানুষ বেঁচে থাকে। বেঁচে থাকাটা অভ্যাস। ভালো থাকা মানে আসলে কী ভাবতে ভাবতে পথ হাঁটে বিতান। চারপাশের বদলে যাওয়া দেখতে দেখতে ক্লান্তি যখন বাঁধ মানে না; তখন সব ছেড়ে চলে যায় জঙ্গলে। নদীর ধারে বসে দেখে মেঘের ছায়া। তিরতির করে হাওয়া বইছে। একটা পাথর নিয়ে ছুঁড়ে দেয় জলে। জলে কাঁপন লাগে। 


আপনজন বলতে একটা ফোন। কেউ কল করার নেই অকাজে। ইদানীং কাস্টমার কেয়ারের ফোন এলে ধরে। আগে ধরত না। গান বেজে যায়। নিজের পছন্দ করা গানের জন্য কোনোদিন বলা হয়ে ওঠেনি। বলবেও না। তবু এই রেকর্ডেড ভয়েসটাকেই মনে হয় বন্ধু। মেসেজ আসে —একা লাগছে? বন্ধু চান? প্রেস করুন... অসীম সংখ্যক সম্ভাবনা নিয়ে দশ ডিজিটের সামনে বসে থাকে বিতান। যে ফোন আর কোনোদিন আসবে না, তার নম্বর মুখস্থ রেখে কী লাভ?


আচ্ছা, মৃতেরা কোনোদিন কলব্যাক করে?





হাবিবুর রহমানের গল্প



২৫ শে ডিসেম্বর


দুই বছর পূর্ণ হলো অপরূপ ও রেনেশ্রীর সম্পর্ক । ছাত্র থেকে অধ্যাপক --- প্রায় দশ বছরের মধ্যে অপরূপ দাপটের সঙ্গে বিদায় জানিয়েছে চার-চারজন প্রেমিকাকে ।

আজ ২৫ শে ডিসেম্বর , ২০১৮ । রাত সাড়ে বারোটা পর্যন্ত পার্ক-স্ট্রিটেই ঘুরে বেড়াচ্ছে অপরূপ-রেনেশ্রী । স্মরণীয় ক'রে রাখতে প্রথম প্রেম-বার্ষিকীকে ।

আশ্চর্য ব্যাপার , প্রথম সম্পর্কও শেষ হয়েছিলো একই তারিখে...একই সময়ের পরে-পরে । শুধু সালটা ছিলো আলাদা---২০১৩ । রাজশ্রী'র বাবা ছিলো না ; মা ছিলো নিমিত্তমাত্র । অভিভাবক বলতে নিজের একমাত্র দাদা ও সাধের সন্তানহীনা মাসি । 'টিপিক্যাল মুসলিম সম্প্রদায়ের টিপিক্যাল মুসলিম পরিবার' বললে অত্যুক্তি হবে না হয়তো । 'আমি খুব স্বাধীনচেতা...আমি খুব বাস্তবিক । পরিবারে আমার কথা-ই শেষ ও শ্রেষ্ঠ'---বলেছিলো সে , সম্পর্কের শুরুর সময় । অপরূপের কাজই হলো আপাদমস্তক মানুষকে মাপা । তাই , ধীরে-ধীরে প্রথম প্রেমিকার মানসিক পরিবর্তনের দীর্ঘমেয়াদি পরীক্ষার ফলাফল না দেখেই 'আমারও একটি ভবিষ্যৎ আছে। আমারও একটি স্বপ্ন আছে । এভাবে দিনের-পর-দিন বেনো জলে মুক্ত ছড়ানো সম্ভব নয় । আজ এত দাদা-দাদা করছো তো ? বৌদি এলে বুঝতে পারবে দাদা কতটা আপন' । বয়সে তিন বছরের ছোটো অবাস্তব জঞ্জালকে নিজে দাঁড়িয়ে বিদায় জানায় ।

অপরূপ দিনকে-দিন প্রবেশ করে বাস্তব থেকে অতি-বাস্তবের জগতে ; উত্তীর্ণ হয় ছেলে থেকে প্রেমিকে । দেবশ্রীকে জীবনে নিয়ে আসে এবং বিদায়ও দেয় সাত-পাঁচ ভেবেই । বরানগরের বনেদি চক্রবর্তী পরিবারের একমাত্র মেয়ে । 'সংস্কৃতির প্রবেশ নিষিদ্ধ , শিক্ষার লেশমাত্র চিহ্ন নেই , টাকার গদিকে ভালোবেসে শুয়ে থাকে...চুমু খায়' । এককথায় টাকা খায়...টাকাকে খায় । লোক দেখানো প্রতিশ্রুতি-পরায়ণ দেবশ্রীও এক বছর শেষ হতে-না-হতেই একের-পর-এক বালখিল্য অজুহাত খাড়া করতে থাকে অপরূপের সামনে । কিন্তু কথার উপস্থাপন-রীতি অনুযায়ী সহজেই ধ'রে ফেলে , সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে যেতে চাইছে সে । 'তোমার কথাবার্তা মার্জিত করো...ইংরেজিটা একটু চর্চা করো...'---কথাগুলো যেনো অপরূপের কাছে বজ্রপাত । অপরূপ মনে করে 'সম্পর্ক হলো জলবৎ তরল...সম্পর্ক হলো পাহাড় থেকে জল গড়িয়ে মোহনায় পড়ার মতো...সম্পর্ক হলো দুটি ঠোঁটকে এক ক'রে...চারটি হাতকে দুই ক'রে মৃত্যুর দোরগোড়ায় পৌঁছে যাওয়া ; শতাংশের লভ্যাংশের হিসেব-নিকেশ সেখানে গৌণ' । তাই অপরূপ ভবিষ্যতের কাব্যিকতায় ভর ক'রে বয়সে পাঁচ বছরের ছোটো অতি-অবাস্তব জঞ্জালকে দাঁড়িয়ে বিদায় জানায় ।

অবাস্তব জঞ্জাল ও অতি-অবাস্তব জঞ্জালের ঊনে যে সোঁদা গন্ধ থাকে...যে গন্ধে মাতাল তরণী অনর্গল শ্রোতধারায় কুলকুল ক'রে বয়ে যায়...বয়ে যাওয়া নুড়ি-কাঁকর-বালি এক জায়গায় জড়ো হয়ে কবিতা-কাব্যিকতার রূপ নেয়---সে কথা কেউ না জানলেও অপরূপ জানতো । আর জানতো বলেই তনুশ্রী'র আদব-কায়দা খুঁটিয়ে পরীক্ষা করেই তৃতীয় সম্পর্কে লিপ্ত হয়েছিলো । এই সময় অপরূপ অধ্যাপক । সবে এক বছর পূর্ণ হয়েছে চাকরি । তনুশ্রী মুখার্জিও অধ্যাপক । দু'জনেরই বিষয় বাংলা । সুদূর উত্তরবঙ্গের মাটিগাড়া এলাকার মেয়ে । জলপাইগুড়ি জেলার এই অঞ্চলের মেয়ের মধ্যে প্রথম-প্রথম এঁটেল মাটির গন্ধ পেতো । এঁটেল মাটির প্রভাব কি মনুষ্য-জীবনেও দানা বাঁধে ? সংক্রামিত হয় ? তনুশ্রী'র সম্পর্কের মধ্যে থাকতে-থাকতে নূতন সম্পর্কে বুঁদ হয়ে যাওয়া তো তাই-ই প্রমাণ করে । সে মুখে বলে না ; প্রকাশ করে আচরণের মধ্যে দিয়ে । অপরূপও ঘাঁটায় না ; নিষ্কৃতি নয় , পরিত্রাণই পাথেয় হয়তো এখন । তাই পোহানলগ্নের রিরংসার তলে কাব্যিকতার স্বাদ পেতে-পেতে শক্তিশালী মানসিক সংযুক্তিকরণে নিয়োজিত থাকতে-থাকতে একই দিনের...একই তারিখে অপরূপের থেকে চার বছরের বড়ো অবসাদগ্রস্ত অতি-অবাস্তব জঞ্জালকে দাঁড়িয়ে বিদায় জানায় ।

অপরূপ নিজেকে ধীরে-ধীরে প্রতিষ্ঠিত করতে চায় 'কবি' হিসেবে । প্রায় দু'শো কবিতা লিখে ফেলেছে ২৫ শে ডিসেম্বর , ২০১৬ সালের মধ্যে ।আপাতত লিখে চলেছে প্রেমের কবিতা-ই । আসলে অপরূপ পণ করেছে নর-নারীর প্রেম বা দাম্পত্য সম্পর্কের খুঁটিনাটি দিকগুলোকে একটি গবেষণার পর্যায়ে নিয়ে যেতে । উৎস , অভিমুখ , বিবর্তন , পরিণতির পূর্বাভাস , পরিণতি---এই সমস্ত দিককে মূর্ত ক'রে তুলতে । ট্রেনে যেতে-যেতে...সম্পর্কের সাত-পাঁচ ভাবতে-ভাবতে পৌঁছায় অফিসের কাজে বর্ধমান । সিউড়ি থেকে একটি ফোন আসে মধুশ্রী ব্যানার্জির । ইংরেজিতে ডক্টরেট করছে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে । সে কবিতা পাগল ; অপরূপের কবিতার বড়ো ভক্ত । আজ সামনাসামনি কবির দেখা পেয়ে সে আপ্লুত...সে অভিভূত । 'আজ আমার পরম সৌভাগ্যের দিন...আজ আমার জীবনের নূতন অধ্যায়ের সূচনা হলো হয়তো...আজ আমার অন্তরে শিহরণ জাগছে আপনার দেখা পেয়ে'---কথাগুলো বলতে-বলতে বুক থেকে ওড়না খসে পড়েছে...লাল রঙের ব্রা ভিজে গিয়েছে...ডান হাতটি অজান্তেই অপরূপের জঙ্ঘায় নামিয়ে এনেছে...স্তনের বোঁটা সালোয়ার ভেদ ক'রে বেরিয়ে আসতে চাইছে' । এই সময়ে হয়তো অপরূপ দুটি স্তনকে 'কাগজ-কলম' ভেবে এক ঝোঁকে খান দশেক কবিতা লিখে ফেলতে পারতো । লিখেছেও ; কাগজে নয় , মনে...মনের গহীন-গহনে । 'আমি চায়ের দাম দেবো... ; চলুন একটু কৃষ্ণসায়ার পার্কে গিয়ে বসি । আপনার ফেরার তাড়া নেই তো ?'---বলেই , নিজের মনের গোপন-সুপ্ত ইচ্ছেটি কবিকে ব'লে ফেলে---'আপনার সাথে...' । অবশিষ্ট কথাটি বুঝতে বাকি থাকে না অপরূপের । অপরূপ তো মেয়েই খুঁজছে ; মেয়ে নয় , প্রেম খুঁজছে ; প্রেমও নয় , প্রেমের রূপভেদ খুঁজছে ; রূপভেদও নয় হয়তো , কবিতা খুঁজছে । তাই মধুশ্রী'র অফার সে সহজেই লুফে নেয় । কিন্তু এখানেও একই গলদ । মেয়েদের কি মুহুমূহু মনের পরিবর্তন ঘটে ? মেয়েরা কি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত শুধু অন্বেষণ করতে চায় ? প্রতি মুহূর্তে অন্যের প্রলোভনেই পা ফেলে ? 'আমাকে এখন একা থাকতে দাও...আমাকে এখন আধ্যাত্মিকতায় টানছে...আমাকে প্রাণায়ম , মেডিটেশন , ব্যায়াম তোমার থেকেও বেশি-বেশি তৃপ্তি দিচ্ছে'---কথাগুলোতে বাঁধা না দিয়ে ছয় বছরের বড়ো মানসিক অবসাদগ্রস্ত অতি-অবাস্তব জঞ্জালকে দাঁড়িয়ে বিদায় জানায় ।

২৫ শে ডিসেম্বর , ২০১৭ সালের দিন আগত । কবিতা-সংখ্যা ৪০০ সম্পূর্ণ । এখন অপরূপ ছাত্র নয় ; নয় শুধু অধ্যাপক । সে গ্রাম-শহর বিগর্ভিত সমগ্ৰ রাজ্যের। সমগ্ৰ দেশের মধ্যে একজন। সে এখন কলকাতা মহানগরীতে নিজে পাকাপাকিভাবে অধিষ্ঠিত। সে নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান। সে নিজেই আধুনিক সভ্য-সমাজের ধারক ও বাহক। সে গ্রামের বাড়ি , বন্ধু-বান্ধব , দাদা-দিদির ভিড় ঠেলে আজ এই জায়গায় উত্তীর্ণ ।

আরো আশ্চর্য ব্যাপার , পৃথিবী ঘুরছে।মানুষ ঘুরছে। সম্পর্ক ঘুরছে । তাই , রাজশ্রী , দেবশ্রী , তনুশ্রী, মধুশ্রী---প্রত্যেকেই অপরূপ-রেনেশ্রী'র চারদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে। পাক খাচ্ছে। তাকাচ্ছে উৎসবমুখর পরিবেশ দেখতে এসেও । দাম্পত্য বন্ধনের মাঝেও এক ইঞ্চি লম্বা ফাঁক কেন ?---অপরূপ বুঝতে পারছে আলো-আঁধারী পর্দার আড়ালে লুকিয়ে । শাড়ি পরা অবস্থা দেখে কবির বুঝতে অসুবিধা হয় না , 'কারো পেটে বাচ্চা আসেনি । বাচ্চা আসলে নিচের বোতাম খোলা সোয়েটারের ধার-বরাবর ব্লাউজ ও কোমরের উপর পঞ্চভুজ অংশের পেট , পেটের মেদ খসানো দেখেই বোঝা যেতো' । বিষাদ-গ্রস্ত হয়ে যায় মনটা সাময়িকভাবে । কাগজ-কলম নিয়ে লিখে ফেলে ------

        "ঘর ছাড়াটা দোষের নয়,
         ভরলে গিরি গভীর খাত।
         নিজ মানুষ দোষের হলে,
         মরতে হবে জনম রাত...।"

শ্রাবণ-সন্ধ্যায় নিকষ-কালো মেঘের ভেলায় গা এলিয়ে শুয়ে আছে পার্ক-টেরেসের নিজের ফ্ল্যাটে । কবিতার সন্ধানে, কবিতার রূপভেদের সন্ধানে, প্রেমের সন্ধানে, মেয়ের সন্ধানে। এখন আর সে লালায়িত নয় ; তেইশ বছরের রেনেশ্রীর সাথে লীলায়িত । মুসলিম পরিবারের সদস্য হওয়ায় সমাজের খুঁটিনাটি দেখে এসেছে। তিরিশ বছরের টানাপোড়েনের জীবন অতিবাহিত করেছে। চারটি প্রেমিকাকে দাঁড়িয়ে বিদায় জানিয়েছে। নিজেকে প্রতিপন্ন করেছে 'প্রতিষ্ঠান' হিসেবে । এ কী চাট্টিখানা কথা ! রেনেশ্রী এতটাই বুদ্ধিমতী যে , নতুন ক'রে কিছু শেখানোর প্রয়োজন পড়েনি । চক্রবর্তী পরিবারের একমাত্র মেয়ে , মানবিকতায় আস্থাশীল ও বিশ্বাসী , বাংলায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রির পর এখন এম.ফিল । বাস্তবতা যার কাছে বড়ো , সম্পর্কের রূপভেদগুলো যার নখদর্পণে , নিজের মানুষটাই যখন ইহজগতের মূল অবলম্বন , তখন তাঁকে নিয়ে তাঁর কোলে মাথা রেখে জীবনটা উপভোগ করা-ই শ্রেয় মনে করে । মনে করে বলেই পরিবারের সদস্যদের 'টু' শব্দটি পর্যন্ত করতে দেয়নি...করার সুযোগ দেয়নি ; 'রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অধিকার ও কর্তব্যের মধ্যে সম্পর্ক অধ্যায়টি তোমরা শেষ বয়সে একটু পড়ে নিও' বলেই সটান বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে । ইতিমধ্যেই কয়েকবার দুই দেহ এক রূপ ধারণ করেছে । পার্ক-স্ট্রিটের এই উৎসবমুখর পরিবেশ কেবলমাত্র স্মৃতিচারণ যেনো ; যেনো যীশুর আনন্দে নিজেরা আত্মহারা ; যেনো এক বছর এক দিনের যাবতীয় কার্যকলাপের প্রসব বেদনার সূচন্যাংশে বীজ বপন ; যেনো অন্ধকার ঠেলে-ঠেলে আলোর মুখ দেখার সন্ধিকালীন মুহূর্ত ।

 ২৫ শে ডিসেম্বর , ২০১৯ সালটি স্মরণীয় ক'রে রাখতে শুধু পার্ক-স্ট্রিটে নয়, শুধু পার্ক-টেরেসে নয়, শুধু সন্তোষপুরে নয়, শুধু যাদবপুরে নয়, শুধু কলকাতায় নয় ; সমগ্ৰ রাজ্যে, সমগ্ৰ দেশে, সমগ্ৰ বিশ্বে।

বিশ্বজিৎ ধরের গল্প



সংসার


রান্নাঘরের উত্তর কোণের বাঁশের খুঁটিতে টিকটিকিটি ‘ঠিক ঠিক’ শব্দ করেই চলেছে। দুপুরবেলা অনিল রায়  আর তাঁর বড়ো ছেলে বীরকান্ত দাগলাকুরার ট্যাংরা মাছের ঝোল দিয়ে বেশ আনন্দেই খেয়ে যাচ্ছে। আজ সকাল থেকে প্রায় ঘন্টা তিনেকের পরিশ্রমে বীরকান্ত তাঁর সমবয়সী বন্ধুদের সাথে গিয়ে প্রায় কেজি দেড়েক ছোট বড়ো ট্যাংরা, পুঁটি, খলসে, পয়া ধরেছিল। বন্ধুদের কাছে আবদার  করে বীরকান্ত ট্যাংরা মাছগুলিকেই বাড়িতে নিয়ে আসে। কেননা এই মাছ যে তাঁর বাবার খুব পছন্দ।
 
অনিল রায় কেদারপুর গ্রামের একজন সামান্য চাষি। সম্পত্তি বলতে বিঘে দুই জমি আর বাস্তু ভিটে। বছর দুই আগে নিজের একমাত্র কন্যার বিবাহের ঋণ তাঁকে এখনও ভাবায়। স্থানীয় এক পরিচিত সম্পন্ন গৃহস্থ সুশীল রায়ের কাছে তাঁর যেতে এখন লজ্জা করে। অনিল ভেবেছিল এবারের ধান বিক্রি করে সে সুশীল রায়ের ঋণ মেটাবে। ধানগাছ যে ভালো চেহারার হয়েছিল তাতে সন্দেহ ছিল না। কিন্তু ছোটো ছেলে হরির প্রাইভেট খরচ আর স্ত্রীর অসুখেই ঘরের লক্ষ্মী আর ঘরে থাকেনি।

টিকটিকির ‘ঠিক ঠিক’ শব্দ শুনে খেতে বসেও আশায় বুক বাঁধে অনিল । স্ত্রী ময়নাকে  আরও  দুই হাতা ভাত আর একটু ট্যাংরা মাছের ঝোল দিতে বলে বলে ওঠে— ‘এই সন হইবে... দেনাও মেটামো আর থাকার ঘরটাতও সিমেন্টের খুঁটি লাগামো।’ ময়না স্বামীর কথা শুনে বেশ খুশিই হয় কিন্তু ভাবে , ‘তায় য্যান হয়... মুই মঙ্গল বার কালী বাড়িত  যায়া মা’ক ফুল বাতাসা মানদ করি আসিম যে হামার তামাক য্যান ঘরত আইসে।’
ময়না তাঁর স্বামীকে বলে, ‘হরিক বোল ম্যাট্রিকের পর টাউনোর স্কুলত ভরতি করিম।  উয়ার দাদু কইছে বইপত্র যা নাগে দিবে। তোমরা খালি ইস্কুলের জামা টেইলারের টে কয়া বানে আনেন। পাইসার কথা কইলে কন তামাক বেচি দেমো এলায়।’

হরি গ্রামের স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র। সংসারের অবস্থা সে জানে। পড়াশুনার ফাঁকে ফাঁকে গ্রামের ভিভিন্ন হাটে  হাটে কাচা লঙ্কা আর কিছু সব্জী বিক্রি করে যা লাভ হয় তা সে বাবার হাতে  দিয়ে দেয়। তাঁর ইচ্ছা বড়ো হয়ে গ্রামের রতন দাদার মতো বি. এড করে মাস্টারি চাকরি করবে। বাবাকে সে তাই প্রায়  সবসময় বলে বসে— ‘ ও বা, মুই বোল কলেজ পাশ করি বি এড-ওত ভরতি হইম।’ 

ভরা ফাল্গুনের দুপুরের রোদ যেন বৈশাখকেও হার মানায়। তবে এই রোদ কিন্তু অনিলের মনে খুশির আমেজ নিয়ে আসে। ভোর থেকে গামছা গলায় নিয়ে বার বার এসে তামাক খেতটাকে চোখের দেখা দেখে যায়। সকাল থেকে সামান্য জ্বরে শরীরটা দুর্বল লাগলেও অনিল ভরদুপুরে সবুজ তামাক খেতের ভেতর বসে অপ্রয়োজনীয় তামাক পাতাগুলি গাছের দেহ থেকে  ছিন্ন করে দেয়। তাঁর যে আর তর সয় না। খালি দিন গোনে আর ভাবে, ‘ এলাও যে তামাকের পাত বারতি না হয়। শিবমেলার হাট আর দুইটা পড়ি আছে। সামনে হাটত না নিবার পালে দাম কি আর পাওয়া যাইবে।’ এইসব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে অনিল আজ দুই ঝুরি গোরার দিকের তামাক  পাতা কেটে নিয়ে আসে। খুব ভালো যে শুকাবে, তা নয়। কিন্তু একটু সময় নিয়ে কষ্ট করে বেঁধে নিতে পারলে দামটা সে মন্দ পাবে না।

পড়ন্ত রোদের বিকেলে অনিল ও তাঁর পরিবার মিলে তামাক পাতা বাঁধতে বসে যায়। পাতা  যে পরিপুষ্ট হয়নি সেটি বাঁধতে বসেই সকলে বুঝতে পারে। বিষ খাওয়া রোগীর মতো পাতার   মুষড়ে পড়া দেখে স্ত্রী ময়না ক্ষেপে গিয়ে স্বামীকে বলে, ‘ এইল্যার কি আর দাম পাইবেন। দেওয়ার যে অবস্থা। কাইল যদি অইদ না হয় তো পাতা তো পচি  গোবর হয়া যাইবে।’

আকাশের বিচিত্র অবস্থাকে অনিল এবং তাঁর পরিবার ভীষণ ভয় পায়। তিল তিল করে বড়ো হয়ে ওঠা তামাক গাছের জন্য চিন্তায় তারা অস্থির হয়ে ওঠে। পাতা না শুকালেও আর সপ্তাহ খানেক হলেই পাতা পরিপুষ্ট হয়ে উঠবে। তখন আর তাদের কোনো চিন্তা থাকবে না।
হঠাৎ করে সমস্ত আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে যায়। আকাশের ভয়ঙ্কর ডাকাডাকিতে অনিল আর  তাঁর স্ত্রী পাগলের মতো হয়ে ওঠে। এই ডাক যে তাদের বহুকালের চেনা ডাক। ভর সন্ধ্যার কিছু আগেই আকাশের ডাকাডাকির মধ্যেই অনিল রায় মস্ত ঝুরি হাতে তামাক খেতের দিকে হাঁটা  শুরু করে। ছোটো ছেলে হরি বাড়ির উঠোন থেকে ডাকতে থাকে, ‘ ও বা.... চলি আয়। দেওয়ার ডাক ভাল নোয়ায় রে এ এ এ ।’
ইতিমধ্যে টপ টপ করে বড়ো বড়ো বৃষ্টির ফোঁটা পড়তে থাকে। ময়না বাড়ির হাঁস-মুরগির জন্য খাঁচা আর বকনা গোরুটাকে রান্না ঘরের পাশের একচালাতে বেঁধে রেখে স্বামী অনিলের উদ্দেশ্যে বের হয়ে যায়। পাশের বাড়ির কাকি শাশুড়িকে দেখে সে শুধু বলে ওঠে, ‘ মানষিটা কথাও না শুনে। দেওয়ার বর্ষনে কাও তামাক পাত কাটে বায়...’   এদিকে বড়ো বড়ো বৃষ্টির ফোঁটার সাথে শুরু হয় বড় বড় শিলা বৃষ্টি। অনিল পাগলের মতো  নিজের খেতের তামাকের পাতাগুলিকে আগলে রাখতে চেয়েও পেরে ওঠে না। হাতের কাটারী যেন মেশিন হয়ে উঠেছে। ছিদ্র ছিদ্র পাতাগুলিকেই যেন কাটারি দিয়ে কেটে ঝুরি ভর্তি করে। বৃষ্টির ধারা বৃদ্ধি পেয়ে পাতাগুলি যেন দলা পাকিয়ে যাচ্ছে। অবুঝ অনিল তবুও তামাক পাতা কাটাতে বিরাম দেয় না। শিলাবৃষ্টিতে শত ছিদ্র হয়ে চলেছে অগুনতি তামাকের পাতা। প্রকৃতির কাছে হার না মানা অনিল রায় বুঝে উঠতে পারছে না কেনই বা পাতাগুলি রক্তাক্ত হয়ে ক্রন্দন শুরু করেছে। দূর থেকে হরির কান্নামিশ্রিত আওয়াজ ভেসে আসে, ‘ ও বা, মুই টাউনের ইস্কুলোত পড়িম না। ও বা , চলি আইসেন, হামা বাঁচিবার চাই...।’