Thursday, May 2

হাবিবুর রহমানের গল্প



২৫ শে ডিসেম্বর


দুই বছর পূর্ণ হলো অপরূপ ও রেনেশ্রীর সম্পর্ক । ছাত্র থেকে অধ্যাপক --- প্রায় দশ বছরের মধ্যে অপরূপ দাপটের সঙ্গে বিদায় জানিয়েছে চার-চারজন প্রেমিকাকে ।

আজ ২৫ শে ডিসেম্বর , ২০১৮ । রাত সাড়ে বারোটা পর্যন্ত পার্ক-স্ট্রিটেই ঘুরে বেড়াচ্ছে অপরূপ-রেনেশ্রী । স্মরণীয় ক'রে রাখতে প্রথম প্রেম-বার্ষিকীকে ।

আশ্চর্য ব্যাপার , প্রথম সম্পর্কও শেষ হয়েছিলো একই তারিখে...একই সময়ের পরে-পরে । শুধু সালটা ছিলো আলাদা---২০১৩ । রাজশ্রী'র বাবা ছিলো না ; মা ছিলো নিমিত্তমাত্র । অভিভাবক বলতে নিজের একমাত্র দাদা ও সাধের সন্তানহীনা মাসি । 'টিপিক্যাল মুসলিম সম্প্রদায়ের টিপিক্যাল মুসলিম পরিবার' বললে অত্যুক্তি হবে না হয়তো । 'আমি খুব স্বাধীনচেতা...আমি খুব বাস্তবিক । পরিবারে আমার কথা-ই শেষ ও শ্রেষ্ঠ'---বলেছিলো সে , সম্পর্কের শুরুর সময় । অপরূপের কাজই হলো আপাদমস্তক মানুষকে মাপা । তাই , ধীরে-ধীরে প্রথম প্রেমিকার মানসিক পরিবর্তনের দীর্ঘমেয়াদি পরীক্ষার ফলাফল না দেখেই 'আমারও একটি ভবিষ্যৎ আছে। আমারও একটি স্বপ্ন আছে । এভাবে দিনের-পর-দিন বেনো জলে মুক্ত ছড়ানো সম্ভব নয় । আজ এত দাদা-দাদা করছো তো ? বৌদি এলে বুঝতে পারবে দাদা কতটা আপন' । বয়সে তিন বছরের ছোটো অবাস্তব জঞ্জালকে নিজে দাঁড়িয়ে বিদায় জানায় ।

অপরূপ দিনকে-দিন প্রবেশ করে বাস্তব থেকে অতি-বাস্তবের জগতে ; উত্তীর্ণ হয় ছেলে থেকে প্রেমিকে । দেবশ্রীকে জীবনে নিয়ে আসে এবং বিদায়ও দেয় সাত-পাঁচ ভেবেই । বরানগরের বনেদি চক্রবর্তী পরিবারের একমাত্র মেয়ে । 'সংস্কৃতির প্রবেশ নিষিদ্ধ , শিক্ষার লেশমাত্র চিহ্ন নেই , টাকার গদিকে ভালোবেসে শুয়ে থাকে...চুমু খায়' । এককথায় টাকা খায়...টাকাকে খায় । লোক দেখানো প্রতিশ্রুতি-পরায়ণ দেবশ্রীও এক বছর শেষ হতে-না-হতেই একের-পর-এক বালখিল্য অজুহাত খাড়া করতে থাকে অপরূপের সামনে । কিন্তু কথার উপস্থাপন-রীতি অনুযায়ী সহজেই ধ'রে ফেলে , সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে যেতে চাইছে সে । 'তোমার কথাবার্তা মার্জিত করো...ইংরেজিটা একটু চর্চা করো...'---কথাগুলো যেনো অপরূপের কাছে বজ্রপাত । অপরূপ মনে করে 'সম্পর্ক হলো জলবৎ তরল...সম্পর্ক হলো পাহাড় থেকে জল গড়িয়ে মোহনায় পড়ার মতো...সম্পর্ক হলো দুটি ঠোঁটকে এক ক'রে...চারটি হাতকে দুই ক'রে মৃত্যুর দোরগোড়ায় পৌঁছে যাওয়া ; শতাংশের লভ্যাংশের হিসেব-নিকেশ সেখানে গৌণ' । তাই অপরূপ ভবিষ্যতের কাব্যিকতায় ভর ক'রে বয়সে পাঁচ বছরের ছোটো অতি-অবাস্তব জঞ্জালকে দাঁড়িয়ে বিদায় জানায় ।

অবাস্তব জঞ্জাল ও অতি-অবাস্তব জঞ্জালের ঊনে যে সোঁদা গন্ধ থাকে...যে গন্ধে মাতাল তরণী অনর্গল শ্রোতধারায় কুলকুল ক'রে বয়ে যায়...বয়ে যাওয়া নুড়ি-কাঁকর-বালি এক জায়গায় জড়ো হয়ে কবিতা-কাব্যিকতার রূপ নেয়---সে কথা কেউ না জানলেও অপরূপ জানতো । আর জানতো বলেই তনুশ্রী'র আদব-কায়দা খুঁটিয়ে পরীক্ষা করেই তৃতীয় সম্পর্কে লিপ্ত হয়েছিলো । এই সময় অপরূপ অধ্যাপক । সবে এক বছর পূর্ণ হয়েছে চাকরি । তনুশ্রী মুখার্জিও অধ্যাপক । দু'জনেরই বিষয় বাংলা । সুদূর উত্তরবঙ্গের মাটিগাড়া এলাকার মেয়ে । জলপাইগুড়ি জেলার এই অঞ্চলের মেয়ের মধ্যে প্রথম-প্রথম এঁটেল মাটির গন্ধ পেতো । এঁটেল মাটির প্রভাব কি মনুষ্য-জীবনেও দানা বাঁধে ? সংক্রামিত হয় ? তনুশ্রী'র সম্পর্কের মধ্যে থাকতে-থাকতে নূতন সম্পর্কে বুঁদ হয়ে যাওয়া তো তাই-ই প্রমাণ করে । সে মুখে বলে না ; প্রকাশ করে আচরণের মধ্যে দিয়ে । অপরূপও ঘাঁটায় না ; নিষ্কৃতি নয় , পরিত্রাণই পাথেয় হয়তো এখন । তাই পোহানলগ্নের রিরংসার তলে কাব্যিকতার স্বাদ পেতে-পেতে শক্তিশালী মানসিক সংযুক্তিকরণে নিয়োজিত থাকতে-থাকতে একই দিনের...একই তারিখে অপরূপের থেকে চার বছরের বড়ো অবসাদগ্রস্ত অতি-অবাস্তব জঞ্জালকে দাঁড়িয়ে বিদায় জানায় ।

অপরূপ নিজেকে ধীরে-ধীরে প্রতিষ্ঠিত করতে চায় 'কবি' হিসেবে । প্রায় দু'শো কবিতা লিখে ফেলেছে ২৫ শে ডিসেম্বর , ২০১৬ সালের মধ্যে ।আপাতত লিখে চলেছে প্রেমের কবিতা-ই । আসলে অপরূপ পণ করেছে নর-নারীর প্রেম বা দাম্পত্য সম্পর্কের খুঁটিনাটি দিকগুলোকে একটি গবেষণার পর্যায়ে নিয়ে যেতে । উৎস , অভিমুখ , বিবর্তন , পরিণতির পূর্বাভাস , পরিণতি---এই সমস্ত দিককে মূর্ত ক'রে তুলতে । ট্রেনে যেতে-যেতে...সম্পর্কের সাত-পাঁচ ভাবতে-ভাবতে পৌঁছায় অফিসের কাজে বর্ধমান । সিউড়ি থেকে একটি ফোন আসে মধুশ্রী ব্যানার্জির । ইংরেজিতে ডক্টরেট করছে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে । সে কবিতা পাগল ; অপরূপের কবিতার বড়ো ভক্ত । আজ সামনাসামনি কবির দেখা পেয়ে সে আপ্লুত...সে অভিভূত । 'আজ আমার পরম সৌভাগ্যের দিন...আজ আমার জীবনের নূতন অধ্যায়ের সূচনা হলো হয়তো...আজ আমার অন্তরে শিহরণ জাগছে আপনার দেখা পেয়ে'---কথাগুলো বলতে-বলতে বুক থেকে ওড়না খসে পড়েছে...লাল রঙের ব্রা ভিজে গিয়েছে...ডান হাতটি অজান্তেই অপরূপের জঙ্ঘায় নামিয়ে এনেছে...স্তনের বোঁটা সালোয়ার ভেদ ক'রে বেরিয়ে আসতে চাইছে' । এই সময়ে হয়তো অপরূপ দুটি স্তনকে 'কাগজ-কলম' ভেবে এক ঝোঁকে খান দশেক কবিতা লিখে ফেলতে পারতো । লিখেছেও ; কাগজে নয় , মনে...মনের গহীন-গহনে । 'আমি চায়ের দাম দেবো... ; চলুন একটু কৃষ্ণসায়ার পার্কে গিয়ে বসি । আপনার ফেরার তাড়া নেই তো ?'---বলেই , নিজের মনের গোপন-সুপ্ত ইচ্ছেটি কবিকে ব'লে ফেলে---'আপনার সাথে...' । অবশিষ্ট কথাটি বুঝতে বাকি থাকে না অপরূপের । অপরূপ তো মেয়েই খুঁজছে ; মেয়ে নয় , প্রেম খুঁজছে ; প্রেমও নয় , প্রেমের রূপভেদ খুঁজছে ; রূপভেদও নয় হয়তো , কবিতা খুঁজছে । তাই মধুশ্রী'র অফার সে সহজেই লুফে নেয় । কিন্তু এখানেও একই গলদ । মেয়েদের কি মুহুমূহু মনের পরিবর্তন ঘটে ? মেয়েরা কি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত শুধু অন্বেষণ করতে চায় ? প্রতি মুহূর্তে অন্যের প্রলোভনেই পা ফেলে ? 'আমাকে এখন একা থাকতে দাও...আমাকে এখন আধ্যাত্মিকতায় টানছে...আমাকে প্রাণায়ম , মেডিটেশন , ব্যায়াম তোমার থেকেও বেশি-বেশি তৃপ্তি দিচ্ছে'---কথাগুলোতে বাঁধা না দিয়ে ছয় বছরের বড়ো মানসিক অবসাদগ্রস্ত অতি-অবাস্তব জঞ্জালকে দাঁড়িয়ে বিদায় জানায় ।

২৫ শে ডিসেম্বর , ২০১৭ সালের দিন আগত । কবিতা-সংখ্যা ৪০০ সম্পূর্ণ । এখন অপরূপ ছাত্র নয় ; নয় শুধু অধ্যাপক । সে গ্রাম-শহর বিগর্ভিত সমগ্ৰ রাজ্যের। সমগ্ৰ দেশের মধ্যে একজন। সে এখন কলকাতা মহানগরীতে নিজে পাকাপাকিভাবে অধিষ্ঠিত। সে নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান। সে নিজেই আধুনিক সভ্য-সমাজের ধারক ও বাহক। সে গ্রামের বাড়ি , বন্ধু-বান্ধব , দাদা-দিদির ভিড় ঠেলে আজ এই জায়গায় উত্তীর্ণ ।

আরো আশ্চর্য ব্যাপার , পৃথিবী ঘুরছে।মানুষ ঘুরছে। সম্পর্ক ঘুরছে । তাই , রাজশ্রী , দেবশ্রী , তনুশ্রী, মধুশ্রী---প্রত্যেকেই অপরূপ-রেনেশ্রী'র চারদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে। পাক খাচ্ছে। তাকাচ্ছে উৎসবমুখর পরিবেশ দেখতে এসেও । দাম্পত্য বন্ধনের মাঝেও এক ইঞ্চি লম্বা ফাঁক কেন ?---অপরূপ বুঝতে পারছে আলো-আঁধারী পর্দার আড়ালে লুকিয়ে । শাড়ি পরা অবস্থা দেখে কবির বুঝতে অসুবিধা হয় না , 'কারো পেটে বাচ্চা আসেনি । বাচ্চা আসলে নিচের বোতাম খোলা সোয়েটারের ধার-বরাবর ব্লাউজ ও কোমরের উপর পঞ্চভুজ অংশের পেট , পেটের মেদ খসানো দেখেই বোঝা যেতো' । বিষাদ-গ্রস্ত হয়ে যায় মনটা সাময়িকভাবে । কাগজ-কলম নিয়ে লিখে ফেলে ------

        "ঘর ছাড়াটা দোষের নয়,
         ভরলে গিরি গভীর খাত।
         নিজ মানুষ দোষের হলে,
         মরতে হবে জনম রাত...।"

শ্রাবণ-সন্ধ্যায় নিকষ-কালো মেঘের ভেলায় গা এলিয়ে শুয়ে আছে পার্ক-টেরেসের নিজের ফ্ল্যাটে । কবিতার সন্ধানে, কবিতার রূপভেদের সন্ধানে, প্রেমের সন্ধানে, মেয়ের সন্ধানে। এখন আর সে লালায়িত নয় ; তেইশ বছরের রেনেশ্রীর সাথে লীলায়িত । মুসলিম পরিবারের সদস্য হওয়ায় সমাজের খুঁটিনাটি দেখে এসেছে। তিরিশ বছরের টানাপোড়েনের জীবন অতিবাহিত করেছে। চারটি প্রেমিকাকে দাঁড়িয়ে বিদায় জানিয়েছে। নিজেকে প্রতিপন্ন করেছে 'প্রতিষ্ঠান' হিসেবে । এ কী চাট্টিখানা কথা ! রেনেশ্রী এতটাই বুদ্ধিমতী যে , নতুন ক'রে কিছু শেখানোর প্রয়োজন পড়েনি । চক্রবর্তী পরিবারের একমাত্র মেয়ে , মানবিকতায় আস্থাশীল ও বিশ্বাসী , বাংলায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রির পর এখন এম.ফিল । বাস্তবতা যার কাছে বড়ো , সম্পর্কের রূপভেদগুলো যার নখদর্পণে , নিজের মানুষটাই যখন ইহজগতের মূল অবলম্বন , তখন তাঁকে নিয়ে তাঁর কোলে মাথা রেখে জীবনটা উপভোগ করা-ই শ্রেয় মনে করে । মনে করে বলেই পরিবারের সদস্যদের 'টু' শব্দটি পর্যন্ত করতে দেয়নি...করার সুযোগ দেয়নি ; 'রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অধিকার ও কর্তব্যের মধ্যে সম্পর্ক অধ্যায়টি তোমরা শেষ বয়সে একটু পড়ে নিও' বলেই সটান বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে । ইতিমধ্যেই কয়েকবার দুই দেহ এক রূপ ধারণ করেছে । পার্ক-স্ট্রিটের এই উৎসবমুখর পরিবেশ কেবলমাত্র স্মৃতিচারণ যেনো ; যেনো যীশুর আনন্দে নিজেরা আত্মহারা ; যেনো এক বছর এক দিনের যাবতীয় কার্যকলাপের প্রসব বেদনার সূচন্যাংশে বীজ বপন ; যেনো অন্ধকার ঠেলে-ঠেলে আলোর মুখ দেখার সন্ধিকালীন মুহূর্ত ।

 ২৫ শে ডিসেম্বর , ২০১৯ সালটি স্মরণীয় ক'রে রাখতে শুধু পার্ক-স্ট্রিটে নয়, শুধু পার্ক-টেরেসে নয়, শুধু সন্তোষপুরে নয়, শুধু যাদবপুরে নয়, শুধু কলকাতায় নয় ; সমগ্ৰ রাজ্যে, সমগ্ৰ দেশে, সমগ্ৰ বিশ্বে।

No comments:

Post a Comment