Wednesday, January 1

অঞ্জন আচার্যের গল্প : যে রাতে তারাটি খসে পড়েছিল






অঞ্জন আচার্য
যে রাতে তারাটি খসে পড়েছিল


বিদ্যুতের অভিযান যেখানে শেষ সেখান থেকেই শুরু আমার স্বপ্ন
এখন যাকে কাঁটাঝোপ গলা টিপে মেরেছে।
  —রাম বসু

ময়রার কারখানার বাসি কড়াইয়ের তলার মতো মুখ করে মাথার ওপর ঝুলে আছে আকাশ। ওখানে মেঘের আড়ালে বাঁশঝাড়ে লুকিয়ে থাকা জোনাকি পোকার মতো তারাদের মশাল মিছিল জ্বলছে মিটিমিটি। দরিদ্র বিধবার পুরানো মলিন শাড়ি পরে চাঁদটিও হারিকেনের আলো বুকে নিয়ে ধুকছে পাশে বসে। পশ্চিম কোণের একপাশ থেকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা রুপার পয়সার মতো অগুন্তি তারার মাঝখান থেকে অকারণে জাম পড়ার মতো করে আচমকা খসে পড়ে একটি। পড়ন্ত তারা দেখে নাকি মনে মনে চেয়ে নিতে হয় কিছু। ওতে নাকি মনোবাঞ্ছা পূরণ হয়। ওই দেখে সঙ্গে সঙ্গেই ঘড়া ভর্তি সোনার মোহর চেয়ে বসেন অনিল মাস্টার। তিনি জানেন, তার বাপ-ঠাকুর দা জানেন, দেশভাগের আগের বছর হিন্দু-মুসলমানে যে রায়ট লাগে, সে বছরই কোনো এক রাতে গোপনে ইন্ডিয়া চলে যায় নিতাইদের পরিবার। তাদের পতিত বাড়ির পেছনের ঝোপে লুকিয়ে থাকা শেওলাজমা পুকুরটিতে বড় বড় হাড়ি ভর্তি হীরা-মানিক-জহরত ডুব মেরে আছে; গ্রামের কমবেশি সবাই সে-কথা শুনে শুনে বড় হয়েছে। সাহস করে সেই পুকুরে ডুব দেয় না কেউ। ওই পুকুরে নাকি নাগিনী আছে, পা ডুবালেই প্যাঁচিয়ে টেনে নিয়ে যায় অতলে। যে ক’জন পা বাড়িয়েছে, পরের দিন সকালে ফুলে ঢোল হওয়া শরীর ভাসতে দেখা গেছে তাদের। সেই ভয়ে অগত্যা কপালে আঙুল ঠুকে মা জগদ্বাত্রীর নাম জপতে জপতে অনিল বড়াল বলে ওঠেন— “আমার সাধ পূরণ করো মাগো। এক ঘটি ধন পেলেই চলবে। এ আর এমন কি! তোমার কাছে সে তো নস্যি! দিব্যি করছি, তোমায় আমি সোনার নোলক গড়িয়ে দেবো। জয় মা জগদ্বাত্রীর জয়।”

অন্ধকারের চাদর মুড়িয়ে অনিল মাস্টার ফিরছিলেন বাড়ির দিকে। টার্চ লাইটের সরু নলের আলো ফেলে আঁধার কেটে চলছিলেন তিনি। সন্ধ্যার দিকে খানিকটা বৃষ্টি হবো হবো করছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর হলো না। কেমন যেন নতুন বউয়ের মতো অভিমানি মুখ করা আবহাওয়া ঘুরপাক খাচ্ছে অনেকক্ষণ ধরে। একটা বোটকা হাওয়া চক্কর খাচ্ছে বাতাসে। আজ ছিল হাটের দিন। প্রতি রোববারই আমডাঙা বাজারে হাট বসে। সেখান থেকেই ফেরা হচ্ছিল অনিলের। হাতে হাঁপানির ওষুধ। শ্বাস তো নয়; যেন আমপাতার বাঁশি বাজিয়ে চলছে বিকাল থেকে পুষ্প। ছেলে সুনীল গিয়ে মায়ের এ হাপের টানের খবর দিয়ে এসেছিল স্কুলে গিয়ে— মা বলেছে, বাড়ি ফেরার পথে যেন লতিফ কাকার দোকান থেকে পথ্য আনা হয়।

হাটের দিন লতিফ মাস্টারের ডিসেপেন্সারিতে বসে একটু খুশগল্প করতে ভালোই লাগে অনিলের। কত শত মানুষের দেখা মেলে হাটে। দূরের গ্রাম, আরো দূরের গ্রাম থেকেও হাঁটা পথে, নৌকায় চড়ে, গাড়িতে ঝুলে মালপত্তর নিয়ে হাজির হয় ঠিকঠাক সবাই। সকালের পর থেকেই হৈহুল্লোর চলে। বিকালের পর থেকে মরে যেতে থাকে মানুষের আওয়াজ। সন্ধ্যার পর কোলাহল দখল করে নেয় নৈঃশব্দ্য। তখন হাট বসে নীরবতার। এখানে ওখানে ছড়িয়ে থাকা শাকের পাতা, শুকনো খড়, কাঁচা গোবর, পোকায় খাওয়া আলু, ভাঙা পটল, ছাগলের গুটিগুটি মল— এমন কত কিছু যে চোখে পড়ে অনিলের; ভালোই লাগে। এই হদ্দগ্রামে ভৈরব নদীর পাড়ের নলডাঙা বাজারে মানুষ আসে; একটা ছুতোতে তো অন্তত আসে। এই মরার গাঁয়ে তবুও মানুষ আসুক।

নলডাঙা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ শিক্ষক অনিল। বলা চলে খিচুরি শিক্ষক। সেখানকার অংক-বিজ্ঞান পড়ায় লতিফ মন্ডল। তবে মাঝে মধ্যে সবই পড়াতে হয় অনিলের মতো। কোনো বিষয়েই বিশেষজ্ঞ হতে হয় না। একরকম দিন পার করে দিলেই হলো। স্কুল শেষে বিকেল বেলায় দোকান খোলে বসেন লতিফ। গত পাঁচ বছর ধরে এই তার কাজ। বাড়ি যেতে ভালো লাগে না। ভালো লাগার কারণও কিছু নেই।
লতিফের দোকানে ওষুধপত্তর বলতে আছে কিছু জ্বর-ঠান্ডা-কাশির সিরাপ, মাথা ব্যাথা, পেট খারাপ, কৃমির কিছু বড়ি আর আছে দুটি কোম্পানির কনডমের লম্বা প্যাকেট। লাল ও কালো রঙের প্যাকেট দুটি দোল খায় তার ঘাড়ের পেছনে। এছাড়া বাদবাকি যা দেখা যায়, তার সবই ভুয়া। কাঠের রেকের ওপর ধুলোর স্তরে ডুবে থাকা বাক্সগুলো কেবলই লোক দেখানো। খালি বাক্স দিয়ে সাজানো ছোট বেড়ার ঘরটিকে মনে হয় মালপত্তরে ঢাসা। এই রোববারেই কিছুটা বিক্রি হয় শেফালি ফার্মেসিতে। পাশের গ্রামের নিবারণ শীল এসে হাত ইশারায় একটা কনডম চেয়ে নিলো এই মাত্র। খবরের কাগজে মুড়িয়ে সেটি যখন নীরবে নিবারণের হাতে তুলে দিচ্ছিল লতিফ, কেন জানি সেই মুহূর্তে তার মৃত স্ত্রী শেফালির কথা মনে পড়ে যায়। নিবারণ আজ রাতে তার বৌকে সোহাগ করবে। অথচ গত পাঁচ-পাঁচটি বছর হলো লতিফ মাস্টারের শরীরে রাতের বিছানায় কোনো নারী ছায়াও মাড়ায়নি। সন্তান-সন্ততিও নেই ঘরে। বাঁজা মেয়েলোক বলে কম গালি হজম করতে হয়নি শেফালিকে। মুখ বুজে সব সহ্য করত, আর রাতে বসে বসে কাঁদতো বিছানায় আড় কাৎ হয়ে। মা হওয়ার বড়ো আকুতি ছিল শেফালির। কত ওঝা-বদ্যি, হাকিম-কবিরাজ বেটে খাওয়ানো হলো, কোনো কিছুতেই কিছু হলো না। এমনকি ঢাকা শহরে গিয়ে সরকারি ডাক্তারও দেখানো হয়েছে। সমস্যা আর কারো নয়; খোদ লতিফের। শেফালি পুরোপুরি সুস্থ। কিন্তু এ কথা মুখ ফুটে বলবে কি— স্বামীর জাত যায় না তাতে! তাই তো পাড়াপড়শির লতানোপাতানো যা কথা— তা শেফালিকেই কানে ঢোকাতে হয়। শেফালির সমস্যা ধরা পড়লে না হয় কথা ছিল। আরেকটা বিয়ে করে নিতে পারতো লতিফ। শেফালির তো তা করার সুযোগ নেই; তার পক্ষে সম্ভবও না। ফলে যা তাকে দিয়ে সম্ভব তা-ই করে বসে একদিন। বাড়ির পেছনের আমগাছের ডালে শাড়ি পেঁচিয়ে ঝুলে পড়ে সে। বছর পাঁচেক হয়ে গেল সেই ঝুলনযাত্রার ইতিবৃত্ত। বছর দুইএক আগে লতিফের মা ছেলেকে পীড়াপীড়ি করে আবার বিয়ে করে নতুন বউ ঘরে আনতে। পাত্রীও মোটামুটি ঠিক হয়ে গিয়েছিল। সরদার কবিরাজের মেয়ে ফাতেমা সেই বিয়েতে রাজিও ছিল। কিন্তু সব মিলিয়ে হলো না। নাকি হতে দেয়নি লতিফ? দেবেই-বা কেন? ফাতেমাও যদি পোয়াতি হতে না পারে তবে কলঙ্ক রটবে; ধরা পড়ে যাবে লতিফের অক্ষমতা।
এখন বাজার প্রায় জনশূন্য। তারাভরা আকাশের দিকে নির্বিকার তাকিয়ে অতীতের এইসব অ্যালবাম ঘাটছিল লতিফ। হঠাৎ একটি তারা খসে পড়তে দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। এ যেন বহুদিন গুমোট থাকা দীর্ঘশ্বাস!

লতিফের জীবন মানেই বাড়ি, স্কুলের মাস্টারি আর এই ওষুধের দোকান। ঘরে বৃদ্ধ মা আছেন, আর আছে এক মাথা খারাপ বোন লুৎফা। লুৎফার এমনিতে তেমন কোনো সমস্যা নেই। দিব্যি থাকে। বাড়ির সব কাজ একহাতে করে সে। কেবল গরমের দিন এলেই উল্টাপাল্টা হয়ে যায় সব কিছু। বলা নেই কওয়া নেই কোনো একদিন হয়ত লাফ দিয়ে উঠানে পা মেলে আকাশে ফাঁটল ধরিয়ে কাঁদতে বসে যাবে। অবাধ্য গরুর মতো দড়ি দিয়ে বেঁধেও তাকে টেনে ঘরে নেয়ার সাধ্যি নেই কারো। পুরো গ্রামের মানুষের কাছে তো বটেই, গ্রামের পাশের গ্রাম জলডাঙা, তারপরের গ্রাম হাতিভাঙা এবং তারপরের শম্ভুগঞ্জ পর্যন্ত সেই খবর কারো কানে পৌঁছাতে বাকি নেই যে লুৎফা পাগল। দেখতে শুনতে দিব্যা ভারতীর বোন বলে চালিয়ে দেওয়া যেতে পারে। মুখখানা জামবাটির মতো গোল। বুকের ডাইসটাও তেমনই। শরীরের গাঁথুনি টানটান। আর তাই তো সুযোগ পেলেই লুৎফার স্নানঘরে চোখ ডুবিয়ে রাখে পাশের বাড়ির মাসুম কমিশনারের কুলাঙ্গার ছেলে সুরুজ আলী।

লুৎফার চেয়ে সুরুজ বছর তিনেকের বড় হলেও একই সঙ্গে খেলতো তারা। একদিন দুপুরে নিতাইদের বাড়ির পিছনের পুকুরের পাশের ভূতুড়ে জঙ্গলে চড়–ইভাতি খেলছিল দুজনে। লুৎফার বয়স তখন কতই-বা, এগারো বারো হবে হয়ত। কী মনে করে একসময় সুরুজ লুঙ্গিটা তুলে তার কালো কুচকুচে শিশ্নটি নাড়িয়ে নাড়িয়ে লুৎফাকে দেখিয়ে বলে ওঠে— ক’ তো লুৎফা এইডা কি?
এতক্ষণ গোপনে সুরুজ যে সেটি তা দিয়ে যাচ্ছিল— সেদিকে খেয়ালই করেনি লুৎফা। ওটা দেখে ভয়ে চোখ রসগোল্লা হয়ে গেল তার। নিজের হাতের তালুতে চেপে ধরে নিজেরই মুখ। সুরুজের টাক মাথার উত্তুঙ্গ পুরুষাঙ্গটি দেখে ভ্যাঁ করে কেঁদে সব ফেলে দৌড় দেয় লুৎফা। এমন পুরুষ্টু লিঙ্গ এর আগে দেখেনি সে। ওর ধারণা ছিল, শিশ্ন মানেই ছোট্ট ফুলদানির আকারের নুনুর মতো একটা কিছু। লজ্জায় নাকি ভয়ে লুৎফা সেদিন কেঁদেছিল, তা সে-ই ভালো বলতে পারবে। কারো জানার সাধ্যি রইল না। সেদিনের পর থেকে সুরুজের সাথে তার যম্মের আড়ি। কথা বলা বন্ধ, খেলা তো দূরের কথা। দেখলেই নিজেকে আড়াল করে রাখে। সেই ঘটনার কথা আজো কাউকে বলেনি লুৎফা। ওদিকে এর শোধ নিতে চায় সুরুজ। এত সুযোগ থাকতেও লুৎফাকে জোর করে কিছু একটা করতে পারেনি সে। এ যেন তার পৌরুষে ঘা খেয়েছে। শুনেছে পাশের গ্রামের জলডাঙা বাজারের পাশের মাজারে এক ল্যাংটা ফকির বসে। ওই ফকির নাকি বাণ মারতে পারে যে কাউকেই। লুৎফার মাথার চুল একদিন কেড়ে নিয়ে ওই ফকিরের কাছে যায় সুরুজ। বলে— ছেঁকা দিয়ে প্রেমিকা তার প্রেম করে নতুন নাগরের সঙ্গে। তাই ওই খানকি-মাগীকে বাণ মারতে হবে।
ফকির কিছু টাকা পয়সা নিয়ে, নাক-মুখ দিয়ে হুম-হাম শব্দ করে লুৎফার চুলটাকে মুঠোবন্দি করে ছুঁড়ে মারে। এর মাসখানিক পর থেকে ধরা পড়ে লুৎফার ওই রোগটা। বক কিসে মারা গেল তা কেবল ঝড়ই বলতে পারবে।

লুৎফার চিকিৎসা সবই চলছে কম বেশি। অভাবী সংসারে এর বেশি কিছু করা আর সম্ভবও না লতিফের একার পক্ষে। বোনের কনভারসন ডিজঅর্ডার ধরা পড়েছে, মানে হিস্টিরিয়া। কিন্তু ভালো করে সেই সাধ্যি নেই শহরের বড় বড় ডাক্তারেরও। কেবল ঘুমের ওষুধ দেয়। খেয়ে খেয়ে পড়ে পড়ে ঘুমায় লুৎফা। সারাদিন ঘুমানো পর সে আজ এই সাঁঝের বেলায় উঠানের এক কোণে চুল মেলে বসে আছে একা। ঘর থেকে এক ছড়া আলো তার গায়ে পড়েছে মৃদু। দূর থেকে অন্ধকার গায়ে মেখে ঝোপের ভেতর থেকে এ দৃশ্য দেখ যাচ্ছে সুরুজ আলী। লুৎফার ওড়না ছাড়া সুঠোল বুকের দিকে চেয়ে থেকে শরীরে তাপ নিতে থাকে সে। কী মনে করে হঠাৎ আকাশের দিকে তাকায়। দেখে, একটি তারা খসে পড়ছে। আর অমনি লুৎফার সঙ্গে সঙ্গম করার বাসনাটা চেয়ে নেয় মনে মনে।

মাথার ওপর হা করা কালচে আকাশ। লুৎফার চোখ ওই দিকেই ভিঞ্চির মোনালিসার মতো স্থির। সন্ধ্যার পর মেয়ে মানুষের চুল খুলে রাখা অমঙ্গল— মায়ের এ কথায় গা করেনি লুৎফা। এমন সময় হঠাৎ তারাময় আকাশে খসে যাওয়া একটি তারা দেখে আনমনে হেসে ওঠে সে। রহস্যময় কণ্ঠে বলে উঠে— সুরুজ্জার চোখ দুইডা আমি ছেনি পুড়ইরা গাইল্যা দিয়াম। হারামির বাইচ্যা খালি আমারে দ্যাহে, খালি দ্যাহে আর দ্যাহে...।









সাদিয়া সুলতানার গল্প : ডুবসাঁতার





সাদিয়া সুলতানা
ডুবসাঁতার

আজ আমার মোনালিসা আপার সঙ্গে দেখা হবে। তিন বছর আট মাস ছয় দিন পর। মোনালিসা আপা, আমাদের মোনা আপা। যার কাছ থেকে আমি পালাতে চেয়েও ধরা দিয়েছি বারবার। কী করে মোনালিসা আপার মুখোমুখি হবো ভেবে রাতের পর রাত নির্ঘুম থেকেছি, দিনের আলোতেও লুকোচুরি খেলেছি নিজের সঙ্গে।

গতকাল রাতে আমি একদম ঘুমাতে পারিনি। সারারাত বিছানায় শুয়ে ছটফট করেছি। রহস্যময় বাতিঘরের চূড়ায় বসে আবছায়াতে সমুদ্রজলের ওঠানামা দেখেছি। জলের বিস্তার সিঁড়ি হয়ে আমাকে অচেনা গন্তব্যে নিয়ে গেছে। নীল জলের সিঁড়ি ভেঙে আমি এক বিস্তীর্ণ বালুচরে পৌঁছেছি, ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখেছি হাওয়ায় লেগে থাকা নীল চুম্বনের দাগ। একটা ডিঙি নৌকা ঢেউয়ের তালে দুলতে দুলতে পাড়ে এসেছে। আমাকে ফিরিয়ে নেবে ভেবে নৌকাতে যেই পা রেখেছি, পা হড়কে তলিয়ে গেছি অতল জলে। ডুবতে ডুবতে ফের ভেসে উঠেছি। ঘুমের আবেশে রাশেদ গড়িয়ে পড়েছে আমার শরীরে, ওর আঙুলেরা বারবার আমাকে আলিঙ্গনে টেনেছে। সাড়া না পেয়ে পাশ ফিরে শুয়ে রাশেদ বেঘোরে ঘুমিয়েছে। আর আমি হৃদপিণ্ডের তোলপাড় করা ঢেউয়ের মাঝে দুলে দুলে ঘুমানোর ব্যর্থ চেষ্টা করেছি।

আজ ছুটির দিন। রাশেদের অফিসে যাওয়ার তাড়া নেই, আমার চটজলদি নাস্তা বানানোর তাগিদ নেই। অনেক বেলা পর্যন্ত ঘুমিয়ে রাতের ঘুমটুকু তাই পুষিয়ে নেবো ভেবেছিলাম। আরাধ্য ঘুম আসেনি। মোনালিসা আপার মুখোমুখি হবো বলেই হয়তো নিজের ভেতরে এত উৎকণ্ঠা কাজ করেছে আমার। রূপালি রাঙতায় মোড়ানো স্মৃতিবাকসো খুলে যাবার উত্তেজনা শিহরিত আমাকে এক ফোঁটা ঘুমাতে দেয়নি। বহুদিন পর বুকের গোপন সিন্দুকটা খুলে দেখবো ভেবে নির্ঘুম রাত কাটিয়েও উতল আমি কাকভোরে বিছানা ছেড়েছি। চারদিকের থমথমে ভাব সরে গিয়ে সকাল সকাল মেঘ ছাড়াই উথালপাথাল ঝড় হয়েছে, স্মৃতিচিহ্নের গ্লানি ভেজা মাটিতে লেপ্টে গিয়ে বেকায়দা হেসেছে। বিনা নোটিশে খুব গোপনে কেউ এসে বুকের ভেতরটা জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে রেখে গেছে। আগুনহীন সেই দহনে পুড়তে পুড়তে আমি আমূল ভিজে গেছি। ভেজা শরীরে কাঁপতে কাঁপতে বিছানায় ফিরে গেছি। ঘুমানোর আপ্রাণ চেষ্টা করেছি। ঘুম আসেনি। ঘুমের বদলে কেউ এসে খুব যতনে বুকের ঠিক মাঝখানে টুকটুক...টুকটুক করে পেরেক গেঁথেছে, কানের কাছে ঢিমাতালে কেউ তারাপদ রায়ের কবিতা আবৃত্তি করেছে,
বছরের পর বছর,
দিনের পর দিন,
গ্রীষ্ম নেই, বর্ষা নেই,
শুধু শীত আর শীতের হাওয়া,
ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন, স্বপ্নের মধ্যে অভিমান,
শীতল অভিমানে জড়ানো ঠা-া হাওয়ায় ঝরা পাতা এলোমেলো ছড়িয়ে পড়েছে চারপাশে রোদের উজ্জ্বলতায়।
তুমি উদাসীন চলে গেছো
কোনোদিন তাকিয়ে দেখোনি,
তুমি কোনোদিন শুনলে না
আমার ডুগডুগি, আমার বাঁদরনাচের বাজনা।
সেই মুহূর্তে মেসেঞ্জারে মোনালিসা আপার মেসেজ এসেছে, ‘আমি এসেছি। তুই চলে আয়। আজ দুপুরে আমার এখানে খাবি।’
উৎকণ্ঠিত রাশেদকে আশ্বস্ত করে আমি একাই বাসা থেকে বের হয়েছি। ও প্রথমে আমাকে একা ছাড়তে চায়নি। কিন্তু মোনালিসা আপার সঙ্গে দেখা হবার ক্ষণটিতে আমি সামান্য গোপনীয়তার আয়োজন রাখতে চেয়েছি। যদিও উৎকণ্ঠায় সারাক্ষণ আমার বুকের ভেতরে চকমকি পাথরের ঠোকাঠোকি হচ্ছে। আমি রাশেদকে বুঝতে দিইনি।

রাশেদ মানুষ হিসেবে মোটামুটি সহজবোধ্য। একেবারে আটপৌরে সংসারী মানুষ সে। এতদিন ধরে ওকে দেখছি, কোনো জটিলতা নেই ওর ভেতরে। আমাকে নিয়ে ওর টানের সুতো আমিই জটিল অংকে শিথিল করে রাখি। এক পুরনো হিসেবের কারণে আমি চাইলেও দাম্পত্য সম্পর্কের সুতো টানটান রাখতে পারি না। রাশেদ অবশ্য সচেতন অভিভাবকের মতো সর্বক্ষণ নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে, আমাকে ধরেবেঁধে রাখতে চায়। এই যেমন আজও কিছুতেই ও আমাকে একা ছাড়তে চাইছিল না। যদিও বাসা থেকে খুব একটা বাইরে বের হই না আমি। তেমন কোনো প্রয়োজন হয় না। আমার সব প্রয়োজন রাশেদ দক্ষ হাতে মিটিয়ে দেয়। আমি কোথাও যাচ্ছি শুনলে প্রথমে রাশেদ খুব অবাক হয়, অহেতুক বাঁধ সাধে। তারপর আমি কথা শুনবো না নিশ্চিত হয়ে হাল ছেড়ে দেয়। আজও তাই করেছে। আমি পোশাক পাল্টে তৈরি হয়ে দেখেছি, ও নেটফ্লিক্সে মুভি দেখতে শুরু করেছে।

বাসা থেকে বের হয়ে দেখি রোদে পথঘাট সব চকচক করছে। অনেকদিন পর আলোর মুখোমুখি দাঁড়ালে যেমন দৃষ্টিবিভ্রম হয় তেমনি বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে আমি বাহন খুঁজতে থাকি। এই শহর এখন ব্যাটারিচালিত রিকশায় সয়লাব। আমি হাত উঁচু করতেই একজন বৃদ্ধ রিকশাওয়ালা তার প্যাডেলচালিত রিকশা নিয়ে এগিয়ে আসে। আমার তাড়া আছে। তবু বৃদ্ধের ঘামে ভেজা পরিশ্রান্ত মুখ দেখে আমি এই রিকশাতেই উঠে পড়ি।
রিকশাতে উঠতে আর নামতে গিয়ে মাথায় দুই দুইবার বাড়ি খাই। হুডে বাড়ি খেয়ে আমার রাশেদের কথাটা মনে পড়ে। নিজের অজান্তেই আমি শব্দ করে হেসে ফেলি। আমার মনের ভেতরের ঝড় সেই হাসিতে চাপা পড়ে যায়। বৃদ্ধ রিকশাওয়ালা খুচরো ফেরত দিতে দিতে আমার দিকে তাকিয়ে হাসে। তিনি কী বুঝেছেন তা ‘আমি বুঝে পাই না।’ আমার আবার হাসি পায়। আমার সঙ্গে রাশেদ যতোবার রিকশায় ওঠে ততোবারই হুডে মাথা ঠেকে হয় আমার চুল আটকে যায় নয়তো আমি মাথায় ভীষণ শব্দে বাড়ি খাই। রাশেদ হৈহৈ করে ওঠে, ‘ঘাড় নিচু করে রাখতে পারো না? পোনে পাঁচফুটি একটা মানুষের মাথা কীভাবে হুড পর্যন্ত যায় আমি বুঝে পাই না।’

‘আমি বুঝে পাই না’ রাশেদের ঠোঁটে সবচেয়ে মানানসই আর দু’বছরের বিবাহিত জীবনে আমার বহুলশ্রুত একটা বাক্য। আমি বের হবার সময় রাশেদ বলেছিল, ‘এই ছুটির দিনে তুমি কোথাও না গিয়ে উনাকেই বাসায় নিয়ে আসতে পারতে, আমি বুঝে পাই না, বিদেশ থেকে আসা মানুষ, বাড়িতে কেউ নেই, সে তোমাকে কী দাওয়াত খাওয়াবে। তাও আবার রেস্টুরেন্টে হলেও হতো, বাড়িতে। ঠিকঠাক বাড়ি চিনে যেতে পারবে তো? আমি বুঝে পাই না।’

এই শহরের পথ আমি চিনবো না? এই শহর আমার পুরনো শহর। আমার ছেলেবেলার শহর। আমার চিরচেনা শহর। আর মোনালিসা আপাদের বাড়িটা আমার করতলের মতো চেনা। আপন। এই যে এই রাস্তার মাথাতে দাঁড়িয়েও আমি আপাদের নারিকেল গাছ ঘেরা বাড়িটা ঠিকঠাক চিনতে পারছি। এদিকটায় দীর্ঘবছর আমরা ভাড়া বাসায় ছিলাম। বাবার অফিস গনেশপাড়ার সামনের রাস্তা ধরে ঢাকা বাসস্ট্যান্ডের দিকে এগিয়ে পশ্চিমের বড় রাস্তার ধারে ছিল। অফিসের কাছাকাছি ছিল আমার স্কুল। স্কুল থেকে ফিরে রোজ বিকালে আমরা কজন আপাদের বাড়িতে যেতাম।

সেই সময়ে মোনালিসা আপাদের বাড়িটা ছিল গনেশপাড়ার সবচেয়ে আধুনিক বাড়ি। এখন আপাদের বাড়ির আশেপাশের ফাঁকা জায়গাগুলো আর ফাঁকা নেই। উঁচু উঁচু ইট-পাথরের দালান উঠে গেছে। আপাদের বাড়ির একটা বাড়ি পরেই আমরা ভাড়া থাকতাম। সেই পুরনো দোতলা বাড়িটা ভেঙে নতুন একটা পাঁচ তলা ভবন নির্মিত হয়েছে। ঐ বাড়িটা ভেঙে ফেলার তোড়জোর শুরু হলে আমরা এই পাড়া ছেড়েছিলাম। মুলাটোলায় একটা বাড়িতে ভাড়া ছিলাম কিছুদিন। ঐ সময় বাবাও আমাদের বাড়ির কাজ ধরেছিল। পরে আমাদের বাড়ি এক তলা উঠে গেলে আমরা সাগরপাড়ায় চলে আসি।

মোনালিসা আপা আর নাহিদ ভাই ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ায় আবদুর রহমান চাচা বাড়ি ফেলে রেখে ঢাকায় চলে গিয়েছিল। আপাদের পরিবার ঢাকা যাবার আগ পর্যন্ত আমাদের দুজনের নিয়মিত দুই বাড়িতে যাওয়া-আসা ছিল। আপা রিতা বা কলিকে দিয়ে আমাকে খবর দিতো। আমি বুভুক্ষের মতো ছুটে যেতাম। মাঝেমাঝে পালিয়েও থাকতে চাইতাম। শুধু মোনা আপার কাছ থেকে না, নিজের কাছ থেকেও। সেই গল্প থাক। আজ আমি নিজেই ধরা দিতে উন্মুখ।
আমি গন্তব্যস্থলে পৌঁছে গেছি। এখানকার বাতাসে শৈশব-কৈশোরের আদি ঘ্রাণ। আকাশে স্মৃতির মাতম। আমার পা লেগে আসে। বুকের ভেতরের অভিমানের ঢেউ ভেঙে গুঁড়িয়ে যায়। কত কী জড়িয়ে আছে এই পাড়ার মানুষগুলোর সঙ্গে। পুরনো কেউ কি আছে? পুরনো স্মৃতির মতো পুরনো মাটি আঁকড়ে ধরে?
ঐ তো সেই বাড়ি। আমি স্কুলছাত্রীর ফিতে বাঁধা ঝুঁটির মতো নেচে উঠি। অবাক হয়ে দেখি, চারপাশে এতকিছু বদলে গেছে, বদলায়নি কেবল আবদুর রহমান চাচার আদি বাড়ির ঐ ঝুল বারান্দাটা। এই বাড়িটার দক্ষিণের ঝুল বারান্দায় একটা চেনা দৃশ্য আঁকা থাকতো। আমি ওপরে তাকাই। বারান্দায় পাতা রট আয়রনের রঙচটা চেয়ারে এক হাতে বই আর আরেক হাতে চায়ের কাপ নিয়ে মোনালিসা আপা ঝকঝকে রোদের ক্যানভাসে সেই চিরচেনা দৃশ্যটি এঁকে বসে আছে।

আকাশে মেঘ দুলছে। পুরো আকাশজুড়ে মনুষ্যাকৃতির অদ্ভুত বিষণ্ন সব মেঘ। গত বছর নভেম্বরে কালিম্পং, দার্জিলিংয়ে এমন মেঘ দেখেছিলাম। পরিবারের সদস্যের চাপে পড়ে প্রথম বিবাহবার্ষিকীতে আমাদের দুজনকে বেড়াতে যেতে হয়েছিল। ততোদিনে রাশেদ টের পেয়েছে, নিতান্ত অনিচ্ছাতে আমি বিয়েটা করেছি। যদিও ও এখন পর্যন্ত টের পায় না, আমি ঠিক কতোটা যন্ত্রণা নিয়ে গোপনে গুমরে গুমরে কেঁদে মরি। দাম্পত্যচর্চার দুঃসহ ভার নিতে না পেরে দিনরাত মরমে মরি।

রাশেদের স্বপ্নেরা প্রেতের মতো আমাকে ধাওয়া করে। ওকে আমি কিছুতেই বোঝাতে পারি না, আমার কাছে ওর জন্য কোনো প্রেম নেই। রাশেদ ভাবে, সময়ে সব ঠিক হয়ে যাবে, বিয়ের পর মানিয়ে নিতে সব মেয়েরই একটু সময় লাগে। অভিভাবকসুলত হাসিতে ও আমার অস্থিরতাকে উপেক্ষা করে। যেন আমি অবোধ কিশোরী, আমাকে খুশি করতে এটা-সেটা উপহার দেয়, সপ্তাহে একদিন রেস্টুরেন্টে খেতে নিয়ে যায়। আমাকে ভালোবেসে প্রগাঢ়ভাবে জড়িয়ে ধরে। আমার শরীরে একতরফা বুঁদ গিয়ে ব্যর্থ রাশেদ একসময় ঘুমিয়ে পড়ে। তবে এটা সত্যি আমাকে ও দোষারোপ করে না। শুধু কোনো কোনোদিন শিশুসারল্যে আমার প্রাক্তনের কথা জানতে চায়, জানতে চায় কেন এত বিষণ্ন আমি। আমি ওর প্রশ্নের কোনো সদুত্তর দিতে পারি না। ওর কৌতূহলী চোখে বিদ্ধ হতে হতে আমার মরে যেতে ইচ্ছে করে। আমি ওকে বলতে পারি না, সেই কবে থেকে আমি বিষাদের ঘেরাটোপে আটকে আছি, এ থেকে আমার মুক্তি নেই।

মা যখন আমার বিয়ে ঠিক করে তখন নিজের ভেতরের দমবন্ধ করা কথাগুলো আমি কাউকে বলতে পারছিলাম না। কথা ভাগাভাগির মানুষ মোনালিসা আপা তখন মেঘের দেশ পাড়ি দিয়ে অনেক দূরে, মেধাবৃত্তি পেয়ে মেলবোর্নে পড়তে গেছে। স্কুলের বান্ধবীরা কে কোথায় হারিয়ে গেছে। পরে কলেজে পড়াকালীন কারো সঙ্গে সেভাবে ঘনিষ্টতাও হয়নি। নিজের মতো থাকতে থাকতে আমি পাথরের নিষ্প্রাণ মূর্তি হয়ে গিয়েছিলাম। এখনো হয়তো তাই-ই আছি। অদ্ভুত নিস্পৃহতায় জীবনকে টেনে চলছি শুধু।
রাশেদের সঙ্গে দার্জিলিংয়ে কাটানো সপ্তাহটিতে আমার জীবনের বেদনার সকল ঘড়া পূর্ণ হয়েছিল। ঐ কয়েকটা দিন রাশেদ আমার যতো ঘনিষ্ট হতে চাইতো, আমি ততো আড়ষ্ট হয়ে যেতাম। মেঘের ছায়ামাখা কাঞ্চনজঙ্ঘা আর সিকিমকে দূর থেকে দেখে আমার শরীর-মন জুড়ে থাকা বিষণ্নতা নীল মেঘের ডানা লাগিয়ে উড়তে চাইতো। একদিন আমি আনমনে পর্যটকদের ভিড়ে হারিয়ে যেতে যেতে ভাবছিলাম উড়ে যাবো, উড়ে উড়ে চলে যাবো অনেক দূরে। রাশেদ আত্মবিস্মৃত আমাকে টানতে টানতে হোটেলে ফিরিয়ে এনেছিল। সে রাতে মুখোমুখি বসে রাশেদ ছেলেমানুষের মতো আকূল হয়ে কেঁদেছিল। নিজে থেকেই প্রতিজ্ঞা করেছিল, আমি সহজ না হলে এসব বিষয়ে ও কখনো আমাকে জোর করবে না।
প্রথম প্রথম রাশেদকে আমি খুব সন্দেহের চোখে দেখতাম। মনে হতো সারাক্ষণ ও আমাকে উত্যক্ত করবে, অধিকারের মাত্রা দিয়ে চিহ্নিত করে দেবে আমার করণীয়, আমাকে নিজের মতো থাকতে দেবে না। আমাকে অবাক করে রাশেদ ওর কথা রেখেছে। সেকারণেই হয়তো ওকে ছাড়তে পারিনি।

রাশেদ একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ায়। সে নিজেও পড়ালেখায় ডুবে থাকতে ভালোবাসে। রাশেদ চায় আমিও আবার পড়ালেখা শুরু করি। কিন্তু আমার বাসার বাইরে যেতে ভালো লাগে না। অথচ একটা সময় আমি হৈ হৈ করে উড়তাম। আমার অবিরত উড়ানে বিরক্ত মা আমাকে শাসন-বারণে রাখতো। বি.এ. পাস করার পর বাবা মারা যাওয়ায় মা আমাকে চেপে ধরে বিয়ে দিয়েছিল। মোনালিসা আপার বাবাও তখন মারা গেছেন। আপা, চাচী, নাহিদ ভাই ঢাকাতেই থাকতো। মোনালিসা আপা ফোন করলেই বলতো, চাচী উনার বিয়েশাদি নিয়ে বাড়াবাড়ি শুরু করেছেন। বেশি বাড়াবাড়ি করলে কারো সঙ্গেই যোগাযোগ রাখবে না আপা। দেশ ছেড়ে পালাবেন।

আপা পালিয়েছিল। পালানোর পর আমাদের আর দেখা হয়নি। দেখা হয়েছিল অনেক আগে, সেই সেবার, যেবার আপার পরিবারের সবাই ঢাকায় চলে গেলো। সেদিন আপার বিষণ্ন চেহারা দেখে আমার খুব কান্না পাচ্ছিল। আমাকে বাচ্চামেয়ের মতো আলতো করে জড়িয়ে ধরে আপা বলেছিল, ‘তোর সাথে সবসময় যোগাযোগ থাকবে রে।’

আপার সঙ্গে বরাবর আমার যোগাযোগ ছিল। ফেসবুকে, ভাইবারে। দুজনের রাশি রাশি মেসেজে মেসেজবক্স উপচে যেতো। সেই ছোটবেলার মতো শাসনে-প্রশ্রয়ে আপা আমাকে আগলে রাখতো। কিন্তু এতে আমার বিষণ্নতা তিল পরিমাণও কমেনি। গোপন কষ্টের ভার দিনদিন বেড়েছে শুধু। এসব ফুলকো-ফুলকো কষ্টকে দুরছাই বলে উড়িয়ে দেয়ার মতো আপন একটা মানুষও নেই না আমার। আমার আছে সুখ-অসুখে বোঝাই করা এক ওজনদার সিন্দুক। যার ভার বইতে গিয়ে আমি কখনোই জীবনের ক্লান্তিকে অতিক্রম করতে পারিনি।

মোবাইলের তীক্ষ্ম রিংটোনে আমি কেঁপে উঠি। মোনালিসা আপার কল। আর একটু পরেই আপার মুখোমুখি হবো আমি। মোনালিসা আপা, আমাদের মোনা আপা, আমাদের জীবনে ছিল একটা স্ফুলিঙ্গের মতো। আমাদের বলতে আমাদের মহল্লার ছেলেমেয়েদের কাছে। আপার বুদ্ধিদীপ্ত চোখ-মুখ, সুডৌল শরীর, পিঠের ঢেউ খেলানো চুল, বয়সের তুলনায় ভারিক্কি চাল দেখলে যে কোনো যুবকেরই গলা শুকিয়ে আসতো। বুকের ভেতরে চেনা-অচেনা অনুভব পুষে রেখে কোনো কোনো যুবক আপাদের বাড়ির সামনের রাস্তার ধারের সেলুনে দিনভর বসে থাকতো। কেউ কেউ রাস্তার ধারের ল্যাম্পপোস্টে কায়দা করে এক পায়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো, এক সিগারেটের পেছনে আরেক সিগারেট লাগিয়ে ধোঁয়াবাজি করতে করতে গোটা প্যাকেট ফুরিয়ে ফেলতো।

আমরা ভীষণ গর্ব করতাম আপাকে নিয়ে। ছুটে ছুটে আপাকে এসে খবর দিতাম, ‘হিরো ভাই এইবার শাহরুখ কাট দিছে। ফয়সাল ভাই আমির কাট। যা লাগতাছে না দুইজনরে আপা। পুরা দা নিউ লায়ন সার্কাসের জোকার।’ স্কুল থেকে ফিরে নাকেমুখে দুটো খেয়ে নিয়ে আমি, রিতা, কলি মোনালিসা আপার কাছে তার প্রণয়প্রার্থীদের নানান বোকামানুষির গল্প নিয়ে হাজির হতাম। আপা সময়ে-অসময়ে বারান্দায় বসে চা খেতো। মাঝেমাঝে আমরা আপার হাতের বিখ্যাত লেবু চায়ের ভাগ পেতাম। নিতান্ত লোভীর মতো চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে জ্যাঠামো করতাম, ‘আজ ফয়সাল ভাইরে দেখছো আপা? এত ফাজিল না ছ্যামড়াটা! আসার সময়ও দেখলাম, দোকানে বইসা সিগারেট খায়। কলিরে ডাক দিয়া কয়, তোর মোনালিসা আপারে বলিস, আমি রক্ত দিয়া তার নাম লিখ্যা যামু।’
মোনালিসা আপা নির্লিপ্তভঙ্গিতে আমাদের কথা শুনতে শুনতে চায়ের কাপে ঠোঁট ছোঁয়াতো। তারপর আমাদের চকচকে উৎসাহে পানি ঢেলে দিয়ে হাতে থাকা তারাপদ রায়ের বই থেকে আবৃত্তি করতো,
‘সব কথা তোমাকে জানাবো ভেবেছিলাম
কিনে এনেছিলাম আকাশী রঙের বিলিতি হাওয়াই চিঠি’
এভাবে কবিতা পড়তে পড়তে হুট করে একদিন মোনালিসা আপা কবিতার মতো রহস্যময় হয়ে গেলো। আপার গোছা গোছা চুল বিনা নোটিশে কেটে ফেলল। আমরা অবাক হয়ে দেখলাম, আপার ভারি ভারি চোখের পাঁপড়ি কেমন ঘন হয়ে উঠছে। হুট করে কেমন যেন বড় হয়ে গিয়েছিল আপা, বদলে গিয়েছিল। আপার হাসি, চাহনি, কণ্ঠস্বর সবকিছুই তখন আমাদের সবাইকে ধোঁয়াশার মধ্যে ফেলে দিতো। তখন আমি কলেজে ভর্তির অপেক্ষায় আছি। কলি একদিন আমার হাতে চিমটি কেটে বললো, ‘মানুষ প্রেমে পড়লে এমন হয়রে...আপা লুকিয়ে লুকিয়ে প্রেম করছে দ্যাখ গিয়ে। পটকা খাস্তগীরকে দেখলাম আপাদের বাড়ির উল্টোদিকের ঐ বাড়ির ছাদে পাহারা দেয়। ছি, ছি, আপার রুচি এতো খারাপ। ফয়সাল ভাইরে একেবারে আমির খানের মতোন লাগে। কত ঘুরলো আপার পিছে, পাত্তা দিলো না।’ আমি কলির কথা পাত্তা দিতাম না। আমিও ততোদিনে বড় হয়ে গেছি।

পুরো বাড়িতে ভেজা ভেজা গন্ধ। সিঁড়িঘরের নিচে রাখা ফুলের টবগুলোতে শুষ্ক মাটি, গাছের চিহ্ন পর্যন্ত নেই। বোঝা যায়, বাড়ির মানুষজনের আসা-যাওয়া নেই তেমন একটা। সিঁড়ির ধাপ ভেঙে উঠতে উঠতে দেখি মোনালিসা আপা একটা গাঙশালিকের মতো উড়ে উড়ে আসছে। আমাকে দেখেই আপা চিৎকার করে ওঠে, রিক্তা...তুই কত বড় হয়ে গেছিস রে!

আমি হাসি, ‘এ কী কথা আপা! আমি তো বড়ই ছিলাম!’ মোনা আপা আমার হাত ধরে সিঁড়ির ধাপ পার করায়, যেন আমি ছোট্ট রিক্তা।
‘তা তো ছিলিই। এখন পুরো অন্যরকম হয়ে গেছিস।’
‘ফেসবুকে তুমি আমার ছবি দ্যাখোনি?’
‘ইস! তা তো দেখিই। কিন্তু সামনাসামনি দেখার মধ্যে পার্থক্য কত বল তো! আর আমাদের কত বছর পর দেখা!
আমি নিচু স্বরে বলি, ‘তিন বছর আট মাস ছয় দিন পর।’
মোনা আপা বিস্ফোরিত চোখে তাকায়। বলে, ‘তুই দেখি দিন তারিখ একেবারে গুণে রেখেছিস!’
আমি সুযোগ পেয়ে ছোট্ট রিক্তার মতো গাল ফুলাই, ‘তা তো রেখেছিই। আমি কি আর তোমার মতো?’
‘আমি কী রে! পড়ার জন্যই তো গেলাম।’
‘পড়ার জন্য না ছাই। আমাদের ছেড়ে, সবাইকে ছেড়ে...।’
‘আমারও খুব খারাপ লেগেছে রে রিক্তা।’
‘ছাই খারাপ লেগেছে। ওখানে তো নতুন বন্ধু পাতিয়েছো তুমি, সমস্যা কী?’

মোনা আপা শব্দ করে হাসে, আমি চমকে যাই। কী সুন্দর হয়েছে আপা! মসৃণ চুল, দীপ্তিময় মুখশ্রী। উজ্জ্বল চোখে গাঢ় কাজলরেখা। শরীরের কমলা রঙ ফেটে পড়ছে। লং স্কার্ট আর হাইনেক গেঞ্জিতে আপাকে বিদেশী কোনো মডেলের মতো লাগছে। আপা আমার হাত টানে, ‘আয় তো, কত কথা যে আছে তোর সঙ্গে।’
রাশেদ ফোন করেছে, পৌঁছেছি কিনা জানতে চেয়ে। আমার কথা শেষ হতেই মোনা আপা হাত থেকে মোবাইল কেড়ে নেয়, ‘এক্কেবারে সুইচড অফ করে রাখ। কারো সঙ্গে আজ কোনো কথা নেই। আগে বল কী খাবি?’

মোনা আপার কথা না ফুরাতেই একজন মাঝবয়সী মহিলা ট্রেতে করে দুই গ্লাস শরবত নিয়ে আসে।
‘ভাল হয়েছে মানুষ পেয়েছো, এত দিনের পড়ে থাকা বাড়ি, কারো হাত পড়েনি কতদিন। কে করতো এত কাজ।’

‘এসব সাংসারিক কথা বাদ দে, কী খাবি দুপুরে বল?’
‘সবকিছুর আগে তোমার হাতের চা চাই।’
ঠিক এই মুহূর্তে আমি আর মোনা আপা ঝুল বারান্দায় বসে ‘মোনালিসা আপার বিখ্যাত লেবু চা’ খাচ্ছি। উষ্ণ চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে আমরা মুগ্ধচোখে দেখছি, আকাশের বুকে মেঘের আশ্চর্য নিমগ্নতা। কোথাও কোনো শোরগোল নেই। আমাদের দুজনের মুখে কোনো শব্দ নেই। মনের ভেতরে না বলা কথার বুদবুদ। সুখ-দুঃখের ফিসফিসানি। বাতাসও ফিসফিস করে ওঠে, ‘এসো, শরীরে জড়িয়ে নাও মেঘের পালক।’ হাওয়ার খেলায় দুলতে দুলতে মেঘেরা রেখার আদলে বদলে যেতে থাকে। মেঘের সাদা, নীল, ধূসর পালকগুলো কোণাকোণি জুড়ে গিয়ে আকাশে অদ্ভুত এক অবয়ব তৈরি হয়। শব্দহীন মোনা আপা আর আমি, দুজনে চুপচাপ বসে সমকোণে নিমগ্ন মেঘ দেখতে থাকি।

সুন্দরের নিবিড় নিমগ্নতা ভেদ করে বহু দূর থেকে মোনা আপার কণ্ঠ শোনা যায়, ‘কেমন আছিস তুই?’
বুকজুড়ে থাকা অভিমান আমার কণ্ঠনালীতে আছড়ে পড়ে, ‘কেমন থাকবো আবার?’ এতক্ষণ নিজেকে ধরে রাখার প্রাণপণ চেষ্টা ব্যর্থ করে আমি ভেঙে পড়ি। দার্জিলিংয়ে কাটানো রাতগুলোতে রাশেদের অনাকাক্সিক্ষত স্পর্শের কথা মনে পড়ে। আমার সমস্ত শরীর পুড়তে থাকে, জ্বলতে থাকে তুমুল ক্ষোভে। যেন শত শত মৌমাছি হুল ফোটাচ্ছে আমার নিরাভরণ শরীরে। সেই বিষ আমি উগড়ে দিই বাতাসের স্রােতে, ‘তুমি তো ভালোই ছিলে। রায়নাকে নিয়ে। আমার কথা ভেবেছ একবারও?’
‘রায়না আর তুই এক হলি?’
‘হুম, আমি তোমার কে?’
‘তুই? তুই আমার প্রিয়তম পাপ। হাহাহা।’ মোনা আপার হাসিতে আপার সৌন্দর্যের ছটা। দেখে আমার ভীষণ রাগ হয়।

‘এত কঠিন কথা বুঝি না মোনা আপা।’ বলতে বলতে আমার বুক ফেটে কান্না আসে। আমি ভেজা চোখে সামনে তাকাই। মোনালিসা আপার ঠোঁটের কোণে ভিঞ্চির মোনালিসার হাসি। আমি মুগ্ধচোখে আপাকে দেখি, এত সুন্দর মানুষ হয়! এই সুন্দরের পাশে সাদামাটা সালোয়ার কামিজ পরনে বিষণ্ন রিক্তা একেবারে দীনহীন ভিখারির মতো দাঁড়িয়ে আছে।
মোনালিসা আপা আমার পুরনো প্রেমিকের মতো আমার দিকে হাত বাড়ায়। আমার সেই প্রেমিক আমাকে বলেছিল, ভালোবাসি কথাটা জীবনে একবারও না বলে সহস্রবার সহস্রভাবে অনুভব করা যায়। সেই বিচিত্র অনুভবে বহুদিনপর আমার শুষ্ক শরীর প্লাবিত হয়। আমি সম্মোহিতের মতো মোনার হাত ছুঁই। নিমীলিত চোখে অপেক্ষা করতে করতে তলিয়ে যাই গভীর খাদে। মোনা আমাকে গভীর প্রশ্রয়ে টেনে তোলে। আমি মোনার হাত ছুঁয়ে কবুতরের ডানা পেয়ে যাই, ঘাড়-গলার পালক ফুলিয়ে মোনার কানের কাছে বাকবাকুম করি, ‘এতোদিন কোথায় ছিলে।’ কথা না বলে মোনা নরম রোদের উত্তাপ ছড়ায়।

আমি জানি ও কোথায় ছিল। আমার ঠোঁটে-গালে-নাকে মোনার ঠোঁটের অবিনাশী উত্তাপ লেগে আছে। মোমের মতো গলে গলে টের পাই মোনার স্পর্শের উষ্ণতা আজও সেই পাপের মতো নিবিড়, যার রঙ ছিল বেগুনি, নীল, আসমানি, সবুজ, হলুদ, কমলা আর লাল। মোনা কাঁদে, আমি কাঁদি, প্রবল সুখের অনুভবে। ঠিক তখনই বিজলির আখ্যান ভেঙে বৃষ্টিবিরতির রঙধনু আকাশের বহুতল মেঘের পরে শরীর এলিয়ে দেয়। মনভুলানো বাহারের এ রঙধনু রহস্যময় সুন্দর। বিমূঢ় আমরা এর রহস্য বুঝি না। কেবল বুঝি, এই রঙধনুই জানে, একজন মানুষের সঙ্গে আরেকজন মানুষের গড়ে ওঠা সম্পর্কে কতো গোপন পরত থাকে, প্রতি পরতের থাকে আলাদা আলাদা গোপন ঘ্রাণ।
আমি আর মোনা শরীরে মেঘের পালক লাগিয়ে সেই ঘ্রাণের সরোবরে ডুবসাঁতার কাটতে থাকি।

আহসান হাবিবের গল্প : ইলিশ







আহসান হাবিব
ইলিশ

এই বাড়িতে শেষ কবে ইলিশ মাছ রান্না হয়েছে, কেউ তা ঠিক মনে করতে পারে না, বছর দুয়েক তো হবেই । তবে শেষ ইলিশের ঘ্রাণ যে নাকে এখনো লেগে আছে, এটা ঠিক ঠিক তারা টের পায় । অন্তত এই বাড়ির ছোট দুই ছেলে মাঝে মাঝেই সেই ঘ্রাণ মনে করে এক ধরণের সুখ অনুভব করে । তারা তাদের অজ্ঞানতায় মস্তিস্কের যে স্মৃতির নিউরন যা ঠিক ধরে রেখেছে সেই স্মৃতি, সেজন্য এক ধরণের কৃতজ্ঞতা জানায় তাদের কিংবা চোখে মুখে সেই স্মৃতির কৃতজ্ঞতা চিহ্ন ফুটে থাকে । তারা অচিরেই বুঝে যায় স্মৃতি খুব সহজেই হারিয়ে যায় না ।যদিও আবার কবে এই বাড়িতে ইলিশ আসবে, কেউ তা জানে না ।

ইলিশ না আসলেও প্রতিদিন ঠিকই মাছ আসে এ বাড়িতে, সে মাছ বাজারের সবচাইতে সস্তা, সে মাছ পুঁটিমাছ । দেখতে আহামরি কিছু নয়, স্বাদেও না । কিন্তু এই বাড়ির কর্তা ফয়েজ মণ্ডলের এর চেয়ে দামী মাছ কিংবা সুদৃশ্য মাছ আনার ক্ষমতা রাখেন না । তার আয় খুব সামান্য, এদিকে পরিবারে ছেলেমেয়ের সংখ্যা বাড়তে বাড়তে সাতে এসে ঠেকেছে । বাড়িতে মোট নয়জন মানুষ, নয়জন মানুষের খাবার জোটানো কি চারটে খানিক কথা ! কোনরকমে তাদের দিন কেটে যায় । ভাগ্যিস যে বাড়ির কাছেই ছিল সরকারী প্রাইমারী এবং হাইস্কুল যেখানে সবাই একে একে পড়ালেখা শুরু করে । ফয়েজ মণ্ডল নিজে খুব বেশি লেখাপড়া করেন নাই, কিন্তু বাচ্চাদের লেখাপড়ার ব্যাপারে খুব সিরিয়াস । তার সাফ কথা- সবাইকে লেখাপড়া করতে হবে । লেখাপড়া করতে কোন খরচ নাই, সরকারী স্কুল, কোন বেতন নাই, আর কোন ফিস নাই । শুধু কিছু বই আর খাতা কলম কিনে দিলেই হয়ে যায় । ফয়েজ মণ্ডলের সব ছেলেমেয়ে আবার লেখাপড়ায় ভাল, সব বড় ছেলে এবার ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেবে । খুব জোরসে লেখাপড়া চলছে । ক্লাশ এইটে বৃত্তি পরীক্ষা পেয়েছিল, স্কুলের সবাই ধারণা করছে ম্যাট্রিকে ঠিকই স্ট্যান্ড করবে কাজল, এই বাড়ির বড় ছেলের নাম কাজল । কাজলের দেখাদেখি আর সবাই লেখাপড়ায় একই রকম ভাল, ফলে ফয়েজ মণ্ডল এদিক থেকে খুব, খুব ভাগ্যবান । এলাকার লোকজন তাকে সমীহ করে এমনকি স্কুলের শিক্ষকগণও তাকে সম্মান করে থাকেন ।

স্থানীয় বাজারে ফয়েজ মণ্ডলের একটা ছোট্ট দোকান আছে, চাল ডাল সহ নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য নিয়ে তার দোকান । দোকানে সারাদিন কাজ করেন, সকালে বেরিয়ে রাতে ফেরেন । দুপুরে একবার বাড়িতে এসে খেয়ে আবার দোকানে গিয়ে বসেন । সকাল সকাল এই বাজারে বিভিন্ন ধরণের মাছ নামে, ফয়েজ মণ্ডল বেছে বেছে পুঁটি মাছ কিনে বাড়িতে পাঠিয়ে দেন । লাউ, পেঁপে, কুমড়া, শশা, টমেটো বেগুণ নিজের বসত বাড়ির পেছনে যে টুকরো জায়গা আছে সেখানে চাষ করে তার মেজো এবং সেজো ছেলে । এই দুই ভাই খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে এইসব শব্জী চাষে লেগে পড়ে । বাড়ির মধ্যে একটা পেঁপে গাছ আছে, চালের উপরে কুমড়ো আর রান্নাঘরের কোন বেয়ে উঠে গেছে একটা পুঁই গাছ । বাড়ির পেছনে নানা উদ্ভিদ, তার মধ্যে কচুর গাছের ছড়াছড়ি, তাই এই বাড়িতে কচুর শাক প্রায় রোজ রান্না হয় । একটা সজিনার গাছ আছে বাড়ির আর দিকে, সজিনার শাক এ’বাড়ির আর একটা প্রধান খাবার ।
দীর্ঘদিন পুঁটি মাছ খেতে খেতে ততদিনে এই বাড়ির লোকজনের মুখে চরা পড়ে গেছে যেন । বাড়ির গৃহিণী ফরিদা বেগম তাই একদিন সাহস করে বলে ফেললেন-
‘ছেলেমেয়েরা কতদিন ভালমন্দ খায় না, রোজ রোজ একই মাছ, সেই পুঁটি, একদিন একটা ইলিশ আনবেন তো’।

স্বামী তখন দোকান যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, গায়ে ফতুয়াটা জড়াতে জড়াতে ফরিদা বেগমের দিকে তাকালেন, না কোন রাগী দৃষ্টি নয়, কেমন যেন একটা অসহায়ের দৃষ্টি । মুখে কিছু বললেন না, দোকানের উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন । ফরিদা বেগম কেমন যেন নিস্তব্ধ হয়ে গেলেন, মনে মনে বলতে লাগলেন- কথাটা বলা মনে হয় ঠিক হয় নাই, লোকটা কত কষ্ট করে যে সংসার চালাচ্ছেন, তা শুধু তিনিই জানেন । অনেকক্ষণ বারান্দায় মন খারাপ করে বসে রইলেন ।

দিন যায়, মাস যায় । ইলিশ আসে না, আসে সেই পুঁটি । কিন্তু একদিন আসে সেই একটা দিন, যেদিন সত্যি সত্যি এই বাড়িতে ইলিশ আসে । বাজারে হাট বসে সপ্তাহে দুইদিন, সেই দুইদিন হাটে ইলিশ মাছ ওঠে । বিকাল তিনটার পর হাটে মানুষ আসতে শুরু করে । সন্ধ্যা হতে হতে হাট জমে ওঠে । সেদিন দুপুরে খেতে গিয়ে ফরিদা বেগমকে ফয়েজ মণ্ডল বলেন- ‘আজ সন্ধ্যায় তোমার মেজো ছেলেকে একটু দোকানে পাঠিও তো’।

ফরিদা বেগম কিছুটা আঁচ করতে পারেন, আজ নিশ্চয় ভালমন্দ খাবার বাড়িতে আসবে, হতে পারে ইলিশও আসতে পারে । ‘আচ্ছা’ বলে চুপ করে থাকে ।
সন্ধ্যার একটু আগেই মেজো ছেলে কালাম হাতে একটা বাজারের থলে নিয়ে বাজারে উপস্থিত হয়ে পড়ে ।ফয়েজ মণ্ডল তাকে দেখেন, তখন তিনি সামান্য ব্যস্ত, হাতের ইশারায় বসতে বলেন কালামকে, কালাম সামনে একটা বেঞ্চ, সেখানে বসে পড়ে । ব্যস্ততা কমে গেলে তিনি দোকানের ভেতর থেকে নেমে আসেন এবং কালামকে দোকানের ভেতর উঠে গিয়ে বসতে বলেন, কালাম ইতস্তত করে, এটা বুঝতে পারেন ফয়েজ মণ্ডল, তিনি তখন তাকে নিষেধ করেন-
‘থাক বসতে হবে না, তুই আমার সঙ্গে চল’ বলে তিনি দোকানটা বন্ধ করে ফেলেন । সন্ধ্যায় কখনো দোকান বন্ধ করেছেন, ফয়েজ মণ্ডলের মনে পড়ে না । আজ বন্ধ করলেন, কারণ তিনি আজ মাছের বাজারে যাবেন এবং যদি একটা ইলিশ পেয়ে যান তার সাধ্যের মধ্যে, কিনে ফেলবেন । সকাল থেকেই তাঁর মনের ভেতর একটা আলোড়ন চলছে, এর আগে এই বাড়িতে কখনো ইলিশ মাছই রান্না হয় নাই । কালামকে বলেন- ‘চল, আমার সংগে, মাছের বাজারে চল’
‘মাছের বাজারে’ কথাটা শুনেই কালামের ভেতর একটা আনন্দের শিহরণ খেলে যায় । সেও ভাবতে থাকে আজ বাবা নিশ্চয় ইলিশ মাছ কিনবে । সে বাবার পিছনে পিছনে থলে নিয়ে হাঁটতে থাকে । বাজার জমে উঠেছে, এক এক জায়গায় এক এক জিনিসপত্র । সবাই সারি সারি হয়ে বসে আছে, কেউ হলুদের গুঁড়া নিয়ে, কেউ আবার মরিচের গুঁড়া, আবার কেউ সরিষার বোতল নিয়ে বসে আছে । অন্যদিকে নানারকম শব্জীর বাজার, একদিকে ধান এবং অন্য আর দিকে চালের বাজার । বাজারের ঠিক মধ্যিখানে দুই সারি মিষ্টির দোকান, হরেক রকম মিষ্টি । রসগোল্লা, জিলাপী, ঝুরি, বাতাসা, দমমিষ্টি ইত্যাদি । কালাম সেদিকে তাকায়, তার লোভ জাগে, কিন্তু বাবাকে মুখ ফুটে বলতে পারে না । ফয়েজ মণ্ডল সেটা দেখতে পান, কিন্তু মিষ্টির দোকানের সামনে দাঁড়ান না । একদম চলে যান মাছের বাজারে ।

খুব বেশি মাছ বাজারে আজ নামেনি, তবে ইলিছ মাছ বিক্রি করে যে আজমল, সে ঠিকই ইলিশের ঝাঁপি নিয়ে বসে আছে । সে ফয়েজ মণ্ডলকে দেখতে পেয়েই বলে ওঠে-
‘কি ফয়েজ মিয়া, আজ যে বড় মাছের বাজারে, তুমি তো পুঁটি মাছ কেনো সেই সকাল বেলা’
ফয়েজ মিয়া এই কথার কোন জবাব দেন না, ঝাঁপির উপরে রাখা কয়েকটা ইলিশ মাছের দিকে তাকান, একই রকম সাইজ, বড়জোর ৭০০ কিংবা ৮০০ গ্রাম করে হবে এক একটা ইলিশ । দাম কত হবে ফয়েজ মণ্ডল আন্দাজ করতে পারেন না ।কেননা এই প্রথম তিনি পুঁটি মাছ ছেড়ে ইলিশ কিনতে এসেছেন । একটা মাছের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেন-
‘আজমল মিয়া, এই মাছটার দাম কত, বল’ ?
‘তুমি যদি লও, ১৭০ টাকা হলেই হবে’
‘১৭০ ? খুব বেশি বলছ আজমল, ১২০ টাকা হলে দাও’
‘না, ফয়েজ মিয়া, এতো কমে হবে না, আর একটু বাড়াতে হবে’
‘কততে পারবা তুমি বল’ ?
‘যাও তোমার জন্য আমি ১৫০ টাকায় রাখবো’
‘আর দশ টাকা কম নিও আজমল মিয়া’
‘না, আর কমে দিতে পারবো না’
‘ঠিক আছে দাও, এই ব্যাগে ভরে দাও’ কালামের হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে ফয়েজ মণ্ডল ইলিশ মাছটা ব্যাগের মধ্যে রাখতে বলে, আজমল রেখে দেয় । মাছের দাম মিটিয়ে তারা আবার দোকানের দিকে হাঁটতে থাকে । হাঁটতে হাঁটতে মিষ্টির দোকানের সামনে এসে ফয়েজ মণ্ডল দাঁড়িয়ে পড়েন । মিষ্টির বাজারে সবচাইতে নামকরা মিষ্টি বানায় সুধীর ঘোষ । সুধীর ঘোষের মিষ্টির সুনাম এই অঞ্চল ছাড়িয়ে রাজধানী পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে । মাঝে মাঝে রাজধানী থেকে অর্ডার আসে, বিশেষ করে সুধীর ঘোষের চমচমের কোন তুলনা হয় না । ফয়েজ মণ্ডল কালামের দিকে তাকিয়ে বলে-
‘কি মিষ্টি খাইবা, বেটা’ ?
কালাম কি বলবে ভেবে পায় না, সুধীর ঘোষের চমচম কবে খেয়েছে মনে করতে পারে না, আসলে কোনদিনই খায়নি, মাঝে মাঝে বড়জোর ঝুরি বা দু’একখান জিলাপী খেয়েছে । কালাম মুখ ফুটে বের করে ফেলে-
‘চমচম’।

ফয়েজ মণ্ডল চমচম শুনে কিছু বলেন না, সুধীর ঘোষকে চারটা চমচম দিতে বলেন একটা পলিথিনে মুড়ে । সুধীর ঘোষ চারটা চমচম পলিথিনের প্যাকেটে মুড়ে ফয়েজ মণ্ডলের হাতে দেয় এবং তাঁর মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকেন । এর আগে কোনদিন ফয়েজ মণ্ডলকে চমচম কিনতে দেখেনি । মিষ্টির প্যাকেট কালামের হাতে দিয়ে বলেন-
‘বাড়ি নিয়ে যাও, সবাইকে নিয়ে খাবা’
কালাম মিষ্টির প্যাকেট হাতে পেয়ে মনে হল যেন চাঁদ হাতে পেয়েছে । তার এক হাতে তখন ইলিশের ব্যাগ, আর এক হাতে মিষ্টির প্যাকেট, সে ভাবতেই পারে না এমন একটা দিনের কথা । সুধীর ঘোষকে মিষ্টির দাম ৩ টাকা বুঝিয়ে দিয়ে দোকানের দিকে হেঁটে যেতে যেতে কালামকে বলেন-
‘তুমি বাড়ি চলে যাও’
কালাম বাড়ির পথ ধরে, তার ভেতর তখন উত্তেজনার শেষ নাই, তাঁর এক হাতে ইলিশের ব্যাগ, আর এক হাতে মিষ্টির প্যাকেট ! অনেক জোরে জোরে পায়ের কদম ফেলতে থাকে কালাম, ফয়েজ মণ্ডল দোকানে গিয়ে আবার বসেন ।

সেই রাতে এই বাড়িতে খুশীর বন্যা বয়ে যায় । মা ফরিদা বেগমের খুশি কেউ দেখতে পায় না কিন্তু সাত ভাইবোনের চোখমুখ যেন খুশিতে টগবগ করে ফুটছে, আজ তারা ইলিশ খাবে, শুধু ইলিশ নয়, মা বলেছে আজ যে মিষ্টির প্যাকেট এসেছে এই বাড়িতে্ খাওয়ার পর সবাইকে এক টুকরো করে চমচমও খেতে দেবে । যে যার লেখাপড়া শেষ করে বসে আছে । কেরোসিনের কুপি জ্বলছে ঘরে ঘরে, বাইরে একটা লম্বা কাঠের টেবিল, সেখানে একটা লণ্ঠন জ্বলে, এই আলোতেই সব ভাইবোন লেখাপড়া করে । রান্নাঘর থেকে মাছ রান্নার গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে, ইলিশের গন্ধ যে এমন মন মাতানো, এর আগে কেউ জানে না । এই প্রথম এই বাড়িতে ইলিশ এসেছে । ইলিশের গন্ধে এখন এই বাড়ির প্রতিটি কোণ ম ম করছে । মাঝে মাঝে রান্নাঘরে উঁকি দিয়ে দেখছে কেউ কেউ, বিশেষ করে ছোট দুই ভাই, যাদের বয়স একজনের ছয়, একজনের আট । একজনের নাম রাজু, আর একজনের নাম কাজু । রাজু আর কাজু একসঙ্গে একটা খাটে শোয়, এদের মধ্যে দারুণ মিল, ভাব । ওদের দুজনের যেন দেরি সহ্য হচ্ছে না, মাঝে মাঝেই পড়ার টেবিল ছেড়ে রান্নাঘরে উঁকি দিয়ে আসছে । যত তারা রান্নাঘরের দিকে যায়, ইলিশের ঘ্রাণ তাদের জেঁকে ধরে, তারা পাগল হয়ে ওঠে । ফয়েজ মণ্ডল আজ একটু আগেই বাজার থেকে চলে এসেছেন, তিনিও হাত মুখ ধুয়ে বারান্দায় এসে বসেছেন একটা মোড়ার উপর । এখন বাড়িতে একটা নীরবতা বিরাজ করছে, কিন্তু সবার মনের মধ্যে চলছে তুমুল উত্তেজনা, একটু পরেই তারা ইলিশ দিয়ে ভাত খাবে ।
মা আজ ঘোষণা দিয়েছেন সবাইকে একসঙ্গে খেতে হবে । কিন্তু একসঙ্গে বসার মত এতো বড় জায়গা কই ? টেবিলে বড় জোর ছয়জন ধরবে, আর দুইজন ? তখন মা সিদ্ধান্ত দিলেন আঙিনায় একটা বড় মাদুর পেতে দিতে । তাই হল, একটা বড় মাদুর পেতে দেয়া হল, সব ভাইবোন মাদুর ঘিরে বসে পড়লো, একপাশে বাবা ফয়েজ মণ্ডল । এসে পড়লো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ- মা সব খাবার একে একে মাদুরের একপাশে এসে রাখলেন, সব শেষে আসলো ইলিশের বাটি । সেদিকে সবাই একবার তাকাল, আহ, কি সুন্দর দেখতে ! মা সবাইকে ভাত বেড়ে দিতে শুরু করলেন, প্রথমে শব্জী, তারপর প্রত্যেকের পাতে এক টুকরো করে ইলিশ, সঙ্গে ঝোল । সবাই খেতে শুরু করলে ফয়েজ মণ্ডল বলে উঠলেন-
‘তুমিও আজ আমাদের সঙ্গে বসে যাও, ফরিদা’
ফরিদা বেগম যেন লজ্জা পেলেন, বললেন-
‘পাগল নাকি, তোমরা আগে খেয়ে নাও, আমি পরে খাবো’
‘তোমার জন্য কিন্তু ইলিশের টুকরা রাখতে ভুইল না’
ফরিদা বেগম স্বামীর দিকে তাকান, সামান্য হাসেন,
‘সে চিন্তা তোমাকে করতে হবে না’
সেই রাত যেন এই বাড়িতে একটা উৎসব এসেছিল, পেট পুরে ভাত খেয়েছিল, ইলিশ মাছ খেয়েছিল । আর ইলিশের গন্ধে তারা মনে মনে মাতাল হয়েছিল । খাওয়া শেষ হলে মা যখন প্রত্যেকের পাতে এক টুকরো করে চমচম তুলে দিল, আনন্দ যেন উপচে পড়েছিল, কোন ভাষাই সেই আনন্দকে অনুবাদ করতে সক্ষম নয় ।


প্রথম সেই ইলিশ খাওয়ার স্মৃতি দিনে দিনে ফিকে হয়ে এসেছে এই বাড়িতে । আবার বছর ঘুরে ঘুরে আসতে শুরু করেছে সেই পুঁটি মাছের ঝোল খেয়ে খেয়ে । দুবছর তো হবেই ? আবার তাদের ইলিশ খাওয়ার কথা মনে হয়েছে, কিন্তু ততদিনে ফয়েজ মণ্ডলের আয় কিছুটা কমে এসেছে, মাঝে মাঝেই গ্রামের এক ধনী বিধবা মাজু পিরাইনের কাছ থেকে ধান ধার করে আনেন, সঙ্গে কিছু পরিমাণ সুদ । ফয়েজ মণ্ডল এর মধ্যেই অনেক ঋণী হয়ে পড়েছেন কিন্তু সেটা ছেলেমেয়েদের বুঝতে দেন না । তাদের লেখাপড়া ঠিকমতই চলতে থাকে । এদিকে বছর বছর একটা উপদ্রব তো আছেই- বন্যা । প্রতিবছর বন্যা হয়, কোন বছর কম কোন বছর খুব বেশি । যে বছর বেশি বন্যা হয়, সে বছর মাটির তৈরি বাড়ির দেয়ালের একদিক ধ্বসে পড়ে, বন্যা নেমে গেলে আবার সেই দেয়াল তুলেন ফয়েজ মণ্ডল ।তখন তার অনেক খরচাপাতি হয়ে যায় ।
এবার সেই বন্যা অন্যান্য সব বছরকে ছাপিয়ে গেছে । ইতোমধ্যেই পাগলা নদী রুদ্র রুপ ধারণ করেছে, চারদিক ভাসিয়ে নিতে শুরু করেছে । ফয়েজ মণ্ডলের কপালে বড় ফাটল দেখা দিতে শুরু করেছে । এবার যদি তার পুরো বাড়িটাকেই ধ্বসিয়ে দিয়ে যায়, কি করে তিনি মেরামত করবেন ? পাগলার যে পাশ দিয়ে একটা খাল চলে এসেছে ফয়েজ মণ্ডলের বাড়ির লাগোয়া বিশাল ফসলের মাঠে, সেটা দিয়ে পানি এসে মাঠটিকে প্রায় ডুবিয়ে দিয়েছে এর মধ্যেই । পানি এখন ফসলের কোমর পর্যন্ত, আর কয়েকদিনেই মধ্যেই মনে হচ্ছে সম্পূর্ণ ডুবিয়ে দেবে । গ্রামের কৃষক ব্যস্ত হয়ে পড়েছে খালের মুখে বাঁধ দিতে, আর কয়েকদিন পরেই ফসল পেকে উঠবে । এই কয়দিন যদি পানিকে ঠেকিয়ে না রাখা যায়, তাহলে সর্বনাশ হয়ে যাবে । ফয়েজ মণ্ডলের কোন জমিজমা নাই, তার এসব চিন্তা নাই, কিন্তু গ্রামের মানুষের কথা চিন্তা করে তিনিও বিষণ্ণ । তাছাড়া জমি জমা না থাকুক তার বাড়িতো আছে, বন্যায় সেটা যদি নষ্ট হয়ে যায়, তাহলে তার বিপদ কারো চেয়ে কম হবে না ।

গ্রামের সব মানুষের চেষ্টাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বাঁধ উপচিয়ে পানি এসে মাঠকে সয়লাব করে দিল, এখন মাঠের দিকে তাকালে মনে হয় এখানে কোন ফসল ছিল না, ছিল শুধু পানি । যেদিকে তাকানো যায়, পানি আর পানি । রাজু আর কাজু এই পানি দেখে কিন্তু দারুণ শিহরিত । তারা শুনেছে বন্যার পানিতে প্রচুর মাছ আসে, তাদের বাড়ির পাশেই একটা পুকুর, সেই পুকুরেও মাছ আছে, মাঝে মাঝেই তারা ছিপ নিয়ে মাছ মারতে বসে যায় ।রাতে যে পানি ছিল হাঁটু বরাবর, ভোরে উঠে দুই ভাই দেখে সেই পানি গলা পর্যন্ত উঠে গেছে । মাঠ ছাপিয়ে এখন পানি তাদের বাড়ির খুব কাছে চলে এসেছে ।ফয়েজ মণ্ডল পানি ঠেকাবার কোন উপায় খুঁজে পান না । বাজারে যাবার উৎসাহ ঢিলে হয়ে আসে, কিন্তু না গেলেও চলে না । ভোর হতেই তিনি ফজরের নামাজ শেষ করে বাড়ির বাইরে এসে তাকিয়ে দেখেন পানি আর পানি । পুকুরও পানিতে উপচিয়ে পড়া শুরু করেছে । ফয়েজ মণ্ডল প্রমাদ গুণতে শুরু করলেন ।

কিন্তু রাজু আর কাজু পানি দেখে বেজায় খুশি । কতদিন তারা ইলিশ খেতে পায়নি, এবার নিশ্চয় খেতে পাবে । দুভাই সলা করে মাঠে মাছ ধরতে যাবে । কিন্তু কি দিয়ে তারা মাছ ধরবে ? তাদের তো মাছ মারার জাল নাই ? ছিপ দিয়ে কি মাছ মারা যাবে ? কোথায় দাঁড়িয়ে তারা মাছ মারবে, সব জায়গায় তো শুধু পানি আর পানি ।তারা দুভাই খুব চিন্তায় পড়ে যায়- কিভাবে তারা মাছ ধরবে ? যেমন তেমন মাছ নয়, তারা ইলিশ মাছ ধরবে । খুব চিন্তা করে ছোট ভাই রাজু একটা বুদ্ধি বের করে-
‘কাজু, শুন, মায়ের একটা পুরানা শাড়ি আছে, সে শাড়ি দিয়ে মাছ ধরবো’
কাজু হাসে,
‘শাড়ি দিয়ে কি মাছ মারা যায় বোকা’ ?
‘যাবে না কেন ? জাল দিয়ে যদি মাছ মারা যায়, তাহলে শাড়ি দিয়ে কেন যাবে না’ ?
‘তা ঠিক বলেছিস। কিন্তু শাড়ি আনবি কিভাবে’ ?
‘তুই দাঁড়া, আমি নিয়ে আসছি’ বলেই রাজু এক দৌড়ে বাড়িতে ঢুকে গেল । কয়েক মিনিট পরে ঠিকই সে মায়ের পুরানা কাপড় নিয়ে এসে হাজির । এখন খুব ভোর, মা টের পায়নি । মা এখন রান্না ঘরে ঢুকে রান্না করছে, দেখতে পায়নি ।

দুই ভাই মায়ের পুরানা শাড়ি নিয়ে মাঠের দিকে দৌড় দেয়, যেখানে পানি বেশি । মাঠ আর বাড়ির মধ্যে কোন দূরত্ব নাই, তবে মাঠের মাঝখান সামান্য নীচু, সেখানে পানি অনেক বেশি । তারা সেইদিকে দৌড়াতে শুরু করে । মাঠের দিকে যেতেই তাদের চোখে পড়ে গ্রামের সব মানুষ যেন এখানে এসে জড় হয়েছে । দূরে তাকিয়ে তারা দেখতে পায় বাঁধ ঠিক করার জন্য কোদাল নিয়ে প্রাণপণে চেষ্টা করছে । কিন্তু কোনমতেই পানির স্রোত বন্ধ করতে পারছে না, বাঁধ উপচিয়ে পানি তীব্র বেগে ছুটে আসছে মাঠে । যত সময় যাচ্ছে ফসল পানির তলায় তলিয়ে যাচ্ছে । একটা হাহাকার যেন সারা মাঠকে ঘিরে ফেলেছে । এরি মধ্যে কেউ কেউ আবার বড় জাল নিয়ে নেমে পড়েছে মাছ ধরার জন্য । রাজু আর কাজুও নেমে শুরু করে শাড়ি দিয়ে মাছ মারার কাজ । দুইভাই দুদিকে শাড়ি ধরে টানতে থাকে । বেশ কিছুদুর টেনে নিয়ে যায়, তারপর উপরে উঠিয়ে দেখে কোন মাছ ধরা পড়েছে কি না । না কোন মাছ ধরা পড়ে নাই । তারা আবার শাড়ি টানতে থাকে, আবার দেখে, না এবারও কোন মাছ শাড়ির জালে উঠে আসে নাই । মাছ উঠে নাই বলে তারা মন খারাপ করে না, তারা ভাবে মাছ উঠবেই ।এদিকে বেলা বেড়ে উঠতে থাকে । সূর্য অনেকটা উপরে উঠে এসেছে ।
হঠাৎ রাজুর খেয়াল হয় স্কুলের বেলা হয়ে গেছে, স্কুলে যেতে হবে-
‘এই কাজু স্কুল যাবি না’ ?
কাজু চট করে জবাব দেয় না, একটু ভাবে, বলে-
‘না, যাবো না, দেখবি আজ কেউ স্কুলে আসতে পারবে না’
‘হ্যা, তুই ঠিকই বলেছিস, স্কুল যাওয়ার সব রাস্তা তো বন্ধ হয়ে গেছে’
‘চল মাছ মারি’
‘চল’
আবার দুভাই শাড়ির দুদিক ধরে টানতে থাকে । তাদের আশেপাশেই কেউ কেউ ধান কাটতে শুরু করে দিয়েছে যদিও ধান এখনো সম্পূর্ণ পেকে উঠেনি । তাদের একটাই চেষ্টা যদি কিছু ধান বাঁচাতে পারে ! রাজুর এইসময় ক্ষুধা লাগে, পেট মোচড় দিয়ে ওঠে । এইসময় তারা নাস্তা খেয়ে রোজ স্কুলে চলে যায় ।
‘খুব ক্ষুধা লেগেছে, কাজু’
‘আমারও তো’
‘বাড়ি যাবি’ ?
‘আরে না, বাড়ি গেলে তুই মাছ মারবি কিভাবে ? মা তো আর আসতে দেবে না’
‘তাহলে’ ?
‘একটু কষ্ট কর, আর একটু দেখি’
রাজু ‘ঠিক আছে’ বলে শাড়ি টানা শুরু করে । তাদের একটাই লক্ষ্য- ইলিশ । একটা ইলিশ মাছ পেলেই তারা মাছ মারা ছেড়ে দিয়ে বাড়ির দিকে দৌড় দেবে । কিন্তু সেই মাছের দেখা নাই । সময় বয়ে যায়, সূর্য আরও উপরে উঠে এসেছে, গনগণে রোদ, ক্ষুধাও বেড়ে চলেছে । ইতোমধ্যে দুভায়ের মুখ শুকিয়ে এসেছে, পানিতে বোঝা যাচ্ছে না । তারা লক্ষ্য করে বানের পানি ক্রমাগত বাড়ছে । সকালে যতটুকু পানি ছিল এখন তার চাইতে অনেক বেড়ে গেছে । যত পানি বাড়তে থাকে তারা পিছাতে থাকে । ক্রমে তারা বাড়ির দিকে আসতে থাকে । দুভায়ের শাড়ি ধরে টানার বিরাম নাই, পানি বাড়ারও বিরাম নাই, যেন দুদিক থেকে একটা অসম যুদ্ধ চলছে । সেই যুদ্ধে রাজু কাজুর জিততেই হবে ।

এখন তারা বাড়ির খুব কাছাকাছি চলে এসেছে, না এসে উপায় নাই, পানি তাদের এখন গলা বরাবর । এখনো কোন মাছ তাদের শাড়িতে আটকায়নি । একবার কয়েকটা ছোট ছোট চিংড়ি মাছ ধরা পড়েছিল, তাদের লাফানি দেখে দুভাই খুব খুশি, কিন্তু তারা তো ইলিশ ছাড়া কোন মাছ ধরবে না । বাড়ির কাছাকাছি আস্তেই তারা লক্ষ্য করে ইতোমধ্যে পুকুর পানিতে ছাপিয়ে বাড়ির দেয়াল বরাবর চলে এসেছে । তারা শেষবারের মত শাড়ির টান দেয়, মাছ উঠে আসে, বেশ কয়েকটা মাছ শাড়িতে ধরা পড়ে । কিন্তু সেই মাছ ইলিশ নয়, কয়কেটা ছোট ছোট পুঁটি মাছ ।




জাকির তালুকদারের গল্প : বালকের চন্দ্রযান




জাকির তালুকদার
বালকের চন্দ্রযান


...মা জ্বরে প্রায় বেহুঁশ। ছেলে গায়ে হাত দিয়ে দেখে ধান ছোঁয়ালে ফুটে খই হয়ে যাবে এমন জ্বর। সে এখন কী করে, কী করে! কপালে জলপট্টি দেয়, মাথায় পানি ঢালে। কিন্তু কলসি-কলসি পানি ঢেলেও জ্বর নামে না। তখন উতলা ছেলে বলে-- মা আমি বদ্যির কাছে যাই।
মা নিষেধ করে-- না বাবা যাসনে। অনেক রাত এখন। ডিঙি বেয়ে এত রাতে যাবি কীভাবে?
আমি ঠিক যেতে পারব।
ছেলে নিষেধ শোনে না। সে যাবেই যাবে। মা তখন বলে-- তাহলে আলো নিয়ে যা।
গরীবের ঘরে একটাই কুপিবাতি। ছেলে বলে-- না মা। আলো তোমার কাছে থাকুক। তুমি আলো জ্বেলে রাখো। চারদিকে অন্ধকার। আমি দূর থেকে আলো দেখে তোমার কাছে ফিরে আসতে পারব।
ছেলে চলে যায়।
আর মা অপেক্ষা করতে থাকে।
পলে পলে সময় কেটে যায়। শিয়াল পহরে পহরে এসে ডেকে চলে যায়। ছেলে তখনও ফেরে না। মায়ের বুক ভয়ে কেঁপে ওঠে। ছেলে চলনবিলের গহীন অন্ধকারে পথ হারায়নি তো! ঘরে আর থাকতে পারে না মা। কেরোসিনের কুপি হাতে এসে দাঁড়ায় ঘাটপারে। উঁচু ঢিবির ওপর দাঁড়িয়ে বাতি দেখাতে থাকে অন্ধকারকে। বাতাসের ঝাপটা এসে নিভিয়ে দিতে চায় বাতির শিখা। কিন্তু মা আঁচলে আড়াল করে পরম যত্নে জ্বালিয়ে রাখে বাতি। এই আলোই যে তার ছেলের ঘরে ফেরার দিশা।
একসময় তেল ফুরিয়ে আসে। বার কয়েক দপদপিয়ে ওঠে শিখা। এক্ষুনি নিভে যাবে। এখন মা কী করে! আলো না দেখালে তার বুকের মানিক যে ঘরে ফিরতে পারবে না!
মা তখন নিজের শরীরে আগুন লাগিয়ে দেয়। জ্বলন্ত শরীর নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে ঢিবির ওপর। যতক্ষণ পারে দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর একসময় পুড়ে ছাই হয়ে পানিতে গিয়ে মেশে।
এখনও রাতের বেলা সেই মায়ের জ্বলন্ত শরীর বিলের পানিতে ছুটাছুটি করে ছেলেকে পথ দেখানোর জন্য। আর সেই আলোকেই আমরা বলি আলেয়া।’

রনি পড়ে শোনাচ্ছিল। শুনছিল অনি। গল্পের মধ্যেই হাই উঠেছে বারকয়েক। কিন্তু শুনেছে পুরোটাই। গল্প শেষ হলে ফিসফিস করে বলে-- তাহলে অন্যরকম মা-ও আছে তাই না রে ভাইয়া?
রনি একটু বড়। নয় বছরের। তার আড়াই বছরের ছোট অনির প্রশ্নে তাকে একটু উদাস দেখায়-- আছে বোধহয়।
অনির দুই চোখ সবসময় টলটলে। কোনো প্রত্যাশা বা প্রশ্ন জাগলে সেই চোখ একেবারে স্বচ্ছ পানির সমুদ্রের মধ্যে একটুকরো কালো ঝিনুকের মতো উজ্জ্বলপ্রভ হয়ে যায়। এখন অনেকটা সেই রকম-- একটা ভালো মা বদলাবদলি করা যায় না?
এবার হেসে ফেলে রনি। হাসার উপলক্ষ তাদের বেশি জোটে না। তাই হাসিটাকে আরও বেশিক্ষণ ধরে রাখে সে। সংক্রমিত হয় অনির মধ্যেও। সে-ও হাসতে থাকে। পরস্পরের হাসি দেখে পরস্পর আরও বেশি অনুপ্রাণিত হয়ে হাসতে থাকে। প্রথমে দুলে দুলে। রনি দুই হাত বাড়িয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে ছোট ভাইকে। অনি গলা জড়িয়ে ধরে বড় ভাইয়ের। তারপর তারা হাসতে হাসতে একযোগে গড়াগড়ি যায় বিছানায়। এই সময় মা ঘরে ঢোকে দরজা ঠেলে। সঙ্গে সঙ্গে ফ্রিজ হয়ে যায় দুই ভাই। কিছুক্ষণ পরে উঠে বসে শান্ত হয়ে। তাকিয়ে থাকে মায়ের দিকে।
মা একবারও তাকায় না ছেলেদের দিকে। কোনো কথাও বলে না। হাতের ব্যাগটা ধপ করে বিছানার ওপর রেখে ঘরের দুই চেয়ারের একটাতে বসে পিঠে হেলান দিয়ে। তার চোখ বোঁজা। মাথা পিছনের দিকে হেলিয়ে একবার শুধু ক্লান্তির শব্দ উচ্চারণ করে-- উফ্!
ফ্যানের নিচে এখন মা বসে থাকবে অন্তত পনের মিনিট। তারপর কাপড়-চোপড় নিয়ে ঢুকবে বাথরুমে। এ বাড়িতে তাদের ঘর দুইটি। একটা ঘরে তাদের মা-সহ তারা দুই ভাই। আরেক ঘরে নানা আর নানি। দুই ঘরের মাঝখানে বাথরুম। মা বাথরুমে ঢুকলে কমপক্ষে একঘণ্টা। অন্য কেউ তখন তাকে ডিস্টার্ব করতে পারবে না। যতই জরুরি প্রয়োজন হোক না কেন চেপে রাখতে হবে। কোনো ডিস্টার্ব হলেই মা চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় তুলবে-- সারাদিন তো তোমাদের জন্যে পড়েই থাকে। তখন বাথরুম সারতে পারো না? আমি বলে জাহান্নাম থেকে ফিরে একটু গা জুড়াব, তারও উপায় নেই তোমাদের জ্বালায়।
মা যতক্ষণ বাড়িতে থাকে, কেউ পারতপক্ষে কোনো বাড়তি কথা বলে না। কারণ সে যে কোন কথাতে কখন দপ করে জ্বলে উঠবে কেউ তা বুঝতে পারে না। আর রেগে ওঠার সুযোগ পেলেই মা কথা ঘুরিয়ে নেবে তার আক্ষেপ প্রকাশের দিকে-- আমার কি কোনো জীবন আছে? মানুষ মরলে জাহান্নামে যায়। আর আমি বেঁচে আছি জাহান্নামের মধ্যেই। মেয়ে মানুষ, ঘর-সংসার করব, না, বোঝা টানতে টানতেই জীবন শেষ। আল্লায় আমার কান্দের উপর সিন্দাবাদের দৈত্য চাপায়া রাখছে। তা-ও একখান হইলে হয়। গণ্ডায় গণ্ডায় দৈত্য আমার ঘাড়ে।
  বেশি রাগলে নিজের আঞ্চলিক বুলি বেড়িয়ে আসে মায়ের। অথচ ছেলেদের মুখে আঞ্চলিক শব্দ শুনলেই ক্ষেপে যায়-- ওসব কী ভাষা বলছ তোমরা অসভ্যের মতো! রাস্তার লোকের মতো কথা বলবে না খবরদার!
আগে মাঝে মাঝে নানা প্রতিবাদ করত। তখন নরক ভেঙ্গে পড়ত দুই কামড়ার এই ছোট্ট বাসায়। অন্য বাসাগুলি থেকে লোক জমে যেত চ্যাঁচামেচি শুনে। এখন আর নানা তাই মায়ের কথার পিঠে কোনো কথা বলে না। তবে মাঝে মাঝে শক্ত হয়ে যায়, হাত মুঠি পাকায়, বড় বড় নিশ্বাস নেয়। নানিকে দেখলে বড় মায়া হয় তাদের। কালো, ছোট-খাট চেহারার স্নেহময়ী বৃদ্ধা সবসময় যেন ভয়ে ভয়ে থাকে। স্বামীকেও ভয় পায়, মেয়েকেও ভয় পায়। আবার ভালোও বাসে। নানি বলার মধ্যে শুধু বিড়বিড় করে বলে-- আহহারে, মাইয়াডার পুড়া কপাল! মিজাজ-মর্জি তো গরম হইবারই পারে। ভালো কথাও তখন ঠেকনার মতন শুনায়। আর সত্যিইতো আমরা হগলডিই হের ঘাড়ে চাইপা রইছি।
তো মা এখন বাথরুমে। কল থেকে অবিরাম বালতিতে পানি পড়ার শব্দ, গায়ে মগ মগ পানি ঢালার ঝপাৎ ঝপাৎ শব্দ, মায়ের নাক-মুখ থেকে মাঝে মাঝে ফুঁপিয়ে ওঠার মতো শব্দ, মেঝেতে কাপড়ের আছড়ানি, অস্পষ্ট বিড়বিড়ানির মতো মায়ের কিছু অসমাপ্ত বাক্য, মাঝে মাঝে অদৃশ্য কাউকে খবিস বলে গালি দেওয়া, এবং ক্বচিৎ-কখনো গানের সুরে গুনগুনানিও।
বাথরুম থেকে বেরিয়ে আসে অনেক কোমল আর অনেকখানি শান্ত চেহারার মা। তবে ঠোঁটে হাসি তেমন একটা দেখা যায় না। কেবল চেহারায় কাঠিণ্যটুকুই কিছুটা অনুপস্থিত। তারপর শুরু হয় ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ ধরে গায়ে-বুকে-গলায় পাউডার ঢালা।
দিনে দুইবার এই পর্ব। প্রথমবার সকালে। নানি হাতে চায়ের কাপ নিয়ে মোলায়েম কণ্ঠে ঘুম ভাঙায় মায়ের। চা খেয়ে ঝটপট বাজারে যায় মা। কাঁচাবাজার করে নিজের হাতে। আবার এই নিয়ে গজগজানিও কম নেই। রনি-অনিকেও মাঝে মাঝে বলে-- তোরা যে কবে বড় হয়ে আমার কাজগুলি একটু কমাতে পারবি! সব যদি একহাতে এই আমাকেই করতে হয়, তাহলে আমি বাঁচি কীভাবে বল!
বলে বটে, কিন্তু বাজার করার দায়িত্ব কিছুতেই হস্তান্তরে রাজি নয় মা। নানা বেশি চলতে-ফিরতে পারে না। কিন্তু কাঁচাবাজারটিতে যেহেতু শুধু একটা গলি পেরুলেই পৌঁছে যাওয়া যায়, এই কাজটি করতে তার আপত্তি নেই। মা কেন যে তাকে দেয় না! নানা বলে, তাহলে খোঁটা দেওয়ার একটা আইটেম কমে যাবে যে!
বাজার থেকে এসে একঘণ্টার বাথরুমপর্ব। তারপর আধাঘণ্টার সাজগোজ। তারপর নাস্তা। রনি-অনি তখন বারান্দায় টেবিলে বসে পড়া মুখস্ত করে। পাউডার-সেন্টের গন্ধ ছড়িয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় মা মুখস্ত কথাগুলি বলে-- উহ্ রোজ দেরি হয়ে যায়! এত ঝামেলা সেরে বের হতে হয়। এই তোমরা দুষ্টুমি করবে না। স্কুলে যাবে সময়মতো। দেরি যেন না হয়। মা আমি যাচ্ছি!
নানি রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে বিড়বিড় করে দোয়া পড়ে। শুধু দুটো শব্দই জোরে শোনা যায়-- ফী আমানিল্লাহ!
মা বেরিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যেন বাড়িটিতে প্রাণ ফিরে আসে। অনি চেঁচিয়ে বলে-- নানি আইজ কিন্তু পরোটা খামু। সাদা রুটি খাইতে ভালো লাগে না।
নানা হাসিমুখে ওদের পাশে এসে দাঁড়ায়-- দাও, অগোরে পরোটা বানায়া দাও।
সেই অনুচ্চকণ্ঠ নানির। স্বগতোক্তির মতো বলে-- ডালডা ঘিয়ের নাকি দাম খুব বাড়ছে।
নানা নাক কুঁচকায়-- হুহ্! দুইডা পরোটা বানাইতে আর কয়মণ ডালডা লাগে! এই মাসের পেনসন তুইলা আমি ডালডা কিইনা আনুমনে।
নানার পেনসন তোলার দিনটা বড় খুশি খুশি থাকে তারা চারজনই। আলুভর্তা আর গরম ভাতের ওপর ছিটানো হয় দুই চামচ ঘি। নানার পরনে ধোয়া-কাচা পাজামা-পাঞ্জাবি। ঈদের দিনে পরার মখমল টুপিটা সে দিন মাথায়। হাতে লাঠি নিয়ে পান চিবোতে চিবোতে নানা বের হয় ঘর থেকে। দরজা পর্যন্ত সঙ্গে যায় নানি। দোয়া পড়ে নানার বুকে ফুঁ দিয়ে কদমবুসি করে। তারপর সেই  আনুচ্চ কণ্ঠেই বলে-- তাড়াতাড়ি ফির‌্যা আইসেন।

রনি-অনি স্কুল থেকে ফিরে ভাত খায়। তারপর সোজা দৌড়ায় পাড়ার মাঠে। মায়ের পারমিশন আছে সন্ধ্যার আজান পর্যন্ত খেলতে পারবে। তাদের বাড়ি ফেরার বেশ অনেক পরে ফেরে মা। তারপর যথারীতি বাথরুম। তারপর রাতের পরিচ্ছন্নতা। টিভি খুলে সামনে বসে থাকা। নানি আক্ষেপে মাঝেমাঝে বিড়বিড় করে-- বুকের দুধ ছাড়ানোর পর পোলা দুইডার মুখে কোনোদিন এক লোকমা ভাতও উঠায়া দেয় নাই অগো মা।
শুধু টিভি চলে। মা ওদেরকে বড়জোর জিজ্ঞেস করে ওদের পড়াশোনা কেমন চলছে। অন্য কোনো গল্প নয়, কোনো রূপকথা নয়, কোনোদিন বেড়াতে যাওয়ার কোনো পরিকল্পনা নয়। মা টিভি দেখে আর মাঝেমাঝে মোবাইল ফোনে নিচুস্বরে কথা বলে। কথা বলতে বলতে আড়চোখে ছেলেদের দিকে তাকায়, কখনো উঠে গিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে কথা বলে।
শোবার বিছানা একটাই। যথাসম্ভব দেয়াল ঘেঁষে শোয় রনি। মাঝে অনি। মেঝের দিকে মা। অনি ঘুমানোর সময় চেষ্টা করে রনির গায়ের সাথে লেপ্টে থাকতে। কিন্তু প্রায় সকালেই মা অনিকে ধমকায়-- এত খারাপ তোর শোওয়া! ঘুমের ঘোরে খালি হাত-পা ছুঁড়িস। আর ঠেলতে ঠেলতে আমাকে মেঝেতে ফেলেই দিস প্রায়।
ছোট্ট অনি লজ্জায় এতটুকু হয়ে যায়।

০২.
আমাগো বাবায় কই আছে?
রনি কি জানে যে উত্তর বলবে?
তুই তো দেখছস বাবারে?
হ দেখছি।
বলে বটে, কিন্তু তার দেখাটা তো এক ধূসর স্মৃতি। তার বয়স তিন পেরুনোর আগপর্যন্ত দেখেছে বাবাকে। অনি তো দেখেইনি কখনো। সে পেটে থাকতেই বাবা কাউকে কোনোকিছু না জানিয়ে উধাও হয়ে গেছে। আর মা নাকি সেই রাগে তার বাবার যেখানে যত ছবি ছিল সব নষ্ট করে ফেলেছে, পুড়িয়ে ফেলেছে। মাকে তো বাবার কথা জিজ্ঞেস করাই যায় না। নানিকে জিজ্ঞেস করলে উত্তর না দিয়ে ঝরঝর করে কাঁদে।
অনি জিজ্ঞেস করে-- তুই তো বাবারে দেখছস। আবার দেখলে চিনবার পারবি?
আমতা আমতা করে বড়ভাই-- বোধহয় পারুম।
তাইলে চল। ইস্কুলের পরে খেলতে না গিয়া চল আমরা বাবারে খুঁইজা বেড়াই!
প্রস্তাবটা খুবই ভালো। কিন্তু রনির বুদ্ধি একটু হলেও বেশি। বয়সের তুলনায় একটু বেশিই বেশি। সে বলে-- কিন্তু বাবারে খুঁজতে আমরা কই যামু? তারে খুঁজতে গিয়া আমরা দুইজনে যদি হারাইয়া যাই!
হারিয়ে যাওয়া মানে, নানি বলেছে, ছেলেধরাদের হাতে পড়া। তারা চোখ তুলে নেয়, পেট কেটে একটা কিডনি বের করে নেয়, হাত-পা ভেঙ্গে দেয়, তারপর রাস্তার ধারে বসিয়ে ভিক্ষা করায়।
দরকার নাই। বাবায় নিজেই একদিন ফির‌্যা আইব।
তখনকার মতো বাবার আলোচনা চাপা পড়ে। কিন্তু রনির মন থেকে বাবার কথা মুছতে চায় না। খুব আবছা একটা মুখ তার মনে পড়ে। ছোট্ট রনিকে বুকে তুলে নিচ্ছে, দুহাতে উঁচু করে দোলাচ্ছে, তাকে পিঠে বসিয়ে নিজে ঘোড়া সেজে মেঝেতে হামাগুড়ি দিচ্ছে। কিন্তু তাদের ছেড়ে এভাবে চলে গেল কেন বাবা! আর কোনোদিন কী বাবার সাথে দেখা হবে!
বাবার প্রতি মায়ের এত ঘৃণা কেন? বাবার কোনো চিহ্ন পর্যন্ত বাড়িতে রাখেনি। বাবার আত্মীয়-স্বজনের সাথে কোনো সম্পর্ক রাখেনি। মুখ দেখাদেখি পর্যন্ত বন্ধ।
সন্ধ্যায় মাঠ থেকে বাড়িতে ফিরে ওরা দেখল নানার মুখ থমথমে। কয়েকদিন ধরেই দেখছে। মা বোধহয় বেশি খারাপ কোনো কথা বলেছে। ওরা পড়তে বসে যায়। পড়া দেখিয়ে দেয় নানা। তবে অন্য দিনের মতো স্বাভাবিক হতে পারছে না যেন বুড়ো মানুষটা। পড়াতে পড়াতে বারবার কান খাড়া করছে। মায়ের আসার সময় হয়েছে, অথচ এখনও এসে পৌঁছায়নি। হয়তো সেজন্যেই নানা চিন্তিত। ওদের পড়া শেষ হয়। রাতের খাওয়া হয়ে যায়। শুয়ে পড়ে দুজন। মা এখনও আসেনি। নানি এসে মশারি খাটিয়ে দেয়। দুই ভাই এটা-ওটা বলতে বলতে ঘুমিয়েও পড়ে। 

ঘুমের মধ্যে বাবা আসে। তীব্র আবেগে জড়িয়ে ধরে রনিকে। বাবা, বাবা আমি তোমাকে ভালোভাবে দেখতে পাচ্ছি না কেন? আলোটা জ্বালাও বাবা। আমি তোমাকে দেখব বাবা। তুমি আর কোথাও চলে যেয়ো না বাবা! আমাদের ছেড়ে চলে যেয়ো না বাবা! তুমি না থাকলে আমার বুকের মধ্যে কেমন যেন করে বাবা! মনে হয় আমি মরে যাচ্ছি! বাবা...
রনির আবেগ-উচ্ছ্বাসের মধ্যেই মা চলে আসে। তার মুখ তীব্র ক্রোধে জ্বলছে গনগনে কয়লার মতো। চিৎকার করে বাবাকে বলে তার ছেলেকে স্পর্শ না করতে, বেরিয়ে যেতে, আর কোনোদিন এখানে না আসতে। বাবাও উঁচুগলায় চ্যাঁচাতে থাকে। মাকে গালি দেয়। মা-ও পাল্টা গালি দেয়। বেধে যায় তুমুল ঝগড়া। আর সেই ঝগড়ায় ঘুম ভেঙে যায় রনির। বারান্দা থেকে ভেসে আসছে নানা আর মায়ের কথা কাটাকাটির আওয়াজ।
তুই পাইছস কী? তুই রোজ রোজ রাইত কইরা ঘরে ফিরিস। তুই ভাবিস কেউ তোরে কিছু কইবার পারব না!
কই? আমি কি রোজ রোজ রাইত কইরা ঘরে ফিরি?
এই তো গত পরশুই তুই দেরি কইরা ফিরলি। আবার আইজ ফিরছস দুপুর রাইতে।
কইলাম তো হেইদিন আমার বান্ধবীর বাড়িত দাওয়াত আছিল।
কিয়ের দাওয়াত? কিয়ের বান্ধবী? জন্মে তোর কোনো বান্ধবী কোনোদিন দ্যাখলাম না। অহন বান্ধবী দেখাইছ!
আইচ্ছা আইচ্ছা, আমার বান্ধবী নাই তো নাই। তাতে তোমাগো অসুবিধা কিয়ের!
অসুবিধা নাই? কোনো ভদ্রঘরের মাইয়া এত রাইত কইরা ঘরে ফিরে?
কইলাম না কাম আছিল!
কাম তো থাকে দিনের বেলাত। রাইতে কিয়ের কাম? অহন কি নাইট অফিস খুলছে!
আজেবাজে কথা কইবা না কইতাছি!
কী, আমারে চোখ রাঙাইছ! তুই হারামজাদি আজেবাজে কাম করিস আর আমরা কইবার পারুম না!
মুখ খারাপ করবা না! গালি দিবা না খবরদার!
খালি গাইল দেওয়া তো যথেষ্ট না। উচিত তোরে থাপড়াইয়া গাল লাল কইরা দেওয়া।
নানির নিচুগলা শোনা যায়-- অত চিল্লাপাল্লা করনের কাম নাই। আপনে যান তো, শুইয়া পড়েন। চিল্লাপাল্লা করলে আপনার বেলাড প্রেসার বাইরা যাইব।
ব্লাড প্রেসার বাড়তে আর বাকি রইছে যানি! তোমার মাইয়ার কাণ্ড-কারখানা, আচার-ব্যাভার দেখলে ব্লাড প্রেসার এ্যামনে এ্যামনেই বাইড়া যায়।
আবার মায়ের কণ্ঠ শোনা যায়-- কেডায় কইছে চাইয়া চাইয়া দেখতে! চক্ষু বন্দো কইরা রাখবার পারো না?
মা এসে ঘরে ঢোকে। হাতের ব্যাগ ছুঁড়ে ফেলে মেঝেতে। দড়াম করে দরজা লাগায়। তারপর চেয়ারে ধপ করে বসে ফোঁপাতে থাকে।
নিঃসাড় পড়ে থাকে রনি। মা বেশ কিছুক্ষণ কাঁদে। তারপর শুধু শাড়িটা পাল্টে এসে মশারির মধ্যে ঢোকে। বুঝতে পারেনি যে রনি জেগে আছে। রনি বুঝতেও দেয় না। হঠাৎ সে ভেতরে ভেতরে থরথরিয়ে কেঁপে ওঠে। মা ঘুমন্ত অনিকে চেপে ধরেছে বুকের মধ্যে। আরেক হাত পরম মমতায় বিলি কাটছে রনির চুলে। ফিসফিস করে মা বলছে-- বাবারে তোরা আমার কইলজার টুকরা। আমি যে অহন কী করি! কোনদিকে যাই! খোদারে!
মায়ের গালি-গালাজ আর মন্দ ব্যবহার এই বয়সেই অনেক সয়েছে ওরা। কিন্তু অপ্রত্যাশিত এই আদরের স্পর্শ সহ্য করা কঠিন হয়ে পড়ে রনির জন্য। কান্না ঠেলে উঠে আসতে চায় বুক থেকে। অনেক কষ্টে আটকাতে পারে। এই রকম সময়ে কেঁদে ওঠা, বা সে জেগে আছে তা মাকে বুঝতে দেওয়া কোনোমতেই উচিত হবে না, এটুকু অন্তত সে বুঝেছে।

০৩.
নানি বিড়বিড়িয়ে হিসাব করে-- বিয়ার কালে অর বয়স আছিল ঊনিশ। বিয়ার বছর ঘুরার লগে লগেই জন্মাইছে বড় পোলা। হ্যার বয়স অহন দশ। তাইলে দশ আর এক এগার। আর এগার আর ঊনিশে হইল...কড় গুনে গুনে হিসাবে পৌঁছায় নানি-- এগার আর ঊনিশে হইল তিরিশ।
তারপরেও নিজে নিজে কথা বলে চলে-- আমগো সময় কইত মাইয়া মানুষ কুড়িতেই বুড়ি। অহন আর সেই যুগ নাই। মাইয়ার আমার বিয়ার বয়স অহনও রইছে। কিন্তু হ্যায় তো রাজি হয় না। হ্যার চিন্তা আমাগো কী হইব! দুই পোলার কী হইব! আরে আল্লায় জীব তৈয়ার করছে আল্লায় রক্ষা করব, আল্লায় ব্যবস্তা করব। জুয়ান মাইয়া, বিয়া না বইলে কখন যে কী ঘইটা যায়! জুয়ানকিরে বিশ্বাস কী? জুয়ানকির ঘাট কী?

০৪.
পরের কয়েকদিনে আবার আগের ছন্দ ফিরে আসে পরিবারে। মা এখন কথায় কথায় আর আগের মতো বিরক্তি প্রকাশ করে না। যেন নিজেকে সামলে রাখে প্রাণপণে।
কিন্তু হঠাৎ নতুন আব্দার তোলে নানা। তাকে একবার দেশে যেতে হবে। সেখানে তার বাপের কবর। কয়েকদিন ধরে নাকি স্বপ্নে নিজের পিতাকে দেখছে নানা। ধারণা হয়েছে তার নিজেরও মৃত্যুর সময় হয়ে এসেছে। মৃত্যুর আগে শেষবার নিজের পিতার কবর জিয়ারত করার ইচ্ছা তার।
তো নানা যদি শেষ পর্যন্ত গাঁয়ে যায়-ই, তাহলে বুড়ো মানষটাকে একা একা ছাড়ে কীভাবে নানি!
তাহলে দুই বাচ্চা? আর তাদের মা?
ব্যবস্থা নানিই করে। নিচের তলার কাজের বুয়া সাতদিন এসে রাঁধা-বাড়া, ঘরগোছানোর কাজ করবে। সন্ধ্যায় মা ঘরে না ফেরা পর্যন্ত ছেলে দুটো থাকবে নিচতলায় বাড়িঅলাদের কাছেই। তারা রাজি আছে। তবে মায়ের উচিত হবে সাঁঝের আগেই বাড়িতে ফিরে আসা। মোটে তো সাত-আটটা দিনের ব্যাপার।

নানা-নানি গাঁয়ে যাওয়ার দ্বিতীয় দিনেই বাড়ি ফিরে ছেলেরা অবাক। এই দুপুরেই মা চলে এসেছে অফিস থেকে! সঙ্গে আবার একজন লোক। এই প্রথম তাদের বাড়িতে কোনো মেহমানকে দেখতে পেল ছেলেরা। দরজা খোলা। মা খাবার টেবিলে বসে হেসে হেসে গল্প করছে লোকটার সঙ্গে।
তাদের দেখে উঠে দাঁড়ায় মোটা গোঁফঅলা দোহারা গড়নের মানুষটা। হাসিমুখে বলে-- তোমরা নিশ্চয়ই রনি আর অনি।
কেতাদুরস্ত ভঙ্গিতে হাত বাড়িয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে সে হ্যান্ডশেক করে ছেলেদুটোর সাথে। মায়ের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায় দুজনেই। মাকে এত হাসি-খুশি দেখেনি ওরা আগে কখনোই। শুধু হাসি-খুশি নয়, মাকে এখন কোমল প্রশান্ত এবং সুখিও দেখাচ্ছে। মা কিছু বলতে চাইলে বাধা দেয় গোঁফঅলা লোকটা-- আমাদের আনুষ্ঠানিকভাবে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে না মাদামোয়াজেল। আমরা নিজেরাই পরিচিত হয়ে যাব পরস্পরের সঙ্গে। তুমি বরং ছেলেদের খাবারের বন্দোবস্ত করো। ওরা স্কুল থেকে ফিরল। নিশ্চয়ই খুব ক্ষুধার্ত।
মা তার কথা একবাক্যে মেনে নিয়ে হাসিমুখে চলে গেল রান্নাঘরের দিকে।
হ্যালো! আমার নাম হচ্ছে মিস্টার খ।
হকচকিয়ে যায় দুইভাই-- এ আবার কোন ধরনের নাম!
হাসে লোকটা-- আমার নাম শুনলে সবাই প্রথমে অবাক হয়। ভাবে এটি বোধহয় আমার ছদ্মনাম। কিন্তু আমি তোমাদের নিশ্চয়তা দিয়ে বলছি এটাই আমার প্রকৃত ডাকনাম। আমরা ছিলাম অনেকগুলি ভাই-বোন। এতগুলি ছেলে-মেয়ের নাম মনে রাখতে মা-বাবাই হিমসিম খেয়ে যেত। একজনকে ডাকতে গিয়ে ভুল করে ডেকে ফেলত আরেক জনের নাম ধরে। সে সব মহা কেলেঙ্কারির ব্যাপার বুঝলে। শেষে বাবার বুদ্ধিতে এইভাবে নাম রাখা হয়। ক খ গ ঘ ঙ চ ছ...
খিকখিক করে হেসে ওঠে অনি। রনিও। এমনকী রান্নাঘর থেকে মায়ের হাসির শব্দও শোনা যায়। ব্যাস! লোকটাকে ভালো লেগে গেল রনি-অনির।
রনি প্রশ্ন করে-- আপনি কি ফ্রান্সে ছিলেন?
কেন? এই প্রশ্ন কেন?
আপনি যে মাদামোয়াজেল বললেন মাকে। ফ্রান্সের মানুষ নাকি এটা বলে!
স্মার্ট বয়! না। আমি ফ্রান্সে ছিলাম না। তবে আফ্রিকাতে ছিলাম। সেখানে শিক্ষিত লোকেরা ফরাসি ভাষায় কথা বলে।
আফ্রিকা! চোখ গোল্লা গোল্লা হয়ে যায় অনির। আফ্রিকা! তার মানে চিতাবাঘ, হাতি, সিংহ, জিরাফ, শিম্পাঞ্জি!
হ্যাঁ। ওসব আমি অনেক দেখেছি।
শিকার করেননি?
হ্যাঁ, তা-ও করেছি বটে।
আপনি যেখানে থাকতেন, মানে আপনার বাড়িতে এসে ঢুকে পড়ত না সিংহ জিরাফ?
না, তা অবশ্য ঢুকত না। তবে বানর ছিল আমার একটা। কালো বানর। খুব বুদ্ধিমান। আমার অনেক কাজ করে দিত সেই বানর।
কী রকম?
এই ধরো, বললাম তোয়ালে এনে দাও, এনে দিল। বললাম গাছ থেকে ফল পেড়ে আনো, পেড়ে আনল। এমনকী বললে আমার পিঠের ঘামাচি পর্যন্ত মেরে দিত। আফ্রিকাতে থাকলে পিঠে ঘামাচি হয় খুব। খুব গরম তো!
বাহ্ !
সেই জন্যেই তো খুব মায়া পড়ে গেল। আমি আসার সময় তার সে কী কান্না!
তখন কী করলেন?
কী আর করব, সঙ্গে নিয়ে এলাম। একেবারে প্লেনের টিকেট কেটে পাশে বসিয়ে নিয়ে এলাম।
কোথায় আছে এখন বানরটা?
এই শহরেই আছে। আমার বাড়িতেই থাকে।
অবধারিতভাবে অনির পক্ষে তখন আর নিজেকে সামলানো সম্ভব হয় না-- আমি আপনার কালো বানরটাকে দেখব!
অবশ্যই দেখবে। আমি একদিন ওটাকে সঙ্গে করে নিয়ে এসে তোমাদের দেখাব। তোমাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতিয়ে দেব।
মা ততক্ষণে টেবিলে খাবার সাজিয়ে ফেলেছে।
খেতে বসে রনি-অনি এ-ওর মুখের দিকে তাকায়। এত রকমের খাবারের আয়োজন! অনির মনে হয়, আজ বোধহয় ঈদের দিন। একবার মুখ ফস্কে বেরিয়েও আসতে চায় প্রশ্নটা। কিন্তু কালো বানর ফের দখল করে নেয় তার মনের সক্রিয় অংশটিকে। একের পর এক প্রশ্ন করে চলে মিস্টার খ-কে। সবই কালো বানর নিয়ে। মিস্টার খ হাসিমুখেই উত্তর দিয়ে চলে। আবার কৌশলে একসময় গল্পের প্রসঙ্গ অন্যদিকেও ঘুরিয়ে নেয়। মজার মজার বিভিন্ন বইয়ের নাম বলে মিস্টার খ। একটাও পড়া হয়নি ওদের। রনি বলে-- ওসব বই কোথায় পাব, জানি না তো! একটাই বই দিয়েছিল নানা। তা-ও ছেঁড়া আর পুরনো।
অনি চোখ বড় বড় করে বলে-- জানেন গল্পগুলো খুব সুন্দর। আর সব গল্প মা নিয়ে।
মা একটু থমকায়-- তাই নাকি! রাতে দিস তো তোদের বইটা। পড়ে দেখব।
খাওয়ার পরে আয়েশ করে সিগারেট ধরায় মিস্টার খ। রনি আড়চোখে মায়ের দিকে তাকায়। নানা কোনোদিন খাবার টেবিলে সিগারেট খেলে মা খুব রেগে যায়। কিন্তু না। মিস্টার খ-এর সিগারেট টানা নিয়ে মায়ের চোখে কোনো বিরক্তির চিহ্ন নেই।
মা বলে-- রনি-অনি তোমরা এখন খেলতে যেতে পারো। কিন্তু সন্ধ্যা লাগার সঙ্গে সঙ্গেই কিন্তু ফিরে আসতে হবে।
অনি তেমন গা করে না। খেলতে যাওয়ার ইচ্ছা তেমন নেই। কালো বানরের গল্প শুনতেই তার এখন বেশি ভালো লাগছে।
মিস্টার খ আর মায়ের মধ্যে আবছা দৃষ্টি বিনিময় হয়। মিস্টার খ বলে-- আরে কালো বানরের গল্প কী আর শেষ হয়! তাছাড়া গল্পের তো দরকারই পড়বে না। কারণ এরপরে তোমরা নিজের চোখেই দেখতে পাবে ওটাকে। আমি দু-চারদিনের মধ্যেই নিয়ে আসব কালো ভূতটাকে। তার জন্য তোমাদের খেলা নষ্ট করা মোটেই উচিত নয়। জানো তো, পড়ার সময় পড়া আর খেলার সময় খেলা।
ওরা খেলতে চলে যায়।

সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে দেখে মিস্টার খ চলে গেছে। মা এটা-সেটা গোছগাছ করছে আর গান গাইছে গুনগুন করে।
রাতের খাওয়াটাও হলো দারুণ।
শুতে গিয়ে মা অনেকক্ষণ গল্প করল ওদের সাথে। কথায় কথায় জিজ্ঞেস করল-- এই যে মিস্টার খ আজ এখানে এসেছিল, তাকে তোদের কেমন লাগল?
খুব ভালো।
মানে-- মা একটু থেমে থেমে শব্দ উচ্চারণ করে-- মানে উনি যে এখানে এসেছিলেন, সে কথাটা তোদের নানা-নানিকে না জানানোই ভালো হবে বুঝলি! উনারা কী জানি কেন, ঠিক পছন্দ করে না মিস্টার খ-কে।
কিন্তু আমাদের কালো বানর দেখা?
তা নিশ্চয়ই তোরা দেখতে পাবি।  মা জোর দিয়ে বলে-- মিস্টার খ কথা দিলে অবশ্যই কথা রাখবে!

০৫.
আটদিনের মাথায় ফিরে এসেছে নানা-নানি।
মাঝের কয়েকদিনের পরিবর্তনের পরে আবার আগের নিয়মে ফিরে গেছে পরিবার। কিন্তু অনি মাঝেমাঝে কালো বানরের কথা তোলে রনির কাছে। তবে মাকে যে কথা দিয়েছিল, সেটা পালন করেছে তারা। নানা-নানির সামনে কখনো উচ্চারণ করেনি মিস্টার খ-এর কথা। অনি থাকতে না পেরে মাকে বার দুয়েক জিজ্ঞেস করেছে ইতোমধ্যে মিস্টার খ-এর সঙ্গে তার দেখা হয়েছে কি না। যদি দেখা হয়, মা যেন অবশ্যই তাকে কালো বানরটি দেখানোর কথা মনে করিয়ে দেয়।
মা কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলেছে যে মিস্টার খ-এর সাথে তার দেখা হয়নি। খোঁজ যে নেবে তারও উপায় নেই। কারণ আফিসে কাজের খুব চাপ। তবে দেখা হলে অবশ্যই সে কালো বানর দেখানোর প্রতিশ্রুতির কথা মনে করিয়ে দেবে। তারপরই ওদের ঠিক সময়ে স্কুলে যাওয়ার কথা মনে করিয়ে দিয়ে তড়বড় করে বেরিয়ে যায় মা।

নতুন এক মাস্টার এসেছে ওদের স্কুলে।  অন্য শিক্ষকরা বলে লোকটা একটু নাকি পাগলাটে। সে ছাত্রদের নিয়ে বানিয়েছে অ্যাডভেঞ্চার ক্লাব। ক্লাসের পড়ার ফাঁকে ফাঁকে, টিফিন পিরিয়ডে, ছুটির পরে নানান ধরনের কা--কারখানা করছে অ্যাডভেঞ্চার ক্লাব। সেদিন হঠাৎ একটা ক্লাস হয়ে ছুটি হয়ে গেল স্কুল। পরিচালনা কমিটির কেউ একজন মারা গেছেন। ক্লাবের স্যার বললেন-- এই শহরে একটা নদীবন্দর আছে। তোমরা কেউ দেখেছ?
কেউ-ই দেখেনি।
তাহলে চলো। অ্যাডভেঞ্চার ক্লাবের সদস্যরা আজ আমরা নদীবন্দর দেখতে যাব।
স্কুল থেকে দলটা বেরুল রীতিমতো মার্চপাস্ট করে।

ফেরার পথে হঠাৎ বড়ভাইয়ের জামার হাতা টেনে ধরল অনি-- ভাই, ওখানে মা!
তারা যে ফুটপাথ দিয়ে হাঁটছে, রাস্তার ঠিক উল্টোদিকে একটা ছিমছাম গার্ডেন রেস্তোরা। সিমেন্টের ছাতার নিচে চেয়ার-টেবিলে বসে খেতে খেতে গল্প-গুজব করছে খদ্দেররা। মাকে দেখা যাচ্ছে একটা টেবিলে। তাদের দিকে বামপাশ ফেরানো। খুব হাসছে। কথা বলছে। চায়র কাপে চুমুক দিচ্ছে। সঙ্গে? আরে ওটা মিস্টার খ! অনি প্রায় রাস্তা পেরিয়ে দৌড় দিতে যায়। কিন্তু রনি এবার তাকে থামায় জামা টেনে ধরে-- না ভাই, না!
অনি উত্তেজিত স্বরে বলে-- মিস্টার খ-কে দেখতে পাচ্ছ না? চলো, কালো বানরের কথা জিজ্ঞেস করি!
রনির মনের মধ্যে অস্বস্তি। ওদের দেখতে না পেলেই যেন ভালো হতো। কেউ যেন তাকে নিষেধ করছে মনের মধ্যে বসে থেকে। কিন্তু অনি টানাটানি শুরু করেছে হাত ছাড়িয়ে নেবার জন্য। পারলে ছুট লাগায়। রনি কীভাবে ফেরাবে  ওকে! বাঁচা গেল স্যারের হাঁক শুনে-- খবরদার, কেউ লাইন ছেড়ে নড়বে না! চলো সবাই পা চালিয়ে। এই তো আর একটু সামনে গিয়েই আমরা বাসে উঠব।

রাতে অনি কথাটা বলতেই মায়ের মুখ মুহূর্তের মধ্যে কয়েকবার রং পাল্টায়। এবং শেষে পুরোপুরি ফ্যাকাশে হয়ে যায়। কিন্তু অনির কথাকে অস্বীকার করে অস্বাভাবিক জোর দিয়ে-- কী উল্টাপাল্টা কথা বলিস! সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত আমি বলে অফিসের টেবিলে না-মুখ ডুবিয়ে বসে থেকেও কাজ শেষ করতে পারি না, আর আমি যাব বেড়াতে! আর নদী-টার্মিনাল যেখানে, আমার অফিস সেখান থেকে অনেক দূরে। আমি কীভাবে ঐ জায়গায় যাব? পাগলের মতো কথা বলছিস তুই।
অনি জোর দিয়ে বলতে যাচ্ছিল যে সে অবশ্যই মাকে ঐ রেস্টুরেন্টে বসে চা খেতে দেখেছে, এবং তার সঙ্গে মিস্টার খ-ও ছিল। কিন্তু রনি তাকে থামিয়ে দেয়। ক্লান্তস্বরে বলে-- না না মা, অনি ভুল দেখেছে। ওটা অন্য কেউ ছিল। আমি ঠিকই বুঝতে পেরেছিলাম ওটা তুমি নও, অন্য কেউ। সেইজন্যেই তো অনিকে যেতে দিইনি।

০৬.
আর কোনোদিন মিস্টার খ-এর সাথে দেখা হয়নি তাদের। অ্যাডভেঞ্চার ক্লাবের সঙ্গে এখন প্রায়ই বিভিন্ন দিকে বেরিয়ে পড়ে ওরা। খুব তাড়াতাড়ি বড় হয়ে উঠছে দুজন। আর ওদিকে ওদের সাথে পাল্লা দিয়ে বুড়িয়ে যাচ্ছে নানা-নানি। কিন্তু সবচেয়ে দ্রুত বুড়িয়ে যাচ্ছে মা। প্রতিদিন যেন আরও বেশি অচেনা হয়ে যাচ্ছে ওদের মা। এখন তার কথায় কথায় রেগে ওঠা নেই, ছেলেদের আদর করা তো নেই-ই, বাথরুমে ঘণ্টাধরে সময় কাটানো নেই, অফিসে যাওয়ার জন্য হুড়মুড় করে ছুটে চলা নেই। তবে রনি হঠাৎ হঠাৎ ঘুম ভেঙে দেখেছে মা বিছানায় নেই। জানালার ধারে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে বাইরে। কখনো কাঁদছে নিঃশব্দে কিন্তু অঝোর ধারায়। রনির ভেতরে ধীরে ধীরে বড় হতে থাকা কেউ একজন ইশারায় জানিয়ে দেয় যে সবাইকে সব কথা জানতে দিতে নেই। সে যে মাকে রাতে একা একা কাঁদতে দেখেছে, একথাও অন্যকে জানানো উচিত নয়। এমনকী সে যে মাকে কাঁদতে দেখেছে, সেকথা মাকেও বুঝতে দেওয়া উচিত হবে না।

হঠাৎ একদিন দুই ভাইকে স্কুল থেকে বাড়িতে ডেকে আনল বাড়িঅলার ভাগ্নে মমতাজভাই। স্যারকে সে ফিসফিস করে কিছু একটা বলতেই ক্লাসটিচার ওদের ডেকে বলল-- তোরা তাড়াতাড়ি বাড়ি যা বাবারা! বড় খারাপ খবর। আল্লা তোদের হেফাজত করুন!
পাড়ার লোক ভেঙে পড়েছে তাদের বাড়িতে। এত মানুষের ভিড়, কিন্তু আশ্চর্য নীরব তাদের বাড়ি। কথা প্রায় বলছেই না কেউ। বললেও বলছে খুব নিচুস্বরে, গলা একেবারে খাদে নামিয়ে। নানা-নানি বসে আছে পাথরের মতো নিশ্চুপতা নিয়ে। সবচেয়ে নীরব এবং নিথর তাদের মা।
তাদের মা নাকি আত্মহত্যা করেছে।
০৭.
‘ ছেলে হাতজোড় করে বলে-- আমার মাকে বাঁচাও শুকপাখি! মা ছাড়া আমাদের আর কেউ নেই।
শুকপাখি মাথা নেড়ে বলে-- আমি জানি। জানি বলেই তোমার কাছে এসেছি। তোমার মাকে ফের বাঁচিয়ে তোলার একটাই উপায় আছে।
কী উপায় বলো শুকপাখি!
হৃদকমল ফুল এনে তার রস ছেঁচে দিতে হবে তোমার মায়ের মুখে।
কোথায় আছে সেই ফুল?
অনেক দূরে।
হোক দূর। যত দূরই হোক, আমি যাব হৃদকমল ফুল আনতে। তুমি শুধু বলে দাও কোথায় গেলে পাওয়া যাবে সেই ফুল।
এখান থেকে নৌকা নিয়ে চলতে চলতে তুমি পৌঁছুবে উল্টাস্রোতের গাঙে। সেই গাঙের পানি সবসময় বাতাসের উল্টাদিকে বয়। সেই গাঙ পেরুলে পাবে ঘূর্ণিবিল। সেই বিলের পানি সবসময় ঘুরপাক খায়। সেই ঘূর্ণিতে যা পড়ে তা-ই নিমেষে তলিয়ে যায়। সেই ঘূর্ণিবিলের পরে তুমি পড়বে কালিদহে। এতই গহীন সেই দহ যে একশো লগি জোড়া দিলেও তুমি থৈ পাবে না, তল পাবে না। কালিদহ পার হতে পারলে ক্ষীরোদবিল। সেই বিলের পানি ক্ষীরের মতো ঘন। সেখানে বৈঠা চলতে চায় না। নৌকা একচুলও নড়তে চায় না কোনোদিকে। সেই বিলের মাঝখানে ফুটে আছে হৃদকমল ফুল। এক্ষুণি রওনা দিয়ে তুমি যদি সূর্য ডোবার আগেই সেই ফুল নিয়ে ফিরে আসতে পারো, মায়ের মুখে ঢেলে দিতে পারো সেই ফুলের রস, বেঁচে উঠবে তোমার মা।’

বই বন্ধ করে জানালা দিয়ে বাইরে তাকায় ছেলে। এখন বেশ রাত। অন্ধকার নেমেছে ঘন হয়ে। সে জানালার কাছে যায়। চার বছর আগে, মায়ের আত্মহত্যার রাতে, নানি বলেছিল যে তাদের মা আজ থেকে হয়ে গেল আকাশের তারা। কোন তারাটা যে তাদের মা! ছেলে ফিসফিস করে বলে-- হৃদকমল ফুলের আরেক নাম যে ভালোবাসা, তা আমার জানা ছিল না মা। আমি একদিন সেই হৃদকমল ফুল নিয়ে ঠিক পৌঁছে যাব তোমার কাছে। 

মোজাফ্‌ফর হোসেনের গল্প : বাবার বিয়ে






মোজাফ্‌ফর হোসেন
বাবার বিয়ে

আগামীকাল কিংবা পরশু বিয়ে করবেন বাবা। বাড়িতে চূড়ান্ত ঘোষণা দিয়ে দিয়েছেন। ছোটবোন ফোন করে রাতে জানাল। মায়ের মৃত্যুর ছ’মাসও হলো না। শশুরবাড়ির লোকজনকে মুখ দেখাব কেমন করে, বলে ছোটবোন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল। আমি কিছু বলিনি। ওর কথা শেষ হলে মোবাইলের কলটা ও নিজেই কেটে দিল। মা জানতেন তার মৃত্যুর পর বাবা ফের বিয়ে করবেন। আমাকে বলেওছিলেন, ছোট সন্তান হিসেবে আমি যেন বাঁধা না দিই। মায়ের আদেশ ঠিকঠাক মেনে চলার মতো আদর্শ সন্তান আমি না। মৃত যে তার কাছে দায় তো আরও কম। তবু বাবার বিয়ে করার খবরটি আমার মধ্যে এতটুকু নাড়া দিল না। ছোটবোন তার শশুরবাড়ির লোকজন নিয়ে চিন্তিত। ওর সমস্যা আন্দাজ করতে পারি। আমার ওরকম কোনো সমস্যা নেই। শহর থেকে দূরে আরেকটি শহরে পড়াশুনা করছি। এখানে আমার মা জীবিত না মৃত, বাবা আবার বিয়ে করলেন কিনা, তাতে কার কি এসে যায়। কারও কিছু এসে গেলেই বা আমার কি করার আছে!

ছাদে আজ আলোটা বেশ। এত চড়া আলো রাতে বেমানান। কোনো এক রাতে এমন আলোয় বাবাকে দেখেছিলাম মাকে উঠোনে বেঁধে ঘরের হুড়কো দিয়ে পেটাচ্ছেন। সকালে উঠে মায়ের হাতে-পায়ে কোনো দাগ দেখিনি। বড় ভাইবোনদের বললে ওরা হাসতে হাসতে বলেছিল, বাবা কখনোই মায়ের গায়ে হাত উঠান না। এরপর খেতে বসে আমার সামনেই বাবাকে যখন ওরা বলল, বাবা তুমি নাকি কাল রাতে মাকে উঠোনে মেরেছ! সঙ্গে সঙ্গে মা বাবাসহ ওদের হেসে ওঠা দেখে আমি তো লজ্জায় বাঁচি না। এরপর যতবার এ দৃশ্য দেখেছি আমি চুপ করে থেকেছি। আমার দেখার ভুল নিয়ে আরও অনেক সন্দেহ থেকে গেছে। সংসারে সব সন্দেহ দূর হয় না। এটা মায়ের কথা। কোন প্রসঙ্গে বলেছিলেন আজ আর মনে করতে পারি না। মায়ের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে তার অনেক কথা উড়ো কথা মনে হয়। কোনো কোনো কথা ভেসে ওঠে বাতাসে। মানুষের মৃত্যুর পর যদি কিছু থেকে যায় পৃথিবীতে, সে হল কথা। সেই কথা থেকে আবার নতুন কথা তৈরি হয়। যেমন, মাসখানেক আগে মা বললেন, ন্যায় অন্যায় সমাজের ব্যাপার। খুন করাও কখনো কখনো অন্যায় না, প্রকৃতির চেয়ে বড় খুনি তো আর কেউ হতে পারে না। তাই মনের ভেতর ন্যায় অন্যায় বলে কিছু পুশে রাখতে নেই। এই কথাগুলো মা যখন আমাকে বললেন তার কয়েকমাস আগেই তিনি মারা গেছেন। মায়ের ভাসতে থাকা কথা থেকে এমন আরও অনেক কথা তৈরি হয়, আমি কিছু শুনি, কিছু আমার অন্য ভাইবোনরা শুনতে পায়। কিছু হয়ত কেউ শোনে না। আমি কারও না শোনা কথাগুলো প্রায়ই ধরে ধরে মেলানোর চেষ্টা করি। সেদিন ভুল করে অন্য একজনের কথা ধরে ফেলেছিলাম, আমার মা নয়, অন্য মা, তার সন্তানকে বলছেন মরে উঠতে। সন্তানের কণ্ঠস্বর খুঁজে পাইনি। জীবিত মানুষের কণ্ঠস্বর শূন্যে ভাসে না। মা কেন তার সন্তানকে মরে উঠতে বলবে? কথাটি কি বেঁচে উঠতে হবে? মৃত মা কেন তার জীবিত সন্তানকে বেঁচে উঠতে বলবে? নাকি সন্তানও মৃত? সন্তান মৃত হলে মরে উঠতে বলবে কেন? অনেকদিন এই কথাগুলো নিয়ে ভেবেছি।

ছোট বোন ফের ফোন করে। ওর স্বামী বলেছে, তোর বাবা যদি সত্তরে বিয়ে করতে পারে, আমি করলে দোষ কোথায়? সম্ভবত মেরেছেও। ও না বললেও বুঝেছি। মার খাওয়াটা ওর জন্য ঘটনা না, আরেকটা বিয়ে করার হুমকি শুনে ভড়কে গেছে। একটা মেয়ে প্রাইমারি শেষ করবে, আরেকটা এখনো স্কুলে যাওয়া শুরু করেনি। বিয়েটা যদি সত্যিই করে ফেলে তো ওর জন্য বড় ক্ষতি হয়ে যাবে। কিন্তু ওর কষ্ট আমাকে এখন ছুঁতে পারে না। আমি যত চেষ্টা করি তত দুলাভাইয়ের কথা মনে হয়। এক মহিলার সঙ্গে প্রেম করেছে। শুয়েছেও। লোকজন সব এখন জানে। ও বিয়ে না করলে ঔ নারী আত্মহত্যা করবে বলে আমাকে জানিয়েছে। আমি বোনের হয়ে ওকালতি করতে গিয়েছিলাম। সংসার টেকাতে ওকে হালকা করে হুমকিধামকিও দিতে হয়েছে। মহিলা রাজি হয়েছিল এক শক্ত শর্তে। আমি যদি বিয়ে করি তো ও আমার দুলাভাইকে ছেড়ে দেবে। মহিলার মায়ের মুখ থেকে কথাটা শুনেছি। এরপর আর ওর ব্যাপারে আমি কিছু বলিনি। তুই বিয়েটা করে ফেল। ছোটবোন আমাকে কাঁদতে কাঁদতে বলে। আমার দুধের শিশুদুটোর কথা ভেবে। আমি বললাম, ঠিক আছে করব। ও তখন নিজেই তেড়ে ওঠে, ও বেশ্যা মাগীকে বিয়ে করে তুই কেন জীবন নষ্ট করবি? ওই খানকি তো এটাই চায়, কারও গলায় ঝুলে যেতে পারলেই হয়। ও কাঁদতে কাঁদতে ফোনটা রেখে দেয়।

নীলার সঙ্গে ব্রেকআপ হয়েছে আমার। এটাকে ঠিক ব্রেকআপ বলা যায় কিনা জানি না। ও চেয়েছিল স্বামীটা যতদিন পিএইচডিটা শেষ করে দেশে ফিরছে ততদিন আমাকে দিয়ে বিছানার কাজটা মিটিয়ে নেবে। চার দিন ওর বাসাতে আর একদিন আমাদের মেসের রুমে চেষ্টাও করা হলো। কিন্তু আমার সাড়ে তিন ইঞ্চি দিয়ে ওর হলো না। বিবাহিত, এক সন্তানের মা। আমাকে দেখে নাকি ধারণাই করতে পারেনি এত ছোট হবে ধোনটা। ও খুব হতাশ হয়েছে। আমার কোনো অপরাধ নেই, ওকে বলেছি। এইটুকু নিয়ে কেউ প্রেম করে, তাও পরকীয়া-- নীলা কাঁদতে কাঁদতে বলেছে। নীলার মনটা খুব নরম। হাসনা চাচির মতো হিজড়া গালি দিয়ে লাথি মেরে বিছানা থেকে উঠে পড়েনি। আমাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থেকেছে। কেঁদেছে, একটু আমার জন্য একটু নিজের জন্য। আমার চেহারা ও শরীরটা দেখে আরও অনেক নারী ধোকা খেয়েছে। অধিকাংশ মেয়েদের সমস্যা ওরা মোড়ক দেখে কোয়ালিটি বিচার করতে চায়। আমার রুমমেট শফিকের সাইজটা ঠিক আছে, কিন্তু চেহারা খারাপ, ছোটখাটো মানুষ বলে কোনো মেয়েকে বিছানা পর্যন্ত আনতে পারেনি। শফিকের জন্য আমার খারাপ লাগে। ভেবেছিলাম নীলাকে বলব শফিকের কথা। তার আগেই নীলা একজনকে পেয়ে গেল। ওর মেয়েকে পড়াতে আসে ছেলেটা। আমাকে ফেসবুকে ছবি দেখিয়েছে। অল্পবয়সী ছেলে। শুকনো শরীর। কিন্তু যেটা দরকার সেটা ঠিক আছে। নীলাকে খুশি দেখে আর কিছু বলিনি। 

বড়ভাইয়ের ফোন এলো। বুঝেছি বাবার বিয়ে নিয়ে বলবে। ভেবেছিলাম আপত্তি করবেন। কিন্তু আমাকে বলবেন আপত্তি না করতে। বড়ভাবী বাবাকে রান্না করে খাওয়াতেন। কিছুদিন থেকেই বলছেন বাপের বাড়ি চলে যাবেন। বাবা বললেন, বাবাকে রান্না করে খাওয়ানোর জন্যও তো একজন দরকার। বুড়ো হয়েছে, বিছানায় পড়ে গেছে কে দেখবে? আমি কোনো কথা বলিনি। মায়ের মৃত্যুর পর ঠিক হয়েছিল বাবাকে বড়ভাবী আর মেজভাবী পালা করে খাওয়াবেন। গতমাসেই মেঝভাই শহরে বাড়ি ভাড়া উঠেছেন। গ্রাম থেকে নাকি ছেলেমেয়েদের পড়াশুনা ভাল হচ্ছে না। বাবার বিয়ের বিষয়ে তার অমত থাকার কথা না। মেজোভাই ফোন করে বাবার বিয়ে নিয়ে কিছু বললেন না। বললেন, বিয়ের আগে সম্ভব হলে বাবার কাছ থেকে বাড়িটা লিখে নিতে হবে। না হলে শেষ বয়সে নতুন কেউ সংসারে এসে বাড়িটা তার নামে লিখে নিতে পারে। মাঠের জমির বণ্টননামা ঠিক করে নিতে হবে। বিয়েতে আমরা মত দিলে বাবা সহযোগিতা করবেন বলে জানিয়েছেন। মেজভাবির হাত থেকে মোবাইলটা ভাবি নিলেন। বললেন, নতুন বউকে লিখে দেয়াটা বড় কথা না। যদি তার ঘরে সন্তান হয়, তাহলে সে বাড়ি-জমিজমার অংশীদার হয়ে যাবে। বাবার বয়স সত্তর পার। এ বয়সে সন্তান হয় নাকি? ভাবিকে বললাম আমি। ভাবি বললেন, সন্তান হতে বাবাকে লাগবে কেন? আশেপাশের পুরুষ মানুষের অভাব নাকি? অল্পবয়সী মেয়েকে বিয়ে করলে দু বছরের মধ্যেই পেট হবে, আমি বলেদিলাম, তুই লিখে রাখ। ভাবি আমাকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে বললেন। সন্তান হলে সম্পত্তির ভাগ পাবে। বড়ভাই আর মেজভাই কি আমাদের ভাগ দিচ্ছে না? আমরা আলাদা মায়ের সন্তান হলেও তো কেউ বঞ্চিত হচ্ছি না? আমি প্রশ্ন করি ভাবিকে। কিন্তু এখন যে সন্তান হবে সে তো বাবার সন্তান না, আমরা তাকে ভাগ দেব কেন? ভাবীর উত্তর। এতটা নিশ্চিত হয়ে ভাবী যখন বলেন আমার আর কিছু বলার থাকে না। শুধু আস্তে করে বলি, আমরা কে বাবার সন্তান আর কে বাবার সন্তান না, সেটা আর এখন শতভাগ নিশ্চিত হই কেমন করে যখন আমাদের মায়েরা মৃত। ভাবী আমার কথা শুনে রাগ করে ফোনটা রেখে দেন। ভাবির পুরানো ইতিহাস আমি জানি, ইঙ্গিতটা কোন দিকে যাচ্ছে দেখে কথা বাড়াননি।

ব্যক্তির ইতিহাস সমষ্টির ইতিহাস না। এটা সবসময় লিপিবদ্ধ থাকে না। জাতির ইতিহাস ব্যক্তি ধারণ করে সেখানে তার নিজের ইতিহাস নেই দেখেও। আমার মুক্তিযুদ্ধ-পলাতক বাবা জাতীয় ইতিহাসে নিজের ভুল ইতিহাসের অংশ হয়ে আছেন আঞ্চলিক মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস গ্রন্থে গবেষক শান্তিবাহিনির তালিকাতে বাবার নামটি ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। যুদ্ধের সময় বাবা তার দ্বিতীয় স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে ভারতে প্রথম স্ত্রীর বড়বোনের বাড়িতে আশ্রিত ছিলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার কয়েকমাস পর গ্রামে ফেরেন। ওখানে কিছু ঋণ করে আর একটা দোকানে বিক্রয়কর্মীর কাজ করে শরণার্থী ক্যাম্পের জন্য ছোটভাইয়ের হাতে নিয়মিত টাকা দিতেন। দেশে ফিরে জানতে পারলেন তার ছোটভাই, মানে আমার আপন ছোটচাচা, কলকাতায় হোটেলে আরামে থেকেছেন সেই টাকায়। ঐ গ্রন্থে মুক্তিযোদ্ধাদের নামের তালিকায় ছোটচাচার নামটা সংক্ষিপ্ত পরিচিতিসহ আছে। বাবাকে বলেছিলাম গবেষক ও প্রকাশকের নামে একটা মানহানির মামলা করতে। বাবা করেননি। বলেছেন, টাকা যখন শরনার্থী ক্যাম্পে পৌঁছাইনি তখন আর পলাতক ও শান্তি কমিটির মধ্যে পার্থক্য করে কি লাভ! বাবা লাভ লোকসান না দেখলেও ক্ষতি একটা হয়েছে আমাদের। সেজোবোনের বেসরকারি স্কুলের হওয়া চাকরিটা হতে দিল না প্রতিপক্ষ ক্যান্ডিডেটের বাবা, আমার বোনকে রাজাকারের মেয়ে অভিযোগ তুলে। সেই ছোটচাচার মেয়ে মুক্তিযোদ্ধার কন্যা হিসেবে সগৌরবে চাকরিটা পেল। বাবা কোনো প্রতিবাদ করলেন না। সেজোবোনটা আত্মহত্যা করলেন তার এক বছর পরে। চাকরি না হওয়ার জন্য নয়, স্বামী অন্য একটা মেয়ের প্রেমে পড়েছিল, বিয়েও করেছিল। বোনটাকে মেরে ঘরের আড়ার সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখল। আত্মহত্যা বলে সেজোবোনের ব্যক্তিগত ইতিহাসে লেখা রইল।
সেজোবোনের কোনো কোনো কথাও শূন্যে ভেসে ওঠে। আমাকে একদিন বলেছিল মেয়েটা খুব সুন্দর হয়েছে দেখতে। মরার সময় ওর পেটে ছিল। সাত মাসের। আর একদিন বলেছিল, ওর খুব আনন্দ হয় বেঁচে থাকতে। ও তো মৃত, বেঁচে থাকতে আনন্দ হয় কিভাবে আমি বুঝিনি। মৃতদের যে কথাগুলো শূন্যে তৈরি হয় তাদের আগের কথাগুলো থেকে তাতে অনেক সময় কোনো অর্থ থাকে না। থাকলেও আমরা জীবিত মানুষেরা বুদ্ধি খাটিয়ে বের করতে পারি না। কখনো কখনো সক্ষমতার প্রশ্নে কে বেশি এগিয়ে -- জীবিত না মৃত আমি বুঝতে পারি না। যেমন আমার নিজের সক্ষমতা কতটুকু? নীলা কিংবা হাসনা চাচিকে কেন খুশি করতে পারি না? বাবার বিয়ে থামাতে বলে ছোটবোন, বড়ভাই-মেজোভাই বলে বিয়েতে আপত্তি না তুলতে। কিন্তু আমি কি চাই সেটা নিজেও ঠিক করতে পারি না।
মাঝে মাঝে মনের এমন নিষ্ক্রিয়তা থেকে কোনো কোনো কাজ করে বসি। ছোটবোন সেদিন রাতে বলল দুলাভাইয়ের প্রেমিকার বাসায় ফের যেতে। গেলাম আমি। মহিলার বয়স আমার চেয়ে কিছুটা বেশি হবে। ঘরের ভেতরে গিয়ে বসলাম। মহিলার মা বাইরে থেকে দরজাটা আটকে দিল। আমি কিছু বলি না। জানি না কি বলতে এসেছি। ছোটবোন কিছু কথা শিখিয়ে দিয়েছিল, মনে করতে পারি না। মহিলা শাড়িটা খোলে। ব্লাউজ না খুলে পেটিকোটের ফিতা ধরে টান মারে। আর কিছু পরেনি ভেতরে। আমি তাকিয়ে থাকি। ভেজা লোমশ যোনি। ঘর্মাক্ত অথবা ধুয়ে এসেছে। আমার প্যান্টটা এখন খোলা উচিত। আমি উঠে দাঁড়াই। মহিলা নিজে খুলে নেয়। এরপর কি হবে আমার জানা। কিন্তু এই মহিলা অন্য নারীদের মতো আমার নগ্নতা দেখে হতাশ হয় না। হাঁটু গেড়ে আমার পায়ের কাছে বসে। চেনটা টেনে মুখের মুধ্যে নিয়ে চুষতে থাকে। আমি কি বলতে এসেছিলাম, কি করছি সেটা ভেবে লজ্জা হওয়া উচিত। কিন্তু আমার মহিলার প্রতি আগ্রহ তৈরি হয়। কেউ একজন দরজাটা ফাক করে। ক্যাচ করে শব্দ হয়। মোবাইলে ছবি তোলার আওয়াজ আসে। ক্যামেরার সাউন্ড অফ করতে ভুলে গেছে কিংবা ইচ্ছা করেই অফ করেনি। ছবি তোলা শেষ। এখন মহিলার থেমে যাওয়া উচিত। তা না করে আমাকে বসিয়ে একপা পা বিছানায় তুলে মুখটা চেপে ধরে জোনির উপর। বের হ মাগি। ওর মা বাইরে থেকে বলে। থাম, বের করে নিই। মহিলা ভেতর থেকে ঘনস্বরে উত্তর দেয়। আমার নিস্ক্রিয়তা কখনো কখনো কারও জন্য সক্রিয়তার কারণ হয়ে ওঠে। আমি আর সে রাতের বোনের বাসায় ফিরে যাই না। বাড়ি ফিরতে রাত হয়ে যায়। বাবা ততক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছেন। পেছনের মসজিদে কয়েল জ্বেলে ঘুমায় পাড়ার শফি হুজুর। মসজিদে গেল সপ্তায় দু রাতে দুটো ফ্যান চুরি হয়েছে। জুম্মার নামাজে টাকা তোলায় ব্যবহৃত টিনের বাক্সটাও কখন কে নিয়ে গেছে। এরপর থেকে শফি হুজুর পাহারায় থাকে। বউ ডাকলে উঠে যায়, কাজ সেরে আবার এসে মসজিদে ঘুমায়। মাঝরাতে মসজিদের টিউবওয়েলে ওর গোসল করার শব্দ শুনে বুঝি। আমার এখন গোসল করা উচিত কিনা জানি না। কোনো নারীর সামনে নগ্ন হলে কি গোসল করতে হয়? পাশে শুয়ে ওকে জিজ্ঞাসা করি। কাজ না করলে গোসল করার দরকার নেই। শফি হুজুর আমাকে বলে। কাজ করা বলতে যা বোঝায় তা আামাদের হয়েছে কিনা বুঝে উঠতে পারি না। আমরা মসজিদের ভেতরে আর এসব নিয়ে কথা বলি না। কিছুক্ষণের মধ্যে শফি হুজুরের নাক ডাকার শব্দ আসে। একজন নারী আমাদের মাথার কাছ থেকে ছায়ার মতো ঘুরে যায়, আমি টের পাই। পেছন ফিরে তার চলে যাওয়া দেখি। শফি হুজুরের বউ সালোয়ার-কামিজ পরে না। শাড়ি পরে। সালোয়ার-কামিজ পরা মেয়েটি শফি হুজুরের বাড়ির উল্টো দিকে আমবাগানের ভেতর দিয়ে অন্ধকারে মিলে যায়। ওদিকে গোরস্থান। কোনো বাড়িঘর নেই। আমি উঠে বসি। স্বপ্ন দেখছেন, ঘুমিয়ে পড়েন। শফি হুজুর বলে। গোলস করে শুলে ভালো করতেন। ওর কথা শুনে আমার আর ঘুম আসে না।

বড়দুলাই ভাই ফোন করেন। উনার ধারণা বাবার বিয়েতে আমার জোর আপত্তি আছে। আমার শাশুড়ি মারা যাওয়ার পর তোর মাকে যখন শশুর বিয়ে করলেন তখন আমরা আপত্তি করিনি। শশুরের বয়স তখন কম ছিল, আপত্তি করলেও শুনতেন না। পুরুষ মানুষ ঐ বয়সে একা থাকলে নানা বদনাম হতে পারে। তার চেয়ে বিয়ে ভাল। এখন শশুরের বয়স হয়েছে। আমরা আপত্তি করলে জোর করতে পারবেন না। কিন্তু তার দেখাশুনার জন্য তোর বোনরা পড়ে থাকতে পারবে না। তোর দু ভাইয়ের বউ তো কোনো দায়িত্ব নিচ্ছে না। তুই বিয়ে করে বউকে রেখে যা। গরীবঘরের অল্প শিক্ষিত মেয়ে বিয়ে করলে থাকবে। দুলাভাইয়ের কথাগুলো আমি শুনলাম। বিয়ে আমি করতেই পারি। বউ আমার টিকবে না। বাবার তৃতীয় বিয়ের কেলেঙ্কারি থেকে বাঁচতে আরেকটা কেলেঙ্কারি তৈরি হবে। দুলাভাইকে সব বোঝাতে পারি না। বলি, বাবা বিয়ে করলে সমস্যা কোথায়? তাহলে তোর অমত নেই? দুলাভাই আমার মত পেয়ে খুশি হন। তখন বুঝতে পারি উনি আসলে কৌশলে আমার মত নিতে চেয়েছিলেন।
রাতটা ছাদে বেশ কাটে। শহরের সন্ধ্যারাতের প্রয়োজনীয় আলোগুলো নিভে গেলে কিছুটা অন্ধকার আসে এদিকে। কিংবা অন্ধকার আগে থেকেই ছিল, আলো সরে গেলে দৃশ্যত হয়। অন্ধকারটাই পৃথিবীর, আলোটা আসে বাইরে থেকে। গাছগুলো যে আছে এতক্ষণে টের পাওয়া যায়। প্রাণ আছে যতকিছুর তার মধ্যে গাছ এক যে নিজের ইচ্ছায় স্থান বদল করতে পারে না। শহরে এক একটা গাছ আমাদের পূর্বগাছদের বিস্মৃত স্মৃতি হয়ে অপেক্ষা করে। কোনো কোনো অপেক্ষা জড় বস্তুর মতো নিস্ফলা, বৃক্ষের মতো নিশ্চল।

রাত আরও গভীর হলে আমার স্মৃতিগুলো জেগে ওঠে। অতীতের সঙ্গে সঙ্গে ভবিষ্যতের দিনগুলোর কথা আগাম মনে পড়ে। মনে হয় মা বেঁচে আছেন। আমি গনগনে দুপুরে গোলাঘরের ছায়ায় বসে। বাবা বিয়ে করতে যাচ্ছেন, তখন আর মা বেঁচে নেই। উঠোনে দেখি রোদের ভেতর মা শুকোতে দেওয়া সিদ্ধ ধানগুলো নেড়ে দিচ্ছেন খালি পায়ে। সেই উঠোনেই আবার নতুন বউ নিয়ে বাবা বসে আছেন এক বিকালে। ঘোমটা সরিয়ে লোকজন দেখছে। আমি উঠে গিয়ে দেখি আমার মায়ের চেহারা। বাবার বয়স তখন অনেক কম। মাকে বিয়ে করে এনেছেন। আমার জন্মের আগের দৃশ্য কিন্তু আমার স্মৃতিতে ভেসে ওঠে। বাবার বয়স আরও কমে, ঘোমটার ভেতর চেহারাটা বদলে যায়। আমার বড় মা কিংবা মেজো মা হবে। আমি তাদের দেখিনি বলে নিশ্চিত হতে পারি না। মা যখন ধানগুলো নেড়ে দিয়ে রান্নাঘরে যান, তখনই অন্ধকার নামে। দুপুর থেকে সরাসরি রাত। বিকালটা গায়েব। রাতে আমি বারান্দায় বসে। সামনে অচেনা দৃশ্যপট। একজন নারী আমার সামনে চায়ের কাপ তুলে ধরে বলে, পেনশনের টাকাটা কাল তুলে আনো। আমার পায়ের শক্তি কমে আসে। বুঝতে পারি বয়স হয়েছে। চায়ের কাপ ধরে থাকা হাতটির মানুষকে বোঝার চেষ্টা করি। আমার স্ত্রী হতে পারে। কিন্তু আমি বিয়ে করলে আমার স্ত্রী টেকার কথা না। আমার বাকি জীবন একা থাকার কথা কিন্তু ঘরের ভেতর থেকে অনেক কণ্ঠস্বর ভেসে আসে। আমি কান পেতে শোনার চেষ্টা করি। একজন জোর গলায় বলছে, আমাকে কেউ মারেনি। আমি একা একা মরেছি। কিন্তু আত্মহত্যা করিনি। আমার মেজোবোন কিংবা মায়ের কণ্ঠস্বর বলে মনে হয়। আরেকজন বলছে, চেষ্টা করলে হয় না, সব চেষ্টা হওয়ার জন্য না। কণ্ঠস্বরটা চিনতে পারি না। আমি ছাদে হাঁটতে হাঁটতে কার্ণিশের কাছে চলে যাই। এই আমি অতীত, বর্তমান নাকি ভবিষ্যতের কিছুক্ষণের জন্য বুঝে উঠতে পারি না।   

ঘুমটা ভাঙে বড় দুলাভাইয়ের কলে। ভালো একটা পাত্রী পেয়েছি। বয়সটা কম, কিন্তু সন্তান হবে না। আগের স্বামী সেই কারণে তালাক দিয়েছে। কোনো বদনামের সুযোগ থাকল না। আমার আর বিছানা থেকে উঠতে ইচ্ছা করে না। আজ ভার্সিটি যাব না। দ্বিতীয়বার ঘুমটা ভাঙিয়ে দেয় ছোটবোন। বাবার বিয়ে হয়ে গেছে। ও বলে। ততটা অখুশি বলে মনে হয় না। ঔ মহিলার সঙ্গে। বড় দুলাভাইয়ের প্লান।
কোন মহিলা? আমি জানতে চাই।
মাগীটা। বলে আমাকে আবার প্রশ্ন করে-- এখন কি গালি দেওয়া ঠিক হবে? বাপের বউ মানে তো আমাদের মা। মানি আর না-মানি।
রাখ তুই। আমি ঘুমাব। সারাদিন ঘুমিয়ে থাকব। যখন জেগে উঠব আমার কণ্ঠস্বর ভেসে উঠবে শূন্যে। তুই মোবাইল ছাড়াই শুনতে পাবি।   
দিন কোথায় পেলি? এখন তো রাত। ছোটবোন বলে।
জানালা খুলে দেখি সকাল হয়েছে। মা বাসি উঠোন ঝাড়– দিয়ে ময়লাগুলো টোকায় তুলছেন। একবার মনে হয়, মাকে ডেকে বলি বাবা আবার বিয়ে করবেন। তখন মনে পড়ে যায় মা আগে থেকেই জানেন, মৃত্যুর আগে আমাকে বলেছেন। আমি ভবিষ্যৎ দেখে এলাম নাকি অতীতে ফিরে গেছি বুঝে উঠতে পারি না। নিজের বর্তমান ছাড়া সময়ের আগপিছ নির্ণয় করা কঠিন। মৃতের কি কোনো বর্তমান থাকে?

রুমা মোদকের গল্প : মর্জিনা খাতুনের অষ্টপ্রহর





রুমা মোদক
মর্জিনা খাতুনের  অষ্টপ্রহর


এখন আর ঝিম মারা দুপুর কই।স্বামীদের ভরপেট খাইয়ে কর্মস্থলে বিদায় দিয়ে বৌ ঝিরা গায়ে নুন হলুদ আর লাকড়ি পোড়ানো ধোঁয়ার রান্নার গন্ধ মেখে গায়ে আলস্য জড়িয়ে ঘুমাবে। কানের কাছে রেডিওতে এন্ড্রুকিশোর গাইবে,আমার বুকের মধ্যিখানে,মন যেখানে হৃদয় যেখানে....। বাচ্চারা পা টিপে বাইরে সঙ্গীদের সাথে খেলার মাঠে যাবার ফুসরত খুঁজবে আর মফস্বলের অফিস পাড়ায়  হাই তুলতে তুলতে অবসন্ন হাতে ফাইলের পাতা উল্টাবে সফল কিংবা অতৃপ্ত পুরুষেরা। শেকড়-বাকড় ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকা শত বছরের পুরানো বটের ছায়ায় রিক্সা রেখে তাতে বসে ঝিমুবে শ্রান্ত রিক্সাড্রাইভার আর বেকার যুবকেরা বিড়িতে সুখটান দিতে দিতে বাজারের চাতালে বসে তাস পেটাবে।দোকানগুলোতে খদ্দের থাকবে না আর দোকানীরা সেই সুযোগে ঢুলে পড়বে ঘুমে। না এখন সেই দুপুর নেই।

এই দুপুরে মর্জিনা খাতুন দেখে সামনের রাস্তায় ইজিবাইক আর রিক্সার উপচেপড়া ভীড়। কে কার আগে যাবে তার অস্থির প্রতিযোগিতা। সেগুলোতে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে  বসা মানুষগুলোরও অবসর নেই। যেনো এখনই সেরে  সব জরুরী যোগাযোগ সেরে না নিলে পৃথিবীর আহ্নিকগতি বার্ষিকগতি থেমে যাবে।   মোবাইলফোন কারো কানে, কারো হাতে।সবাই ব্যস্ত। গলির মোড়ে খুচরা মাছ,সবজি অলাদের লম্বা লাইন। এই উৎপাত ইদানিং শুরু হয়েছে। রাস্তা বন্ধ করে এই ভরদুপুরে ভীড় করে  কিনছে মানুষ।আসতে যেতে পথচারীদের অসুবিধা হলে কার কি! এই কেনাই আসল,এই বেচাই আসল। এ শুধুই কেনাবেচার যুগ।
সে নিজেও ফিরেছে এই ভীড় ঠেলে। মাথার উপর খুলে রাখা ছাতার ভেতর শিকে ঝুলে দেখেছি আমি।দেখে যাচ্ছি গত কয়েকমাস ধরে। আমি আসলে তার মায়ায় পড়ে গেছি। রান্নাঘরের মিটসেফ কিংবা বইয়ের তাকের স্বসমাজ ছেড়ে আমি গত কয়েকমাস যাবৎ একটা লোহার শিকে ঝুলে তার সাথে লেগে আছি। লেগে আছি আর টের পাচ্ছি আমাদের দুজনের জীবন প্রবাহ এক অভিন্ন  অভিযোজন  ক্ষমতায় দীর্ঘস্থায়ী জীবন নিয়ে মিশে আছে একবিন্দুতে।

ঠক ঠক ঠক গেটে কেউ ডাকে। কলিংবেলের শব্দের যুগে পাড়ায় তাদের বাড়িটাতেই এখনো কড়া নাড়ার ঠক ঠক। চোরাপথ, গলিপথ, রোজগারের নানা ধান্ধা করেও তরিকুল ইসলাম নিজের বাড়িটাকে আশেপাশের বাড়িগুলোর মতো সম্ভ্রান্ত করে তোলার সুযোগ পায়নি। জায়গা কিনে মাথা গুঁজার ঠাঁইটুকু শুধু করতে পেরেছিলো।

 এই দুপুরে কে ঠকঠক করে মর্জিনা খাতুন জানে। ছেলেটা।এই বাড়িতে এক কড়া ঠকঠকায় ছেলে আর বাড়ি বন্ধক নেয়া জমিরুদ্দিন মিয়া। সে আসে বিকেল বিকেল।  নির্দিষ্ট সময় অন্তর এসে চা-পান খেয়ে মর্জিনা খাতুনের শরীর স্বাস্থ্যের খবর জানতে চায়, জানতে চায় প্রেসারের ওষুধ নিয়মিত খায় কিনা,সুগার শেষ কবে মেপেছে,তারপর পরামর্শ দেয় আথ্রাইটিসের ব্যাথার জন্য পেইনকিলার যতো কম খাওয়া যায় ততোই মঙ্গল। তারপর নরম সুরে হিসেবটা জানিয়ে যায়। যে হারে সুদ জমছে বাড়ি দখল নিতে আর কয়েকটা মাস মাত্র! তার সুরে পেশাদার চাতুর্য। যেনো এই শরীর স্বাস্থ্যের খবর নেয়াটাই মূখ্য উদ্দেশ্য তার। বাড়ি দখল নেয়ার সময়ের হিসাবটা গৌণ।

শরীরের ঘাম শুকায়নি এখনো মর্জিনা খাতুনের। জেলা একাউন্টস অফিসে পাঁচ হাজার টাকা ঘুষ দিয়ে মাত্রই হেঁটে বাড়ি ফিরেছে। আজও চেকটা হাতে আসেনি।ছেলের মুখোমুখি হতে ভয়ে তার বুক দুরুদুরু করে।  ছেলেটা ঢুকে অকারণেই বারান্দায় রাখা মোড়াটায় গায়ের জোরে লাথি মারে। মোড়াটা গড়িয়ে গড়িয়ে ছাতায় হুমড়ি খায়।ছাতার ভেতরে শিক ধরে ঝুলে থাকা আমি দৌড়ে পালাই। এই ছেলেটিকে আমিও  খুব ভয় পাই,মর্জিনা খাতুনের মতো। ভয়ে আমি পালাতে পারি,মর্জিনা খাতুন পারে না। তার পালানোর জায়গা নেই।প্রতিদিন ছেলেটা ঘরে ঢুকেই ছেলে কাপ ভাঙে,প্লেট ভাঙে,গ্লাস ভাঙে। চেঁচিয়ে পাড়া মাথায় তোলে। সে বাড়ি ফিরলে মর্জিনা খাতুনের সাথে আমারও বুকটা দুরুদুরু কাঁপতে থাকে।

টাকাটা পেয়েই তাকে দিয়ে দেবে এমন আশ্বাসে ছেলেটা বিশ্বাসও করে না,ভরসাও করে না।এই অবিশ্বাস আর ভরসাহীনতা তার নিজেরই অন্তর্জাত। নিজের চরিত্র বিশ্লেষণে সে বুঝে এত্তোগুলো টাকা পেলে সে হাতছাড়া করতো  না। কাজেই মর্জিনা খাতুন হাতছাড়া করবে এ ভরসাটুকু নাই তার। হোক গর্ভধারিণী মা। মানুষ আসলে অন্যকে যাচাই করে নিজেকে দিয়েই। সে নাড়ি ছিন্ন করা জননী হোক কিংবা আত্মীয়,পরিজন, বন্ধু। নিজেকে জানার গণ্ডি ভেঙে  অন্যকে চিনতে পারার শিক্ষা নেই তার। বিশ্বাস আর ভরসাহীনতায় সে প্রতিদিন গালাগালি করে মর্জিনা খাতুনকে,এতো দেরি হয় পেনশনের টাকা পাইতে! কারে শিখাস তুই! আমার সাথে চালাকি করছ? মর্জিনা খাতুন ছেলের মরা বাপের দিব্যি দেয়। কী হয় তাতে! বাপের চুরি-চামারি, আরা কথায় কথায় মাকে চড় থাপ্পড় মারা দেখে বড় হয়েছে সে। মরা বাপের দিব্যি চুল পরিমাণ আবেদনও রাখেনা তার উদ্দেশ্য হাসিলের ধান্ধায়। বরং পাল্টা চোখ রাঙায়, চেক পাইছস কিনা খবর নিতে আমার পাঁচ মিনিট লাগব। হাছা কথা ক.....ছেলে গর্জাতেই থাকে। সিস্টেমের দীর্ঘসূত্রতা,  ছেলের স্বভাবজাত অবিশ্বাস আর ভরসাহীন চেঁচানোর মাশুল দিতে দিতে  এভাবেই তার শ্রান্ত দুপুরগুলো প্রায় প্রতিদিন অবসন্ন  বিকেল পেরিয়ে অলস সন্ধ্যার দিকে গড়িয়ে গড়িয়ে যায়।

সম্প্রতি ছেলের চেঁচানোতে নতুন  যুক্ত হয়েছে  মেয়ের প্রসঙ্গ। স্বভাব-চরিত্র নষ্ট হয়ে গেছে মেয়েটার।শহরে চেহারা দেখানো যায় না বদনামে। ভাইয়ের ভয়ে বাড়ি বয়ে কাউকে নিয়ে আসে না বটে,কিন্তু যখন তখন ছেলেদের মেসে যায়। আশেপাশের সবাই দেখে। মেয়ের এই বখে যাওয়ার দায়ও মর্জিনা খাতুনের উপরই বর্তায়। নিশ্চই এ তারই দোষ। মেয়েটাকে যথেষ্ট শাসনে রাখতে পারে নি সে।অবশ্য  চেষ্টাই তো করে নি কোনদিন। হোক জন্মদাত্রী।  ছেলেমেয়ে কাউকেই শাসন করার ধৃষ্টতা ছিলো  নাকি তার! তরিকুল ইসলাম একচ্ছত্র অধিপতি ছিলেন সংসারের। তার ইচ্ছেয় এ সংসারে যেমন তেল-নুন আসতো, তেমনি সে সহ ছেলেমেয়েরাও নড়তো চড়তো। তার অবর্তমানে ছেলেমেয়েদের শাসন করতে হবে, তার না আছে এমন প্রস্তুতি না আছে ক্ষমতা! 

ছেলে বাড়ি ফিরলেই মর্জিনা খাতুন দুরুদুরু বুকে নিত্যদিন তটস্থ থাকে তার চাওয়া মাত্র সব হাজির করার প্রস্তুতি নিয়ে। আমার জীবনের দুরুদুরুটা তার সাথে যুক্ত হল সেদিন থেকে,যেদিন মোঃ তরিকুল ইসলাম, সরকারের উন্নয়নমূলক প্রতিষ্ঠানের প্রধান সহকারি, আর্থিক কেলেঙ্কারির দায়ে বরখাস্ত হয়ে বাড়ি ফিরল। আর ফিরেই বড় কর্তাদের সামনে হেনস্থা হওয়ার ক্ষোভ ঝাড়তে থাকলো সে পুত্রকন্যার সাথে। রাবণের গোষ্ঠীর খোরাক যোগাতে গিয়ে আজ তার এই অবস্থা। মর্জিনা খাতুন শুধু একবার উত্তর করেছিলো, আমি কী তোমার কাছে কুনুদিন কিচ্ছু চাই? বলামাত্রই গালে ঠাস করে এক চড়। এমন চড় খাওয়া মর্জিনা খাতুনের অভ্যাস। চড়ের সাথে অভিযোজিত হয়েই তাঁর জীবন। বিয়ের পর থেকেই তরিকুল ইসলাম সুযোগ পেলেই ঠাসঠাস চড় মারে মর্জিনা খাতুনকে,বেশি রেগে গেলে একইসাথে চলে লাথি কিলও। আজকেও সে একটা চড় মেরে রাগ উপশমের সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিলো। কথাটা না বললেই বরং তার রাগ আরো বাড়তো। মর্জিনা খাতুন কথাটা বলে  চড় মারার সুযোগ করে দিয়ে তাকে রাগ কমানোতেই  সাহায্য করে।
 প্রতিবার চড় খেয়ে মর্জিনা রান্নাঘরে ঢুকে,ধোয়া হাড়ি পাতিল আবার ধোয়। ঘষে ঘষে চুলা পরিস্কার করতে গায়ের সব জোরের সাথে ঝেড়ে দেয় অসুখী-অপদস্থ জীবনের আক্ষেপ আর আঘাতের শারিরীক মানসিক যাতনা। ঝাড়ু দিয়ে তেলাপোকাদের বংশ ধ্বংস করে সে মাথার উপর ঝুল ঝাড়তে গিয়ে মাকড়সাদের পিষে মারে। নির্বোধ কীটদের অসহায় মৃত্যু তাকে একরকম  শক্তি দেয়,নিজের বেঁচে থাকার টিকে থাকার শক্তি।
সেদিনও সে এই কাজটি করছিলো,ঝাড়ু দিয়ে হত্যা করছিলো রান্নাঘরের নেট ভাঙা মিটসেফ থেকে প্রানভয়ে পালিয়ে যাওয়া সব তেলাপোকাদের মাঝ থেকে ভাগ্যক্রমে এক ফাঁকে আমি বেঁচে দলছাড়া হয়ে ঢুকে পড়েছিলাম ঘরের কোণায় মাটির ফিল্টারে ঠেস দিয়ে রাখা ছাতাটার ভেতরে। আমি তখনো দুধের মতো সাদা ফুটফুটে একটা বাচ্চা।অতপর বড়ো হই আর তাদের পরিবারের সদস্যদের পরস্পর কথাবার্তায় জানতে থাকি, তারও আগে যেদিন তরিকুল ইসলাম বাজারের ব্যাগে কয়েক প্যাকেট অফসেট কাগজ, প্রিন্টারের কালি এনে বাজারে বিক্রি করতে গিয়েছিলো সেদিনও- এই হারামের টাকা পোলাপানরে খাওয়াইবেন বলে সে থাপ্পড় খেয়েছিলো। জানতে থাকি,তারও আগে কন্ট্রাক্টর দুই নম্বরি বিল পার করিয়ে দেয়ার জন্য বাড়ি বয়ে টাকা দিয়ে গেলে -আপনে জাইন্যা শুইন্যা নদীর পাড়ের মানুষগুলার মরণ ডাইক্যা আনলেন,বললে তরিকুল ইসলাম তার গলা টিপে ধরেছিলো। সে মরেনি, টিকে গেছে। জানতে থাকি এই মর্জিনা খাতুন বাপের সংসার থেকে স্বামীর সংসার, স্বামীর সংসার থেকে ছেলের সংসার সর্বত্রই সে নিত্য  আমার মতোই টিকে থাকা প্রাণী। শুধুই টিকে থাকা। কোথাও কোনদিন নিজের অস্তিত্ব ঘটা করে জানান দেবার বোধই নেই তার।

যেমন আমরা মানে আমাদের প্রজাতি টিকে আছি মিলিয়ন বছর ধরে,অথচ অতিকায় ডাইনোসর বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তেমনি সেও টিকে আছে। স্বামীর চড় চাট্টি খেয়ে, ছেলের গোয়ার ক্রোধের আস্ফালন সহ্য করে।  অস্ফুট চোখ দিয়ে আমি দেখি একটি পরিবারের ভেতরে বাইরে কতো বিচিত্র রূপের সাথে অভিযোজিত তার টিকে থাকা। থাপ্পড় খেয়ে হজম করে আগের জীবন, ছেলের উন্মত্ত খ্যাঁকানি খেয়ে পরের জীবন, সংসারে দাঁত কামড়েই পড়ে থাকে সে। আমার মতোই। ঝাড়ুর বাড়ি থেকে বাঁচার পর আমি যেমন কতোদিন ছেলেটার পায়ে পিষ্ট হতে হতে হই নাই! মেয়েটার পাপোশের ঝাড়া খেয়ে দিব্যি আধঘণ্টা  পা উল্টে শুয়ে থেকে আবার ছাতার ভেতর লুকিয়ে গেছি! বেঁচে গেছি। ঠিক মর্জিনা খাতুনের মতো সংসারে টিকে গেছি।
ছেলেটার ঝাড়ি খেয়ে অর্ধদিনের ক্লান্তি মুছে মর্জিনা ঢুকে রান্নাঘরে আর আমি মেয়েটার দরজার চিপায় ঘাপটি মেরে বসে থাকি। মেয়েটা ঘুমাচ্ছে এই ভরদুপুর অবধি। ঘুমাবেই বা না কেনো!  সারারাত তার কীর্তি  আমি দেখি।কিসের রাত,কিসের ঘুম। সারা দুনিয়া যখন ঘুমায়,মেয়ে তখন জাগে,নানান ভঙ্গিতে জাগে,একেকদিন একেক কিসিমে জাগে। একেকদিন একেকজনের সঙ্গে জাগে।

টেবিলে ভাত আর মলামাছের সালুন সাজাতে সাজাতে মর্জিনা খাতুন কৈফিয়ত দেয়,পাঁচ হাজার টাকা নগদ দিছি, তবু আজও  কাজটা হইলো না।ডি এ ও নাই। ঢাকাত গেছে ট্রেনিং করতো।  ছেলেটা খ্যাঁকারি দিয়ে উঠে। আর কবে অইবো সুযোগখান হাত থাইকা ফইসকা গেলে! মর্জিনা খাতুন চুপ। স্বামী তরিকুলের চড় থাপ্পড় খেয়ে তবু মুখ খুলতেন,ছেলে মেয়ের কাছে সে মূক। বধিরও খানিকটা। উত্তর দিতে গেলে কথা  বাড়বেতো বটেই গোঁয়ার ছেলে হাত উঠাবে না তারই বা নিশ্চয়তা  কী? মায়ের পক্ষ নিয়ে কথা বলায় একদিন ঘুষি মেরে নাকেমুখে রক্ত ছুটিয়ে দিয়েছিলো মেয়েটার। ঘুষিগুলো যতোটা মেয়েটার নাকেমুখে পড়ছিলো, ততোধিক তীব্রতায় টলটলায়মান অস্তিত্বকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছিলো মর্জিনা খাতুনের।মর্জিনা খাতুন টের পেয়েছিলো ডাইনে বায়ে কয়েক ইঞ্চি ঘুরে ঘুষি তার নাকে মুখে পড়তে সেকেণ্ড লাগবে না। অনেক বছর স্বামীর চড় থাপ্পড়,এমনকি গলা টিপে ধরা যদিও বা সহ্য করতে পেরেছে,ছেলের চড় থাপ্পড় বা অন্যকিছু হজম করার মতো মানসিক জোর আছে কিনা এ সম্পর্কে সে আত্মবিশ্বাসী নয়।তাই চুপ থেকে সবসময়  নিজেকে আগলে রাখে সে,সময়মতো টাকা না পাওয়া নিজেরই দোষ মানে। সত্যি তো সুযোগ ফসকে গেলে টাকাগুলো পেয়ে লাভ কী!

সুযোগ মানে নেতার চ্যালা চামুণ্ডাদের দলে ভিরে যাওয়ার সুযোগ।একসাথে টাকা ইনভেস্ট করে ব্যবসা করার সুযোগ। তাদের অসীম দয়া। তারা প্রস্তাব দিয়েছে। তারা একেকজন নেতার ডানহাত বামহাত। তাদের পার্টনার হওয়ার লোকের অভাব?  উচিত হলেও  মর্জিনা খাতুনের  কোন ফুসরতই নেই বলার যে, টাকাগুলো ভবিষ্যতের জন্য ফিক্সড করে রাখা উচিত! মর্জিনা খাতুনের স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়না ছেলের হাতে তুলে দেয়া বাড়ি বন্ধক রাখা কয়েক লাখ টাকার কোন হদিসই নাই।

এখন আর রাত কই? দূর থেকে ভেসে আসা শেয়ালের ডাক, নিঝুম নিস্তব্ধতায় সুনসান চরাচর, হঠাৎ একটা দমকা বাতাসে পাতাগুলো ধাক্কা খাবে একে অপরের গায়ে,পরস্পর সেই ধাক্কা খাওয়ার শব্দ  রাতের নিস্তব্ধতাকে কেমন নিঝুম নিস্তব্ধ করে তুলবে। একটা পাতা টুপ করে ঝরে পড়বে নিচে, কান পাতলে সেই পাতা ঝরার শব্দটা রাতের নীরবতাকে ডেকে আনবে আরো গহীন করে।  দূরে কোন নিমগাছের ডালে ডাকবে কানাকুয়ো। রাতের নিস্তব্ধতায় সেই ডাক তীব্র ভয়ানক হাহাকার জাগিয়ে দেবে ঘুমন্ত পৃথিবীর না ঘুমানো কোন মানুষকে।

এই রাতে মর্জিনা খাতুন দেখে মেয়ের ঘরের বন্ধ দরজার নীচ দিয়ে তীব্র আলো ছিটকে বেরুচ্ছে। মৃদু মিউজিকও কী বাজছে?মর্জিনা খাতুন বুঝে না কী চলে ঘরের ভেতরে। কাছে ধারে কোন বাড়ি থেকে ভেসে আসে টকশোয়ের তুমুল বিতণ্ডা। ডাকসু নির্বাচন কী জাতীয় নির্বাচনের মতো একতরফা হবে? সরকার কী ভূমিকা নেবে! নিস্তব্ধ হতে চাওয়া রাতকে কাঁপিয়ে একটা বাচ্চা একটানা কেঁদে চলে অনতিদূরে।
আমি চুপিসারে দরজার নিচ দিয়ে ঢুকে পড়ি মেয়েটার ঘরে। শরীরে কাপড় চোপড় নেই,বিবস্ত্র মেয়েটা নানা অঙ্গভঙ্গি করছে মোবাইল ক্যামেরার উল্টোপাশে এক যুবকের সাথে। প্রতিদিন এই কাজ। যুবকটিরও গায়ে কোন কাপড় নেই। অন্য অনেক রাতের মতো সাক্ষী হয়ে আমি ফিরে আসি। মর্জিনা খাতুনের গিড়ায় গিড়ায় আথ্রাইটিসের ব্যাথা। খোঁড়াতে খোঁড়াতে ছেলের ঘরে উঁকি দেয়। দমবন্ধ  ধোঁয়া আর অচেনা নেশাদ্রব্যের গন্ধে ঘর ভুরভুর করছে। ইয়ার বন্ধুদের দল ঘন্টাখানেক বের হয়েছে। এবড়ো থেবড়ো গ্লাস প্লেট। ছড়ানো ছিটানো ইস্কাবনের টেক্কা। এশট্রে ভর্তি সেগেরেটের মাথা। মর্জিনা খাতুন লাইটের সুইচ অফ করে আবার খোঁড়াতে খোঁড়াতে নিজের বিছানায় শুয়ে পড়ে। একটা মোটামুটি নির্বিঘ্ন দিন পার করার স্বস্তিতে।আমি লম্বা শুর দুটো খাড়া করে গন্ধ শুঁকে শুঁকে রান্নাঘরের দিকে যাই,  খাবারের উৎসমুখে।

পরদিন সকাল থেকে দুপুর দুপুর থেকে বিকাল একটানা বসে থেকে তার সঙ্গে ডিস্ট্রিক্ট একাউন্টস অফিস ঘুরে ত্রিশ লাখ টাকার চেক নিয়ে ঘরে ঢুকলে আমি আন্দাজ করি আজ ঘরে শান্তি ফিরবে। রাস্তা পার হতে হতে, কানে হেডফোন লাগানো লালচুলের ছেলেটাকে পাশ কাটাতে কাটাতে, নিউ বরকত লেদার স্টোর ঝাড়ু দেয়া ধুলো বোরকায় এসে পড়লে ঝাড়তে ঝাড়তে মর্জিনা খাতুন ভাবে বাসায় গিয়েই চেকটা তুলে দিতে হবে ছেলের হাতে। নিত্য এই অশান্তি থেকে মুক্তি চাই। ভবিষ্যত যেমনে চলবে চলুক।

অবিবাহিত তিন বোন ঘরে রেখে বাপ যখন মরলো,তখন সে ভেবে আকুল হয়েছে,কী হবে তাদের। বোনগুলো যার যেদিকে চোখ যায় সেদিকে চলে যাবার মতো পথ খোঁজে নিলে সে নিজের কী হবে ভেবে কতো রাত বালিশ ভিজিয়ে নির্ঘুম কাটিয়েছে। দুইমাসের পোয়াতি অবস্থায় তরিকুল ইসলাম বিয়ে করে ঘরে তুলতে পারবে না জানালে ইঁদুর মারার বিষ খেয়েছে। তখনো বেঁচে গিয়েছে।টিকে গিয়েছে।

 তরিকুল ইসলাম যেদিন চাকরি হারিয়েছে সেদিনও সে সংসার কেমনে চলবে ভেবেছে,চাকরি যখন ফিরে পেয়েছে তখনো  ক্লান্ত হয়েছে আবার কী করে বসে ভেবে। অফিসের সহকর্মী আব্দুল মালেক যখন জানায় তরিকুল হার্ট এটাকে হাসপাতালে নেয়ার আগেই মারা গেছে তখনো সে ভেবেছে ভবিষ্যৎ কী হবে। পাওনা টাকাকড়ি আদায়ের জন্য অফিসে অফিসে দৌড়াতে দৌড়াতে সে ভবিষ্যতের কথাই ভেবেছে।ছেলেটার একটা আয় রোজগারের ব্যবস্থা,মেয়েটার বিয়ে,বন্ধক দেয়া বাড়িটা উদ্ধার!

ঘরে আজও পাড়া মাথায় তোলা চেঁচামিচি। হৈচৈ, ধূসর হয়ে যাওয়া ড্রেসিং টেবিলের গ্লাস ভাঙা.......,কুড়ি বছর পুরানো ধুঁকে ধুঁকে চলতে থাকা দেয়াল ঘড়িটা খানখান । মর্জিনা খাতুন সব ভাবাভাবি দূরে ঠেলে সিদ্ধান্ত নেয় টাকার চেকটা চোখ বন্ধ করে ছেলেটার হাতে তুলে দেবে।অনেক ভাবা হয়েছে জীবনভর। আর না।  যেভাবে পারে মেয়ের বিয়ের  দেবে। বাড়িটা চলে গেলে বস্তিতে গিয়ে উঠবে,খাবার না জুটলে না জুটবে। আপাতত ছেলেরে শান্ত করা দরকার।নিত্য এই বুক ধড়ফড় করা তটস্থ জীবন আর ভাল্লাগেনা। বুঝি এই প্রথমবার একটুখানি নিজের মতো হবার সাধ জাগে তার। ভাঙা কাঁচ আর থেমে যাওয়া ঘড়ির কাঁটার মাঝে দাঁড়িয়ে সিদ্ধান্ত নেয় এখন অনিশ্চিতের হাতেই সঁপে দেবে সে নিজেকে, ঝড়ের রাতে মধ্যসমুদ্রে পথ হারানো নাবিকের মতো হাল ছেড়ে দেবে। তাদেরও কেউ না কেউ টিকে থাকে। সবাই সমুদ্রের অতলে নিঁখোজ হয়ে যায় না।

 কিন্তু না। ঘরে ঢুকে আঁচ করে ঘরে ছেলের উন্মাদ চেঁচানোতে  আজ অন্য অশান্তি।  গ্লাস প্লেট ভাঙায়  সীমাবদ্ধ উন্মাদনা আজ ড্রেসিং টেবিলের আয়না আর দেয়াল ঘড়ি পেরিয়ে মেয়ের বন্ধ দরজায় দুম দুম লাথি পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে।রান্নাঘরের ধারালো বটি নিয়ে ছেলে বসে আছে মেয়ের বন্ধ দরজার সামনে,যেনো পালিয়ে বেড়ানো রাতা মোরগ বের হলেই ধরে জবাই করার অপেক্ষায়।  মর্জিনা খাতুনের হতভম্ব চেহারা দেখে সে চুপি চুপি নয়, গলা ফাটিয়ে জানান দেয় ঘটনা।   মেয়ের উলঙ্গ ভিডিও শহরে ছেলেদের হাতে হাতে। মর্জিনা খাতুনরে কে চিনে,ছেলে চিৎকার করে, তর আছেই কী আর হারাবি কী! সত্যি তো বাপ চুরির দায়ে চাকরি হারিয়ে কুখ্যাত  হয়েছে। পাঁচজনের কাছে পরিচয় দিতে লজ্জা হয়। মর্জিনা খাতুনরে চিনে কে। শহরে ছেলে নিজে একটুখানি ইমেজ তৈরির চেষ্টা শুরু করেছে মাত্র।নেতার পিছনে শ্লোগান ধরে, সাঙ্গপাঙ্গদের সাথে ব্যবসা করে জাতে উঠতে চাইছে। সাঙ্গপাঙ্গরা নির্বিবাদে গভীর রাত অবধি আসর বসানোর নিরাপদ স্থান পেয়ে ছেলেটাকে আপন করে নিয়েছে।
আর তখনই বোনের আবার এই কীর্তি। হয় আজ নিজে মরমু নয় তরারে মারমু। ছেলের উন্মাদ, বেহুশ, উন্মত্ততার কাছে নিজেকে অসহায় লাগে মর্জিনা  খাতুনের। বটি নিয়ে বন্ধ দরজার সামনে কতোক্ষন পরপর হুঙ্কার ছাড়ে সে,বের হ মাগি.......।

হাই সুগার, হাই ব্লাডপ্রেসার আর আথ্রাইটিসের ব্যাথা নিয়ে সারারাত নির্ঘুম কাটে মর্জিনা খাতুনের। খুব কষ্ট হয় তার। কিন্তু সংসারে কে কবে বুঝতে চেয়েছে তার কষ্ট!  আমিও এক প্রজাতি  চুপচাপ দেখা ছাড়া আমার কিছু করার নেই।

ভোরের দিকে চোখদুটো একটু তন্দ্রামতো জড়িয়ে এলে হঠাৎ ছেলের এক চিৎকারে তন্দ্রা টুটে যায় মর্জিনা খাতুনের। ধড়ফড় করে উঠে বসে সে। চশমা ব্যাগ হাতড়ে বেড়ায়, যত্ন করে ব্যাগের ভেতরে ডায়েরির ভাঁজে  লুকিয়ে রেখেছে সে চেকটা। ছেলেকে জানানো  হয়নি চেক পাবার কথা ,ঘরে ঢুকে বিকট পরিবেশে বলার সুযোগই পায়নি। গত কয়েকমাস এই "চেক -চেক" ক্রম উৎপাতে গতরাতে ছেলের অন্য কারণের উন্মত্ততা প্রথমটায় মনেই পড়ে না তার।বোধহয় চেকের জন্যই এই চিৎকার।

চেকটা হাতে নিয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে ঘর থেকে বের হতেই ছেলে হ্যাঁচকা টানে নিয়ে দাঁড় করায় মেয়ের ঘরের সামনে, মেয়েটা গলায় উড়না পেঁচিয়ে ফ্যানের সাথে ঝুলছে। মেয়ের মুখের দিকে ঠিকমতো তাকায় কি তাকায় না মর্জিনা খাতুন দেখে ছেলেটার চোখদুটো তীব্র লাল,যেনো ফুঁড়ে তেড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে কামানের অগ্নিগোলার মতো। জেগে থাকা ক্লান্তির সাথে দুচোখে যুক্ত হয়েছে উন্মত্ত ক্রোধ। বাড়িত গেছেই,এই মাগিও পথ দেখছে.....ছেলেটা অনুচ্চ স্বরে বিষাক্ত সাপের মতো ফোঁসফোঁস করে। তুই বাঁইচ্যা থাইক্যা আর কী করবি!  উন্মত্ত ছেলের ধেয়ে আসা হাত দুটোর সামনে সে চেকটা তোলে ধরে, বারবার বলতে থাকে আমি নিয়ত করছিলাম বাপ,টাকাগুলো তরে দিয়া দিতাম......।

এখন রাতের চেয়ে সকালটাই বরং বেশি নিঝুম। রাতজাগা মানুষের দিন শুরু হয় তখন,যখন প্রথম আলো লাল আবীর রঙের পোশাক ছেড়ে দেয়। আগুনের হল্কার মতো কড়া হলুদের গাঢ়তা ছড়াতে শুরু করে তাপের তীব্রতার সাথে পাল্লা দিয়ে। কোথাও ভোর হবার সংবাদ ছড়িয়ে কুক্কুরুকু সুরে মোরগ ডেকে উঠে না,তবে  রাস্তায় রিক্সা গাড়ির তেমন হুল্লোড় থাকেনা। কাকেদের তারজাল-খড়কুটোর বাসাবাড়ি নেই কাছেপিঠে,  মোবাইল টাওয়ারের রশ্মি সব গিলে খেয়েছে। সমস্বরের কাকা আওয়াজ আর রাত পোহানোর বার্তা জানান দেয়না। আমি বুকে দুরুদুরু ছাতার শিকে ঝুলে থাকি মর্জিনা খাতুনের অপেক্ষায়। আমার মতোই তীব্র বাঁচার ক্ষমতা নিয়ে যদি জেগে উঠে আরেকটা সকালটা দেখে!