Thursday, December 26

রাব্বীনূর আলী - তেভাগা আন্দোলন এবং আবু ইসহাকের ‘জোঁক’ : একটি বিকল্প প্রস্তাব




রাব্বীনূর আলী
তেভাগা আন্দোলন এবং আবু ইসহাকের ‘জোঁক’ : একটি বিকল্প প্রস্তাব



পরাধীন ভারতবর্ষের অবিভক্ত বাংলায় জমিদারি প্রথায় কৃষক-শ্রমিকদের উৎপাদিত পণ্যের তিন ভাগের দুই ভাগ দিতে হতো জমিদারকে। সেই ভাগের অর্থ দিয়ে জোতদার-জমিদাররা শহরে বিলাসবহুল জীবনযাপন করতো। ফলত এর বিরুদ্ধে আপামর কৃষক-শ্রমিকরা তাদের উৎপাদিত ফসলের দুই তৃতীয়াংশের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে, যা ইতিহাসে তেভাগা আন্দোলন নামে পরিচিত। তেভাগা শব্দের প্রচলিত অর্থে ভাগচাষী তাদের ভাগচাষের অধিকারস্বরূপ উৎপাদনের সমান অংশ বা দুই ভাগের এক ভাগ পাওয়ার অধিকারী। ১৯৪৬-৪৭ সাল নাগাদ স্বাধীনতার প্রাক্‌ মুহূর্তে ভূমি মালিক এবং ভাগচাষীদের মধ্যে উৎপাদিত শস্য সমান দুই ভাগ করার পদ্ধতির বিরুদ্ধে বর্গাদাররা প্রবল আন্দোলন গড়ে তোলে। তৎকালীন পূর্ব বাংলা এবং পশ্চিমবঙ্গে এই আন্দোলন সংগঠিত হয়। মূলত এই আন্দোলন সংগঠিত করেন বাংলার প্রাদেশিক কৃষকসভার কম্যুনিস্ট কর্মীরা। তাদের নেতৃত্বে বর্গাচাষীরা ভূমি মালিক শ্রেণির বিরুদ্ধে আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ হয়। বাংলার ১৯ টি জেলায় এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। ভূমি মালিকরা ভাগ-চাষীদের দাবি প্রত্যাখ্যান করে পুলিশ দিয়ে আন্দোলনকারীদের অনেককেই গ্রেফতার করে। কিন্তু জমিদারের দমনেও আন্দোলন স্তিমিত হয়ে যায়নি। রংপুর, দিনাজপুর, খুলনা, ময়মনসিংহ, যশোর, জলপাইগুড়ি এবং চব্বিশ পরগনা প্রভৃতি জায়গায় আন্দোলন ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। জলপাইগুড়ি, যশোর এবং দিনাজপুর তেভাগা এলাকা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। আন্দোলনের চাপে অনেক ভূস্বামী তেভাগা আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা প্রত্যাহার করে নেয়। পরবর্তীকালে ১৯৪৭ সালে তদানীন্তন মুসলিম লীগ সরকার বিধানসভায় বর্গা প্রথা সংস্কারের উদ্দেশ্যে একটি বিল উত্থাপন করে। এই বিল বর্গাদার আন্দোলনে যেমন উৎসাহের সঞ্চার করে, তেমনই তেভাগা আন্দোলন সম্পর্কে একটা সহজ মনোভাবও গড়ে তোলে। শেষ পর্যন্ত এই নিপীড়িত আইনের বিরুদ্ধে লড়াই করে কৃষক-শ্রমিকরা জয়লাভ করে।
      তেভাগা আন্দোলনের এই কৃষক অভ্যুত্থানকে কেন্দ্র করে  বাংলা সাহিত্যে রচিত হয়েছে অজস্র শিল্প-সাহিত্য-নাটক। প্রথিতযশা সাহিত্যিকেরা তেভাগা আন্দোলনের ওপর অসংখ্য কবিতা-উপন্যাস-ছোটগল্প রচনা করেছেন। বাংলা ছোটগল্পে তেভাগা কৃষক সংগ্রামের বাস্তব চিত্র ফুটে উঠেছে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘হারানের নাত জামাই’, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘বন্দুক’, সমরেশ বসুর ‘প্রতিরোধ’, সৌরি ঘটকের ‘কমরেড’ প্রভৃতি গল্পে। এছাড়াও আরও অনেক গল্পকার তাঁদের লেখায় তেভাগা কৃষক সংগ্রামকে তুলে ধরেছেন।
        আমাদের আলোচ্য বাংলাদেশের বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক আবু ইসহাক (১৯২৬-২০০৩) সেই তেভাগা কৃষক আন্দোলনকে তুলে ধরেছেন তাঁর ‘জোঁক’ গল্পে। গল্পটি ‘মহাপতঙ্গ’(১৯৬৩) গল্পগ্রন্থের অন্তর্গত। রচিত হয় ১৯৫৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। আবু ইসহাক তখন পুলিশ বিভাগের পরিদর্শক হিসেবে করাচিতে কাজ করছিলেন। গল্পকার হিসেবে আবু ইসহাকের চল্লিশের দশকে উত্থান ঘটলেও তিনি সর্বদা নিজেকে অন্তরালে রাখতেন। তাঁর সাহিত্য পরিধি বিবেচনা করলেই আমরা খুঁজে পাব বাস্তবতা। মূলত বাস্তবধর্মী গল্পকার তিনি। যারা প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করছে তাদেরকে তিনি তাঁর গল্পের উপাদান করেছেন। সেই চিত্রই আমরা খুঁজে পাই তাঁর ‘জোঁক’ গল্পে। দেশের শোষক শ্রেণির দ্বারা নির্যাতিত, নিপীড়িত কৃষক সমাজকে আবু ইসহাক তাঁর এই গল্পে তুলে ধরেছেন। জোঁক একটি পতঙ্গ হলেও গল্পকার সেটিকে একটি রূপক হিসেবে পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন। গল্পে ভূমিহীন দরিদ্র কৃষক ওসমান জোতদার ওয়াজেদ চৌধুরী এবং তার ছেলে ইউসুফ চৌধুরীর ছল চাতুরির দ্বারা প্রতারিত হয়েছে। ওয়াজেদ চৌধুরী শহরের প্রতিভাবান চাকুরীজীবী। ওসমান তার জমিতে ফসল আবাদ করে। গল্পের শুরুতেই গল্পকার ওসমানের উক্তির মাধ্যমে একজন কৃষকের নিত্যনৈমিত্তিক জীবনাচারকে তুলে ধরেছেন-
          ‘সেদ্ধ মিষ্টি আলুর কয়েক টুকরো পেটে জামিন দেয় ওসমান। ভাতের অভাবে অন্য
          কিছু দিয়ে  উদরপূর্তির  নাম চাষী-মজুরের  ভাষায় পেটে জামিন দেয়া। চাল যখন
          দুর্মূল্য তখন এ ছাড়া উপায় কি?’
                  (আবু ইসহাক, নির্বাচিত গল্প সমগ্র, নওরাজ সাহিত্য সম্ভার, প্রথম সংস্করণ,
                   ২০০৫, পৃ- ১৩০)
এই খেয়েই ওসমানদের কাজে যেতে হয় স্ত্রী-সন্তানের মুখে অন্ন জোগানোর আশায়। ওসমান জোতদার ওয়াজেদ চৌধুরীর জমিতে চাষাবাদ করে। কাজে যাবার সময় সঙ্গে নেয় তার দশ বছরের ছেলে তোতাকে, পড়াশুনার পাশাপাশি তোতা পিতার কাজে সহযোগিতা করে। শ্রাবণের ভরা বর্ষায় ওসমানের আবাদ করা পাটক্ষেত স্বল্প জলে ডুবে থাকে। ওসমান তাই নৌকা করে তার  পাটক্ষেতে যায় এবং পাটক্ষেত দেখে আনন্দে আপ্লুত হয়ে উঠে। গল্পকার লিখেছেন-
         
            ‘পাট গাছগুলোর  দিকে  তাকিয়ে  ওসমানের  চোখ তৃপ্তিতে ভরে ওঠে। যেমন
            মোটা হয়েছে, লম্বাও হয়েছে প্রায় দুই-মানুষ সমান। তার খাটুনি সার্থক হয়েছে।’           
                                                                         (তদেব, পৃ- ১৩০)
কিন্তু সুপুষ্ট পাট গাছ দেখে আনন্দ হলেও ক্ষণিকেই তার মুখ ম্লান হয়ে যায়। কেননা এতো কঠোর পরিশ্রমের ফসল তার একার নয়। সে শুধুমাত্র এই আবাদের ভাগচাষী। জোতদার ওয়াজেদ চৌধুরীর গোমস্তা সঠিক সময়ে এসে সেই চাষের অর্ধেক ভাগ নিয়ে যায়। প্রতি মরশুমের সময় ওয়াজেদ চৌধুরীর ছেলে ইউসুফ ঢাকা থেকে এসে ধান-পাট বিক্রি করে সেই ভাগের টাকা নিয়ে আবার ঢাকায় চলে যায়। তাই সে আক্ষেপ করে ভাবে, তার মেহনতের ফসলে যদি কেউ ভাগ না বসাত তাহলে সবটাই সে পেত। এসব ভাবতে গিয়ে তার মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। কারণ পাট কাটতে গিয়ে তাকে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করতে হয়েছে, পানি কামড়ানো, জোঁকের কামড়ও খেতে হয়েছে। রাগ করে সে তার আবাদি পাট গাছগুলোকেই গালাগাল দিয়ে ওঠে-
             ‘আমরা না খাইয়া শুকাইয়া মরি, আর এই শালার পাটগুলা মোট্টা অইছে কত।
             কাচিতে ধরে না। ক্যান্‌ চিক্কণ চিক্কণ অইতে দোষ আছিল কি? হে অইসে এক
             পোচে দিতাম সাবাড় কইরা।’  (তদেব, পৃ- ১৩২)
ওসমান জলের তলায় পাট কাটার দরুণ ক্রমাগত ওঠা-নামা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। খিদার চোটে সে জমিদারের উপরেও ক্ষিপ্ত হয়ে বিড়বিড় করে বলে-
             ‘ব্যাডা তো ঢাকার শহরে ফটেং বাবু অইয়া বইসা আছে। থাবাডা দিয়া আধাডা
             ভাগ লইয়া যাইব। ব্যাডারে একদিন পচা পানির কমড়া খাওয়াইতে পারতাম!’
                                                                           (তদেব, পৃ- ১৩২)
এ শুধু ওসমানের নয়, এ যেন সমগ্র কৃষক সমাজের সংগ্রামী মনোভাবাপন্ন দৃষ্টিভঙ্গী। যারা প্রতিনিয়ত জুলুমকারীর শোষণ-বঞ্চনাকে সহ্য করে চলেছে। আর তাই ওসমানের পায়ে জোঁক লাগার ফলে তার রক্ত দেখে তোতা যখন বলে ওঠে-
            ‘ইস্‌, কত রক্ত!...বাজান কেমুন কইর‍্যা জোঁক ধরল তোমারে, টের পাও নাই?’
                                                                         (তদেব, পৃ- ১৩৩)
এর প্রত্যুতরে ওসমান তার ছেলেকে বলে-
           ‘ এইডা আর এমুন কী জোঁক। এরচে বড় জোঁকও আছে।’ (তদেব, পৃ- ১৩৪)
বলার অপেক্ষা রাখে না এ জোঁক আর কেউ নয়, এরা হল সমাজের শীর্ষস্থানীয় শোষকশ্রেণি। এরা
দিনের পর দিন ওসমানের মতো কৃষকের রক্ত খেয়ে জোরপূর্বক তাদের অধিকার কয়েম করে নেয়। জোঁক যেমন ফাক পেলে মলদ্বার দিয়ে পেটের মধ্যে গিয়ে নাড়ী কেটে দেয় ঠিক তেমনি এই শোষকশ্রেনিরা কৃষকদের দিয়ে কাজ করিয়ে তাদের প্রাপ্য পাওনা না দিয়ে তিলে তিলে তাদের জীবনকে ধুলিস্বাৎ করে দেয়। গল্পকার জোঁক-কে তাই রূপক হিসেবে ব্যবহার করে সমগ্র গল্পে  শোষকদের দ্বারা শোষিত, নির্যাতিত কৃষক সমাজকে তুলে ধরেছেন।
       গল্পের শেষ পর্যায়ে ওসমান তার কষ্টের ফলানো ফসল যখন ঘরে নিয়ে আসে ঠিক তখনই ওয়াজেদ চৌধুরীর গোমস্তা ওসমানের বাড়ির ঘাটে দাড়ি-পাল্লা নিয়ে হাজির হয়। গোমস্তার কয়াল উৎপন্ন পাট মেপে মেপে তিন ভাগ করে। ওসমান ভাবে হয়তো তেভাগা আইন পাশ হয়ে গেছে এবং উৎপাদিত ফসলের তিন ভাগের দুই ভাগ সে পাবে- এ আশা করেছিল। কিন্তু না; গোমস্তা ফসলের তিন ভাগের দুই ভাগ দাবি করে। এই কথা শুনে ওসমানের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে। পচা পানিতে নেমে বিষাক্ত প্রাণীর কামড় খেয়ে  অক্লান্ত পরিশ্রম করে সে চাষাবাদ করেছে, সেই ফসলের সাথে জড়িয়ে আছে তার জীবনের সুখ অথচ অত্যাচারী শোষকের এই নির্মম আচরণে ওসমান বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে। সে তৎক্ষণাৎ সেখান থেকে উঠে ওয়াজেদ চৌধুরীর ছেলে ইউসুফ চৌধুরীর বৈঠকখানায় চলে যায় এর কারণ জানতে। কিন্তু কিছু বুঝে উঠার আগেই ইউসুফ চৌধুরী  ফসলের সিংহভাগ দাবি করার কারণস্বরূপ জানায়, ওসমান লাঙল গরু কেনা বাবদ তাদের কাছ থেকে গত বছর টিপসই দিয়ে ৫০০ টাকা নিয়েছিল। তাই ওসমান ফসলের এক ভাগ পাবে। অথচ ওসমান এসবের কিছুই জানে না। কারণ টিপসই সে গত বছর দিয়েছিল ঠিকই কিন্তু সেটা ছিল জমি বর্গা নেওয়ার বন্দোবস্তস্বরূপ একটা লিখিত দলিল। নিরীহ ওসমান বুঝতে পারেনি এটা ছিল জমিদারের ধোঁকাবাজি। আর আইনের একটা ধারায় বলা ছিল- ‘জমির মালিক লাঙ্গল-গরু সরবরাহ করিলে বা ঐ উদ্দেশ্যে টাকা দিলে উৎপন্ন শস্যের অর্ধাংশ পাইবেন।’ (তদেব, পৃ- ১৩৫) সেই সুযোগকেই কাজে লাগিয়ে জোতদার ওয়াজেদ চৌধুরী তার ছেলেকে দিয়ে ওসমানদের মতো নিরক্ষর ভাগ-চাষীদের কাছ থেকে কাগজে টিপসই নিয়েছিল। তাই তাদের কাছে গিয়ে ওসমানের লাভ হয় না কিছু। ইউসুফ চৌধুরীও তার পিতার মতোই রক্তচোষা জোঁকে পরিণত হয়েছে। আইনের পরোয়া করে না তারা। আইন তাদের হাতের মুঠোয়-
             ‘আইন! আইন করে কি আর আমাদের আটকাতে পারে। আমরা সূচের ফুটো
             দিয়ে আসি আর যাই। হোক না আইন। কিন্তু আমরা জানি, কেমন করে
             আইনকে ‘বাইপাস’ করতে হয়। হুঁ হ্‌ হুঁ।’ (তদেব, পৃ- ১৩৫)
       জমিদারের বঞ্চনার শিকার অসহায় ওসমান প্রতাড়িত হয়ে বিলাপ করতে থাকে। তার মন থেকে রঙিন স্বপ্নগুলো হারিয়ে যায়। সে ক্লান্ত, বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে। আর জোঁকরূপী রক্তশোষক ভূস্বামীরা এভাবেই ওসমানের মতো অসংখ্য ভূমিহীন কৃষকের উপর দিনের পর দিন নির্যাতন করতে থাকে।
       পরিশেষে এই ঘটনার আকস্মিকতায় ওসমান ছেলে তোতাকে নিয়ে পাগলের মতো টলতে টলতে চৌধুরীবাড়ির সীমানা পার হয়। সে সময় দেখা হয় আরেক চাষী করিম গাজীর সঙ্গে। নবুখাঁ সহ আরও দশ-বারো জন চাষীও তার সঙ্গে ছিল। এরা কেউই অত্যাচারী জোতদারের কালো হাতের আস্ফালন থেকে রেহাই পায়নি। তাই তারা সমবেত হয়ে এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর পরিকল্পনা করে। ইউসুফ চৌধুরীর মিথ্যার কাছে নেতিয়ে পড়া ওসমান ভুয়া টিপসই দিয়ে চাষীদের কাছ থেকে উৎপাদিত শস্যের তিন ভাগের দুই ভাগ লুফে নেওয়ার প্রতিবাদে শামিল হওয়ার সাহস পায় না দেখে করিম গাজী ওসমানকে তাড়া দিয়ে বলে-
              ‘চল আমাগ লগে দেখি কি করতে পারি!...আরে এমনেও মরছি অমনেও
              মরছি। একটা কিছু না কইড়্যা ছাইড়্যা দিমু?’  (তদেব, পৃ- ১৩৬)
তাদের ঝিমিয়ে পড়া রক্ত আবার জেগে ওঠে। তারা তাদের স্বাধিকারের দাবিতে এবং জমিদারের এই ঘৃণ্য প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেমে পড়ে। ওসমান গা ঝাড়া দিয়ে বলে-
            ‘হঁ, চল। রক্ত চুইষ্যা খাইছে। অজম করতে দিমু না, যা থাকে কপালে।’
                                                                       (তদেব, পৃ- ১৩৬)
        যুগ-যুগান্তর ধরে বঞ্চিত ও শোষিত মানুষের জোতদার-জমিদারের বিরুদ্ধে এই যে রুখে দাঁড়ানো, এই যে প্রতিবাদী মনোভাব- তেভাগা আন্দোলনের প্রকৃত সাফল্য এখানেই। আর এখানেই ওসমানের মতো কৃষকেরা জয়ী।







সহায়ক গ্রন্থ
১. আবু ইসহাক। নির্বাচিত গল্প সমগ্র। নওরাজ সাহিত্য সম্ভার। ঢাকা। ২০০৫।
২. জয়ন্ত ভট্টাচার্য। বাংলার তেভাগা,তেভাগার সংগ্রাম। ন্যাশনাল বুক এজেন্সি। কলকাতা। ১৯৯৬।
৩. ধনঞ্জয় রায়। তেভাগা আন্দোলন। আনন্দ। কলকাতা। ২০০০।
৪. সোমনাথ হোড়। তেভাগার ডায়েরি। সুবর্ণরেখা। কলকাতা। ১৯৯১।




তন্বী হালদারের অণুগল্প : পাষাণ কন্যার কথকতা






তন্বী হালদার
পাষাণ কন্যার কথকথা


শুনেছিলাম, কার যেন অভিশাপে আমি পাষাণ হয়ে যাব বলে, বহুদিন আগেই টেলিকাস্ট হয়ে গিয়েছিল। প্রথমটা গুজব বলে কান দিই নি - ভেবেছিলাম এমনটা তো কতই হয়। যে মহিলার গর্ভে ভ্রূণ হয়ে গুটিসুটি মেরে যখন ছিলাম তখন শুনেছিলাম সেই মহিলা খেদোক্তি করছেন – ও যদি ভূমিষ্ঠ হয়ে পাষাণ হয়েই যায় তাহলে জন্ম দিয়ে কী লাভ? ঐ মহিলার স্বামী যিনি পাবলিকলি আমার পিতা বলে স্কুলের খাতায় নাম লেখা আছে, তিনি বললেন – থাক্‌ তবুও .........। এখন তো নানারকম আধুনিক চিকিৎসা বেরিয়েছে যদি কিছু ব্যবস্থা করা যায়! এরপর যা হয় আর কি – পাষাণ, পাষাণ, পাষাণ কন্যার নামের পাশে থাকে লজ্জা, ঘেন্না, অবহেলা, অত্যাচার, লাঞ্ছনা, অপমানের সমস্ত রকম যতিচিহ্ন। ঐ মহিলা আর তার স্বামীর প্রবল ক্ষোভে এতগুলো থেরাপি দেওয়া হচ্ছে তবু পাষাণ জেগে ওঠে কই?
স্কুলে কোনোদিন প্রথম দশজনের মধ্যেও থাকা হল না। কোনও বন্ধু হল না। কেমন শক্ত শক্ত হাত পা নিয়ে জীববিজ্ঞানের ক্লাসে মানুষের হৃদয়ে রক্ত সঞ্চালনের ছবি আঁকবার পর দিদিমণি কৌতূহলে জিজ্ঞাসা করেন – হ্যাঁরে তোরও কি আমাদের মতই হৃদয় ......। আমি ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকি। পাষাণ বলেই হয়তো আমার সমস্ত অনুভূতি খুব প্রবল। গ্রীষ্মে অসম্ভব তপ্ত হয়ে উঠি। শীতে পুরো জমে যাই। বর্ষায় হাজার ভিজলেও সর্দিকাশি কিছু হয় না।
কলেজ যাওয়ার পর সে এক অভিজ্ঞতা – থার্ড ইয়ার কেমিস্ট্রি অনার্সের একটা ছেলে বললো – আচ্ছা তোমার সমস্ত অরগ্যানও কি আর সব মেয়েদের মতো। ছেলেটা অনায়াসে আমার জামার ভিতর তার হাত রেখে বলে – ছ্যাঁ – এতো পাথর! সে ছেলের বিয়েতে মেয়ের বাড়ির পরিচয় সূত্রে নিমন্ত্রণ হয়েছিল। গিয়েছিলাম।
এরপর কত আলোকবর্ষ সময় পার হয়ে আজ এখানে পৌঁছেছি। শুনেছি যে মহিলার গর্ভে ভ্রূণ হয়ে একসময় আমি ছিলাম, তার স্বামী মারা গেছেন। মহিলা এখন অ্যালঝাইমারের পেসেন্ট। সব ভুলে গেছে। এমন কি এক সময় এক পাষাণ কন্যা জন্ম দেওয়ার জন্য তার লাইমলাইটে আসার ঘটনাও। পাষাণ বলেই আমার বয়স বাড়ে নি। চোখের নীচে রিংকেল আসেনি। টোন্‌ড দেহ। শুধু একটু উজ্জ্বলতা কমে গেছে। কিছুদিন হল আমি একটা জিনিস আবিষ্কার করেছি, তা হল - আমার শক্ত বুকের নীচে নরম তলতলে কী যেন একটা আছে। কী সেটা? সেটাই কি ব্ল্যাক বোর্ডে আঁকা মানুষের হৃদয়! ইউরেকা! তার মানে –
আমাকে জন্মের পর থেকে মানবী করে তোলবার জন্য যে সমস্ত থেরাপিগুলো চলেছিল, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রত্যেকটার সম্পর্কে অনুসন্ধান চালাতে গিয়ে একটা জার্নালে জানলাম - আসল এবং প্রধান থেরাপিটাই নাকি আমার উপর প্রয়োগ করা হয়নি। তা হল ভালোবাসা। ভালোবেসে কেউ যদি আমাকে স্পর্শ করে তবেই নাকি আমি অন্যরকম হয়ে যাব। যেমনটা ত্রেতাযুগে অহল্যা হয়েছিলেন। কিন্তু এতগুলো দিন পরে আমার কি আর মানবী হয়ে বাঁচতে ইচ্ছা করবে? আমিই বা ভিক্ষুণীর মতো কারও পথ চেয়ে বসে থাকবো কেন? আমারও তো আমার মত করে বাঁচবার অধিকার আছে। তাই না?

খোকন বর্মন - মধ্যরাতের ঘরবদল : সেলিনা হোসেন


খোকন বর্মন
মধ্যরাতের ঘরবদল : সেলিনা হোসেন


আকাশের সীমান্ত নেই।মেঘেদের কি কখনো দেশভাগ হয়? তবে ধরণীর সীমান্ত আছে ,মানুষের তৈরি সীমান্ত  সেই সীমান্তের অংশ ছিটমহল ।
আমরা হিন্দুরো শুয়োর নোয়াই আর মুসলিমেরও গরু নোয়াই আজকের মধরাতের  পর থেকে আর এই অন্তর্দ্বন্দ্ব কাজ করবে না। কিছুক্ষন পর আমরা পাব নতুন সূর্য, একটা  নতুন ভোর সেই ভোরের আলো গায়ে মেখে  আমরা শামুকের মতো খোলস ছড়াব।এখন থেকে আমরা শক্ত পায়ে হাঁটব ,হামাগুড়ি দেওয়ার দিন ফুরিয়ে এসেছে ,আজ থেকে আমরা বন্দী মানুষ না মধ্যরাতের পর থেকে আমরা স্বাধীন আমরা স্বাধীন।
ছিটমহলের কথা শুনলেই আমাদের হৃদয়ের রংমহল যেন মুহূর্তে ফ্যাকাসে হয়ে আসে । এই মানবজীবন ,ধরলা নদী, প্রেমপ্রীতি ,গাঢ় স্মৃতিকে এক সূত্রে গেঁথে ছিটজীবনের সাতরং আঁকলেন  ওপর বাংলার গল্পকার সেলিনা হোসেন। ছিটবাসীদের গ্লানিময়জীবন এবং স্বাধীনতার আকাঙ্খাকে   তুলে ধরলেন "মধ্যরাতের ঘরবদল " এ। ইউনিক একটি সমস্যাকে তুলে ধরলেন জীবনের কঠোর বাস্তবতায়। ছিটমহলবাসীদের আঁতের কথা তুলে আনলেন আমাদের সামনে। নাগরিকত্ব এবং নিখাদ প্রেমের মধ্যে
স্বাধীনতা প্রাপ্তির স্বাদকে সামনে রেখে তিনি বের করে আনলেন  আঁতের কথা, সৃষ্টি করলেন একটি স্বতন্ত্র ধারার।সোলেমান মিয়া মনে করেন এতদিন বাদে সে মানুষ হল অন্যদিকে  অবনীশ জন্মভূমি  কিছুতেই ছাড়বে না  প্রয়োজনে প্রেম ছাড়বে
খুব সহজেই যেন তার মুখ থেকে বেরিয়ে আসে প্রথম প্রেমের স্মৃতি আঁকড়েই সে না হয় বেঁচে থাকবে ।প্রেমকে উপেক্ষা করে অবনীশের কাছে বড়ো হয়ে ওঠে আত্মপরিচয়,দেশপরিচয়।
আশায় বাঁচে চাষা ।এতদিন পাটগ্রামের ভুয়ো ঠিকানা নিয়ে লেখাপড়া করেছে, এতদিন তার মনে ছিল প্রবল ভয়। সে এখানকার ডিগ্রি দিয়ে চাকরি করতে পারবে না কিন্তু আজ মধ্যরাতের পর থেকে সে ভয় আর তার মধ্যে থাকল না।এখন সে দেশ পাবে ,নাগরিকত্ব পাবে ,চাকরি পাবে, নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করবে ।
সেমন্তী চায় না কেউ তাকে ছিটমহলের বাসিন্দা বলুক ,এখন সে দেশ পাবে ।এ আশায় যেন মিশে রয়েছে তার স্বাভাবিক জীবনের স্বাদ। এসবের ঘোর কেটে গেলে সে আবার দুঃখে ডোবে।এভাবেই একটি প্রেম   মধ্যরাত্রে  অগ্রসর হতে থাকে মৃত্যুর দিকে।
সাতচল্লিশের দেশভাগের সময় ভারত ও পাকিস্তান দুটো দেশ তৈরি হয় কিন্তু ছিটবাসীরা কোনো দেশ পায় নি তখন থেকেই তাদের মনে দেশপ্রাপ্তির আকাঙ্খা  ।সেই দিন টিও ছিল শুক্রবার আর আজকের মধ্যরাত্রের স্বাধীনতার দিনটিও শুক্রবার  ,মাঝখানের আটষট্টি বছরের স্মৃতি রোমন্থন করে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে হারাধন। তাদের জীবনের আর একটি শুক্রবার এবং মধ্যরাত্রে নাগরিকত্ব পাওয়ার আনন্দ মিলে মিশে এক হয়ে যায়,স্মৃতি তাদের কাঁদায়  ,আনন্দে চোখের জল বেরিয়ে আসে । ছিটবাসীদের তীব্র যন্ত্রণার কথা তিনি তুলে আনলেন।মেঘলা আকাশে যেন পূর্ণিমার আলোছায়া সৃষ্টি হয়। হারাধন এবং সোলেমান মিয়ার মধ্যে ।
ধরলাতে জল নেই,ঢেউ নেই ,এর পর আর ধরলা নদীকে দেখতে পাবে না সোহন বণিক।
ধরলা তাকে কত সুখ দিয়েছে দুঃখ দিয়েছে,কতবার তাকে কাঁদিয়েছে ,কতবার তাকে দিয়েছ সুখ  এসব  তার কাছে শুধুই স্মৃতি নয় ,ধরলা তাকে যেন বাঁচতে শিখিয়েছে, শিখিয়েছে অস্তিত্বের জন্য সংগ্রাম । এই নদী তার ভিটেমাটি ভেঙেছে বহুবার ,সে গাছতলায়  থেকেছে। আবার ধরলার পাশে বসেই সে পেয়েছে আনন্দ ।ধরলা এখানে যেন একজন মায়ের ভূমিকায় অবতীর্ণ। মধ্যরাতের পর থেকে সে আর ধরলা নদীকে দেখতে চাইলেও দেখতে পাবে না ,তার মন ভারী বিষণ্ণ ।মায়ের উপর রেগে গিয়ে আবার মায়ের কোলে মাথা ঠেকিয়েই যেন চিরসুখ। এবার সে কার কোলে মাথা ঠেকাবে?এভাবে পরিচয়হীন মানুষের কষ্ট দূর করেছে ধরলা।তার নেওয়ার মতো কিছু নেই এই ধরলার স্মৃতি ছাড়া।
একদিকে নিখাদ ভালোবাসার টান এবং অন্যদিকে জন্মভূমির টান ,সালমা ও মনোয়ারকে সামনে রেখে  তাদের মনস্তত্ত্বকে আবিষ্কার করলেন গল্পকার।অনেকেই জন্মভূমিকে ছাড়তে নারাজ ,যে জমির ধান খেয়ে বেঁচে আছে ,যে জমি বাঁচিয়ে রাখে তাকে কি ছেড়ে যাওয়া যায় । কোনো মুসলিম তো এই সুনীলের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে নি তবে কেন আমি এই জন্মভূমি ছাড়ব ।আমি  কি ভারতে যাওয়ার আবেদন করবে পারি?
যারা একবার ইন্ডিয়া যাওয়ার আবেদন করেছিল তারা ইচ্ছে করলেও বাংলাদেশে থাকতে পারবে না। ওপারে গিয়ে আদৌ ঘরবাড়ি মিলবে কি না সে বিষয়েও সন্দেহ থাকলে নাগরিকত্বের টানে অনেকে বুক বেঁধেছে আশায়। মনোয়ার তার স্ত্রী পুত্রকে পর্যন্ত ছাড়তে রাজি নাগরিকত্বের টানে,জন্মভূমির টানে অন্যদিকে সালমা তার জন্মভূমি বাংলাদেশ ছাড়তে নারাজ তাই সে ঝগড়া করে তার দুই পুত্রকে নিয়ে বাপের বাড়ি রওনা দিয়েছিল । কিন্তু শেষ অবধি তারা। ভালোবাসার টানের কাছে পরাভূত হল জন্মভূমির টান-
"  আমি এতকিছু বুঝতে পারি না ।আমি আমার তমাল তুষারকে বুকের মধ্যে চাই ।নইলে আমি কেমন বাবা -- ও চিৎকার করে কেঁদে উঠলে ওর চারপাশে দাঁড়ানো মানুষেরা চোখের পানি মোছে ।সোহান বণিক ওর মাথায় হাত রেখে বলে সালমা তোকে ছাড়া থাকতে পারবে না রে মনোয়ার ।ও তো জন্মভূমির টানে থাকতে চেয়েছে ।কিন্তু ওর তো ভালবাসার টান আছে।
এখানেই যেন অস্পষ্ট হয়ে আসে ছিটমহল ,  মনোয়ারের চোখে সালমার ছবি ছাড়া কিছুই ফুটে ওঠে না।তাদের মধ্যে আর কোনো কাঁটাতারের বন্ধন নেই ,রয়েছে শুধুই ভালোবাসার পারিবারিক বন্ধন।
গল্পকার এখানে ছিটমহল বাসীদের সুখ দুঃখে ভরা কিছু স্মৃতি এবং নিখাদ ভালোবাসা দিয়ে আঁকলেন ছিটমহলবাসীদের শরীরেই আঁকলেন নতুন মানচিত্র।  একদিকে ভালোবাসা ও অন্যদিকে অধিকার , সব কিছুকে মিলিয়ে মিশিয়ে গল্পকার সৃষ্টি করলেন এক নতুন মানচিত্র যেখানে কোনো কাঁটাতার নেই, রয়েছে শুধুই ভালবাসা।
গল্পকার একদিকে একটি প্রেমকে বলি দিলেন অন্যদিকে প্রেমকে ঘিরেই গড়ে তুললেন এক গভীর মনস্তত্ত্বকে। যেখানে কাউকে তিনি দিলেন জন্মভূমির নাগরিকত্ব আবার কাউকে তিনি দিলেন ভালোবাসার নাগরিকত্ব। একদিকে ভিটেমাটি ছেড়ে যাওয়া , প্রেমিকাকে ছেড়ে যাওয়া অন্যদিকে   আত্মপরিচয় পরিচয় পাওয়া ,নিজের দেশ পাওয়া ।গল্পকার এখানে যেন একটি প্রশ্ন চিহ্ন  দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন পাঠকের হাতে। একদিকে সেমন্তীর ভালোবাসার বন্ধন কে ছিঁড়ে দিয়েছেন আবার অন্যদিকে জন্মভূমির টানে বাংলাদেশে থাকতে চাওয়া সালমা হেরে যায় মনোয়ারের নিখাদ প্রেমের সামনে। সব গ্লানি ভুলে সোহন বণিক বলে ওঠে-" ছিট মানচিত্র পেয়েছে এজন্য আমরা সবাই খুশি"
এভাবে ছিটবাসীদের  আঁতের কথা বের করে আনলেন গল্পকার সেলিনা হোসেন ,তুলে আনলেন জীবনধারীনি ধরলার কথা, প্রেমের পরিণতির কথা।
স্বাধীনতা প্রাপ্তির স্বাদের আড়ালে লুকোনো তীব্র যন্ত্রণাকে ও স্মৃতিগুলোকে জাগ্রত করে দিয়ে তিনি "মধ্যরাতের ঘরবদল " এর মাধ্যমে  ছড়িয়ে দিলেন বেঁচে থাকার তীব্র আকাঙ্ক্ষা আবার কারও মনে ছড়িয়ে দিলেন তীব্র বিষাদ। এভাবেই গল্পকার বের করে আনলেন ছিটবাসীদের আঁতের কথা। ছিটবাসীদের ইউনিক একটি সমস্যাকে তুলে ধরতে গিয়ে তিনি ছিটবাসীদের পুরো শরীর জুড়েই সৃষ্টি করলেন মানচিত্র।


তপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের অণুগল্প : খিদে






তপন বন্দ্যোপাধ্যায়
খিদে

পাঁচিল-ঘেরা বিশাল মাঠ, মাঠটা এক স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের, সেখানে ভোর থেকে বেলা ন'টা-দশটা পর্যন্ত স্থানীয় মানুষজন আসেন স্বাস্থ্যোদ্ধারের আকাঙ্ক্ষায়। মুক্ত আকাশের নীচে কেউ ব্যায়াম করেন, কেউ মাঠের চারদিকে ঘোরেন, কেউ ব্যস্ত প্রাণায়ামে।

তাদের মধ্যে চোখে পড়ে দোহারা চেহারার একজনকে যার ব্যায়াম দেখে মনে হয় অটুট স্বাস্থ্যের অধিকারী। তাকে দেখলেই এদিকে ওদিকে ছড়িয়ে থাকা তিনটে কুকুর ছুট্টে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে থাকে।

আসলে তার পকেটে থাকে বেশ কয়েকটি বিস্কুট, কুকুর তিনটে এলেই তিনি পকেট থেকে বার করে দেন সেই আহার্য। কুকুর তিনটে মহানন্দে খেতে থাকে আর লেজ নেড়ে কৃতজ্ঞতা জানাতে থাকে লোকটিকে। লক্ষ্যনীয় এই যে, বাইরের অন্য কোনও কুকুর গেট টপকে সেই বিস্কুটে ভাগ নিতে এলে তিনজনে একযোগে তাকে এমন তাড়া করে যে, সে প্রাণপণে ছুটে গেটের বাইরে।

দৃশ্যটা গা সওয়া হয়ে গেছে সবার।

হঠাৎ সেদিন একটি বাচ্চা কুকুর কী করে যেন গেটের মধ্যে ঢুকে পড়ে চলে এল বিস্কুটের গন্ধ শুঁকে শুঁকে। সাদা ধবধবে লোম, মিষ্টি তার হাবভাব। কুকুর তিনটেকে বিস্কুট খেতে দেখে কুইঁ কুইঁ। কুইঁ কুইঁ। হয়তো বলতে চাইলো, আমাকেও একটা বিস্কুট দাও না!

কুকুর তিনটে প্রথমে পাত্তাই দিতে চাইল না তাকে। বাচ্চাটা তবু ঘুরঘুর ঘুরঘুর। ঘ্যানঘ্যান। ঘ্যানঘ্যান। কুকুর তিনটে তাকে ঘেউ ঘেউ করে তাড়াতে চেষ্টা করল, কিন্তু বাচ্চাটা তখনও কুইঁ কুইঁ। কুইঁ কুইঁ। তিনটে কুকুর তখন তাকে চেপে ধরে এমন আঁচড়ে-কামড়ে দিল যে, বাচ্চাটা প্রায় মরো-মরো।

কোনও ক্রমে ছাড়া পেয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে, গোঙাতে গোঙাতে গেটের বাইরে গিয়ে কুইঁ কুইঁ করে কী যেন বলতে লাগল। হয়তো বলছিল, আমারও তো খিদে পায়!