Sunday, December 29

অভিজিৎ দাশ - সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ‘স্তন’ গল্পটি জটিল মনের মানচিত্র





অভিজিৎ দাশ
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ‘স্তন’ গল্পটি জটিল মনের মানচিত্র

‘স্তন’ শব্দটি শুনলেই মনে হয় যেন আলাদা সুর বেজে ওঠে। কিন্তু স্তনগ্রন্থি ও স্তনবৃন্ত কর্ডাটা পর্বভূক্ত ম্যামেলিয়া বা স্তন্যপায়ী প্রাণীদের অমোঘ অঙ্গ বা প্রত্যঙ্গ। স্তন্যপায়ী প্রাণীদের স্ত্রী বা পুরুষ দুই দেহেই স্তন দেখা যায়। স্বাভাবিকভাবেই মানুষের দেহেও এর উপস্থিতি আছে। তবে পুরুষ দেহে স্তন নিষ্ক্রিয় অঙ্গের মতো অবস্থান করে। নারীদেহে এর গুরুত্ব সর্বজনবিদিত। এর মধ্যে মানুষ যৌনতার গন্ধ খোঁজে। নারীর স্ফীত স্তন দেহের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য। আর তা নারীর সৌন্দর্যের প্রতীকে পরিণত হয়েছে। এর পরিচর্যা নিয়ে নারীর যেমন ভাবনা পুরুষরাও তেমনি কম ভাবেন না। সাহিত্য, শিল্প, সংস্কৃতি প্রতিটি ক্ষেত্রেই এর সৌন্দর্য নানাভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। সুদূর প্রাচীনকাল থেকে আজ পর্যন্ত এই সৌন্দর্য নানাভাবে হাজির করা হয়েছে মানুষের সামনে। ভারতের প্রাচীন ভাস্কর্য, দেওয়াল চিত্র, মুরাল ইত্যাদিতে একে জীবন্ত করে রাখার চেষ্টা ইতিহাসগতভাবে সত্য। খাজুরাহো কিংবা লিঙ্গরাজ মন্দিরের দেওয়ালগাত্র তাই মানুষের মনে বিস্ময়ের সৃষ্টি করেছে। আবার শুধু ভারতে নয়, সারা বিশ্বের এরকম সৃষ্টিকর্ম আছে।
সাহিত্যে তো উজাড় করে লেখা হয়েছে স্তনের সৌন্দর্য বর্ণনা পর্ব। ধর্মগ্রন্থ, কাব্য, মহাকাব্য, গদ্য, নাটক- সাহিত্যের প্রতিটি শাখা এতে মুখর। আদম ও ইভের আপেল খাওয়ার ঘটনায় আপেল কি প্রতীক নয় ? আর এর জন্যই তাদের প্যারাডাইস লস্ট (Paradise Lost) হয়েছে। নারীর স্তন অনেক মুণী-ঋষিকেও কামমোহিত করেছে। নারীদেহের সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশ নিয়ে ‘ইন্ডিয়া টুডে’ (India Today) পত্রিকা একটি সমীক্ষার প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। তাতে দেখা যায় আটচল্লিশ শতাংশ (৪৮%) পুরুষ স্তনকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। সিনেমাগুলিতে প্রয়োজকরা দর্শক টানার মাধ্যম হিসেবে এই সৌন্দর্যকে ব্যবহার করার চেষ্টা করেন। এতে হলিউড, বলিউড, টলিউডের মধ্যে বিশেষ পার্থক্য নেই। সাহিত্যগুলিতে কখনো আপেল, কখনো বেল, কখনো দাড়িম্ব, কখনো টমাটো ইত্যাদি প্রতীক ব্যবহার করে এই অঙ্গটিকে সাহিত্যায়িত করা হয়েছে। কিন্তু এখানেই তো এর ভূমিকা শেষ নয়, বরং এর আসল সৌন্দর্য ফুটে ওঠে মাতৃত্বের মাধ্যমে। কোনো শিশুর প্রথম খাদ্য যোগান দেয় এই স্তন। স্তন নিঃসৃত ক্ষরণ (দুধ) পুষ্টিকর খাদ্য। সদ্যোজাত শিশুর পক্ষে এই খাদ্যের বিকল্প নেই। আসলে এজন্যই তো আমরা  স্তন্যপায়ী প্রাণী। এ প্রসঙ্গে তুলসী লাহিড়ী রচিত ‘ছেঁড়া তার’ নাটকে ফুলজানের একটি সংলাপ উল্লেখ করলে অত্যূক্তি হবে না। সংলাপটি হল- “বাচ্চা পয়দা হবার আগে আল্লা মায়ের বুকে দুধ আনি রাখি দ্যায়। বাপের বুকে তো দ্যায় না।” এ নিয়ে নারীদের গর্ব হওয়াই স্বাভাবিক, আর এখানেই বোধ হয় নারীর প্রকৃত সৌন্দর্য। নারী বিকৃত রুচির দেহলোলুপ পুরুষকে চোখে আঙুল দিয়ে বলতে পারে-তুমিও তো কোনো নারীর স্তন পান করেই জীবনধারণ করেছ, তোমার এই বিকৃতি কি তাকে অপমান করা নয় ?
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর একটি গল্প ‘স্তন’। গল্পটি তাঁর ‘দুই তীর এবং অন্যান্য গল্প’ গল্পগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। ওয়ালীউল্লাহর মাত্র দুটি গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। এই গ্রন্থটি ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাসে ঢাকা থেকে থেকে প্রকাশিত হয়। অপর গল্পগ্রন্থটি হল ‘নয়নতারা’। এটি মার্চ ১৯৪৫-এ কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়। আরো কয়েকটি গল্প বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। পরে সেগুলি তাঁর ‘গল্পসমগ্র’-তে স্থান পেয়েছে। তবে সব মিলিয়ে গল্পের সংখ্যা পঞ্চাশটিও ছোঁয়নি। তাছাড়া তিনটি উপন্যাস, তিনটি নাটক এবং বাংলা ইংরেজি ভাষায় কয়েকটি প্রবন্ধ এই শিল্পীর নির্মাণ। তবে নির্মাণের স্বল্পতা থাকা সত্ত্বেও তাঁর চিন্তাধারা, দার্শনিকতা, মনঃসমীক্ষা তাঁকে ভাস্বরতা দান করেছে। তাঁর ‘লালসালু’ উপন্যাসটি তো এককথায় অনন্য। গল্পগুলির সম্বন্ধে ‘পরিচয়’ পত্রিকায় সুশীল জানা লিখেছেন-
“ওয়ালীউল্লাহ সাহেবের ঝোঁক মনঃসমীক্ষণের দিকেই বেশি। এতে বিপদ আছে। বিশেষ করে যে শ্রেণির মর্মকথা তিনি লিখেছেন সেক্ষেত্রে। মধ্যভিত্তিক ভাব প্রবণতা আবেশের ঝোঁকে ঘাড়ে চেপে বসে গিয়ে নিপীড়িত শ্রেণি জীবনের ওপরে। জীবন আড়াল হয়ে যায়। যা বর্তমান সাহিত্যে খুবই সুলভ। এতে রচনা জীবনধর্মী না হয়ে হয়ে পড়ে ভাবধর্মী।” (১৩৫৩ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত)
চট্টগ্রামের ষোলকাহারে ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ই আগস্ট তিনি জন্মগ্রহণ করেন। শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সাহিত্যের পরিবেশে তিনি মানুষ হয়েছেন। ফলে তাঁর মনে একটি রুচিশীল সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল গড়ে উঠেছিল। বাল্যকালে পিতার কর্মসূত্রে এবং নিজের কর্মজীবনে তিনি দেশ, বিদেশের নানা জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছেন। স্বাভাবিকভাবেই বহু মানুষের সাথে তিনি মেলামেশার সুযোগ পেয়েছিলেন। এগুলির প্রভাব তাঁর সাহিত্যের মধ্যে পড়েছে। সংবাদপত্র ও বেতারে সাংবাদিকতা বা বার্তা সম্পাদক হিসেবে কাজ করার সূত্রে জীবনকে জানার পরিধি বেড়েছে। মানুষের জীবন চর্যা, মন ও মননের সাথে নিবীড় যোগসূত্র তাঁর সৃষ্টিতে বৈচিত্র দান করেছে। ১০ই অক্টোবর ১৯৭১ প্যারী শহরের উপকন্ঠে তাঁর জীবনাসন ঘটে।
তিনি স্বাধীন বাংলাদেশ দেখে যেতে পারেননি। কিন্তু বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে জনমত গঠনে তিনি সক্রিয় ছিলেন। মুক্তিযোদ্ধাদের তহবিলে তিনি নিয়মিত অর্থদান করতেন।  দেশ নিয়ে দুশ্চিন্তা, আশঙ্কা ও হতাশা তাঁর অকাল মৃত্যুর কারণ বলে তাঁর পরিবার মনে করে। দেশের মানুষকে যে তিনি কত ভালোবাসতেন তার জ্বলন্ত উদাহরণ তাঁর সাহিত্য। এখানে দেশের মানুষ, দেশের সমাজ, পটভূমিকায়ও দেশের ছবি পাঠক মাত্রই সহজে বুঝতে পারবেন। তাঁর ছোটগল্পগুলি যেন এরই প্রতিচ্ছবি।
‘স্তন’ গল্পটির মূল বিষয় আবর্তিত হয়েছে এক মা-হারা সদ্যোজাত শিশুকে দুধ খাওয়ানোকে কেন্দ্র করে। আবু তালেব মোহাম্মদ সালাহ্‌উদ্দিনের ছোট মেয়ে খালেদা সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে মারা যায়। ফলে তার আদরের মেয়ের সদ্যোজাত ছেলেটি মায়ের দুধ থেকে বঞ্চিত হয়। ঠিক একই সময়ে দূর সম্পর্কিত আত্মীয় কাদেরের ষষ্ঠ সন্তান জন্মানোর কয়েক ঘণ্টা পরেই পৃথিবী ছেড়ে বিদায় নেয়। একদিকে তার নাতি মা হারা, অপরদিকে কাদেরের স্ত্রী সন্তান হারা। তাই সালাহ্‌উদ্দিন সাহেবের মনে হয়েছিল এই শিশু এবং কাদেরের স্ত্রী পরস্পরের পরিপূরক হতে পারে। এই ভাবনা থেকেই তিনি কাদেরের বাড়ির বৈঠকখানায় হাজির হন।
কম বেতন পাওয়া কেরানী কাদেরের ঘরে দারিদ্রের ছাপ স্পষ্ট। ঘরের চারদিকে নোংরা, তার চার বছরের মেয়েটির মুখেও ময়লার স্পর্শ। অপরদিকে সালাহ্‌উদ্দিনের অবস্থার কথা গল্পে না থাকলেও তার নিজস্ব একট গাড়ি আছে। নাতির জন্য দাই রেখেছেন। সুতরাং তিনি অবস্থাপন্ন না হয়ে পারেন না। তাই কাদেরের বাড়ি দেখে তিনি নারাজ হন। তার মনে হয় “যে প্রস্তাবটি নিয়ে তিনি কাদেরের বাড়িতে উপস্থিত হয়েছেন, সেটি উত্থাপন করা সমীচীন হবে কি না সে-বিষয়ে ক্ষণকালের জন্য তার মনে একটা সন্দেহ জাগে। কিন্তু গরজ বড়ো বালাই। তাই দ্বিধা ঝেড়ে বলেন, “ আপনার কাছে একটা কথা নিয়ে এসেছি। আমার নাতিকে দুধ দেবার কেউ নেই। এটুকু বলেই তিনি থামেন। ...শুনেছি আপনার স্ত্রীর স্বাস্থ্য খোদার ফজলে ভালোই। ভাবছিলাম, আমার মা-হারা শিশু-নাতিকে তার বুকের দুধ দিতে রাজি হবেন কি ? হলে বাচ্চাটিকে এখনই নিয়ে আসি। ...আপনার স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করে আসবেন ?”
কাদের ফিরে এলে তার মুখে সম্মতির চিহ্ন দেখে তিনি উঠে পড়েন। সাথে নিজের প্রস্তাবের পক্ষে যুক্তি দেন, “ডাক্তার অবশ্য বোতলের দুধ দিতে বলে। ওসব আধুনিক পন্থায় আমার বিশ্বাস নেই। দুধের শিশু বুকের দুধ খাবে, প্রকৃতির রীতি তাই।” ডাক্তার হয়তো মা-হারা শিশুকে বিকল্প খাদ্যের যোগান দিতে বোতলের দুধ পান করানোর কথা বলেছিলেন, কিন্তু মায়ের দুধের বিকল্প তা হতে পারে না। অনেক মানুষ-মাকে দেখা গেছে মা-হারা পোষ্য ছাগল বা কুকুরকেও নিজের স্তন থেকে দুধ খাইয়ে বাঁচিয়েছেন। সুতরাং সালাহ্‌উদ্দিন সাহেবের এই প্রস্তাব কোনো সৃষ্টিছাড়া প্রস্তাব নয়। আর তাছাড়া বাচ্চা জন্মানোর পর তাকে স্তনের দুধ খাওয়াতে না পারলে মায়ের শারীরিক সমস্যাও দেখা দেয়। সেদিক থেকে ভাবতে গেলে এই প্রস্তাব কাদেরের স্ত্রীর কাছে আশীর্বাদস্বরূপ। শিশুটি যেমন মাকে পাবে (স্বপ্ল সময়ের জন্য হলেও), তেমনি কাদেরের স্ত্রী মাজেদাও সন্তানকে পাবে। সুতরাং মনস্তাত্বিক দিক থেকে পর্যালোচনা করলে এতে উভয়ের ভালো হবার কথা। এজন্যই কাদের ও মাজেদা রাজি হয়েছে। নাতিকে বাঁচাতে ঘরে, গায়ে যত নোংরাই দেখুন না কেন সালাহ্‌উদ্দিন সাহেবও তৃপ্ত। কিন্তু মনের গলিঘুজির সন্ধান পাওয়া এত সহজ নয়। এখানেই মনোবিকলন তত্ত্বের কথা এসে পড়ে। আবদুল মান্নান সৈয়দ তাই গল্পটিকে মনোবিকলনধর্মী বলে চিহ্নিত করেছেন।১
গল্পের বাস্তবে মনোবিকলন প্রভাব বিস্তার করেছে। তাই সেদিন বিকেলে শিশুটিকে দুধ খাওয়ানোর জন্য মাজেদা কোলে তুলে নেয়। তার মনে হয় “উন্নত স্ফীত স্তনে ঝরণার মতো আওয়াজ করেই যেন দুধ জমেছে। তার স্তনে সঞ্চিত দুধের বেদনা। সে বেদনা জীবনেরই বেদনা; বুকে যা জমেছে দৃষ্টির অন্তরালে তা স্নেহ-মমতার সুধা। মনে আছে তার অন্যান্য সন্তানের বেলায় যখনই শিশুর কান্না কানে পৌঁছুত, তখন কুচাগ্র দিয়ে দুধ বেরিয়ে আসত, পেটের নীচে কেমন সঙ্কোচন-প্রসারণও শুরু হত। তার এখন মনে হয়, কোলের শিশুটির কান্নার আওয়াজে কুচাগ্র যেন তেমনি সিঞ্চিত হয়ে উঠেছে, তেমনি সংকোচন-প্রসারণ শুরু হয়েছে পেটের তলে। শিশুটি যে তার নয়, তাতে বাঁধা পড়েনি।” কিন্তু শিশুটি তার ইপ্সিত দুধ পায়নি। মাজেদার মন তো আসলে ভরে আছে তার মৃত শিশুর কথায়। তাই শিশুটি দুধ পায়নি। মনের জটিলতাই তার দুধ ক্ষরিত না হবার কারণ। মাজেদার মনে হয়েছে ‘দুধ জমে গেছে’। পরদিন মাজেদা শিশুটিকে দুধ খাওয়াতে ব্যর্থ হয়। তার মনে আবার দুধ জমে যাওয়ার কথা আসে। তার মনে প্রশ্ন জাগে এবং সে এভাবে উত্তর খোঁজে- “কিন্তু কেন তার স্তনের এই অবস্থা হয়েছে ? এ কি সম্ভব যে, যে-দুধ তার সন্তানের জন্যই এসেছিল, তার সন্তানটি আর নেই বলে সে-দুধ এমনভাবে জমে গেছে।” এর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া মুশকিল। একমাত্র মনস্তত্ত্বগত ব্যাখ্যাই শুধু হতে পারে।
মাজেদার মনের জটিলতায় আর একটি বিপরীত কথারও উদয় হয়। “তাই শীঘ্র একটি তীব্র অনুশোচনার জ্বালা সে বোধ করে। কী করে সে এমন নির্মম কথা ভাবতে পেরেছে? শিশুটি
নিজের গর্ভের না হোক সে শিশু। তাছাড়া মা-হারা অসহায় শিশু। এমন শিশুকে কেউ কখনো দুধ থেকে বঞ্চিত করতে পারে না। তাছাড়া কথাটি যে সত্য নয় তার প্রমাণ সে নিজেই দেখতে পায়। শিশুটিকে স্তন দেবার জন্য সে মনে-প্রাণে-দেহে একটি তীব্র আকাঙ্ক্ষা বোধ করে। সে আকাঙ্ক্ষা কি ভুল হতে পারে ?” বাস্তবিক মাজেদার মাতৃত্ব এক্ষত্রে দেহে সঞ্চারিত হয়েছে। কিন্তু শিশুটি জন্মের চতুর্থ দিনেও দুধ পায়নি। পরিবর্তে দাই ওর মুখে জল দিয়েছে। এরকম অবস্থায় শিশুটিকে বাঁচানো বড়ো প্রশ্ন চিহ্নের সন্মুখীন হয়ে পড়েছে।
আসলে শিশুটি অন্যের হলেও ওর প্রতি মাজেদার মাতৃত্ব প্রকাশে একটুও কার্পণ্য ঘটেনি। কিন্তু সবই নিষ্ফল হয়ে গেছে। তাই “তার মনে হয় শিশুটিকে স্তন পান করানোর জন্য সে যে তীব্র আকাঙ্ক্ষা বোধ করে, সেটি আসল সত্যটি ঢাকার জন্য তার মনেরই একটি কৌশলমাত্র। আসল সত্যটি এই যে, তার নিজের সন্তানের মৃত্যু হয়েছে বলে সে চায় না যে, পরের শিশু বেঁচে থাক। সেজন্যেই তার বুকভরা দুধ এমন করে জমে পাথর হয়ে গেছে।” মাজেদার নিজের মনে ব্যর্থতার কারণ হিসেবে যে সত্য উঠে এসেছে তা পুরোপুরিভাবে অস্বীকার করা যায় না। তবু একথা বলা যায় যে, তাহলে মাজেদা প্রথমে এবং পরেও দুধ দিতে চাইত না। কিন্তু কখনো তা করেনি। এই প্রসঙ্গে ‘Home They Brought Her Warrior Dead’ নামে টেনিসন রচিত বিখ্যাত কবিতাটির কথা মনে পড়ে। কবিতাটিতে এক যোদ্ধার বাড়িতে তার মৃতদেহটি বয়ে নিয়ে আসার কথা আছে। তা দেখে  মৃত যোদ্ধার স্ত্রী এমন হয়ে যায় যে তার বাস্তবজ্ঞান লোভ পায়। সে অজ্ঞান হয়ে পড়ে না ঠিকই কিন্তু তার জীবনে কী ঘটেছে বা তার চারপাশে কী ঘটছে তা তার মস্তিষ্ক গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়। তাই স্বামীর মৃত্যু তাকে স্পর্শ করতে পারে না। এরকম পরিস্থিতিতে তার শুভাকাঙ্ক্ষী মানুষজন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে। শেষে একজন তার শিশুটিকে কোলে তুলে দিলে সে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে-তার বাস্তবজ্ঞান ফিরে আসে।
এই গল্পে মাজেদা মনের টানাপোড়েনে ভুগতে ভুগতে তবে কি অ্যাবনরমাল হয়ে পড়ল? এর জন্যই তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। ডাক্তারবাবু বলেন, “মাজেদার দুধ এখনো আসেনি। সেটা নাকি বিচিত্র নয়। আকস্মিকভাবে গভীর আঘাত পেলে দুধ আসতে দেরী হয়।” তারপর তিনি চিকিৎসা বিজ্ঞানের দুর্বোধ্যতায় এর ব্যাখ্যা করেন। ডাক্তারবাবুর কথা তাঁকে আরও ভীত করে তোলে তার মানসিক চাপ আরও বাড়ে।
অপরদিকে সালাহ্‌উদ্দিন সাহেব এইনির্মম সত্য জানতে পারেননি। তাই তিনি মাজেদার উপকারকে মনে রেখে তাকে ভালো খাবার পাঠাতে চেয়েছেন। তার মুন্সীরহাটে থাকা জমি মাজেদার নামে লিখে দিতে চেয়েছেন। কিন্তু কারো কোনো শুভ মানসিকতা বা মানবিকতাই শিশুটির মুখে দুধ দিতে পারেনি।
মাজেদার মনে হয় সব ঘটনাই আসলে তার পরীক্ষা। এই পরীক্ষায় সে উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য অদম্য হয়ে ওঠে। আবদুল মান্নান সৈয়দ বলেছেন, “সন্তানের মৃত্যুর পর স্তনে দুধহীন নারী কী করে অস্বভাবী (abnormal) মানসতায় পৌঁছোল, এখানে তার অনুপুঙ্খ ক্রমিক বর্ণনা আছে। শেষ পর্যন্ত মাজেদার মনে দুধের আকাঙ্ক্ষা এমন তীব্র হয় যে তার ধারণা হয় কুচাগ্রে কী যেন আটকে আছে বলে দুধ সরছে না।” তখন সে মাথার চুলের কাঁটা দিয়ে দুই স্তনাগ্রই তীব্রভাবে বিদ্ধ করে। আর তারপর ? গল্পের শেষে দুটি বাক্য ; ‘তার স্তন থেকে দুধ ঝরে, অশান্তভাবে দুধ ঝরে। আর সে দুধের বর্ণ সাদা নয়, লাল।’ দুধের আকাঙ্ক্ষায় স্তন থেকে রক্তপাতের বর্ণনা মাজেদার অস্বভাবী অদ্ভুত মানসতার সাক্ষ্যে গল্প শেষ হয়।”২
হায়াৎ মামুদ ওয়ালীউল্লাহর ‘স্তন’ এবং আরো কয়েকটি গল্প নিয়ে মন্তব্য করেছেন, সেগুলি “মিলবে যেখানে গল্প-কবিতা মেশামিশি হয়ে আমাদের মনের বুদ্ধি বা চেতনার স্তরে নয়, অন্য কোনো গহীন অচেতন স্তরে বা বোধে অনুরণন তোলে। ...তিনি বস্তু জাগতিক বিশ্বের ভিতরেই স্বপ্ন ও বাস্তবের মাঝামাঝি এক প্রদোষান্ধকারে নিয়ে যান আমাদের।”৩
এখানেই সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর অনন্যতা। ছায়াৎ মামুদ আরো বলেছেন, “সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর মনের প্রবণতা ছিল, আমার ধারণায়, দার্শনিকের।”৪ তাঁর এই ‘স্তন’ গল্পটিতে মাতৃত্ব, মনোবিকলনত্ব ইত্যাদির মধ্যেও দার্শনিকতার স্বাদ থেকে পাঠকরা বঞ্চিত হননি। এখানেই আর সৃষ্টির সার্থকতা নিহিত আছে।
তথ্যসূত্র-
১) আবদুল মান্নান সৈয়দ- সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ছোটগল্প (প্রবন্ধ), দিবারাত্রির কাব্য, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ সংখ্যা, জানু-মার্চ ২০০৮, পৃ. ১২২
২) প্রাগুক্ত, পৃ. ১২৩
৩) সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ‘গল্প সমগ্র’-এর ভূমিকা, প্রতীক প্রকাশনা, ঢাকা, মার্চ ২০১৭
৪) প্রাগুক্ত

রণজিৎ শীল - ইলিয়াসের দুধে ভাতে উৎপাত : মানবতার প্রতীকী সংকট




রণজিৎ শীল
ইলিয়াসের দুধে ভাতে উৎপাত : মানবতার প্রতীকী সংকট   


আখতারুজ্জামান ইলিয়াস (১৯৪৩-১৯৯৭) বাংলাদেশ তথা বাংলা সাহিত্যের এক ব্যতিক্রমী সাহিত্যিক ।দেশভাগের কিছু পূর্বে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের  সময়  তৈরি করা মন্বন্তর , কালোবাজারি , খাদ্য সংকটের মতো কালো মেঘে ঢাকা আকাশের নিচে  জন্ম নেওয়া সাহিত্যিকের রচনার শিরা উপশিরায়  ঘুরে ফিরে বাংলাদেশের নানা সময়ের ঘটনা  ফল্গুধারার মতো বয়ে চলেছে একটু লক্ষ করলে বোঝা যায়  ।আখতারুজ্জামান ইলিয়াস তাঁর ৫৪ বছরের জীবনে মাত্র দুটি উপন্যাস  ও  ২২-২৩ টি গল্প রচনা করেছেন সত্য  ।সংখ্যার বিচারে নয় ভাবনার গভীরতায় , ভাষার দৃঢ়তায়, শৈলীগত নবনির্মাণে  ইলিয়াস এক বলিষ্ঠ লেখক এবিষয়ে সংশয় নেই। বাবা স্কুল হেডমাস্টার অর্থাৎ নিজে মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান হলেও মধ্যবিত্ত জীবনচর্চার স্বাভাবিক পরিণতিতে তাঁর অবস্থান দৃঢ় ছিলনা ।তাই পরবর্তী জীবনে মধ্যবিত্তের  খোলস ছেড়ে বেরিয়ে ফিরে যান চাষি মজুরের জীবনে ।তাঁর এই সময়ের গল্প গুলিতে এই বীক্ষা ও চিন্তনের পরিবর্তন অন্যমাত্রা দান করেছে ।তাঁর  গল্পে দেখা যায়  আপসহীন  আক্রমণের ভঙ্গী যেমন স্বতন্ত্র  ,তেমনি  আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ভাষা তীরের ফলার মতো  শানিত ,সজারু কাঁটার মতো তীক্ষ্ণ ।তার গল্পের মুল  কাহিনী বাস্তবের কপি পেস্ট নয় বরং গল্পের চরিত্ররা অনেক বেশি  স্বপ্রতিভ।একজন সাহিত্যিকের সাথে কথোপকথনে  ইলিয়াস নিজেই বলেছিলেন যে- তার গল্পের চরিত্ররা আগের থেকে ভাবনার ফলশ্রুতি নয় বরং তার গল্পের চরিত্ররাই গল্পকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে ।আখতারুজ্জামান নিজে ওতপ্রোত ভাবে রাজনীতি করেননি সত্য কিন্তু রাজনৈতিক উত্থানপতন ,আন্দোলনের গতিপথ ,বিপ্লবের ভয়াল রুপ প্রত্যক্ষ করেছেন।ঢেউ লেগেছে তার অতল হৃদয়ে , তার হৃদয়কে আরথিন ছাড়া বিদ্যুৎ এর মতো ঝলসে দিয়েছে পূর্ব  পাকিস্থানের মুক্তি যুদ্ধের ভয়াবহ স্মৃতি কৃষক ,মজদুর ,সাধারণ মানুষের বেঁচে থাকার  কঠিন  লড়াই ।  অনুভব কয়েছেন এপার  বাংলার নকশাল আন্দোলনের তীব্রতা ।সাহিত্য ক্ষেত্রে ইলিয়াস মানিক বন্দোপাধ্যায়ের   উত্তরসূরী হলেও অনেক জায়গায় তিনি মানিকের পথ থেকে অনেকটা দূরত্ব বজায় রেখেছেন অটুট রেখেছেন আপন ঘরানা ।মানিক সাম্যবাদে বিশ্বাসী । তাঁর  বিশ্বাস জায়গা করে নিয়েছে তাঁর  সাহিত্যে ।শ্রমিক শ্রেণি, মজদুর সমাজ হয়ে উঠেছে  তাঁর  রচনার নিয়ন্ত্রক ।কিন্তু সুকৌশলে ইলিয়াস সেই মোহ কাটিয়ে বাংলা সাহিত্যে  এক নব নির্মাণ করলেন মজদুর নয় অভিজাত নয় তাঁর গল্পের নায়ক সময়  ।গল্পের চরিত্ররা শ্রেণি ভিত্তিক  নিয়ন্ত্রক না হয়ে, হয়ে উঠল  সময় কেন্দ্রিক নায়ক ।কিন্তু সাম্যবাদের কথা সরাসরি না বললেও  অধিকারের কথা ,জীবনের প্রয়োজনীয়  প্রাপ্য আদায়ের অঙ্গীকার  ।তাঁর গল্পের পাঠক মাত্রই বুঝতে পারবেন দেশভাগের যন্ত্রণা ,পাকিস্থান সরকারের পূর্ব পাকিস্থানের বাংলা ভাষী মানুষের প্রতি বৈষম্য মূলক  আচরণ,খাদ্য সংকট ,গ্রামের নিঃস্ব মানুষের হাহাকার ,তার গল্পের ধমনীতে নিত্য প্রবাহিত ।এর আগেই বলা হয়েছে ইলিয়াস নিজেই বলেছেন যে তার গল্পের চরিত্ররা আপন গৌরবেই মহীয়ান । যেখানে লেখকের আর কর্তৃত্ব চলেনা, চলেনা রিমোড কন্ট্রোল।তার-ই এক প্রতিভাস আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের “দুধে ভাতে উতপাত”    নামক গল্পটি ।গল্পটি  রচিত হয়েছে ১৯৬৫-৭৮ সালের মধ্যে কোন এক সময়ে ।অর্থাৎ দেশভাগ , পাকিস্থান ,স্বাধীন বাংলাদেশ হাতে পেয়েছে ততদিনে পূর্ব বঙ্গের সাধারণ মানুষ ।এই    গল্পের মূল প্লট অতি সাধারণ হলেও এর প্রতীকী আবদার অনেক গভীর ।হাশমত  মহুরি   পেশায়  ব্যবসায়ী  ।জয়নাবকে  সন্তানের বা সংসারের খাবার জোগারের জন্য ধারে চাল নিতে হয়।আধ্মন চালের দাম শোধ না করতে পারায় জরদস্তি জয়নাবের কালো  দুধেল গরু হাশমতের  বোন জামাই  হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে যায়  ।প্রতিবাদ করার প্রয়াস পর্যন্ত তখন সে পায় না ।মানসিক দ্বন্দ্ব  যন্ত্রণা  তার পাজরের হাড় ভেঙ্গে দিয়েছে । তাকে কুড়ে কুড়ে খেয়েছে ,সন্তান সন্ততির অতিসাধারণ প্রত্যাশা একটু খানি দুধ ও ভাত  না দিতে পারার   আক্ষেপ ।শেষে জয়নাব রোগ যন্ত্রণার বিষময় দেহ   নিয়ে আশ্রয় নিয়েছে বিছানায় ।জয়নাবের ও   তার সন্তানের দুধভাত খাওয়ার স্বপ্ন ভঙ্গ শুধু তার ব্যক্তিগত যন্ত্রণা  বললে ভুল হবে ।সেদিনের তামাম পূর্ব পাকিস্থানের সাধারণ মানুষের অন্তরের আর্তি –ই নয় রীতি মতো ক্ষোভ ভাবলে অত্যুক্তি হবেনা বলেই আমার মনে হয় ।যে আশা নিয়ে বাঙালি নতুন সূর্যের আলোতে অবগাহন করবে বলে আনন্দে আতখানা হয়ে পড়েছিল সে স্বপ্ন অধরাই রয়ে গেছে ।জয়নাবের দুধ ভাত খাবার ও সন্তানদের খাওয়ানোর  আশার অন্তরালক্ষে  কোথায় যেন  ঘুরে দাঁড়াবার প্রয়াস ,অধিকার লাভের তীব্র বাসনা ,ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণার রক্তিম মুখ ভেসে উঠেছে  পাঠকের কল্পনালোকে ।তাই তো জয়নাব বারবার ছেলেকে বলে ওঠে “ওইদুল্লা   বাবা আমার কালা গাইটা আনতে পারলি না? হাশমত  মউরির পোলায় দড়ি ধইরা টাইনা  লইয়া গেলো ।একটা বছর পার হইয়া গেলো একটা   দিন দুগা ভাত মাখাইতে পারলাম না ।“ মাতৃ হৃদয়ের এই যে হাহাকার এটা শুধু ব্যক্তি জয়নাবের নয় ।দেশভাগ  পরবর্তীপূর্ব বাংলার  বাঙালি জাতির মাতার  আর্তনাদ ছাড়া আরকী?।
                   
ইলিয়াস অতি সন্তর্পণে পাঠকের ভাবালুতাকে এড়িয়ে নিয়ে আবেগে মাতিয়ে দিতে  সক্ষম এবিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই ।মানুষের প্রয়োজনীয় খাদ্য,বস্ত্র বাসস্থানের মতো ন্যূনতম বিষয় যখন প্রশ্নের মুখে পড়ে তখন আর মানুষের ধর্ম ,জাতি  লিঙ্গ , আপন -পর মাথায় থাকে না ।পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ কল্পনায়  আপন সন্তান সন্ততি নিয়ে স্বপ্নের নীড় রচনা করে। , যখন সে তার সামান্য অংশটুকু হাতের কাছ থেকে দূরে চলে যায় তখন সে অসহায় বাইসনের   মতো হিংস্র  হয়ে ওঠে । যখন কালো  গরুটিকে  হারুন মৃথা  নিয়ে যেতে নেয় তখন জয়নাব হুঙ্কার দিয়ে বলে ওঠে ছেলেকে  “বুইড়া মরদটা কী দ্যাহস ? গরু লইয়া যায়  খাড়াইয়া খাড়াইয়া কী দ্যাহস “ অর্থাৎ জয়নাব প্রতিবাদের বিষ শল্য নিক্ষেপ করেছেন সুকৌশলে এটা সচেতন পাঠকের বুঝতে  বিন্দুমাত্র  অসুবিধা   হয়না  ।  এ যেন নিজের প্রাপ্য বুঝে নেওয়ার  ,নিজের অধিকার আদায়ের এক সূক্ষ্ম ইঙ্গিত ,পৃথিবীতে বাঁচার সংগ্রামের  এক প্রতীকী ডাক । অবহেলিত ,বঞ্চিত , প্রলেতারিয়াৎ মানুষের মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার সংকল্পটি সুচালো সূচের মতো ফুটিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছেন ইলিয়াস ।এইখানেই ইলিয়াস স্বতন্ত্র  ,এইখানেই ইলিয়াসের লেখক সত্তার অনন্য  ব্যক্তিত্ব ।


                    এখানেই গল্প শেষ করেননি   লেখক ।জয়নাব  ছেলে ওইদুল্লাকে  শেষ বারের মতো আদেশ দিলে   ছেলে বেরিয়ে পড়েছে  মাতার  আদেশ কায়েম করার সঙ্কল্প নিয়ে।গল্পে কোথাও সরাসরি বিদ্রোহের কথা নেই তবে ঝাঁঝ চোরাস্রোতের মতো প্রবহমান  ।  তাইতো এই গল্পের গতি বুঝতে তিন সেকেন্ড সময় লাগেনা পাঠকের ।এইখানেই ইলিয়াসের কলম  স্বাতন্ত্র্য ।

এই গল্পে  যখন দেখা যায়  দরিদ্র ঘরের   ওইদুল্লা  মহুরির বাড়িতে যায়  তখন দেখে সেখানে  অ্যালুমিনিয়াম  থালা থেকে গম ছিটিয়ে মুরগিকে খাওয়াতে তা দেখে তার মনে হয়  সব কটা মুরগির  ঠোঁট কামড়িয়ে  গম গুলি দাঁতে চিবিয়ে ফেলে ।এই বক্তব্যের  অন্তরালে  ওইদুল্লার শুধু নয় সেই সময়ের অস্থির দোলাচল সময়ের  বাঙালি জাতির অন্তরের এক হিম -শীতল কষ্টের আগুনকে  আবিষ্কার করা  যায় ।  এখানেই যা মানুষের প্রয়োজন তা যেন হয়ে উঠেছে  বিলাসিতা ।দুধ ভাত বাঙালি জাতির অতি প্রাচীন কাল থেকেই প্রত্যাশিত বিষয় ।আমরা কবি রায়গুণাকর  ভরত চন্দ্রের মুখেও  অষ্টাদশ  শতকে শুনেছি ঈশ্বরী পাটনির বর প্রার্থনা “আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে” অর্থাৎ ন্যূনতম   প্রয়োজন টুকু মিটলেই তারা সুখী-খুশি ।এই গল্পে দেখেছি  আমরা যখন ওহিদুল্লা  মহুরির বাড়িতে গিয়ে নিজেদের বিক্রি করা গরুর দুধ আবদার করে  মাতা জয়নাবের শেষ ইচ্ছে দুধ ভাত খাওয়ার  ইচ্ছে  পূরণের জন্য। সে বলে তার মায়ের হাউস অর্থাৎ শখ হয়েছে দুধ ভাত খাওয়ার । দু দুটো আন্দোলন হয়েছে ।নতুন স্বাধীন সূর্যও  উঠেছে কিন্তু  বাঙালি সাধারণ মানুষ সূর্য গ্রহণের গাঢ়  অন্ধকার কাটিয়ে উঠতে পারেনি ।বাংলাদেশের কৃষকদের এই খাদ্য সংকট , অভাব অনটন  এক নির্মম সত্য এইভাবেই ইলিয়াস সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন এই গল্পের শাখা প্রশাখায়।

  এই গল্পে আমরা  অবাক হই  না যখন  দেখি মহুরির অনুপস্থিতিতে  হারুন মৃথার কটূক্তি শুনি  ” তর মায়ের প্যাট খারাপ , তগো হইছে মাথা খারাপ ।“ এ তো ৭০ দশকের বাংলাদেশের কঠিন নিরেট সত্য ।ইলিয়াস ধরতে চেয়েছেন এই সময়কে ,বোঝাতে চেয়েছেন দেশভাগ ,স্বাধীনতার পর   মেকি ভেগ ধারীদের আসল রুপ ।আখতারুজ্জামান ইলিয়াস  এই গল্পে এই  সময়ের মানুষের প্রতিদিনের  জীবন যাপনের   একটি স্পষ্ট ছবি এঁকে আঘাত করেছেন মানবতার সোনালী অট্টালিকায় ।ইলিয়াস বাংলাদেশের  সাধারণ মানুষের নাড়ীর যন্ত্রণা বুঝতে পেরেছিলেন বলেই তো  তিনি ইলিয়াস ।





          

সুকুমার রুজের অণুগল্প : জামা






সুকুমার রুজ
জামা

 সোনাদা, পঞ্চাশ হাজার  টাকার খুব দরকার, ধার দেবে? সামনের মাসেই তো ভোট, ভোট পেরোলেই শোধ দেব!
 ---- এত টাকা কী করবি রে!
 ---- একটা জামা কিনবো।
---- জামা! পঞ্চাশ হাজার টাকার!
 ----- পঞ্চাশ হাজার নয়, ষাট হাজার টাকার। দশ হাজার জমিয়েছি।
 ----- সেতো তোর তিন মাসের রোজগার। তোর মাথার ঠিক আছে তো!
 ------ হ্যাঁ, তার জন্যই তো ওই জামা কিনবো। ওই জামা গায়ে দিলে আর আমার টাকার চিন্তা করতে হবে না।
 ----- কী রকম! জামার এত বিশেষত্ব কী?
----- ওই জামার রং বদলায়। যখন যেখানে যে মিটিং - মিছিলে যাব,
তখন প্রয়োজন অনুযায়ী সেটা লাল, নীল-সাদা, গেরুয়া কিংবা সবুজ রঙের হয়ে যাবে। ভোটের আগে এক মাস মিটিং-মিছিলে গেলেই...
 ------ চল, আমিও তোর সঙ্গে যাবো জামা কিনতে।