Saturday, May 4

উত্তরবঙ্গের জনজাতি : প্রদীপ রায়ের প্রবন্ধ


বিমল লামার ‘নুন চা’ : উত্তরবঙ্গের তামাং জনজাতির জন-জীবন


উত্তরবঙ্গের তামাং জনজাতিদের জনজীবন, লোক-ঐতিহ্য ও রাজনীতি কথাকার বিমল লামা (১৯৬৮) তাঁর আখ্যানভুবনের আঙিনায় চিত্রিত করেছেন বহুমাত্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে। ছোটোবেলা থেকে পাহাড়ের কোলে বেড়ে ওঠা, নিজেও তামাং জনজাতি সম্প্রদায়ের একজন হিসাবে লেখক এই জনজাতির জনজীবনকে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন গভীরভাবে। একথা বললেও  হয়তো অত্যুক্তি হবে না যে, স্বজাতীর প্রতি শ্রদ্ধা ও নিষ্ঠা  নিঃসন্দেহে তাঁকে তামাং জনজাতিকেন্দ্রিক আখ্যান গ্রন্থনায় বাড়তি প্রেরনা দিয়েছিল। সেই জায়গা থেকেই তিনি অখ্যানে নির্মান করতে থাকেন তামাং জনজাতির জনজীবনের নিজস্ব আবেগ ও আত্মীক অনুভূতিগুলিকে। যা আমরা সচরাচর তথাকথিত দেশ ও সমাজ গঠনের কারিগরদের চোখে এড়িয়ে যেতে দেখি।

উত্তরবঙ্গের তামাং জনজাতির জনজীবনের আখ্যান— বিমল লামার আত্মপরিচয়ের আখ্যান। জন্মসূত্রে পাওয়া প্রাকৃতিক সান্নিধ্য তাঁর সৃষ্টিকর্মকে নিরন্তর সজীব ও সতেজ রেখেছে। জীবনযাপনের সেই সুখানুভূতির কথা লেখক তাঁর এক স্মৃতিকথাতেও উল্লেখ করেছেন— ‘চা বাগান ঘেরা আমাদের সেই হিমালি গ্রাম।...ধাপচাষি মা আমার কোনও এক আষাঢ়ী বিকেলে চাষের ধাপেই কাহিল হয়ে পড়েন প্রসব বেদনায়। বনপ্রকৃতির মাঝে তখন তিনি পুরো একা। বেদনা সামলে তাড়াতাড়ি রওনা দেন ঘরমুখে। কোনও রকমে পৌঁছেও যান ঘরে। কিন্তু ঘরে ঢোকার আগেই ওই ঘর পাথরের গলিপথেই ভুমিষ্ঠ হয় তাঁর পুত্রসন্তান।... ভাবতাম জীবজন্তুর মতো এ কী ধরনের জন্ম ! আজ গর্ব হয় এই জন্মের কথা ভেবে, মনে হয় এক মানবী তাঁর সন্তানকে ভাগ করে নিয়েছিলেন প্রকৃতির সঙ্গে, তাঁর জন্মক্ষণেই।’১

বোঝা যাচ্ছে, লেখকের কলমের আঁচড়ে প্রকৃতি ও প্রকৃতি নির্ভর জনজাতিরা যে পাঠকচিত্তে ঘনিষ্ঠভাবে স্পর্শ করবে, তা স্মৃতকথা থেকেই স্পষ্ট। স্কুল ম্যাগাজিনে প্রকাশিত ছোটোগল্পের মধ্যে দিয়ে তাঁর সাহিত্যের পথে— পথ চলা শুরু হলেও প্রথম উল্লেখযোগ্য লেখা প্রকাশিত হয় দেশ পত্রিকায় সাহিত্য প্রতিযোগিতায়। জন্মের পর প্রথম শেখা ভাষা নেপালি (মাতৃভাষা)  বিমল লামা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যেও দক্ষ ‘রুশিকা’। তাঁর ভাষার বাঁধন ও চলনে সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ও রীতিমতো চমকে গিয়ে তাঁর পাঠ প্রতিক্রিয়ার জানিয়েছেন— ‘ লেখক কি সত্যিই আমাদের পাহাড় অঞ্চলের নেপালি, না কি কোন বাঙালি লেখকের ছদ্মনাম।’২

দুই. 

নৃতাত্ত্বিক দিক থেকে তামাং জনজাতিদেরকে আমরা দেখতে পাই মঙ্গোলীয় শাখার চৈনিক ভোট বংশের অন্তর্গত ভোট-বর্মী ভাষা বিভাগে।৩

বিভিন্ন গবেষকদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তামাং জনজাতির আদি বাসভূমির বর্নিত রূপরেখা  থেকে মোটামুটি এরকম একটি সিদ্ধান্তে উপনিত হতে পারি যে, উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলা (দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি ) ও ডুয়ার্সের চা বাগানের অঞ্চলগুলিতে (কালচিনি, বীরপাড়া, সামসিং, বাগ্রাকোট, দুমসিপাড়া, বুকিমপাড়া, রায়মাটাং, লঙ্কাপাড়া, দলসিং পাড়া, জয়গাঁও, দলমোর, নাগরাকাটা প্রভৃতি ) তামাংরা এসেছিল তিব্বত বা নেপাল থেকে। পেশা হিসাবে বেঁছে নিয়েছিল কৃষি, পশুপালন ও ইংরেজদের চা-বাগানের শ্রমিকের কাজ। সন্তবীর লামা তাঁর ‘তাম্বা-কইতেন’ গ্রন্থে একটি কিংবদন্তির সূত্র ধরে তামাংদের নেপাল দেশের আদিবাসী হিসাবে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন।৪

তামাংদের ভাষার সঙ্গে বেশি মিল খুঁজে পাওয়া যায় তিব্বতি ভাষায়। তামাংদেরকে তিব্বতি ভাষায় মুল্মী-ও (সীমানার মানুষ) বলা হয়। তাঁদের মধ্যে সম্বোটা লিপির প্রচলন শুরু হয় রাজা সঞ্চন গোম্পের প্রেরণায়। তামাংদের নিজস্ব লিপি ও ভাষা থাকা সত্ত্বেও উত্তরবঙ্গে এই ভাষার চর্চা ও প্রচলন বর্তমানে  সেরকমভাবে আর দেখা যায় না। ক্ষমতাবান শ্রেণির ভাষার চাপে তাঁদের ভাষা আজ অস্তিত্বের সংকটে । তবে তামাংদের বিয়ের গান, রিচ্যুয়াল ও মন্ত্রে তামাং ভাষার ব্যবহার আজও শুনতে পাওয়া যায়। 

তামাং জনজাতির নিজস্ব লোকগীতি তামাং সেলোয় শুরুতে মাতৃবন্দনার কথা পাওয়া যায়। এথেকে আমরা সহজে বুঝে নিতে পারি— মাতৃতান্ত্রিক সমাজে তামাং নারীদের গুরুত্বের কথা। যেখানে নারীরা সমাজে  যথেষ্ঠ মর্যাদা ও সম্মানের জায়গা পেত। কিন্তু তাঁদের এই ধারার বদল হতে থাকে আধুনিক নেপালের রূপকার পৃথ্বিনারায়ণ শাহ-র নেতৃত্বে হিন্দুত্বকরণের প্রক্রিয়ায়। হিন্দু ধর্মের হাত ধরে তাদের সমাজেও চলে আসে পুরুষদের প্রাধান্য। সামাজিক, রাজনৈতিক, আর্থিক জীবনেও ঘটতে থাকে বিরাট পরিবর্তন। তামাংদের বারো তামাং বলা হয় পূর্বপুরুষেরা বারোটি অঞ্চলে বাস করার কারণে।৫

তাঁদের বসবাসের প্রত্যেকটি অঞ্চলকে বলা হয় ‘কিপট’। এদের মধ্যে আঠারোটি জাতের কথা ও প্রায় ১৩৮টি থর বা গোত্রের কথা গবেষকরা অনুসন্ধান পেয়েছেন। উত্তরবঙ্গের রাভা, মেচ, টোটো জনজাতির মতো তামাং জনজাতির প্রাচীন সমাজ ব্যবস্থায় তাঁদের নিজেদের মধ্যে নির্বাচিত একটি সংগঠন সমাজের শৃঙ্খলা বজায় রেখেছিল। একে বলা হয় ‘ঘেদুং’। বর্তমানে সামাজিক শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে এই প্রথার পরিবর্তন হলেও তামাংদের বিয়ের সময়ে ‘ঘেদুং’—এর গুরুত্ব আজও প্রাসঙ্গিক। তামাংদের বাড়ির সামনে  পবিত্রভাবে পূজার্চনার পরে এক ধরনের পতাকাদণ্ড ব্যবহার কর হয় যা দেখে তাঁদের চিনে নেওয়া যায় সহজে, আলাদা ভাবে। এক সময় তামাংরা তাঁদের পোশাক-পরিচ্ছদ নিজেরাই তৈরি করত। পুরুষরা পোশাক হিসাবে ব্যবহার করত লুকনি (নিম্নাঙ্গের পোশাক), তদুং (উপরের অংশে), কুলাগি (টুপি), কে (কোমর বন্ধনী) আর মেয়েরা পরত দোরমা (বড় ফ্রক), গ্যাপঠুল (কোমরের পিছনে পরার জন্য), হাংগ্রে (ফুল হাতা ব্লাউজ), শ্যামা (লুঙ্গির মতো পরার জন্য ), ধরচুলা বা কোমরবন্ধ। লামাদের দেখা যায় ছুরা ও বোনবোরা লাল পাগড়ি বেঁধে থাকতে। মেয়েরে অলংকারেও রয়েছে বিচিত্র নাম যেমন— শিরফুল, শিরবন্দি, ঢুংরি, চেপটে সুন, পুঁয়ালেকো মালা, বিরমালা প্রভৃতি।৬

তামাংদের সমাজে আধুনিক গণমাধ্যমের ছোঁয়া ধীরে তাঁদের পোশাক ও অলংকারের মধ্যেও দেখতে পাওয়া যায়।

তামাংদের ঘরের আদল বর্তমানে পরিবর্তন হলেও ডুয়ার্সের বনবস্তিগুলিতে এখনও চোখে পরে কাঠ, বাঁশ ও খড়ের ছাউনি দেওয়া গোলাকার ঘরের নমুনা। তামাংদের বাড়ির সামনে ‘দোরজু’ বা ‘লুং দার’ টাঙানো থাকে, যেটা কেউ মারা গেলে বা পুজো করার জন্য ব্যবহার করা হয়।৭

তামাং সমাজে প্রচলিত কয়েটি পুজোর উল্লেখ পাওয়া যায়। যেমন— খ্যাপ্পাসুঙ পুজো, ভূমি পুজো, গোঠ পুজো। খ্যাপ্পাসুঙ পুজোয় পিতৃপুরুষের স্মরণ করে পরিবারের বয়সে বড় কেউ পুজো করে। ডুয়ার্সের বিভিন্ন অঞ্চলে মহালায়ার দিন থেকে শুরু করে চলে দুর্গাপুজোর ষষ্ঠির  দিন পর্যন্ত। এদের মধ্যে ভূমি পুজো হয় কার্তিক ও অগ্রহায়ণ মাসে। বিভিন্ন রকম রোগ ও প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তাঁদের এই প্রকৃতির কাছে মাথা নত করা, প্রকৃতির প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন। প্রাকৃতিক সম্পদ ও গৃহপালিত পশুকে রক্ষা করার জন্য তাঁদের মধ্যে ‘গোঠ পুজোর’ প্রচলন দেখা যায়। তামাংদের এই গোঠ পুজোর সঙ্গে উত্তরবঙ্গের গোরখ নাথ দেবতার পুজোর উদ্দেশ্যের সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায়। দুটো পুজোর সঙ্গেই প্রকৃতিকে রক্ষা করার প্রসঙ্গ যুক্ত।

তামাং সমাজে নবজাতক শিশু জন্মানোর আগে বিশেষ কিছু বিধিনিষেধ গর্ভবতী মায়েরা  মেনে চলে। সেই সময় তাঁদের নদনদী পারাপার বা শবদাহের কাছে যেতে দেওয়া হয় না। শিশু জন্মানোর পর তিনদিন অশৌচ পালোন করেন। তিনদিন পর হয় নামকরণ (থ্যাস্পাপ ঠুই) অনুষ্ঠান । কানখ্যাবা বা অন্নপ্রাশন অনুষ্ঠান হয় মেয়েদের ক্ষেত্রে পাঁচ মাস ও ছেলেদের ক্ষেত্রে ছয় মাসে। শিশুকে নতুন বস্ত্র পরিয়ে ভাত খাওয়ায় বাড়ির বসস্ক ব্যক্তি। এই সমাজে বিয়ের পাত্রপাত্রীকে বলে ‘সেবু’ ও ‘সেমু’। তাঁদের মধ্যে বিয়েতে ঘটক বা লমির কাছ থাকে পাত্রপাত্রির সন্ধান দেওয়া। তামাং জনজাতির মধ্যেও একই গোত্রের মধ্যে বিয়ে হয় না। কিন্তু  ভিন্ন সম্প্রদায়ের সঙ্গে বিয়ে হলে তা সামাজিক স্বীকৃতির জন্য মেয়েকে তামাং সম্প্রদায়ের কেউ একজনের সঙ্গে ভাইবোনের সম্পর্ক স্থাপন করতে হয়। বিয়েতে ডম্ফু বাদ্যযন্ত্র সহযোগে গান গাওয়ার রীতি প্রচলিত। এই জনজাতির শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানকে বলা হয় ‘ঘেয়া’। এই অনুষ্ঠান পরিচালনা করে প্রধান লামা। শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানে তামাংদের অনেকে ‘বাকপা’ নৃত্যের আয়োজন করে। বাকপা, জুংবা, চই এই নৃত্যগুলি যুদ্ধনৃত্য। চই নৃত্যের মধ্যে দিয়ে মৃতের আত্মাকে অশুভ শক্তি থেকে রক্ষা করে স্বর্গের পবিত্র স্থানে নিয়ে যাওয়া যায় বলে তাঁরা বিশ্বাস করে।  তামাংদের সমস্ত অনুষ্ঠানে গানের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। দেব-দেবীর পুজোর প্রসাদ বিতরনের সময় তাঁদের গান হল ‘সাংলাহুয়াই’। কুলদেবতার ইতিহাস বলার সময় তাঁদের গান— ‘রুইলাহুয়াই’। আর ‘থাবরয়য়াই’ গান হল তাঁদের দুঃখ, বিরহ, বেদনা প্রকাশ করার জন্য।৮                 

তিন.

উত্তরবঙ্গের তামাং জনজাতির এই সামগ্রিক জীবনালেখ্য ও তাঁদের রাজনৈতিক চিন্তা চর্চার বিস্তৃত পরিসর বিমল লামা তাঁর  নুন চা (২০১২) উপন্যাসে যেন একটু একটু করে নির্মান করতে চাইলেন। সমগ্র উপন্যাসটিকে তিনি বত্রিশটি শিরোনামে নামাঙ্কন করে চায়ের দেশের নুন কথার অনেক না বলা কথা দিয়ে সাজিয়ে তুলেছেন তাঁর আখ্যানের পটভূমি । আমরা জানতে পারি, সাদা বরফের চাঁদরে ঢাকা— পাহাড়ের উপরের অংশে সূর্যের আলোয় আপাত হাসি মুখের নীচে  বিভিন্ন খাঁজে কী ভাবে চাঁপা পরে রয়েছে কত দুঃখ-যন্ত্রণা ও হাহাকার। নিপুন শিল্পীর মতো  আখ্যানকার নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখিয়েছেন জনজাতিদের জীবনযাপনে সে সব প্রতিদিনের বেঁচে থাকার সংগ্রাম, জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সুযোগ না পাওয়ার যন্ত্রনাগুলিকে। এপ্রসঙ্গে মনে পড়ে যায় নুন চা উপন্যাস নিয়ে সাহিত্যিক দেবেশ রায়ের মন্তব্যের কথা। তিনি বলেছেন— ‘গত কয়েক বছরের সবচেয়ে ভাল বাংলা উপন্যাস লিখেছেন একজন নেপালি- বাঙালি।’৯

 সত্যিই নুন চা উপন্যাস পড়তে পড়তে দেবেশ রায়ের এ কথার পূর্ণ সমর্থন না করার কোন উপায় থাকে না। উত্তরবঙ্গের পাহাড়ি অঞ্চলের আনাচকানাচ এমন অনুপুঙ্খ বর্ননা এ উপন্যাসের আগে— সে ভাবে দেখা যায় না। তবে পাহাড়ি অঞ্চলের জনজাতিদের শুধু গোর্খালি জীবনযাপন ও রাজনীতি চিন্তা চর্চার চালচিত্রই নয়, উপন্যাসে চরিত্রদের নিজেদের ভিতরকার সম্পর্কের ভাঙ্গা-গড়া ও নকশা নিয়ে রয়েছে একটি চমৎকার পরীক্ষা নিরীক্ষা।

উপন্যাসের প্রথমে পুলপারের সবজিবাজারকে ঘিরে জনজাতিদের জীবন ধারণের বিচিত্র পরিচয় পাই। উপন্যাসের প্রধান চরিত্র উরগেন তামাং-এর জীবনের বিভিন্ন বাঁক-বদল ঘটে— এই পুলপারের সবজি বাজারে ব্যাপারী হিসাবে জীবন শুরু করে। উরগেন তামাং এর এপথে আসা ফুলমায়ার হাত ধরে। সবজির ব্যাপারী তাঁর একমাত্র পেশা নয়। সপ্তাহের দুটো দিন শুক্র, শনি বাদ দিয়ে অন্য দিনগুলিতে সে মায়ের সঙ্গে ধাপ চাষে ব্যস্ত থাকে। তামাংদের কাছে খেতবারি সন্তানপালনের মতো কাজ। শুধু গায়েগতরে খেটে নয় যেখানে তাঁরা অনুভব করে আন্তরিক ভালবাসার। এই রচনায় উরগেন ও ফুলমায়ার সংলাপের মধ্যে দিয়ে উঠে আসে পাহাড়ের বসতির মানুষদের প্রতি দার্জিলিং শহরের মানুষদের বৈষম্যমূলক আচরণ, তাদেরকে গেঁয়ো কোদে বলে ব্যঙ্গ করার প্রসঙ্গ। অথচ বসতির লোকদের রক্ত জল করা পরিশ্রমে তাজা সবজি শহরে পৌঁছোয় শহরের বাবু সাহেবের জন্য। উপন্যাসে ফুলমায়ার কথায় সেই ক্ষোভ দেখতে পাই—
এই কোদেরা না থাকলে খেতিস কী ? এই ঠান্ডায় ভোররাতে উঠে...।১০

পুলবাজারের পথে পথে ঘিরে থাকা বিভিন্ন লোকবিশ্বাস, লোক-কথা ও আপদেবতার প্রতি বিশ্বাস তামাং জনজাতিরা কী ভাবে লালনপালন করত প্রসঙ্গক্রমে লেখক সে বিষয়গুলিকেও দেখিয়েছেন। তাঁরা বিশ্বাস করত তেমাথার মোড়ে কলাপাতার ওপর আটার তৈরি রাখা পুতুল কেউ আসাবধানে ডিঙোলে অন্যের অপদেবতার বালাই তাঁর ঘাড়ে এসে পরবে। পাহাড় জঙ্গলে সবাই এই বিশ্বাসকে শ্রদ্ধা করে। ভুলক্রমে কেউ ডিঙ্গোলে যত বড়ো ঝাঁকরি হোক না কেন সেই বালাই থেকে মুক্তি নেই। ধনমানধুরায় এই ঘটনায় ভুক্তভোগী বুদ্ধিরাম নামে একজনের কথা পাওয়া যায়, যে ছোটোবেলায় সেই আটার পুতুলে লাথি মারায় তাঁর পা পঙ্গু। এই উপন্যাসে উরগেন ও ফুলমায়ার মধ্যেও এই অপদেবতার প্রতি বিশ্বাস লক্ষ্য করা যায়। এক সঙ্গে  পুলবাজারের পথে আসতে আসতে ফুলমায়াও হঠাৎ কলাপাতার ওপর আটার তৈরি কয়েকটি গুটলি পুতুল দেখে লাফ দিয়ে পিছিয়ে গিয়েছিল। এভাবে কঠোর জীবন সংগ্রামের মধ্যেও তাঁদের লোকবিশ্বাস ও লোকদেবতার প্রতি শ্রদ্ধা নিয়ে এগিয়ে চলে জীবন। পিঠে বাঁশের বোনা বিরাট ডোকো, পাটের নামলো দড়ি দিয়ে মাথা আটকিয়ে শাকসবজির বোঝা বহন করার সময়েও তাঁদের মুখে থাকে তৃপ্ত হাসির প্রলেপ। লেখক তামাং জনজাতি মেয়েদের পাহাড়ের প্রাকৃতিক পরিবেশে জীবন সংগ্রামের কথা জানাতে গিয়ে  লিখেছেন—
হিম হাওয়ার সঙ্গে যুঝতে গিয়ে কমবয়সি মেয়েদের ফরসা চওড়া গালগুলো লাল হয়ে উঠেছে। পাতার শিরাতন্ত্রের মতো হালকা ফাটলের জাল, পাহাড়ের ভালোবাসা দু’গালে চড়চড় করছে। নামলোর চাপে চুল লেপটে আছে মাথার সঙ্গে। প্রায় কোন অলংকার নেই কারও গায়ে। কিন্তু সবার কবজিতে ঘড়ি। পুরুষ্টু হাতে এঁটে বসে আছে ধাতু ও চামড়ার ফিতে। এরা বুঝেছে ঘড়ির চেয়ে কেজো গয়না হয় না।১১

কথাকারা বিমল লামার এভাবেই কথা দিয়ে আঁকতে থাকেন উত্তরবঙ্গের জনজীবনের মেয়েদের সংগ্রামী মানুষিকতাকে। যাঁরা জীবন ও জীবিকার তাগিদে প্রাকৃতিক দুর্যোগকে জয় করে হাসি মুখে, তাঁরা আমাদের বুঝিয়ে দেয় নারীর সৌন্দর্য বৃদ্ধি পায় অলংকারে নয়, কর্মে।

তামাংরা শুধু নিজেদের সম্প্রদায় নয়, অন্য সম্প্রদায়ের প্রতি ছিল সমানভাবে শ্রদ্ধাশীল। নুন চা উপন্যাসে উরগেন তামাংকে আমরা ভাবতে দেখি ভিন্ন সম্প্রদায়ের দাইদের কথা যারা পুলবাজার-বিজনবাড়িতে মোটবাহকের কাজ করে। উরগেন আক্ষেপ করে সেই সব নাম না জানা দাইদের সঙ্গে মানবিক সম্পর্ক গড়ে না ওঠায়। উরগেনের খুব জানতে ইচ্ছে করে নাম না জানা দাইদের পরিচয়, তাঁদের খোশগল্প, হাসিঠাট্টা, প্রেম-বিরহ, শোক-তাপ। সারেঙ্গি ও আড়বাঁশির সুরে গানে গানে খবর পেতে চায় বনের ধারে কোন পাহাড়ি গ্রামের। যা হয়তো উরগেন, ফুলমায়া, ডোলমাদের (বিভিন্ন জনজাতির) গল্পের মতো একই সুরে বাঁধা। উরগেন তামাং-এর এই ভাবনার মধ্যে দিয়ে লেখক ভিন্ন জনজাতি সম্পর্কে তামাং জনজাতির মানুষের মানবিক সম্পর্কের স্তরগুলি দেখাতে চাইলেন। তিনি দেখাতে চাইলেন এই জনজাতিরা (তামাং) শুধু মানুষের প্রয়োজনে নয়, আত্মিক সম্পর্কের মধ্যে দিয়ে পারস্পরিক ভাব বিনিময় করে হয়ে উঠতে চায় প্রিয়জন।

এই উপন্যাসের তামাং জনজাতিদের মধ্যে মৃত্যুর পরে বিভিন্ন রীতিনীতি ও মৃত ব্যক্তির অতৃপ্ত আত্মার শান্তির উদ্দ্যেশে ঝাকরিদের কথা পাওয়া যায়। তামাং জনজাতির যুবক চ্যাংবা— ভালুর আক্রমনে মারা গেলে তাঁকে দাহ করা হয়। চ্যাংবার আত্মার শান্তি কামনায় বিস্তারিত বিষয়গুলি লেখকের কথায় আমরা জানতে পারি—
আজ থেকে চ্যাংবার বাড়িতে শুরু হবে লামাপড়া। একদল লামা দিনরাত পবিত্র গ্রন্থ পাঠ করবেন মৃতের আত্মার শান্তিকামনায়। তাঁরা এসে হাজির হয়েছেন তাঁদের সাজসরঞ্জাম নিয়ে। লাভা, ঝ্যামটা, ঢ্যাংরো, কাংলিং, ঘ্যারলিং এইসব বাদ্যযন্ত্র দিনরাত বাজাতে থাকবে মন্ত্রচ্চারণের সঙ্গে। অতিথিরা আসবে যাবে সারাদিন। সাধ্যমতো সাহায্য করবে তাঁরা।... মৃতের আত্মার শান্তি কামনায় বাতিদানের খরচ উঠে আসবে অতিথিদের দানেই। এক একবারে একশো আটটা করে থরে থরে বাতি। আর বাতি দান চলবে তেরো দিন ধরে। তারপর শ্রাদ্ধ।১২

শ্রাদ্ধের দিন দেখা যায়, গল্পগুজব, হাসি-ঠাট্টা, তাস-জুয়া বিড়ি রক্সি সব মিলিয়ে জমজমাট। শ্রাদ্ধে সবাই দুধ, রক্সির সঙ্গে কিছু আর্থিক ভাবে সহায়তা করে। দিনের আলো মিলিয়ে যাওয়ার আগেই তাঁদের গুটিয়ে আনতে হয় শ্রাদ্ধানুষ্ঠান।

চার.

বিমল লামার আখ্যানে উত্তরবঙ্গের তামাং জনজাতির জনজীবন, লোক-ঐতিহ্যের পাশাপাশি তাঁদের রাজনৈতিক আদর্শ ও আত্মত্যাগ কীভাবে তাঁদের জনজীবনের নতুন ইতিহাস ও বিকল্প সমাজ দর্শনের ভাবনার জন্ম দিচ্ছে বিভিন্ন রাজনৈতিক ঘটনা ও চরিত্র বিশ্লেষণে সে কথা স্পষ্ট। ১৯০৭ গোর্খাল্যাণ্ড আন্দোলনের জন্ম থেকে ২০১৮—এই দীর্ঘ একশো বছরের বেশি সময়ের ব্যবধানে এসেও উত্তরবঙ্গের জনজাতিদের গোর্খাল্যাণ্ড আন্দোলনের ইতিহাস আমাদের নতুন করে ভাবায়, নতুন ভাবনার জন্ম দেয়। জনজাতিদের এই রাজনৈতিক আদর্শকে তাই হয়তো অন্য পাঁচটি ক্ষমতা লোভী রাজনৈতিক দলের সঙ্গে একই নিক্তিতে মেপে বিচার করলে বড় ভুল হবে। কারণ জনজাতিদের এই রাজনৈতিক আদর্শে মিশে রয়েছে তাঁদের জাতিসত্তা তথা আত্মপরিচয়ের আবেগ, তাঁদের স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের গভীর দুঃখ আর হাহাকার। নুন চা উপন্যাসে সুকরামের মুখে  সেসব আবেগ ঘন কথাই শুনতে পাওয়া যায়—
গোর্খাল্যান্ড হুনে ছৈ না। এ হবার নয়। কে দেবে তোকে গোর্খাল্যাণ্ড। ওই ধোতিতে গিঁটমারা বাঙ্গালিগুলো।... আধি বাঙালি ভাবে আমরা চিনা, আরশোলা খাই। কেউ ভাবে আমরা জাপানি, সাপ খাই। কেউ ভাবে না আমরা ইণ্ডিয়ান।১৩

নিজেদের জাতিসত্ত্বা গঠনের জন্য, নিজেদের সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার তাগিদে এই রচনায় উরগেনের মতো অনেকেই গোর্খাল্যাণ্ডের স্বপ্নে ঝাঁপিয়ে পড়ে আন্দোলনে। ডি. কে উরগেনকে বলেছিল গোর্খালিরা এতদিন তাঁদের রক্ত পরের জন্যই ঝড়িয়েছে। কখনও রাজা, কখনও ব্রিটিশ আবার কখনও মাকপার জন্য। এবার তাঁরা প্রতিজ্ঞা নিয়েছে নিজেদের জন্য রক্ত ঝরানোর। গোর্খাল্যাণ্ডের যুদ্ধ তাঁদের কাছে হয়ে ওঠে মুক্তির যুদ্ধ। এই উপন্যাসে কমলের আবেগ মথিত কণ্ঠে শোনা যায় তাঁদের বিভিন্ন সংকটের কথা—
বঙ্গাল বঙ্গালিদের জন্য। আমরা বংগালী নই। তাহলে আমাদের জায়গা কোথায়? উত্তর দিল কমল নিজেই, কোথাও না আমরা না ঘরকা, না ঘাটকা। কলকত্তা গিয়ে যদি বলি আমি বঙ্গালী বঙ্গালিরাই হাসবে। বঙ্গালের বাইরে গিয়ে যদি বলি আমি ইন্ডিয়ান, ওরা সন্দেহ করবে। ১৪

  গোর্খাদের এই সংকট থেকে মুক্তি সম্ভব একমাত্র গোর্খাল্যাণ্ড গঠন করেন। কিন্তু তাঁদের একাজে  কঠিন বাঁধা গোর্খা নিজেই যাঁরা বঙ্গাল সরকারের দালালি করে নিজেদের আখের গুছিয়ে নেয়।

গোর্খাল্যাণ্ড আন্দোলনের রাজনৈতিক আদর্শ কেবল অধিকার আদায় নয়, উত্তরবঙ্গের জনজাতি নারীদের জীবন দর্শনকে কী ভাবে বদলে দিয়েছিল এই উপন্যাসে ফুলমতি, যশোমতি, ডোলমা, জুনির মতো মেয়েদের চরিত্র বিশ্লেষণের মধ্যে দিয়ে লেখক বুঝিয়ে দিয়েছেন। যশোমতি তাঁর নিজের ঘরে গোর্খাল্যাণ্ড আন্দোলনের মিটিং এর ছেলেদের সেবা করে জীবনে বেঁচে থাকার অর্থ খুঁজে পায়। সে অনুভুতির কথা  আমরা লেখকের কথায় জানতে পারি—
জোয়ান ছেলেদের দলকে নিজের ঘরে ডেকে আদর আপ্যায়ন এর আগেও সে করেছে। বিনিময়ে পেয়েছে চরম শিহরণ, ভরা তৃপ্তি, গায়েগতরে পরম সুখ। আজও সে একদল ছেলেকে তাঁর ঘরে বসতে দিয়েছে । ওদের আদর আপ্যায়ন করছে। বিনিময়ে যা পাচ্ছে অবাক করে দিচ্ছে যশোমতীকে। এই প্রাপ্তির কোন ছাপ নেই শরীরের ওপর। কিন্তু মনটাকে যেন হাওয়ায় ভাসিয়ে দিয়েছে।১৫

ডোলমা ভোটে জাতের নারী হয়েও  নিজের জীবন বিপন্ন করে পুলবাজারে পুলিশের গুলির হাত থেকে উরগেনকে বাঁচিয়েছে। ডোলমার অন্য সম্প্রদায়ের প্রতি নিস্বার্থ প্রেম উরগেনের কথায় জানতে পারি—
ওরা ভোটে, টিবেটের লোক। নিজের ঘর থেকে ওরা বিতাড়িত। ঘর থেকেও বেঘর ওরা, উদবাস্তু। সে যা করেছে খুবই উচু মানের কাজ। একটা জাতির পাশে এসে দাঁড়িয়েছে নিঃস্বার্থভাবে।১৬
 
‘গোর্খা মানে অয়াচম্যান’ বড়লোকদের বানিয়ে তোলা এই  নিয়ম উরগেন বদল ঘটাতে চায়। চকবাজারের সামান্য সবজীর ব্যাপারী থেকে সে হয়ে ওঠে গোটা সিংতাম চা বাগানের গোরামুমোর প্রেসিডেন্ট। মিটিং করে সাধারণ মানুষকে বোঝায় গোর্খাদের নিজস্ব অধিকার। উরগেন স্বপ্ন দেখে নতুন গোর্খাল্যাণ্ডে জুনিকে নিয়ে ঘর বাঁধার, কিন্তু ক্ষমতাবান শাসক শ্রেণি তাঁদের সেই স্বপ্নকে বারবার ভেঙে চুরমার করে দেয়। জুনিকে পেতে হয় শাসক দলের সি. আর. পি দের  হাতে গন বাসরের আস্বাদ।

পাঁচ.

বিমল লামার আখ্যানে উত্তরবঙ্গের তামাং জনজাতির জনজীবন, লোক-ঐতিহ্য ও রাজনৈতিক জীবন শেষ পর্যন্ত হয়ে ওঠে জনজাতিদের নতুন জীবন দর্শন। যে পথে সব জনজাতিরা পাবে তাঁদের নিজেদের আধিকার, বেঁচে থাকার মানে। জাতিসত্তা গঠনের লক্ষ্যে সব বিভেদ ভুলে জনজাতিরা অনুভব করে একাত্মতার বোধ।


তথ্যসূত্র :
১. তিতির, সঞ্জয় সাহা (সম্পা.), কোচবিহার, জানুয়ারী— ২০১৮, পৃ. ৩৫৪
২. আনন্দ বাজার পত্রিকা, ‘আদতে আত্মপরিচয়ের আখ্যান’, শিলাদিত্য সেন, কলকাতা সংস্করণ, শনিবার ১৩ অক্টবর, ২০১২, পুস্তক পরিচয়,পৃ. ২
৩. নাথ,প্রমোদ, তামাঙ, লোকসংস্কৃতি ও আদিবাসি সংস্কৃতি কেন্দ্র, তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগ, কলকাতা, মার্চ, ২০১১, পৃ. ১১
৪. পূর্বোক্ত, পৃ. ১২
৫. পশ্চিমবঙ্গ (জলপাইগুড়ি জেলা সংখ্যা), তারাপদ ঘোষ (সম্পা.) তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগ, কলকাতা, ১৪০৮, পৃ. ১৬৪
৬. পূর্বোক্ত, তামাঙ, পৃ. ২৩
৭. পূর্বোক্ত, তামাঙ, পৃ. ৪১
৮. পূর্বোক্ত, তামাঙ, পৃ. ৪৪
৯. আনন্দ বাজার পত্রিকা, কলকাতা সংস্করণ, ২৪ জুলাই ২০১২
১০. লামা, বিমল, নুন চা, সপ্তর্ষি, কলকাতা, জানুয়ারি, ২০১২, পৃ. ৮
১১. পূর্বোক্ত, পৃ. ৯
১২. পূর্বোক্ত, পৃ. ৩০
১৩. পূর্বোক্ত, পৃ. ১৬৭
১৪. পূর্বোক্ত, পৃ. ১২৪
১৫. পূর্বোক্ত, পৃ. ১২৫
১৬. পূর্বোক্ত, পৃ. ১৬৫




               


           
       
                 
         
      

নবনীতা সান্যালের পাঠ প্রতিক্রিয়া : কথা কিংবা কাহিনি


নিচের লিংকে যান :


কথা কিংবা কাহিনি : অলোক গোস্বামী

দ্বিতীয় পৃষ্ঠা 
  
তৃতীয় পৃষ্ঠা 

চতুর্থ পৃষ্ঠা