Saturday, December 28

মহম্মদ লতিফ হোসেন - আউয়াল আহমদ-এর ‘ছিটগ্রস্থ’ : বাংলাদেশে অবস্থিত ভারতীয় ছিটবাসীদের প্রবহমান জীবনযাত্রার চড়াই-উৎরাই-এর চালচিত্র






মহম্মদ লতিফ হোসেন -
আউয়াল আহমদ-এর ‘ছিটগ্রস্থ’ : বাংলাদেশে অবস্থিত ভারতীয় ছিটবাসীদের প্রবহমান জীবনযাত্রার চড়াই-উৎরাই-এর চালচিত্র


‘দ্রষ্টব্য ও করাতকল’ পত্রিকার সম্পাদক আউয়াল আহমদ (জন্ম-১৯৭৮) মূলত কবি। আমরা পেয়েছি তাঁর কাব্যগ্রন্থ – ‘সদ্যপুরাণ রূপকথা’। পাশাপাশি গল্পকার হিসেবেও তিনি দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য গল্পগ্রন্থ হল – ‘একটি জন্মদিনের মৃত্যু এবং একজন মৃতের জন্মদিন’। আউয়াল আহমদ-এর ছিটমহল বিষয়ক একটি গল্পই আমরা খুঁজে পাই। ‘ছিটগ্রস্থ’  নামক এই আখ্যানটি প্রকাশিত হয়েছিল রাজা সহিদুল আসলাম সম্পাদিত ‘চালচিত্র’ পত্রিকায়, ২০১৬ ফেব্রুয়ারি সংখ্যায়। গল্পটি পুনরায় সংকলিত হয় ২০১৮-য় বরেন্দু মণ্ডল সম্পাদিত ‘ছিটমহলের গল্প’  সংকলনে।   
‘ছিটগ্রস্থ’ গল্পটিতে সরাসরি কোনও কাহিনী নেই। জটিল বাক্যবন্ধের উপস্থাপনে কথাকার অজস্র ইঙ্গিতে গল্পের শরীর নির্মাণ করেছেন। কিছুটা রিপোটার্জ ধর্মী এই গল্পে তথ্য দেবার মানসিকতা কোথাও সুপ্ত হয়ে আছে। গল্পের আখ্যানপট ‘শালবাড়ি’ নামক বাংলাদেশে অবস্থিত একটি ভারতীয় ছিটমহল। তবে কেবল একক স্থানিক সীমাবদ্ধতায় আবদ্ধ রেখে গল্পের সংকটগুলিকে মেপে দেখা সম্ভব নয়। ‘শালবাড়ি’ কেবল তাই শুধু শালবাড়ি নয়, শালশিরি, শালবাহান, ঝলইশালশিরি হ’য়ে ‘ইতিহাস সন্ধানী গবেষণার উপাদেয় খোরাক’-এ পরিণত হয়। এই কাল্পনিক পটেই মিশে থাকে এক’শ বাষট্টিটি ছিটমহলের প্রবহমান যাপন যন্ত্রণার হালহকিকত। আভ্যন্তরীণ সংকটের দাবানলে ক্ষয় পেতে থাকা ছিটমহলগুলি তাই বাহ্যিকভাবে রাষ্ট্র ব্যবস্থার চোখে একরকম গবেষণাগার, একাডেমিক ডিসিপ্লিনের উল্লেখযোগ্য চর্চিত বিষয় মাত্র। যাদের উৎস, ইতিহাস, সংকটের ইতিবৃত্ত পিএইচ.ডি থিসিসের গ্রহণযোগ্য টপিক হ’তে পারে, কিন্তু এই চিন্তাচর্চা, এই অনুসন্ধান সাত দশকের আইডেনটিটি-হীন মানুষগুলির যাপিত জীবনের অনুষঙ্গ হ’তে পারে না কোনও অজ্ঞাত কারণেই। নাগরিকত্বের সংকট, আত্মপরিচয়হীনতার ক্রাইসিস-গুলিকে কথাকার উপস্থাপন করেছেন তাঁর আখ্যান নির্মাণের নিজস্ব স্টাইলে –
পিতৃ/মাতৃকুলের লেজুড়সমেত/ বিবর্জিত একটা নাম যে ছিল, থাকতে পারে, ভুলে যায়, ভুলে যেতে চায়, হয়তো, তারা। উত্তর প্রজন্মের পরিচয়টাই তখন প্রকট হয়ে ওঠে, নিজের অজান্তে, কাঞ্চনজঙ্ঘা দর্শনের মতো, ভ্রম অথবা সম্ভাবনা নিয়ে। বুধারু, আকালু, ফাকতাল – এসবও ওদের প্রকৃত নাম কিনা, তদন্তের অবকাশ রাখে না। কেননা মহম্মদ ইউনুছ, খগেন্দ্রনাথ বাড়ৈ বা আব্দুর রহিম প্রমাণের আপাত কোনো দলিল-দস্তাবেজ, সাক্ষী-সবুদ না থাকায় রিপোর্ট ফাইনাল। সময়/ঘটনাবিজড়িত, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যসম্বলিত কিংবা নিতান্তই অকারণে জুড়ে যাওয়া এই সকল সামাজিক/অসামাজিক নামেই আমরা সম্বোধন করতে থাকব আমাদের চরিত্রগুলোকে, জন্ম নিবন্ধন সনদ/নাগরিকত্ব সার্টিফিকেট/ জাতীয় পরিচয়পত্র ইস্যু হওয়ার আগে পর্যন্ত।                         
এরই মাঝে গল্পে প্রবেশ করে ছিটমহল বিনিময় চুক্তির রাজনৈতিক টানাপোড়েনের আবহ। আখ্যানের নামহীন চরিত্রটি যখন ফাকতালের বাপ আকালুকে প্রশ্ন করে –
তুই আছস খালি তোর লেপটিন আর কম্বল লেহেনে ! খবর পাইচি, না নাই ? তোর কিবা কহচে, নরেন মদি ত রাজি হোই গেইচে। ছিট বিনিময় এলা টাইমের ব্যাপার।
তখন এই স্বল্প ইঙ্গিতেই কথাকার দীর্ঘ সাত দশকের রাজনৈতিক চড়াই-উৎরাই-কে যেন স্পর্শ করতে চেয়েছেন। নেহরু-নুন চুক্তি (১০ সেপ্টেম্বর, ১৯৫৮), ইন্দিরা-মুজিব চুক্তি (১৬ মে, ১৯৭৪), হ’য়ে ২০১৫-য় পৌঁছে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের নতুন ক’রে ছিটমহল বিষয়ে উদ্যোগ গ্রহণ এবং শেষ অবধি কেন্দ্র এবং পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সদিচ্ছা ও সক্রিয়তায় স্থল সীমান্ত বিনিময় চুক্তি সম্পাদন – এই জার্নিটি নেহাত কম নয়। আন্তর্জাতিক এবং উভয় দেশের আভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক দ্বিধা-দ্বন্দ্বের এই অস্থিরতা গ্রাস করেছে ছিটবাসীদের ব্যক্তিগত যাপনকেও। ‘বিনিময়’ শব্দটি তাই অশীতিপর বৃদ্ধের কর্ণকুহরে প্রবেশ ক’রেও হৃদয়পটে খুব বেশী আলোড়ন সৃষ্টি ক’রে না। যোগীনের বাপের মতো প্রচার বিমুখ মুক্তিযোদ্ধা শেষ অবধি কোনও বিশ্বাসের কাছেই আশ্বস্ত হ’তে পারে না। ‘ছিটমহলবাসী’ ছাড়া যেন তাদের আর কোনও পরিচয়পত্র নেই। তবুও রাষ্ট্রবেত্তাদের পারস্পরিক ইচ্ছা-অনিচ্ছা, আপোষ নীতির গ্যাঁড়াকলে বদলে যায় ছিটবাসীদের ছাপোষা জীবন। বাংলাদেশে অভ্যন্তরে অবস্থিত ১১১টি ভারতীয় ভূখণ্ড রূপান্তরিত হয় বাংলাদেশী ভূখণ্ডে। ভারত-বাংলাদেশ যৌথ হেড কাউন্টিং ভারতীয় নাগরিকত্ব গ্রহণে অপশন প্রদান, অপশন প্রত্যাহার, পুনরায় অপশন প্রদানের মধ্য দিয়ে একদা রাজা-নবাবদের পাশা খেলা – দাবা খেলার ফসল ছিটমহল একবিংশ শতাব্দীতে পৌঁছে অসহায় ছিটমানুষদের দেশবদল, জাতীয়তা বদলের নিয়তিতে পরিণত হয়। পতাকা উত্তলন, ইলেকট্রনিক মিডিয়ার ব্রেকিং নিউজ, সরাসরি সম্প্রচার, স্থানীয় দৈনিকের বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ, ফেসবুক লাইভের ভিড়ে হারিয়ে যায় কারও স্বপ্ন, কারও দেশ, কারও সম্পর্ক, কারও জন্মভিটে। ছিটমহলের আখ্যান কোথাও পরিবর্তিত হ’য়ে যায় দেশ বদলের গল্পে। না-নাগরিক থেকে নাগরিকে রূপান্তরের পরেও অজস্র হারানো, অজস্র বেদনা, সম্পর্কের দোলাচলতা, ‘ছিটগ্রস্থ’-র মতো গল্পকে মাল্টিডাইমেনশনাল্‌ ক’রে তোলে।
এ গল্পের বাঁকবদল ঘটে ২০১৫, ২৬ নভেম্বরের ঘটনায়। পুশব্যাক নয়, নব্যভারতীয়র সম্মান নিয়ে বাংলাদেশে বসবাসকারী ভারতীয় ছিটমহলের কোনও কোনও ছিটবাসীরা নতুন দেশে যাত্রা ক’রলে অশীতিপর বৃদ্ধ যোগীনের পিতা শেষবারের মতো জন্মভূমিতে প্রার্থনার ভঙ্গিতে হাঁটু গেরে বসে। মিডিয়ার কোলাহল, ক্যামেরার ক্লিক্‌, বাহ্যিক অস্থিরতা তাকে স্পর্শ করতে পারে না। অজস্র প্রশ্নের মিছিলেও নিরুত্তর বৃদ্ধ জীবনের শেষ প্রান্তে পৌঁছে দশ আঙুলে আঁচড় দিতে থাকে তার জন্মভূমির শরীরে। এভাবেই তিনি যেন খুঁজে পেতে চান তার নিজস্ব অস্তিত্বকে, তার নিজস্ব ‘দেশ’-কে, যে দেশ কেবল ভৌগোলিক বেষ্টনী কিংবা কাঁটাতারে বিভক্ত কোনও রাষ্ট্র নয়, এ দেশ আসলে তার হৃদয়ে আজন্ম লালন ক’রে চলা ‘বাস্তু দেশ’। যেখানে মিশে থাকে পূর্ব পুরুষের শেকড়, আত্মসত্তা আর অজস্র স্মৃতির সিরিজ। নিশ্চল বৃদ্ধের ফ্ল্যাশব্যাকে ভিড় ক’রে আসে সাতচল্লিশ, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ হ’য়ে ছিটমহল বিনিময়ের পূর্বেকার অতিক্রান্ত সাত দশক, নির্মিত হয় নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন ব্যাংক — ‘পাঁজাকোলা করে বাসে তুলতে হয়, যোগীনের বাপকে, ডানহাতের তর্জনী তখনো ভূমি নির্দেশক।’ ভূমি নির্দেশক এই তর্জনীর বিপরীতেই দাঁড়িয়ে থাকে অজানা দেশ, প্রশ্নময় ভবিষ্যৎ। অধ্যাপক বরেন্দু মণ্ডল তাই যথার্থই বলেছেন—
অনাথ-ইতিহাসের সেইসব প্রাকৃতজনেরা এভাবে হারিয়ে যায় সময়ের অগোচরে। এই সব প্রাকৃতজনদের কথকতা নিয়েই এনক্লেভ স্টাডিজের স্বতন্ত্র পরিসরটি নির্মিত হয়ে ওঠে।           
এভাবেই অনাথ ইতিহাসের সেইসব প্রাকৃতজনদের হাত ধরেই যেন ‘ছিটমহলের গল্প’ দেশভাগের অনুষঙ্গ ছুঁয়ে ‘মানুষ ভাগ’-এর আখ্যানে পরিণত হয়। আউয়াল আহমদ স্পষ্ট কাহিনীর বুনটে নয়, স্বল্প ইঙ্গিতের আলো-আঁধারিতেই যেন নির্মাণ করেছেন এক টেনশনাল সিমট্রি। শৈল্পিক উৎকর্ষতার প্রশ্নে দ্বন্দ্ব থাকলেও পাঠকৃতিতে মিশে থাকে বিকল্প এক অনুভব, যে অনুভবের জারণ-বিজারণে ছিটবাসীদের প্রবহমান জীবনযাত্রার চড়াই-উৎরাইগুলিকে ধরা যায়, স্পর্শ করা যায়।