Friday, May 3

মেহেবুব আলমের গদ্য



স্মৃতির পাতা থেকে


কখনও মনে হয় সারাদিনান্তে আমি একটি বার নিজের কাছেই ধরা পড়ে যাই, যখন ডায়েরি লিখতে বসি। সকলের থেকে লুকিয়ে গোপনে আমি যদি কিছু করি, তাহলে আমি ও আমার ওপরওয়ালার বাইরেও আরো একজন তা জেনে যায়, সে হল আমার ডায়েরি। আয়নায় আমি আমার নিজের অবয়ব দেখি ঠিকই, তবে নিজের মনকে যখনই দেখতে ইচ্ছে করে এবং স্মৃতিকে তাজা রাখতে আমি এই ডায়েরি নিয়েই বসে পড়ি। এমনই একদিন ডায়েরির পাতা উল্টোতে গিয়ে হঠাৎ একটি পাতায় চোখ আটকে গেল।

দিনটি ছিল ২০১৮-র লক্ষ্মীপূজা। আমাদের বাড়ি থেকে একটু দূরে এক জেঠুর বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলাম গত লক্ষ্মী পূজায়। জেঠু ও জেঠিমণি দুজনেই প্রাইমারী স্কুলে চাকরি করেন। দুজনেরই উপার্জনে এবং কিছু টাকা লোনে তারা এক বিরাট অট্টালিকা খাড়া করেছেন। তবে বাড়িতে শুধু মাত্র মোটে তিন জন সদস্য। আর এক পরিচারিকা আছে লোপা। অনেক আগেই শুনেছি, তাদের একটি মাত্র পুত্র সন্তান। সে নাকি ভালো ভাবে কথা বলতে পারেনা, ঠিক করে হাঁটতে পারেনা, এমনকি ভালোমত দেখতেও পারেনা। এক কথায় যাকে আমরা প্রতিবন্ধী বলে থাকি। তার নাম ঋক। বার্ধক্যের কারণেই হোক বা লোকহাস্যের কারণেই হোক জেঠু ও জেঠিমণি আর দ্বিতীয় সন্তান নেননি। তাই স্বাভাবিক ভাবেই ঋক-ই ছিলো তাদের কাছে পৃথিবীসম। ঋক-ই তাদের যাবতীয় শান্তির ঠিকানা। চাকরি সূত্রে দিনের বেশির ভাগ সময়ই তাদের বাড়ির বাইরে থাকতে হয়। তাই তাদের অনুপস্থিতিতে ঋকের দায়িত্ব সামলায় লোপা। তার জন্য অবশ্য সে বেশি অর্থের দাবী করে। বাড়ির কর্তা তাতে সম্মতিও জানিয়েছে। তবে বেতন বাড়লেও ঋকের প্রতি লোপার দায়িত্ব কতটা বেড়েছে তা বলা ভার। লোপার দায়িত্ব শুরু হয় জেঠু ও জেঠিমণির স্কুলে যাবার পর থেকে। আর শেষ হয় তাদের স্কুল থেকে ফিরে আসার সাথে সাথেই। তার বাইরে আর এক মিনিটও বেশি নয়। সময় হিসেবে নির্ধারিত হয় তার দায়িত্ব বোধ। তবে লোপার মত চরিত্রের বাইরেও অনেক চরিত্রই আছে, যাদের মধ্যে অন্তত আন্তরিকতা বোধটি আছে। আর এমনি এক চরিত্র হল অনিল। ঋকের এই বয়ঃজ্যেষ্ঠ বন্ধু অনিল প্রতিদিন সন্ধ্যায় নিয়ম করে ঋককে শরীরচর্চা করায়, হাঁটতে ও কথা বলতে অভ্যাস করায়। উভয়ের বন্ধুত্বের মাঝে ‘সময়’ কোনো ভাবেই বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনা।
গত লক্ষ্মীপূজোর দিনেই ঋকের সাথে আমার প্রথম দেখা ও কথা হল। ঋকের বয়স হবে আনুমানিক পনের-ষোল। আমি গিয়ে ঋকের পাশেই বসে পড়লাম। জেঠু ও জেঠিমণিও রিকের পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। ঋকের সাথে ভাব জমাতে আমি ঋককে একটি প্রশ্ন করলাম-
-ঋক, তুমি পড়াশুনা করো…?
-ঋক উত্তর দিল- হ্যাঁ…।
ঋকের থেকে এত সহজেই প্রত্যুত্তর পাবো, এটা আমার আশাতীত ছিলো। তাই আমি আমার পরবর্তী প্রশ্ন করলাম-
-কী পড় তুমি ?
-ABCD -পড়ি…।
-আর কী কী পড় তুমি ?
-১,২,৩,৪,৬,৭,৫,৯…পড়ি।
ঋকের ভাষা অস্পষ্ট হলেও কিন্তু তা বুঝতে আমার বিশেষ অসুবিধা হয়নি। আমি ঋকের আগ্রহ দেখে একের পর এক প্রশ্ন রিকের দিকে ছুঁড়তে লাগলাম এবং তার উৎসাহ বাড়াতে বললাম- বাহ্‌, তুমি তো অনেক কিছু শিখেছ ঋক !
-মণি (ঋকের দিদিমণি) আমা...য়  পড়ি...য়েছে।
-আচ্ছা ঋক, তোমার কোন্‌ খেলা ভালো লাগে ?
-বল খে...লা। বুঝলাম ও ক্রিকেট খেলার কথা বলছে।
-তুমি গান শোনো ?
-হ্যাঁ...হিন্দী গান। পাশ থেকে ঋকের মা ঋকের উদ্দেশ্যে বলল- বাবু নতুন হিন্দী গানটা করো তো। যেটা তুমি সব সময় গাও। কিন্তু ঋক অপরিচিত লোকের সামনে গান করতে ভীষণ লজ্জা পাচ্ছিল বলে, সে গান না করে শুধুই হাসছিল। আমিও খুব একটা জোর করলাম না। বরং আরও একটি প্রশ্ন রিকের কাছে তুলে ধরলাম-
-আমি কিন্তু আজ তোমার বাড়িতে, তোমার বিছানায় থাকব ঋক। তুমি কি আমায় তোমার বাড়িতে থাকতে দেবে ? এ কথা শুনে রিক খুব খুশি হয়ে হাততালি দিয়ে হাসতে হাসতে জানাল-
-হ্যাঁ…।
ইতিমধ্যেই আমি ঋকের কাছে এক পরিচিত মুখ হয়ে উঠেছি। আমি যে ওর খুব ভালো বন্ধু হয়ে উঠেছি তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আর এটা তখনই বুঝলাম, যখন রিক আমাকে দুম করে একটি প্রশ্ন করে বসল। বুঝলাম যে, ঋক এখন আমাকে তার আপন ভাবতে শুরু করেছে। আমার প্রতি রিকের প্রশ্ন-
-তোমা...র   বা...ড়ি   কো...থায়…?
আমি ঋকের প্রশ্নে খুশি হয়ে তাকে জানালাম- তোমার বাড়ির ঠিক পাশেই তো আমাদের বাড়ি। বাবার সাথে একদিন এসো আমাদের বাড়িতে। আমরা দুজনে মিলে অনেক গল্প করব এবং অনেক খেলব।
আমি বললাম - ঋক, সত্যি তুমি খুব ভালো ছেলে।
অনেক গল্পের পর জেঠিমণির দেওয়া পূজোর প্রসাদ খেয়ে, বাড়ি আসব বলে উঠে ঋকের সাথে হ্যাণ্ড শেক করার জন্য আমার হাত বাড়িয়ে দিলাম। ঋক আমার হাত ওর চোখের কাছে নিয়ে অনেক্ষণ ধরে ভাল করে দেখতে লাগল। গভীর মনযোগে কিছু খোঁজার চেষ্টা করছে। যেন সে এখনই আমার হাতে কিছু খুঁজে পাবে। কিন্তু ঋক আমার হাত নিয়ে বার বার চুমু খেতে লাগল। তারপর মন খারাপ করে অস্পষ্ট কিছু শব্দ যোগে বিড়বিড় করে বলতে লাগল-
-দাদা, তুমি আমা...র   সা...থে   থা...কো। তুমি বাড়ি  যে...ওনা।
ঋকের সেই অনুরোধ তীরের মত তীব্র ভাবে আমার বুকে বিঁধতে লাগল। সাথে সাথেই আমার চোখের কোণা দুটি রীতিমত ভরে উঠল। দ্রুত ঋকের মন খারাপ যেন আমার মনেও সঞ্চারিত হল। ঋকের প্রশ্নের প্রত্যুত্তরে শব্দ-বাক্য ও ভাষা যেন আমি সেই মুহূর্তে হারিয়ে ফেলেছি। শুধুই ভাবতে লাগলাম, এতক্ষণ ধরে ঋককে আনন্দ দেবার জন্য নানান চেষ্টা চালিয়ে থাকলেও, এখন ওর মন ভালো করার জন্য বা ঋকের মুখে পূর্বের সেই হাসি টুকু ফিরিয়ে দেবার জন্য আমি কিছুতেই কিছু করতে নিতান্তই ব্যর্থ। ঋকের মাথায় ও পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে আমি শুধু মাত্র এই টুকুই বলতে পেরেছি যে-
-ঋক, আমি আবার আসব। আমি আবার এসে তোমার সাথে অনেক গল্প করব এবং খেলব।
 আর এর থেকে বেশি কিছুই আমার মুখ থেকে সেসময় বের হল না। শুধু মাত্র এইটুকু বলেই ঘর থেকে বেড়িয়ে এসে বাইরে আমি জুতো পড়ছি, ঠিক তখনই বাইরে থেকে আমি ঋকের গলার স্বর শুনতে পেলাম-
-দাদা ক...ই গেলো…? আমি দাদা...র কাছে যা...বো।
ঋকের কথার জবাব হিসেবে আমার মুখে যেমন কোনো শব্দ ও বাক্য ছিলনা, তেমনই একই রকম ভাবে ছিলনা রিকের মায়েরও। আমি নিঃশ্চুপ হয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে পা বাড়ালাম। তারপরেও যতটুকু শুনতে পেয়েছি তাতে বুঝেছি, ঋকের আবদার এবার কান্নায় পরিণত হল।
বাড়ি এসেও ঋকের সাথে কাটানো মুহূর্ত গুলি বার বার মনে পড়ছিল। ঋকের মত ভাই-বোনদের ভবিষ্যৎ কী তা বার বার আমায় ভাবিয়ে তুলছিল। আজ ঋকের অভিভাবক জীবিত আছেন, বার্ধক্য হবার পরেও বেশির ভাগ সময় তারা ঋককে দেবার চেষ্টা করেন ঠিকই। কিন্তু  আগামী দিন গুলিতে জেঠু ও জেঠিমণির অনুপস্থিতিতে ঋকের দায়িত্ব কে নেবে ? কে-ই বা ঋককে তার অভিভাবকের মত নিজের পৃথিবী বলে মনে করবে ? রিকের মত এমন অনেকেই আছে আমাদের চারপাশে, যারা আমাদের কাছে অবহেলার পাত্র হতে চায় না। বরং আমাদের কাছে চায় শুধু মাত্র আমাদের একটু মূল্যবান সময় আর একটু ভালবাসা। যা আমরা তাদের দিতে নিতান্তই ব্যর্থ।
আমরা অল্প কিছুতেই অনেক বেশি ক্রুদ্ধ হই, অভিমান করি, অনাহারে থাকি, অন্যের সাথে দুর্ব্যবহার করি, বাবা-মায়ের মনে কষ্ট দেই। কখনও কখনও এতটাই অবসাদে ভুগি যে আত্মহত্যার পথ বেছে নেই। কিন্তু এই ঋকদের দেখলে আমরা বুঝতে পারি যে, সত্যি আমরা কতটা ভুল করে থাকি যারা এমন করি। আমাদের থেকেও এই পৃথিবীতে অনেক দুখী মানুষ আছে, যাদের দুঃখের কাছে আমাদের যাবতীয় দুঃখ নিতান্তই তুচ্ছ। নিজে সুখে থাকলে হয়ত চোখের ওপর একটা প্রলেপ পড়ে যায়, তাই অন্যের দুঃখ সহজেই চোখে পড়ে না। ঋকের সাথে পরিচয় না হলে এই অপ্রিয় সত্যের সন্ধান আমিও যে ঠিক কবে পেতাম তা আমি জানিনা। তবে ২০১৮-র লক্ষ্মীপূজোর সেই দিনটি স্মৃতির পাতায় আজীবন থেকে যাবে এভাবেই।

সম্পাদকীয় : পারক।। বৈশাখ।। ১৪২৬




সম্পাদকীয়

গল্প কখনো কখনো k2 হ’য়ে চেপে বসে স্রষ্টার ফুসফুসে। তিনি তখন সৃষ্টির গন্ধ পান। কলম্বাসী চোখে স্পর্শ করতে চান শিল্পের চর। কেবল ফর্ম নয়, টেনশনের সিমেট্রি-তেই নির্মাণ করতে চান টেক্সট-এর ইমারত। ভাঙতে চান-গড়তে চান, ভেঙে ভেঙে আদল দিতে চান নতুন কোনও স্বরলিপির। এই অবিনির্মাণের ‘টপ্পা’য় আমরাও তো ‘স্বর’ হতে পারি ! ছোটো ছোটো সুতোয় গাঁথতে পারি ঐশ্বরিক সুখ। ‘পারক’ সেই অবকাশ আমাদের দেয়। ‘পারক’ তাই একটি প্লাটফর্ম...
             
এবারের বৈশাখে ‘পারক’ এল নতুন সাজে। গল্প, অণুগল্প, অনুবাদ গল্প, চিরায়ত গল্প, প্রবন্ধ, ব্যক্তিগত গদ্য, ভ্রমণ বৃত্তান্ত, আত্মকথা, পুস্তক পরিচয়ের বাইরেও রয়েছে ‘উত্তরের জনজাতি’ বিষয়ক বিশেষ ক্রোড়পত্র। চিরায়ত গল্পে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, আত্মকথায় তপন বন্দ্যোপাধ্যায় - এই সংখ্যার হার্টবিট। আমরা একদিকে পেয়েছি সসীমকুমার বাড়ৈ, মণিদীপা নন্দী বিশ্বাস, অভিজিৎ দাশের মতো ‘পরিণত কলম’, পাশাপাশি পেয়েছি এক ঝাঁক ‘নবীন স্বপ্ন’। নবীন-প্রবীণের বাইনারি অপজিটে সজ্জিত হয়েছে ‘পারক’-এর এবারের বৈশাখী শরীর।

সম্পাদক সুজয়-দা কে অসংখ্য ধন্যবাদ এই জন্য নয় যে এই সংখ্যার অতিথি সম্পাদকের দায়িত্ব দেবার জন্য, ধন্যবাদ এই জন্য যে তিনি ভরসা রাখতে পেরেছেন। কে-ই বা চায় না ‘বীরবল’ হ’তে !!!

কৃতজ্ঞ থাকব যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক প্রদীপ রায়ের কাছে। জনজাতি বিষয়ক ক্রোড়পত্রটি হ’য়ে ওঠায় ওঁর সাহায্যকে কুর্ণিশ জানাই।

এই সংখ্যার প্রচ্ছদ শিল্পী অয়ন দত্ত। তাকেঁও অনেক অভিনন্দন।

গণতন্ত্রের উৎসব, সিংহলী কান্না, ফণী-তাঙ্ক – সবমিলিয়ে এই সংশয়ী সময়ে এক মুঠো অক্সিজেন দেবে ‘পারক’। সংহৃষ্ট সংবাদী রসিকজনের ভালোলাগাতেই আমাদের আহ্লাদ...। ২৫ বৈশাখের পবিত্র ক্ষণে মুক্তি পাচ্ছে ‘বৈশাখী-পারক’। ‘গুরুদেব’-এর চরণে প্রণাম।


                                            মহম্মদ লতিফ হোসেন
                          

সূচিপত্র



পারক (ই - ম্যাগাজিন)
বৈশাখ।। ১৪২৬।।
------------------------------

সম্পাদকীয়

ক্রোড়পত্র : উত্তরবঙ্গের জনজাতি
-----------------------------------------------
তিনটি গল্প : সসীমকুমার বাড়ৈ মণিদীপা নন্দী বিশ্বাস অভিজিৎ দাশ
একটি প্রবন্ধ : প্রদীপ রায়

প্রবন্ধ
---------
মহম্মদ লতিফ হোসেন তিস্তা রায়চৌধুরী

ছোটগল্প
-------------
অমিতাভ দাস মলয় মজুমদার রাজেশ ধর দীপক মান্না ফাল্গুনী সিনহা মহাপাত্র সৌরভকুমার ভূঞ্যা রবীন বসু গীর্বাণী চক্রবর্তী সত্যম ভট্টাচার্য মণিদীপা দাস সুদীপ ঘোষাল শুভাশিস দাশ দেবপ্রিয়া সরকার গোপা মুখোপাধ্যায় অহি বন্দ্যোপাধ্যায় অরিন্দম রায় বিশ্বজিৎ ধর হাবিবুর রহমান

অণুগল্প
-----------
সুকুমার সরকার দেবায়ন চৌধুরী দেবাশিস দে পার্থ প্রতিম পাল মানিক সাহা অমিয়কুমার চৌধুরি হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় গোবিন্দ তালুকদার প্রদীপ রায় বিপ্লব বসাক সুজয় চক্রবর্তী

আত্মকথা
---------------
তপন বন্দ্যোপাধ্যায়

অনুবাদ গল্প
------------------
বাসুদেব দাস (অসমীয়া গল্প)

চিরায়ত গল্প
------------------
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়

ভ্রমণ
--------
মৌপালী সাহা

ব্যক্তিগত গদ্য
--------------------
মেহেবুব আলম

পুস্তক পরিচয়
---------------------
কথা কিংবা কাহিনি
প্রবাসীর সাত সতেরো




এই সংখ্যার অতিথি সম্পাদক : মহম্মদ লতিফ হোসেন

প্রচ্ছদ : অয়ন দত্ত







চন্দনা সান্যালের পাঠ প্রতিক্রিয়া : প্রবাসীর সাত সতেরো








সুখপাঠ্য বইটির পরিচয়পত্রে বলা আছে, আজন্ম কলকতাবাসী লেখিকা, বিবাহ পরবর্তী জীবনে, জন্মস্থান থেকে অনেক দূরে, ভারতের বিভিন্ন স্থানে দিন কাটিয়ে যে অমূল্য অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন, তারই একটি রম্যরচনা সংকলন এটি। বিশেষত "প্রবাসী বাঙালিমহলের টক -ঝাল-মিষ্টি অনুভূতি মেশানো জীবনযাত্রা, তাদের উৎসব পালন ও খাওয়াদাওয়ার" নানা ঘটনার ফুলে ফুলে মালাটি গেঁথেছেন লেখিকা~যে ফুলগুলির ঝলমলে হাসির আড়ালে অতি সূক্ষ্ম একটু বিষাদের ছোঁয়া।

২১টি ছোট বড় রচনার এই সংকলনে প্রথমটিই হলো প্রবাসী বাঙালির দীর্ঘ দিন পর কলকাতায় ফিরে bus এ চড়ার অভিজ্ঞতা। ছোট্ট ৩ পাতার লেখাটিতে আমাদের চির পরিচিত কলকাতার bus তার ভীড়, গরম, ঠেলাঠেলি, সাহায্যকারী কন্ডাক্টর, সরস টিপ্পনিকার সহযাত্রী সব কিছু নিয়ে এক্কেবারে নিখুঁত, জীবন্ত। তারই পাশাপাশি একদিন যে মানুষটি কৈশোর যৌবনে কলকাতায় দাপিয়ে বেড়িয়েছেন, তাঁর পক্ষে bus এ চড়ার অভ্যেস চলে যাওয়াটাকে মানতে না পারা, পরবর্তী প্রজন্মকে কলকাতার চরিত্রটা চেনানোর আকুলতা এবং শেষ পর্যন্ত bus এ চড়ার বিব্রতকর অভিজ্ঞতা পেরিয়ে ফেরার সময় মেয়েদের taxi ধরার জেদের কাছে নতিস্বীকার~এত বাস্তব, এত মনের কাছাকাছি যে হাসতে হাসতে একটা চোরা গোপ্তা দীর্ঘশ্বাস কিছুতেই এড়ানো যায় না।

প্রতিটি লেখা নিয়ে কথা বলার পরিসর এখানে নেই। বাকী লেখাগুলির বেশির ভাগই প্রবাসী বাঙালির বারো মাসে চোদ্দ পার্বণ পালন ও খাওয়াদাওয়া সম্পর্কিত। সব কটিই মন ছুঁয়ে যায়। আমরা যারা কলকাতাকে ভালোবাসি, এবং যাদের কখনো কলকাতার সঙ্গে বিচ্ছেদ বেদনা সইতে হয়নি, তাদের কাছে কিন্তু লেখিকা হাসি ঠাট্টার ভিতর দিয়ে নিপুণ ভাবে পৌঁছে দিয়েছেন প্রবাসীদের এই মনকেমন করা অনুভবটুকু। শুধু সরস্বতী পুজো, দুর্গা পুজো বা রবীন্দ্রজয়ন্তীই নয়, এই যে খুঁজে খুঁজে এক একটি পার্বণকে টেনে বের করে এনে দোল, রথযাত্রা এমনকি জামাইষষ্ঠী বা রামনবমী পর্যন্ত হৈ হৈ করে পালন করা, এ কি শুধুই হুজুগ? না তো!  এ হলো আত্মীয় স্বজন বন্ধুবান্ধব থেকে বিছিন্ন কয়েকটি বাঙালি পরিবারের পরষ্পরকে আত্মীয় বোধে আঁকড়ে ধরে নিঃসঙ্গতা ভোলার চেষ্টা, বাঙালি খাবারের স্বাদ ফিরে পাওয়ার, বাঙালি সংস্কৃতিকে ধরে রাখার চেষ্টা। শুরুতে তাই বলেছিলাম ঝলমলে ফুলের আড়ালে একটু ম্লান ছায়ার কথা।

এই পর্যন্ত পড়ে কেউ যদি বইটি সম্বন্ধে আগ্রহী হন,তাহলে সংগ্ৰহ করে পড়ে দেখতে পারেন। এই প্রসঙ্গের বাইরেও ভিন্ন স্বাদের লেখাগুলি নিজ গুণে রমণীয়।

ভালো লেগেছে সযত্ন প্রকাশনা। মুদ্রণপ্রমাদহীন ঝকঝকে  ছাপা, সুন্দর প্রচ্ছদ, সুবিধাজনক আকার। সব থেকে ভালো প্রকাশনা সংস্থার নামটি।


লেখক : ইন্দ্রাণী ভট্টাচার্য
প্রকাশক : দ্য কাফে টেবল

রাজেশ ধরের গল্প


শ্রাবস্তী ও শ্রবন


আমরা ছিলাম ছোটবেলার সাথী। ওর বাবা আর আমার বাবা দুই বন্ধু। এক মফস্বল শহরে আমাদের বাস। ছোট থেকেই সবাই বলত আমাদের নাকি বিয়ে হবে। মা বাবাদের হাসিতেও কোনদিন তার অন্যথা দেখিনি। তাই কি...কিম্বা তা নয়। আমার মনে হয় কেউ কিছু বলুক আর নাই বলুক কৈশোর থেকেই আমরা দুজন দুজনকে ভালবেসেছিলাম। মানে ওকে না দেখতে পেলে আমার বুকের মধ্যে সবসময় ফাকা ফাকা লাগত। সে বন্ধুদের সঙ্গে সরস্বতীর পুজোর রাতজাগাই হোক কিম্বা অঙ্ক পরীক্ষার আগের রাত... সর্বক্ষণ। কিছুই ভাল লাগত না। ও আমাকে কোনদিন কিছু বলেনি। কিন্তু আমার মনে হয় ওরও ঠিক তাই হত। ও শুধু একদিন একটা কথাই  বলেছিল আমায়। মা ওকে বাটি করে কুলের মিস্টি আচার দিয়েছিল খেতে। দুনিয়ার সব থেকে কিপ্টের মত একটা কুল-বীজ চুষতে চুষতে ও বলেছিল, ‘ তোমার কাছে আসার কথা ভাবলেই আমার বুকের ভেতরটা এমন ধকধক করে কেন গো? কখনো কখনো তোমার নাম শুনলেও  অমন হয় !কেন গো...বল তো কেন?’

সে প্রশ্নের উত্তর তোড়জোড় করে কীভাবে  দেয় তখনও জানতাম না। আমি চোখ নামিয়ে ওর আচারের বাটিটা দেখছিলাম। ও যেই মুখ ঘোরাচ্ছিল লুকিয়ে লুকিয়ে ওকে দেখছিলাম। যেভাবেই হোক না কেন আমি শুধু হাঁ করে ওকে দেখতাম। কখনও কখনও ড্যাবড্যাব করে সবার সামনেও। ওর দুই বেনি বা মাথা ওপর বাধা ঝুটি, ওর ববি প্রিন্টের ফ্রক বা পুজোর সময়ে লাল ছাপা শাড়ি, দুস্টুমিতে ভরা ওর দুই চোখের তারা অথবা মন খারাপে  টলটলে জলে ভরা পুকুর পুকুর ওর দুই চোখ। আমি দেখতাম। আর ভাবতাম কবে বিয়ে হবে আমাদের? ও একদিন আমায় বুড়ো আঙুলের কাঁচকলা দেখিয়ে বলেছিল, ‘ তোমার মত একটা ভ্যাবলাকে বিয়ে করতে বয়ে গেছে আমার!’

ঠিক তাই। ওর বয়েই গেল। বিয়েটা ও করল না । এক বিকেলে আমি ঘুমিয়েছিলাম। পা টিপে টিপে ও নাকি আমার ঘুমন্ত  মুখের ওপর ঝুঁকল। তারপর একটা নাম শ্রাবস্তী...শ্রাবস্তী...শ্রাবস্তী।বিড়বিড় করে বলছিলাম আমি বারবার। সেই একটা নাম। মা পিছন থেকে ওকে অনেক ডেকেছিল। ও আর পিছন ফেরে নি। ঘরের ভেতরে নাকি আমি বলেই চলেছিলাম...শ্রাবস্তী...শ্রাবস্তী...শ্রাবস্তী!



(২)

ওকে ছেড়ে এসেছিলাম। তার জন্য আমার কি আজকাল আপশোষ হয়! বুঝতে পারি না। ওকে কি আমি এখনও ভালবাসি...চাই! জানি না। এত সুন্দর আমার সংসার। তাকে সরিয়ে  এইসব কথা  এতটুকুও ভাবতে  ইচ্ছা হয় না। কিন্তু এই এখন এত বছর পরে যখন ও একজন মাঝবয়েসী সংসারী মানুষ। স্ত্রীপুত্রদের নিয়ে সুখী জীবনের এক পুরুষ। তখন ও  আমাকে নিয়মিত মেসেজ করে, ফোন করে। উত্তর না দিয়ে ফেরাতে পারি না। বশর চারেক হল ওর সাথে আবার দেখা সোশ্যাল মিডিয়ায়। বাবা-মা মারা গেছে, আর ভাই বোন নেই। তাই সেই ছেলেবেলার গঞ্জ শহরে আর যাওয়া হয় না। যেটুকু যোগাযোগ ঐ সোশ্যাল মিডিয়াতেই। সেখান থেকেই একদিন ওর  অনুরোধ এল।

সেই সেদিন, যেদিন ওর বাড়ি থেকে অলক্ষুণে সন্ধেবেলায় ফিরে এসেছিলাম। তারপর থেকে শ্রাবস্তী  আমায় ছেড়ে যায়নি। জোর করে ওকে মনে করতে চাইতাম না।  কিন্তু হঠাৎ হঠাৎ শ্রাবস্তী নামের একটা সরু চাবুক নেমে আসত আমার বুকের মধ্যে। আমি যেন একটা বাসি মড়ার গা ছুঁয়ে ফেলতাম। স্বামীর আদর-বিছানা, ছেলেদের মানুষ করা , একজনের মিসেস বলে পরিচিত হওয়া...এইসব চলতে চলতে  সেই চাবুকের বাড়ি আবছা...আরো আবছা হয়ে যাচ্ছিল। 

কিন্তু  আজকাল যখনই ওর সাথে কথা হয়। তখনই জ্বালিয়ে  পুড়িয়ে  সেই চাবুকের বাড়ি নেমে আসে । আমার স্বামী একদিন জিজ্ঞাসা করে বসল, ‘ তোমার  চোখমুখ এত বসে যাচ্ছে কেন। এত কালো কালো দাগ কীসের। কী হয়েছে? কীসের টেনশান...’ হালকা চালে ঋতুবন্ধের প্রসঙ্গটা এনে তাকে এড়িয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু চিন্তা তো এসেই যায়! কেন টেনশান আমার! কী জন্য পড়ছে চাবুকের বাড়ি আজ এতদিন পরেও। ও তো বারবার এখনও বলে যাচ্ছে...শ্রাবস্তী নামে কেউ ছিল না। কেউ নেই। সত্যি সত্যি নানাভাবে জানতে পেরেছি। আমাদের সেই শহরে , সেই সময়ে কিশোরী থেকে যুবতী  শ্রাবস্তী নামের কেউ ছিল না! তাহলে এসবই কি ওর কল্পনা...কিন্তু ও তো তেমন কল্পনাপ্রবন ছেলে না। কবিতা-টবিতা লেখা তো দূরের কথা। জীবনে ড্রয়িং খাতায় আঁচড়টুকুও কাটেনি। তাহলে কি আমি ভুল শুনেছিলাম? তা তো না ...আমি নিজেকে চিমটি কেটে, খিমচি কেটে, কামড়ে বুঝে নিয়েছিলাম। বিড়বিড় করে ও বারবার বলছিল শ্রাবস্তী...শ্রাবস্তী...শ্রাবস্তী।  ইস্‌…নামটা যেই এল ... চাবুকের বাড়ি আবার পড়ল। নাহ্‌ এভাবে  আর পারা যাচ্ছে না। ভুলে যেতে হবে ওকে।



                                                                (৩)

‘ফোন করলি কেন আবার? বলেছিলি নিজে ভুলে যাবি...আমাকেও ভুলে যেতে হবে। তাহলে?’

‘তুমি কি ভুলে যেতে পেরেছিলে!’

‘ সে তো আমার কথা...ভোলা যায় না! আমি ভুলতে পারিনি তোকে...ভালো যে বাসি তোকে কী করে ভুলি?’

‘ তোমার বৌ আছে...এসব কথা তোমার মোটেও বলা উচিত না।’

‘শোনাও তো তোর উচিত না! তাহলে?’

‘জানিনা...কিন্তু তুমি বলবে না!’

‘বাহ্‌...বল, কেন ফোন করেছিস?’

‘ জানিনা...কিচ্ছু জানি না। এমনি...’

‘ তাহলে তো কিচ্ছু বলার নেই। রেখে দি?’

‘দাও তোমার ইচ্ছে হলে...’

ফোনটা কেটে গেল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে আবার বেজে উঠল। এবার বিপরীত দিক থেকে।

‘কেন ফোন করলে?’

‘তুই তো বারণ করিস নি?’

‘ওসব ছাড়... বলো...কী?’

‘ যে কথাটা বারবার বলতে চাই...তোকে ভালবাসি...শুধু ভালবাসি!’

‘মিথ্যে...তুমি  ভালবাস শ্রাবস্তীকে? এই দেখ , তুমি ভালবাসার কথা বললে... শ্রাবস্তীর নাম এল আর আমার গায়ে চাবুকের ছ্যাকা ফুটে উঠছে...লাল লাল দাগ!’

‘উহ্‌! তোর এই কমপ্লেক্সটা ছাড়...শ্রাবস্তী ফ্রাবস্তি কেউ নেই। আমি তোকে ভালবাসি...আমাদের দুজনের আবার নতুন করে ভালবাসার দুনিয়ায় মিলে যেতে হবে...’

‘ তুমি কি পাগল! আমাদের দুজনেরই এত সুন্দর ভালবাসায় ভরা সুখের জীবন। আবার নতুন করে ভালবাসা...ইস ছাড়। রেখে দাও।’

‘রেখে দেব...হ্যাঁ, হয়ত আমি পাগল!কিন্তু তুইও তো আমায় প্রশ্রয় দিচ্ছিস। তাহলে তুইও কি পাগল না? আসলে আমরা দুজনেই দুজনের ভালবাসা পাওয়ার জন্য পাগল রে! আমরা দুজন দুজন দুজনকে পাইনি। তাই আমাদের মিলতেই হবে। সেটাই আমাদের ভবিতব্য...’

‘ বড় বেশি দিবাস্বপ্ন দেখ তুমি। আসলে আমরা খুব সুখী। তাই দিনরাত ভালবাসা ভালবাসা করি। ভাব তো  যদি রাতদিন খেটে  দুটো পেটের ভাত জোগাড় করতে হত। সেটা ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারতে না তাহলে কী তুমি এইভাবে দিনরাত ভালবাসা ভালবাসা করতে পারতে?’

‘আর তুইও তাহলে দিনরাত ভূত শ্রাবস্তীর কিল খেতিস না!’

‘শ্রাবস্তী ভূত না মোটেই। সে আছে ...কোথাও নিশ্চই আছে। সেখান থেকে বারবার এসে আমায় চাবুক মেরে যায়! একমাত্র তুমি জান তার ঠিকানা। কিন্তু তুমি কিছুতেই বলবে না!’

‘ আর আমিও বলব ... ভাল বা খারাপ, হালৎ যেমনই হোক না কেন। আমি তোকেই ভালবাসি রে...যত দিন যাচ্ছে। বুকের চিনচিনে ব্যাথা দিয়ে সেকথা বুঝতে পারছি!শ্রাবস্তী বলে কেউ, কখনও নেই...ছিল না!’

‘ তাহলে আমরা যার যার কথা নিয়ে, নিজের নিজের মত থাকি। তুমি আর ফোন কোরো না!’



আর ফোন এল না...গেল না। প্যাচপেচে ঘাম আর খিস্তি গালাগালির মাছের বাজারে, মাঝরাত্তিরের নিঃসঙ্গ রেললাইনের স্লিপারের ওপরে... অ্যালকোহলের গন্ধে...গেস্টদের এন্টারটেন করার ফাকে ফাকে ওয়াইনের গ্লাস হাতে নিয়ে কিম্বা এসির ঠান্ডায় পর্দা সরিয়ে কাচের ওপার থেকে রাত আড়াইটের মেট্রোপলিটন সিটির স্কাইলাইনে খুটে খুটে ...কথাগুলো  বেজেই চলল...বেজেই চলল! তোকে ভালবাসি শুধু তোকে ... তুইও আমায়...যাই হোক না কেন... নাহ্‌! তোমার মনের ভেতরে শ্রাবস্তী আছে শুধু শ্রাবস্তী...শ্রাবস্তী!


(৪)

চ্যালেঞ্জটা আমি নিয়েই নিলাম। এভাবে বএললে  বাচাদের মত হিরোগিরি দেখানো হয়ে যায়! অবশ্য চ্যালেঞ্জ বললে চ্যালেঞ্জ...না বললে...আসলে কিছু করার ছিল না। আর পারছিলাম না ওকে ছেড়ে থাকতে। ওকে বললাম,

‘তুই যখন বলেছিস। তখন নতুন করে শুরু করব আবার। একেবারে অচেনা কোন জায়গায় চলে যাব। যেখানে কেউ চেনে না আমায়।  হাড়ভাঙা খাটুনি খাটব বেঁচে থাকার জন্য। তারপর দেখব তোকে মনে পড়ে কিনা...তোকে ভালবাসতে ভালবাসতে ছটফট করি কিনা!’ ও উত্তর দিয়েছিল,

‘ তোমার পরিবারের কী হবে?’

‘সে আমি সব গুছিয়ে দিয়ে যাচ্ছি ওদের জন্য। লুকিয়ে ভলেন্টারি রিটায়ারমেন্ট নিয়েও নিয়েছি। টাকাপয়সা সব ওদের নামে ফিক্সড করে দিয়েছি।’

‘ বাহ্‌...আর ওরা যে তোমায় পাগলের মত খুজবে?’

‘ পাবে না ...তারপর একদিন মেনে নেবে।সবাই এভাবেই একদিন মেনে নেয়!’

‘তা বলে...’

‘না রে আমার আর কিচ্ছু করার নেই। আমি অতি সাধারণ একটা লোক...আমার প্রচন্ড লোভ...তোকে ভালবেসে এসেছি সেই শিশুকাল থেকে। তারপর তুই চলে গেলি। বুকের ভেতরে কবর দিলাম আমার ভালবাসাকে। আবার হঠাৎ দেখা হল...আর তোকে হারাতে চাই না। তোর বলা কস্টিপাথরে আমার সেই ভালবাসাকে যাচাই করব এবার। যদি উতরে যেতে পারি তাহলে ফিরে এসে দাঁড়াব তোর সামনে। বলব তুই চল!’

‘ আমি যাব কেন? আমার এত সুন্দর সংসার ফেলে?’

‘যাবি...কারণ তুই আমায় ভালবাসিস আর আমিও তোকে ভালবাসি!’

‘ না ...তুমি আমায় ভালবাস না ...ভালবাস শ্রাবস্তীকে!’

ফোনটা কেটে দিয়ে সেই রাতেই বেরিয়ে পড়লাম।



(৫)


হিমাচলের এক অজ গাঁ। অদ্ভূত সুন্দর একটা নাম...পাঞ্ছিলা। নাক খ্যাদা, গোল মুখের মানুষগুলোর সারা শরীর জুড়ে হাসি। আছে, ওদের ঝগড়া আছে...মাতাল হয়ে মারামারি আছে। শাপশাপান্ত আছে...অনেক কিছুই আছে। তবু আমার মনে হয় ওরা সব সময় যেন আসছে। ওদের সেই হাসি যখনই চোখে পড়ে। আমি ওর ছোট্টবেলার দুষ্টুমিস্টি হাসি মুখটা দেখি।

ছোট্ট একটা দোকান করেছি এখানে। দেশলাই থেকে স্যারিডন সবই রাখি। আট কিলোমিটার চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে বাস ধরি। দু ঘন্টার ঝাকুনি খেতে খেতে ছোট্ট শহর। সেখান থেকে মাল কেনা। সারাদিন দোকানদারি। নিজের রান্না-বান্না-ঘরের কাজকম্ম...রান্নার জন্য কাঠকাটা। সব চলতে থাকে। আর ফাকে ফাকে আলোছায়ার লুকোচুরির মত ওকে দেখে ফেলি ।

এখানে মেঘ-বৃষ্টি-রোদ সত্যি সত্যি লুকোচুরি খেলে।শীতকালটায়  বরফ আর বরফ। ঘরের মধ্যে কাঠের ধুনি জ্বালিয়ে বসে থাকা। আমার কিন্তু একলা লাগে না। মনে হয় ও যেন আমার পাশটিতে শুয়ে আছে। আমি কাপড়ের পট্টি সেকে ওর ঠান্ডা পাগুলো গরম করছি। ভোরবেলা চোখ বন্ধ করে হরেকরককমের পাখির ডাক শুনি। মনে হয়...ফোনে ওর মৃদু গলা শুনছি। আমি বুঝতে পারছি...নাহ্‌...সত্যি সত্যি ওকে ভালবাসি। আর হ্যাঁ...এই শান্ত শীতল দিনরাত্তিরগুলোতেও  কিন্তু শ্রাবস্তী নামের কাউকে খুঁজে পেলাম না। ।নিজের মনকে ঘুলিয়ে ঘুলিয়ে ক্লান্ত করেও জানতে পারলাম না… কে সেই শ্রাবস্তী... কে?

(৬)

পাঞ্ছিলা গ্রাম থেকে দেওধারিয়া আশ্রম, গাড়িতে প্রায় আধ ঘন্টার রাস্তা।  আশ্রমটা বৃক্ষানি সাধুদের আশ্রম। অদ্ভূত সাধু এরা। এই পাহাড়, জঙ্গল , নদী, পশুপাখি ...এরাই সাধুবাবাদের উপাস্য। এরা ধ্যান করে ঘন্টার পর ঘন্টা। আর নীরবে সেবা করে চলে ঐ প্রকৃতির। গেরুয়া পরা মানুষগুলোর সবাই নাকি বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের নামী প্রফেসার, গবেষক। জীবনের এক পর্বে এসে এনারা উপলব্ধি করেছেন প্রকৃতিকে ভাল না বেসে মানুষের মুক্তি নেই!

এখানে আশ্রমের ফুল বাগানের দেখাশোনা করি আমি। এক মেঘ-বর্ষার বিকেলে আমায় দেখলেন আশ্রমের প্রধান স্বামী অরণ্যেশ। বলিরেখার কাটাকুটি মুখে, সারা শরীরে। একটু ঝুঁকে বসে রয়েছেন কম্বল পাতা বিছানায়। কী শান্ত... তার দুটো নীলাভ চোখ। সেই দুই চোখের সামনে বড় দ্বিধায় ভুগছিলাম। কী বলব ?...কে আমি? কেন এসেছি? অদ্ভূত দাবী এক মাঝবয়েসী ভিনভাষী মহিলার...সে এখানে থাকতে চায়! কিন্তু কেন...তা সে জানাতে চায় না...অদ্ভূত, সত্যি অদ্ভূত! ...আমার ঠোট কাপছিল। হাড় কাপানো জোলো ঠান্ডাতেও ঘামছিলাম আমি। কিন্তু অরণ্যেশ হাসলেন...তার দুই চোখে নাম না জানা কত রঙবেরঙের ফুল ফুটে উঠল। তিনি বললেন...আপ ফুলোঁকো দেখরেখ কিজিয়ে।

ঢালু উঠোনে গোল করে সাজানো ফুল বাগানে দাঁড়িয়ে আছি আমি। দূরে সবুজ থেকে নীলচে হয়ে যাওয়া পাহাড়ের গায়ে গায়ে পাকদন্ডী। সেই পথে কাছের মানুষগুলো একটু একটু করে বিন্দু হয়ে মিলিয়ে যায়। আবার দূরের বিন্দুগুলো একসময় স্পষ্ট হয়ে একটা পরিপূর্ণ অবয়ব হয়ে ওঠে। আজ বারবার চোখ চলে যাচ্ছে ঐ দূরের সীমানায়। একটা বিন্দু একটু একটু করে এগিয়ে আসছে না! তাই তো... ঠিক...সত্যি সত্যি এগিয়ে আসছে।

যোগাযোগের সব রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছিলাম। ওকে ভুলেই গিয়েছিলাম বহুদিন।  তারপর একদিন একটা ফোন। ধরলাম...একটা অচেনা ল্যান্ড ফোনের নম্বর। এস টি ডি কোডটা বলে দিল অনেক দূরের কোনো জায়গা থেকে ফোনটা এসেছে। অনেকবার জানতে চাইলাম কে ফোন করেছে...কে? কোন উত্তর নেই। বুঝলাম এটা ওর ফোন।  সাথে সাথে আমার চারদিকে ভিড় করে এল অনেকগুলো ছবি। ওর বাড়ির লোকেদের দুশ্চিন্তা...তন্নতন্ন করে ওকে খোঁজা...ওর স্ত্রীর সাময়িক অসুস্থতা...ইত্যাদি ইত্যাদি। হ্যাঁ...শ্রাবস্তীও এল সেই ধারালো চাবুক নিয়ে। কিন্তু আমি অবাক হয়ে গেলাম। নিজেই নিজেকে চিনতে পারছিলাম না। আমি কাদছিলাম...ওর জন্য আমি কাদছিলাম। কত...কতদিন পরে! কেন! জানি না। তারপরেও একবার এসেছিল ফোন। সেই একইভাবে কোন কথা নেই।  মনে হচ্ছিল ভয়ঙ্কর তোলপাড় চলছে ওর মধ্যেও।  না চাইলেও আমাকে ফোন না করে থাকতে পারছে না।  তারপর ভয়ঙ্কর একঘূর্ণি উঠল আমার মধ্যে… প্রবল দুই জলস্রোতের ধাক্কা । সংসার নাকি ঐ পাগল প্রেমিক...কাকে ছাড়ব আমি? কিন্তু আবার যদি ও শ্রাবস্তীর নাম নেয়...তাহলে?


 (৭)



‘ কেমন আছিস?’

‘তুমি কেমন আছ?’

‘দেখছিস না...কত রোগা হয়েছি। সারাদিন খাটছি। পেটের ভাত জোগাড় করা মুখের কথা না। বুঝছি রে…তবুও বলছি,বেশ আছি...তুই?’

‘ আমি? ...এই ফুলবাগানের মধ্যে কেমন আছি...বুঝতে পারছ না?’

‘হুঁ...তুই সব ছেড়ে চলে এলি? কী করে জানতে পারলি আমি এই কাছেই আছি?’

‘ এলাম...আসতে হল! আর ...চেষ্টা করলে পঙ্গু যদি পাহাড়ে চড়তে পারে...তো এই বয়সে কি প্রযুক্তি শিখে...তোমার ঐ পাঞ্ছিলা আর এই দেওধারিয়াকে চিনে নেওয়া যায় না!’

‘তাই তো!’

বাগানের একটা দিক ফাকা হয়ে শূণ্যে ঝাপ দিয়েছে। সেইখানে এসে বিকেলের গাঢ় হলুদ রোদ পড়ল। সামনে নাম না জানা একের পর এক পাহাড়ের চূড়াগুলোয় কারা যেন সোনালি আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। একটু পরে ফুলের গন্ধ মেখে নেমে আসবে সন্ধ্যা। অনেকদিন বৃষ্টির পরে আজ আকাশে এক টুকরোও মেঘ নেই।

‘ এখনও এক বছর হয়নি না!’

‘কেন?’

‘এমনি...’

‘বাহ্‌...এক বছর পরে আমার যাওয়ার কথা ছিল। আমি তো কিছুই জানাইনি...তুই চলে এলি। শোন তোর বাঁহাতটা ধরতে পারি?’

চামড়ার ভেতর থেকে উকি দেওয়া শিরার এক হাত, আর এক হাতকে ছুঁয়ে ফেলল।

‘বলো! কী দেখছ অমন করে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।’

‘ দেখছি...রে! আমার সারাদিনের সব কাজের ফাকে ফাকে তো তোকেই দেখি! ছুঁতে যাই কিন্তু তুই পালিয়ে যাস! আজ ...ধরেছি শক্ত করে তোর হাত...আজ তোকে পালাতে দেব না!’

‘এ তোমার পাগলামি...আমাদের দুজনের সংসার আছে। সব ছেড়ে এই বয়সে আমরা এমনভাবে ... ইস!কী করছি আমরা!’

আকাশে এখন হালকা একটা কমলা আভা। দু-একটা তারা উকি মারছে এখানে ওখানে। পাহাড়্গুলো একের পর এক মাথায় ঘোমটা দিয়েছে।

 ‘জানো... সেদিন নিজের মুখ পুড়িয়ে, সব লজ্জার মাথা খেয়ে... স্বামী অরণ্যেশজীকে তোমার কথা বলতে যাব...তিনি কী বললেন জান?’

‘কী?’

‘ পুরুষ আর প্রকৃতির মিলনেই এই জগত আর এই সংসার। তাকে অস্বীকার করা যায় না। তাই তো… তিনি আর তার গুরুভাইরা প্রকৃতিকে রক্ষা করছেন। নাহলে পুরুষ রুষ্ট হবেন…এ সভ্যতা তখন থাকবে না।  আমি চুপ করে তার পায়ের কাছে বসে শুনছিলাম।  তিনি বন্ধ দুইচোখ খুলে তাকালেন… আমি দেখলাম।  ভালবাসার ঝরণা নেমে আসছে তার দুইচোখ থেকে।  দুই পরিণত বাঙলাভাষী মানুষ কত দূর থেকে এখানে এসে থাকছে! এ নিশ্চই প্রকৃতি দেবীর নির্দেশ।  তিনি জানেন... জানো তারপর তিনি বললেন… একদিন তোমরা মিলতে হবেই মা… আবার চোখ বন্ধ করে ফেললেন তিনি।’

‘হুঁ… তিনিই খবর দিলেন আমায়। আমি জানতাম তুই এসেছিস…আমার জন্যেই এসেছিস । তবু আসিনি।  বুকের ভেতরটা ছিড়ে গেছে তবুও আসিনি…’

‘কেন?’

‘মনে হচ্ছিল…পরীক্ষা যেন শেষ হয়নি। আর…’

‘আর…কী?’

‘শ্রাবস্তীর ভুল ধারণাটা যদি আবার তোর মনে পড়ে যায়! দূর থেকে দেখেছি তোকে। আশ্রমের কাজে ব্যস্ত তুই। তোর চোখেমুখে কত খুশি!’

‘এখানে এসেছি…তারপর থেকে বিশ্বাস করো…শ্রাবস্তীকে আর দেখিনি।  কোন চাবুক আমায় আর স্পর্শ করেনি!’

‘তাই?’

‘হুঁ…ঠিক তাই!’

তখন চারিদিকে ঘন নীলচে অন্ধকার। দূরের প্রার্থনাকক্ষ থেকে উপনিষদের মন্ত্রোচ্চারণ ভেসে আসছে। আকাশে লক্ষ কোটি তারার ঝলকানি।

‘তোর মনে আছে? বিকেলে খেলার শেষে আমরা দুজনে নদীর পারে শুয়ে আকাশে তারা গুণতাম!’

‘মনে আছে…খুব মনে আছে!’

‘এ কি তুই কাঁদছিস কেন?  আজ চরম পরিশ্রম আর দারিদ্রেও তোকে অনুভব করছি… বারবার করছি…আর শ্রাবস্তীর ভূতটাও তো কোথায় পালিয়েছে…আজ তো চিৎকার করে বলার দিন…দুজন দুজনকে ভালবাসি। চল না আজ আবার আমরা ঐ ঘাসের বিছানায় শুই। তারপর আকাশের ওড়না থেকে একটা একটা করে হীরের কুচি কুড়িয়ে নি!’

‘ না…না…তুমি চলে যাও!’

‘না…তুই চল!’

‘না...’

‘কেন রে...এখনও রাত আছে, তারারা আছে...ঐ আকাশ আছে...আমরাও আছি!’

‘ সে বয়স নেই যে!’

‘  তোর শ্বাস প্রশ্বাসে এখনও যে সেই মধুগন্ধ...আয় না...যাই!’

সেইরাতে শিশির, জোছনা, মাতাল হাওয়া, পাহাড়দের কবোষ্ণ বুক পাহারা দিয়েছিল। তারাদের গুনতে গুণতে কখন যেন মিশে গিয়েছিল সব শ্বাস প্রশ্বাস…

                                                                (৮)

তবুও ফিরে আসতে হল। ও যখন ওর সব ভার আমার ওপর ছেড়ে দিয়ে অচেতন। ওর সব অস্তিত্ব যখন আমার পাজরের নীচে আশ্রয় নিয়েছে। ঠিক তখন শুনতে পেলাম আমার মাথার মধ্যে এক ভয়ঙ্কর বাঁধ ভাঙার কম্পন। তার তরঙ্গদৈর্ঘ্য শুধু আমার মস্তিষ্ককেই আঘাত করছিল, গুড়িয়ে দিচ্ছিল। প্রতিধ্বনির পর প্রতিধ্বনি ...শ্রাবস্তী...শ্রাবস্তী...শ্রাবস্তী।  নিশ্চিত ঘুমে  মগ্ন  ওকে জাগাতে পারলাম না। সারারাত সেই সবুজ উপত্যকায় নিজের কঙ্কালটাকে চিনে নিচ্ছিলাম একটাই শব্দে...শ্রাবস্তী...শ্রাবস্তী...শ্রাবস্তী। কে আমি...কী আমার ভালবাসা...কী আমার অস্তিত্ব...উত্তর খুঁজে পাইনি...শুধু একটাই শব্দ...শ্রাবস্তী...শ্রাবস্তী...শ্রাবস্তী।

আমার স্বামী সব শুনতে শুনতে নির্বিকার ভাবে চা শেষ করল। তারপর  ওর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ এটা কমন ম্যাটার...আরে এমন শ্রাবস্তী সবার  ছিল, আছে...থাকবে...তা বলে ডিউটি ভুললে হবে নাকি! চলুন আমি যাচ্ছি আপনার সঙ্গে!’ ওরা চলে গেল।  আমার সেই ছোট্টবেলার শহরে আমার স্বামী যাচ্ছে…ওকে ফিরিয়ে দিতে। চূর্ণ-বিচূর্ণ আমি নিজের ঘরে ফিরে দরজাটা বন্ধ করলাম। একা থাকতে হবে আমায়।  অনেক… অনেকটা সময়...কতক্ষণ...জানি না! বুকের ভেতর থেকে উঠে আসছে নামটা...শ্রবণ...শ্রবণ...শ্রবণ। কে এই শ্রবণ... জানি না…কিচ্ছু জানি না।  সেই রাতে ফুলের গন্ধে, হাওয়ার মাতলামিতে, তারাদের প্রশ্রয়ে হারিয়ে যেতে যেতে যখন সব চেতনা আমার শূণ্য হবে।  ঠিক তখন বুকের দরজা ভেঙে বেরিয়ে এল শ্রবণ? চোখ বন্ধ করে ফেলেছিলাম লজ্জায়। কিছুই বলতে পারিনি ওকে। কিন্তু আমায় খুঁজতে হবে, জানতে হবে...কে এই নাম...শ্রবণ...শ্রবণ...শ্রবণ।


ভ্রমণ : মৌপালী সাহা



বজ্র ড্রাগনের দেশ ভুটান


ভ্রমণ পিপাসু মন নিয়ে শহরের ক্লান্তি ও গরমের দাবদাহ থেকে বাঁচতে গত বছর গরমের ছুটিতে গিয়েছিলাম আমাদের পড়শি দেশ ভুটানে। সেখানে প্রকৃতি যে কতটা মায়াময়, তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যাবে না ।   

ভুটান শব্দটি এসেছে সংস্কৃত শব্দ 'ভূ উত্থান' থেকে যার অর্থ 'উঁচু ভূমি'। সেখানকার অধিবাসীরা নিজেদের দেশকে মাতৃভাষা জংকা ভাষায় দ্রুক ই উল বা বজ্র ড্রাগনের দেশ নামে ডাকে।

আমরা ভূটানে পৌঁছে phuntshiling immigration অফিসে permit করে একটা গাড়ি reserve করে চললাম রাজধানী থিম্পুর উদ্দেশ্যে। আশেপাশের অসাধারণ প্রাকৃতিক শোভা দেখতে দেখতে পাহাড়কে বন্ধু করে এগিয়ে চলছিলাম, পরিস্কার পরিচ্ছন্ন পাহাড় অধ্যুষিত শহর থিম্পু। আমাদের গন্তব্য থিম্পু, পুনাখা ও পারো। পরদিন সকালে অল্প বৃষ্টি হচ্ছিল, ওদের official building SAARC, তার উল্টো দিকে permit করতে হলো পুনাখার জন্য। তারপর গেলাম memorial chorten, ওদের এক অতি পবিত্র monastry। তিনতলা পর্যন্ত উঠলাম। রাস্তার দিকে মুখ করে আছে প্রহরারত বুদ্ধের মূর্তি। তারপর buddho point, বিশাল এক বুদ্ধ মূর্তি অনেক উঁচুতে।
শহরের সবখান থেকেই দেখা যায় সেই মূর্তি। ওখান থেকে নিচের পুরো থিম্পু শহরের সৌন্দর্য উপভোগ। আয়না কাঁচে reflection হচ্ছে চারদিকের monastry, বৃষ্টির ফলে নীচে reflect হচ্ছে অসাধারণ statue গুলো। ভেতরে বুদ্ধ ও তারপাশে বৌদ্ধ ধর্মের ধর্মপ্রচারকদের সুন্দর মূর্তি।
ভেতরে ফটো তোলা নিষেধ, তাই বাইরের অসাধারণ সৌন্দর্যের ফটো তুলে নীচে নেমে এলাম। পৌঁছে গেলাম library । চারদিকে প্রচুর ফুল। অনেক বড়ো বড়ো বিভিন্ন রঙের গোলাপ। সেখান থেকে বেরিয়ে গাড়ি নিয়েই দূর থেকে দেখলাম রাজার বাড়ি, saarc building, tasiko জং। তারপর museum, বাঁশের জিনিস, চামড়ার জিনিস এইসব সাজানো-গোছানো দোকান। সেখান থেকে গেলাম handicraft factory, বিভিন্ন মুখোশ ও sculpture তৈরি হচ্ছে সেখানে। পরদিন বেরোলাম পুনাখার উদ্দেশ্যে।

অপূর্ব সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশ, চারদিকে পাহাড় ও মেঘের লুকোচুরি।
গেলাম পুনাখা জং। মোচু ও পোচু দুই  নদী দুইদিক থেকে এসে মিশে হয়েছে পুনাখা নদী। স্রোতস্বিনী নদীর একদিকে পাহাড়, জং এর সামনে অনেক ফুলের গাছ, নিচে নাম না জানা ফুলগুলো ঝরে পড়ে বিছানার মতো হয়েছে। জং এর ভেতরে গেলাম, ওখান থেকে বেরিয়ে আরও এগিয়ে চললাম suspension bridge। পুনাখা নদীর এপার ওপার যুক্ত করেছে এই ঝুলন্ত bridge। অবর্ণনীয় সৌন্দর্য, নদীর শব্দ, সবুজ পাহাড় সব কিছুকে সঙ্গে নিয়ে চললাম দোচুলা পাস। চতুর্থ রানী 108টা মিনার তৈরি করেছিলেন রাজার আয়ু বাড়ানোর জন্য। প্রতিটি মিনারের গায়ে রাজার ছবি লাগানো। দূর থেকে দেখলাম চিমি মনাস্ট্রি। সেখান থেকে চলেছি পারো । চারদিকে সবুজ পাহাড়ের মাঝে পারো উপত্যকা। যেদিকে তাকাই সবুজ পাহাড়, শান্ত এক পরিবেশ।  সন্ধ্যের পারো পাহাড়ের উপরে আলোকমালায় সজ্জিত হয়ে স্বপ্নপুরী।

পরদিন সকালে বেরিয়ে দূর থেকে দেখলাম tiger nest, সেটা পাহাড়ের উপর। এটা actually সারাদিনের ট্রেক রুট, তাই দূর থেকেই দেখতে হলো। এরপর kichulakhang, কথিত আছে এই মন্দিরে যা প্রার্থনা করা হয় সেই মনস্কামনা পূর্ণ হয়। মন্দিরের গায়ে কমলালেবুর গাছ। প্রচুর কমলালেবু ধরে আছে। ভিতরে গিয়ে প্রণাম করে ফিরে এলাম। গেলাম রিংপং জং, সেখানে ও গাছে ধরে আছে কমলালেবু। অনেকগুলো সিঁড়ি দিয়ে ভেতরে গেলাম। বাচ্চা লামারা প্রার্থনায় বসেছে । উপর থেকে নীচে দেখা যাচ্ছে পাহাড় ও তার মাঝে বহমান পারো নদী।
তারপর গেলাম museum। সেখানে বিভিন্ন রকমের পাখি, কিছু পাখিদের জীবাশ্ম, কিছু বাঘের চামড়া ঝোলানো,ওদের নানান অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত হত এরকম বিভিন্ন মুখোশ ইত্যাদি দেখতে পেলাম । সেখান থেকে গেলাম Nya Mey zam bridge, নীচে পারো নদী বয়ে চলেছে। পেছনে রিংপং জং। এগিয়ে গেলাম পারো নদীর দিকে। ঠান্ডা জল। বসলাম পাথরের উপর। পেছনে পাহাড় পরিবেষ্টিত পারো উপত্যকার সৌন্দর্য উপভোগ করে পা বাড়ালাম airport, পাহাড়ের মাঝে ভুটানের airport। ভুটান রাজার দেশ, ওখানে সবাই বিনা খরচায় পড়াশোনার সুযোগ পায়, চিকিৎসা-পরিসেবা পায় । আমাদের ড্রাইভারের কাছে শুনে ওদের এক বিশেষ খাবার এমা দাসী খেলাম।

এবার ঘরে ফেরার পালা। অসাধারণ সৌন্দর্য ছেড়ে আসতেই মন চাইছে না, কিন্তু কর্মব্যস্ত জীবনে ফিরতেই হবে। তাই সকালে পারোকে বিদায় জানিয়ে ফিরছি ভুটান থেকে। সেই মেঘ ও পাহাড়ের লুকোচুরি, মেঘের মধ্যে দিয়ে চলেছি রাজার দেশ ছেড়ে অসাধারণ সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে ভারাক্রান্ত মন নিয়ে। বিদায় ভুটান !
               








অসমীয়া গল্পের অনুবাদ : বাসুদেব দাস

২৬ মার্চ,১৯৭১
দিলীপ বরা

মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ - বাসুদেব দাস

রাজধানী শহর থেকে বহু দূরের একটি ছোট রেলস্টেশন।বিনয়বাবু চাকরি সূত্রে এই স্টেশনে বদলি হয়ে আসার বেশিদিন হয়নি।তা হলেও বাবু স্টেশনটার কাহিনি অনেক শুনেছেন।ভূতে পাওয়া স্টেশন।‘গোটা দেশটাই ভূতে পাওয়া।‘ বাবুর প্রায়ই মনে হয়। প্রথম যখন রেলে চাকরি পাওয়ার খবর পেয়েছিল তখনই বাবুর মা-বাবা ছেলেকে যাতে এদিকে চাকরি করতে না হয় তারজন্য নানারকম চেষ্টা চরিত্র করেছিল। তবে সেগুলি কাজে এল না। রেলের উপর মহলে বাবুর বাবার পরিচিত কেউ ছিল না।ফলে বিনয় বাবুকে ‘সোনার বাংলা’ছেড়ে একেবারে যাদুর দেশ কামরূপের এক কোণে এসে বসবাস করতে হল।বাবুকে মা-বাবা সাবধান করে দিয়েছিল,মানুষকে ভেড়া বানানোর দেশ কামরূপ।তারমধ্যে মা-কামাখ্যার পীঠস্থান।বুঝেসুজে চলবি।
এই স্টেশনেই গার্ডবাবু সুমিত সাহা এবং তাঁর পরিবার থাকে।দুই বঙ্গভাষী বাবুর মধ্যে খুব কম সময়ের মধ্যেই অন্তরঙ্গতা গড়ে উঠল।সাহা বাবুর বয়স বিনয় বাবুর বয়সের প্রায় দ্বিগুণ।সুমিতবাবুর আদি বাড়ি বাংলাদেশের বরিশালে।মুজিবর রহমান বাংলাদেশ স্বাধীন করার জন্য যুদ্ধের সময় সুমিত সাহার পরিবারকে বরিশাল ছেড়ে চলে আসতে হয়েছিল।
‘সেইসব দিনগুলি ছিল বড় ভয়ঙ্কর।বিনয় বাবুকে সাহা বাবু অতীতের কাহিনি শোনায়।বিনয় বাবুরও ভালো লাগে,একই জাতি,একই ভাষা।সাহাবাবুর ছোট পরিবার।স্ত্রী এবং দুটি ছেলেমেয়ে।মেয়েটি বড়,স্থানীয় কলেজে বি এ পড়ছে,নাম তার বাসবী।ছেলেটি স্কুলের শেষ ক্লাসে।সাহাবাবু বিনয় বাবুকে অনুরোধ করলেন ছেলেটিকে পড়াশোনায় সাহায্য করতে।বিনয় বাবু পড়াশোনার পাট চুকিয়েছেন খুব বেশিদিন হয়নি।দশম শ্রেণির একটি ছেলেকে পড়া দেখিয়ে দেওয়ায় তার কোনো অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।অঙ্ক এবং ইংরেজি দুটো বিষয়েই বিনয় বাবুর দখল আছে।
‘আপনাকে কিছু একটা দেব।‘সাহাবাবু টিউশুনির জন্য টাকা দিতে চাইলে বিনয় বাবু বাধা দিলেন।এখন ও সে বিয়ে করেনি।মা-বাবার প্রয়োজন টুকু বাবার পেন্সন থেকেই হয়ে যায়। যুবক ছেলেটির কথা শুনে সাহাবাবু খুশি হলেন।ছেলে পড়ানো শুরু করার পর থেকে প্রতিদিন সন্ধ্যেবেলা বিনয়বাবু সাহাবাবুর বাড়ি যাওয়া আসা শুরু করলেন।সাহা বাবু বাড়ি থাকলে টিউশুনির পরে দুজনেই দীর্ঘকালীন আড্ডা মারেন।এরকমই একটি সন্ধ্যেবেলা তাঁর জীবন সংগ্রামের কাহিনি সাহাবাবু বলতে শুরু করলেন।
‘সবকিছু খুলে বলুনতো।’বিনয় বাবুর ও খুব আগ্রহ ছিল।বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিষয়ে তিনি পড়েছেন।শেখ মুজিবর,বাঘা সিদ্দিকি,ঢাকা বিশ্ববিদালয়ে রাজাকারদের,বিনয় বাবু অনেক কাহিনি শুনেছেন। হলেও প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থাকা কারও সঙ্গে এতদিন কথা হয়নি।সাহা বাবুর কথা শোনার জন্য স্বাভাবিক ভাবেই আগ্রহী হয়ে উঠল নতুন করে চাকরিতে প্রবেশ করা যুবক অ্যাসিস্টেন্ট স্টেশন মাস্টার।
ধর্মের নামে ভারতবর্ষ বিভক্ত হয়েছিল।১৯৪৭ সনের চৌদ্দ এবং পনেরো আগস্ট দুটো নতুন দেশের জন্ম হয়েছিল,ভারত এবং পাকিস্তান।পাকিস্তান ও ছিল দুটি,পূর্ব এবংপশ্চিম,মাঝখানে দুই হাজার মাইলের ব্যবধান।দুই পাকিস্তানের মানুষগুলির মধ্যে বেশিরভাগ বাসিন্দা ইসলামধর্মী হওয়া ছাড়া অন্য কোনো কথাতেই মিল ছিল না।পশ্চিমের মানুষগুলি দীর্ঘদেহী,হৃষ্টপুষ্ট,পূর্বের মানুষগুলি ক্ষীণকায়,দুর্বল।পশ্চিমের মানুষগুলির ভাষা উর্দু-সিন্ধি-পাখতুন,পূর্বের মানুষগুলির ভাষা বাংলা।পশ্চিমের মানুষেরা রুটি খায়,পূর্বের মানুষেরা ভাত খায়।পশ্চিমের মানুষেরা গায় গজল,পূবে গায় ভাটিয়ালি।‘
‘পোশাক পরিচ্ছদেও মিল ছিল না,পশ্চিমের কুর্তা শেরওয়ানির বিপরীতে পূবে লুঙ্গি-জামা,ধুতি-পাঞ্জাবি,শাড়ি-ব্লাউজ।জনসংখ্যার দিক থেকে পূর্ব পাকিস্থান বৃহৎ,কিন্তু অফিস-কাছারি,পুলিশ-মিলিটারির বেশিরভাগ চাকুরিজীবীরা পশ্চিমের।পূর্বের মানুষেরা বারো মাস জলের সঙ্গে যুদ্ধ করে বেঁচে থাকে,পশ্চিমের মানুষের গঠিত সরকার কেবল ধন আকর্ষণ করে। পাকিস্তানের জন্মদাতা জিন্না সাহেব গণতান্ত্রিক পাকিস্তানের কথা বলেছিলেন,কিন্তু মাত্র কয়েকবছর পরে পশ্চিমে সামরিক অভ্যুত্থান হয়।সমগ্র দেশকে সামরিক শাসনের অধীনে নিয়ে আসা হয়।‘
জনতা প্রতিবাদ করল না?’
পশ্চিমে প্রতিবাদ না হলেও পূর্বে হয়েছিল।কঠোর হাতে পশ্চিমের মিলিটারি পূর্বের প্রতিবাদী কণ্ঠ রুদ্ধ করে দিল।পূর্বের জনসাধারণ শারীরিকভাবে দুর্বল হলেও মেধার দিক দিয়ে পশ্চিমের থেকে অনেকটা এগিয়েছিল।পশ্চিম থেকে এসে সামরিক অফিসাররা বেছে বেছে পূর্বের বুদ্ধিজীবীদের হত্যা,অপহরণ,এবং নিখোঁজ করলেন।সংখ্যালঘুদের উপরে বেশি করে অত্যাচার চলল।দেশ বিভাজনের সময় পূর্ব পাকিস্তানে থেকে যাওয়া মোট জনসংখ্যার শতকরা চব্বিশ শতাংশ হিন্দু এই সময়ে কমে গিয়ে আঠারো শতাংশে পরিণত হয়।পুর্বপাকিস্তান থেকে অনেকেই শরনার্থী হয়ে ভারতে চলে আসে,তার বেশিরভাগই হিন্দু।কিছু পূব এবং পশ্চিমের দেশগুলিতে চলে যায়।‘সাহাবাবুর দৃষ্টি দরজার পর্দা ভেদ করে রাতের পৃ্থিবীর দিকে চোখ রাখে।চূণা পাথরে জল ঢাললে যেভাবে বুরবুরি ঊঠে সেভাবে সাহার মনের ভেতরেও স্মৃতির বুরবুরনি দেখা দিল।সেই দিনগুলি কী ভয়ানক ছিল।্রক্ত পিপাসু রাজাকাররা অলিতে গলিতে ঘুরে বেড়াচ্ছিল।প্রতি রাতে দরজায় টোকর পড়ত।রাজাকারদের লিষ্টে থাকা বাঙালি মুসলমান বুদ্ধিজীবী ,নেতা,ছাত্রদের ধরে নিয়ে জেলে ভরা হচ্ছিল।হিন্দু প্রতিবাদকারীদের রাতের অন্ধকারে ঘর থেকে তুলে নিয়ে যাবার পরে আর কোনো খবর পাওয়া যেত না। নিখোঁজ হওয়া পরিবারের যুবতি মেয়ে এবং কম বয়সী মেয়েদের গায়ে ওরা হাত দিত।ওরা লুণ্ঠন এবং ধর্ষণ কার্যেও লিপ্ত ছিল।কোথাও প্রতিবাদ করার কোনো উপায় ছিল না।পুলিশ,ম্যাজিষ্ট্রেট সবাই ওদের ভয়ে তটস্থ।মুজিবর রহমানের আওয়ামী লীগ রাজাকারদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করার হুমকি দেওয়ায় তাকে গৃহবন্দি করে রাখা হয়।রাজাকারদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ তুষের আগুনের মতো ভেতরে ভেতরে জ্বলছিল।বেশিদিন লাগল না।বাঘা সিদ্দিকির অধীনে আত্মগোপনকারী একটা দল গড়ে উঠল।বোমা দেওয়া,রেল লাইন উপড়ে ফেলা,সেনা এবং পুলিশ ছাউনিতে গেরিলা পদ্ধতিতে গোলা বর্ষণ ইত্যাদি অনেক ঘটনা বাঘা সিদ্দিকির নে্তৃত্বে ঘটে চলল।পশ্চিম পাকিস্থানের সামরিক বাহিনি মিলিটারির সাহায্যে প্রতিবাদকারীদের কণ্ঠ যতই চাপা দিতে চেষ্টা করল ততই আর ও অনেক প্রতিবাদী কণ্ঠের জন্মদান করল।অবশেষে সামরিক সরকার মুজিবরের দাবি মেনে নিতে বাধ্য হল।এক ব্যক্তি,এক ভোট নীতির আধারে সার্বজনীন ভোটে জাতীয় অ্যাসেম্বলিতে প্রতিনিধি নির্বাচনের জন্য নির্বাচনের সময়সূচি ঘোষণা করা হল।‘এতটুকু বলে সাহা বাবু চুপ করলেন।
‘কী ভাবছেন?’তাকে বেশ কিছু সময় চুপচাপ বাইরের গহীন অন্ধকারের দিকে স্থিরভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে বিনয় বাবু জিজ্ঞেস করলেন।
‘কি বলছ?’বিনয় বাবুর কথা শুনে গভীর ঘুম থেকে জেগে উঠা মানুষের মতো সাহা বাবু ধড়মড় করে উঠে বসলেন।
জিজ্ঞেস করছিলাম,আপনি কি ভাবছেন?’সাহাবাবুর ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া মুখ দেখে বিনয় বাবুর চিন্তা হল।
ফেলে আসা ভয়ার্ত দিনগুলির স্মৃতি আজ ও আমার বুকের ভেতরে কম্পন তুলে।কত মানুষ নিখোঁজ হয়ে গেল,কত জনের মুন্ডহীন দেহ পথের পাশে,মাঠে ঘাটে পড়ে রইল,কত বৌ-ঝিকে রাজাকারদের হাতে ধর্ষিতা হয়ে ধর্মান্তরিত হতে হল,আজ ও তার সঠিক হিসেব হয়নি।উনিশ শো সত্তরের সাধারণ নির্বাচনে মুজিবরের দল আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করা সত্ত্বেও পশ্চিম পাকিস্তানের মিলিটারি শাসক মুজিবরকে সরকার গঠন করতে দিল না।প্রধান মন্ত্রী হওয়ার পরিবর্তে মুজিব হলেন পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি।হাজার হাজার রাজাকারে পূব পাকিস্তানের শহর-নগর ভর্তি হয়ে পড়ল।অনেক হিন্দু এবং কিছু সংখ্যক মুসলমান ও বাড়ি-ঘর,জমি-মাটি,বন্ধু-বান্ধব,আত্মীয়-স্বজন ছেড়ে বেঁচে থাকার তাড়নায় সাত পুরুষের ভিটা ছেড়ে ভারতে পালিয়ে এল,শরণার্থী হল।অনেকে তা ও করতে পারল না।যারা রাজাকারদের হাতে পড়ল তাদের বেশিরভাগকেই হত্যা করা হল।মেয়ে-বৌ্দের ধর্ষণ-বলাৎকারের পরে ধর্মান্তরিত করে রক্ষিতা এবং চাকরানী হিসেবে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে গেল।‘সাহা বাবু দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।কথা বলার সময় তাঁর দুচোখ দিয়ে জলের ধারা বয়ে গেল।
‘ঈশ্বরকে ধন্যবাদ যে,আপনারা প্রত্যেকেই ভালোভাবে পালিয়ে আসতে পেরেছেন।সান্ত্বনা দেবার সুরে বিনয় বাবু বললেন।
অনেকক্ষণ পর্যন্ত সাহা বাবু বিনয়ের কথার কোনো উত্তর দিল না।রাত গভীর হয়ে আসছিল।রাজধানীর উদ্দেশে যাওয়া ডাউন পেসেঞ্জার একটু পরেই এসে যাবে।বিনয় বাবু ঘড়ির দিকে তাকালেন।
‘ডাউন পেসেঞ্জার আসার সময় হয়ে গেছে।আমি উঠছি।’বিনয় বাবু চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালেন।রেলের কোয়ার্টারের হলদে বাল্বের আলোতে সাহা বাবুর দুই চোখ দিয়ে বয়ে যাওয়া চোখের জলটুকু একটা ক্ষণিকের সাপের মতো জ্বলজ্বল করে উঠছিল।বিনয় বাবু চমকে উঠলেন।
‘আপনি কাঁদছেন?’
সাহা বাবুর সম্বিৎ ফিরে এল।শার্টের আস্তিন দিয়ে তিনি চোখের জল মুছে ফেললেন।
‘ট্রেন যাবার পরে চলে এসো’।
‘অনেক রাত হবে।’বিনয় বাবু নিম্নস্বরে আপত্তি জানাল।
‘কিছু হবে না।আজ ইলিশ এনেছিলাম।’সাহা বাবু জোর করলেন।কোনো বাঙালি ইলিশ মাছের লোভ সামলাতে পারে?মৃতদেহে মাছি পড়ার মতোই ইলিশের উপরে বাঙালিরা ঝাঁপিয়ে পড়ে।
‘কোথায় পেলেন?এখানে তো ইলিশ পাওয়াই যায় না।‘বিনয় বাবুর জিভে জল এসে গিয়েছিল।কত দিন ইলিশ মাছের স্বাদ পাইনি।
‘কাল ফেরার সময় নিয়ে এলাম।রাজধানীর বাজারে পদ্মার ইলিশ এসেছে শুনে আর লোভ সামলাতে পারলাম না।’সাহা বাবুর মুখে কিছুক্ষণ আগে দেখা যাওয়া মন খারাপের চিহ্নমাত্র আর নেই।বিনয় বাবুর ও মন ভরে গেল,ইলিশ মাছের স্বাদ পাওয়ার আশায়।
সাহাবাবু ড্রইং রুমেই বসে রইলেন।ভুলতে চাইলেও বিভীষিকায় ভরা দিনগুলির স্মৃতি ভোলা সম্ভব নয়।সাহা বাবুর পরিবারে দশজন মানুষ ছিলেন।মা-বাবা,দাদু-দিদিমা,সাহা বাবু,তিন ভাই আর দুই বোন।দাদু-দিদিমা ষাঠ বছর অতিক্রম করেছিল।চাষের জমি ছিল একশ বিঘার উপরে।দাদু মুসলমান শ্রমিকদের দিয়ে চাষ করাতেন।স্বাধীনতার সময়েও সংঘর্ষ হয়েছিল।কিন্তু সাহা বাবুর বাবার জমিতে চাষ করা চাষার মাথায় তখনও মৌলবাদী সংগঠনের প্রভাব বিস্তারিত হয়নি।হিন্দু জমিদার এবং জমিতে চাষ-বাস করা মুসলমান চাষিরাও এক সময়ে হিন্দুই ছিল।জাতিতে নিচ এবং অর্থনৈ্তিকভাবে বিশেষভাবে পেছেনে পরে থাকা এই মানুষগুলিকে হিন্দু জমিদার তথা উচ্চ বংশজাত মানুষগুলি কোনোদিনই তুলে ধরার চেষ্টা করল না।উলটো কীভাবে ওদের সামাজিক,অর্থনৈতিক তথা শৈক্ষিকভাবে পেছনে ফেলে রেখে নিজের ভাণ্ডার সমৃদ্ধ করে তোলা যায় সেই কথাতেই তারা প্রাধান্য দিয়েছিল।স্বাধীনতা এবং দেশ বিভাজনের পরে গরিষ্ঠসংখ্যক মুসলমানের দেশ পূর্ব পাকিস্থানে হিন্দু জমিদার তথা উচ্চ বংশজাত হিন্দু পরিবারগুলির প্রতি দুঃখী মুসলমান মানুষগুলির মধ্যে এতদিন ধরে সুপ্ত থাকা রোষের বহির্প্রকাশ ঘটতে লাগল।অনেকদিন ধরে ভেতরে ভেতরে তুষের আগুনের মতো জ্বলতে থাকা আগুনকে দেশবিভাজনের বাতাস আরও উদ্দীপিত করে তুলল।অনেক ধনী জমিদার এবং উচ্চ বংশজাত হিন্দু পরিবার বাড়ি-ঘর বিক্রি করে ভারত,ইংল্যাণ্ড ইত্যাদি দেশে চলে গেল।তখন ও তাতে থেকে যাওয়া দুঃখী হিন্দু মানুষগুলিকে গরিষ্ঠ মুসলমানরা নানাভাবে অসুবিধা দিতে লাগল।সরকারি কাগজপত্রেও হিন্দু পূর্ব পাকিস্তানীদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকের মর্যাদা দেওয়া হল।চাকরি-বাকরি,সমস্ত রকম সুযোগ-সুবিধা থেকে তাদের বঞ্চিত করা হল।হাতে না মেরে ভাতে মারার এই ব্যবস্থা বহু গরিব হিন্দুকে দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যেতে বাধ্য করল।সাহা বাবুও বাবাকে বরিশালের মাটি-বাড়ি,ঘর-দুয়ার বিক্রি করে কলকাতায় চলে আসার কথা বলেছিলেন।কিন্তু ছেলের কথায় সোমেন্দ্র সাহা রাজি হলেন না। সাত পুরুষের বাড়ি ঘর ছেড়ে কলকাতা শহরের গলিতে জীবন কাটাতে রাজি হলেন না,নামে জমিদার কিন্তু কাজে অ্যাটর্নি সোমেন্দ্র বাবু।সাহা বাবু সেই সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছিলেন।সেখানকার পরিবেশ অন্যরকম ছিল।বেশিরভাগ ছাত্র ছাত্রীর মনেই বামপন্থী চিন্তাধারা এবং দর্শনের প্রভাব পড়েছিল। চারপাশে বর্ধিত ইসলামীয় গোড়ামির বিপরীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিরাজ করছিল ধর্মনিরপেক্ষ,সমাজবাদী চিন্তাধারা। ধূ ধূ মরুভূমির মধ্যে মরুদ্যান।পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আসা রাজাকার এবং পূব পাকিস্তানের মৌলবাদীর বিরুদ্ধে সবল প্রতিবাদ গড়ে তোলার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছাত্রের একটি বিরাট দল দেশের কোণে কোণে প্রচার চালিয়ে যাচ্ছিল।
‘মুজিবর রহমানকে সরকার গঠন করার জন্য রাষ্ট্রপতি ডেকে পাঠালেন না।এক মাস ধরে দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত ঘুরে শ্রান্ত ক্লান্ত হয়ে সাহা বাবুদের দলটি সেদিনই দুপুর বেলা বিশ্ববিদ্যলয় ক্যাম্পাসে ফিরে এসেছে।বিকেলে ছাত্র ইউনিয়নের কার্যালয়ে বসতেই ছাত্র ইউনিয়নের সম্পাদক আমিনুল ইসলাম খবর দিলেন।উপস্থিত সবারই মুখের কথা বন্ধ হয়ে গেল।
‘এখন কী হবে?’নিস্তব্ধ ঘরের নীরবতা ভঙ্গ করে কাবেরী পাল নামে ছাত্র কাউন্সিলের সভাপতি জিজ্ঞেস করলেন।
‘মুজিবুর রহমানকে জেলে ভরিয়েছে।মুজিবরের জেল এবং রাষ্ট্রপতির সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ দল দেশজোড়া বন্ধের কার্যসূচি হাতে নিয়েছে’।আমিনুল যতটুকু খবর পেয়েছিল সব বিস্তারিত জানাল। দুইপক্ষই যুযুধান অবস্থিতি নিয়েছে।মুজিবরের সমর্থনে লক্ষ লক্ষ পূব পাকিস্তানী নাগরিক রাজপথে বেরিয়ে এসেছে।রাষ্ট্রপতির সিদ্ধান্ত কার্যকরী করার দায়িত্ব নিয়ে পাকিস্তানী সেনাবাহিনির লেঃজেনারেল নিয়াজী নব্বই হাজার সৈ্ন্য নিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়েছেন।দুই একদিনের মধ্যেই তার ঢাকা পৌছানর কথা।তাকে রাষ্ট্রপতি পূব পাকিস্তানের মার্সাল আডমিনিস্ট্রেটর নিযুক্ত করেছেন।
মার্সাল আডমিনিস্ট্রেটর?’সাহা বাবু আকাশ থেকে পড়লেন।মাত্র দুই মাস আগে নির্বাচন ঘোষণা করে রাষ্ট্রপতি কথা দিয়েছিল সাধারণ নির্বাচনের পরেই জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের রাজনৈতিক ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে।নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যে বিজয়ী হবে এই কথাটা আগে থেকেই জানা ছিল।তাহলে এখন পুনরায় কেন মার্সাল শাসনের কথা বলা হচ্ছে?কাবেরীর প্রশ্নের উত্তর আমিনুল দিতে পারল না।
সাহাবাবুর মনের ভেতরে তুফান চলতে লাগল।মুজিবর রহমানকে পূব পাকিস্তানের হিন্দু সংখ্যালঘুরা সম্পূর্ণ সমর্থন দিয়েছিল,নির্বাচনের পরে মুজিবই দেশের প্রধানমন্ত্রী হবে এই আশায়।সরকার গড়ার জন্য মুজিবরের সংখ্যা গরিষ্ঠতাও ছিল।কিন্তু পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি জাতীয় সরকার গঠন করার প্রস্তাব দিল,মুজিবরকে উপ-প্রধান মন্ত্রীর পদ গ্রহণ করতে বললেন।মুজিবরের পক্ষে কোনো ভাবেই এই প্রস্তাব মানা সম্ভব নয়। মুজিবরকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে নিক্ষেপ করা হল।
কথাটা বাতাসের মতো দেশের বিভিন্ন কোণে কোণে ছড়িয়ে পড়ল।স্বতঃস্ফুর্তভাবে মানুষ রাজপথে বেরিয়ে এল।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসীমায় থাকা ছত্রাবাসের আবাসিকরাও বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল প্রবেশদ্বারের সামনে জমায়েত হল। মুজিবর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ পূর্ণ স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে।স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকার নিচে সমবেত হওয়ার জন্য সমস্ত বাংলাদেশীকে জেল থেকেই রহমান সাহেব আহ্বান জানিয়েছেন।প্রবেশদ্বারের সামনে সমবেত হওয়া হাজার হাজার ছেলে-মেয়ের সামনে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ঘোষণা করলেন।
উপাচার্যের ঘোষণা শুনে ছেলে-মেয়েরা ‘জয়-বাংলা’বলে চিৎকার করে উঠলেন।‘মুজিবর রহমান জিন্দাবাদ’ ধ্বনিতে আকাশ-বাতাস আলোড়িত হল। মহানগরের রাজপথ ধরে এগিয়ে চলল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলে-মেয়েরা,শিক্ষক-শিক্ষয়িত্রীরা,শুভাকাঙ্খী কর্মচারীদের বৃহৎ মিছিল।সাহা বাবু ছিলেন মিছিলের মধ্যভাগে।
ঢাকা শহরের আকাশ-বাতাস নিনাদিত করে এগিয়ে চলছিল স্বাধীনতার দাবীতে আত্মহারা হওয়া ছেলে-মেয়েরা।মিছিল খুব বেশি দূর এগিয়ে যেতে পারল না।মিছিলের সামনের দিকে হঠাৎ গুলির আওয়াজ শোনা গেল।মিছিলের মানুষগুলিকে লক্ষ্য করে ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি বৃষ্টি হতে লাগল।কিছুক্ষণ আগেই ‘জয় বাংলা’ধ্বনিতে চারপাশ মুখরিত করে তোলা ছেলে-মেয়েদের মুখ থেকে কেউ যেন তাদের বাক্য হরণ করে নিল।চোখের সামনে ঢলে পড়া শত শত ছেলে-মেয়ের দেহ গুলিকে জুতোর দ্বারা মাড়িয়ে দৌড়ে এল রাজাকারের দল।
চোখের সামনে সহপাঠীদের ঢলে পড়তে দেখে সাহাবাবুর হাত-পা শক্ত হয়ে গেল।পরের মুহূর্তেই কেউ তার কানের কাছে চিৎকার করে বলল,ভাগ ভাগ এখন মরবি।‘চারপাশে হতে থাকা ধুম-ধাম শব্দগুলিকে হাপিয়ে তার কানে প্রতিধ্বনিত হল গুলি লেগে ঢলে পড়া কবেরী পালের মরণ কাতর আর্তনাদ।সাহা বাবু সম্বিৎ ফিরে পেলেন।বেঁচে থাকার তাড়নায় তীব্র বেগে সে সেখান থেকে দৌড় লাগাল।কোথায় গিয়েছিল,কোথায় গিয়ে পৌছাবে,কেউ তাড়া করেছিল নাকি,কোনো কথাই তার মনে পড়ল না।যেদিকে খোলা পেল সেদিকেই দৌড় লাগাল।ঢাকা শহরের প্রতিটি অলি গলি তার পরিচিত ছিল।তবুও মাথা তুলে সে কোনোদিকে তাকায়নি।বাঘে তাড়া করা হরিণের মতো প্রাণের মমতায় কেবলই দৌড়াচ্ছিল,দৌড়াচ্ছিল আর দৌড়াতে দৌড়াতেই একটা সময়ে ঘরের উঠোনে গিয়ে দাঁড়াল।
অন্ধকারে ডুবে ছিল সোমেন্দ্র সাহার সাতপুরুষের দুই মহলা বাড়ি।চারপাশে শ্মশানের নিস্তব্ধতা বিরাজ করছিল।উঠোনে দাঁড়িয়ে লম্বা করে শ্বাস নিয়ে সাহা বাবু চারপাশে তাকালেন।ঢাকা শহরের চারপাশে আগুন আর ধোঁয়া বেরোতে দেখা যাচ্ছিল।কালবৈশাখীর মতো দূর থেকে চিৎকার চেঁচামিচি ভেসে আসছিল।সাহা বাবু নিঃশ্বাস বন্ধ করে কিছুক্ষণ শুনলেন,কিসের শব্দ এটা?বাতাস তো নয়।তাহলে?ওগুলো মানুষের কথা,অনেক মানুষ একসঙ্গে কথা বললে বা পদচারণা করলে এই ধরনের শব্দের সৃষ্টি হয়।কে ওরা?কোথায় এসেছে মানুষগুলি?কি কথা বলছে বিশাল শোভাযাত্রার সঙ্গে আসা মানুষগুলি?
সাহা বাবু কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লেন।সমস্ত শরীরটা ঘামে ভিজে গিয়েছিল।পরনের জামা পেন্ট শরীরের সঙ্গে আঁটো হয়ে বসেছিল।পায়ের স্যাণ্ডেল জোড়া পা থেকে খুলে গিয়ে কোথায় পড়েছিল বুঝতেই পারেনি।ধানবানা ঢেঁকির মতো সাহা বাবুর বুকটা উঠানামা করছিল।পায়ের ব্যথা আর গায়ের ঘাম দেখে সে অনুমান করেছিল কমেও সে দুই মাই দৌড়ে এসেছে।
কোথায় একটা শব্দ হল।পেছনের বাগান থেকে নিশাচরদের কলরবের শব্দ ভেসে এল।সাহা বাবুর এতক্ষণে খেয়াল হল অনেকক্ষণ কোনো মানুষের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছেন না।অন্ধকারে ডুবে থাকা নির্জন ঘরের দিকে তাকিয়ে তার বুকটা অজানা আশঙ্কায় কেঁপে উঠল।
সাহা বাবু সন্তর্পণে পা ফেলে বারান্দায় উঠে এলেন।সদর দরজার একটা পাট খোলা।তিনি দরজাটা এক হাতে ঠেলে দিলেন।সম্পূর্ণ দরজাটা খুলে গেল।সাহা বাবু অভ্যস্থ হাতে ইলেক্ট্রিক বোর্ডের সূইচে হাত দিলেন।না কোথাও আলো জ্বলল না।দ্রুততার সঙ্গে তিনি সবগুলি সূইচ টিপে গেলেন।ফেন,লাইট কোনোটাই কাজ করছে না।
বাবা,মা,আপনারা কোথায়?দৌড়ে দৌড়ে শুকিয়ে যাওয়া গলা দিয়ে কোনো আওয়াজ বের হচ্ছিল না।সাহা বাবু সজোরে চিৎকার করে ডাকলেন,মা,বাবা আপনারা কোথায়?
নিস্তব্ধ অন্ধকারে সাহাবাবুর কণ্ঠস্বর নিশাচর পাখির শব্দের মতো প্রতিফলিত হয়ে চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছিল।হন্তদন্ত হয়ে সাহা বাবু এঘর থেকে ও ঘরে খুঁজে বেড়ালেন।কেউ কোথাও নেই।মাত্র কয়েক মিনিটের আতঙ্ক দ্বিগুণ হয়ে তার বুক পিঠ বিদ্ধ করল।এতক্ষণ পর্যন্ত তিনি আশেপাশের বাড়িগুলির দিকে তাকান নি।এবার ভয়ে ভয়ে চারপাশে তাকালেন।
ঢাকা শহরের ধানমুণ্ডি এলাকার হিন্দু পাড়া অন্ধকারে ডুবে গিয়েছিল।সাহা বাবুর বুঝতে বাকি রইল না,রাজাকাররা এদিকটাতেও এসেছিল।পাড়ার প্রতিটি মানুষ হয় পালিয়েছে না হয় রাজাকাররা তাদের বন্দি করে নিয়ে গিয়েছে।কোনো অদৃশ্য যাদুকরের হাতের স্পর্শে যেন জীবন্ত মানুষগুলি বাতাসে মিলিয়ে গেছে।
সুমিত সাহা নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ষষ্ঠ বার্ষিকীর  ছাত্রটি কী করবে কী না করবে কিছুই বুঝতে পারল না।বিশ্ববিদ্যালয়ের চারপাশে যে পরিস্থিতি দেখে এসেছে তাতে সেখানে ফিরে যাবার প্রশ্নই উঠে না।অন্ধকারে দুই হাঁটুর মধ্যে মাথা গুঁজে বসে রইল ভয়ে শঙ্কায় কাঠ হয়ে যাওয়া ছেলেটি,একা।
বড় বেশি সময় নয়,খুব বেশি আধ ঘন্টা।এক দল কুকুর রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে চিৎকার করে উঠল।সাহা বাবু মাথা তুলে তাকালেন।বাড়ির সামনের রাজপথ দিয়ে গাড়ির পরে গাড়ি গিয়েছে।ছেলেটি কিছুক্ষণ সেদিকে নির্নিমেষ চোখে তাকিয়ে রইল।গাড়িগুলির পেছনের নাম্বারপ্লেটগুলি পেছনের গাড়ির আলোকে জ্বলজ্বল করছে।চোখ দুটি সে নাম্বার প্লেটগুলি পড়ার চেষ্টা করল।
সেনার গাড়ি।একসঙ্গে এতগুলি গাড়ি যেতে দেখে সাহা বাবুর চিন্তা হল।এতগুলি গাড়ি কোথায় গিয়েছে?পরিবারের চিন্তা বোবা করে রাখা মানুষটা সেনার গাড়ির সংখ্যা দেখে সচকিত হয়ে উঠল।যুদ্ধ,নিশ্চয় যুদ্ধ আরম্ভ হয়েছে।আওয়ামী লীগ সর্বাত্মক বন্ধ ঘোষণা করেছে,রাজাকার বাহিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিজের হাতে নিয়ে নিয়েছে,শত শত প্রতিবাদকারীকে বন্দুকের গুলিতে ঝাঁঝরা করে দিয়েছে।ঢাকা শহরের অভিজাত অঞ্চল ধানমুণ্ডিতে থাকা হিন্দু পাড়ার সমস্ত বাড়ি খালি হয়ে গেছে।সুমিত সাহা নামে বাইশ বছরের ছেলেটি এই পরিস্থিতিতে কী করতে পারে?নিখোঁজ হওয়া পরিবারের সন্ধানের খোঁজে কার কাছে গিয়ে দাঁড়াবে?পুলিশ,থানা,ডিসি,অফিস,পার্লামেন্ট হাউস,রাজভাণ্ডার,সবকিছুই রাজাকারের দখলে।বিদ্রোহী আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীর কিছু সংখ্যকদের সঙ্গে পরিচয় আছে সুমিত বাবুর।কিন্তু কোথায় দেখা পাওয়া যাবে,কার সঙ্গে দেখা করবে,এই দুর্দিনে কিছুই তো বলতে পারছে না।
সেনার গাড়ির সারি তখনও শেষ হয় নি।সৌ্মেন্দ্র সাহাকে যখন ভারতে চলে আসার জন্য আশেপাশের মানুষেরা দেখা করেছিল তখন প্রত্যেকেই অল্প দূরের আগরতলা নামে শহরটির কথা বলেছিল।ঢাকা শহর থেকে বাসে মাত্র তিন ঘন্টার দূরে থাকা আগরতলা নামে শহরটি ত্রিপুরা নামে ছোট্ট প্রদেশের রাজধানী।বাঙ্গালি মানুষের শহর আগরতলা।বেশিরভাগ মানুষই দেশ বিভাজনের সময় পূর্ববঙ্গ থেকে পালিয়ে আসা।এখন ও সৌ্মেন্দ্রবাবু পরিবার সহ সেখানেই গিয়েছে নিশ্চয়।কিন্তু বড় ছেলের জন্য কেন অপেক্ষা করলেন নে সৌ্মেন্দ্র বাবু?না কি?ভাবতেও ভয় হল সুমিত সাহার।অন্ধকারে ডুবে থাকা বাড়িটা থেকে নিঃশব্দে সে রাজপথে বেরিয়ে এল।গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থেকে অন্ধকারে ডুবে থাকা বাড়িটার দিকে ফিরে তাকালেন।তারপর কিছুক্ষণ চিন্তা করলেন।রাজপথ দিয়ে যাওয়াটা নিরাপদ নয়।আগরতলা ঠিক কোন দিকটায় অন্ধকারের মধ্যে নির্ণয় করে নিলেন।মাঠে মাঠে হেঁটে চললে রাতের মধ্যে সীমান্ত অতিক্রম করে যাওয়া সম্ভব।ভারতের মাটিতে পা দিতে পারলেই নিরাপদ।হয়তো নিখোঁজ হওয়া পরিবারটিকে সেখানেই পেয়ে যাবে,কোনো শরণার্থী শিবিরে,না হলে কোনো পুরোনো পরিচিত মানুষের বাড়িতে।কিছুক্ষণ আগের নিরাশার কালো অন্ধকার ঘিরে ফেলা সুমিত সাহার মনে আশার আলো ফিরে এল।
রাজপথ ছেড়ে মাঠে নেমে এলেন সাহা বাবু।মিলিটারি গাড়িগুলি তখনও সার বেঁধে যাচ্ছিল।সাহা বাবুর মনে পড়ল,দিনটা ছিল ২৬ মার্চ,১৯৭১।সেদিনই আরম্ভ হয়েছিল তিন নিযুত মানুষের হত্যায় কালকে কলঙ্কিত করে রেখে যাওয়া পশ্চিম পাকিস্তানী সরকারের ‘অপারেশন সার্চলাইট’।
           ---------------                             

লেখক পরিচিতি -
১৯৫৪ সনে অসমের নগাঁও জেলার সামগুড়িতে গল্পকার এবং ঔপন্যাসিক দিলীপ বরার জন্ম হয়।চাকরি সূত্রে অসম সরকারের সঙ্গে জড়িত।অসম আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে রচিত শ্রী বরার ‘কলিজার আই’উপন্যাসটি অসম আন্দোলনের এক নিরপেক্ষ দলিল হিসেবে বিবেচিত।ভস্মাচলর ছাই,বধ্যভূমিত একলব্য লেখকের সাম্প্রতিক উপন্যাস।