Wednesday, January 2

সাক্ষাৎকার : রমানাথ রায়


'কাপুরুষরা কখনো ভালো লেখক হতে পারে না।'





সাহিত্যিক রমানাথ রায়ের মুখোমুখি প্রগতি মাইতি ও রাজেশ ধর


( সাহিত্যিক রমানাথ রায়ের জন্ম ১৯৪০ সালে, মধ্য কলকাতায়। পৈতৃক নিবাস যশোহর, বাংলাদেশ। " শাস্ত্রবিরোধী আন্দোলন" - এর অন্যতম পুরোধা। রাজ্য সরকারের বিদ্যাসাগর পুরস্কার লাভ করেন। আনন্দবাজার পত্রিকা, দেশ, আজকাল, বর্তমান - ইত্যাদি কাগজে লিখেছেন। কিন্তু তাঁর উত্থান লিটল ম্যাগাজিন থেকে। এখনও লিটল ম্যাগাজিনের সাথে তাঁর নাড়ির সম্পর্ক। বাংলা সাহিত্যে ' জাদু বাস্তবতা'  নিয়ে তাঁর অবদান অবিস্মরণীয়। তারঁ উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ : প্রিয় গল্প, দু'ঘন্টার ভালোবাসা, শ্রেষ্ঠ গল্প, গল্প সমগ্র। উপন্যাস  : ছবির সঙ্গে দেখা, ভালোবাসা চাই, মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী, কাঁকন, অন্যায় করিনি, উপন্যাস সমগ্র ইত্যাদি।)


পারক : শাস্ত্র বিরোধী আন্দোলন এর কি উদ্দেশ্য ছিল?

বাংলা সাহিত্যে তারাশঙ্কর মানিক প্রমুখ ও লেখকদের হাতে তথাকথিত বাস্তববাদী সাহিত্যের যে ধারা তৈরি হয়েছিল তাকে বর্জন করাই ছিল শাস্ত্রবিরোধী সাহিত্যের উদ্দেশ্য। আমরা চেয়েছিলাম বাস্তবের সঙ্গে ফ্যান্টাসি মিশিয়ে নতুন সাহিত্য রচনা করতে।

পারক : এই আন্দোলনকে সফল হয়েছিল বলে আপনার মনে হয়?

 আমাদের উদ্দেশ্য পূরণ না হলেও অনেকটাই সফল হয়েছে। কারণ এখন অনেকেই তথাকথিত বাস্তববাদী সাহিত্যের ধারা থেকে সরে এসেছেন, তাদের লেখায় ফ্যান্টাসি আসছে। 

পারক : ওই সময় এই আন্দোলনে কে কে ছিলেন? 

এই আন্দোলনে প্রথমে আমি ছাড়া ছিলেন শেখর বসু, আশীষ ঘোষ, সুব্রত সেনগুপ্ত, কল্যান সেন। পরবর্তীকালে এসেছেন অমল চন্দ্র, বলরাম বসাক এবং সুনীল জানা।

পারক : আপনি প্লটে বিশ্বাস করেন না কেন?

 প্লট সব সময় কার্যকারণে গঠিত হয়। সেখানে প্রতিটি কাজের পিছনে কারণ থাকে। কারণ ছাড়া কার্য হয়না। বিজ্ঞানের এই নিয়মকে আমরা মানতে চায়নি। আমরা দেখেছি অনেক কার্যের কারণ সব সময় খুঁজে পাওয়া যায় না। বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক হাইজেনবার্গের 'অনিশ্চয়তার তত্ত্ব' তো সেই কথাই বলে। তাছাড়া আমাদের জীবনে এমন সব অদ্ভুত অদ্ভুত ঘটনা ঘটে, যার কারণ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। সেই কারণেই আমরা প্লট নির্ভর গল্প বর্জন করে ছিলাম।

পারক : আপনার গল্প উপন্যাসে দেখা গেছে আপাত অ্যাবসার্ড  চরিত্র এসেছে। এর পিছনে উদ্দেশ্য কি? 

 পুরনো যুগের বাস্তববাদী সাহিত্যের ধারায় আধুনিক যুগের সমস্যা বা চরিত্রদের প্রকাশ করা সম্ভব হচ্ছে না বলেই অ্যাবসার্ড সাহিত্যের রচনারীতিকে গ্রহণ করা হয়েছে। এটাও একটা রচনাশৈলী। বর্তমান যুগকে প্রকাশ করতে হলে এই রচনারীতি আমার কাছে জরুরী বলে মনে হয়েছে। এই রকমই জরুরি মনে হয়েছিল ত্রৈলোক্যনাথ, সুকুমার রায় বা রাজ শেখর বসুর কাছে। আমাদের পৌরাণিক গল্পে বা মঙ্গলকাব্যের আমরা এই রচনারীতি দেখেছি, এই রচনারীতি আমরা কথাসরিৎসাগর বা আরব্য রজনীতেও দেখেছি। আমরা আমাদের এই মহান ঐতিহ্য থেকে সরে এসে পাশ্চাত্যের বাস্তববাদী সাহিত্যের ধারায় গল্প উপন্যাস রচনা করতে গিয়ে নিম্নমানের একঘেয়ে রচনা রীতিতে আটকে গেছি।

পারক : আপনার প্রায় সব গল্প উপন্যাসে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ শ্লেষ আছে এর কারণ কি? 

সমাজ ও চরিত্রদের অসঙ্গতিকে ফুটিয়ে তোলা এর উদ্দেশ্য। চিরকালীন মূল্যবোধে যা স্বাভাবিক বলে মনে হয় তা যখন আর স্বাভাবিক থাকে না, হয়ে ওঠে অসঙ্গতিতে ভরা, তখনই তা কৌতুকের বিষয় হয়ে ওঠে। ব্যঙ্গ বিদ্রুপ শ্লেষের প্রয়োজন হয় তখনই। আমার সব লেখায় যে ব্যঙ্গ বা কৌতুক আছে তা বলা যায় না, তবে অনেক লেখাতেই এসব আছে। আমার কি তাহলে দুটো মুখ? এক মুখে হাসি আর এক মুখে বেদনা! জানিনা, আমার পাঠকরাই এর সঠিক উত্তর দিতে পারবেন।

পারক : আপনি কি মনে করেন কথা সাহিত্যে হাস্যরস অনিবার্য? 

সাহিত্যে কোন কিছু অনিবার্য নয়। প্রত্যেক লেখকেই তার মানসিকতা বা দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী নিজস্ব রচনারীতি নির্মাণ করেন। সেখানে হাস্যরস থাকতেও পারে, আবার নাও থাকতে পারে। তবে তির্যক দৃষ্টিভঙ্গি বা সরসতা গল্প বা উপন্যাসকে অনেকখানি সুপাঠ্য করে তোলে। তাই বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ এবং শরৎচন্দ্রের লেখা আমাদের আজও আকর্ষণ করে, আর সরলতার অভাবে তারাশঙ্কর, বা মানিক আমাদের আকর্ষণ করে না। পাশ্চাত্য সাহিত্যেও বর্তমানে হাস্যরসকে আশ্রয় করা হচ্ছে। তাদের রচনায় কৌতুক রসের প্রাবল্য দেখা যায় কাফকা, বোর্হেস, মার্কেজ, ক্যালভিনো, কুন্দেরা প্রমূখ লেখকদের রচনা তার প্রমাণ। 

পারক : আপনার উত্তরণ লিটিল ম্যাগাজিন থেকে। ষাট সত্তরের দশকের লিটিল ম্যাগাজিনের সঙ্গে এই সময়ের লিটল ম্যাগাজিনের কোনো পার্থক্য দেখতে পান?

 ছয়-সাতের দশকের লিটিল ম্যাগাজিনগুলো অর্থাভাবে ভুগত, তাই সেই সময় লিটিল ম্যাগাজিনগুলো ছিল ক্ষীণকায় এবং দীর্ঘস্থায়ী হত না। তা না হলেও সেই সব ম্যাগাজিনে ছিল স্পর্ধা, অহংকার ও যৌবনের দীপ্তি। নতুন চিন্তা ভাবনার নিয়মিত প্রকাশ হত সেখানে। এক কথায় সেখানে থাকত একটা বেপরোয়া ভাব। কিন্তু এখনকার লিটিল ম্যাগাজিন ক্রমশই যেন রক্ষণশীল হয়ে উঠছে। গল্প উপন্যাস বা কবিতায় বিদ্রোহী মনের পরিচয় সেভাবে থাকছে না। সবাই যেন এখন একটা স্থিতাবস্থা চাইছে, অথচ এখন লিটিল ম্যাগাজিনগুলো বেশ স্থূলকায়। দেখে মনে হয় এদের আর্থিক অবস্থা বেশ ভালো, কিন্তু সর্বত্র চিন্তার দৈন্যতা কেন? কেন গতানুগতিক? অবশ্যই ব্যতিক্রম আছে, কিন্তু তাদের সংখ্যা নগন্য।

পারক : এই প্রজন্মের গল্পকারদের গল্প কি আপনি পড়েন? পড়লে কেমন লাগে?

 পড়ি। এই প্রজন্মের গল্পকারদের গল্প নিয়মিত পড়ি। ভাল লাগলে  লেখককে জানাতে ভুলি না। 

পারক : এই প্রজন্মের গল্পকারদের বিশেষ কিছু কি বলবার আছে?

 না, বিশেষ কিছু বলার নেই। আমি চাই সবাই নিজের নিজের মত করে লিখুন। বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করুন। শুধু একটাই অনুরোধ, গতানুগতিক লেখা লিখবেন না। 

পারক : সাহিত্যিকের সামাজিক দায়বদ্ধতা থাকবে কি? 

মানুষ মাত্রই দায়বদ্ধ হয়ে বেঁচে আছে। সে দেশের কাছে দায়বদ্ধ, পরিবারের কাছে দায়বদ্ধ, পাড়ার কাছে দায়বদ্ধ, রাজনৈতিক দলের কাছে দায়বদ্ধ, বন্ধুদের কাছে দায়বদ্ধ, সমাজের কাছে দায়বদ্ধ। তার দায়বদ্ধতা শেষ নেই। এত দায়বদ্ধতার কারণে সে হাঁপিয়ে ওঠে মাঝে মাঝে। তাই সে এইসব দায়বদ্ধতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। লেখক কোন অসাধারণ মানুষ নয়। সেও একজন সাধারন মানুষ। তার আছে এইসব দায়বদ্ধতা। এছাড়াও তার আছে সম্পাদকের কাছে দায়বদ্ধতা। এত দায়বদ্ধতা নিয়ে তাকে বেঁচে থাকতে হয়। এ খুব কষ্টের, খুব যন্ত্রণার। তবে সবার উপরে শিল্পের কাছে তার দায় বদ্ধতা। নিজের সময় ও সমাজের কথা লিখলেও যদি তা শিল্প না হয়ে ওঠে তাহলে তার কোন মূল্য নেই। লেখক অবশ্যই তার সময় ও সমাজের কথা বলবে, তবে তা যেন প্রচারধর্মী না হয়, বক্তব্যধর্মী না হয়। সময় ও সমাজ হচ্ছে মাটির মতো, যার বুকে শিকড় চালিয়ে যেমন ফুল গাছের জন্ম হয়, তেমনি জন্ম হয় শিল্প-সাহিত্যের এখানে দায়বদ্ধতার কোন ব্যাপার নেই।

পারক : জাদুবাস্তবতার সফল প্রয়োগ আপনার সাহিত্যে নজর কাড়ে। এখন আর কোন কোন কথাকার জাদুবাস্তবতার গল্প লেখেন? আপনি কি মনে করেন গল্পে জাদুবাস্তবতা বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে?

 ল্যাটিন আমেরিকার লেখকদের মতো সেই অর্থে আমার গল্পে জাদুবাস্তবতা নেই। যা আছে আমার গল্পে তা হল অ্যাবসার্ডিটি। মঙ্গল কাব্যের কথা না হয় বাদই দিলাম, কিন্তু সুকুমার রায়, ত্রৈলোক্যনাথে অ্যাবসার্ডিটি কি নেই? আমি ছোটবেলায় সুকুমার রায়ের লেখা পড়ে উদ্বুদ্ধ হয়েছি। এছাড়া বঙ্কিমচন্দ্রের 'মুচিরাম গুড়ের জীবনচরিত', একে তুমি কি বলবে! সুতরাং বাংলা সাহিত্যে এটা ছিল এবং আছে। এই সময় অনেকে অ্যাবসার্ড গল্প লিখেন কেন? তোমার অনেক গল্পেও (প্রগতি মাইতি) আমি অ্যাবসার্ডিটি খ্ব্বুঁজে পেয়েছি। সায়ন্তনী ভট্টাচার্য্য এ নিয়ে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন। আরো অনেকে লিখছেন অর্থাৎ আগের মত এই প্রজন্মে অনেকেই তাদের গল্পে অ্যাবসার্ডিটি আনছে। অ্যাবসার্ডিটি যদি বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ না করতে পারে তাহলে সুকুমার রায়ের লেখাগুলো ব্যর্থ বলা যাবে কি!

পারক : আগামীতে বাংলা সাহিত্যে কোনো বাঁক বদল হতে পারে বলে আপনার মনে হয়? 

এটা খুব কঠিন প্রশ্ন। কখন কোন প্রতিভার উন্মেষ হবে তা বলা মুশকিল। তবে সাহিত্য তো স্থবির কিছু নয়, তা গতিশীল। বাংলা সাহিত্যে নানা সময়ে নানা পরিবর্তন হয়েছে এবং কিছু বাঁক বদল হয়েছে। ভবিষ্যতেও যে হবে না তা বলা যায় না, বরং তা হতেই পারে। যদিও এই মুহূর্তে বাংলা সাহিত্য কেমন যেন গর্তের মধ্যে পড়ে পাক খাচ্ছে। এখান থেকে সাহিত্যকে তুলে আনতে হবে, গতিশীল করতে হবে।

পারক : শিক্ষা ব্যবস্থায় চরম নৈরাজ্য। বেকারি বেড়েই চলেছে। জিনিসপত্রের দাম লাগামছাড়া। মধ্যবিত্ত ও গরীব মানুষ দিশাহারা অথচ তেমন কোনো প্রতিবাদ আন্দোলন নেই। একজন প্রবীণ কথাকার হিসেবে বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে আপনার সংক্ষিপ্ত প্রতিক্রিয়া জানাবেন।

 শিক্ষা ব্যবস্থায় চরম নৈরাজ্য দেখা যাচ্ছে। ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের চরম অবনতি ঘটেছে। এ অত্যন্ত উদ্বেগজনক পরিস্থিতি। শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মর্যাদা হারিয়ে ফেলছে। এরকম চলতে থাকলে একদিন শিক্ষা ব্যবস্থাটাই ভেঙে পড়বে। শিক্ষার সাথে সাথে স্বাস্থ্য! সেখানেও আমরা পিছিয়ে পড়ছি। কলকারখানা তেমন করে হচ্ছে না, ফলে বেকারি তো বাড়বেই। শিল্পে ব্যাপক কর্মসংস্থান করতে হবে, আর এখানেই চূড়ান্ত সংকট। ব্যাপক কর্মসংস্থানের কথা কেউই ভাবছেন না। সবদিক থেকে একটা অদ্ভুত সংকট এসে উপস্থিত অথচ বিরোধী শক্তির তেমন কোনো আন্দোলন চোখে পড়ছে না। শক্তিশালী বিরোধী দল না থাকাটাও একটা সমস্যা বলে মনে করি। লেখক কবিদেরও সাহসী হতে হবে, কলম ধরতে হবে। কাপুরুষরা কখনো ভালো লেখক হতে পারে না।




গল্প : দূর্বা মিত্র



দুঃসহ দুবাই

লেক ক্লাবের সুইমিং পুলে ৫০ থেকে ১০০ বার এপার ওপার করলে সন্ধ্যেটা ভালো কাটে সৌমাভ সান্যালের | ওপার থেকেই দেখতে পেলো মোবাইল ফোনের আলো জ্বলছে নিভছে রং লাল আর সাদা ।তার মানে কমিশনার  স্যারের মোবাইল থেকে ফোন | হাত বাড়িয়ে চেয়ার থেকে তোয়ালে জড়িয়ে ফোনটা কানে ধরে সৌমাভ -
-"বলুন স্যার |"
-"এয়ারপোর্ট পৌঁছতে কতক্ষন লাগবে ?"
-"৪০ মিনিটস স্যার |"
-"ব্যাগ এ পাসপোর্ট আছে ?"
-"হ্যাঁ স্যার |"
-"ভালো কথা | এয়ারপোর্ট চেক ইন কাউন্টার এ তোমার টিকেট আর কেস ফাইল রাখা আছে |
দূতাবাসের একজন অফিসার থাকবেন - ভিসা স্ট্যাম্প মেরে দেবেন | ওহ ইন্টারন্যাশনাল ড্রাইভিং লাইসেন্স সাথে রেখো | আমাদের যে অফিসার থাকবে - তাকে নিজের জীপ্ এর চাবি দিয়ে দিও - তোমার বাড়িতে পৌঁছে দেবে |
THE CASE IS CODE RED, HANDLE IT PROPERLY |"
ফোন লাইন কেটে যায় |
অবান্তর প্রশ্ন করা সৌমাভর স্বভাব নয় - কমিশনার এর সময় নেই |
পুল থেকে জীপ্ এ পৌঁছতে ওর সময় লাগলো ৭ মিনিটস - তাহলে হাতে রইলো ৩৩ মিনিটস | হুটার চালু না করলেও হবে ।শুধু যেন বাইপাস এ জ্যাম  না থাকে | যাদবপুর থানা পৌঁছোবার আগেই একটি পাইলট বাইক স্যালুট করে ফলো করতে হাত দেখালো | নিশ্চিন্তি | কমিশনার স্যার এর কোনো কাজে সুঁচ গলার ফাঁক থাকে না | ৩০ মিনিটে এয়ারপোর্ট |
সব ফর্মালিটিজ মিটিয়ে টিকেট এ চোখ পড়লো - দুবাই - ফ্লাইট এর সিকিউরিটি চেক ইন শুরু হয়ে গ্যাছে | সৌমাভর একটাই ব্যাগ - হাই প্রায়োরিটি সিকিউরিটি ক্লেয়ারেন্স নিয়ে প্লেন এ উঠে বসলো | উইন্ডো সিট | ৫ ঘন্টা |
এবার ফাইলটা খোলা যাক | একটা কালচে রুমাল ফাইল এর খোলা পাতার ওপর ফেলে লাইন বাই লাইন পড়তে শুরু করে |
অনাবাসী মহিলা যাত্রী | সঙ্গে ১৭ বছরের কন্যা | গন্তব্য ছিল কলকাতা | দুবাই এয়ারপোর্ট এ  স্টপ ওভার ছিল কয়েক ঘন্টার | বোর্ডিং শুরু হবার পর মেয়ে অস্থির হয়ে ছুটে যায় কাউন্টার এ - মা কে ডাকাডাকি করা সত্ত্বেওউঠছে না -  ঘুমাচ্ছে |
একজন মহিলা কর্মচারী ছুটে যান | গায়ে হাত দিয়ে ডাকতেই সোফা  থেকে গড়িয়ে পড়েন | ইমার্জেন্সি রেসকিউ টীম ডাকা হয় - তারা ডেড - অন -আরাইভাল রায় দিয়ে যায় |
কেস টা ৩ দেশে ছড়ানো হওয়াতে দুবাই পুলিশ লালবাজার এর সাহায্য চায় | ফলশ্রুতি - সৌমাভ দুবাই পৌছায় |
একজন লোকাল অফিসার ওকে নিয়ে সোজা পুলিশ মর্গে  যায়  | পোস্টমর্টেম রিপোর্ট বলছে
ম্যাসিভ কার্ডিয়াক এটাক |
বডি দেখলো সৌমাভ | মধ্যবয়সি মহিলা শরীর | সুগঠিত | মাঝারি সুন্দরী | উচ্চতা ৫'৩" / ওজন ৬২ কেজি.| কালো চুল ও চোখ | এ ছাড়া আর কিছু দেখার নেই | কোনো চোট / আঘাত নেই |
একজন লেডি অফিসার মহিলার মেয়েটিকে নিয়ে বাইরে বসে ছিল | সৌমাভর হাতে একটা
ফাইল দিলো | এটা এসকর্ট হ্যান্ডওভার ফাইল | সৌমাভ মহিলার মৃতদেহ ও বাচ্চা মেয়েটিকে
নিজের দায়িত্বে দুবাই থেকে কলকাতায় নিয়ে আসবে |
সই করে ফেরত দিয়ে মেয়েটির দিকে তাকায় - "খিদে পেয়েছে ?"
মেয়েটি ঘাড় নাড়ে - "No, thank you  ... I am just thirsty. Oh by the way - I can understand Bangla but can't speak fluently."
সৌমাভ একটা সোডা মেয়েটার হাতে ধরায় -" Can you show me the place inside the airport lounge - where you and mom had been sitting?"
মেয়েটি ঘাড় নাড়ে | লেডি অফিসার হাত নেড়ে গাড়ি ডাকেন | তিনজনে ২০ মিনিটে এয়ারপোর্ট এ পৌঁছন | অফিসারটি নিজের আই.ডি. দেখিয়ে ওদের নিয়ে ঢোকেন |
জায়গা টা একটু কোণের দিকে | হলুদ ক্রাইম সিন্ টেপ দিয়ে ঘেরা |
মেয়েটি ফুঁপিয়ে ওঠে - "We were sitting together on that sofa - mom said waiting for transit would take 5 hours. She was feeling a bit tired - wanted to take some rest - closed her eyes. i got up and started to walk around."
- "How long you had been out of her sight?"
-"I haven't checked closely - perhaps a couple of hours - or a bit more."
কথা বলতে বলতে সৌমাভ নজর ফেলছিলো  ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরার দিকে | ডানদিকের
ক্যামেরা ঘুরে চলেছে , বাঁ দিকেরটা স্থির | সৌমাভ ইশারা করে লেডি অফিসারটির দিকে | তিনি টেবিল এ ল্যাপটপ রেখে সেলফোন এ কাউকে কিছু নির্দেশ দেন | একটু বাদেই পর্দায় পরপর দুটো ক্যামেরার ছবি ফুটে ওঠে |
মা কে সোফায় শুয়ে থাকতে দেখা যায় | মেয়েটি হেঁটে বেড়িয়ে যাচ্ছে | কোনো নতুন চেহারা নেই | সৌমাভ বলে একটু ফাস্ট ফরওয়ার্ড করতে ।ঘুমের মধ্যেই কার্ডিয়াক আরেস্ট  হয়ে থাকলে দেখার কিছু নেই |
দেড় ঘন্টার মাথায় ফ্রেম এ কিছু পরিবর্তন দেখা যায় |
হিজাব  পরা একটি স্থানীয় মেয়ের আগমন ঘটে | হাতে একটা ট্রে তে দুটি পেপার  কাপ এ কফি - এক্সট্রা লার্জ |  অন্য হাতে ফোন | সৌমাভ জুম করতে বলে - পাশ থেকে বাচ্চা মেয়েটি আঁতকে ওঠে - "MOM !!"
ঠিক | হিজাব পরা মেয়েটির হাতের ফোন এ মৃত মহিলাটির ছবি ।আইফেল টাওয়ার এর সামনে তোলা |
মেয়েটি খুব ভালো করে মিলিয়ে নিতে থাকে ছবি ও বাস্তবের মুখ |
নিশ্চিন্ত হয়ে কাউকে ফোন করে | ইতিবাচক ঘাড় নেড়ে ফোন পকেটে ঢোকায় | পাশের সোফায় বসে ।হাতে ধরা গরম কফি ছলকে পড়ে ঘুমন্ত মহিলাটির গায়ে | তিনি চমকে চেঁচিয়ে উঠে
বসেন | স্থানীয় মেয়েটি বারবার ক্ষমা চাইতে থাকে - এমন কি হাঁটু গেড়ে বসে ও পড়ে |
কথা তো কিছু শোনা যাচ্ছে না | নিজের হিজাব খুলে মুছে নিতে থাকে মহিলার গায়ে পরা কফি | মহিলা ধীরে ধীরে শান্ত হন | মেয়েটি একটা কাপ বাড়িয়ে ধরে করুণ মুখ করে - মহিলাটি একটু হেসে কাপটা নিয়ে মেয়েটিকে বসতে বলেন |
দুজনে কথা বলতে বলতে কফি খেতে থাকে |
একটু পরে স্থানীয় মেয়েটি কারো ফোন ধরে ।মহিলা কে একটা আঙ্গুল দেখিয়ে ক্যামেরা
ফ্রেম -এর বাইরে চলে যায় | মহিলা কফি শেষ করে নিজের ফোন বার করেন | কারো সাথে দু একটা কথা বলে ফোন ব্যাগ এ রাখেন |

ধীরে ধীরে ওনার মাথা একপাশে ঝুলে পড়তে থাকে - সোফায় কাত হয়ে শুয়ে পড়েন |
ফ্রেম  এ একটি অল্পবয়েসী আফ্রিকান ছেলে আসে | সে ও ফোন এ মহিলার ফটো মিলিয়ে নিয়ে ফোন পকেট এ রাখে | তারপর ধীরে সুস্থে কফির কাপ ও ট্রে তুলে বাইরে বেড়িয়ে যায় |
এরপর একেবারে মহিলাটির নিজের মেয়ের প্রবেশ । মা কে ডাকতে থাকে । দৌড়ে বেড়িয়ে যায় - কিছু অফিসিয়াল লোকদের নিয়ে ঢোকে |
সৌমাভ ল্যাপটপ পজ করে | পাশে বাচ্চা মেয়েটি রীতিমতো কাঁদছে | তাকে বাঁ হাতে শক্ত করে ধরে থাকে | লেডি অফিসারটির সাথে কথা বলতে থাকে ।ওই স্থানীয় মেয়েটি আর আফ্রিকান ছেলেটিকে খুঁজে বার করারব্যাপারে | কষ্টসাধ্য ও সময়সাপেক্ষ কাজ | তবে অসম্ভব নয় - দরকারে ইন্টারপোল এর সাহায্য নেয়া যেতে পারে |
বাচ্চা মেয়েটির কান্নার মধ্যে বলা কিছু কথা কানে যেতে ওকে ঘুরে আরেকটা সোফায় বসায় |
টুকরো কথা জোড়া দিয়ে দিয়ে ইতিহাস তৈরী হয় |
ওর মায়ের কোনোদিন বিয়েই হয়নি | বাবা কি জিনিষ ও দেখেনি | ছোট থেকেই বিদেশে মায়ের সাথে থেকেছে    ।কলকাতায় দাদু, দিদা আর এক মামা ছিল | এখন শুধু মামা | প্যারিস এ একজন বাঙালির সাথে মায়ের আলাপ হয় ।তিনি ওদের সাথে বাড়িতে গিয়েও থাকেন | বেশ কয়েকবার গেছেন | মা খুব আনন্দ পেতেন ।প্রচুর জিনিষ কিনে দিতেন | এবার ও এক সুটকেস ভর্তি জিনিষ নিয়েছেন |
ওকে জিজ্ঞেস   করেছেন ওই লোকটিকে বাবা বলে যদি ও মানে ।তবে কলকাতায় গিয়েই বিয়ে করবেন |মেয়েটির কোনো আপত্তি ছিল না ।সে তো প্যারিস এ গিয়ে আর্ট নিয়ে পড়বে ঠিক
করেছে |
সৌমাভ ওকে লোকটির নাম ও নাম্বার জিজ্ঞেস করে | মেয়েটি নিজের ফোন খুলে দেখায় | অতি সাধারণ দেখতে একটি মধ্য বয়েসী লোক |
একটু ভেবে নিয়ে ডাটা ট্রান্সফার করে লালবাজারে  ওর একজন জুনিয়র অফিসার এর ফোন এ | কমিশনার কে জিজ্ঞেস করে যে কফিন আর বাচ্চা মেয়েটাকে নিয়ে রিটার্ন ফ্লাইট ধরবে কি না |
কেসটা প্রবাবেল হোমিসাইড শুনে আর সাস্পেক্ট কলকাতার বাসিন্দা জেনে কমিশনার সৌমাভকে ফিরে আসতে বলেন | দুবাই পুলিশ নিজের কাজ করুক |
সৌমাভ ফ্লাইট এ মেয়েটির কাছ থেকে আরো কিছু খবর পায় | কলকাতায় নেমে মেয়েটি কে মামার হাতে তুলে দিয়ে অনুমতি চায় মহিলার দেহ ও জিনিসপত্র । বিশেষ করে ফোন গুলি ফরেনসিক আর সাইবার পরীক্ষা করানোর জন্যে লালবাজার এ নিয়ে যাবার |
মামা মানুষটি গোবেচারা | ঘাড় নেড়ে কাগজ পত্র সই করে দেন | লালবাজারের একজন
অফিসার  মামা ও মেয়েটিকে নিয়ে তাদের বাড়ির দিকে যায় ।সৌমাভ তার দলকে কফিন আর জিনিসপত্র ভ্যান এ তুলতে বলে | নিজের জিপসি গাড়ির চাবি নিয়ে  এগোয় অফিস এর দিকে |
এক সপ্তাহ লাগলো সব কাজ শেষ করতে | ফাইল নিয়ে সৌমাভ কমিশনার এর কাছে যায় |
কমিশনার সব যুক্তি শোনেন | কিছু প্রশ্ন করেন | সেক্রেটারি কে ডেকে নির্দেশ দেন গ্রেফতারি
পরোয়ানা তৈরী করতে |
পরের দিন সকাল ৬ টায়ে একটা ভ্যান সঙ্গে নিয়ে সৌমাভ সেই লোকটাকে ঘুম থেকে তুলে নিয়ে আসে লালবাজারে |
সে ভাবতেই পারেনি তার ফোনরেকর্ডস , ব্যাঙ্ক ডিটেলস , ২০ বছর আগেকার বিয়ের সার্টিফিকেট ,  মহিলার ফোন আর ফেসবুক রেকর্ডস ,  সব মজুদ থাকবে সৌমাভর টেবিলে | বাঁ দিকে একটা বড় কাঁচের জার এ কোনো শরীরের
ভেতরের অংশ তরলে ভাসছে |
ঘরে ঢুকেই সেটার দিকে আঙ্গুল তোলে সৌমাভ - " এটা ওই মহিলার পাকস্থলী | ভিসেরা টেস্ট রিপোর্ট বলছে হজম না হওয়া স্যান্ডউইচ / কফি - সঙ্গে অতিরিক্ত সুগার ও  প্রেসার কমাবার ওষুধ আর ঘুমের ওষুধ | কেনা হয়েছে আপনার মায়ের নামে প্রেসক্রিপশন এ | ও হ্যাঁ ,এটা দুবাই পুলিশ এর ফ্যাক্স । ওই দুজন মেয়ে আর ছেলে ও ধরা পড়েছে - ফোন ও ব্যাঙ্ক ডিটেলস সহ |"
লোকটা হড়হড় করে বমি করে ফেললো - পাশ থেকে ধরে না রাখলে পড়েই যেত |
কমিশনার নিজের ঘরে বসে হেসেই ফেললেন সিসিটিভি দেখে | জার এ পাকস্থলী রাখার আইডিয়া টা দুর্দান্ত | লোকটা হুড়মুড় করে কনফেস করতে লাগলো |
অবিবাহিত ও সন্তানের জননী কে ঘরণী করার কোনো বাসনাই তার কোনোদিন ছিল না |
কলকাতায় তার ইলেকট্রনিক্স এর দোকান, জমিবাড়ির দালালি, বাড়ি, গাড়ি, বৌ, বাচ্চা সবই আছে | বাইরে যেত । ওই মহিলাটির সাথে আলাপ হওয়ার পর থাকা খাওয়ার খরচ বেঁচে যায় | উপরন্তু প্রচুর উপহার পেতো - যা দেশে  বেশি দামে বেচে দিতো | বিয়ে করবো ভাবটা জারি রাখতো - যাতে একটু একটু করে মহিলাটির টাকা পয়সা ও সম্পত্তি হস্তগত করতে পারে |
এইবার যে মহিলা  ১০বছর পর কলকাতা ফিরে বিয়ে করবেই প্রতিজ্ঞা করে বসবেন - সেটা ওর হিসেবের বাইরে ছিল |
শহরে পৌঁছে গেলে গায়েব করা শক্ত হতো | দুবাই এর লোক কে সুপারি দিয়েছিলো কফি দিতে আর কাপ সরিয়ে ফেলতে ।সরাসরি খুন করাও হলো না | ওষুধ গুলি পেট এ গিয়ে প্রথমে ঘুম এসে গিয়েছিলো ।তারপর হার্ট এট্যাক |
একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ায় সৌমাভ | ফাইল আর পেন ধরায় সই করার  জন্যে | ফোন তুলে নির্দেশ পাঠায় লক আপ  এ  ভরার  আর চার্জশীট তৈরী করার উদ্দেশ্যে |


গল্প : গৌতম দে




পরী

আমার নাম ধীমান চ্যাটার্জি। লিপি দুলের প্রেমিক।
আমি লিপি দুলে। ধীমান চ্যাটার্জির প্রেমিকা।
অনেকটা বাঁধা আর শক্তি যেন দুটো ডাম্বেল হয়ে প্রতিনিয়ত আঘাত করছে আমাদের। আজ দুহাজার আঠেরোর পনেরো আগস্ট। একটা সিদ্ধান্তে এসেছি। আমরা দুজনে। এই সিদ্ধান্তটা আমাদের একেবারে নিজস্ব। দুজনের সম্মতিক্রমে...।



এসো, কাছে এসো। একদম ঘন হয়ে কাছে বসো। আমার এই কথায় লিপি খুব খুশি হয়। সে অনেকটা আবেগ নিয়ে আমার খুব কাছে সরে আসে। একেবারে কোলের কাছে। আমাকে ভীষণ বিশ্বাস করে লিপি। ভালোবাসে। খুব খুব ভালোবাসে।

লিপির সঙ্গে প্রেম করছি বছর পাঁচেক। এখনও চালিয়ে যাচ্ছি। আমাদের যেন কথার শেষ নেই। কোনও বিরাম নেই। এ পাড়ার প্রতিটা মানুষ, প্রতিটা গাছ, প্রতিটা পাখি জানে আমাদের প্রেমকাহিনী। কিন্তু আমাদের বাড়ির মানুষজন আমাদের প্রেম মেনে নিতে পারেনি। মেনে নিতে পারেনি বলে পাড়ার অনেকেই 'লায়লা-মজনু' নামে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করে। তাতে আমাদের কিসসু যায় আসে না। 

আমি যেমন লিপিকে ভাবোবাসি সেও আমাকে ভীষণ ভালোবাসে। 'আমাকে ছাড়া সে একদন্ড কাউকে ভাবতে পারে না।'  সে বুক চিতিয়ে বলেও এই কথা।

আমি মাঝেমধ্যে ওর এই কথায় হেসে উঠি। বলে কি অষ্টাদশী মেয়েটি!

আমি যত  হাসি ও তত রেগে যায়। ভীষণ রেগে যায়। তারপর চিৎকার করে বলে, আমি, কি এমন হাসির কথা বললাম। বলো? 
আমি এর কোনও উত্তর দিই না। কেবল হাসতেই থাকি। হো হো হি হি। হাসতে হাসতে আমার শরীরটা ছড়িয়ে পড়ে চাদ্দিকে। মাথাটা ফুটবলের মতো গড়াতে গড়াতে চলে যায় রেল লাইন বরাবর। দুটো হাত টপাটপ এ গাছের কিংবা ও গাছের ডাল ধরে ঝুলতে থাকে। দুপায়ে ভয়ংকর গতি নিয়ে একছুটে চলে যাই অজানা জায়গায়। অনেকটা স্বপ্নের জগতে। সেখানে লিপিকে পরীর মতো দেখতে পাই। সাদা পোশাকের সুন্দর পরিপাটি সাজ। পরীর পিঠে সুন্দর দুটো ডানা। সেই সুন্দর ডানা নিয়ে উড়ে বেড়াচ্ছে এখানে সেখানে। গাছে গাছে রং বেরঙের ফুল ফল। কত নাম না জানা নানা রঙের পাখি। পরীকে চেনে। তার সঙ্গে খেলা করে। আকাশের রং ঘন নীলে ডোবা। গর্বিত মেঘগুলো নিজেদের শরীর ভাঙতে ভাঙতে দিকশূন্যপুরে এগিয়ে যাচ্ছে। লিপিও সেই মেঘেদের সঙ্গে খেলতে খেলতে আমার দৃষ্টির বাইরে হারিয়ে যাচ্ছে। সেই হারিয়ে যাওয়াতে যেন ক্লান্তি নেই। কেবল আনন্দ আর আনন্দ। 
আমি আঁতকে উঠি। আমি 'লিপি লিপি' করে চেঁচিয়ে ডাকি। এটা ঠিক, লিপি দু'হাত বাড়িয়ে সাড়া দেয়। সেও ডাকে। বলে, এসো আমাকে ধরো তো দেখি। লিপি খিলখিল করে হাসতে হাসতে অনায়াসে এই কথাগুলো বলে। আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যাই। লিপির পিছন পিছন বেপরোয়া ভাবে  ছুটতে থাকি। লিপি নামক পরীর নাগাল পাই না তবুও। 
আবার ফিরেও আসি। এইসব লিপি বুঝতে পারে না। কেবল আমার শরীরটা ওর কোলের কাছে প্রাণহীন একখন্ড পাথরের মতো পড়ে থাকে।

আসলে ওর রাগটা আমার ভীষণ ভালো লাগে। রাগলে পরে ওর ঠোঁটজোড়া থরথর করে কাঁপে। তখন আমার মনে হয়, ওর পাকা করমচার মতো ঠোঁটজোড়া এখুনি বুঝি মুখ থেকে খসে পড়বে মাটিতে! এই ঠোঁট দিয়ে সে অনেকবার আমাকে চুমু খেয়েছে। আদর করেছে। ওর ঠোটজোড়ায় অনেক রস আছে। মিষ্টি রস। ঠিক মিষ্টি রস নয়। অনেকটা ঝাঁঝাল। নেশা ধরিয়ে দেওয়ার মতো। আমিও মাঝে মধ্যে ওর ঠোঁটে  ঠোঁট ডুবিয়ে ওর জিবের অনেকটা নাগাল পেয়ে যেতাম। তাতে ও খুব খুশি হত।

তো সেই পাকা করমচার মতো ঠোটজোড়া যদি  খসে পড়ে তখন এই লিপিকে দেখতে কেমন লাগবে? লিপির ঝকঝকে দাঁতের পাটিজোড়া ভয়ানক ভাবে বেরিয়ে আসবে। এই অনিন্দ সুন্দর মুখটা দেখতে খারাপ লাগবে তখন। তার চেয়ে বরং  দু'হাতের তালু নৌকোর কোল করে ওর ঠোঁটের তলায় মেলে ধরি আমি। যদি পড়ে যায়, আমার হাতেই পড়বে। এখনও কাঁপছে। ভয়ানক ভাবে কাঁপছে লিপির ঠোঁটজোড়া।

আমার হাসিটা আসতে আসতে পেটের ভিতর ঢুকে যায়। ঢুকতে ঢুকতে শরীরের অনেক নীচে নেমে যায়। তারপর  মাথাটা ওর ঘাড়ের কাছে নিয়ে যাই। ও দুহাতে জড়িয়ে ধরে আমায়। আমার ঠোঁটজোড়া ওর ঘাড় স্পর্শ করে। আমার দুই ঠোঁট ওকে খুব আদর করে। আদর করতে করতে ডান কানের লতিতে কামড় বসায়। আমি বুঝতে পারি, ওর ঠোঁটের সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত শরীর কাঁপছে। এবার আমি যা ইচ্ছা তাই করতে পারি। 

লিপি আমার হাতে তুলে দেয় ওর যত্নে রাখা স্তনজোড়া। আমি যেন জাগলারির মাস্টার হয়ে উঠি মুহূর্তে। দু'হাতে ওর দুই স্তন নিয়ে খেলতে থাকি। স্পষ্ট দেখতে পাই প্রতি মুহূর্তে ওর দুই স্তন জায়গা পরিবর্তন করছে আশ্চর্যজনক ভাবে। 

আগেও বলেছি। আবার বলছি, লিপি আমাকে বিশ্বাস করে। ভালোবাসে।

ভালোবাসতে বাসতে আমরা দুজন মাখনের মতো গলতে থাকি। গলতে  গলতে একেবারে গাছের শিকড়ে গিয়ে পৌঁছে যাই।

এই বৃদ্ধ বটগাছটা সব জানে। ওর কোলেই আমাদের বহু বছরের আশ্রয়। সব জানে আমাদের কথা। বড় বড় শিকড়ের ফাঁকে অনায়াসে ঢুকে যায় আমাদের শরীর। আমরা ক্ষণিকের শীতল আশ্রয় পেয়ে আপ্লুত হয়ে উঠি। তখন এই নির্জন জায়গাটা মনে হয়, আরও নির্জন। আশপাশে আমাদের মতো একটিও প্রাণী  নেই। আমাদের কান্ড কারখানা একমাত্র এই প্রবীণ বটগাছ জানে। আমাদের ছেলেমানুষী দেখে পাতায় পাতায় হাততালির শব্দ বেজে ওঠে। আমরা স্পষ্ট শুনতে পাই।
আমাদের গলতে থাকা শরীরের ভিতর থেকে একটা পাখি তীব্র চিৎকারে ডাকে। শেষবারের মতো এই ডাক বোধহয়। সেই ডাক আমাদের দুজনার শরীরে দুলতে থাকে। ঘন ঘন। পরস্পরের নিঃশ্বাসে ধূপের সুগন্ধি ভাসে। ভাসতে থাকে।  আমাদের শরীর গলতে গলতে গড়াতে গড়াতে রেল লাইনের বরাবর চলে যায়। আর কয়েক মিনিটের মধ্যে একটা এক্সপ্রেস ট্রেন যমদূতের মতো ছুটে আসবে। 

শেষবারের মতো আমরা দুজনায় দুজনকে দেখতে থাকি। দেখি লিপি সত্যি সত্যি একটু একটু করে পরী হয়ে যাচ্ছে। অথচ নীলে ডোবা চেনা আকাশটা আজ উধাও। সাদা মেঘের পরতে পরতে কি ভীষণ রক্তের দাগ। হঠাৎ তীব্র গতিতে ভয়ংকর হুইসেল বাজাতে বাজাতে ঝড়ের মতো ট্রেনটা ছুটে আসে আমাদের মধ্যে। দিশাহীন আমি লিপিকে দেখতে পাই না। লিপিও আমাকে দেখতে পায় না।

ট্রেনটা চলে যাওয়ার পর আমরা দুজন দুজনকে নতুনভাবে দেখি। তারপর বাঁচার আনন্দে পাগলের মতো হেসে উঠি।