Wednesday, January 2

গল্প : দূর্বা মিত্র



দুঃসহ দুবাই

লেক ক্লাবের সুইমিং পুলে ৫০ থেকে ১০০ বার এপার ওপার করলে সন্ধ্যেটা ভালো কাটে সৌমাভ সান্যালের | ওপার থেকেই দেখতে পেলো মোবাইল ফোনের আলো জ্বলছে নিভছে রং লাল আর সাদা ।তার মানে কমিশনার  স্যারের মোবাইল থেকে ফোন | হাত বাড়িয়ে চেয়ার থেকে তোয়ালে জড়িয়ে ফোনটা কানে ধরে সৌমাভ -
-"বলুন স্যার |"
-"এয়ারপোর্ট পৌঁছতে কতক্ষন লাগবে ?"
-"৪০ মিনিটস স্যার |"
-"ব্যাগ এ পাসপোর্ট আছে ?"
-"হ্যাঁ স্যার |"
-"ভালো কথা | এয়ারপোর্ট চেক ইন কাউন্টার এ তোমার টিকেট আর কেস ফাইল রাখা আছে |
দূতাবাসের একজন অফিসার থাকবেন - ভিসা স্ট্যাম্প মেরে দেবেন | ওহ ইন্টারন্যাশনাল ড্রাইভিং লাইসেন্স সাথে রেখো | আমাদের যে অফিসার থাকবে - তাকে নিজের জীপ্ এর চাবি দিয়ে দিও - তোমার বাড়িতে পৌঁছে দেবে |
THE CASE IS CODE RED, HANDLE IT PROPERLY |"
ফোন লাইন কেটে যায় |
অবান্তর প্রশ্ন করা সৌমাভর স্বভাব নয় - কমিশনার এর সময় নেই |
পুল থেকে জীপ্ এ পৌঁছতে ওর সময় লাগলো ৭ মিনিটস - তাহলে হাতে রইলো ৩৩ মিনিটস | হুটার চালু না করলেও হবে ।শুধু যেন বাইপাস এ জ্যাম  না থাকে | যাদবপুর থানা পৌঁছোবার আগেই একটি পাইলট বাইক স্যালুট করে ফলো করতে হাত দেখালো | নিশ্চিন্তি | কমিশনার স্যার এর কোনো কাজে সুঁচ গলার ফাঁক থাকে না | ৩০ মিনিটে এয়ারপোর্ট |
সব ফর্মালিটিজ মিটিয়ে টিকেট এ চোখ পড়লো - দুবাই - ফ্লাইট এর সিকিউরিটি চেক ইন শুরু হয়ে গ্যাছে | সৌমাভর একটাই ব্যাগ - হাই প্রায়োরিটি সিকিউরিটি ক্লেয়ারেন্স নিয়ে প্লেন এ উঠে বসলো | উইন্ডো সিট | ৫ ঘন্টা |
এবার ফাইলটা খোলা যাক | একটা কালচে রুমাল ফাইল এর খোলা পাতার ওপর ফেলে লাইন বাই লাইন পড়তে শুরু করে |
অনাবাসী মহিলা যাত্রী | সঙ্গে ১৭ বছরের কন্যা | গন্তব্য ছিল কলকাতা | দুবাই এয়ারপোর্ট এ  স্টপ ওভার ছিল কয়েক ঘন্টার | বোর্ডিং শুরু হবার পর মেয়ে অস্থির হয়ে ছুটে যায় কাউন্টার এ - মা কে ডাকাডাকি করা সত্ত্বেওউঠছে না -  ঘুমাচ্ছে |
একজন মহিলা কর্মচারী ছুটে যান | গায়ে হাত দিয়ে ডাকতেই সোফা  থেকে গড়িয়ে পড়েন | ইমার্জেন্সি রেসকিউ টীম ডাকা হয় - তারা ডেড - অন -আরাইভাল রায় দিয়ে যায় |
কেস টা ৩ দেশে ছড়ানো হওয়াতে দুবাই পুলিশ লালবাজার এর সাহায্য চায় | ফলশ্রুতি - সৌমাভ দুবাই পৌছায় |
একজন লোকাল অফিসার ওকে নিয়ে সোজা পুলিশ মর্গে  যায়  | পোস্টমর্টেম রিপোর্ট বলছে
ম্যাসিভ কার্ডিয়াক এটাক |
বডি দেখলো সৌমাভ | মধ্যবয়সি মহিলা শরীর | সুগঠিত | মাঝারি সুন্দরী | উচ্চতা ৫'৩" / ওজন ৬২ কেজি.| কালো চুল ও চোখ | এ ছাড়া আর কিছু দেখার নেই | কোনো চোট / আঘাত নেই |
একজন লেডি অফিসার মহিলার মেয়েটিকে নিয়ে বাইরে বসে ছিল | সৌমাভর হাতে একটা
ফাইল দিলো | এটা এসকর্ট হ্যান্ডওভার ফাইল | সৌমাভ মহিলার মৃতদেহ ও বাচ্চা মেয়েটিকে
নিজের দায়িত্বে দুবাই থেকে কলকাতায় নিয়ে আসবে |
সই করে ফেরত দিয়ে মেয়েটির দিকে তাকায় - "খিদে পেয়েছে ?"
মেয়েটি ঘাড় নাড়ে - "No, thank you  ... I am just thirsty. Oh by the way - I can understand Bangla but can't speak fluently."
সৌমাভ একটা সোডা মেয়েটার হাতে ধরায় -" Can you show me the place inside the airport lounge - where you and mom had been sitting?"
মেয়েটি ঘাড় নাড়ে | লেডি অফিসার হাত নেড়ে গাড়ি ডাকেন | তিনজনে ২০ মিনিটে এয়ারপোর্ট এ পৌঁছন | অফিসারটি নিজের আই.ডি. দেখিয়ে ওদের নিয়ে ঢোকেন |
জায়গা টা একটু কোণের দিকে | হলুদ ক্রাইম সিন্ টেপ দিয়ে ঘেরা |
মেয়েটি ফুঁপিয়ে ওঠে - "We were sitting together on that sofa - mom said waiting for transit would take 5 hours. She was feeling a bit tired - wanted to take some rest - closed her eyes. i got up and started to walk around."
- "How long you had been out of her sight?"
-"I haven't checked closely - perhaps a couple of hours - or a bit more."
কথা বলতে বলতে সৌমাভ নজর ফেলছিলো  ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরার দিকে | ডানদিকের
ক্যামেরা ঘুরে চলেছে , বাঁ দিকেরটা স্থির | সৌমাভ ইশারা করে লেডি অফিসারটির দিকে | তিনি টেবিল এ ল্যাপটপ রেখে সেলফোন এ কাউকে কিছু নির্দেশ দেন | একটু বাদেই পর্দায় পরপর দুটো ক্যামেরার ছবি ফুটে ওঠে |
মা কে সোফায় শুয়ে থাকতে দেখা যায় | মেয়েটি হেঁটে বেড়িয়ে যাচ্ছে | কোনো নতুন চেহারা নেই | সৌমাভ বলে একটু ফাস্ট ফরওয়ার্ড করতে ।ঘুমের মধ্যেই কার্ডিয়াক আরেস্ট  হয়ে থাকলে দেখার কিছু নেই |
দেড় ঘন্টার মাথায় ফ্রেম এ কিছু পরিবর্তন দেখা যায় |
হিজাব  পরা একটি স্থানীয় মেয়ের আগমন ঘটে | হাতে একটা ট্রে তে দুটি পেপার  কাপ এ কফি - এক্সট্রা লার্জ |  অন্য হাতে ফোন | সৌমাভ জুম করতে বলে - পাশ থেকে বাচ্চা মেয়েটি আঁতকে ওঠে - "MOM !!"
ঠিক | হিজাব পরা মেয়েটির হাতের ফোন এ মৃত মহিলাটির ছবি ।আইফেল টাওয়ার এর সামনে তোলা |
মেয়েটি খুব ভালো করে মিলিয়ে নিতে থাকে ছবি ও বাস্তবের মুখ |
নিশ্চিন্ত হয়ে কাউকে ফোন করে | ইতিবাচক ঘাড় নেড়ে ফোন পকেটে ঢোকায় | পাশের সোফায় বসে ।হাতে ধরা গরম কফি ছলকে পড়ে ঘুমন্ত মহিলাটির গায়ে | তিনি চমকে চেঁচিয়ে উঠে
বসেন | স্থানীয় মেয়েটি বারবার ক্ষমা চাইতে থাকে - এমন কি হাঁটু গেড়ে বসে ও পড়ে |
কথা তো কিছু শোনা যাচ্ছে না | নিজের হিজাব খুলে মুছে নিতে থাকে মহিলার গায়ে পরা কফি | মহিলা ধীরে ধীরে শান্ত হন | মেয়েটি একটা কাপ বাড়িয়ে ধরে করুণ মুখ করে - মহিলাটি একটু হেসে কাপটা নিয়ে মেয়েটিকে বসতে বলেন |
দুজনে কথা বলতে বলতে কফি খেতে থাকে |
একটু পরে স্থানীয় মেয়েটি কারো ফোন ধরে ।মহিলা কে একটা আঙ্গুল দেখিয়ে ক্যামেরা
ফ্রেম -এর বাইরে চলে যায় | মহিলা কফি শেষ করে নিজের ফোন বার করেন | কারো সাথে দু একটা কথা বলে ফোন ব্যাগ এ রাখেন |

ধীরে ধীরে ওনার মাথা একপাশে ঝুলে পড়তে থাকে - সোফায় কাত হয়ে শুয়ে পড়েন |
ফ্রেম  এ একটি অল্পবয়েসী আফ্রিকান ছেলে আসে | সে ও ফোন এ মহিলার ফটো মিলিয়ে নিয়ে ফোন পকেট এ রাখে | তারপর ধীরে সুস্থে কফির কাপ ও ট্রে তুলে বাইরে বেড়িয়ে যায় |
এরপর একেবারে মহিলাটির নিজের মেয়ের প্রবেশ । মা কে ডাকতে থাকে । দৌড়ে বেড়িয়ে যায় - কিছু অফিসিয়াল লোকদের নিয়ে ঢোকে |
সৌমাভ ল্যাপটপ পজ করে | পাশে বাচ্চা মেয়েটি রীতিমতো কাঁদছে | তাকে বাঁ হাতে শক্ত করে ধরে থাকে | লেডি অফিসারটির সাথে কথা বলতে থাকে ।ওই স্থানীয় মেয়েটি আর আফ্রিকান ছেলেটিকে খুঁজে বার করারব্যাপারে | কষ্টসাধ্য ও সময়সাপেক্ষ কাজ | তবে অসম্ভব নয় - দরকারে ইন্টারপোল এর সাহায্য নেয়া যেতে পারে |
বাচ্চা মেয়েটির কান্নার মধ্যে বলা কিছু কথা কানে যেতে ওকে ঘুরে আরেকটা সোফায় বসায় |
টুকরো কথা জোড়া দিয়ে দিয়ে ইতিহাস তৈরী হয় |
ওর মায়ের কোনোদিন বিয়েই হয়নি | বাবা কি জিনিষ ও দেখেনি | ছোট থেকেই বিদেশে মায়ের সাথে থেকেছে    ।কলকাতায় দাদু, দিদা আর এক মামা ছিল | এখন শুধু মামা | প্যারিস এ একজন বাঙালির সাথে মায়ের আলাপ হয় ।তিনি ওদের সাথে বাড়িতে গিয়েও থাকেন | বেশ কয়েকবার গেছেন | মা খুব আনন্দ পেতেন ।প্রচুর জিনিষ কিনে দিতেন | এবার ও এক সুটকেস ভর্তি জিনিষ নিয়েছেন |
ওকে জিজ্ঞেস   করেছেন ওই লোকটিকে বাবা বলে যদি ও মানে ।তবে কলকাতায় গিয়েই বিয়ে করবেন |মেয়েটির কোনো আপত্তি ছিল না ।সে তো প্যারিস এ গিয়ে আর্ট নিয়ে পড়বে ঠিক
করেছে |
সৌমাভ ওকে লোকটির নাম ও নাম্বার জিজ্ঞেস করে | মেয়েটি নিজের ফোন খুলে দেখায় | অতি সাধারণ দেখতে একটি মধ্য বয়েসী লোক |
একটু ভেবে নিয়ে ডাটা ট্রান্সফার করে লালবাজারে  ওর একজন জুনিয়র অফিসার এর ফোন এ | কমিশনার কে জিজ্ঞেস করে যে কফিন আর বাচ্চা মেয়েটাকে নিয়ে রিটার্ন ফ্লাইট ধরবে কি না |
কেসটা প্রবাবেল হোমিসাইড শুনে আর সাস্পেক্ট কলকাতার বাসিন্দা জেনে কমিশনার সৌমাভকে ফিরে আসতে বলেন | দুবাই পুলিশ নিজের কাজ করুক |
সৌমাভ ফ্লাইট এ মেয়েটির কাছ থেকে আরো কিছু খবর পায় | কলকাতায় নেমে মেয়েটি কে মামার হাতে তুলে দিয়ে অনুমতি চায় মহিলার দেহ ও জিনিসপত্র । বিশেষ করে ফোন গুলি ফরেনসিক আর সাইবার পরীক্ষা করানোর জন্যে লালবাজার এ নিয়ে যাবার |
মামা মানুষটি গোবেচারা | ঘাড় নেড়ে কাগজ পত্র সই করে দেন | লালবাজারের একজন
অফিসার  মামা ও মেয়েটিকে নিয়ে তাদের বাড়ির দিকে যায় ।সৌমাভ তার দলকে কফিন আর জিনিসপত্র ভ্যান এ তুলতে বলে | নিজের জিপসি গাড়ির চাবি নিয়ে  এগোয় অফিস এর দিকে |
এক সপ্তাহ লাগলো সব কাজ শেষ করতে | ফাইল নিয়ে সৌমাভ কমিশনার এর কাছে যায় |
কমিশনার সব যুক্তি শোনেন | কিছু প্রশ্ন করেন | সেক্রেটারি কে ডেকে নির্দেশ দেন গ্রেফতারি
পরোয়ানা তৈরী করতে |
পরের দিন সকাল ৬ টায়ে একটা ভ্যান সঙ্গে নিয়ে সৌমাভ সেই লোকটাকে ঘুম থেকে তুলে নিয়ে আসে লালবাজারে |
সে ভাবতেই পারেনি তার ফোনরেকর্ডস , ব্যাঙ্ক ডিটেলস , ২০ বছর আগেকার বিয়ের সার্টিফিকেট ,  মহিলার ফোন আর ফেসবুক রেকর্ডস ,  সব মজুদ থাকবে সৌমাভর টেবিলে | বাঁ দিকে একটা বড় কাঁচের জার এ কোনো শরীরের
ভেতরের অংশ তরলে ভাসছে |
ঘরে ঢুকেই সেটার দিকে আঙ্গুল তোলে সৌমাভ - " এটা ওই মহিলার পাকস্থলী | ভিসেরা টেস্ট রিপোর্ট বলছে হজম না হওয়া স্যান্ডউইচ / কফি - সঙ্গে অতিরিক্ত সুগার ও  প্রেসার কমাবার ওষুধ আর ঘুমের ওষুধ | কেনা হয়েছে আপনার মায়ের নামে প্রেসক্রিপশন এ | ও হ্যাঁ ,এটা দুবাই পুলিশ এর ফ্যাক্স । ওই দুজন মেয়ে আর ছেলে ও ধরা পড়েছে - ফোন ও ব্যাঙ্ক ডিটেলস সহ |"
লোকটা হড়হড় করে বমি করে ফেললো - পাশ থেকে ধরে না রাখলে পড়েই যেত |
কমিশনার নিজের ঘরে বসে হেসেই ফেললেন সিসিটিভি দেখে | জার এ পাকস্থলী রাখার আইডিয়া টা দুর্দান্ত | লোকটা হুড়মুড় করে কনফেস করতে লাগলো |
অবিবাহিত ও সন্তানের জননী কে ঘরণী করার কোনো বাসনাই তার কোনোদিন ছিল না |
কলকাতায় তার ইলেকট্রনিক্স এর দোকান, জমিবাড়ির দালালি, বাড়ি, গাড়ি, বৌ, বাচ্চা সবই আছে | বাইরে যেত । ওই মহিলাটির সাথে আলাপ হওয়ার পর থাকা খাওয়ার খরচ বেঁচে যায় | উপরন্তু প্রচুর উপহার পেতো - যা দেশে  বেশি দামে বেচে দিতো | বিয়ে করবো ভাবটা জারি রাখতো - যাতে একটু একটু করে মহিলাটির টাকা পয়সা ও সম্পত্তি হস্তগত করতে পারে |
এইবার যে মহিলা  ১০বছর পর কলকাতা ফিরে বিয়ে করবেই প্রতিজ্ঞা করে বসবেন - সেটা ওর হিসেবের বাইরে ছিল |
শহরে পৌঁছে গেলে গায়েব করা শক্ত হতো | দুবাই এর লোক কে সুপারি দিয়েছিলো কফি দিতে আর কাপ সরিয়ে ফেলতে ।সরাসরি খুন করাও হলো না | ওষুধ গুলি পেট এ গিয়ে প্রথমে ঘুম এসে গিয়েছিলো ।তারপর হার্ট এট্যাক |
একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ায় সৌমাভ | ফাইল আর পেন ধরায় সই করার  জন্যে | ফোন তুলে নির্দেশ পাঠায় লক আপ  এ  ভরার  আর চার্জশীট তৈরী করার উদ্দেশ্যে |


No comments:

Post a Comment