Wednesday, May 1

উত্তরবঙ্গের জনজাতি : মণিদীপা নন্দী বিশ্বাসের গল্প





ওজা পাখির ঘর


  ১.
 স্রগ্ধরার বাড়ীতে আজ হুলু স্থূলু।বিকেল,বিকেল পেরিয়ে সন্ধে,সন্ধে পেরোনো রাত,ঘড়ির কাঁটা চর চর ঘুরছে তো ঘুরছেই।চোখে টলটলে জল বার বার মুছছে তিতির।গেট খোলাই আছে।গ্রীলে তালা পড়েনি।বার কয়েক চম্পক ঘর থেকে বেরিয়ে চৌরাস্তা,আবার কিছুটা হেঁটে পোষ্ট অফিস মোড়...আবার ফিরে আসা হতাশ্বাসে ওরা ফিরলেই তিতিরের ফোঁস ফোঁস বাড়ছে।ইতিমধ‍্যে হাওয়ায় কথা ভাসে বড় দ্রুত।ছুট লাগিয়েছে খবর হয়ে এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত।রাত দশটাতেও তাই কেরানী পাড়ার জেঠু জেঠিমা,শান্তিপাড়ার মাসী মেসো সব জুটেছেন,সঙ্গে পাড়ার এদিক ওদিক চেনা পরিচিত জনেরা তো আছেই,উঁকিঝুঁকি,তারপর এসে দাঁড়ানো,সান্ত্বনা ঝরছে যেন'মধু মধু চিনি চিনি'...এসব চম্পকের একদম ভালো লাগেনা।এইসব দিদিভাইটার জন‍্য।সে আর সমীরণ মোটামুটি চুপ।সমীরণের কোন তাপ উত্তাপ নেই।আর চম্পক দুশ্চিন্তার পারদের নাড়া খেয়ে মাঝে মাঝে বেরিয়ে পড়ছে,কিন্তু কোন কুল কিনারা না পেয়ে আবার ফিরে আসছে।-কি ব‍্যাপার...কি হয়েছেরে সমীরণ?
মাঝু কাকু এলেন এতক্ষণ পর।ফ‍্যামিলি ফ্রেন্ড বলে কথা।আর সবচেয়ে বড় কথা স্রগ্ধরা মিসিং।কোথায় গেছে তোদের বলে যায়নি?এবার তিতিরের দিকে তাকিয়ে প্রশ্নটা।তিতির একটু রুক্ষ স্বরেই জবাব দেয় ,তা সেটা হলে তো চিন্তাই ছিলনা।আজতো চার পিরিয়ডের পর ছুটি হয়ে গেছে স্কুল,আমি বন্ধুদের সঙ্গে অনেক আগেই ফিরি,আর মা তো স্কুল ছুটির পর ও বহুক্ষণ খাতা দেখা,কাজকর্ম সেরে ফেরে।প্রথমে তো অত ভাবিনি,...এবার আর চোখের জল বাধ মানেনা।..ঐ পিউ,মৌলী ওরা সব পড়তে এসেছে মার কাছে,ঘড়িতে আটটা পেরোলো যখন,তখন থেকেই চিন্তা শুরু হল।আর এখনতো দশটা...দেখ,বাবা কেমন চুপচাপ!এবার ঝেঁঝে ওঠে তিতির।...ঠিক হয়েছে।মা কোথায় গেল গেলনা,কি খেল,খেলনা কিচ্ছু তো দেখনা,এখন বোঝো...আমরা কি করব এখন!
  মাঝু রায় ধীরে  সমীরণের ঘরে যায়।-কিরে,ঝগড়া করেছিলি নাকি? তিতির ফুট কাটে।...সেত লেগেই আছে।মার তো সব কাজেই খুঁত।যেটা মা ভালো বলবে,সেটাই ওনার খারাপ,এবার...আর বোধহয় সময় নেই,পুলিশে...চম্পক দ্রুত কথাটা কানে যেতেই একটা কথাই বলে,না না,ওসব থানা পুলিশ  এখন ই করা যাবেনা।তলিয়ে ভাব কোথায় যেতে পারে,ফোনটাতো সুইচ স্টপ বলছে।যা মা কখনোই করেনা।...এমন কোথাও হয়তো আছে যেখানে নেট ওয়ার্ক ই নেই।ফোন কাজ করছেনা।
একথা বলেই কেমন চুপসে গেল চম্পকের মুখ।আর তিতির শব্দ করে ফুঁপিয়ে ওঠে।মৌলী,পিউ কিছুক্ষণ দেখে রিক্সা করে বাড়ী ফিরেছে।
    সমীরণের অসহ‍্য লাগতে থাকে।অফিস থেকে ফিরে এখন ও চা খায়নি।তিতিরকেতো বলাই যাবেনা চা কর।মা সোহাগী একেবারে।মনে মনে ফিস ফিস করে,আসবে আসবে।যাবে আর কোন চুলোয়? এইতো শুধু এদিক ওদিক,বাড়ীতে মন আছে নাকি!পায়ের নীচে সর্ষে দানাতো লেগেই আছে।উত্তরের কি এক সংস্থা বানিয়ে দিয়ে গেল ভদ্রলোক...ড:প্রীতম বিশ্বাস...ওনাকে করলেন সেক্রেটারী।কেন,না খুব ভালো ছাত্রী,প্রিয় ছাত্রী ছিল যাদবপুরের,তা এখন এত বেড়ে উঠেছে,আর সামলানো যাচ্ছেনা,আর ছেলে মেয়ের সামনে বলবেই বা কি!অপছন্দ তো বহুবার জানিয়েছে,আর তত ই বেড়েছে স্রগ্ধরা।আশ্চর্য!
-মাঝুদা বসুন।চা করি খান।দাদারাও চলে যাবে এখন।তিতির লাল চোখে তাকিয়ে থাকে ততোধিক নিষ্ঠুর বাবাটির দিকে।দপদপ করে রান্নাঘরে ঢুকে চা বসায়...মাঝু কাকুও যেন কি,যেন কত চিন্তা,একে তাকে ফোন করতে লেগেছে।চায়ের কাপ সহ ট্রে ঠকাস করে নামিয়ে রেখে,চম্পকের হাতে এক কাপ ধরিয়ে দিয়ে ছাদে চলে যায় কাঁদবে বলে।অসম্ভব আঁকুপাকু করছে মন।শেষমেশ মা ওদের ও ছেড়ে গেল,ভাইকেও!!কেমন অসহায় লাগে,আর বাবার উপর উষ্মাগুলো বাড়তে বাড়তে আগ্নেয়গিরি।
   মাঝু রায় ততক্ষণে সিনিয়র সাংবাদিক 'প্রভাত'পত্রিকার,যোগাযোগ করে ফেলেছে।-আচ্ছা,আপনাদের সঙ্গেতো স্রগ্ধরা দেবী প্রায়  প্রতিদিন ই কাজ করতেন,আজ কি প্রেসে গিয়েছিলেন?...না,মানে আজ এখন ও স্কুল ফেরৎ বাড়ী ঢোকেননিতো,তাই বলছি।...সমীরণ চায়ের কাপ হাতে উৎকর্ন তখন। একটু যে চিন্তা এখন হচ্ছেনা,তা নয়,আসলে তলিয়ে ভাবনা করা ওর স্বভাব ই না।তার উপর স্ত্রীর এত এদিক ওদিক কাজ,নামডাক কটা পুরুষের আর সহ‍্য হয়!মুখে যত ই স্বধীনতার বুলি কপচাক,বুক ঠুকে নিজের বৌয়ের কথা শুনতে হলেই কবজা করে রাখ পাঁচ আঙুলের মুষ্ঠিতে এটাইতো অভিপ্রায়।
...একটু যেন সূত্র পেয়েছে মাঝু।দাঁড়িয়ে পড়েছে।-হ‍্যাঁ বলুন,...বাসে উঠেছে?বিকেলের দিকে?...কোনদিকের বললেন,আলিপুর দুয়ার?ওও কোন সার্ভেতে গেছে?
তেমন পরিষ্কার করে জানা না গেলেও,এটুকু বোঝা গেল স্রগ্ধরা আলিপুরদুয়ারগামী বাসে উঠেছে পোষ্ট অফিস মোড় থেকে,কোন বিষয়ের সার্ভে করতে।...তিতিরের ফোঁপানি খানিক থেমেছে,চম্পক চুপচাপ।আর মায়ের এদিক ওদিক বেরিয়ে যাওয়ায় ওরা অভ‍্যস্ত।কিন্তু এরকম না বলে রাত করে বাড়ী না ফিরে আসা,এমন কখনো হয়নি।
সমীরণ তলিয়ে তাকায় নিজের দিকে।কিন্তু স্রগ্ধরার উপর রাগতো কমছেইনা,বরং ইগোতে লেগে রাগের পারদ ক্রমশ চড়ছে।সেইসঙ্গে তিতিরের সবটুকু বুঝে ফেলা,মার ভালো কাজ গুলোও যে বাবার কাছে উপেক্ষার এটা তিতির বার বার ধরে ফেলে বলে রাগ একেবারে চরমে পৌঁছে যায়।...তবু যা হোক,পুলিশে তো যেতে হলোনা।অবশ‍্য এখন ও সঠিক জানা যায়নি কোথায় আছে,ওদিকের প্রত‍্যন্ত গ্রামগুলোয় নেট ওয়ার্ক থাকেনা।...মাঝুদাও সকলে চলে যাবার পর ফিরে গেছে।ঘরের তিনটে প্রাণী যে যার বিছানায় বিনিদ্র ই এখন।প্রহরে প্রহরে পাখিরা যেমন ডাকে ডাকছেই।যত ভোরের দিকে যাবে,তত ই ডাকগুলো বদলে যাবে।

২.
আলিপু্রদুয়ার পৌঁছলো যখন বাসটা,ঘড়িতে সাড়ে তিন পেরিয়ে গেছে।এত সময় দেখে তো কাজকর্ম করা যায়না।তাছাড়া সব কাজ একা করলেই কাজটা এগোয় বেশী স্রগ্ধরা মিলিয়ে দেখেছে।গেল সাতদিনে টিফিন পিরিয়ডে,অফ পিরিয়ডে চৈতালি,তিস্তা,মহুয়ার কত গলা ফাটানো।কি,না...এবার তোর সঙ্গ আমরা নেব ই নেব।একাই ঘুরে আসিস সর্বত্র,তারপর খবরের কাগজের মুখ হয়ে উঠিস,ব‍্যাপার কি বলত?এতো এনার্জি পাস কোথায়?এ প্রশ্নটা এতবার শুনেছে,এখন আর খুশী হয়না,বিরক্ত লাগে।তাহলে বলছ কি!অভিপ্রায় কি,আমার ইচ্ছেগুলো বাক্সবন্দী করে রেখে দেব?আশ্চর্য!তা এবার ওগত দুবারের পুনরাবৃত্তি।যেই ছুটির ঘন্টা বাজলো,নারে,আজ আর হচ্ছেনা স্রগ্ধরা,বাপির স্কুলে কাল পরীক্ষা,না থাকলেতো পড়বেইনা।...চৈতালি উক্ত।একটু পর মহুয়া,তিস্তাও নানা অজুহাত খাড়া করে কেটে পড়ল।স্রগ্ধরা চিন্তায় পড়ে,আজ ওরা না বললে কোন্ ভোরবেলায় গাড়ী ধরে বেরিয়ে যেত। এখন কখন পৌঁছবে আর ফিরবেইবা কখন!কোচিং ক্লাস ও আছে।সে থাক,তবে বাড়ীতে ফোন লাগালেই চিত্তির,আর বেরোনো যাবেনা।মাথাটা কলিগদের নেগেটিভনেসে এত ঝাঁঝা করছে যে আর কিছু ভাবলোনা।স্কুল লকারে এতক্ষণের দেখা খাতাগুলো ঢুকিয়ে বড় ডায়রী আর কলম,কয়েকটা তা কাগজ ঢুকিয়ে নিল।আর ক‍্যামেরাতো সঙ্গেই আছে।ওর মোবাইলে ফটো তোলা যায়না।এ পেপারসটা তৈরি করতেই হবে দ্রুত।আর ইলেভেনের ছাত্রী সতি আর শোভনা কবে নিমন্ত্রণ দিয়ে রেখেছে।আজ লক্ষ্য করেছে ওরা স্কুলেও আসেনি।দিদিমণি ওদের টোটোপাড়ায় যাবে বলে।আরনা,কিচ্ছুটি না ভেবে সোজা হেঁটে পোষ্ট অফিস মোড়।একখনা ব‍্যাগ ই সঙ্গে,কাঁধের

     মাদারীহাটের দিকে যখন অন‍্য বাসে  চেপে চলতে শুরু করেছে বিকেল তখন।আবছা অরন‍্য অন্ধকার রাস্তার দুপাশে।এই ছায়া ছায়া অনুভূতি  কি যে টানে স্রগ্ধরাকে।বাসে সব খেটে খাওয়া মানুষেরা,কেউ চলেছে হাটের পসরা নিয়ে,কেউ পাইকারী জিনিস কিনে ফিরছে হান্টাপাড়া,লঙ্কাপাড়ার দিকে।হাসিমারা পর্যন্ত যাবে কেউ কেউ।মাদারীহাটে কয়েকজন শিক্ষিকার সঙ্গে দেখাও হলো,তারা আলিপুরদুয়ার কেউ কোচবিহারগামী বাসের জন‍্য অপেক্ষা করছে।স্রগ্ধরা এদের চেনে।হাত নাড়ে,আলিপুরদুয়ার জেলার মাদারীহাট থানা থেকে ২৩কিলোমিটার দূরে অবস্থান টোটোপাড়ার,ঠিকঠাক বাস যদি পেয়ে যায়,মিস যদি না করে তাহলে ঠিক সময়ে পৌঁছে যাবে।ফেরার কথাটাও মাথায় আছে,তবে একটু আগে দীপু ফোন করেছিল কলকাতা থেকে,ও কয়েকবার এসেছে টোটোপাড়ায়,আর দিনের ভেজা ভেজা ঠান্ডা সৌন্দর্য আর রাতের চাঁদের জ‍্যোৎস্নায় টং ঘরে থাকালর দুরন্ত অভিজ্ঞতা এমনভাবে গল্পে গেঁথে দিয়েছে স্রগ্ধরার মাথায় বসে গেছে,বড় লোভ হচ্ছে বহুদিন থেকেই। দেখা যাক যাওয়া কপালে আছে কিনা।
   বাসে সাধারনত চোখ বুজে আসে।এখানে অরন‍্যের সৌন্দর্যের ঘন নিবিড়তা ওকে সচেতন করে রাখে।আপ্লুত হয়ে তাকিয়ে থাকে অরন‍্যে,শাল সেগুন মহল্লায় মাঝে মাঝে কাঠের আড়তখানা,কাঠুরেদের কাঠ কুড়োনোর ছবি মাঝে মধ‍্যে চোখে পড়ছে।চাইকি,বাইসন হরিণ ময়ূর সব ই মিলতে পারে...বরাত জোর থাকলে হাতি।কয়েকবার শোভনা ফোন করেছে বড় উৎসাহে।'আজ আর স্কুলে যাইনি দিদি,আপনি আসবেন বলে,আনন্দ হচ্ছে খুব।ঠিকঠাক আসুন...হান্টাপাড়ায় নেমে বাস পেয়ে যাবেন।'   আর কিছুক্ষণের পথ।টোটো জাতির ই হাতে গড়া গ্রাম'টোটোপাড়া'।পাশেই প্রতিবেশী দেশ ভুটান।ইতিহাস যেটুকু জেনেছে স্রগ্ধরা,তাতে আছে,আলিপুরদুয়ার সলসলাবাড়ী এলাকায় টটপাড়া গ্রামে টোটো জনজাতি বাস করত।সুদূর মঙ্গোলীয় থেকে পানা হিমালয় ভূটান পেরিয়ে তারা এই সলসলা বাড়ি টটপাড়ায় এসে যাত্রা থামায়।আবার যথাস্থানে ফিরে যায়।ডুয়ার্স অঞ্চলে বিভিন্ন জায়গায় অস্থায়ীভাবে বাস করতে থাকে।দীর্ঘ যাত্রায় প্রাকৃতিক দুর্যোগতো সঙ্গী ছিল ই,সঙ্গে নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে অনেক টোটোজাতির পুরুষ নারী,শিশু মারা যায়।ভুটানের ভোদে নামের এক জায়গায় তারা বাস করে সে সময়।এখন ভোদের নাম হয়েছে জন্তু।ভুটানে থাকার সময় ই ভুটানের প্রাচীন জনজাতি ডয়া জাতি টোটো জাতির সঙ্গে গোষ্ঠী সংঘর্ষে মাতে।ডয়া জাতি টোটো জাতির সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক তৈরি করতে চাইলে টোটোরা তা নাকচ করে দেয়।কারণ ডয়াদের সঙ্গে তাদের সামাজিক নিয়ম নীতির কোন মিল ছিলনা।পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া সাতি নামের নদীতে ডয়া জাতির রক্ত মিশেছিল বলে তারা সে সাতি নদীর জল পান করেনি কোনদিন।তাদের কাছে সাতি নদীর জল তখন থেকেই অপবিত্র।যাঁরা বেঁচেছিল দক্ষিণ পশ্চিম কোণে সরে গিয়ে বৌদ্ধ গাওয়ে বসতি গাড়ে।পরে আর ও দক্ষিণে গ্রাম বাড়িয়ে নেয়।জঙ্গল কাটে,অনেকগুলো ঝোরা আবিষ্কার করে।কতগুলো নাম দীপুর কাছে শুনেছে স্রগ্ধরা। নিতেনতি,চুয়াতি,দীপ্তি,দাতেনতি,...ইত‍্যাদি।প্রথমে দীপ্তি নদীর জল তারা ব‍্যবহার করত,এখন ওদের বাঁচিয়ে রেখেছে দাতেনতি।
     স্রগ্ধরা যত ওদের কথা শুনেছে তত বেড়েছে ওদের উপর আগ্রহ।আহা! বহুদিন পর্যন্ত অশিক্ষিত বন‍্যজাতি নিজেরা কিন্তু নিজেদের রীতি নিয়ম নিজেরাই তৈরি করেছে।সবচেয়ে ভাল লাগে বিবাহরীতির কথা শুনলে।নারীদের যথেষ্ট মর্যাদা এরা প্রথম থেকেই দিয়েছে।বিয়ের আগে পাঁচ ছ মাস তারা শ্বশুর বাড়িতে স্বামীর ঘর করতে পারে,যদি পছন্দ না হয় বা থাকা অসহ‍্য মনে হয়,পাত্রী বেরিয়ে আসতেই পারে। এই জনজাতি এ ব‍্যাপারে অনেক সভ‍্য মানুষ,সমাজ থেকে  কতটা এগিয়ে বোঝা যায়।আজো বোধহয় শোভনা টোটোর কাকার মেয়ের বিয়ে।ওদের রীতি,পূজা,নিয়মনীতি সম্পর্কে স্রগ্ধরার আগ্রহ অত‍্যন্ত বেড়েছে।বিশেষ করেস্কুলে শোভনা আর সতী ভর্তি হ ওয়ার পর।ওদের দিদি সুনীতা প্রথম বি এ পাশ করে টোটোদের মধ‍্যে।শহরে এসে কলেজে পড়ে চাকরীও পেয়ে গেছে।সেই পথ অনুসরণ করছে এখনকার পরের প্রজন্ম।তাই টোটোপাড়া গ্রামে গড়ে ওঠা সভ‍্যতার ছোঁয়া একটু ছুঁয়ে আসতে লোভ হয় বৈকি!
    ভাবতে ভাবতে আর অরণ‍্য সৌন্দর্য নিতে নিতে কখন যে পৌঁছে গেছে বাস।দেহাতি কিছু মানুষ,অন‍্যান‍্য জনজাতি,কিছু ঘর নেপালিও এদিক ওদিক নেমে ছড়িয়ে গেল। এবার কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতেই হবে।পাঁচটার সময় একটাই বাস টোটোপাড়ায় যাবে।স্রগ্ধরা খুঁজে খুঁজে একখানা চায়ের দোকান পেয়ে গেল।ওর তেমন কোন বাছবিচার নেই,অনেকেই চা খেতে ঢুকেছে।তারমধ‍্যে দু একজন টোটো জনজাতির মানুষ ও আছে।তারাও ঐ বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দিতেই যাচ্ছে।ওদের কাছেই জেনে নিল স্রগ্ধরা ওদের উপগোষ্ঠির কথা।টোটোদের প্রধান গোষ্ঠিরা-বহোবে,বৌদুবে,বুদুবে,ধিরিংচাংনকোবে,নরিনচাংনকোবে,মাংএবে,মাংনচিবে,দাংএবে,দাংকোবে,রেংকাইচিবে,নুবেবে,পিশোচানকোবে,..চট করে ব‍্যাগ থেকে ডায়রীটা বের করে।ক‍্যামেরা তো আগেই বেরিয়েছে।
       বিয়েতে যোগ দেবে বলে বিশেষ পোষাক ও পরেছে ওরা।এদের মধ‍্যে একজন কাইজিও আছেন।মানে সমাজের প্রধান পুরোহিত।তিনি আবার যোগ করলেন,বৌদুবে গোষ্ঠীর তিনটি উপগোষ্ঠী।ম ইপা,জাপা,স ইপা,থাপা ইত‍্যাদি।প্রত‍্যেক গোষ্ঠীর কুল দেবতা আলাদা ,এক গোত্রে বিবাহ ও নিষিদ্ধ।একটি গোষ্ঠির সঙ্গে মোট পাঁচটি গোষ্ঠীর বিবাহ হতে পারে।নিজস্ব সামাজিক রীতি মেনেই বিবাহ হয়।আলোচনা আর গল্পে গল্পে চা শেষ,ঝমঝমিয়ে লজঝড়ে ছোট গাড়ীটা চলে এল।স্রগ্ধরাকে ফিরে ফিরে দেখছে যাত্রীরা।আসলে,এদিক থেকে একটু অন‍্যরকম সাজপোশাকে একা একজন মহিলা চলেছে,একটুতো আগ্রহ হবেই।ওরাও নিজেদের মধ‍্যে কথা বলে যাচ্ছে,স্রগ্ধরাকে সামনের দিকেই একখানা সিট ছেড়ে দিল।ভাড়া মিটিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে সে...আরে!এইযে টোটোপাড়ায় যাচ্ছে বলে র ওনা...রাস্তা কোথায়,!এইতো বোধহয় তিতি ঝোরা,বর্ষায় বিরাট চেহারা,এখন ও জল আছে,জলের উপর দিয়েই সিনেমাটিক ঢঙে ড্রাইভার গাড়ী চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে নিজস্ব মুন্সিয়ানায়।হঠাৎ করে হড়কা বানের কথা মনে হল।শুনেছিল এ পাহাড়ী ঝোরা নদীতে হঠাৎ করে জল নামলে সব ভাসিয়ে নেয়।এইসব গাড়ী টাড়ি তখন তুচ্ছ।একটু কি কেঁপে ওঠে স্রগ্ধ রা! অল্প সময়ের জন‍্য ও কি মনে পড়ে তিতির আর চম্পকের মুখ,তাড়াতাড়ি ফোন বের করে,আরে!চার্জ আছে কিনা বোঝাই যাচ্ছেনা,নেট ওয়ার্ক ভোঁভাঁ।হ‍্যাঁ এরকম ইতো বলেছিল দীপু।জনসংযোগহীন কিন্তু, মনে রাখিস।এত শত তো আর ভেবে ওঠেনি।যেতে হবে,দেখতে হবে,ব‍্যস।শোভনাকেও এখন আর ফোন করা যাচ্ছেনা।গাড়ীটা ঢুকছে।দক্ষিণ দিকে বিশাল জঙ্গল।এ জঙ্গল ই লঙ্কাপাড়া,চা বাগান ও পশ্চিমে তিতি ভুটান পর্যন্ত প্রসারিত,প্রাচীনকালে টোটোরাতো শিকার ই করত।আবার শিকারজাত বস্তুর একাংশ কাইজি আর মোড়লকে উপহারের রীতি ছিল,এখন অবশ‍্য শিকার ছেড়ে চাষবাস করছে বলেই শোভনার বাবা জানিয়েছে।তিনিও মেয়েকে ভর্ত করতে এসে কতবার নিমন্ত্রণ করেছেন।এমনকি,নিজের বাড়ীতেই তৈরি করেছেন অতিথি গৃহ।আজতো শোভনা বোধহয় ওখানেই নিয়ে যাবে স্রগ্ধরা দিদিমণিকে।

      শোভনা,সতী,সুনীতা ওরা ছোট থেকেই দেখেছে শিকারীরা বম শিকারে যাবার আগে ঘরের বারান্দায় শিকারী পূজা(সাই)করত।
পূজারী লাল মোরগ বলি দিয়ে ছেড়ে দিত,মরার আগে মোরগটি পূর্বদিকে প্রাণত‍্যাগ করলে মনে করা
হত,শিকার নিশ্চিত।হাতি বাঘ,গন্ডার শিকার নয়,যেটুকু প্রয়োজন তাই শিকার করেছে তারা।
    বাইরে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মুগ্ধ হ ওয়ার মতো,সেইসঙ্গে বেলাও কমে আসছে,আর যত ভিতরে ঢুকছে আলো যেন মরে যাচ্ছে।এবার যেখানে থামলো বাস সেখান থেকেই একটু এগিয়ে গ্রামীণ ব‍্যাঙ্ক দাঁড়িয়ে আছে।এখানেই শোভনার বাবার চাকরী।স্রগ্ধরা মাটিতে পা দেওয়া মাত্র ই শোভনা বাবাকে নিয়ে ছুটে এসেছে,আন্তরিকতায় মুগ্ধ আবিষ্ট সে।কিন্তু বেলা যে পড়ে আসছে তাহলে আজ ফিরবে কি করে!একথা বলতেই হৈ হৈ করে শোভনা,বলে তড়িঘড়ি,আজতো ম‍্যাম ফেরা হবেনা।বিয়ের অনুষ্ঠান দেখবেন না?আপনার জন‍্য ঘর ঠিক করে রেখেছি।এবার একটু শঙ্কিত হয় মনে মনে,মূলত তিতিরের জন‍্য,কোন ফোন ই ঢোকেনি,আর এখানে নেট ওয়ার্ক নেই।

৩.
অন্ধকার হয়ে এসেছে।একটু আগে চা বিস্কুট চলে এসেছে শোভনার বাবা গিরিধারী টোটোর অতিথি আবাসনের কাঠের দোতলায়।বড় গোল ঝকঝকে পালিশ করা টেবিলে ধূমায়িত চা।একটু আগেই আকাশ পরিষ্কার ছিল,একটুকরো কালো মেঘ ঢেকে দিয়েছে তাকে,ঠিক স্রগ্ধরার মনের মত,যতখানি  ঝোঁকের মাথায় উৎসাহ নিয়ে ছুটেছিল,একদিকে দীপুর উৎসাহ,অন‍্যদিকে শোভনা সতিকে কথা দিয়ে সেটা তখনিই রাখতে হবে,এমন ই মানুষ স্রগ্ধরা।এ শিক্ষাই তো পেয়েছে ছোট থেকে।ওর আগ্রহ,সব কাজে বেদম উৎসাহ আর মিশুকে স্বভাবে পরিবার,স্কুল,সমাজ কোনখানেই বন্ধুত্ব,এ্যাডজাষ্টমেন্ট,এসবের অভাব হয়নি।এখানেও যে হবেনা জানতো নিজেই।তবে অন‍্য এক কাঁটা খচ খচ করছে।কোনভাবে,বাড়ীতে একটা খবর দেওয়া উচিত ছিল,কিন্তু সেটা বহু চেষ্টা করেও শোভনা,গিরিধারী বা ও নিজেও পারলোনা।এবার দুশ্চিন্তার কালো মেঘ নিয়ে বসে থাকা ওর স্বভাব নয়।তাহলে যে জন‍্য থাকা সেটাও তো মাটি হবে।আর গিরিধারীতো যোগাযোগের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।এত চিন্তা আর করবেনা এমন প্রত‍্যয় নিল মনে মনে।
   একটু আগেই শোভনা দিদিমণিকে নিয়ে একটু দূরে যে বাড়ীতে বিয়ে হচ্ছে,সেই মেয়ের পরিচয় করিয়ে দিয়েছে।ছেলেও পাস দিয়ে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ‍্যালয়ের অফিসে আছে।অবাক হয়ে যায় স্রগ্ধরা,কিভাবে সভ‍্যতার অগ্রগতিতে উঠে আসছে ছেলে মেয়েগুলো মূল স্রোতে।ভাল লাগে মন ভরে যায়।স্রগ্ধরা ঔৎসুক‍্য নিয়ে বিয়ের যে রিচুয়াল সবটা ওরা মেছে কিনা জানতে চায়।শোভনা বোঝে দিদিমণি কি জানতে চাইছেন।বাইরে এসে বলে,সত‍্যিই দিদি,এদের বেলায় এমনটাহয়নি।কারণ দুই পরিবার দুই পরিবারকেআগে থেকেই চিনত,আর সীমাদিদিওতো এসি কলেজে পড়ছে,আর পাত্র যোগেশদাকে ও নিজেই পছন্দ করেছে।তাই ওর বাড়ীতে আগে থেকে থাকতে চায়নি ও।
-বা: বেশতো।..সকাল সকাল তোদের বিয়ের অনুষ্ঠান একটুক্ষণ যোগ দিয়েই আমায় বেরিয়ে পড়তে হবে,কিযে হচ্ছে ওদিকে,বেশ চিন্তা হচ্ছে বুঝলি!
--হ‍্যাঁ দিদি,একটু যদি বলতে পারতেন।
--যাক্ এখন আর চিন্তা করবনা।চল দোতলায়,তোদের প্রকৃতি পূজা,বিশ্বা এসব কথাগুলো বল্।
--হ‍্যাঁ ,দিদি, সতিকেও ডেকে নেব।ও আপনার সঙ্গে দেখা করবে বলে কতদূর থেকে হেঁটে হেঁটে চলে এসেছে।
       অন্ধকার পথের অদূরে আঙুল তুলে শোভনা দেখায়...ঐযে জঙ্গল,ওখান থেকে টোটোরা নানারকম জঙ্গলী শাক,মাশরুম,জংলী আলুর কন্দ সংগ্রহ করত আগে,এখনও কেউ কেউ করে।অঞ্চু ঝোরা ও হাসি ঝোরার পাশে প্রচুর জংলী বাঁশের চারা হালকা করে কেটে সব্জি বানাত, শোভনা জানিয়ে রাখে,আজ ডিনার হবে চিশাইয়ের সঙ্গে মাংস মিশিয়ে রান্না করা সুস্বাদু খাবারে।ওরা আর ও
খাবারের কথা জানায়।কাল সাধারণ মাছ মিষ্টি এসবতো থাকছেই,এছাড়া ওদের মাসরুম খুব প্রিয়,সে দারুন মাসরুমে একখানা পদ তৈরি হবেই।স্রগ্ধরার একটু ক্ষিধে ক্ষিধে পাচ্ছিল,এসবের টেষ্ট জানা না থাকলেও,নাম শুনেও ক্ষিধেটা জেগে উঠল।'বাড়িতে আজ মাসী না ঢুকলে কি খাবে ওরা...চিন্তা ঢুকতেই মনে পড়ল ফ্রিজে ডিমের ঝোল বানিয়ে রাখা আছে।আর স্রগ্ধরা না থাকলে সমীরণ বেশ রাঁধতে টাধতে পারে,তিতির বলেছে সে সময় ওদের বেশ পিকনিক পিকনিক ফিলিং হয়।আজও হোক। স্ত্রী নেই ফিরছেনা বলে মুষড়ে পড়ার লোক নয় মোটেই।

বাইরের আবছা আলো,আর সামান‍্য গ‍্যাসের আলোয় বেশ মায়াময় হয়ে উঠেছে বারান্দাখানা।এত সুন্দর আর ও হয়ে উঠেছে সময়গুলো শোভনা আর ওর পরিবারের আতিথ‍্যে।এক রাত থাকলো বলে বিকেল পেরোনো নদীতে পুজো,প্রধান পুরোহিতের বাড়িতে মিটিং(ওরা বলে লাচিজান-ওয়া)এর মধ‍্যমেই পুজোর সময় দিনক্ষণ ঠিক হয়।ওরা দৌড়ে এসে স্রগ্ধরাকে জানিয়েছে।আর পুজোতেও অক্টোবরের আগে পরে আবার আসার নিমন্ত্রণ।সকালে বিয়ের বাসরের আগে অন্চু পুজোর বাকিটা সেরে নেবে ওরা,তাই সকাল সকাল স্রগ্ধরার স্নান টান সেরে নেওয়া চাই।শোভনার এমন ই দাবী দিদিমণির কাছে।একসঙ্গে খাওয়া পর্ব সেরে গল্প গুজবে রাত কখন গভীর হয়।শোভনা জানায়,দিদি আমি পাশের ঘরেই আছি,একটু নীচে নেমে কলঘর,বাথরুম,আমাকে ডাকবেন উঠতে হলে। স্রগ্ধরা জানে,এখন শুয়ে পড়লে ওর আর ওঠার প্রশ্ন নেই।এতটাই ক্লান্তি লেগে আছে।
 পালিশ করা শক্ত কাঠের পাটাতনে তৈরি ঘরের ভিতর রাত্রিযাপন করলেও একলাটি সাদা চাদরে কেমন শির শির অনুভূতি,পাশের বেডখানা ফাঁকা, শোভনাকে বললে ও থেকে যেত,কিন্তু ওর সংকোচ হবে ভেবে শোভনাকে আর ডাকেনি।রাত পোষাক না পরে একটু প্রস্তুতি না নিয়ে কি করে ঘুমোবে,সে সব কথা আর ভাববেনা।কাপড়টা আলগা করে খুলে সরিয়ে রাখে।পাশের ঘরটায় সব আছে বলেছিল শোভনা।সত‍্যিইতো,একখানা নতুন নাইটি রেখে গেছে।একটু খিতখিতে অনুভূতি হলেও জামাকাপড় না ছাড়লে কি ঘুম হবে!পরে নেয় নাইটিটা,নতুনের একটা গন্ধ পায় বটে।অদ্ভুত সুন্দর পরিচ্ছন্ন এক ঘরের নির্জনতা যেন আর ও জোর শব্দ করে।আশ পাশ থেকে যেন নি:শ্বাস প্রশ্বাসের শব্দ ভেসে আসে।চোখ বুজে শোভনা,সতী,ওর বাবা একজন ব‍্যাঙ্ককর্মী,অন‍্যজন ব‍্যবসায়ী...এদের কথা ভেবে ,অঞ্চলটার প্রতি একান্ত আনুগত‍্য দেখে মনে হয়,এই নতুন যারা শিক্ষা পাচ্ছে ছড়িয়ে পড়ছে টোটোপাড়া ছেড়ে অন‍্য কোথাও কলকাতা,কিংবা অন‍্যান‍্য কর্মস্থলে,ওদের সংস্কৃতিকে কি ওরা ধরে রাখবে শেষ পর্যন্ত!ভবিষ‍্যৎই বলবে সেকথা।কি অদ্ভুত এদের দৃষ্টিভঙ্গি,অন‍্যান‍্য আদিবাসী,উপজাতি বন্ধুদের মত এরাও প্রকৃতি পূজায় বিশ্বাস করে,ওরা জানে পাহাড়কে,গাছপালাকে সন্তুষ্ট না করলে পরবর্তী দিনগুলো শুভ হবেনা।
সামাজিক,পারিবারিক আর গোষ্ঠী পূজাতো ছিল ই,জল নিমন্ত্রণ ওরা করে অন‍্যভাবে।কি অদ্ভুত ভাবে কলস হাতে সরে গেছে ঝোরার ধারে বিয়ের আসর থেকে।
গ‍্যাস ল‍্যাম্পখানা নিভিয়ে দেয়।ও বুঝতে পারে,এইযে পরদিন সকালে সীমার আর যোগেশের বিয়ে নিয়ে হৈ চৈ ওদের,এইযে আনন্দ এসব ই ওদের বিশ্বাসে সংস্কারে তেমন করে আঘাত লাগেনি বলে,দুজনেই এক ই এলাকার,এক ই গোষ্ঠী ভুক্ত বলে।একটু অন‍্যরকম হলে এ আয়োজন হত!টোটোরা বিশ্বাস করে,অন‍্য জাতির পুরুষ বা মহিলার সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করা গুরুতর অপরাধ।এই ধরণের ব‍্যভিচার যদি ওরা প্রশ্রয় দেয় তাহলে টোটোপাড়ায় হবে অজন্মা।বিনা রোগে মানুষ মরবে,কলেশ্বর ক্রুদ্ধ হবেন,শিলাবৃষ্টি হবে,শস‍্য নষ্ট হবে,দুগ্ধবতী গাই দুগ্ধহীন হয়ে যাবে,মানে টোটো জাতির অমঙ্গল ও ধ্বংস নেমে আসবে বলে টোটোদের বিশ্বাস।তবে এ বিশ্বাসগুলো কালে কালে থাকবে কি!এই শোভনারাও কি সংস্কারে বিশ্বাস করবে,মনে হয়না।
      এখানে এই গ্রামে ঢোকার পর থেকেই মনে হচ্ছে পাহাড়,নদী,অরণ‍্য,ভূমি সবাই যেন এক একজন প্রাণসত্তা।সজীব চলে ফিরে বেরানো জীব।জীবনযাত্রার প্রয়োজনে মানুষ এদের সঙ্গে মিশে ওদের আত্মীয় করে নিয়েছে,তুষ্ট রাখতে চেষ্টা করছে।...বাইরে অন্ধকার ঘন।কাঠের ঘরে ফাঁক ফোকর গ'লে বাইরের প্রকৃতি যেন ঢুকে পড়তে চাইছে।হঠাৎই টোটোদের অপদেবতা পিদুয়ার কথা মনে হয়,মাথা জুড়ে খানিক ভয় দৌড়ে আসে। ওদের বিশ্বাস অদূরে উত্তরে যে বাদু পাহাড় ঐ পাহাড় সংলগ্ন তিতি নদীর ধারে তিত্রীং নামে গভীর অরণ‍্যে পিদুয়া,মৈশিং অপদেবতারা আছে। পিদুয়া কে তাই ওরা পুজো করে। সেখানেও প্রকৃতি যেন মিশে আছে। গভীর অরণ‍্যের মধ‍্যে পিদুয়ার পুজো দিলে তারা ভূত,প্রেত,দানবের হাত থেকে বাঁচবে।
      এখনতো শ্রাবণ।তাই বোধহয় কাল ওরা অঞ্চু পুজোর আয়োজন করেছে। এই যে প্রকৃতি পুজো,ফসলের পুজো,বিশ্বাস এর সঙ্গে স্রগ্ধরার কোথায় যেন এক টুকরো ভালো লাগা তৈরি হয়েছিল আগেই।এবার কাল যে সেসব বিশ্বাসের ছবি চোখের সামনে দেখবে ভেবেই উদ্বেলিত স্রগ্ধরা ভেবেছিল,আজ না ঘুমোলে কেমন হয়, বারান্দায় বেরোবে বলে দরজাটা খুলতেই...কে যেন ফিস ফিস করে,বাতাসের উদ্দামতায় ঝোরো দাপটে এক ধাক্কায় কপাটে শব্দ তোলে,একা কেঁপে ওঠে শরীর।ছিটকিনি তুলে দেয় সঙ্গে সঙ্গে।চাদরের উষ্ণতায় ধিকি ধিকি নানা ভাবনায় কখন ঘুমিয়ে পড়ে।
----------------------
৪.খুব সকাল সকাল কিচির মিচির হৈ হুল্লোরে ঘুম ভেঙে গেছে অনেক্ষণ।দরজায় শব্দ করে শোভনা যখন এসে ঢোকে ওর ঘরে,বোঝা যায় ওর স্নান হয়ে গেছে।হাতে বোনা এক নতুন বুনটের সুতির শাড়ীতে ফুলো চোখ ছোট নাক আর ফরসা রঙে প্রকৃতি কন‍্যা মনে হচ্ছে,একগাল হেসে জানায়,দিদিমণি,ডাকিনি তোমাকে,হয়তো অনেক রাতে ঘুম এসেছে,আর বাবা "প্রভাতে"র সাংবাদিকের ফোনে অফিস থেকে জানিয়ে এসেছে তুমি আজ ই ফিরছ,আমাদের সঙ্গে আছ।...আহা!নিশ্চিন্তির সুবাস ছড়ালো।রবীন্দ্রনাথের সেই কথা মনে এল,"প্রাচীন হয়েও চির নতুন"।লোকায়ত মানুষের জীবন চর্যা আর মানস চর্চাইতো লোক সংস্কৃতি।এতো ঐতিহ‍্য নির্ভর।এ সংস্কৃতি মৌখিক ভাবে,হাতে কলমে অথবা বংশানুক্রমেই প্রবাহিত হয়।এতো অতীতের প্রতিধ্বনি হয়েও বর্তমানের বলিষ্ কন্ঠস্বর।নিজেকে স্রগ্ধরার অত‍্যন্ত পরিপূর্ন মনে হয়,শোভনা আর গিরিধারী,সতী,ওর বাবা এরা তো সেই সংস্কৃতিকেই বয়ে নিয়ে চলেছে শ্রদ্ধার সঙ্গে।ওর হাতের পাত্র একটু দ্বিধা নিয়ে হাতে নিল স্রগ্ধরা।সঙ্গে সঙ্গে শোভনা বলে ওঠে,দিদি,কাল গল্প করেছিলাম বলে ভেবনা তোমাকে 'ইউ'দিয়েছি,তোমার জন‍্য চা এনেছি,একেবারে গ্রীণ টি।এগুলো বাবার স্টকে থাকে,কত অতিথি কলকাতা থেকে ফোন টোন করে মাঝে মাঝে চলে আসেন তো!এবার একটু লজ্জিত স্রগ্ধরা অপ্রস্তুত।
-নারে,তা ভাবব কেন!
ওদিকে চায়ের গোল মত কাঠের রঙের পাত্র হাতে নিয়ে দুজনে রেলিঙে দাঁড়ায়। নীচে ঝুঁকে দেখে একটু দূরে গাছঘেরা এক বাড়ীর প্রঙ্গণ আর সামনের কাঁচা পাথুরে রাস্তায় মানুষের জটলা,হৈ হৈ।আনন্দের হৈ চৈ দেখলেই বোঝা যায়।জিজ্ঞাসু চোখে শোভনার দিকে তাকাতেই ও বলে,"আরে দিদি,আজ শুধু বিয়েই না।মাদি-পাই-পো-আ অনুষ্ঠান।"-সেটা কি?
-ঐ যে তোমরা নামকরণ অনুষ্ঠান করোনা...ঐরকম নতুন জন্মানো শিশুর নামকরণ অনুষ্ঠান হচ্ছে গো।
তাড়া তাড়ি চা আর মেরি বিস্কুট শেষ করে স্রগ্ধরা।
....চল্ তো শোভনা,একটু দেখি।কাছে যেতে বাধা দেবেনাতো কেউ?
-না না,তা কেন? কাল ইতো যারা বাকি ছিল সকলেই জেনে গেছে তুমি এসেছ,থাকছ আমাদের উৎসব অনুষ্ঠান গুলোয়।
মাঝ উঠোনে দুটো চেয়ার পেতে দিল ওরা।স্রগ্ধরা একা বসলে খারাপ দেখায়, গিরিধারী টোটোও পাশের চেয়ার খানা একটু টেনে নিয়ে বসেছে। শোভনা আর সতী দাঁড়িয়ে দিদিমণির পিছনে।এক এক করে কি হচ্ছে বুঝিয়ে চলেছে ওরা।- ওই যে দেখ দিদিমণি,বাচ্চাকে ঠান্ড জলে স্নান করিয়ে পবিত্র 'ইউ' বা মদ ছুঁইয়ে দিচ্ছে ওরা ওর মুখে।...অজান্তেই স্রগ্ধরার মুখ থেকে "ইস্"কথাটা বেরোয় আফশোসের মত।...আসলে দিদি,এত বিশ্বাস।...ঐ দেখ দিদি,শিশুর মা নিজে হাতে দূর্বা ঘাসের মালা তৈরি করেছেন আর কার্পাস তুলো থেকে নিজের হাতে সুতো কেটেছেন।এর নাম শংভি।স্রগ্ধরা ডায়রীতে লিখে নেয় সঙ্গে সঙ্গে।ঐ সুতো আবার হলুদ রঙে রাঙিয়েছে।দেখ, এর নাম "মাদি'।সুতোয় ব়াধা হশ ঝাটার ক্ষুদ্র অংশ দূর্বা ঘাস,এক খন্ড গোটা হলুদ,তারপর ঐ সুতো শিশুর হাতে বেঁধে দেওয়া হল।আর দূর্বার মালাটি ঐ দেখ,বাচ্চার গলায় পরিয়ে দিল।নামকরণ ও হয়ে গেল। কি নাম দিল রে? এখনিই জানা যাবেনা দিদি।...আর ঐ যে মাকে দেখছনা, ওতো কয়েকদিনের মধ‍্যেই গৃহস্থালির নানা কাজে যোগ দেবে।তখন আবার'বদি-লংমি'অনুষ্ঠান হবে।প্রসূতি মাকে একখন্ড কাপড় গ্রহণ করানো হয়, সে বস্ত্রখন্ডে শিশুটিকে পিঠে বেঁধে সে সংসারে্য কাজকর্ম করবে।
বাবা!....এত নিয়ম!
হ‍্যাঁগো দিদি,অনেকেই ধরে রাখে,আর টোটো সংস্কৃতি,বিভিন্ন ধর্ম ,আচার,পূজা রীতি অনেকেতো জানেইনা।তাই আমরাও পরবর্তীরা এই অনুষ্ঠানগুলোয় সময় মেনে ক্লাস ট্লাস বন্ধ থাকলে চলে আসি,যোগ দিই।যেমন সীমা দিদির বিয়ের জন‍্য এবার আসা।স্কুল হোষ্টেলে বলে এসেছি দুজনেই।
...চল তাহলে সীমাদের বাড়ির ধর্মীয় অনুষ্ঠান দেখে নিই।বাবাকে বল,এরপর ই আমি বেরিয়ে পড়ব সকাল সকাল।
-হ‍্যাঁ দিদি,স্নানতো হয়েই গেছে,আমাদের সঙ্গে একটু খেয়ে নিয়ে বেরিয়ে পড়ুন।সতী বলে ওঠে।

যখন ওরা সকলে টোটো পাড়া প্রাথমিক বিদ‍্যালয়ের পাশ দিয়ে সীমাদের বাড়ীর সাজানো গেট দিয়ে ঢুকলো ততক্ষণে কতগুলো ধর্মীয় পুজোর রীতি আচার,প্রকৃতি পুজো,অঞ্চুর বাকি পর্ব,আর ময়য়ূ দুটোই সেরে ফেলেছে ওরা।দুটোই ঈশ্ পা পুজো। অঞ্চু(ওংজু)ছোট পুজো,আর ময়য়ূ বড় পুজো। সকলেই নতুন জামা পরে আনন্দে ঘুরছে ফিরছে।

আসলে সীমা আর যোগেশ দুজনেই টোটোপাড়ার মান অনেকটাই বাড়িয়ে দিয়েছে,তাই কাইজি আর সমাজের মোড়ল স্থানীয়রা ওদের বিয়ের আগেই ঐ দুটো পুজো করে তারপর এই বিয়ের অনুষ্ঠান আয়োজন করেছে।
পুজোয় নৈবেদ‍্য সাজিয়ে, অতি ভোরে মোরগ-মুরগী বলি হয়ে গেছে।রক্তের ধারা সে চিহ্ন রেখেছে মাটিতে।শোভনা যোগ করে, অঞ্চু পুজো আগেই করে নেওয়া হয়েছে দিদি,উনিশ দিন পর আজ ময়য়ূ পুজো দেখলে তুমি।
     ঘরের ভিতর চাটাইয়ের উপর বসে সীমা।সুন্দর শাড়ী পরেছে।পুরো অনুষ্ঠান দেখা হবেনা,একটু খুঁত খুঁত করছে মন।কিন্তু নিজস্ব নিয়ম রীতি যাই থাক,যোগেশ কিন্তু রেজিষ্ট্রীকরণের ব‍্যবস্থা করেছে,মাদারীহাট হয়ে জলপাইগুড়ির দুজন ম‍্যারেজ রেজিষ্ট্রার উপস্থিত হয়েছেন। দেখে ভালো লাগলো স্রগ্ধরার।ব‍্যাগ থেকে দুটো পাঁচশো টাকার নোট খামে ভ'রে সীমার হাতে দেওয়ার আগে ধান দুব্বো,গোটা পান সুপুরী এগিয়ে দিল সীমার মা,
-আশীর্বাদ করতে বলছে দিদি...শোভনা বলার আগেই দু হাত দিয়ে সেসব তুলে আশীর্বাদ দিল স্রগ্ধরা।সীমা একটু হেসে পা ছুঁয়ে প্রণাম করে।
    টোটোদের সংস্কার বিশ্বাস লোক লৌকিকতা যে একেবারে হারিয়ে যায়নি এতে মন  ভরে যায় ওর। সবচেয়ে ভালো লাগে ওদের ঈশ্বরের নাম থাকলেও কোন আকার নেই,এই বিরাট প্রকৃতিই তাদের ঈশ্বর।
সকলের সঙ্গে বসে সাধারণ ফল প্রসাদ,নৈবেদ‍্য গ্রহণের পর মাংস ভাতের আয়োজনে...সামান‍্য ই মুখে দেয় স্রগ্ধরা।মুখ ধুয়ে ব‍্যাগ হাতে দাঁড়াতেই মাথা ঘুরিয়ে দেখে গিরিধারী দাঁড়িয়ে।শোভনাও এগিয়ে দিতে প্রস্তুত।গাড়ীও যোগাড় করে ফেলেছে গিরিধারী,এ এলাকায় সে যে প্রভাবশালী বুঝতে অসুবিধে হয়না।শোভনা,সতী দুজনেই ভীষণ খুশী দিদিমণি এসেছিল বলে,ওরাও প্রণাম করে স্রগ্ধরাকে।ওর একটা ব‍্যাপার আছে,এক রাত বা একটু বেশীক্ষণ কোথাও কাটানোর পর চলে আসার সময় এলে কেমন যন্ত্রণা হয়।মিলে মিশে ডায়রী ভরা পচুর তথ‍্য আর মনে এই প্রকৃতির ভালোবাসা ভরে সে যখন বেরিয়ে যাচ্ছে টোটোপাড়ার বৌ ঝিয়েরা গৃহস্থালির কাজে ব‍্যস্ত,কেউ কুয়ো থেকৈ জল তুলছে,কেউ কাপড় কাচছে।ওর ই মধ‍্যে উৎসব বাড়ী ফেলে ওদের পিছু পিছু অনেকেই দিদিমণিকে বিদায় জানাতে এসেছে।বড় বড় সুপারি গাছ লম্বা হয়ে ছায়া
দিচ্ছে।অরণ‍্য সঙ্কুল এ টোটোপাড়া অঞ্চল বাড়ছে জন সংখ‍্যায় যেমন,তেমনি শিক্ষায়।গাড়ী যত এগিয়ে চলে স্রগ্ধরার কানে টোটোপাড়ার মেয়ে পুরুষের 'দেমসায়' নৃত‍্য গীতের আওয়াজ জোরালো থেকে মৃদু হতে থাকে।ঢোলকের আওয়াজ ঘুরে ঘুরে এসে শ্রুতি ঘিরে থাকে তার।
বাইরে ততক্ষণে লাল রঙের মারুতি ভ‍্যানখানা তিতিঝোরার স্বচ্ছ জলের নীচে নুড়ি পাথর ছাড়িয়ে,খানিক জল ছিটিয়ে ওপাড়ে হান্টাপাড়া পেরিয়ে হাসিমারার সাদাটে পথ ধরে মাদারীহাটের দিকে চলতে শুরু করেছে..শব্দ উঠছে হুঁস..
কখনো ভোঁস
-------------------
৫.আজ এ গ্রাম তো কাল ও গ্রাম।সংগ্রহণের সংরক্ষণের ঝুলি ভরছেই।অধ‍্যাপক ড: প্রীতম বিশ্বাসকে মনে মনে প্রণাম না জানিয়ে পারেনা।নিজের জায়গা,নিজস্ব উত্তরবঙ্গ,কতটুকু জানে তাকে মাটির মানুষ জন!শুধু পিছিয়ে যাওয়া অন্ধকারে ঢেকে রাখা মাটির সম্পদ গুলো নিয়ে বিত্তবানদের হুল্লোড়।অদ্ভুত বেয়াদপি।কার আগে কে আকাশ ছুঁয়ে দেবে তার প্রতিযোগিতা।অসহ‍্য হয়ে উঠেছে ঐ ফেসবুক পেজ। স্রগ্ধরা ঐ পেজ চম্পক খুলে দিয়েছিল বলে,আর এদিক ওদিক কি হচ্ছে,কে কি কাজ করছে জানার জন‍্য এক আধবার খুলত দিনে  অথবা রাতে।এখন আর ইচ্ছে করেনা।ঢাক পেটানোর জায়গাটা মানুষ পেয়েছে ভালো।অজস্র লাইক।অজস্র কমেন্টস্,এহব পড়তে পড়তে  স্রগ্ধরা কেমন অসার হয়ে পড়ছে ধীরে।নিজের ক্ষমতা,কাজ সব আটকে থাকে,চিন্তায় বিষাদ বাড়ছে শুধু।বাড়ীতে সিরিয়ালের পোকা সমীরণ অসীম আগ্রহে টিভির দিকে যখন তাকিয়ে থাকে,ঠিক সে মুহূর্তে মনে হয় এর একচুল ও যদি সে চম্পক বা তিতিরের পিছনে ব‍্যয় করত!সঙ্গে সঙ্গে সদর্থক ভাবনায় নিয়ে যায় নিজেকে,না না এইজন‍্য ই তো ওরা কত স্বাবলম্বী,কতটা আত্ম সচেতন।তিতিরের জন‍্য এবার ভীষণ কষ্ট হতে থাকে।জানিনা কাল রাতে কি দু:সহ চিন্তা ওদের কুরে খেয়ছে।চম্পকতো একেবারে চুপচাপ।নিষ্পলক তাকিয়ে থাকা,কারোর দোষ না দেখা এক মহৎ ছেলে।ওদের জন‍্য ই এত দৌড়ে বেড়াতে পারে স্রগ্ধরা।এক বছর যাদবপুর তো অন‍্য বছর কল‍্যানী ইউনিভার্সিটিতে পেপারস্ পড়তে যায়।মূলত লোকসংস্কৃতি নিয়ে কাজের প্রায় পঁচিশ বছর পেরিয়েছে।স্কুল ছাত্রী সামলে,ওদের ই সাহচর্যে কি দারুন সব অনুষ্ঠান একের পর এক।ড:প্রীতম বিশ্বাস যে বছর প্রথম জলপাইগুড়ি এলেন,স্রগ্ধরা ওর সহকর্মী রুহাকে নিয়ে ঠিক রাভা এক লোকসংস্কৃতি গ্রুপ যোগার করে ফেলল। অতিথিরা তোরণ ছাড়িয়ে ঢুকছেন রবীন্দ্রভবনে,সঙ্গে রাভা জনজাতির নাচ আর মুখা বাঁশির অপূর্ব আওয়াজ।ড: বিশ্বাস সত‍্যিই অবাক হয়েছিলেন।-কি করে এত অল্পদিনে সবটা আয়োজন করলে?জিজ্ঞেস করেছিলেন।স্রগ্ধরা শুধু জানে উত্তরের জনজাতির বিশাল সম্পদের কথা।নিজস্ব সংস্কৃতি লোকায়ত বৈশিষ্টের কথা।ওদের রীতি,পূজা গান,ভাষা তুলে ধরতে হলে ইচ্ছেটাই তো বড় কথা,তাই কোন উত্তর দেয়নি।শুধু ধীরে বলেছিল,'সঙ্গে থাকবেন স‍্যার'।
      সেই তখন থেকেই চলছে অনুসন্ধান।একে গবেষনা বলে কিনা তলিয়ে ভাবেনি স্রগ্ধরা কোনদিন।ওর নানা কাজের মধ‍্যে যোগীন রায়কে খুঁজে নিয়েসাহায‍্য করে আসা যেমন,সান্তালিখোলায় রুহাকে নিয়ে বেরিয়ে গিয়ে মেচেদের সংস্কৃতি খুঁজে আনা এটাও এক কাজ।
  আজ এতদিন পর হঠাৎই টোটো ছাত্রী দুজন আবার যেন মনের গোপন জায়গাটা ধরে বেদম নেড়ে দিয়েছে।কি কষ্ট,কত কায়িক,মানসিক শ্রমে উঠে দাঁড়িয়েছে,প্রতিষ্ঠা করেছে অধিকার।
ভাবতে ভাবতেই প্রখর আলোর মত সূর্যটা মধ‍্যগগন ভরে থাকে।টোটো পাড়ার ছায়া ছায়া শীতলতা কমে গেছে কখন।এখন গরম লাগছে।মাদারীহাটের মূল‍্যবান কাঠের রক্ষণাবেক্ষণ,গাছগুলোকে কড়া পাহারায় রাখে বীট অফিসার।ড্রাইভারের সঙ্গে গল্প করতে করতে আসে বাকি পথ, যেটুকু জানা যায়।আর একটু পর আলিপুর।নতুন জেলা।...চা খাবেন দিদি?..
নানা ভাই আমার একটু তাড়া আছে।তুমি খেয়ে এসো।পরে বীর পাড়া বা ধূপগুড়িতে ভাল মিষ্টির দোকান এলে দাঁড় করাবে।
-ঠিক আছে ।আমি এক ছুটে যাব আর আসব,পাঁচ মিনিট দিদি।
একা হতেই বাড়ীর জন‍্য ম কেমন ই করে এবাআর।হুট ছুট বেরিয়ে পড়া,কাজ কর্মে এখানে সেখানে আর সবচেয়ে বড় এখনকার যে কাজ ওর সংস্থা করছে রবীন্দ্র গান নিয়ে,বহু ছেলে মেয়ের ভীড়,এর মধ‍্যে শোভনাও হোষ্টেলের মেয়েদের সঙ্গে নিয়ে ওদের অনুষ্ঠান দেখে গেছে রবীন্দ্রভবনে।
ভাবতে ভাবতেই ড্রাইভার ফিরে আসে।এবার সোজা চল ।কোন রাস্তা ধরবে কে জানে!খুব যান জট ইদানীং।ফোন এতক্ষণে কাজ করছে।প্রথমে বেজেই যায় দুবার।সমীরণকে ট্রাই করে পায়না।এবার তিতির।দুবার তিনবার...হুঁ,ঘুম ঘুম জড়ানো গলা।হুম্ মা,...কোথায় গিয়েছিলে তুমি?...একেবারে কাঁদছে দেখ,বোকা মেয়ে,আমি ভালো আছিরে। কাল ভীষণ ভাবে আটকে গেছিলাম।কাজ সেরে ফেরার গাড়ী ছিলোনা।...এখন ও শুয়ে কেন?জ্বর এসেছে নাকি?ভাই কোথায়?...এক নি:শ্বাসে কথাগুলো বলে ওদিকের ফোঁস ফোস শব্দ শোনে।বাইরে তাকায়।...আর কতক্ষণ লাগবে বলোতঝ ভাই?..এইতো বীরপাড়া ম‍্যাডাম,গয়েরকাট দিয়ে ধূপগুড়ি হয়ে বেরিয়ে যাব।আর বাইপাস রাস্তায় বেশীক্ষণ লাগবেনা।আর দেড় ঘন্টা।
    চম্পকের চুপচাপ গম্ভীর মুখখানা এসে ছুঁয়ে যায়।যাক,উড়নচন্ডী হলে কি হয়,মনতো সেই মায়ের ই।....গাড়ীটা ছাড়তেই দুদিকের সবুজ চা বাগান মন ভরে রাখে।যখন ই ডুয়ার্সের আনাচ কানাচ গেছে তখন ই চেষ্টা করেছৈ চা বাগানের মাঝ বরাবর রাস্তা ধরতে।বীরপাড়া,গয়েরকাটা জুড়ে সবুজছ সবুজ।গয়েরকাটা পেরিয়ে যেতেই মনে পড়ছিল হৈ হৈ করে উরশুল লাইন হিন্দী হাই স্কুল আর স্রগ্ধরার সাংস্কৃতিক সংস্থার ছেলে মেয়ে সব মিলে গয়েরকাটায় সাদরি ভাষায় চন্ডালিকা পরিবেশন।কি যে মন ভাল হয়ে যাওয়ার দিন সব।সবুজের দিকে তাকালেই মন অকারণেই ভাল হয়ে যায়।
 শোভনারা কাল স্কুলে পৌঁছে যাবে।বিয়ের অনুষ্ঠান নিশ্চয় ই এতক্ষণে মধ‍্যপথে। রাতে মূল ভোজ পর্ব।ওরাতো প্রকৃতির ই সন্তান।গাছপালা,নদীনালা,পাথরকেইতো দেবতা ভেবেছে তারা।প্রবাহিত স্বচ্ছ ঝোরার জল তারা কখনো নোংরা করেনা।এমনকি,প্রাতকৃত‍্য ও নয়।নদীকে এইযে মাতৃ রূপে পূজা করা এযেন শিখিয়ে দেওয়া সভ‍্য সমাজকে...ভালোবাসো ভালোবাসো।অন‍্যের ধর্মের প্রতি কোন বিদ্বেষ নেই তাদের। শোভনা সতীকে দেখলেই বোঝা যায় বড় স্নেহ কেড়ে নিতে জানে ওরা।পড়াশুনোতেও ভালো।ওরা স্রগ্ধরাকে অনেক গল্প করেছে কি করে মাছ ধরে ওরা,মূল নদী থেকে প্রবাহিত ছোট শাখানদীর মুখ বন্ধ করে টোটোরা মাছ ধরত।মাছেদের নামগুলো ওদের মুখে মিষ্টি শুনিয়েছে।টুপর্চুন ওয়া,তান্ গা(সাটি),জায় ইগা(শোল),জোবেন,দেপ্রেন,আবার কি তাড়াতাড়ি ওরা বলেছে,ডায়রীর পৃষ্ঠায় তবু লিখেছে।...জাসাসি,নিবে,পালগা,বারোবুটি,য়ুঙগা...ইত‍্যাদি।
    কি অদ্ভুত ভাবে শোভনা চোখ বুজে বলেছিল এই প্রকৃতি এই সবুজ থেকেই তো আমরা সব শিখেছি।ওজা পাখির পাতায় ঢাকা উঁচু ঘর বানানো দেখে ঘর বানানো শেখা।কি সুন্দর ওরা পাতার বারান্দা বানায়।উড়ে ঘর ছাড়ার আগেও বারান্দায় দাঁড়ায়,আবার ফিরে এসেও বারান্দায় বসে জিরিয়ে ঘরে ঢোকে।ময়ূরের নাচ দেখে নাচ শিখে নেওয়া,আর গান?বসন্ত বাউড়ির কাছে,আর জানো আমরা ময়ূরকে বলি পেখং,আর বসন্ত বাউড়ির নাম 'পত্র'।....সব লিখেছে স্রগ্ধরা,শুধুকি নিজের জন‍্য!নাতো।সভ‍্য সমাজের সদস‍্য হয়ে উঠছে যে ওরা ,ওইযে স্রগ্ধরার ছেলে মেয়ে,তিতির চম্পক ওরা কি জানবে কখনো?এসব কি নেট ঘেঁটে জেনে। নিতে পারবে,কখনো না।
শিকারের গান ও লিখে এনেছে।বাঘের সঙ্গে বন‍্য প্রণীর সঙ্গে যেন কথা বলছে ওরা।আহা!
               যা-টামু-মেতো পুওয়াআলাগা
               সেনা-হো-মেলাগে দাংতো
                নেদা-সংদা-লামা-চাউযে, 
                মিঠা ও সো হি: বাসো
                ওয়া লাগা-সুদা(বনের রাস্তায় যেতে যেতে ছানা সহ বন মুরগীর দেখা পেল,তাকেও টোটো শিকারী দল সতর্ক করছে,ওহে বন মুরগী তুমি তোমার ছাড়া সব সাবধানে থাকো।তোমার উপরে বিল।বাজপাখি আকাশ থেকে নজর দিচ্ছে)

চলে এসেছে। আকাশটা মুখ ভার করে আছে। কিছুতেই মুখ ভার করে ঢোকা চলবেনা।পরের মোড় পেরোলেই বাড়ির গলি রাস্তা।গাড়ীটাকে বড় রাস্তার মাথাতেই দাঁড় করায় স্রগ্ধরা।উৎসুক পাড়া প্রতিবেশীর উঁকি ঝুঁকি চলেই।সেসব কখনো তাকিয়ে দেখেনি,আজ একটু খচ খচ করছে।চারদিকে চোখ চলে যাচ্ছে।প্রথমেই মাঝুদা,...কি ব‍্যাপারকি বলোতো!বন্ধুটিকে একেবারে হতভম্ব করে দিয়েছ যা হোক।
একটু চুপ করে থেকে বলে,আপনারা হননি?বন্ধুর থেকে বুঝি বেশী রকম ই।এত চিন্তা করবেননা‌। একজন  পুরুষ হলে কিন্তু এত ভাবতেননা,তাইনা?হেসে ফেলে দুজনেই।
আসলে ফেরা হতোনা।দেরীতে পৌঁছনো,গাড়ী নেই...এসব আরকি!
একজন দুজন এগিয়ে আসছিল বটে,খেয়াল করেছে স্রগ্ধরা,একেবারেই তাকায়নি সে,সোজা বাড়ীর সামনে।কলিংবেল বেজে ওঠে বার দুয়েক।
 চম্পক গম্ভীর হলে ওকে কাতুকুতু দিলে বেশ হেসে ওঠে,পালায় ।আজ আর ইচ্ছে করেনা।কেনরে বাবা!এত জবাবদিহির কি আছে,কিছুই বললষবেনা সে,মনে মনে ভেবে নেয়।
চম্পক তালা খোলে,তাকিয়ে থাকে,এবার দুহাতে জড়িয়ে ধরে ছেলে...এক দীর্ঘশ্বাস চুলের উপর দিয়ে বয়ে যায়...।স্রগ্ধরা কি কেঁদে ফেলবে,মুহূর্তে স্টেডি।....চম্পু কি খেয়েছ আজ?দেখ কি এনেছি,বীরপাড়ার মিষ্টি...ইয়া বড় ছানার জিলিপি।দেখ।চম্পক হাত বাড়ায়,ফিক করে হেসে নিয়ে হাঁক দেয়,দিদিভাই....মা এসেছে
সেই ভার হয়ে থাকা শ্রাবণ মেঘ এবার ঝর ঝর জল...গুমোটের পর এইযে বরষণ,এত উত্তরের ই বৈশিষ্ট।
-তিতির,তোকে আজ একখানা শিকারের গান,মানে সাইরার গান শেখাবো।টোটোরা শিকারকে বলে যে 'সাইরা'....দেখ,চার ঘন্টার ওপর জার্নি করে এসেছি,চা খাবো।....
কোথায় গুমোট? তিতির বলে,চা বসাচ্ছি মাম মাম,আগে গানটা গাও দেখি...
শোন্,টোটো ভাষায় বন মুরগীর গান...
         'যা চাউজে চনতুনু ওয়ালাগা
         সেনা হো মেলা সেই দাংতো
         নেদা সুদালামা চাউজে
         মিটাও চো হিংবা সোওয়লা
          সুদা।মিসে নামু সিং সিং পাগা....'
বন‍্য সুর  তখন ভাসে একঘর থেকে অন‍্যঘর।
--------------------------------------------------------------
**সহায়ক গ্রন্থ

১.উত্তরবঙ্গের লোক সংস্কৃতির নানা দিগন্ত: সম্পাদনা,প্রমোদ নাথ,ড:জীবন রানা। ২.তরাই ডুয়ার্সের লোকসংস্কৃতি,:সম্পাদনা,আবদুর রহিম গাজী। ৩.বিশেষ কৃতজ্ঞতা:আমার টোটো ছাত্রীরা ও টোটোপাড়ায় বসবাসকারী মানুষেরা।
'










No comments:

Post a Comment