Wednesday, May 1

ফাল্গুনী সিনহা মহাপাত্রের গল্প




নিমগাছ                                             

গ্রীষ্মের চড়া রৌদ্রে জ্বলে পুড়ে কালি একবোজা ঘাস মাথায় নিয়ে বাড়ি ফিরল। দেখে তার ছেলে লখাই বউয়ের সদ্য বেড়ে দেওয়া ভাত খাচ্ছে তার মেয়েকে নিয়ে।
  ছোট্ট একচালা ঘর। যার চারটি দেওয়াল ইঁট-সিমেন্টের হলেও এসবেসটসের চাল। খুব উঁচুও নয়। বাড়ির পাশে নিমগাছটা আছে বলেই সারাবছর রক্ষে। যার বয়স লখাইয়ের প্রায় সমান। কালির অনাদরের ‘সন্তান’। কালি ভালবাসে ওর উপকারের কথা ভেবে। বউকে এই ক’বছরে কতবার বকেছে ঝাঁট ধূলো গাছের গোড়ায় দেওয়ার জন্য; গাছের গায়ে ঝাঁটা লাগাবার জন্য।

  কালির মরদ বাড়ি ফেরেনা। পাশেই প্রসাদপুরের বাজারে কখন সবজি বেচে, কখনো এটা ওটা করে। নিজের খরচ নিজেই চালায়। তবে কাজের চেয়ে অকাজ করে বেশি। প্রতিদিন দুবেলা চুল্লু না খেলে ওর দিন চলে না। আগে ঐ সব খেয়ে ঘরে এসে কালির অকথ্য গালাগাল খেয়ে কালিকে যাবদা করে পেটাত। কালিও পেটাত। কালিকে কতবার মেরে দিতে গেছে – হয়তো নেশার ঘোরে পারেনি। তবে পুরুষ মানুষ তো বউয়ের হাত বার বার মার খাওয়াটা হজম করতে পারেনি। তাই শেষমেষ ঘর ছাড়া।
  লখাই ফ্যানের গরম বাতাস গায়ে নিয়েও ঘামতে ঘামতে ভাত খায়। দূর থেকে তার খাওয়া দেখলে বুঝতে পারা যাবে না, যে ও ভাত খাচ্ছে! নাকি কোদাল চালাচ্ছে। বাইরে যদিও চল্লিশ ডিগ্রী তাপমাত্রা। লু বইছে অল্প অল্প।

  লখাইয়ের মাথার তাপমাত্রাও কম নয়। ভাল ভাবে মনের থার্মোমিটারে দেখলে হয়তো ধরা পড়তে পারে আশি কিম্বা একশ ডিগ্রী তাপমাত্রার রেজাল্ট। কেননা, কালি আজ বউকে সকালে বাপের বাড়ি যাওয়া নিয়ে কথা শুনিয়েছে।

  লখাই আর পাঁচটা বাঙালি ছেলের মতো স্ত্রৈণ স্বামী – হয়তো ছোটবেলায় লিবোডো চরিতার্থ হয়নি বলেই এ কান্ড! দিনে দুপুরে বউকে নিয়ে দরজা দেয়।

  লখাই কালির দিকে একবার বড়ো বড়ো লাল চোখে তাকায়। কিছু বলেনা। বাকি ভাত প্রায় গোগ্রাসে খায়।

কালিও ছাড়ার পাত্রী নয়। ছেলের চোখের ভাষা বুঝতে পারে। দাঁত বের করে আঁত জ্বালানো হাসিতে ছেলেকে একবার দেখে, ঘাস বোজাটার ওপর বসে পড়ে।

 নিমগাছটার তলা দিয়ে একটা ঠান্ডা বাতাস বয়ে যায়। কালি চোখ বুজে জলের জন্য অপেক্ষা করে। তেষ্টায় অধীর সে এখন।

  বউ জল এনে নামিয়ে দেয় সামনে। ছোট মেয়েটা হাসিমুখে দিদির দিকে তাকিয়ে বলে— ‘দিদি আমি বাত খাচ্চি!’
কালি— ‘খাও। খাও। তুমি ত খাতেই আসেচ।’

লখাই মেয়েটাকে ধমকে বলে—‘খাইলে ভাতগুলা। না বকে।’

  চাড়ি ব্যাপারটা অল্প বয়সে বুঝতে না পেরে আপন মনে ডাল মাখা ভাত খেতে থাকে। হঠাৎ বলে— ‘দিদি। আমি মামাগর গেছলম।’

  কালি আধময়লা গামছা নিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বলে – ‘বেশ করেছ নানি। ই খেনে সব ফুটে শেষ হোক, তুমরা মামাঘরে ভাত খাও। তালেই পেট ভরবেক সবার।’

  লখাইয়ের আর সহ্য হয়না। কালিরও কথার ঝাঁজ বাড়তে থাকে। কিছু যেন একটা না বলতে পারলে ওর সুখ হচ্ছে না। মাঠে ধান সব জলের অভাবে মরছে। আর বেটা ছেলে-মেয়েকে নিয়ে শ্বশুর ঘরে ফূর্তি করছে। কিসের জন্য কালি এতো করবে। একটা পেট এমনি চলে যাবে ওর বিশ্বাস। ব্যাটার দিকে তাকিয়ে একটা আক্রোশের সুরে হুমকার দেয়।

  লখাই এবার আর সহ্য করতে না পেরে ভাতের থাল ছুড়ে ফেলে দেয়। বলে – ‘ধূর শালা! এই সংসারে মানুষ থাকে।’

 কালি সঙ্গে সঙ্গে যেন জ্বলে উঠে। ভাতের থালা ছোড়া ওর সহ্য হয়না। বলে, ‘হ ই সংসারে কী মানুস থাকে! থাকবি যা মানুসের ঘরে। শ্বশুর ঘরে থাকবি যা। পেট ভরবেক তবে।’

 লখাইও গলা চড়ায়। মাকে বেশ কয়েকটা অভদ্র ইঙ্গিত করে বলে, ‘বেশ করব যাব। হাজার বার যাব। আবার যাব। আজই যাব। এখনই যাব। তুই থাক তোর ঘরে। ই খানে কী কেউ মানুষ থাকে।’

 কালি যেন আরও বল পায়। চিৎকার করে বলে, ‘হ হ অমন ফুটানি ঢের দ্যাখেছি। তোর বাপ পারে নাই। তুইও পারবি নাই আমাকে বশ করতে। আমি কারও গতরে খাই নাই। যা যা দেখব কদিন কে খাওয়াই। হুম, পঁদে নাই চাম, আর সেনাপতি নাম।’

 লখাই কথা বলেনা। মেয়েকে হাত মুখ ধুইয়ে জামা পরায়। বউকে রেডি হতে বলে। বউ নিমেষে রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়ে। মনে হয় তৈরি ছিল আগে থেকেই। ছোট্ট মেয়েটা দিদির কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদতে থাকে। লখাই জোর করে বাইকে তুলে নিয়ে বেরিয়ে যায় বাড়ি থেকে। কালি রাগে দুঃখে অভিমানে ক্ষোভে স্তম্ভ হয়ে নিমগাছের তলায় বসে পড়ে। দুচোখ বেয়ে জল আসে। একটা ঠান্ডা বাতাস বয়ে যায় ধীরে ধীরে।



কালি সেদিন ভাত খেয়েছিল কিনা জানিনা। আজ অনেক বছর হল। এখন সে একবেলা রান্না করে। প্রতিদিনের মতো সমস্ত কাজ সেরে রাতে নিমগাছের তলায় শুয়ে ঘুমোয়।

   ব্যাটার বিয়ে দেওয়ার পর থেকে নিমতলায় কালির জায়গা। তাই অভ্যাসে এখনও কালি ওখানে শুয়ে থাকে। শীত গ্রীষ্ম বর্ষা। বর্ষায় টিনের চালাটায় শোয়। কনকনে শীতে একটা কাপড় আঁড় দিয়ে ঢাকা নিয়ে শুয়ে পড়ে। ঝড় হলে ভীজে ভীজেও নিমতলায় শুয়ে থাকে। ঘরে শোয় না। ভাবে ছেলে বউ ফিরে এলে শোবে। নিমগাছের তলায় তাই তার একমাত্র আশ্রয়।

  ছেলের খবর পেয়েছে কিছু কিছু। লখাই দক্ষিণ ভারতে একটা কী কাজ করে। বউ নাতনি তার টাকায় বাপের ঘরে ভালোই আছে। আবার নাকি কিছু একটা হবে। তার জন্য কালি সকাল-সন্ধ্যে ঠাকুরকে ডাকে। ভাবে নাতি হোক। তাহলে নাম রাখবে নিমাই। লখাইয়ের ব্যাটা নিমাই।

কালির সংসারে ওকে সব ছেড়ে গেছে একে একে। স্বামী। ব্যাটা বউ নাতনি। শুধু নিমগাছটা যেতে পারেনি। দুহাতে কালি তাকে যেন আগলে রেখেছে। সব ভালোবাসা দিয়ে। নিমগাছটাও হয়তো তাই। নাহলে গতবার ঝড়ে ভেঙে যাওয়া ডালটা এবার নতুনভাবে গজিয়ে উঠে!

  নিঃসঙ্গ কালি অনেক বছর পর ভর দুপুরে কাঁদতে বসে নিমতলায়। যার কেউ নেই তার দুঃখ হয়তো গাছটা বোঝে। ও শুনেছে গাছের প্রাণ আছে। গাছ শত বাধা ঠেলে সোজা হয়ে বেঁচে থাকতে পারে। সমস্ত আবর্জনা জঞ্জালের মধ্যে নিঃসঙ্গ ভাবে। কালির স্বপ্নের নিমাই যেন এই নিমগাছ। যার কাছে সে সমস্ত মান অভিমান না পাওয়া ব্যক্ত করতে চায়। সমস্ত না পাওয়া দিয়ে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চায়। যে সব ছেড়ে পূর্বপুরুষের ভীটে আগলে রাখবে। কালিকে মাথায় করে রাখবে। কালি সেই ভাবি পুরুষের কথা ভাবে আর অজান্তে নিমগাছটাকে জড়িয়ে ধরে বলতে থাকে এক নাগাড়ে – ‘তুই যাতে লারবি রে নিমাই। তুকে আমি ছাড়ব নাই নিমাই। আমি জানি তুই লারবি। তুই আমার হয়ে থাকবি নিমাই।’ কালি ভাবি কালের স্বপ্ন আর সংশয়ে হাউমাও করে কাঁদতে কাঁদতে জড়িয়ে ধরে আরও জাপটে – আপন মনে বলে – ‘‘তুই লারবি যাতে আমাকে ছাড়ে। তুই লারবি...’’ 


No comments:

Post a Comment