Wednesday, May 1

অরিন্দম রায়ের গল্প







পাকা বুড়ো


নৃপেন বুড়ো ভবিষ্যৎ দেখে, ধংসাত্মক ভবিষ্যৎ। বুড়ো অনুভব করে তার রক্ত জল করা সংসারটি যোগ্য উত্তরসূরির অভাবে বোধয় টিকবে না। সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে বুড়োর চিন্তা বাড়ে তার ঝুলে পড়া চামড়ার শতজীর্ণ ভাজগুলোর মতো। কিন্তু চলার শক্তি না থাকলেও বুড়ো চিন্তা এবং বলার শক্তি হারায়নি। সকাল থেকে টিনের ঘরের পিছনের বাঁশের চাংড়ায় বসে সে তার অযোগ্য উত্তরসূরিদের সতর্ক বার্তা দিয়ে যায়- ‘আজিকার ভালে ভাল নাহয় রে বাও ভাল আছে কাইল আর নয় মাসতে না উঠবে মুখত খিসিড়ি কালাইর ডাইল।’ 
                                       
বুড়োর প্রতিদিনের পাঁচালি পাঠ একান্নবর্তী পরিবারে গা-সওয়া হয়ে উঠেছে। বাড়ির বৌ-ছেলে-নাতি-নাতনি কেউ বুড়োকে তেমন পাত্তা দেয় না। নৃপেন বুড়ো এ অবজ্ঞা বুঝতে পারে। রাগে চৈত্রের টিনের মতো গরম হয়ে ওঠে তার শরীর, নড়তে না পারা সেই গরম টিনে কেউ ইচ্ছে  করে গা ঠেকায় না। সকালের এক কাপ চা থেকে শুরু হয় বুড়োর চণ্ডীপাঠ; চলে শুতে যাবার আগ পর্যন্ত। দিনে দুই একবার করে সেই আসরে যোগ দেয় প্রতিবেশী লালচাঁদ,  প্রাণেশ্বর, কান্ত বুড়োরা। প্রাণেশ্বর বুড়োটা প্রতিদিনই আসে, আর আসলেই মেজ ছেলের মেয়ে নীলার ডাক পড়ে-‘দুই কাপ চা করতো রে চেংরি।'

 এটা বুড়োর দেওয়ানি গিরির অভ্যাস। সারা জীবন যে মানুষটা অর্ডার দিয়ে আসছে  দু-কাপ  চায়ের অর্ডারেও তার খানিকটা আভাস ফুটে উঠে। নীলা রাগে গজ গজ করতে করতে পাটকাঠি ভাঙে আর বিড়বিড় করে বলে-‘ মরার বুড়াটা মরেও না।’
                                             
বাড়ির বাইরে থেকে বুড়ো আঁচ করে নাতনির রাগ। এবার একটি জামা কিনে দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়েও দেওয়া হয়নি তাই তার এই রাগ স্বাভাবিক। নৃপেন বুড়ো দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে। একটু পড়ে চা আসে, চায়ের কাপ দুটো জোরে নামিয়ে রেখেই নীলা চলে যায়। সেই চায়ের ধোঁয়ায় নৃপেন অতীত দেখে।

একদিন বুড়োর বাড়িতে কাজের লোকের অভাব ছিল না। চা-জল খাবারের পালা লেগেই  থাকত একের পর এক লোক সমাগমে। আজকের এই দিনটাকে বুড়ো অতীতের দিনগুলোর সঙ্গে মেলানোর চেষ্টা করে যে দিন গুলোতে তার কথায় বাঘে গরুতে এক ঘাটে জল খেত।  সবার কাছে দেওয়ানি বলে পরিচিত লোকটির সামর্থ্য বার্ধক্য যেন খর্ব করে দিয়েছে। সহায়হীন  একাকীত্ব আর ছেলেদের দায়িত্বহীনতা তাকে কাতর করে। চোখের সামনে এই অরাজকতা দেখতে না পেরে বুড়ো ব্যর্থ আস্ফালন করে যায়। নৃপেন বুড়ো প্রাণেশ্বরকে বলে-‘দ্যাখরে প্রাণেশ্বর মুই না মইরতে মানষিলা মোক ভূত বানাইল রে!’
                                                 
‘কি করবুরে দাদা, শ্যাষকালে এলা বেটা বউয়ের কথা শুনিবারে নাইগবে; না হইলে আরও কপালত দুঃখ আছে। এলাতো তাও চাইলে এক কাপ চা ঢাকলাউ করি দিয়া যায় নচেৎ হোকনাও না পাবু।’                                                                                    বুড়ো গলায় বিষাদের সুর এনে বলে-‘মুই মোর বেটালাক সংক্ষেপে লাখোটিয়া বানে থুছুং রে, কিন্তু শালার ঘর রাখির পাবে নারে! আরে বানার জল আর বাপের সম্পত্তি একে রে প্রাণেশ্বর, বেশি দিন থাকে না।’
                                                                                     ‘তুই হিল্লা কথা না কইস রে দোয়ানী। মানষি কবে বুড়াটা শেষ বয়সে ছাওয়া-পোয়ালাক অভিশাপ দিবার ধইরচে।’                                                                               ‘পিতা মাতার আশীর্বাদ খাও বাছা দুধ ভাত’-হিল্লা অভিশাপ না হয় রে প্রাণেশ্বর; অভিশাপ না হয়। এইল্ল্যা যে হবে মুই চৌকের সামনে দেখির ধরছুং। কথাটা তুই মিলি নিস দেখিস এই  বুড়াও যাবে এই বাড়ির ভিটাত ঘুঘু নাইচবে।’
           
দুপরের রোদ মাথার ছায়াকে পায়ের নীচে আনলে প্রাণেশ্বর চলে যায়। নৃপেন বুড়ো  বাঁশের  চাংড়ায় বসে স্মৃতি আওড়ায়। রাস্তায় চলতে থাকা লোকগুলোকে দেখে আর ভাবে এই সংসারটা তার তিলে তিলে গড়া, কত সুখ-দুঃখ এর সাথে জড়িয়ে। সংসারটার ভাবি আশঙ্কার কথা ভেবে বুড়ো তার বয়সের কথাও ভুলে যায়।       তিনটা ছেলের একটাও বাপের মতো হয়ে ওঠে নি। সবার ছোট জিনিসের প্রতি লক্ষ্য। এতো বড় একটা সংসার চালাতে গেলে যে একটু বড় করে ভাবতে হয় সেটা কারো মাথায় নেই। বড় ছেলেটা হাটুরে। সে বলে ‘আমি মাছের তেল দিয়ে মাছ ভাজি।’- ছোটো ছেলেটা হাতুড়ে ডাক্তার। সে সারাদিনের ডাক্তারির টাকায় আখের গুছায় আর বৌ কে খুশী করে। খেটে মরে মেজো ছেলেটা। সারাদিন গাধার খাটনি খাটে আর বিড়ি টানে। সে সাদাসিধে, তাকে নিয়ে বড় ভাবনা করা যায় না। তার প্রতি বুড়োর মায়া আছে, তাই শেষ বয়সে বুড়ো তারই দিকে গরেছে। সবচেয়ে ক্ষোভ বুড়োর পরের বেটি গুলোর প্রতি। বৌ দের আচরণ একেবারেই সহ্য হয় না তার। বুড়ো থেকে থেকে বলে ওঠে--‘কাঙ্গালের ছাওয়ার ঘর সংসারটাক শ্যাষ কইরলেক। ভাতারের সাথে একে পাতত বসি খায়। হিল্লাক ত্রিস্যকুলে আইটবে না।’

বুড়োর এ রাগ অসঙ্গত নয়। চল্লিশ বিঘা জমি, বাগান, তিন তিনটে পকুর ছেলেদের নামে করে দিয়েও বুড়োর কপালে আজ চায়না ধানের মোটা ভাত জোটে। অথচ ভোগধানের ভাত ছাড়া এই বুড়ো একদিন খেত না। সঙ্গত কারনে নৃপেনের রোষের আগুন থেকে  কেউ বাদ যায় না। সেদিন বড় নাতি বড়শি নিয়ে পুকুরে মাছ ধরতে যাচ্ছিল। আড় চোখে ক্ষীণ দৃষ্টি মেলে বুড়ো দেখে আর বলে-‘নেও মুইও মরিম দিঘিও না শুকাবে, ততদিন খেয়া নেও দাদার ঘর।’ 

আজি এক বছর হল পুকুরে মাছ ছাড়া নাই। কিন্তু রাজার ছেলেদের ভালো মন্দ না হলে খাওয়া হয়না। এসব চোখের সামনে যতই দেখে ততই নৃপেনের অসহ্য বোধ হয়, আর সইবেই বা কেন সম্পত্তি তো আর তারা করেনি যে এর মর্ম বুঝবে । কান্ত বুড়ো কাছ থাকে একটা বিড়ি নিয়ে ধরিয়ে নৃপেন বলে-‘তিনটা বেটার একটাও মোর সাথে বসি একনা পরামর্শ নেয় না, পুঁছেও না বাবা কেমন আছিস কি কোনো!’

বুড়োর চোখে জল আসে। পরক্ষণেই নীলা কে ডেকে বলে-‘দিদি এক কাপ চা করত।’     নীলা আসে রাগ ভুলে। নৃপেন বুড়ো নাতনির চোখে ভবিষ্যৎ দেখে; অজানা ভবিষ্যৎ।

আজ সারাদিন ধরে বুড়োটা বকেই চলেছে শ্রাবনের অবিশ্রান্ত ধারার মতো। এ ধারায় কেউ ভিজতে চায়না জ্বর হতে পারে বলে। কিন্তু এ ধারা জমিকে যে চাষ যোগ্য করে দিয়ে যায় সেদিকে কার খেয়াল আছে। প্রাণেশ্বর সত্যর বাড়ি আসে, দেখে বুড়টাকে নিয়েই ছেলে-বৌ রা কথা বলছে। প্রাণেশ্বরকে দেখে বড়ছেলে সত্য বলে-‘দেখতো কাকা বুড়াটা মানষির আগত কি কি কয়, মানষি কবে হামা বোধয় বুড়াটাক দেখি না।’

   
প্রাণেশ্বর বুড়ো হেসে বলে-‘আরে নেও নেও কয়টা দিন আর বাঁইচবে সহ্য কর। জানেন না আম পাকলে মিঠা আর মানষি পাকলে তিতা।’


No comments:

Post a Comment