Wednesday, May 1

মণিদীপা দাসের গল্প




টানাপোড়েন


(১)

"চলো রাই খেয়ে নেবে চলো।"

"না আআ.. আমি যাব না। তোমরা খাওগে। আমার ক্ষিদে নেই।"

"কেন মিছিমিছি রাগ করছ রাই? সামান্য একটা বিষয় নিয়ে এত রাগ করার কোনো মানে হয়, বল?"

"কোনটা সামান্য বিষয়? তোমার মায়ের আজকের আচরণ টা? তোমার কাছে সব কিছুই তো সামান্য বিষয়.. আমার মোটেও সামান্য লাগছে না।"

" ঠিক আছে ।আগে খেয়ে নাও। তারপর এ নিয়ে কথা হবে। "

"না আমি কিছুতেই খাব না। তোমার মা আমাকে যা খুশী তাই বলবেন আর আমি সব সহ্য করব তুমি তা ভাবলে কিকরে? "

বেডরুম থেকে বেরিয়ে সামনের ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ায় ঋষভ। একটা সিগারেট ধরিয়ে চুপ করে ভাবতে থাকে পুরো ঘটনাটা। কিসের থেকে যে কি হয়ে যায় মা আর বউয়ের মধ্যে সে বুঝেই উঠতে পারে না। আজ মাত্র দু'মাস হল তাদের বিয়ে হয়েছে। এই দু' মাসে শাশুড়ি বউমার অশান্তি এমন জায়গায় গিয়ে পৌঁছতে চলেছে যে সে রীতিমত উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে। কাকে সামলাবে বুঝতে পারে না। আশ্চর্যের বিষয় এই যে দুজনেই সমানে তাকে দায়ী করে চলেছে। অথচ ঘটনার যখন সূত্রপাত ঘটে সে তখন বাড়িতে থাকেই না।

ঋষভ অফিস থেকে ফিরলে কোনো দিন মা দরজা খুলে দেয়। কোনো দিন রাই। যেদিন মা দরজা খোলে সেদিন ঘরে গিয়ে রাইয়ের গোমড়ামুখ দেখে আর যেদিন রাই খোলে সেদিন মা মুখভার করে সোফায় বসে থাকে। কি আশ্চর্য ব্যাপার! অথচ এই রাইকে তো মা- ই  পছন্দ করেছিল ছেলের বউ হিসেবে। বাবা তো বেশ কয়েক বছর ধরে প্রায় শয্যাশায়ী বিভিন্ন অসুখে। মা বাবা ছেলের সংসারে আছে একজন আয়ামাসী। আর ঠিকে কাজের লোক আর রান্নার মাসী। রাই আসার পর একজন সদস্য বাড়ল।

 (২)

"মা তুমি কাল বলেছিলে না কি একটা কাজ আছে ব্যাঙ্কে.."

"না না আমি কিছু বলিনি। কিচ্ছু বলতে চাইনা আর.."

"এরকম করে বলছ কেন? তুমি তো বলেছিলে সকালে। তখন আমার অফিসে যাওয়ার তাড়া ছিল তাই শুনতে পারিনি।"

"আমার কোনো কথা শোনারই  কি সময় তোমার এখন হয় বাবু? এখন তো তুমি শুধু একজনের কথাই শোনো। বাড়িতে আর কেউ আছে নাকি সে ছাড়া? "

" ধুর! তুমি অকারণে রাগ করছ মা। কি হয়েছে বলতো? "

" কেন কি হয়েছে তুই জানিস না? নাকি সব জেনেবুঝেও না জানার ভান করছিস রে? "

" আচ্ছা মা সারাদিন কি আমি বাড়িতে ছিলাম বলো? হ্যাঁ এটা বুঝতে পারছি যে তোমার আর রাইয়ের মধ্যে কিছু একটা হয়েছে। কিন্তু কি হয়েছে সেটা কিকরে জানব বলো? "

" কেন রে? তুই শুনতে পেলিনা তোর সামনে তোর বউ আমাকে যা নয় তাই বলল? "

" হ্যাঁ সেটা শুনেছি। আর তুমিও তো ওকে অনেক কিছু বলে দিলে তাইনা? "

" ওওও! এখন থেকেই বউয়ের পক্ষে চলে গেছিস? ভালো। ভালো। খুউউউব ভালো ।এটাই তো আমার পাওয়ার ছিল রে! "

" উফ্ তোমাদের নিয়ে আর পারিনা মা। আমি কারোর পক্ষেই কথা বলছিনা কিন্তু এটা তো সত্যি যে তোমরা দুজনেই দুজনকে অনেক কথা বলেছ? আমি বাড়িতে ফিরে কিছুটা শুনেছি। কিন্তু কি হয়েছে তাতো ভালো করে জানিনা। আটটার সময় বাড়িতে ঢুকেই তো তোমাদের ঝামেলা দেখলাম। তারপর আমি ফ্রেশ হলাম ।বাবাকে তুমি রাতের খাবার দিলে। তুমি তোমার সিরিয়াল দেখলে আর রাই আমাকে এককাপ চা দিয়ে ঘরে ঢুকে গেল। তারপর খাবার টেবিলে তোমার আর রাইয়ের কিসব কথা কাটাকাটি হল। এখন রাই বলছে সে খাবেনা আর তুমি তোমার ঘরে আলো নিভিয়ে শুয়ে রয়েছ। কি যন্ত্রণা বলতো? "

" শোনো বাবু তোমার বউ আমাকে যা খুশী তাই বলবে তা কিন্তু আমি কোনোমতেই সহ্য করতে পারব না। এটা আমি পরিষ্কার করে বলে দিচ্ছি। "

অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে ঋষভ। দুজনেই একই রকম ডায়ালগ ঝাড়ছে কিকরে? অদ্ভুত ব্যাপার তো! বিয়ের পর থেকেই তো ঋষভ দেখছে দুজনের মধ্যে ঝামেলা লাগতে সময় লাগে না। তা বলে দুজনেই একরকম অবস্থানে চলে যাচ্ছে কিকরে? এই নালিশ আর পাল্টা নালিশ নিয়ে কিকরে চলবে? এরকম ভাবে চলতে থাকলে তো তার অবস্থা টাইট হয়ে যাবে। কত সকালে বেরোতে হয় অফিসে। তাড়াতাড়ি রাতে ঘুমিয়ে পড়তে হয়। কাজের যথেষ্ট চাপ। অফিস থেকে ফিরে বড্ড ক্লান্ত লাগে। এসে কোথায় একটু রেস্ট নেবে, একটু শান্তি পাবে, তা নয়, এসব কি উৎপাত শুরু হল কে জানে?

 (৩)

"শোনো মা আমি কাল বাড়ি যাচ্ছি। এই বাড়িতে আর থাকতে পারছি না। ঋষির মা যা আরম্ভ করেছে না.. উফ্!"

স্নান করে বাথরুম থেকে বেডরুমে ঢোকার মুখে রাইয়ের অভিযোগ শুনে ফেলল ঋষভ। মোবাইলে কথা বলছে নিজের মায়ের সঙ্গে। খাট থেকে নিজের জামাকাপড় নিয়ে মায়ের ঘরে ড্রেস আপ করতে ঢোকে ঋষভ। এসব যে হবে জানাই তো ছিল। ওই ঘরের কাছে যেতেই কানে এল," শোন ঋতু, তোর বাড়িতে কাল যাব ।আর ভাল্লাগছে না রে, তোর বউদি যা শুরু করেছে না.. এখানে আমি বোধহয় থাকতে পারব না।"

খানিক হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে গেল ঋষভ। বেরোনোর টাইম হয়ে গেছে ।ডিনার টেবিলে তাকিয়ে দেখল, তার খাবার দেওয়া হয়েছে কিন্তু সেখানে কেউ নেই। তার স্নান করে বেরোনোর সময় টুকুতে যে যার মত কাজ সারতে চলে গেছে। বড্ড অসহায় লাগছে আজ। পুরুষ মানুষ হওয়ার কি জ্বালা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে সে।

অফিসের লাঞ্চ করতে করতে একটু অনলাইন হয়েছিল ঋষভ ।ফেসবুক খুলতেই চোখে এল, রাইয়ের ওয়ালে কয়েকটা পোস্ট। এক ঘন্টার তফাতে তিনখানা --- "শ্বশুরবাড়ির জন্য সব করেও কারোর মন পাওয়া যায় না।" একশো লাইক ।আশিটা কমেন্ট ।
" শাশুড়িরা শুধু নিজের মেয়েকেই মেয়ে ভাবে।
পরের মেয়ে আপন হয়না।
আসল গলদ তো স্বামী নামক প্রাণীটার,
বউয়ের দোষ চোখে পড়ে, মায়েরটা পড়েনা। "---বাহাত্তর লাইক, দুশো কমেন্ট ।
" ঘরের বউয়ের নির্যাতন কারোর চোখে পড়ে না। রাস্তায় মহিলারা নির্যাতিত হলেই সকলের কত কষ্ট!!! "---এই পোস্ট টা দেখে সকলে অনেকটা সতর্ক। তাই মাত্র আঠেরোটা লাইক আর তেত্রিশটা কমেন্ট।

প্রথম দুটো পোস্টে ঋষভের আত্মীয়দের অনেকেরই প্রতিক্রিয়া দেখা গেল। মাথাটা ঝিমঝিম করতে লাগল তার। এসব কি করছে রাই? ওর কি মাথা খারাপ হয়ে গেল? মাথাটা টিপে ধরে চোখ বুজে একটু বসতেই জ্যেঠিমার ফোন, "হ্যাঁ রে কি খবর তোর? ব্যস্ত নাকি? তোর টিফিন টাইম দেখেই ফোন করলাম রে.."

দুটো তিনটে কথার পর জ্যেঠিমা বললেন, "শোন না ঋষি, ঋতু আজ ফোন করেছিল, তোর মায়ের সাথে নাকি আজকাল তোর বউয়ের.."

"আমি এখন রাখছি জ্যেঠি। পরে ফোন করব" ---ঝট করে ফোনটা কেটে দেয় ঋষভ। ভেতরটা কেমন যেন করছে। মা আর রাই দুজনেই বড্ড বাড়াবাড়ি করছে।

 (৪)

"শোনো বাবা ঋষভ, তোমার মা কিন্তু যা করছেন ঠিক করছেন না। আমার মেয়ে বলে এরকম আচরণ! ওনার তো নিজেরও একটা মেয়ে আছে। কিকরে পারেন আমার মেয়ের সাথে এরকম করতে? অবশ্য শাশুড়িরা এরকমই হয়। কিন্তু তুমি? তুমি কেন চুপ করে থাকছ? কেন তোমার মাকে সামলাচ্ছো না? তুমি তো রাইয়ের স্বামী। ওর ভালো মন্দের দায়িত্ব তো আমরা তোমার হাতেই ছেড়ে দিয়েছি ভরসা করে। তাইনা? "
এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে একটু বিরতি দিলেন রাইয়ের মা।

" দেখুন, আমি সারাদিন বাড়িতে থাকিনা। চাকরির চাপ যথেষ্ট। সেটা আপনারা জানেন। ক্লান্ত হয়ে বাড়িতে ফিরে এসব ভালো লাগেনা। রাইয়ের সাথে মায়ের রোজ কিকরে গন্ডগোল হচ্ছে আমি নিজেও বুঝতে পারছি না। আমি চাই দুজনেই একটু মানিয়ে নিক। ঘরোয়া ব্যাপারে আমি থেকে কি করব বলুন তো? "

" ওসব বললে তো চলবে না বাবা! তোমার মা সেদিন বলেছেন যে রাই নাকি শুধু আমাকে নিয়েই আমার, তোমার আর রাইয়ের ছবি ফেসবুকে পোস্ট করে। ওখানে তোমার মায়ের জায়গা নেই কোনো। উনি তোমার জন্ম দিয়েছেন আর ওনার ছবি নেই এটা ওনার খারাপ লেগেছে। আমি তো বাপু এতে দোষের কিছু দেখি না। আমি তো রাইয়ের মা। আমিও তো আমার মেয়ের জন্ম দিয়েছি তাইনা? আমার ছবি দিলে সমস্যা কোথায় তাতো আমার মাথায় ঢুকছে না। "

" ফেসবুকের ছবি মা কিকরে দেখল? মা তো ওসব করতে পারে না? "

" নিশ্চয়ই তোমার বোন লাগিয়েছে। "

লজ্জায় মুখ নীচু করে ঋষভ। এই কথাটায় যে যুক্তি আছে সেটা সে জানে। দু'মিনিট পর বলে, এই কাজটা যে ঠিক হয়নি সেটা আমি মানছি। কিন্তু আজ রাই ওর নিজের ওয়ালে যে পোস্ট গুলো করেছে তাতে কি আমার সম্মানটা রইল? আমার মা যদি অন্যায় করে থাকেন তাহলে কি রাইকেও অন্যায় করতে হবে? সমস্ত রিলেটিভদের মধ্যে যে জানাজানি হয়ে গেল। এটা কি ঠিক হল? "

" ওমা তুমি দেখছি উত্তর টা রেডি করেই রেখেছিলে! খুব তো মায়ের পক্ষে কথা বলছ বাবা! আচ্ছা শাশুড়ি যদি বউমাকে নির্যাতন করে তাহলে সেটা নিয়ে তো লোকে নানা কথা বলবেই। "

" আপনার কি মাথা খারাপ হয়ে গেল? আপনার মেয়ের বয়স কম হতে পারে কিন্তু আপনার কাছ থেকে আমি এই কথা আশা করিনি মা। এই বিষয়টা কি নির্যাতনের মধ্যে পড়ে? "

" অবশ্যই পড়ে। তোমার মা এরকম অনেক অনেক কথা রোজ বলেন। আমার মেয়ে আমাকে সব বলেছে ।এটাকে মানসিক নির্যাতন বলে।"

"আপনার মেয়ের বিয়ে হয়েছে মাত্র দু'মাস হয়েছে। এর মধ্যে অষ্টমঙ্গলার পর এখানেই এসে ছিল। তারপর এখান থেকেই আমরা হানিমুনে গেছি। হানিমুন থেকে ফিরে ও এখানেই ছিল। প্রায় মাসখানেক তো আমাদের বাড়িতে ছিলই না। তারপরের মাসে দিনপনেরো ওখানে থেকেছিল। তারপর আবার এখানে এসেছিল। ওই মাসের শেষ সপ্তাহে আবার ওই বাড়িতে যায়। আর এই মাসের দিন দশেক ওখানে রয়েছে। এর মধ্যে আমার মা ওকে মানসিক নির্যাতন করে ফেলল? "

" নিশ্চয়ই করেছে। আমার মেয়ের সাথে এসব অন্যায় আমি বরদাস্ত করব না এই আমি বলে রাখছি। "

" আর আমার বিরুদ্ধে কি অভিযোগ আছে আপনাদের? "
" না না। তুমি ওরকম করে বলছ কেন? তুমি তো খুব ভালো ছেলে। শুধু নিজের মাকে একটু শাসন করতে হবে বাবা। তুমি একটা শিক্ষিত ছেলে হয়ে যদি বউয়ের সম্মান রক্ষা করতে না পারো তাহলে কিকরে চলবে, বলো? "

" তাহলে আমি আজ উঠি। দেরী হয়ে যাচ্ছে। "

" মিষ্টি গুলো তো পড়েই রইল। খেলে না তো কিছুই। আমি যে তোমাকে অফিস ফেরত এই বাড়িতে আসতে বলেছি এটা রাইকে বলতে যেওনা কিন্তু। "

 (৫)

"এত দেরী হল যে? তিনি কোথায়?"

"একটু কাজ ছিল আমার । কার কথা বলছ?"

"কার কথা আবার? তোমার বউয়ের কথা বলছি। ঘন্টা তিনেক আগে সাজুগুজু করে কোথায় যেন বেরিয়ে গেল। ভাবলাম তুই অফিসফেরত ওকে নিয়ে কোথাও ঘুরতে বেরিয়েছিস।"

"সত্যি মা। তোমরা পারোও বটে! মনে মনে কত কিছু কল্পনা করে নাও। আজ তো সারাদিনে রাইয়ের সাথে আমার ফোনে একবারো কথা পর্যন্ত হয়নি। "

" সে তো আমার সাথেও হয়না। আমি তো বুড়ো হয়ে গেছি রে। এই আমাকেই তো স্কুল থেকে ফিরে এসে জড়িয়ে ধরতিস। এখন তো কিছুই মনে পড়ে না। "

" কেন এরকম করে বলছ মা? চাকরি পাওয়ার আগে পর্যন্ত তোমার আর বাবার সব কথা শুনে চলেছি। চাকরি পাওয়ার পর ঋতুর বিয়ের জন্য তোমাদের সাথে সাথে সমস্ত কিছু করেছি। তারপর তোমার পছন্দেই রাইকে বিয়ে করেছি। কোনো দিন কি নিজের ইচ্ছেতে কিছু করেছি বলো? "

" কেন আমরাও কি তোর জন্য সবকিছু ত্যাগ করিনি? তোদের পড়াশোনা, বিয়ে, ভবিষ্যৎ সবকিছু গুছিয়ে দিইনি? এত কথা শোনাচ্ছিস যে বড়? "

" উফ্ মা তোমার সাথে তো কথাই বলা যায় না দেখছি। কি বললাম আর কি বুঝলে বলতো? "

" হ্যাঁ হ্যাঁ এখন তো মাকে খারাপ লাগবেই। সুন্দরী বউ ঘরে এসেছে। তার পা চাট বসে বসে। "

" ছিঃ মা! তোমার মাথাটা খারাপ হয়ে গেল নাকি?"

অসহ্য খারাপ লাগায় ভিতরটা ভরে যায়। ঘরে ঢুকে দ্রুত জামাকাপড় ছেড়ে বাথরুমে ঢোকে ঋষভ। শাওয়ারের নীচে দাঁড়িয়ে নিজেকে ঠান্ডা করতে থাকে। রাগে দুঃখে চোখে জল এসে যায়। মনে পড়ছে, টিভি তে কতবার দেখেছে, ধর্ষিতা নারী শাওয়ারের তলায় দাঁড়িয়ে নিজেকে ধুয়ে যাচ্ছে আর কাঁদছে। ওই পরিস্থিতিতেও ওদেরকে কত সুন্দর দেখায় কিকরে কে জানে! চোখের জলের ফোঁটাগুলো মুক্তোর মত লাগে। সবকিছু কত যত্ন করে স্টুডিওতে বানায়। কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনো ছেলের করুণ পরিস্থিতি এভাবে কেউ তুলে ধরে না। ছেলে মানেই কারোর পুত্র। কারোর স্বামী। দু'পাশ থেকে চাপ খেতে খেতে তাদের যে কি পরিস্থিতি হয় তার খবর কে রাখে?

 (৬)

আজ রাতের খাওয়া একটু দেরী করেই হল। রাই ঘরে ফিরেছে ঋষভ ঢোকার ঘন্টা খানেক পরে। সাথে কিছু প্যাকেট। বোধহয় কিছু কেনাকাটা করেছে। তাই রাতের খাওয়া শেষ হতে হতে এগারোটা বেজে গেল।

বাবাকে একটা ওষুধ দিয়ে এসে ঋষভ বিছানায় শুয়ে পড়ল। কাল সকালে উঠে অফিসের তাড়া আছে।

ঘুমটা এসে গিয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই ভেঙে গেল। রাই ব্যাগে জামাকাপড় গোছাচ্ছে। মনে হচ্ছে কালই বাপের বাড়ি চলে যাবে।

"তুমি কি কাল ওবাড়িতে যাচ্ছ নাকি?"

"হ্যাঁ"

"কই আগে বলনিতো?"

"তোমার বোঝা উচিৎ ছিল। তুমি কি ভেবেছ এখানে পড়ে থেকে আমি তোমার মায়ের কথা শুনব?"

"তুমি এভাবে কেন কথা বলছ রাই? আর আমাদের মধ্যে প্রতি মুহূর্তে মা চলে আসে কিকরে?"

"তোমার মা তো চান যে আমি এখানে না থাকি ।আমাকে তো সহ্যই করতে পারেন না। এভাবে চলতে পারে না আর বুঝেছ? "

" আমি সত্যিই বুঝতে পারছি না তোমাদেরকে কিভাবে সামলাবো? তোমরা একজনও তো আমার কথা শুনছ না। শোনো একটা দিন থেকে যাও। আমি কাল মা আর তোমার সাথে একসঙ্গে এ নিয়ে আলোচনা করব। দরকার পড়লে কাল আমি অফিস যাব না। কিন্তু তুমি প্লিজ এভাবে চলে যেওনা।"

" তুমি কি করবে? তুমি তো একটা ভেড়া। তোমার মায়ের কথায় চলো। আমি কে? বউকে কিভাবে যত্ন করতে হয় তা তো জানোই না! আমার মা অবশ্য বলেছিল যে শাশুড়ি জিনিষটা এরকমই হয়। মা চেয়েছিল যে আমার যেন শাশুড়ি না থাকে। আমি বোকার মত তোমাকে দেখে গলে গেলাম। তোমার মায়ের মিষ্টি মিষ্টি কথায় ভুলে গেলাম। তাই আজ এই অবস্থা! "

" তুমি একথা বলতে পারলে রাই? আমাকে এতটা হার্ট করতে তোমার এতটুকু বাধল না? "

" না বাধল না। আমি তোমার মায়ের সাথে থাকতে পারব না। এখানে আমি আমার মত করে থাকতেই পারিনা। উনি যখন যেটা বলবেন সেটাই করতে হবে। এটা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমি কোনোদিন এভাবে চলিনি। আমার ওপর দিয়ে কেউ কখনো কথা বলেনি। আমি আমার বাবা মা ছাড়া কিছু ভাবতে পারিনা। আমি ওদের সাথেই থাকব। শাশুড়ি জিনিষটা রিয়েলি বড্ড বাজে। একটা ব্যাড এক্সপিরিয়েন্স হল আমার। "

আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ে রাই। পাঁচ মিনিটের মধ্যে ঘুমিয়েও পড়ে। বিছানায় খানিকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে শুয়ে থাকার পর আস্তে আস্তে উঠে গিয়ে ব্যালকনিতে দাঁড়ায় ঋষভ। রাত দেড়টা বেজে গেছে। নিঝঝুম পাড়ার গলিতে একটা কুকুর কেঁদে যাচ্ছে একটানা। ছোটবেলা থেকে ফিরে দেখতে লাগল ঋষভ নিজের জীবনটা। কোনো দিনই কাউকে জোর করতে পারেনি। মা বাবা বোন সবাই তো তাকে নিজেদের ইচ্ছেমতো চালিয়ে গেছে। বাবার ইচ্ছেতে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া। মায়ের ইচ্ছেতে চাকরিটা কলকাতাতেই নেওয়া । বোনের ইচ্ছেতে এই পাড়ার ফ্ল্যাট। পরিবারের দেখা সম্বন্ধে বিয়ে। তারপর একটু একটু করে চারপাশের চাপে পিষ্ট হয়ে যাওয়া।

রাইকে প্রথম দিন দেখে মনে হয়েছিল একটু অধৈর্য্য। কিন্তু সুন্দরী বলে মা পছন্দ করেছিল। হানিমুনে গিয়েও ওর কিছু একগুঁয়ে আচরণ সহ্য করেছে ঋষভ। তবু ভেবেছিল, আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু না। কিছুই বোধহয় ঠিক হবে না। অন্যকে শোধরানো খুব মুশকিল। নিজের মা যেখানে অবুঝ সেখানে দু'মাসের পরিচিত স্ত্রী কতটা সংবেদনশীল হবে? পুরুষ হিসেবে আজ নিজেকে সত্যিই পরাজিত বলে মনে হচ্ছে। যে পুরুষ জোর খাটাতে পারে না, কথা কাটাকাটি করতে পারে না, দুই বিবাদমান পক্ষের মহিলারা তাকে নিয়ে নির্মমভাবে লোফালুফি করে চলেছে । রাতের অন্ধকারে ডুবে যায় ঋষভ। তার ভবিষ্যৎটা কি গভীর অনিশ্চিতার মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছে না ক্রমশ :?

No comments:

Post a Comment