Wednesday, January 1

জাকির তালুকদারের গল্প : বালকের চন্দ্রযান




জাকির তালুকদার
বালকের চন্দ্রযান


...মা জ্বরে প্রায় বেহুঁশ। ছেলে গায়ে হাত দিয়ে দেখে ধান ছোঁয়ালে ফুটে খই হয়ে যাবে এমন জ্বর। সে এখন কী করে, কী করে! কপালে জলপট্টি দেয়, মাথায় পানি ঢালে। কিন্তু কলসি-কলসি পানি ঢেলেও জ্বর নামে না। তখন উতলা ছেলে বলে-- মা আমি বদ্যির কাছে যাই।
মা নিষেধ করে-- না বাবা যাসনে। অনেক রাত এখন। ডিঙি বেয়ে এত রাতে যাবি কীভাবে?
আমি ঠিক যেতে পারব।
ছেলে নিষেধ শোনে না। সে যাবেই যাবে। মা তখন বলে-- তাহলে আলো নিয়ে যা।
গরীবের ঘরে একটাই কুপিবাতি। ছেলে বলে-- না মা। আলো তোমার কাছে থাকুক। তুমি আলো জ্বেলে রাখো। চারদিকে অন্ধকার। আমি দূর থেকে আলো দেখে তোমার কাছে ফিরে আসতে পারব।
ছেলে চলে যায়।
আর মা অপেক্ষা করতে থাকে।
পলে পলে সময় কেটে যায়। শিয়াল পহরে পহরে এসে ডেকে চলে যায়। ছেলে তখনও ফেরে না। মায়ের বুক ভয়ে কেঁপে ওঠে। ছেলে চলনবিলের গহীন অন্ধকারে পথ হারায়নি তো! ঘরে আর থাকতে পারে না মা। কেরোসিনের কুপি হাতে এসে দাঁড়ায় ঘাটপারে। উঁচু ঢিবির ওপর দাঁড়িয়ে বাতি দেখাতে থাকে অন্ধকারকে। বাতাসের ঝাপটা এসে নিভিয়ে দিতে চায় বাতির শিখা। কিন্তু মা আঁচলে আড়াল করে পরম যত্নে জ্বালিয়ে রাখে বাতি। এই আলোই যে তার ছেলের ঘরে ফেরার দিশা।
একসময় তেল ফুরিয়ে আসে। বার কয়েক দপদপিয়ে ওঠে শিখা। এক্ষুনি নিভে যাবে। এখন মা কী করে! আলো না দেখালে তার বুকের মানিক যে ঘরে ফিরতে পারবে না!
মা তখন নিজের শরীরে আগুন লাগিয়ে দেয়। জ্বলন্ত শরীর নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে ঢিবির ওপর। যতক্ষণ পারে দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর একসময় পুড়ে ছাই হয়ে পানিতে গিয়ে মেশে।
এখনও রাতের বেলা সেই মায়ের জ্বলন্ত শরীর বিলের পানিতে ছুটাছুটি করে ছেলেকে পথ দেখানোর জন্য। আর সেই আলোকেই আমরা বলি আলেয়া।’

রনি পড়ে শোনাচ্ছিল। শুনছিল অনি। গল্পের মধ্যেই হাই উঠেছে বারকয়েক। কিন্তু শুনেছে পুরোটাই। গল্প শেষ হলে ফিসফিস করে বলে-- তাহলে অন্যরকম মা-ও আছে তাই না রে ভাইয়া?
রনি একটু বড়। নয় বছরের। তার আড়াই বছরের ছোট অনির প্রশ্নে তাকে একটু উদাস দেখায়-- আছে বোধহয়।
অনির দুই চোখ সবসময় টলটলে। কোনো প্রত্যাশা বা প্রশ্ন জাগলে সেই চোখ একেবারে স্বচ্ছ পানির সমুদ্রের মধ্যে একটুকরো কালো ঝিনুকের মতো উজ্জ্বলপ্রভ হয়ে যায়। এখন অনেকটা সেই রকম-- একটা ভালো মা বদলাবদলি করা যায় না?
এবার হেসে ফেলে রনি। হাসার উপলক্ষ তাদের বেশি জোটে না। তাই হাসিটাকে আরও বেশিক্ষণ ধরে রাখে সে। সংক্রমিত হয় অনির মধ্যেও। সে-ও হাসতে থাকে। পরস্পরের হাসি দেখে পরস্পর আরও বেশি অনুপ্রাণিত হয়ে হাসতে থাকে। প্রথমে দুলে দুলে। রনি দুই হাত বাড়িয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে ছোট ভাইকে। অনি গলা জড়িয়ে ধরে বড় ভাইয়ের। তারপর তারা হাসতে হাসতে একযোগে গড়াগড়ি যায় বিছানায়। এই সময় মা ঘরে ঢোকে দরজা ঠেলে। সঙ্গে সঙ্গে ফ্রিজ হয়ে যায় দুই ভাই। কিছুক্ষণ পরে উঠে বসে শান্ত হয়ে। তাকিয়ে থাকে মায়ের দিকে।
মা একবারও তাকায় না ছেলেদের দিকে। কোনো কথাও বলে না। হাতের ব্যাগটা ধপ করে বিছানার ওপর রেখে ঘরের দুই চেয়ারের একটাতে বসে পিঠে হেলান দিয়ে। তার চোখ বোঁজা। মাথা পিছনের দিকে হেলিয়ে একবার শুধু ক্লান্তির শব্দ উচ্চারণ করে-- উফ্!
ফ্যানের নিচে এখন মা বসে থাকবে অন্তত পনের মিনিট। তারপর কাপড়-চোপড় নিয়ে ঢুকবে বাথরুমে। এ বাড়িতে তাদের ঘর দুইটি। একটা ঘরে তাদের মা-সহ তারা দুই ভাই। আরেক ঘরে নানা আর নানি। দুই ঘরের মাঝখানে বাথরুম। মা বাথরুমে ঢুকলে কমপক্ষে একঘণ্টা। অন্য কেউ তখন তাকে ডিস্টার্ব করতে পারবে না। যতই জরুরি প্রয়োজন হোক না কেন চেপে রাখতে হবে। কোনো ডিস্টার্ব হলেই মা চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় তুলবে-- সারাদিন তো তোমাদের জন্যে পড়েই থাকে। তখন বাথরুম সারতে পারো না? আমি বলে জাহান্নাম থেকে ফিরে একটু গা জুড়াব, তারও উপায় নেই তোমাদের জ্বালায়।
মা যতক্ষণ বাড়িতে থাকে, কেউ পারতপক্ষে কোনো বাড়তি কথা বলে না। কারণ সে যে কোন কথাতে কখন দপ করে জ্বলে উঠবে কেউ তা বুঝতে পারে না। আর রেগে ওঠার সুযোগ পেলেই মা কথা ঘুরিয়ে নেবে তার আক্ষেপ প্রকাশের দিকে-- আমার কি কোনো জীবন আছে? মানুষ মরলে জাহান্নামে যায়। আর আমি বেঁচে আছি জাহান্নামের মধ্যেই। মেয়ে মানুষ, ঘর-সংসার করব, না, বোঝা টানতে টানতেই জীবন শেষ। আল্লায় আমার কান্দের উপর সিন্দাবাদের দৈত্য চাপায়া রাখছে। তা-ও একখান হইলে হয়। গণ্ডায় গণ্ডায় দৈত্য আমার ঘাড়ে।
  বেশি রাগলে নিজের আঞ্চলিক বুলি বেড়িয়ে আসে মায়ের। অথচ ছেলেদের মুখে আঞ্চলিক শব্দ শুনলেই ক্ষেপে যায়-- ওসব কী ভাষা বলছ তোমরা অসভ্যের মতো! রাস্তার লোকের মতো কথা বলবে না খবরদার!
আগে মাঝে মাঝে নানা প্রতিবাদ করত। তখন নরক ভেঙ্গে পড়ত দুই কামড়ার এই ছোট্ট বাসায়। অন্য বাসাগুলি থেকে লোক জমে যেত চ্যাঁচামেচি শুনে। এখন আর নানা তাই মায়ের কথার পিঠে কোনো কথা বলে না। তবে মাঝে মাঝে শক্ত হয়ে যায়, হাত মুঠি পাকায়, বড় বড় নিশ্বাস নেয়। নানিকে দেখলে বড় মায়া হয় তাদের। কালো, ছোট-খাট চেহারার স্নেহময়ী বৃদ্ধা সবসময় যেন ভয়ে ভয়ে থাকে। স্বামীকেও ভয় পায়, মেয়েকেও ভয় পায়। আবার ভালোও বাসে। নানি বলার মধ্যে শুধু বিড়বিড় করে বলে-- আহহারে, মাইয়াডার পুড়া কপাল! মিজাজ-মর্জি তো গরম হইবারই পারে। ভালো কথাও তখন ঠেকনার মতন শুনায়। আর সত্যিইতো আমরা হগলডিই হের ঘাড়ে চাইপা রইছি।
তো মা এখন বাথরুমে। কল থেকে অবিরাম বালতিতে পানি পড়ার শব্দ, গায়ে মগ মগ পানি ঢালার ঝপাৎ ঝপাৎ শব্দ, মায়ের নাক-মুখ থেকে মাঝে মাঝে ফুঁপিয়ে ওঠার মতো শব্দ, মেঝেতে কাপড়ের আছড়ানি, অস্পষ্ট বিড়বিড়ানির মতো মায়ের কিছু অসমাপ্ত বাক্য, মাঝে মাঝে অদৃশ্য কাউকে খবিস বলে গালি দেওয়া, এবং ক্বচিৎ-কখনো গানের সুরে গুনগুনানিও।
বাথরুম থেকে বেরিয়ে আসে অনেক কোমল আর অনেকখানি শান্ত চেহারার মা। তবে ঠোঁটে হাসি তেমন একটা দেখা যায় না। কেবল চেহারায় কাঠিণ্যটুকুই কিছুটা অনুপস্থিত। তারপর শুরু হয় ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ ধরে গায়ে-বুকে-গলায় পাউডার ঢালা।
দিনে দুইবার এই পর্ব। প্রথমবার সকালে। নানি হাতে চায়ের কাপ নিয়ে মোলায়েম কণ্ঠে ঘুম ভাঙায় মায়ের। চা খেয়ে ঝটপট বাজারে যায় মা। কাঁচাবাজার করে নিজের হাতে। আবার এই নিয়ে গজগজানিও কম নেই। রনি-অনিকেও মাঝে মাঝে বলে-- তোরা যে কবে বড় হয়ে আমার কাজগুলি একটু কমাতে পারবি! সব যদি একহাতে এই আমাকেই করতে হয়, তাহলে আমি বাঁচি কীভাবে বল!
বলে বটে, কিন্তু বাজার করার দায়িত্ব কিছুতেই হস্তান্তরে রাজি নয় মা। নানা বেশি চলতে-ফিরতে পারে না। কিন্তু কাঁচাবাজারটিতে যেহেতু শুধু একটা গলি পেরুলেই পৌঁছে যাওয়া যায়, এই কাজটি করতে তার আপত্তি নেই। মা কেন যে তাকে দেয় না! নানা বলে, তাহলে খোঁটা দেওয়ার একটা আইটেম কমে যাবে যে!
বাজার থেকে এসে একঘণ্টার বাথরুমপর্ব। তারপর আধাঘণ্টার সাজগোজ। তারপর নাস্তা। রনি-অনি তখন বারান্দায় টেবিলে বসে পড়া মুখস্ত করে। পাউডার-সেন্টের গন্ধ ছড়িয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় মা মুখস্ত কথাগুলি বলে-- উহ্ রোজ দেরি হয়ে যায়! এত ঝামেলা সেরে বের হতে হয়। এই তোমরা দুষ্টুমি করবে না। স্কুলে যাবে সময়মতো। দেরি যেন না হয়। মা আমি যাচ্ছি!
নানি রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে বিড়বিড় করে দোয়া পড়ে। শুধু দুটো শব্দই জোরে শোনা যায়-- ফী আমানিল্লাহ!
মা বেরিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যেন বাড়িটিতে প্রাণ ফিরে আসে। অনি চেঁচিয়ে বলে-- নানি আইজ কিন্তু পরোটা খামু। সাদা রুটি খাইতে ভালো লাগে না।
নানা হাসিমুখে ওদের পাশে এসে দাঁড়ায়-- দাও, অগোরে পরোটা বানায়া দাও।
সেই অনুচ্চকণ্ঠ নানির। স্বগতোক্তির মতো বলে-- ডালডা ঘিয়ের নাকি দাম খুব বাড়ছে।
নানা নাক কুঁচকায়-- হুহ্! দুইডা পরোটা বানাইতে আর কয়মণ ডালডা লাগে! এই মাসের পেনসন তুইলা আমি ডালডা কিইনা আনুমনে।
নানার পেনসন তোলার দিনটা বড় খুশি খুশি থাকে তারা চারজনই। আলুভর্তা আর গরম ভাতের ওপর ছিটানো হয় দুই চামচ ঘি। নানার পরনে ধোয়া-কাচা পাজামা-পাঞ্জাবি। ঈদের দিনে পরার মখমল টুপিটা সে দিন মাথায়। হাতে লাঠি নিয়ে পান চিবোতে চিবোতে নানা বের হয় ঘর থেকে। দরজা পর্যন্ত সঙ্গে যায় নানি। দোয়া পড়ে নানার বুকে ফুঁ দিয়ে কদমবুসি করে। তারপর সেই  আনুচ্চ কণ্ঠেই বলে-- তাড়াতাড়ি ফির‌্যা আইসেন।

রনি-অনি স্কুল থেকে ফিরে ভাত খায়। তারপর সোজা দৌড়ায় পাড়ার মাঠে। মায়ের পারমিশন আছে সন্ধ্যার আজান পর্যন্ত খেলতে পারবে। তাদের বাড়ি ফেরার বেশ অনেক পরে ফেরে মা। তারপর যথারীতি বাথরুম। তারপর রাতের পরিচ্ছন্নতা। টিভি খুলে সামনে বসে থাকা। নানি আক্ষেপে মাঝেমাঝে বিড়বিড় করে-- বুকের দুধ ছাড়ানোর পর পোলা দুইডার মুখে কোনোদিন এক লোকমা ভাতও উঠায়া দেয় নাই অগো মা।
শুধু টিভি চলে। মা ওদেরকে বড়জোর জিজ্ঞেস করে ওদের পড়াশোনা কেমন চলছে। অন্য কোনো গল্প নয়, কোনো রূপকথা নয়, কোনোদিন বেড়াতে যাওয়ার কোনো পরিকল্পনা নয়। মা টিভি দেখে আর মাঝেমাঝে মোবাইল ফোনে নিচুস্বরে কথা বলে। কথা বলতে বলতে আড়চোখে ছেলেদের দিকে তাকায়, কখনো উঠে গিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে কথা বলে।
শোবার বিছানা একটাই। যথাসম্ভব দেয়াল ঘেঁষে শোয় রনি। মাঝে অনি। মেঝের দিকে মা। অনি ঘুমানোর সময় চেষ্টা করে রনির গায়ের সাথে লেপ্টে থাকতে। কিন্তু প্রায় সকালেই মা অনিকে ধমকায়-- এত খারাপ তোর শোওয়া! ঘুমের ঘোরে খালি হাত-পা ছুঁড়িস। আর ঠেলতে ঠেলতে আমাকে মেঝেতে ফেলেই দিস প্রায়।
ছোট্ট অনি লজ্জায় এতটুকু হয়ে যায়।

০২.
আমাগো বাবায় কই আছে?
রনি কি জানে যে উত্তর বলবে?
তুই তো দেখছস বাবারে?
হ দেখছি।
বলে বটে, কিন্তু তার দেখাটা তো এক ধূসর স্মৃতি। তার বয়স তিন পেরুনোর আগপর্যন্ত দেখেছে বাবাকে। অনি তো দেখেইনি কখনো। সে পেটে থাকতেই বাবা কাউকে কোনোকিছু না জানিয়ে উধাও হয়ে গেছে। আর মা নাকি সেই রাগে তার বাবার যেখানে যত ছবি ছিল সব নষ্ট করে ফেলেছে, পুড়িয়ে ফেলেছে। মাকে তো বাবার কথা জিজ্ঞেস করাই যায় না। নানিকে জিজ্ঞেস করলে উত্তর না দিয়ে ঝরঝর করে কাঁদে।
অনি জিজ্ঞেস করে-- তুই তো বাবারে দেখছস। আবার দেখলে চিনবার পারবি?
আমতা আমতা করে বড়ভাই-- বোধহয় পারুম।
তাইলে চল। ইস্কুলের পরে খেলতে না গিয়া চল আমরা বাবারে খুঁইজা বেড়াই!
প্রস্তাবটা খুবই ভালো। কিন্তু রনির বুদ্ধি একটু হলেও বেশি। বয়সের তুলনায় একটু বেশিই বেশি। সে বলে-- কিন্তু বাবারে খুঁজতে আমরা কই যামু? তারে খুঁজতে গিয়া আমরা দুইজনে যদি হারাইয়া যাই!
হারিয়ে যাওয়া মানে, নানি বলেছে, ছেলেধরাদের হাতে পড়া। তারা চোখ তুলে নেয়, পেট কেটে একটা কিডনি বের করে নেয়, হাত-পা ভেঙ্গে দেয়, তারপর রাস্তার ধারে বসিয়ে ভিক্ষা করায়।
দরকার নাই। বাবায় নিজেই একদিন ফির‌্যা আইব।
তখনকার মতো বাবার আলোচনা চাপা পড়ে। কিন্তু রনির মন থেকে বাবার কথা মুছতে চায় না। খুব আবছা একটা মুখ তার মনে পড়ে। ছোট্ট রনিকে বুকে তুলে নিচ্ছে, দুহাতে উঁচু করে দোলাচ্ছে, তাকে পিঠে বসিয়ে নিজে ঘোড়া সেজে মেঝেতে হামাগুড়ি দিচ্ছে। কিন্তু তাদের ছেড়ে এভাবে চলে গেল কেন বাবা! আর কোনোদিন কী বাবার সাথে দেখা হবে!
বাবার প্রতি মায়ের এত ঘৃণা কেন? বাবার কোনো চিহ্ন পর্যন্ত বাড়িতে রাখেনি। বাবার আত্মীয়-স্বজনের সাথে কোনো সম্পর্ক রাখেনি। মুখ দেখাদেখি পর্যন্ত বন্ধ।
সন্ধ্যায় মাঠ থেকে বাড়িতে ফিরে ওরা দেখল নানার মুখ থমথমে। কয়েকদিন ধরেই দেখছে। মা বোধহয় বেশি খারাপ কোনো কথা বলেছে। ওরা পড়তে বসে যায়। পড়া দেখিয়ে দেয় নানা। তবে অন্য দিনের মতো স্বাভাবিক হতে পারছে না যেন বুড়ো মানুষটা। পড়াতে পড়াতে বারবার কান খাড়া করছে। মায়ের আসার সময় হয়েছে, অথচ এখনও এসে পৌঁছায়নি। হয়তো সেজন্যেই নানা চিন্তিত। ওদের পড়া শেষ হয়। রাতের খাওয়া হয়ে যায়। শুয়ে পড়ে দুজন। মা এখনও আসেনি। নানি এসে মশারি খাটিয়ে দেয়। দুই ভাই এটা-ওটা বলতে বলতে ঘুমিয়েও পড়ে। 

ঘুমের মধ্যে বাবা আসে। তীব্র আবেগে জড়িয়ে ধরে রনিকে। বাবা, বাবা আমি তোমাকে ভালোভাবে দেখতে পাচ্ছি না কেন? আলোটা জ্বালাও বাবা। আমি তোমাকে দেখব বাবা। তুমি আর কোথাও চলে যেয়ো না বাবা! আমাদের ছেড়ে চলে যেয়ো না বাবা! তুমি না থাকলে আমার বুকের মধ্যে কেমন যেন করে বাবা! মনে হয় আমি মরে যাচ্ছি! বাবা...
রনির আবেগ-উচ্ছ্বাসের মধ্যেই মা চলে আসে। তার মুখ তীব্র ক্রোধে জ্বলছে গনগনে কয়লার মতো। চিৎকার করে বাবাকে বলে তার ছেলেকে স্পর্শ না করতে, বেরিয়ে যেতে, আর কোনোদিন এখানে না আসতে। বাবাও উঁচুগলায় চ্যাঁচাতে থাকে। মাকে গালি দেয়। মা-ও পাল্টা গালি দেয়। বেধে যায় তুমুল ঝগড়া। আর সেই ঝগড়ায় ঘুম ভেঙে যায় রনির। বারান্দা থেকে ভেসে আসছে নানা আর মায়ের কথা কাটাকাটির আওয়াজ।
তুই পাইছস কী? তুই রোজ রোজ রাইত কইরা ঘরে ফিরিস। তুই ভাবিস কেউ তোরে কিছু কইবার পারব না!
কই? আমি কি রোজ রোজ রাইত কইরা ঘরে ফিরি?
এই তো গত পরশুই তুই দেরি কইরা ফিরলি। আবার আইজ ফিরছস দুপুর রাইতে।
কইলাম তো হেইদিন আমার বান্ধবীর বাড়িত দাওয়াত আছিল।
কিয়ের দাওয়াত? কিয়ের বান্ধবী? জন্মে তোর কোনো বান্ধবী কোনোদিন দ্যাখলাম না। অহন বান্ধবী দেখাইছ!
আইচ্ছা আইচ্ছা, আমার বান্ধবী নাই তো নাই। তাতে তোমাগো অসুবিধা কিয়ের!
অসুবিধা নাই? কোনো ভদ্রঘরের মাইয়া এত রাইত কইরা ঘরে ফিরে?
কইলাম না কাম আছিল!
কাম তো থাকে দিনের বেলাত। রাইতে কিয়ের কাম? অহন কি নাইট অফিস খুলছে!
আজেবাজে কথা কইবা না কইতাছি!
কী, আমারে চোখ রাঙাইছ! তুই হারামজাদি আজেবাজে কাম করিস আর আমরা কইবার পারুম না!
মুখ খারাপ করবা না! গালি দিবা না খবরদার!
খালি গাইল দেওয়া তো যথেষ্ট না। উচিত তোরে থাপড়াইয়া গাল লাল কইরা দেওয়া।
নানির নিচুগলা শোনা যায়-- অত চিল্লাপাল্লা করনের কাম নাই। আপনে যান তো, শুইয়া পড়েন। চিল্লাপাল্লা করলে আপনার বেলাড প্রেসার বাইরা যাইব।
ব্লাড প্রেসার বাড়তে আর বাকি রইছে যানি! তোমার মাইয়ার কাণ্ড-কারখানা, আচার-ব্যাভার দেখলে ব্লাড প্রেসার এ্যামনে এ্যামনেই বাইড়া যায়।
আবার মায়ের কণ্ঠ শোনা যায়-- কেডায় কইছে চাইয়া চাইয়া দেখতে! চক্ষু বন্দো কইরা রাখবার পারো না?
মা এসে ঘরে ঢোকে। হাতের ব্যাগ ছুঁড়ে ফেলে মেঝেতে। দড়াম করে দরজা লাগায়। তারপর চেয়ারে ধপ করে বসে ফোঁপাতে থাকে।
নিঃসাড় পড়ে থাকে রনি। মা বেশ কিছুক্ষণ কাঁদে। তারপর শুধু শাড়িটা পাল্টে এসে মশারির মধ্যে ঢোকে। বুঝতে পারেনি যে রনি জেগে আছে। রনি বুঝতেও দেয় না। হঠাৎ সে ভেতরে ভেতরে থরথরিয়ে কেঁপে ওঠে। মা ঘুমন্ত অনিকে চেপে ধরেছে বুকের মধ্যে। আরেক হাত পরম মমতায় বিলি কাটছে রনির চুলে। ফিসফিস করে মা বলছে-- বাবারে তোরা আমার কইলজার টুকরা। আমি যে অহন কী করি! কোনদিকে যাই! খোদারে!
মায়ের গালি-গালাজ আর মন্দ ব্যবহার এই বয়সেই অনেক সয়েছে ওরা। কিন্তু অপ্রত্যাশিত এই আদরের স্পর্শ সহ্য করা কঠিন হয়ে পড়ে রনির জন্য। কান্না ঠেলে উঠে আসতে চায় বুক থেকে। অনেক কষ্টে আটকাতে পারে। এই রকম সময়ে কেঁদে ওঠা, বা সে জেগে আছে তা মাকে বুঝতে দেওয়া কোনোমতেই উচিত হবে না, এটুকু অন্তত সে বুঝেছে।

০৩.
নানি বিড়বিড়িয়ে হিসাব করে-- বিয়ার কালে অর বয়স আছিল ঊনিশ। বিয়ার বছর ঘুরার লগে লগেই জন্মাইছে বড় পোলা। হ্যার বয়স অহন দশ। তাইলে দশ আর এক এগার। আর এগার আর ঊনিশে হইল...কড় গুনে গুনে হিসাবে পৌঁছায় নানি-- এগার আর ঊনিশে হইল তিরিশ।
তারপরেও নিজে নিজে কথা বলে চলে-- আমগো সময় কইত মাইয়া মানুষ কুড়িতেই বুড়ি। অহন আর সেই যুগ নাই। মাইয়ার আমার বিয়ার বয়স অহনও রইছে। কিন্তু হ্যায় তো রাজি হয় না। হ্যার চিন্তা আমাগো কী হইব! দুই পোলার কী হইব! আরে আল্লায় জীব তৈয়ার করছে আল্লায় রক্ষা করব, আল্লায় ব্যবস্তা করব। জুয়ান মাইয়া, বিয়া না বইলে কখন যে কী ঘইটা যায়! জুয়ানকিরে বিশ্বাস কী? জুয়ানকির ঘাট কী?

০৪.
পরের কয়েকদিনে আবার আগের ছন্দ ফিরে আসে পরিবারে। মা এখন কথায় কথায় আর আগের মতো বিরক্তি প্রকাশ করে না। যেন নিজেকে সামলে রাখে প্রাণপণে।
কিন্তু হঠাৎ নতুন আব্দার তোলে নানা। তাকে একবার দেশে যেতে হবে। সেখানে তার বাপের কবর। কয়েকদিন ধরে নাকি স্বপ্নে নিজের পিতাকে দেখছে নানা। ধারণা হয়েছে তার নিজেরও মৃত্যুর সময় হয়ে এসেছে। মৃত্যুর আগে শেষবার নিজের পিতার কবর জিয়ারত করার ইচ্ছা তার।
তো নানা যদি শেষ পর্যন্ত গাঁয়ে যায়-ই, তাহলে বুড়ো মানষটাকে একা একা ছাড়ে কীভাবে নানি!
তাহলে দুই বাচ্চা? আর তাদের মা?
ব্যবস্থা নানিই করে। নিচের তলার কাজের বুয়া সাতদিন এসে রাঁধা-বাড়া, ঘরগোছানোর কাজ করবে। সন্ধ্যায় মা ঘরে না ফেরা পর্যন্ত ছেলে দুটো থাকবে নিচতলায় বাড়িঅলাদের কাছেই। তারা রাজি আছে। তবে মায়ের উচিত হবে সাঁঝের আগেই বাড়িতে ফিরে আসা। মোটে তো সাত-আটটা দিনের ব্যাপার।

নানা-নানি গাঁয়ে যাওয়ার দ্বিতীয় দিনেই বাড়ি ফিরে ছেলেরা অবাক। এই দুপুরেই মা চলে এসেছে অফিস থেকে! সঙ্গে আবার একজন লোক। এই প্রথম তাদের বাড়িতে কোনো মেহমানকে দেখতে পেল ছেলেরা। দরজা খোলা। মা খাবার টেবিলে বসে হেসে হেসে গল্প করছে লোকটার সঙ্গে।
তাদের দেখে উঠে দাঁড়ায় মোটা গোঁফঅলা দোহারা গড়নের মানুষটা। হাসিমুখে বলে-- তোমরা নিশ্চয়ই রনি আর অনি।
কেতাদুরস্ত ভঙ্গিতে হাত বাড়িয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে সে হ্যান্ডশেক করে ছেলেদুটোর সাথে। মায়ের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায় দুজনেই। মাকে এত হাসি-খুশি দেখেনি ওরা আগে কখনোই। শুধু হাসি-খুশি নয়, মাকে এখন কোমল প্রশান্ত এবং সুখিও দেখাচ্ছে। মা কিছু বলতে চাইলে বাধা দেয় গোঁফঅলা লোকটা-- আমাদের আনুষ্ঠানিকভাবে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে না মাদামোয়াজেল। আমরা নিজেরাই পরিচিত হয়ে যাব পরস্পরের সঙ্গে। তুমি বরং ছেলেদের খাবারের বন্দোবস্ত করো। ওরা স্কুল থেকে ফিরল। নিশ্চয়ই খুব ক্ষুধার্ত।
মা তার কথা একবাক্যে মেনে নিয়ে হাসিমুখে চলে গেল রান্নাঘরের দিকে।
হ্যালো! আমার নাম হচ্ছে মিস্টার খ।
হকচকিয়ে যায় দুইভাই-- এ আবার কোন ধরনের নাম!
হাসে লোকটা-- আমার নাম শুনলে সবাই প্রথমে অবাক হয়। ভাবে এটি বোধহয় আমার ছদ্মনাম। কিন্তু আমি তোমাদের নিশ্চয়তা দিয়ে বলছি এটাই আমার প্রকৃত ডাকনাম। আমরা ছিলাম অনেকগুলি ভাই-বোন। এতগুলি ছেলে-মেয়ের নাম মনে রাখতে মা-বাবাই হিমসিম খেয়ে যেত। একজনকে ডাকতে গিয়ে ভুল করে ডেকে ফেলত আরেক জনের নাম ধরে। সে সব মহা কেলেঙ্কারির ব্যাপার বুঝলে। শেষে বাবার বুদ্ধিতে এইভাবে নাম রাখা হয়। ক খ গ ঘ ঙ চ ছ...
খিকখিক করে হেসে ওঠে অনি। রনিও। এমনকী রান্নাঘর থেকে মায়ের হাসির শব্দও শোনা যায়। ব্যাস! লোকটাকে ভালো লেগে গেল রনি-অনির।
রনি প্রশ্ন করে-- আপনি কি ফ্রান্সে ছিলেন?
কেন? এই প্রশ্ন কেন?
আপনি যে মাদামোয়াজেল বললেন মাকে। ফ্রান্সের মানুষ নাকি এটা বলে!
স্মার্ট বয়! না। আমি ফ্রান্সে ছিলাম না। তবে আফ্রিকাতে ছিলাম। সেখানে শিক্ষিত লোকেরা ফরাসি ভাষায় কথা বলে।
আফ্রিকা! চোখ গোল্লা গোল্লা হয়ে যায় অনির। আফ্রিকা! তার মানে চিতাবাঘ, হাতি, সিংহ, জিরাফ, শিম্পাঞ্জি!
হ্যাঁ। ওসব আমি অনেক দেখেছি।
শিকার করেননি?
হ্যাঁ, তা-ও করেছি বটে।
আপনি যেখানে থাকতেন, মানে আপনার বাড়িতে এসে ঢুকে পড়ত না সিংহ জিরাফ?
না, তা অবশ্য ঢুকত না। তবে বানর ছিল আমার একটা। কালো বানর। খুব বুদ্ধিমান। আমার অনেক কাজ করে দিত সেই বানর।
কী রকম?
এই ধরো, বললাম তোয়ালে এনে দাও, এনে দিল। বললাম গাছ থেকে ফল পেড়ে আনো, পেড়ে আনল। এমনকী বললে আমার পিঠের ঘামাচি পর্যন্ত মেরে দিত। আফ্রিকাতে থাকলে পিঠে ঘামাচি হয় খুব। খুব গরম তো!
বাহ্ !
সেই জন্যেই তো খুব মায়া পড়ে গেল। আমি আসার সময় তার সে কী কান্না!
তখন কী করলেন?
কী আর করব, সঙ্গে নিয়ে এলাম। একেবারে প্লেনের টিকেট কেটে পাশে বসিয়ে নিয়ে এলাম।
কোথায় আছে এখন বানরটা?
এই শহরেই আছে। আমার বাড়িতেই থাকে।
অবধারিতভাবে অনির পক্ষে তখন আর নিজেকে সামলানো সম্ভব হয় না-- আমি আপনার কালো বানরটাকে দেখব!
অবশ্যই দেখবে। আমি একদিন ওটাকে সঙ্গে করে নিয়ে এসে তোমাদের দেখাব। তোমাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতিয়ে দেব।
মা ততক্ষণে টেবিলে খাবার সাজিয়ে ফেলেছে।
খেতে বসে রনি-অনি এ-ওর মুখের দিকে তাকায়। এত রকমের খাবারের আয়োজন! অনির মনে হয়, আজ বোধহয় ঈদের দিন। একবার মুখ ফস্কে বেরিয়েও আসতে চায় প্রশ্নটা। কিন্তু কালো বানর ফের দখল করে নেয় তার মনের সক্রিয় অংশটিকে। একের পর এক প্রশ্ন করে চলে মিস্টার খ-কে। সবই কালো বানর নিয়ে। মিস্টার খ হাসিমুখেই উত্তর দিয়ে চলে। আবার কৌশলে একসময় গল্পের প্রসঙ্গ অন্যদিকেও ঘুরিয়ে নেয়। মজার মজার বিভিন্ন বইয়ের নাম বলে মিস্টার খ। একটাও পড়া হয়নি ওদের। রনি বলে-- ওসব বই কোথায় পাব, জানি না তো! একটাই বই দিয়েছিল নানা। তা-ও ছেঁড়া আর পুরনো।
অনি চোখ বড় বড় করে বলে-- জানেন গল্পগুলো খুব সুন্দর। আর সব গল্প মা নিয়ে।
মা একটু থমকায়-- তাই নাকি! রাতে দিস তো তোদের বইটা। পড়ে দেখব।
খাওয়ার পরে আয়েশ করে সিগারেট ধরায় মিস্টার খ। রনি আড়চোখে মায়ের দিকে তাকায়। নানা কোনোদিন খাবার টেবিলে সিগারেট খেলে মা খুব রেগে যায়। কিন্তু না। মিস্টার খ-এর সিগারেট টানা নিয়ে মায়ের চোখে কোনো বিরক্তির চিহ্ন নেই।
মা বলে-- রনি-অনি তোমরা এখন খেলতে যেতে পারো। কিন্তু সন্ধ্যা লাগার সঙ্গে সঙ্গেই কিন্তু ফিরে আসতে হবে।
অনি তেমন গা করে না। খেলতে যাওয়ার ইচ্ছা তেমন নেই। কালো বানরের গল্প শুনতেই তার এখন বেশি ভালো লাগছে।
মিস্টার খ আর মায়ের মধ্যে আবছা দৃষ্টি বিনিময় হয়। মিস্টার খ বলে-- আরে কালো বানরের গল্প কী আর শেষ হয়! তাছাড়া গল্পের তো দরকারই পড়বে না। কারণ এরপরে তোমরা নিজের চোখেই দেখতে পাবে ওটাকে। আমি দু-চারদিনের মধ্যেই নিয়ে আসব কালো ভূতটাকে। তার জন্য তোমাদের খেলা নষ্ট করা মোটেই উচিত নয়। জানো তো, পড়ার সময় পড়া আর খেলার সময় খেলা।
ওরা খেলতে চলে যায়।

সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে দেখে মিস্টার খ চলে গেছে। মা এটা-সেটা গোছগাছ করছে আর গান গাইছে গুনগুন করে।
রাতের খাওয়াটাও হলো দারুণ।
শুতে গিয়ে মা অনেকক্ষণ গল্প করল ওদের সাথে। কথায় কথায় জিজ্ঞেস করল-- এই যে মিস্টার খ আজ এখানে এসেছিল, তাকে তোদের কেমন লাগল?
খুব ভালো।
মানে-- মা একটু থেমে থেমে শব্দ উচ্চারণ করে-- মানে উনি যে এখানে এসেছিলেন, সে কথাটা তোদের নানা-নানিকে না জানানোই ভালো হবে বুঝলি! উনারা কী জানি কেন, ঠিক পছন্দ করে না মিস্টার খ-কে।
কিন্তু আমাদের কালো বানর দেখা?
তা নিশ্চয়ই তোরা দেখতে পাবি।  মা জোর দিয়ে বলে-- মিস্টার খ কথা দিলে অবশ্যই কথা রাখবে!

০৫.
আটদিনের মাথায় ফিরে এসেছে নানা-নানি।
মাঝের কয়েকদিনের পরিবর্তনের পরে আবার আগের নিয়মে ফিরে গেছে পরিবার। কিন্তু অনি মাঝেমাঝে কালো বানরের কথা তোলে রনির কাছে। তবে মাকে যে কথা দিয়েছিল, সেটা পালন করেছে তারা। নানা-নানির সামনে কখনো উচ্চারণ করেনি মিস্টার খ-এর কথা। অনি থাকতে না পেরে মাকে বার দুয়েক জিজ্ঞেস করেছে ইতোমধ্যে মিস্টার খ-এর সঙ্গে তার দেখা হয়েছে কি না। যদি দেখা হয়, মা যেন অবশ্যই তাকে কালো বানরটি দেখানোর কথা মনে করিয়ে দেয়।
মা কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলেছে যে মিস্টার খ-এর সাথে তার দেখা হয়নি। খোঁজ যে নেবে তারও উপায় নেই। কারণ আফিসে কাজের খুব চাপ। তবে দেখা হলে অবশ্যই সে কালো বানর দেখানোর প্রতিশ্রুতির কথা মনে করিয়ে দেবে। তারপরই ওদের ঠিক সময়ে স্কুলে যাওয়ার কথা মনে করিয়ে দিয়ে তড়বড় করে বেরিয়ে যায় মা।

নতুন এক মাস্টার এসেছে ওদের স্কুলে।  অন্য শিক্ষকরা বলে লোকটা একটু নাকি পাগলাটে। সে ছাত্রদের নিয়ে বানিয়েছে অ্যাডভেঞ্চার ক্লাব। ক্লাসের পড়ার ফাঁকে ফাঁকে, টিফিন পিরিয়ডে, ছুটির পরে নানান ধরনের কা--কারখানা করছে অ্যাডভেঞ্চার ক্লাব। সেদিন হঠাৎ একটা ক্লাস হয়ে ছুটি হয়ে গেল স্কুল। পরিচালনা কমিটির কেউ একজন মারা গেছেন। ক্লাবের স্যার বললেন-- এই শহরে একটা নদীবন্দর আছে। তোমরা কেউ দেখেছ?
কেউ-ই দেখেনি।
তাহলে চলো। অ্যাডভেঞ্চার ক্লাবের সদস্যরা আজ আমরা নদীবন্দর দেখতে যাব।
স্কুল থেকে দলটা বেরুল রীতিমতো মার্চপাস্ট করে।

ফেরার পথে হঠাৎ বড়ভাইয়ের জামার হাতা টেনে ধরল অনি-- ভাই, ওখানে মা!
তারা যে ফুটপাথ দিয়ে হাঁটছে, রাস্তার ঠিক উল্টোদিকে একটা ছিমছাম গার্ডেন রেস্তোরা। সিমেন্টের ছাতার নিচে চেয়ার-টেবিলে বসে খেতে খেতে গল্প-গুজব করছে খদ্দেররা। মাকে দেখা যাচ্ছে একটা টেবিলে। তাদের দিকে বামপাশ ফেরানো। খুব হাসছে। কথা বলছে। চায়র কাপে চুমুক দিচ্ছে। সঙ্গে? আরে ওটা মিস্টার খ! অনি প্রায় রাস্তা পেরিয়ে দৌড় দিতে যায়। কিন্তু রনি এবার তাকে থামায় জামা টেনে ধরে-- না ভাই, না!
অনি উত্তেজিত স্বরে বলে-- মিস্টার খ-কে দেখতে পাচ্ছ না? চলো, কালো বানরের কথা জিজ্ঞেস করি!
রনির মনের মধ্যে অস্বস্তি। ওদের দেখতে না পেলেই যেন ভালো হতো। কেউ যেন তাকে নিষেধ করছে মনের মধ্যে বসে থেকে। কিন্তু অনি টানাটানি শুরু করেছে হাত ছাড়িয়ে নেবার জন্য। পারলে ছুট লাগায়। রনি কীভাবে ফেরাবে  ওকে! বাঁচা গেল স্যারের হাঁক শুনে-- খবরদার, কেউ লাইন ছেড়ে নড়বে না! চলো সবাই পা চালিয়ে। এই তো আর একটু সামনে গিয়েই আমরা বাসে উঠব।

রাতে অনি কথাটা বলতেই মায়ের মুখ মুহূর্তের মধ্যে কয়েকবার রং পাল্টায়। এবং শেষে পুরোপুরি ফ্যাকাশে হয়ে যায়। কিন্তু অনির কথাকে অস্বীকার করে অস্বাভাবিক জোর দিয়ে-- কী উল্টাপাল্টা কথা বলিস! সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত আমি বলে অফিসের টেবিলে না-মুখ ডুবিয়ে বসে থেকেও কাজ শেষ করতে পারি না, আর আমি যাব বেড়াতে! আর নদী-টার্মিনাল যেখানে, আমার অফিস সেখান থেকে অনেক দূরে। আমি কীভাবে ঐ জায়গায় যাব? পাগলের মতো কথা বলছিস তুই।
অনি জোর দিয়ে বলতে যাচ্ছিল যে সে অবশ্যই মাকে ঐ রেস্টুরেন্টে বসে চা খেতে দেখেছে, এবং তার সঙ্গে মিস্টার খ-ও ছিল। কিন্তু রনি তাকে থামিয়ে দেয়। ক্লান্তস্বরে বলে-- না না মা, অনি ভুল দেখেছে। ওটা অন্য কেউ ছিল। আমি ঠিকই বুঝতে পেরেছিলাম ওটা তুমি নও, অন্য কেউ। সেইজন্যেই তো অনিকে যেতে দিইনি।

০৬.
আর কোনোদিন মিস্টার খ-এর সাথে দেখা হয়নি তাদের। অ্যাডভেঞ্চার ক্লাবের সঙ্গে এখন প্রায়ই বিভিন্ন দিকে বেরিয়ে পড়ে ওরা। খুব তাড়াতাড়ি বড় হয়ে উঠছে দুজন। আর ওদিকে ওদের সাথে পাল্লা দিয়ে বুড়িয়ে যাচ্ছে নানা-নানি। কিন্তু সবচেয়ে দ্রুত বুড়িয়ে যাচ্ছে মা। প্রতিদিন যেন আরও বেশি অচেনা হয়ে যাচ্ছে ওদের মা। এখন তার কথায় কথায় রেগে ওঠা নেই, ছেলেদের আদর করা তো নেই-ই, বাথরুমে ঘণ্টাধরে সময় কাটানো নেই, অফিসে যাওয়ার জন্য হুড়মুড় করে ছুটে চলা নেই। তবে রনি হঠাৎ হঠাৎ ঘুম ভেঙে দেখেছে মা বিছানায় নেই। জানালার ধারে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে বাইরে। কখনো কাঁদছে নিঃশব্দে কিন্তু অঝোর ধারায়। রনির ভেতরে ধীরে ধীরে বড় হতে থাকা কেউ একজন ইশারায় জানিয়ে দেয় যে সবাইকে সব কথা জানতে দিতে নেই। সে যে মাকে রাতে একা একা কাঁদতে দেখেছে, একথাও অন্যকে জানানো উচিত নয়। এমনকী সে যে মাকে কাঁদতে দেখেছে, সেকথা মাকেও বুঝতে দেওয়া উচিত হবে না।

হঠাৎ একদিন দুই ভাইকে স্কুল থেকে বাড়িতে ডেকে আনল বাড়িঅলার ভাগ্নে মমতাজভাই। স্যারকে সে ফিসফিস করে কিছু একটা বলতেই ক্লাসটিচার ওদের ডেকে বলল-- তোরা তাড়াতাড়ি বাড়ি যা বাবারা! বড় খারাপ খবর। আল্লা তোদের হেফাজত করুন!
পাড়ার লোক ভেঙে পড়েছে তাদের বাড়িতে। এত মানুষের ভিড়, কিন্তু আশ্চর্য নীরব তাদের বাড়ি। কথা প্রায় বলছেই না কেউ। বললেও বলছে খুব নিচুস্বরে, গলা একেবারে খাদে নামিয়ে। নানা-নানি বসে আছে পাথরের মতো নিশ্চুপতা নিয়ে। সবচেয়ে নীরব এবং নিথর তাদের মা।
তাদের মা নাকি আত্মহত্যা করেছে।
০৭.
‘ ছেলে হাতজোড় করে বলে-- আমার মাকে বাঁচাও শুকপাখি! মা ছাড়া আমাদের আর কেউ নেই।
শুকপাখি মাথা নেড়ে বলে-- আমি জানি। জানি বলেই তোমার কাছে এসেছি। তোমার মাকে ফের বাঁচিয়ে তোলার একটাই উপায় আছে।
কী উপায় বলো শুকপাখি!
হৃদকমল ফুল এনে তার রস ছেঁচে দিতে হবে তোমার মায়ের মুখে।
কোথায় আছে সেই ফুল?
অনেক দূরে।
হোক দূর। যত দূরই হোক, আমি যাব হৃদকমল ফুল আনতে। তুমি শুধু বলে দাও কোথায় গেলে পাওয়া যাবে সেই ফুল।
এখান থেকে নৌকা নিয়ে চলতে চলতে তুমি পৌঁছুবে উল্টাস্রোতের গাঙে। সেই গাঙের পানি সবসময় বাতাসের উল্টাদিকে বয়। সেই গাঙ পেরুলে পাবে ঘূর্ণিবিল। সেই বিলের পানি সবসময় ঘুরপাক খায়। সেই ঘূর্ণিতে যা পড়ে তা-ই নিমেষে তলিয়ে যায়। সেই ঘূর্ণিবিলের পরে তুমি পড়বে কালিদহে। এতই গহীন সেই দহ যে একশো লগি জোড়া দিলেও তুমি থৈ পাবে না, তল পাবে না। কালিদহ পার হতে পারলে ক্ষীরোদবিল। সেই বিলের পানি ক্ষীরের মতো ঘন। সেখানে বৈঠা চলতে চায় না। নৌকা একচুলও নড়তে চায় না কোনোদিকে। সেই বিলের মাঝখানে ফুটে আছে হৃদকমল ফুল। এক্ষুণি রওনা দিয়ে তুমি যদি সূর্য ডোবার আগেই সেই ফুল নিয়ে ফিরে আসতে পারো, মায়ের মুখে ঢেলে দিতে পারো সেই ফুলের রস, বেঁচে উঠবে তোমার মা।’

বই বন্ধ করে জানালা দিয়ে বাইরে তাকায় ছেলে। এখন বেশ রাত। অন্ধকার নেমেছে ঘন হয়ে। সে জানালার কাছে যায়। চার বছর আগে, মায়ের আত্মহত্যার রাতে, নানি বলেছিল যে তাদের মা আজ থেকে হয়ে গেল আকাশের তারা। কোন তারাটা যে তাদের মা! ছেলে ফিসফিস করে বলে-- হৃদকমল ফুলের আরেক নাম যে ভালোবাসা, তা আমার জানা ছিল না মা। আমি একদিন সেই হৃদকমল ফুল নিয়ে ঠিক পৌঁছে যাব তোমার কাছে। 

No comments:

Post a Comment