Tuesday, April 30

অহি বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প




ইন্টারভিউ

দৈনিক 'নগর সমাচার' এমনিতেই বেশ নামকরা কাগজ।তার ওপর যখন বৈশাখের বিশেষ সংখ্যার জন্য সদ্য সাহিত্য একাডেমী পুরষ্কার প্রাপ্ত বিখ্যাত লেখক সুষেন মান্ডী'র ইন্টারভিউ নিতে আমায় পাঠানো হল তখন বেশ টেন্সড ছিলাম।

সত্যি বলতে কি আমার চাকরিটা হয়েছিলো বেশ কষ্ট করে।
খুব সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হলেও বাংলা সাহিত্যে একটা মাস্টার্স ডিগ্রি আর গল্প,কবিতার জগতের সাথে কিছু আলাপ থাকার জন্যই ওপর মহল থেকে হয়তো এই সুযোগটা আমায় দেওয়া হল!
সুষেন মান্ডীর ভাড়া বাড়ি মধ্য কলকাতার এক অপরিসর গলির মধ্যে।
এত নামকরা লেখক যে এমন ঘরে থাকবেন তা আগে থেকে আন্দাজ করতে পারিনি।

অবশ্য লেখক মাত্রেই তাদের অর্থনৈতিক অবস্থার ধার ধারেন না শুধুমাত্র পরিবেশের গুণে একথা শুনেছিলাম বটে।
ঘরটা গলির ভেতর বলে বেশ নিরিবিলি।
সাধারণত লেখকদের ঘর যেমন হয়।ঘরের একদিকের দেওয়াল পুরোটাই আলমারি।যার কাঁচের ভেতর দিয়ে দেখা যাচ্ছে বই এর সারি তাছাড়া এদিক -ওদিক ছড়িয়ে আছে এমন কিছু বই যা নিয়ে সাম্প্রতিক কালে হয়তো উনি কাজ করছেন।

তার মধ্যে একটা শ্রী অমিয়নাথ স্যান্যালের লেখা 'স্মৃতির অতলে' আর একটা বই এর উপরে স্যার অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের ছবি দেওয়া।একটু দূরে রয়েছে বলেই নামটা পড়া যাচ্ছে না। উঠে গিয়ে বইয়ের নামটা দেখব কি না ভাবছি,এমন সময় ঘরে ঢুকলেন ঢুকলেন ভদ্রলোক।

সুষেন বাবুর চেহারায় কোন বিশিষ্টতা নেই। মধ্যে ষাটের এই ব্যক্তির পরনে সাধারণ লুঙ্গি,ওপরে পাতলা ফতুয়া।
হাইট আন্দাজ পাঁচ ফুট দশ কি এগারো।
গায়ের রঙ বেশ চাপা।

আমায় দেখে হাল্কা হেসে বললেন,আমার সম্মন্ধে কিচ্ছু নতুন বলার নেই মশাই।
আমার যা বাহ্যিক পরিচয় তা তো আপনারা একেবারে সব ঘেঁটে বের করেছেন। সমস্তটাই নিউজে দেখিয়েছেন পুরষ্কার পাওয়ার আগেই। একাডেমির পুরষ্কার কি আমায় একদিনেই বদলে দেবে নাকি,এ্যাঁ? হাঃ হাঃ হাঃ।

আমিও হেসে ফেললাম। বললাম না, স্যার, আসলে ব্যপারটা ঠিক তা নয়,এই দক্ষিণপন্থার জয়জয়কারের যুগে সবাই স্রেফ বাহ্যিক আবরণটা সকলে দ্যাখে,প্যাকেজিংটাই মুখ্য।

তা তুমি কি পেঁয়াজের খোলা ছাড়িয়ে আসল মানুষটা কে বুঝতে চাইছো?
বলেই আবার এক প্রস্থ হাসি।

হাসি থামিয়ে সুষেন বাবু জিজ্ঞেস করলেন,"কবিতা পড়া হয়?"

বললাম হয় একটু-আধটু।
ওই কিছু জয় গোঁসাই,কিছু রবীন্দ্রনাথ,কিছু সুভাষ মুখুজ্যে।

শুনে উনি খানিক্ষণ গম্ভীর থেকে বললেন,কবিতা এক ধরনের মানসিক উওরণের পথ জানো তো!
যারা একেবারেই কবিতা পড়ে না বা কবিতার মাধুর্য সম্বন্ধে যাদের কোন ধারণাই নেই তারা কিছুতেই "শখের লিখিয়ে"হওয়ার পরের চৌকাঠ টা ডিঙোতে পারে না। তা বলো তোমার কি প্রশ্ন করার আছে।

স্যার, আপনি প্রথমে রাজনৈতিক সাহিত্য লিখতেন। আপনার প্রথম উপন্যাস 'চিংড়ি' তে আপনি তুলে ধরেছিলেন যে কিভাবে ধানী জমিতে জোর করে নোনা জল ঢুকিয়ে দিয়ে চিংড়ি মাছের ভেড়ি বানিয়ে দেওয়া হয়। সেই উপন্যাস পাঠক মহলে তো বটেই এমনকি রাজনৈতিক মহলেও হুলুস্থুল ফেলে দিয়েছিলো।
শোনা যায় আপনাকে নাকি প্রচুর থ্রেটও শুনতে হয়েছে এই জন্যে! তারপর আপনি দীর্ঘকাল নিরুদ্দেশ ছিলেন। যদিও আদিবাসী জীবন এবং প্রকৃতি নিয়ে সেই সময় 'জঙ্গুলে' নামে একজন অজ্ঞাত পরিচয় লেখকের বই প্রকাশিত হয়।
দীর্ঘ সময় বাদে জানা যায় সেটা আপনারই ছদ্মনাম। লেখার মাধ্যম ও বিষয় নিয়ে এই মারাত্মক এক্সপেরিমেন্ট এর সিদ্ধান্ত কি হঠাৎই?

এই প্রশ্নে সুষেন বাবুর মুখে আবার হালকা হাসির আভাস দেখা গেল। খানিক্ষন অপেক্ষা করে যেন গোটা বিষয়টা সাজিয়ে নিয়ে উনি শুরু করলেন-
সাহিত্য মানেই তাতে কোন না কোন রাজনৈতিক মতামত থাকবেই। তা বলে তা কখনোই কারুর ধামা ধরার জন্য নয়।সেটা থাকবে সৃষ্টি কর্তার নিজস্ব বিশ্বাস,নিজস্ব সত্ত্বার জন্য। যাক সে কথা,
আমার পদবি শুনেই বুঝতে পারছো যে আমি এই বাংলার প্রান্তিক জঙ্গলমহলের মানুষ।তবে আমাদের বাড়ি ছিলো মফস্বলে,যাকে বলে জঙ্গল ঘেঁষা ছোট শহর। 'চিংড়ি' প্রকাশের পর নানা ভাবে আমাদের বাড়ির ওপর চাপ আসছিলো।
একদিন সামান্য দেওয়াল লিখন নিয়ে গঞ্জের কাছেই কিছু লোক আমার বাবা কে মারধোর করে,কেউ বাঁচাতে এগিয়ে আসেনি। ছোটবেলা থেকেই আদিবাসী দের পরব,তাদের বিশ্বাস,জীবনযাত্রা আমায় আকৃষ্ট করতো। দাদা তো সংসারের ভার আগেই নিয়েছিলেন। তাই আর কোন পিছুটান না রেখেই ঠিক করি সভ্যতার অবদান এই সমাজ আমার জন্য নয়। একদিন রাত্তির বেলা বাড়ি থেকে একরকম পালিয়েই অরণ্যের গভীরে চলে যাই। প্রথম প্রথম একটু সমস্যা হত। তবে মুখোশ আঁটা 'ভদ্দরলোকে'দের প্রতি আমার বিতৃষ্ণাই আমায় সাহায্য করেছিলো ওখানে টিকে থাকতে।
অবশেষে একদিন শাল গাছের ছায়ায় সূর্যাস্ত দেখেছিলাম। আদি-অনন্ত প্রকৃতির কাছে অ-কৃত্রিম সেই সব উপলব্ধি,নানকি মাহাতোর মাদলের বোল,সেখানকার অপার্থিব সমস্ত দৃশ্যময়তা আর আমায় ফিরে যেতে দেয় নি। এক-আধ দিন যা গেছি তা শুধুই পরিবারের সাথে দেখা করার জন্য। আসলে তখন অন্তরের ঘৃণা মুছিয়ে দিয়েছে প্রকৃতি। ওই কষ্টি পাথরের মতো মানুষগুলোর কাছে জেনেছি সোনা আসলে গলায় বা কানে নয় থাকে মানুষের মনের গভীরে। তাই জন্যই আবার নতুন করে শহরে আসতে পেরেছিলাম।

জিজ্ঞেস করলাম শহরে এলেন কেন?

সেই প্রকৃতিকেই জানবার জন্যে ।শহুরে প্রকৃতি,শহুরে মানুষ কে দেখার সৌভাগ্য হয়নি কখনো।
--শহরে অসুবিধা হয়নি?
একটু অসুবিধা হত,মনে হত কি লিখব!
সমস্তটাই গতে বাঁধা। প্রথম প্রথম এই ঘরটায় যখন আসি তখন একে লোকে বলতো ভুতুড়ে ঘর,এই ঘরে দেওয়াল নাকি কথা বলে। আগে আগে আমল দিইনি। একদিন মাঝরাতে ঘুম থেকে উঠে দেখলাম চাঁদের আলো আর নভেম্বর মাসের কুয়াশা মিলে অপার্থিব ঔজ্জ্বল্যে ভরে আছে ঘরটা। জানলা দিয়ে দেখা যাচ্ছে একটা কুকুর আর একটা মাতাল প্রায় গলাগলি করে ঘুমাচ্ছে। কাছের চার্চটায় ঘন্টা বাজলো,ঠিক যেন শমনের শব্দ। কাল নিদ্রায় আচ্ছন্ন সভ্যতার অবচেতনকে প্রহরে প্রহরে ঘা দেওয়ার জন্যই যেন ওর সৃষ্টি। জানিনা তখন কটা বাজে,একটা নাকি দুটো!
ধন্ধে পড়েছিলাম। সময়ের এই অনন্ত প্রবাহে স্থির মুক্তো বিন্দুর মত একি আমি না আমি রুপী অর্ধ-জাগ্রত চিরন্তন মানব সত্ত্বা? চারিদিকে এক অদ্ভুত বাঙ্ময় নিরবতার মধ্যে হারিয়ে ফেলেছিলাম নিজেকে। তার পরদিন থেকে ঘুরতে শুরু করি তিলোত্তমার পথে পথে। ক্রমশ উপলব্ধি হয় প্রকৃতি যেমন বন প্রান্তরে আছে তেমনই শহরেও আছে। শুধু তার প্রকাশ আলাদা,চেহারা আলাদা।
অন্তর বস্তুর ঐশ্বর্যে মানুষের মনকে মোহিত করে রাখার ক্ষমতা কিন্তু পুরোপুরি সমান। শহরে অন্ধি-সন্ধি,পথে ঘাটে চারদিকে কবিতা,গল্প ছড়িয়ে আছে।খুঁজে কুড়িয়ে শুধু কুড়িয়ে নেওয়ার অপেক্ষা। ইচ্ছে হলে গল্পের ওপর গল্প গেঁথে উপন্যাসের রুপ দাও।

ইন্টারভিউ শেষে বাড়ি ফেরার জন্য সুষেন বাবু নিজেই এগিয়ে দিতে চাইছিলেন গলি মুখ পর্যন্ত। আমি বাধা দিলাম, কারণ ক্যাব বুক করাই ছিলো। বাড়ি ফেরার পথে বারবার মানুষটার কথা যত মনে পড়ছিলো তত ভালোবেসে ফেলছিলাম আমার চিরচেনা কোলকাতাকে।
বারবার কৃতজ্ঞ হচ্ছিলাম আসন্ন বৈশাখের প্রথম দিনটার কাছে।




No comments:

Post a Comment