Tuesday, April 30

সত্যম ভট্টাচার্যের গল্প




বাসে একদিন


সুযোগটা যে এভাবে একদিন চলে আসবে প্রলয় তা স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি।

এইশহরে ওরা এসেছে প্রায় বারো বছর হয়ে গেছে।আসার কিছুদিন পরেই মলিদির সাথে এক হেয়ার স্পেশালিস্টের চেম্বারে দেখা হয়ে গিয়েছিলো প্রলয়ের।বলা ভালো একদম কাকতালীয়ভাবেই।মলিদি এসেছিলো ওর বরকে সেখাতে।সেদিনই মলিদিকে দেখে প্রলয় জানলো বা বুঝলো যে মলিদির বিয়েও এই শহরেই হয়েছে।সেই ছোট্ট চেম্বারে মলিদির বর আর প্রলয় দুজনে দুজনকে দেখে আশ্বস্ত হয়েছিলো,কারণ চারিদিকে সেসময় সেখানে গিজগিজ করছিলো প্রমীলাকুল,আর কেবলমাত্র ওরা দুজনেই পুরুষ। তখোনো কিন্তু প্রলয় জানেনা যে সেই ভদ্রলোকই মলিদির বর।

যাই হোক সেদিন মলিদি কথা বলেনি প্রলয়ের সাথে।তার কারণও আছে।সদ্য সদ্য তখন প্রলয়ের নীলার সাথে ব্রেকআপটা হয়েছে।আর ওদের দুজনেরই খুব ভালো বন্ধু ছিলো মলিদি।তিনজন একসাথে মিলে কত আড্ডা মারা সেই মফস্বল শহরের চায়ের দোকানে, মাঠেঘাটে,রাস্তায়,কলেজে,রিক্সাভ্যানে যাতায়াতে।মলিদির বাড়িতেও নীলা আর প্রলয়ের ব্যাপারটা জানতো। হাঁটতে হাঁটতে ওরা দুজনে চলে যেত কোনদিন মলিদির বাড়িতে আড্ডা দিতে।মলিদিও এসেছিলো প্রলয়ের বাড়িতে।এমত অবস্থা থেকে যেদিন প্রলয় নীলার সাথে সম্পর্কটার ইতি ঘটাতে চেয়েছিলো,খুব গন্ডগোল হয়েছিলো ওদের মধ্যে। মলিদি প্রলয়কে ফোন করে খুব ধমকেছিলো। আর নীলা তো বলেইছিলো যে দেখে নেবে।দেখে নিতে খানিকটা পেরেওছিলো নীলা।আর তার কিছুদিন পরেই প্রলয় ওর মাকে নিয়ে ওদের পুরোনো বাড়ি ছেড়ে এই শহরে চলে আসে।

এরপর থেকে মাঝেমাঝেই বাসে মলিদিকে দেখতো প্রলয় আর ভগবানকে মনে মনে বলতো-প্লিজ,একটি বার আমাকে কথা বলার সুযোগ করে দাও।ওর শুধু মনে হোতো মলিদিকে যদি বোঝানো যেত ওর সেই সময়ের পরিস্থিতি তাহলে মলিদিই হয়তো একমাত্র বুঝতো।বেশীরভাগই প্রলয় মলিদিকে দেখতো বাসে অফিস যাবার সময়।ও যেখানে বাস থেকে নামে সেখান থেকে আরো খানিকক্ষণ যাত্রাপথ মলিদির।প্রলয় জানে মলিদি কোন স্কুলে পড়ায়।শুধু মলিদিই না,ওদের তখনকার বন্ধুদের সবার খবরই রেখেছে ও।প্রলয় ভাবে শুধু ওরই খবর কেউ রাখেনি।খারাপ লাগে ওর মাঝেমাঝে।নীলা ওর সাথে এত গন্ডগোল করবার পরও প্রলয় ওর খবর রাখে।বাসে উঠেই প্রলয় খোঁজে মলিদি আছে কিনা বাসে।দেখলে আর বাসে জায়গা থাকলে প্রলয় চেষ্টা করে মলিদির সিটের পাশে গিয়ে দাঁড়াতে যাতে কথা বলা যায় একটু।কিন্তু আজ অবধি পেরে ওঠেনি।ভয় লাগে ওর।যদি মলিদি রিএক্ট করে কোনো।যদি চেঁচিয়ে বলে ওঠে-আমি তোর কোন কথা শুনতে চাই না।কোথায় যাবে প্রলয় তাহলে।বাসে মানসম্মান বলে আর কিছু থাকবে না ওর ডেলিপ্যাসেঞ্জারদের মধ্যে।আবার মাঝেমাঝেই নিজেকে বলে প্রলয় কারো কি সম্ভব এতদিন ধরে মনে রাগ ধরে রাখা।আবার ভাবে মলিদির মনে আছে তো ওকে।যেভাবে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকে,ওকে দেখে বা না দেখে জানালা দিয়ে।কে জানে কোনটা ঠিক?এই এতগুলি বছরে মলিদি শুধু একদিনই তাকিয়েছিলো ওর চোখের দিকে।এসব ভাবতে ভাবতে এভাবেই কেটে গেছে প্রায় বারোটা বছর।কথা আর বলা হয়ে ওঠেনি।প্রলয়ের এখন প্রায় মাথা জোড়া টাক।মলিদিরও কয়েকটি পক্ককেশ দেখা যায় এদিক সেদিক।

সেদিন সকাল থেকেই মুষলধারায় বৃষ্টি হচ্ছিলো।ছাতা নিয়ে আধভেজা হয়ে প্রলয় যখন বাসস্টপে এসে দাঁড়ালো তখন সেই বাসটাই এলো যেটাতে মলিদি বেশীরভাগ দিন থাকে।বাসটা আজ অদ্ভূত রকম ভাবে ফাঁকা ফাঁকা।মাত্র এক দুজন দাঁড়িয়ে আছে।সাধারণত এই বাসটায় এই স্টপেজে এত ভিড় থাকে যে সিঁড়ির খুব একটা ভেতরে প্রলয় যেতে পারে না।আজ উঠতেই প্রলয় দেখলো যে মলিদি সিঁড়ির একদম উল্টোদিকে একটা থ্রিসিটারের মাঝে বসে আছে।জানালার দিকে আরেক দিদিমণি।প্রলয় চেনে।মলিদিরই কলিগ।আর এদিকে একজন অচেনা ভদ্রলোক।বাসটা অনেকদূর যায়।অতএব আজও বসা বা কথা বলা হোলো না মলিদির সাথে।ভাবলো প্রলয়।কাছাকাছি এক দুজন চেনা লোক আছেন,বসে বা দাঁড়িয়ে।তাদের সাথেই টুকটাক কথা বলছিলো প্রলয়।এই যেমন স্কুল-গরম-ছুটি-বৃষ্টি এইসব নিয়ে।স্রেফ সময় কাটানো আর মুখচেনাটা বজায় রাখা।

আপাতত প্রলয় মলিদির সিটের দিক থেকে একটু সামনের দিকে চলে এসেছে।সিটটার পাশে এখন সঞ্জীবদা বলে একজন দাঁড়ানো।প্রলয় ওর দিকে ঘুরে ওর সাথেই কথা বলছিলো।ওর আধঘন্টার যাত্রাপথের প্রায় কুড়ি মিনিট চলে গেছে।এখানে একটা রেলগেট আছে।বাসটা ঘুরলো।প্রলয় নীচু হয়ে দেখলো আজ রেলগেট পড়েনি।ভালো।সময়ে পৌছনো যাবে।ঠিক এই সময়ই মলিদির পাশের ভদ্রলোক উঠে দাড়ালেন।প্রলয় ভাবলো হয়তো মানিব্যাগ বা মোবাইল বের করবেন পকেট থেকে তাই।কিন্তু না,উনি নামবেন।নিজের উপর খুব রাগ হোলো প্রলয়ের।ভাবলো আজ যদি ও দাঁড়ানো থাকতো ওখানেই,বসতে পারতো তাহলে মলিদির পাশে একটু।সুযোগটা এত কাছে এসেও চলে যাওয়াতে নিজের কপালকেই দুষলো প্রলয়।এখন স্বাভাবিকভাবেই সঞ্জীবদা বসবে ওখানে।যাবে অনেকটা দূর।কিন্তু একি?প্রলয় অবাক।সঞ্জীবদা ওকে বসার জন্য বলছে।

ডেলিপ্যাসেঞ্জাররা তো বলেনা এরকম বসতে কাউকে।প্রলয় যেন কেমন একটা ঘোরের মধ্যে ঢুকে গেলো।তাহলে ও বসতে পারবে এতদিন পর মলিদির পাশে?একদুবার অনিচ্ছা সহকারে সঞ্জীবদাকে বললো বসতে।তারপর গিয়ে নিজেই বসে পড়লো মলিদির পাশে।

বাস চলছে।প্রলয় শুনতে পেলো অনেকদিন পর আজ আবার ওর বুকের ভেতর সেই আওয়াজটা হচ্ছে যেটা খুব উত্তেজনা হলে কৈশোর বা যৌবনে ও শুনতে পেতো।পারবে কি আজ ও মলিদির সাথে কথা বলতে?সিটটা দিয়ে ভগবান আজ ওকে একটা সুযোগ দিয়েছে,বারো বছর পর।মলিদিও কি বলবে ওর সাথে কথা।আপাতত মলিদি কথা বলছে  পাশে বসা ওর কলিগের সাথে।প্রলয় একটু জল খেলো ব্যাগ থেকে বোতল বের করে।হাতে সময় আর প্রায় একদমই নেই।প্রলয় নামার আগে নদীর ওপর যে ব্রীজটা পড়ে,বাসটা সেটা পার করলো।প্রলয় ভাবলো আর দেরী করা ঠিক হবে না।মলিদি কথা না বললেও তাড়াতাড়িই বাস থেকে নেমে যেতে পারবে ও।দরজা কাছেই আছে।আর বাকি সব পরে ভাবা যাবে।
           
নীচু গলায় প্রলয় বললো-কেমন আছো মলিদি?মলিদি ঘুরে তাকালো। প্রলয়ের বুকের মধ্যে তখন কেউ যেন হাতুড়ি পিটছে।কি করবে মলিদি এখন।প্রলয়কে কি বলে দেবে-আমি তোর সাথে কথা বলতে চাই না।কোনদিন কথা বলার চেষ্টা করবি না তুই আমার সাথে।কিন্তু তেমন কিছু হোলো না।মলিদি নীচু গলায় সেই বারো বছর আগের মতো করেই বললো-ভালো।তুই?পরের দু তিন মিনিট মলিদির সাথে জীবনের এই বারো বছরের গ্যাপটা নিজেই শেয়ার করে নিলো প্রলয়।মলিদির কাছেও জানতে চাইলো।মলিদিও বললো।বৃষ্টি তখন অনেকটা কমে গিয়ে চারিদিক আলো করে রোদ উঠছে।স্টপেজ এসে গেছে প্রলয়ের।কন্ডাক্টর বিকাশদা তাড়া দিচ্ছে গেটের কাছে যাবার জন্য।মন চাইছে না,কিন্তু নামার জন্য প্রলয় উঠে দাড়ালো সিট থেকে।মলিদিকে বললো-ভালো থেকো।মলিদিও স্নিগ্ধ হেসে বললো-তুইও ভালো থাকিস।মলিদির সেই হাসিতে বাইরের রোদ যেন আরো ঝলমল করে উঠলো।

1 comment:

  1. লেখাটায় টান আছে। কিন্তু দুম করেই যেন শেষ হয়ে গেলো। ভালো লাগছিল পড়তে।

    ReplyDelete