Tuesday, April 30

গীর্বাণী চক্রবর্তীর গল্প




আমি সুলগ্না বলছি


এই যে শুনছেন?  হ্যাঁ আপনাদের বলছি। একটা গল্প বলতে খুব ইচ্ছে করছে। শুনবেন? বলি তাহলে……… আমি সুলগ্না। আজকে আমার বিয়ে। ভেবেছিলাম সানাই বাজবে, রজনীগন্ধা, গোলাপের সুবাসে আমোদিত হবে চারিদিক। হাজার আলোর রোশনাইয়ে ভেসে যাবে বাড়ির আনাচ কানাচ । জানি না নিজের লোকজন এত নিষ্ঠুর হয় কি করে! শুধুমাত্র সৌম্যর সাথে বিয়ে দেবে না বলেই আমাকে লুকিয়ে রেখেছে ছোট পাহাড়ী জনপদের এই বাড়িটাতে। আমারও জেদ জানে না। সৌম্যকে যে আমি কথা দিয়েছি ওর কাছে আমি যাচ্ছি।
                                                                       

সৌম্য, আমার পল অনুপলে মিশে যাওয়া এক সত্ত্বা। আমার পরম প্রিয়, আমার বর্তমান ও ভবিষ্যৎ। বিয়ে পাগল ভাবছেন তো আমাকে। আসলে কি জানেন, মফস্বলের মেয়ে আমি। প্রথমবার বাবা মাকে ছেড়ে নিজের শহর থেকে বহুদূরে পড়তে যাই। আমি ছিলাম ওই যাকে বলে ঘরকুনো। বাড়ির বাইরে কিছুতেই মন বসাতে পারতাম না। সেই সময় সৌম্যই আমাকে আগলে রেখেছিল।
                                                                         

আমি যে বাড়িটাতে পেইংগেস্ট থাকতাম সেই বাড়ির ছেলে সৌম্য।একদিন ছাদে কাপড় মেলতে গিয়ে হঠাৎই ওর সাথে পরিচয়। ফাল্গুনের উথাল পাতাল হাওয়ায় সৌম্য উদাস চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল। বিশাল ছাদে সৌম্যকে প্রথম বার দেখে একটু ঘাবড়েই গিয়েছিলাম। কে ওখানে ?  বলতেই ও আমার দিকে ঘুরে তাকায়। টানাটানা চোখের রোগা পাতলা ফরসা ছেলেটার মধ্যে ছিল কেমন যেন এক অমোঘ আকর্ষণ। নিজেই এগিয়ে গিয়ে আলাপ করি।
                     
তারপরে বহুবার সবার অলক্ষ্যে সৌম্যর সাথে দেখা হয়। তবে ওর বাড়ির ছাদেই বেশিরভাগ সময় দেখা হোত আর নয়ত বাড়ির বাইরে, তবে সেটা কদাচিৎ। ওদের বাড়িটা একটা অদ্ভুত বাড়ি ছিল জানেন ! বাড়ির নানা জায়গায় তাবিজ কবজ ঝোলান থাকত। আর ছাদে লাল শালু বাঁধা অজস্র তুলসীগাছ। সৌম্য অবশ্য বলেছিল ওর মা খুব ধার্মিক তাই এইসব তাবিজ কবজ আর তুলসী গাছের ছড়াছড়ি বাড়িতে।
                                                     
সেদিন সৌম্যের বাড়িতে নাম সংকীর্তনের আয়োজন করা হয়েছিল। পুরো একটা দিন ওর দেখা নেই। একটু অভিমান হয়, এত কি ব্যস্ততা একবার দেখা করা যায় না আমার সাথে। সত্যি বলছি তখন সৌম্যকে না দেখে  একদিন থাকতেও আমার ভীষণ কষ্ট হোত।আর থাকতে না পেরে সৌম্যদের ঘরে গেলাম। যদিও আমরা যারা পেইংগেস্ট তারা দোতলায় থাকতাম। একতলায় সৌম্যরা। খুব একটা দেখা হোত না ওর বাবা মা'র সাথে। ওনারা কারোর সাথেই খুব একটা মেলামেশা করতেন না। কেমন যেন নিঝুম হয়ে থাকত ওদের বাড়িটা। সৌম্যর টানেই গেলাম ওদের ঘরে।
                                                           
সৌম্যর মা ভীষণ ধার্মিক জানতাম কিন্তু মাথাটাও যে খারাপ সেদিন না গেলে জানতেই পারতাম না। সামনের বিশাল হল ঘরটাতে যজ্ঞ হচ্ছিল। সৌম্যর বাবা মা হোমকুন্ডের সামনে বসেছিল।বেশ কিছুক্ষণ এদিকওদিক দেখতে থাকি। ওদিকে নাম সংকীর্তন শুরু হয়ে গেছে।কিন্তু সৌম্যর দেখা নেই। শেষে একপ্রকার বাধ্য হয়েই সৌম্যর মাকে জিজ্ঞাসা করি, সৌম্য কোথায়?  ওকে তো দেখতে পাচ্ছি না।
                                                           
এক আশ্চর্য নিস্তব্ধতা সবাইকে যেন গ্রাস করে। তারপর যা হলো এখনও ভাবতে আমার অবাক লাগে। যাচ্ছেতাই ভাষায় সৌম্যর মা আমাকে অপমান করে ঘর থেকে বের করে দিল। আমি নাকি পাগল ! আমি নাকি নেশাগ্রস্থ ! বাবাকে মনে হয় ওরাই খবর দিয়েছিল।পরের দিন বাবা এসে আমাকে বাড়িতে নিয়ে আসে। পরে শুনেছি সৌম্যকেও নাকি ওরা ঘরে আটকে রেখেছিল যাগযজ্ঞের বাহানা করে। কিন্তু আটকে রাখা অত সহজ নাকি ! সৌম্যও চলে এসেছে আমার সাথে। কত করে বাবা মাকে বললাম বিয়েটা দিয়ে দিতে।কে শোনে কার কথা ! তার বদলে আমাকে পাঠিয়ে দিল পাহাড়ি এলাকার এই বাড়িটাতে। এখানেও সৌম্য এসেছে আমার সাথে। একদিকে ভালোই হয়েছে, সৌম্য আর আমি এখন অনেকটা সময় কাটাতে পারি নিজেদের মত করে।
         
বলেছিলাম না আজকে আমার বিয়ে। কিন্তু সাজগোজ করার মত কিছুই হাতের কাছে নেই। শুধু ব্যাগে আমার খুব প্রিয় একটা লাল শারি ছিল। মা বোধহয় দিয়ে দিয়েছিল। ওটাই পড়েছি। আর সুন্দর করে একটা খোঁপা করেছি। ওহো বলতে তো ভুলেই গেছিআপনাদের, যেদিন আমাকে ওদের বাড়ি থেকে বের করে দিল সেদিন সৌম্যর মা তারস্বরে চেঁচাচ্ছিল আর  বলছিল, সৌম্য না কি সাত বছর আগে ছাদ থেকে পা পিছলে পড়ে গিয়ে মারা গেছে। বুঝুন কান্ড ! এটা কখনো হয় ?
                                                     
শুনতে পারছেন পায়ের আওয়াজ ? সৌম্য মনে হয় এসে গেছে । ওই যে দরজায় টোকা পড়ছে……………


সেন্ট মেরিজ এসাইলেমের দশ নম্বর ঘর সকালের নরম আলোয় তখন আলোকিত। তবে অন্যদিনের মত একবুক নিস্তব্ধতায় ডুবে নেই আজ ঘরটা। চারিদিকে এক অস্পষ্ট গুঞ্জন আলোড়িত হচ্ছে। একে একে জড়ো হওয়া ডাক্তার, নার্স এবং আরও অনেকে হতভম্ব বিহ্বল চোখে দেখে এসাইলেমে মাস কয়েক আগে আসা মানসিক ভারসাম্যহীন রুগী সুলগ্না একমাথা সিঁদুর নিয়ে নিথর দেহে খাটের ওপর পড়ে আছে। হাত মুষ্টিবদ্ধ, যেন কারও হাত নিজের হাতের মধ্যে শক্ত করে ধরে আছে।



No comments:

Post a Comment