Tuesday, April 30

সৌরভকুমার ভূঞ্যার গল্প







মুক্তি

পূবের আকাশে সূর্যটা সবে উঠব উঠব করছে। সহসা করুণ কান্না আর হাহাকারের শব্দে ভেঙে খানখান হয়ে যায় সকালের নীরবতা। বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে একটা ভয়ভয় ভাব। পাড়ার পুরুষ-মহিলারা যে যার প্রাত্যহিক কাজকর্ম সারছিল। অকস্মাৎ কান্নার শব্দে স্বাভাবিক জীবন-ছন্দ থমকে যায়। এ-তো যেমন তেমন কান্না নয়। এই কান্নার সঙ্গে জুড়ে আছে মৃত্যুর গন্ধ। আশেপাশের প্রায় সকলে এসে হাজির হয় পরিমলের বাড়িতে। কান্নার কারণটা জানতে পেরে সকলেই স্তম্ভিত হয়ে যায়। ভয় আর উত্তেজনার একটা অদ্ভুত শিহরণ বয়ে যায় শরীরের শিরায় শিরায়। একে মৃত্যু, তাও আবার আত্মহত্যা...পরিবেশটা কেমন যেন থমথমে হয়ে যায়। একটা গা-ছমছম অনুভূতি জড়িয়ে থাকে ভোরের বাতাসকে।
গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছে পরিমলের মা বিজয়া। রোজকার মতো তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়েছিল বিজয়া। শরীর ভালো নেই বলে রাতে খাওয়া-দাওয়া করেনি। প্রতিদিন ভোরের আলো ফোটার আগেই তার ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস। কিন্তু আজ সকাল হয়ে যাওয়ার পরও যখন তার ঘুম ভাঙে না তখন পরিমলের বউ কাবেরী বাইরে থেকে বেশ কয়েকবার ডাক দেয়। কিন্তু কোনো সাড়াশব্দ পায় না। দরজায় ধাক্কাধাক্কি করেও যখন কোনো সাড়া আসে না তখন এক অজানা ভয়ে তার বুকটা ছ্যাঁত করে ওঠে। তার ডাকে পরিমল ছুটে আসে। তার বুঝতে বাকি থাকে না খারাপ কিছু ঘটেছে। দরজা ভেঙে ঘরের মধ্যে ঢুকতেই সারা শরীরে শীতল শিহরণ বয়ে যায়। দেখে কড়িকাঠ থেকে ঝুলছে মায়ের নিথর শরীর।
ষাট ছুইঁছুঁই বিজয়া একে বিধবা, তার ওপর দীর্ঘ্যদিন ধরে অসুখে ভুগছিল। সুতরাং ছেলে-বউমার সংসারে অনেকটা পরগাছার মতো বেঁচে থাকা। কোনো কারণে মনোমালিন্য হওয়ায় এমন ভয়ংকর পথ বেছে নিয়েছে। প্রাথমিকভাবে এমন একটা ধারনা সবার মধ্যে জেগে ওঠার কথা এবং এর জন্য পরিমল বা কাবেরী কিংবা দুজনেই অভিযুক্ত হিসেবে আলোচিত হওয়ার কথা। কিন্তু তা হল না। বরং মনে হল উপস্থিত মানুষের মধ্যে যেন একটা স্বস্তি ভাব। এমনটা হয়ে যেন ভালোই হয়েছে। মৃত্যু নয়, তাদের মনে হল এ-আসলে মুক্তি। যদিও আত্মহত্যার ব্যাপারটা কেউ কেউ সমর্থন করতে পারে না তবুও তেমন করে সমালোচনার ঝড় বইল না। উল্টে পরিমলদের ওপর বর্ষিত হল মানুষের সমবেদনা। মোড়ল দীননাথ ভেঙে পড়া পরিমলের মাথায় হাত রেখে বলে, ‘কষ্ট পেয়ো না। যা হয়েছে ভালোই হয়েছে। বেচারি শান্তি পেয়েছে।’
চোখ তুলে তাকায় পরিমল। ঘোলাটে দু-চোখ যন্ত্রণার ছবি স্পষ্ট কিন্তু মুখে কোনো শব্দ নেই।
‘মনকে শান্ত করো। ওর যাওয়াটাই তো ভবিতব্য ছিল।’
‘তাই বলে এভাবে...!’
‘বেচারি আর কোনো পথ পায়নি। খুব ভালোবাসত তোকে। মরে সেটা আরও একবার প্রমাণ করে গেল।’
চকিতে মুখ তুলে দীননাথের দিকে তাকায় পরিমল। একটা অব্যক্ত যন্ত্রণা তাকে দগ্ধ করতে থাকে। ভালোবাসা শব্দটি যে কতখানি যন্ত্রণাদায়ক তা বুঝতে পারে।
সময় গড়ায়। ভীড় বাড়তে থাকে। নানাবিধ কথাবার্তা ভেসে থাকে বাতাসে। যে কথাবার্তার অধিকাংশটা জুড়ে থাকে বিজয়ার আত্মত্যাগ আর ভালোবাসার কথা। একটি মহিলা কত গভীরভাবেই না ভালোবাসত সংসারটাকে। আত্মহত্যা ব্যাপারটা একটা অপরাধ। কিন্তু এই অপরাধের তত্ত্বটি বুদবুদের মতো হারিয়ে যায় তার আত্মত্যাগের মহত্বে। আর এ-সবের পেছনে বড়ো ভুমিকা বিন্দুবালার। কেননা বিজয়ার আত্মহত্যার কারণটা সেই কেবল জানত। বিক্ষিপ্তভাবে সে-কথাই শোনাচ্ছিল একে-ওকে।
একটু বেলা হতে পুলিশ আসে। বিজয়া যতই মহত্বের কাজ করুক না কেন, আইনকে তার পথে চলতে হবে। তাই সকল অনুরোধ-উপরোধ সরিয়ে একটা লাশ হয়ে তাকি পাড়ি দিতে হয় মর্গের পথে।

২.
বিন্দুবালা গ্রামের সবথেকে বয়স্কা মহিলা। মাঝবয়সিদের কাছে বিন্দুমাসি। পাড়ার প্রায় সব ঘরে তার যাতায়াত। অনেকে তাকে খুব ভালোবাসে, খাতির করে। অনেক বাড়ির অনেক খবর সে জানে। দোষের মধ্যে একটাই সে ছিল পেট পাতলা স্বভাবের। কোনো কথা গোপন রাখতে পারে না। এ-কারণে অনেকে তাকে অপছন্দও করত।
সকাল গড়িয়ে এখন দুপুর। একটা মৃত্যু পারিপার্শ্বিক শোক আনে ঠিকই কিন্তু তার জন্য আশপাশের রোজকার স্বাভাবিক কাজকর্ম বন্ধ হয়ে যায় না। তাই সকলের উত্তেজনা একটু একটু করে থিতিয়ে গেল অনেকটাই। কিন্তু দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর পাড়ার মহিলাদের হাতে যখন কিছুটা অলস অবসর তখন আবারও আলোচনায় উঠে এল বিজয়া। সেটাও বিন্দুবালার মাধ্যমে।
বিজয়ার আত্মহত্যার কারণটা সকালেই বিক্ষিপ্তভাবে বলেছিল বিন্দুবালা। কিন্তু সকালে পরিবেশটা এমন গা-ছমছমে ছিল যে নিজের কথাগুলো ঠিকঠাক বলতে পারেনি। অনেকে আবার তার কথা ঠিকঠাক শুনতে পায়নি। কৌতূহল থাকলেও এই নিয়ে বেশি কিছু জিজ্ঞেস করার সুযোগ হয়নি। হাজার হোক, একটা মহিলা গলায় দড়ি দিয়েছে। এখন হাতে অনেকটা সময়। শোকের পরিবেশও তেমন আর নেই। সবাই বিন্দুবালাকে ঘিরে ধরেছে। বিজয়ার ত্যাগ আর মহত্বের কথা শুনতে সকলেই বেশ আগ্রহী।

৩.
দীর্ঘ্যদিন ধরে মরণ রোগে আক্রান্ত ছিল বিজয়া। প্রথমটা কম ছিল। চিকিৎসা চলছিল। বাইরে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করার সামর্থ নেই পরিমলের। তবুও সাধ্যমতো চেষ্টার কসুর করেনি সে। একটি কোম্পানিতে শ্রমিকের কাজ করে সে। যা উপার্জন হয় তাতে সংসারটা হেসেখেলে চলে যাওয়ার কথা। কিন্তু তা হয়ে ওঠেনি। বিজয়ার রোগের পেছনে প্রতি মাসেই অনেকগুলো করে টাকা খরচ হয়। কম বয়সে বাবাকে হারিয়েছে পরিমল। মাকে আঁকড়ে তার বড়ো হয়ে ওঠা। বড়ো হওয়ার পরও অনেকটাই আঁকড়ে ছিল মাকে। সাধ্যমতো চেষ্টা করে মায়ের চিকিৎসার। কিন্তু রোগের প্রকোপ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তার অবস্থাও আয়ত্বের বাইরে চলে যেতে থাকে। প্রথমে টুকটাক ধার। তাতে কাজ হয় না। বিঘে তিনেক জমি ছিল। তার মধ্যে নিজের কেনা দেড় বিঘে জমিটা প্রায় জলের দরে বিক্রি করে দেয়। সে জানত এ-রোগ সারবে না। তবে ডাক্তাররা আশ্বাস দিয়েছিল অবস্থা যা, তাতে চিকিৎসা করালে আরও কয়েক বছর বাঁচবে। চেষ্টা করেছিল মায়ের চোখের আলো যতদিন বাঁচিয়ে রাখা যায়। বিজয়া লড়ছিল রোগের সঙ্গে আর পরিমল নিজের সঙ্গে। দুজনের যুদ্ধটাই ছিল অসম। বিজয়া বেঁচে রইল ঠিকই কিন্তু রোগ তার শরীরে ডালপালা বিস্তার করতে থাকে। পরিমলের দেনাও মায়ের রোগের পথ অনুসরণ করে। তবুও হার-না-মানসিকতায় লড়াইটা চালিয়ে যাচ্ছিল।
কয়েকদিন আগে বিজয়ার অসুস্থতা হঠাৎ বেড়ে যায়। গোটা শরীরে ভয়ংকর যন্ত্রণা। মাকে ডাক্তার দেখায় পরিমল। ডাক্তার জানায় এখন পরিস্থিতি যা তাতে চিকিৎসার জন্য তাড়াতাড়ি লাখ তিনেক টাকা লাগবে। পরিমল ভেবে পাচ্ছিল না কোথা থেকে আসবে এতগুলো টাকা। নতুন করে ধার পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। থাকার মধ্যে বাবার রেখে যাওয়া জমিটুকু। তা বেচলেও এতগুলো টাকা আসবে কিনা সন্দেহ। যদি আসেও, তারপর?
তারপর কি জানা ছিল না পরিমলের। এদিকে সংসারের অন্দরমহলেও বিদ্রোহের সূচনা হয়েছে। ঘরে বাইরে যুদ্ধ। অসহায়ত্ব আর যন্ত্রণার অক্টোপাশে ক্রমশ জড়িয়ে যাচ্ছিল সে। বিধ্বস্ত পরিমল যখন জমিটা নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারছিল না, তখন যেন মুশকিল আসান হয়ে হাজির হয় বিজয়া।
‘তুই কি জমিটা বিক্রি করার কথা ভাবছিস?’
দ্বিধাগ্রস্ত পরিমল হ্যাঁ-না কি বলবে ভেবে না পেয়ে অদ্ভুত চোখে চেয়ে থাকে মায়ের দিকে। তার জবাবের অপেক্ষায় না থেকে বিজয়া বলে চলে, ‘ওটা তোর বাবার অনেক কষ্টের ওই জায়গা। ও আমি বেচতে দেব না।’
‘তাহলে তোমার চিকিৎসা হবে কী করে?’ পরিমলের গলার সুর মিনমিনে।
‘আমি আর চিকিৎসা করাব না।’
‘তা হয় নাকি!’ বলল বটে কথাটা কিন্তু তাতে যেন উত্তাপের অভাব।
‘বললাম তো, আমার যা হয় হোক, ওই জমি তুই বেচবি না।’
মা-ছেলের কথাবার্তা আরও কিছুটা সময় চলে। যন্ত্রণাদগ্ধ মায়ের জেদি মুখের দিকে তাকিয়ে পরিমলের মনে একটা খটকা জেগে ওঠে। ভাবে মা কি তবে কিছু আভাষ পেয়েছে?’
সত্যি বলতে জমি বিক্রি করায় বাধাটা কেবল মায়ের কাছ থেকে আসেনি। তারও আগে এসেছিল স্ত্রী কাবেরীর কাছ থেকে। এত দেনার পর একেবারে নিঃস্ব হয়ে যাওয়াটা সে মানতে পারে না। বিজয়া যেমন মা, সেও একজন মা। নিজের দুই ছেলেমেয়ের কথা ভাবার মধ্যে সে কোনো অপরাধ দেখেনি। সব হারিয়ে ছেলেমেয়ে নিয়ে পথে নামার পক্ষে সায় ছিল না তার। কিন্তু পরিমল তার কথা মানতে চায়নি। স্বামী-স্ত্রীতে তীব্র কথা কাটাকাটি হয়। সংসারের আদালতে কঠিন রায় শুনিয়ে দেয় কাবেরী। বিধ্বস্ত পরিমল গৃহযুদ্ধ মোকাবিলার কোনো পথ খুঁজে পায় না। নিদারুন অসহায়ত্ব তিন প্রজন্মের বেঁচে থাকার অধিকারে প্রশ্নচিহ্ন তুলে দেয়। পিতা-পুত্র-স্বামী, ত্রিমুখী দাবির মাঝে নিজের কর্তব্য গুলিয়ে যায় পরিমলের। জীবনের আলো-অন্ধকারের মাঝে ঈশ্বর আর শয়তানের নীরব যুদ্ধে প্রতিনিয়তই বিধ্বস্ত হতে থাকে সে।
এখন মায়ের কথা শুনে তার ভাবনাচিন্তাগুলো তাগগোল পাকিয়ে যায়।

৪.
গতকাল বিন্দুবালা গিয়েছিল বিজয়ার বাড়ি। বিন্দুবালাকে দেখে খুব খুশি হয়েছিল বিজয়া। তার সঙ্গে নিজের জীবনের অনেক সুখ-দুঃখের কথা ভাগ করত সে। এই দুঃসময়ে বিন্দুবালাকে পেয়ে তার মনের সমস্ত আগল যেন খুলে যায়।
‘আর বাঁচতে ইচ্ছে করছে না দিদি।’
‘একথা বলিস না।’
‘সারা শরীরে ভীষণ যন্ত্রণা। আর সহ্য করতে পারছি না।‘
‘সব ঠিক হয়ে যাবে।’
‘না দিদি, তা আর হবে না। এ-শরীর আর সারবে না। আর কি জানো দিদি, শরীরের যন্ত্রণা তবু সহ্য করা যায়, কিন্তু মনের মধ্যে যে যন্ত্রণা তা কিছুতেই সহ্য করতে পারছি না। সে যন্ত্রণা আরও ভয়ানক। তার থেকে যে মুক্তি নেই। দিনরাত ঈশ্বরকে ডাকছি আমাকে তুলে নেওয়ার জন্য। কিন্তু আমি যেন যমেরও অরুচি হয়ে গেছি।’
‘এভাবে বলিস না। পরিমল দুঃখ পাবে। তোর জন্য কী না করছে ছেলেটা!’
‘যন্ত্রণাটা তো ওখানেই দিদি।’
কিছু বুঝতে না পেরে নির্বাক চোখে বিজয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে বিন্দুবালা। মুহূর্তক্ষণের নীরবতা কাটিয়ে আরও বিষণ্ণ সুরে বিজয়া বলে, ‘আমার চিকিৎসা করাতে গিয়ে সর্বশান্ত হয়ে গেছে ছেলেটা। বাজারে দেনা। অর্ধেক জমি গেছে। বাকিটাও বেচতে চাইছে। ওর বাবার শেষ স্মৃতি। জীবন থাকতে ওটা আমি বেচতে দিতে পারব না।’
‘মানছি তোর কথা। কিন্তু ভাব এমন ছেলে কজনের কপালে জোটে!’
‘ওই ভেবেই তো শান্তি পাচ্ছি না। আমি বুঝতে পারছি না আমার কপালটা ভালো না মন্দ। মা হয়ে ছেলেটাকে ক্রমশ বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছি। আমার কথা ভেবে ভেবে ছেলেটা শুকিয়ে যাচ্ছে। সংসারটা তছনচ হয়ে যাচ্ছে। আর কিছুদিন বেঁচে থাকলে হয়তো ওদের ধ্বংস হয়ে যাওয়া দেখতে হবে। পারছি না দিদি, কিছুতে সহ্য করতে পারছি না। নিজেকে এখন আমার খুব অপরাধী মনে হয়। আমার জন্য এতগুলো মানুষের জীবনে বিপর্যয় নেমে এসেছে।’
‘এসব কী আবোল-তাবোল বলছিস!’
‘আবোল-তাবোল নয় দিদি। যা সত্যি তাই বলছি। এমনিতে রোগের যন্ত্রণা। তার ওপর এই মানসিক যন্ত্রণায় আমি শান্তি পাচ্ছি না। এখন মরলে আমি শান্তি পাই।’
‘ছি, ছি! এমন কথা মনে আনতে নেই। বুঝতে পারছি তোর মন ভালো নেই, তাই মাথায় এসব কথা আসছে।’
‘না দিদি, সত্যি সত্যি আমি মরতে চাই। বাঁচার কোনো ইচ্ছেই আমার নেই। অনেক তো বাঁচলাম। আর কেন! এই রোগ সারবার নয়। কিছুদিন বেশি বেঁচে কেন একটা সংসারকে একেবারে ভাসিয়ে দিয়ে যাব? তার থেকে নিজেকে শেষ করে দেওয়া ভালো। তাহলে সব জ্বালা জুড়োয়। সংসারটাও বাঁচে।’
‘ষাট ষাট! এসব কী বলছিস পাগলের মতো!’
‘পাগল নয় দিদি, আমি সত্যি সত্যি মরতে চাই।’ বিজয়ার নীরব কান্না অশ্রু হয়ে ঝরে পড়ে। বিন্দুবালা তার চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে স্নেহমাখা সুরে বলে, ‘তুই মরলেই কি সংসারে শান্তি ফিরে আসবে? ছেলেটার কথা অন্তত একবার ভাব। এসব কথা ও যদি জানতে পারে...।’
কথা শেষ হয় না সহসা পরিমল এসে ঘরে ঢোকে। চমকে ওঠে বিন্দুবালা। বিজয়াও। বিন্দুবালা বুঝে পায় না পরিমল তাদের কথাবার্তা শুনতে পেয়েছে কি না। শুনলেও কতটুকু। তার চোখের দিকে তাকিয়ে ঘাবড়ে যায় বিন্দুবালা। সেখানে বিরক্তি না ক্রোধ বুঝতে পারে না। এমনিতে পেট পাতলা স্বভাবের জন্য তাকে একেবারেই সহ্য করতে পারে না পরিমল। তার ওপর মায়ের সঙ্গে এইসব মৃত্যুর ব্যাপার নিয়ে আলোচনা সে নিশ্চয়ই ভালো চোখে দেখবে না। পাছে এই নিয়ে কোনো অপ্রীতিকর অবস্থা তৈরি হয়, সেই ভয়ে ব্যস্তভাবে সেখান থেকে উঠে আসে।

৫.
আসব না আসব না করেও শেষপর্যন্ত পরিমলের বাড়ি আসে বিন্দুবালা। একটা অস্বস্তি তাকে কুরে কুরে খাচ্ছিল। পরশু বিকেলে তার সঙ্গে মরা নিয়ে কথাবার্তা বলছিল বিজয়া আর সেই রাতেই সে আত্মহত্যা করে। বিন্দুমালার মনে এমন একটা ধারনা জন্মাতে থাকে, মায়ের মৃত্যুর জন্য পরিমল হয়তো মনে মনে তাকেই দোষী ভেবে থাকতে পারে। ভাবতে পারে সে হয়তো এমন কিছু কথা বলেছে যাতে করে তার মা আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে। পুরো কথাবার্তা সে শোনেনি। বিন্দুবালার মনে হয় সেদিন বিজয়ার সঙ্গে তার কী কথাবার্তা হয়েছিল সেটা পরিমলকে খোলসা করে বলা দরকার। নাহলে একটা মিথ্যে অপরাধের বোঝা তাকে বয়ে বেড়াতে হবে।
বাড়ির দাওয়ায় বসেছিল পরিমল। গতকাল মায়ের সৎকার হয়েছে। পরিমলের দিকে তাকিয়ে চমকে ওঠে বিন্দুবালা। একেবারে বিপর্যস্ত চেহারা তার। এমনিতে মাথার ওপর দিয়ে ঝড়ঝাপ্টা যাচ্ছিল অনেক দিন। শরীরটা ভেঙে পড়েছিল। কিন্তু মাত্র দু-রাতের ব্যবধানে যেন অনেকটা বুড়িয়ে গেছে সে। চোখের কোনে কালি। মাথার চুল উস্কোখুস্কো, চোখ-মুখ ফোলা। দেখে পরিস্কার গত দুরাত চোখের পাতা এক করতে পারেনি বেচারা। একটা ভয়ংকর ঝড় বয়ে গেছে তার ওপর দিয়ে।
মনে মনে যে ভয় করছিল বিন্দুবালা তা ঘটে না। পরিমল শান্ত। একবার শুধু তার দিকে অদ্ভুত চোখে তাকায় কিন্তু কিছু বলে না। তার বিধ্বস্ত চেহারা দেখে বেশ ঘাবড়ে যায় বিন্দুবালা। যে কথা বলতে এসেছিল তা আর বলতে পারে না। পরিমলের মাথায় হাত রেখে সান্ত্বনার সুরে বলে, ‘এভাবে ভেঙে পড়িস না বাবা। মনকে শান্ত কর। বেচারি খুব ভালোবাসত সংসারটাকে। তুই ভেঙে পড়লে ওর আত্মা শান্তি পাবে না।’
অদ্ভুত দৃষ্টি মেলে বিন্দুবালার দিকে তাকিয়ে থাকে পরিমল। বিন্দুবালা আগের সুরে বলে চলে, ‘খুব কষ্ট পাচ্ছিল বেচারি। শরীর, মনে অসম্ভব যন্ত্রণা ছিল। মুক্তি পেয়েছে ও।’
মুক্তির কথায় চমকে ওঠে পরিমল। নিজেকে আর স্থির রাখতে পারে না। যে বিন্দুবালাকে সে একদম সহ্য করতে পারে না, সহসা তারই দুহাত নিজের দু-হাতের মধ্যে চেপে ধরে তাতে মাথা ঠুকে অশ্রু ঝরায় অনেকক্ষণ। বিন্দুবালা তাকে সান্ত্বনা দেয়। এভাবে কেটে যায় কিছুটা সময়।
বিন্দুবালা চলে যেতেই পরিমল অশ্রুভেজা হাত দুটো মেলে ধরে চোখের সামনে। একদৃ্ষ্টিতে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। সহসা ভীষণ চমকে ওঠে সে। বুঝে পায় না সে হাতে মুক্তির আলো নাকি মৃত্যুর দাগ। নিজের সঙ্গে নিজেই লড়তে থাকে পরিমল কিন্তু হার মানে বারবার। অপরাধী মন বিন্দুবালার ফেলে যাওয়া হাতের স্পর্শে নিবিড়ভাবে অনুভব করে মুক্তির কৃতজ্ঞতা।








No comments:

Post a Comment