Tuesday, April 30

সুকুমার সরকারের অণুগল্প




বাড়িময় গোলাপ


সবে বালুচর জেগে উঠেছে । তার মধ্যে কাশফুল আর কাঁটাশিয়ালের ঝাঁউ । আর দু'চারটে ভেরেন্ডা গাছ । তারই মধ্যে বসত গড়েছে দূরের গ্রাম থেকে পালিয়ে আসা এক দম্পতি । সদ্য বিবাহিত তারা । এলাকার কেউ তাদের চেনে না ।
চরের দু'পারের মানুষের কানাঘুষো, কারা এই দম্পতি ? কেন এই নির্জন চরে এসে বসত গড়লো ? চোর ডাকাত নয় তো ? চরে এরা করে কী ? ইত্যাদি ইত্যাদি ।
ঘর বলতে চরের ভেরেন্ডা গাছের খুঁটির ওপর কাশের ছাউনি । এই ঘর আর ঘরের বাসিন্দাদের প্রথম নজর করে চরের দু'পারের গ্রামের রাখালেরা ।
--- কী সুন্দর বউ , যেন পরী ! গ্রামের রাখাল কাসেমের কথায় অবাক হয় সকলে ।
---- ঠিক দেখছস তো তোরা ? মানুষ ; না জিন পরী ? গ্রামের মাতব্বর সালাম চাচা জিজ্ঞাসা করে ।
---- হইতে পারে চাচা ! মানুষ অত সুন্দর হয় ক্যামন কইরা ! সন্দেহ ধরাইলেন । কাইল সকগোলে মিলা দ্যাহুন লাগবো ।
---- রাতের মধ্যে পলাইয়া যাইবো না তো ?
----- কী পিরিত চাচা! সত্যিকারের মানুষ হইলে পলাইবো না ।
---- থাম ছ্যামরা ! কথার কী ছিরি ! চাচার সামনে পিরিতের কথা ।
---- না ! দেখছিলাম তো , তাই কইলাম ।
----- তগো আর দেখতেও লাগবো না, কইতেও হইবো না । কাল আমরাই দেখ্মো নে গিয়া । যা তোরা এখন এখান থেইকা যা ।
ধমক খেয়ে রাখাল বালকেরা দূরে সরে যায় । মনে মনে তারা প্রমাদ গোনে । সালাম চাচা যা শয়তান ! গ্রামের কোনো মেয়েই তো তার নজর থেকে রেহাই পায় না ।
কাসেম বলে উঠলো , সালাম চাচা সুন্দরী পরীরে তো খুবলে খাইবো রে রহিম !
----- চিন্তা নাই কাসেম ! পরী আর পরীর বর যদি সত্যিকারের জিন-পরী হয় , তাইলে সালাম চাচার খবর আছে । নিজেই বালুচরে লাশ হইয়া যাইবো !
---- পরী ডা কিন্তু খুব ভালো , না রে রহিম ! আমাগো কী সুন্দর পানি খাওয়াইলো ।
--- কিন্তু আমি কই কী কাসেম , পরী অত সুন্দর মিষ্টি পানি পাইলো কোন থেইকা ?
---- মনে কয় , পানির মধ্যে চিনি দিছিলো ।
---- হইতে পারে । কী ভালো রে ওরা, তাই না ! যাই কস কাসেম , চরে সালাম চাচার যাওনের আগে অগো সাবধান কইরতে হইবো ।
---- ঠিক কইছোস হাশেম ! কাইল ভুরে সগলে ওঠার আগেই চরে যাইতে হইবো ।
পরদিন খুব ভোরে হাশেম , কাসেম , রহিম চরে গেলো । কিন্তু একি ! কোথায় সুন্দরী , আর তাদের ঘর বাড়ি ? ভ্যারেন্ডা গাছের খুঁটি আর কাশের ছাউনি ভেঙে পড়ে আছে এখানে ওখানে । ওরা এদিক সেদিক খুঁজে দেখতে লাগলো । একটু দূরে জলের ধারে সুন্দরীর বরের লাশ দেখতে পেল ! কিন্তু সুন্দরী কই ?
দৌড়ে আবার ঘরের কাছে এলো । কাশের জঙ্গল সরাতেই লাল শাড়িতে পেঁচানো সুন্দরীর অর্ধ উলঙ্গ দেহটা বেরিয়ে এলো !
লাল শাড়িতে সুন্দরীর মুখটা আরো লাল হয়ে উঠেছে ! বালির উঠোন জুড়েও ছোপ ছোপ লাল রক্তের দাগ ! যেন কাশবনে গোলাপ ফুটে আছে !
হাশেম , কাসেম আর রহিম আর্তনাদ করে উঠলো ! কী করতে হবে বুঝে উঠতে পারলো না । ভয়ে এদিক সেদিক দৌড়াদৌড়ি করতে লাগলো । কোথাও কাউকে দেখতে না পেয়ে আবার সুন্দরীর লাশের কাছে ফিরে এলো । হাঁটু গেড়ে বসে বোঝার চেষ্টা করতে লাগলো , সুন্দরীর সঙ্গে ঠিক কী করা হয়েছে ।
রাখাল বালকেরা নিজেদের মতো করে কী বুঝলো তা তারা নিজেরাই জানে । একটু পরে উঠে সুন্দরীর বরের কাছে গেল । সুন্দরীর বরকে টেনে টেনে সুন্দরীর লাশের কাছে নিয়ে এলো । তাদের কচি কোমল হাত দিয়ে সুন্দরী আর সুন্দরীর বরকে সুন্দরীর লাল শাড়ি দিয়ে এক সঙ্গে ঢেকে দিয়ে নদী সাঁতরে গ্রামের মধ্যে ঢুকে গেল ! ভয়ে কাউকে কিচ্ছুটি বলার সাহস পেল না ওরা !

No comments:

Post a Comment