Tuesday, April 30

দেবপ্রিয়া সরকারের গল্প




পুনশ্চ


রাতে বোধহয় খানিক বৃষ্টি হয়েছে। ঘাসগুলো কেমন ভিজে ভিজে। সেই ভিজে ঘাসে পা ডুবিয়ে এগিয়ে চলেছেন স্বর্ণেন্দু। তাঁর ঠিক পেছনেই ধীর পায়ে হাঁটছেন কুহেলি। একখণ্ড সবুজ ঘাসের মাঠের শেষেই দাঁড়িয়ে আছে কৃষ্ণচূড়া, বাতাবিলেবু, পেয়ারা গাছের ছায়া ঘেরা ‘শ্যামলী’- স্বর্ণেন্দু আর কুহেলির তিল তিল করে গড়ে তোলা সুখের ঠিকানা।

হালকা সবুজ রঙের দোতলা বাড়িটার সব দরজা-জানালা খোলা। সাদা লিনেনের পর্দা উড়ছে অনবরত। অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন স্বর্ণেন্দু। যেন কতকাল পরে দেখছেন! আচমকাই সদর দরজার পর্দা সরিয়ে বেরিয়ে এল ছোট্ট টুপাই আর টিপলু। হাতে একটা গোলাপি রঙের কেক। তাদের কচি গলার স্বরে জুড়ে দিল চেঁচামিচি, - বাবা এসো, দেখবে এসো, কেমন কেক এনেছি! আজ তো তোমার জন্মদিন। এসোই না ঘরে এসো.........স্বর্ণেন্দুবাবু! বলি ও স্বর্ণেন্দুবাবু এই অসময়ে ঘুমোলেন নাকি?

টুপাই আর টিপলুর কথার সঙ্গে আর একটা গলার স্বর মিশে কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছিল স্বর্ণেন্দুর। আচমকা ভেঙে গেল ঘুমটা। ঘোর লাগা চোখে দেখলেন তার দিকে উদ্বিগ্নভাবে তাকিয়ে আছেন নির্মল সাঁতরা। টুপাই, টিপলু, কুহেলি কেউ নেই তো! আর শ্যামলী! কোথায় গেল সব?

বালিশে ভর দিয়ে উঠে বসে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন স্বর্ণেন্দু। টুপাই তাঁর একমাত্র ছেলে সুদূর আমেরিকায়। ডেট্রয়েটে এক নামী কারখানার অটোমোবাইল ইঞ্জিনিয়ার। স্ত্রী, কন্যা নিয়ে সেখানেই সেটেল্ড। তাঁর আদরের মেয়ে টিপলু আছে চেন্নাইতে। সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারের ঘরণী হয়ে জমিয়ে সংসার করছে। কুহেলিও কথা রাখেনি। তাঁকে একা ফেলে আজ তিনবছর হল চলেগেছে পরপারে। সেরিব্রাল অ্যাটাক। চিকিৎসার সুযোগটাও দায়নি। তাঁদের সাধের শ্যামলীও আর নেই। গুঁড়িয়ে গিয়েছে। সেখানে এখন পাঁচতলা ফ্ল্যাটবাড়ি।

কুহেলির চলে যাবার পর কিছুদিন টিপলুর কাছে গিয়ে ছিলেন স্বর্ণেন্দু। টুপাইও বলেছিল কয়েকমাস ডেট্রয়েটে গিয়ে থাকতে। কিন্তু পারেননি। নিজের মাটির গন্ধ, ঘরের টান তাঁকে আবার ফিরিয়ে এনেছে নিজের শহরে। শ্যামলীকে শেষের দিকে কেমন যেন অচেনা মনে হত। কুহেলির সাজানো ঘরদোর, প্রতিটা আসবাব যেন বদলে ফেলেছিল নিজেদের চেহারা। সব কিছুই অপরিচিত ঠেকত স্বর্ণেন্দুর। তাই ছেলেমেয়েদের সঙ্গে কথা বলে সিদ্ধান্তটা নিয়েই ফেললেন। পর হয়ে গেল শ্যামলী। আর তিনি বেছে নিলেন এই স্বেচ্ছা নির্বাসন।
-কী হল? তখন থেকে কী ভাবছেন? আর এই অবেলায় কেউ ঘুমোয়?
-ও ডাকছিলেন বুঝি?
কেমন একটা অবাক গলায় জিজ্ঞেস করলেন স্বর্ণেন্দু। নির্মল বিচলিত হয়ে বললেন,
-শরীরটরীর খারাপ নয় তো?
-না না তেমন কিছু না। দুপুরে খাবার পর একটা বই পড়ছিলাম। ওটা পড়তে পড়তেই একটু তন্দ্রা মতো এসেছিল। তা ডাকছিলেন কেন?
-আবীর খবর পাঠিয়েছে। আজ পঁচিশে বৈশাখ। তাই কোনও অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে বোধহয়। আমাদের সকলকে যেতে বলেছে। আসুন, তাড়াতাড়ি আসুন।
-ও আচ্ছা। আপনি এগোন, আমি আসছি।
সাদা পাজামার ওপর একটা হলদে রঙের পাঞ্জাবি পরে, হালকা হয়ে আসা সাদা চুলে আলতো করে চিরুনি বোলালেন স্বর্ণেন্দু। ঘরের একফালি আয়নাটায় নিজেকে দেখে একটু যেন থমকালেন। হুমায়ূন আহমেদ পড়তে বড্ড ভালবাসত টিপলু। স্বর্ণেন্দু যখনই হলুদ পাঞ্জাবি পরতেন সে মুখ টিপে হেসে বলতো, “আজ আবার হিমু সাজা হয়েছে, তাই না!”
এলোমেলো মন নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন স্বর্ণেন্দু। একটা বড় টেবিলে রবি ঠাকুরের পূর্ণাবয়ব ছবি রাখা। পাশে ফুলদানীতে রজনীগন্ধা। ধূপকাঠির মায়াবি সুবাসে ভরে আছে চারপাশ। আলোর মালায় ঝলমল করছে সবুজ লনটা। পাশের নার্সারি স্কুল থেকে এসেছে কচিকাঁচার দল। তাদের ওপরই ভার আজকের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের।

ছোট ছোট শিশুদের নাচ, গান, আধো আধো বুলিতে আবৃত্তি ভরিয়ে রাখল পুরো সন্ধেটা। তাদের স্কুলের প্রিন্সিপাল আর একজন শিক্ষিকা যৌথ ভাবে শোনালেন ‘কর্ণকুন্তী সংবাদ’। মনটা বড় ভাল হয়ে গিয়েছিল স্বর্ণেন্দুর। অবেলায় দেখা স্বপ্নটাকে কখন যেন ভুলে গিয়েছিলেন। রবির আলোয় দূর হয়ে গিয়েছিল মনের ভেতর জমাট বাঁধা সকল অন্ধকার।
অনুষ্ঠান তখন প্রায় শেষের পথে। আচমকাই ছোট ছেলেমেয়েগুলো দৌড়ে এল তাঁর কাছে। হাত ধরে আদুরে গলায় বলল,
-দাদু চলো না আমাদের সঙ্গে একটু।
বিস্মিত স্বর্ণেন্দু বললেন,
-কোথায়? কোথায় যাব আমি?
-এসো বলছি আমাদের সঙ্গে। এসোই না, এসো।
স্বর্ণেন্দুর দুহাত ধরে তাঁকে টেনে এনে দাঁড় করালো রবীন্দ্রনাথের ছবির পাশে। হতভম্ব স্বর্ণেন্দু উসখুস করছিলেন। কী করবেন, কী বলবেন ঠিক ভেবে পাচ্ছিলেন না। আর তখনই এগিয়ে এলো আবীর। হাতে একটা গোলাপি রঙের কেক। গলাটা একটু চড়িয়ে, হাসি মুখে সে বলল,
-উপস্থিত সকলকে অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে জানাচ্ছি যে, আজ শুধু কবিগুরুর জন্মতিথি নয়। আজ আমাদের চোদ্দ নম্বর ঘরের আবাসিক স্বর্ণেন্দুবাবুরও জন্মদিন। আসুন আমরা সকলে মিলে তাঁকে এই শুভদিনে অভিনন্দিত করি।

একে একে এগিয়ে এলেন নির্মল, কস্তুরি, অমল, অলকানন্দা, সুধীর আরও অনেকে। অশ্রু সজল চোখে স্বর্ণেন্দু দেখছিলেন তাঁর সহ-আবাসিক, ছোট ছোট বাচ্চাগুলো আর ম্যানেজার আবীরকে। তাঁর গাল বেয়ে নেমে আসছিল বড় বড় জলের ফোঁটা। তার মধ্যে কতটা আনন্দ ছিল আর কতটা দুঃখ, তা হয়তো স্বর্ণেন্দুরও অজানা।

গোলাপি রঙের হৃদয়ের মাঝে জ্বলতে থাকা আগুনটাকে জোরে ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দিলেন তিনি। সঙ্গে সঙ্গে মাথার ওপর ঝরে পড়ল রঙবেরঙের টুকরো টুকরো খুশি। ‘হ্যাপি বার্থ ডে টু স্বর্ণেন্দু’র সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হল সাউন্ড বক্সে বেজে চলা, “চিরনূতনেরে দিল ডাক/পঁচিশে বৈশাখ......হে নূতন,’’
আজ আরও একবার রিক্ততা ভুলে আলোয় আলোয় উদ্ভাসিত হল ‘পুনশ্চ’- শহরের একপ্রান্তে গড়ে ওঠা এই বৃদ্ধাবাস।

No comments:

Post a Comment