Tuesday, April 30

মহম্মদ লতিফ হোসেনের প্রবন্ধ






ছিটমহল সমস্যা এবং আমিনুর রাহমানের দুটি গল্প


ছিটমহল চর্চায় আঞ্চলিক লেখক হিসেবে আমরা যে সকল আখ্যানকারদের পাই, আমিনুর রাহমান তাঁদের মধ্যে অন্যতম। বৃহৎ কোনও সৃষ্টি আমিনুর রাহমানের কলমে উঠে না এলেও, একজন সম্পাদক হিসেবে তাঁর খ্যাতি কোচবিহারের সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী মহলে সুপ্রশংসিত। দীর্ঘ পঁচিশ বৎসর ধরে তিনি সম্পাদনা করে চলেছেন বৈঠা  নামক একটি হাতে লেখা পত্রিকা।

 কোচবিহারে অবস্থিত ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী অঞ্চল গীতালদহে তাঁর বেড়ে ওঠা এবং আজ অবধি সেখানে বসেই তিনি নিরন্তর সাহিত্য চর্চা করে চলেছেন। সীমান্ত কেন্দ্রিক সাহিত্য-সংস্কৃতির চর্চায় বৈঠা অগ্রণী ভূমিকা পালন করে চলেছে। আমরা আমিনুর রাহমানের লেখা ‘ছিটমহল’ এবং ‘নালাটুর ভাষা, সাকিনার চখুর পানি’ –এই দুটি গল্পকে খুঁজে পাই। দুটি গল্পই প্রকাশিত হয় বৈঠা  পত্রিকায়। 
আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহারের কারণে গল্প দুটির আখ্যান বাস্তবতায় নতুনত্বের ছোঁয়া লক্ষ করা যায়।

‘ছিটমহল’ গল্পটিতে নির্দিষ্ট কোনও কাহিনি নেই। কিছুটা প্রতিবেদনধর্মী এই রচনায় ‘স্থল সীমান্ত চুক্তি’ বিনিময় পূর্ববর্তী ছিটমহলের প্রকৃত বাস্তবতাকে কয়েকটি কথায় তুলে ধরা হয়েছে। তিনি দেখিয়েছেন কীভাবে বহিরাগত দুষ্কৃতিরা অপরাধ কর্মে লিপ্ত হয়ে ছিটমহলের বুকে আশ্রয় গ্রহণ করে। পুলিশ প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তার কারণে তারা নিজেদেরকে আড়াল করতে পারে। শুধু বাইরের দস্যুরাই নয়, অনেক ক্ষেত্রে ছিটমহলের মানুষেরাও এই অপরাধ কর্মে লিপ্ত থাকে। গল্পে কথাকার তাই বলেছেন –
এপাকে-ওপাকে অকাম-কুকাম করিয়া মানষি থানা-পুলিশের ভয়ে ছিটমহলত যায়া ছোপে থাকে। ছিটমহলের গিলাক মানষি কম না হয়। সুযোগ পাইলে উমরাও দোনোপাকে জল ঘোলা করি আইসে।                         
এর বাইরেও রয়েছে ছিটমহল আন্দোলনের প্রসঙ্গ। দরিদ্র শ্রমজীবী ছিটবাসীদের নিত্য দিনের সংকট প্রকটতর, তারা দেশ চায়, স্থায়ী নাগরিকত্ব চায়। দেশের দাবিতে তাই তারা জোটবদ্ধ হয় – ‘যে কোন দ্যাশের নাগরিক হওয়ায় খাইবে, হওয়ায় খাইবে’। আমিনুর রাহমান এই গল্পে গাঁজা চাষের প্রসঙ্গও উল্লেখ করেছেন। বলাবাহুল্য বিনিময় পূর্ববর্তী কালে গাঁজা চাষের বাড়বাড়ন্ত ছিটমহলগুলিতে অবৈধ উপায়ে অর্থ উপার্জনের পথকে চিহ্নিত করেছিল। সংবাদ পত্রের প্রতিবেদনেও এ জাতীয় খবরের শিরনাম বারবার আমাদের সামনে উঠে এসেছে। সাংবাদিক রক্তিম দাশের কলমে দৈনিক সমকালে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে আমরা দেখছি – ‘বাংলাদেশি ছিটমহলে ব্যাপক গাঁজার চাষ, নির্বিকার প্রশাসন।’ বিনিময় পরবর্তীকালেও আড়ালে আবডালে কোথাও কোথাও তা সক্রিয় থেকেছে। ৩১ মার্চ, ২০১৭-য় এই সময় –এ প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন – ‘আফিমের নয়া ডেরা কোচবিহার।’ এখানে আমরা দেখতে পাই ভারতের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা বিভাগও ছিটমহল গুলিতে গাঁজা চাষের আধিক্যের কথা স্বীকার করেছেন। শুধু ছিটমহলের বাসিন্দারাই নয়, ভারত-বাংলাদেশের অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তিরাও এর সাথে যুক্ত। ক্ষেত্র বিশেষে দেখা গেছে রাজনৈতিক দলের পরোক্ষ মদতও এতে রয়েছে। ছিটমহল বিনিময়ের দাবিতে একদিকে যেমন আন্দোলন সক্রিয় হয়ে উঠেছিল, অন্যদিকে তেমনি এই বিনিময় পক্রিয়াকে স্তব্ধ করবার জন্যও একশ্রেণীর অসাধু চক্র সর্বাত্মকভাবে প্রচেষ্টা চালিয়েছিল। অমর মিত্রের আখ্যানে আমরা এ জাতীয় চিত্রকে খুঁজে পেয়েছি। আমিনুর রাহমানের লেখাতেও আমরা এরকম ইঙ্গিত পাই –
গাঁজার চাষি, দুই দ্যাশের ব্যাঙ্কত জমা, কাচা টাকার পাহাড়ত বসি ফুক্কুৎ করি হাসে। দশের বাদে, দ্যাশের বাদে উনার নাই কোন মাথার বিষ। উনার কাছাত গোটায় দুনিয়া যে এখান ছিটমহল।                                         
ছিটমহল এভাবেই একদিকে অসহায় মানুষদের নিরন্তর সংগ্রামকে তুলে ধরে, বৈধ দেশের কাছে যে অঞ্চল, যে মানুষ এতদিন ব্রাত্য ছিল। আবার এই ছিটমহলই হয়ে ওঠে বৈধ দেশের দুষ্কৃতীদের অর্থ উপার্জনের ক্ষেত্রভূমি। এই গল্পে তেমন কোনও ব্যঞ্জনা নেই। প্রবাদ প্রবচনের ব্যবহার হলেও লোকায়ত জীবনের চালচিত্র তেমন খুঁজে পাই না। বিশেষ করে স্বল্প আয়তনের কারণে সামগ্রিকতায় পৌঁছানো সম্ভব হয়ে ওঠে না।

আমিনুর রাহমানের অপর একটি গল্প - ‘নালাটুর ভাষা, সাকিনার চখুর পানি’। এই গল্পটি কথাকার ‘সূর্যময় সিরাজ’ ছদ্মনামে লিখেছেন। নামকরণেই বোঝা যায় গল্পকার এখানে উত্তরবঙ্গের রাজবংশী ভাষার ব্যবহার করেছেন। দুই দেশের পরিবেশ-সমাজ-ভাষা-সংস্কৃতি এক হলেও অদৃশ্য প্রাচীর কেন ছিটমহলকে আলাদা করে রেখেছে – এই আক্ষেপ থেকেই গল্পের ভূমিকাটি উঠে এসেছে –
ভারত আর বাংলাদ্যাশের ছিটমহলের মানষিগুলার ভাষা-সংস্কৃতি, জীবন-আচার অ্যাকে নাকান। অ্যাকে বাংলা ভাষা। অ্যাকে মাটির ঘেরান। নরম মাটির ভিতরাত, কোনপাকের গাছের শিপা যে কোন গাছের শিপাক ধরিছে সাপটে – ন্যাকা জোকা নাই। গাছের ছায়াত দোনোপাকে – মন জুড়ায়, পেরান জুড়ায়। তবু বলে ভূখণ্ড আলেদা।   
                               
স্বল্প আয়তনের এই গল্পে সাকিনা আর নালাটুর পারস্পরিক সম্পর্কের টানাপোড়েন প্রকট হয়ে উঠেছে। অজান্তেই বাংলাদেশের কন্যা সাকিনার বিয়ে হয় ছিটের অধিবাসী নালাটুর সাথে। বিয়ের পর সাকিনার সমস্ত স্বপ্ন ভেঙে যায়। সে ভাবে –
এটা কোন দ্যাশ ? আজা নাই। মন্‌তিনী নাই। নাই শিক্ষা, নাই স্বাস্ত্য, নাই আইনের কোনো শাসন। 
সাকিনার এই মানসিকতায় অস্বাভাবিকতা নেই। ছিটনারীদের চেনা সংকট এখানে স্পষ্ট। দীর্ঘদিন বাদে নালাটু শ্বশুরবাড়ি যাবার পথে বি.এস.এফ-দের দ্বারা ধৃত হয়। অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হিসেবে নালাটুর জেল হয়, দীর্ঘদিন বাদে তাকে হয়তো পুশব্যাক্‌ করা হবে। কিন্তু নালাটুর কাছে বাংলাদেশেরও কোনও পরিচয়পত্র নেই। তাই তাকে হাজতবাস করতে হয় দিনের পর দিন। ছিটমহল বিনিময় পূর্ববর্তীকালে ভারত-বাংলাদেশে যে বিপুল সংখ্যক ছিটবাসী অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হিসেবে কারাগারে নির্বাসিত হয়েছিল, আখ্যান বাস্তবতায় আমিনুর রহমান তারই প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত দিয়েছেন।

পুশব্যাকে জীবনের কোনও নিশ্চয়তা থাকে না। অনেক সময় ধৃত ব্যক্তিদের নো ম্যান্‌স ল্যান্ডে এনে ছেড়ে দেওয়া হত। কেউ বাসভূমিতে ফেরে কিনা – এ বিষয়ে কোনও প্রশাসনই মাথা ঘামাত না। অনেক সময় অসহায় নিরাপরাধ ছিটবাসীদের গুলি করেও হত্যার ঘটনা ঘটেছে। এই গল্পে আমিনুর রাহমান নালাটুর মুক্তিলাভের ক্ষেত্রে   ভাষাকে কেন প্রতিবন্ধক করে তুলেছেন, তা নিয়ে আমাদের মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে। তবে আমাদের মনে হয় ‘নালাটুর ভাষা’-কে কথাকার রূপক হিসেবে ব্যবহার করেছেন। আসলে নালাটুর ভাষাই তো ছিটমহলের ভাষা, আর সে ভাষা বোঝবার মতো সামর্থ্য দুই বাংলার কারোরই হয়তো ছিল না। দেশ হীন মানুষ গুলির মুখের ভাষাও যেন কোনও বিচ্ছিন্ন ছিটে পরিণত হয়েছে। গল্প কথকের কণ্ঠে আমরা তাই শুনতে পাই –
বাংলা ভাষার বাদে দুনিয়ার সৌগ ভাষার আজি জ্যাতো মান। সম্মান। কিন্তু দিল্লী তো বহু দূর। ঘরের কাইণ্ঠার দুই বাংলাও নালাটুর মনের ভাষা বুঝির পাইলেক না।                                       
শেষ অবধি নালাটুর আর ঘরে ফেরা হয় না। দিল্লী থেকে ঢাকা কোনও রাজধানীই নালাটুর বন্দীত্ব নিয়ে মাথা ঘামায় না। গল্পের ব্যঞ্জনাময় সমাপ্তিতে কথাকার ‘নেই দেশ’-এর মানুষ গুলির আঁতের কথাকেই যেন তুলে ধরতে চেয়েছেন –
চাইর পাকের মানী মানষি কি সন্দোর নিন্দত পড়ি আছে। সভ্য-স্বাধীন-প’জাবহুল, এক আচানক পিথিমীত নালাটু আর সাকিনার কোন দ্যাশ নাই ! জীবন আছে। ভিতর কুঠিত নদী আছে। আছে পানিও। কিন্তুক সতায় না। ঘুমসি ঘুমসি তুসের অগুণ জ্বলে !                   
এ আগুন কবে নিভবে তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। বিনিময় পরবর্তী কালেও বদলে যাওয়া সংকটের সাপেক্ষে ছিটবাসীদের অন্তরতম অংশের দহন আর কত প্রজন্ম ধরে নিরন্তর সক্রিয় থাকবে – সে বিষয়ে আমরা পাঠকেরাও কোনও নির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি না। আমিনুর রাহমানের আখ্যান আমাদের পাঠকদেরও এ জাতীয় প্রশ্নেরই মুখোমুখি এনে দাঁড় করায়।     

No comments:

Post a Comment