Tuesday, April 30

বিপ্লব বসাকের অণুগল্প



পুনর্জন্ম

প্রায় একবছর হতে চলল, দীপালী দেবী বহির্জগতের সাথে সম্পুর্ণ যোগাযোগ বিহীন। এই এক বছরে তিনি না কারও বাড়িতে গেছেন, না কাউকে বাড়িতে ডেকেছেন। রজতবাবু নিজেও বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন প্রথমে। কিন্তু স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে সামলে নিয়েছেন নিজেকে। দীপালিকে অনেক বুঝিয়েছেন, সবসময় পাশেপাশে থেকেছেন। যদিও এখনো স্ত্রীকে স্বাভাবিক জীবনে ফেরাতে পারেননি। তবে হাল ছাড়েননি তিনি।
মিঠির জন্মমাস পড়তেই বায়না ধরেছেন, জন্মদিনের অনুষ্ঠান করবেন। দীপালি দেবী চমকে তাকিয়েছিলেন একবার। তবে বারণ করেননি। শুধু বলেছেন.."আমি দোতলায় থাকব, আমাকে বিরক্ত করবে না।"

রজত বাবু আবারও বোঝানোর চেষ্টা করেছেন.."মিঠির জন্মের পর থেকে প্রত্যেক বছর ওর জন্মদিন পালন করছি আমরা। এবারেই বা কেন বাদ দেব? আর সবাইকে তো আর বলতে যাচ্ছিনা, শুধু চারজন.. সলমা, রৌনক, বিরজু আর ডেভিড।"

নামগুলো শুনে স্তব্ধবাক হয়ে গেলেন দীপালি দেবী। গত দশ মাসের ঘটনা প্রবাহ বিদ্যুৎবেগে ঝড় তুলে গেল মস্তিষ্কে। বেশ কিছুক্ষণ থমথমে মুখে বসে থাকার পর ঘাড় নেড়ে সম্মতি দিলেন তিনি। রজত বাবুর ভীষণ ইচ্ছে করছিলো খেলোয়াড়দের মত হাত মুঠো করে ইয়াপ বলে চিৎকার করে উঠতে। নিজেকে সামলে সেদিন থেকেই যোগার-যন্ত্রে লেগে পড়লেন।

আজ মিঠির জন্মদিন। বাড়ি সাজানো থেকে শুরু করে বাজার করা, উপহার কেনা, সব নিজে হাতে করেছেন রজত বাবু। সকাল হতেই রান্নার কাজে হাত লাগিয়েছেন দীপালির সাথে। বেলা এগারোটা নাগাদ কলিং বেলের আওয়াজ শুনে দৌড়ে গিয়ে দরজা খুললেন। চারমূর্তি একসাথে হাজির। আদর করে ওদের ঘরে এনে বসালেন। দীপালিও ততক্ষণে ড্রইংরুমে এসে গেছেন। একে একে চারজনই দীপালি দেবীকে প্রণাম করলো।

সলমাই মুখ খুললো প্রথমে.."কেমন আছো মা?"
স্মিত হাসলেন দীপালি দেবী.."হ্যা-রে, তোর  চোখে আর কোনো অসুবিধা নেই তো?"
"না, মা। মিঠির চোখে আজ আমি পৃথিবীর সব রঙ দেখতে পাচ্ছি, আমি তোমাকে দেখতে পাচ্ছি মা।"
সলমার ঝকমকে চোখের দিকে তাকিয়ে সব কষ্ট ভুলে গেলেন দীপালি দেবী। রৌনকের দিকে তাকালেন তিনি.."তুই?"
"আমাকে আর বিরজুকে আর ডায়ালিসিস নিতে হয় না মা। আমরা দুজনেই এখন পুরো সুস্থ।"
"ডাক্তার বাবু বলেছেন, আমি আর কিছুদিনের মধ্যেই ক্রিকেটে ফিরতে পারবো, মা"...ডেভিড বললো।
দীপালি দেবীর দু-চোখ বেয়ে অশ্রুর ঢল। এ অশ্রু দুঃখের নয়, আনন্দের। একসাথে চারজনকে জড়িয়ে ধরলেন তিনি.."আজ মনে হচ্ছে, মিঠিকে আমি হারাইনি। মিঠি বেঁচে আছে, তোদের সবার মধ্যে মিঠি বেঁচে আছে। তোরা সবাই মিলে মিঠিকে বাঁচিয়ে রেখেছিস।"

পরের পর ঘটনা প্রবাহে কেমন যেন বিহ্বল হয়ে পরেছিলেন রজত বাবু। এতদিন ধরে চেপে রাখা কান্নাগুলো বাধ ভাঙবে ভাঙবে করছে, দীপালি দেবীর ধমকে সম্বিত ফিরলো তার।

"বোকার মত দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি দেখছো?ছেলে-মেয়েগুলো রোদে তেতে-পুড়ে এসেছে, সে খেয়াল আছে? ওদের জন্য ঠান্ডা সরবত নিয়ে এসো।"
তারপর আবার ওদের দিকে তাকিয়ে হাসলেন.."তোরা বোস। রান্না প্রায় শেষ , একটু পরেই টেবিলে দিচ্ছি।"
"আমিও তোমার সাথে রান্না করবো"...সলমা লাফিয়ে উঠলো।

রজত বাবু ঝাপসা চোখে দেখলেন, মিঠি তার মায়ের কোমর জড়িয়ে রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছে। চোখ থেকে চশমাটা খুলে পাঞ্জাবিতে মুছে আরেকবার তাকালেন, নাহ, ভুল নয়..মিঠি...হ্যাঁ, মিঠিই তো।

No comments:

Post a Comment