Tuesday, April 30

মলয় মজুমদারের গল্প



আচানক


সকালে ঘুম ভাঙতেই অভয়া সোজা উঠে গেলো চিলে কোঠায় । তবে ঠিক চিলে কোঠা নয় । অভয়ার ‘ছবি ঘর’ । বেশ বড়ো ঘর । বারো বাই চব্বিশ । বাবার মৃত্যুর অনেক আগেই বানিয়ে দিয়েছিলেন । নামটা বাবাই দিয়েছিলেন ‘ছবি ঘর’ । কোলকাতা গর্ভমেন্ট আর্ট কলেজ থেকে পাশ করেছে প্রায় পনের বছর আগে । ফিরতে চায়নি । কিন্ত ফিরতে হয়েছে । মায়ের জন্যে । বাবা মারা যাবার পর মা একদম একা । দাদা চাকরি নিয়ে বিদেশে,বিয়ে করে ওখানেই সংসার পেতেছে  । এখন বাড়িতে মা ও অভয়া ।  বিয়ে করাটা হয়নি । অনির্বাণ অনেকদিন অপেক্ষা করেছে ।  তারপর ফিরে গেছে ।


ঘরের দরজা খুলে কাল রাতের ছবির ক্যানভাসটার কাছে চলে এলো । এক দৃস্টিতে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ । কি এঁকেছে সে ভোর তিনটে অব্দি ? নিজের কাছেই প্রশ্ন করলো । যত গভীর ভাবে ছবিটার মধ্যে ডুবতে থাকলো , মাথার মধ্যে একের পর এক প্রশ্ন মাথাচারা দিতে থাকলো । অনেক অনেক দিন ধরে এই থিমটা নিয়ে সে ভেবেছে । অনেক কিছু বলার ইচ্ছে ছিল । কিন্তু মনে হচ্ছে কিছুই বলতে পারেনি । যে অবগাহন আঁধার ও আলোর পথটার মাঝে অন্য একটা পথের সন্ধান করতে বেড়িয়েছিল ক্যানভাস আর তুলিতে , তার কিছুই চোখে পড়ছে না । মনে হচ্ছে শুধু কিছু ছোপছোপ দাগ,ক্যানভাসের শরীরে দাগিয়ে রেখেছে । আলো বা অন্ধকার অথবা তার মাঝের যে দিশা সে দেখেছিল চিন্তার অবগাহনে , কোন কিছুই সে ছবির ক্যানভাসে মধ্যে খুঁজে পাচ্ছে না । অথচ কত রাত কত দিন কত মূহুর্ত শুধু ভেবেছে এই একটা ছবির জন্যে । কিন্তু আজ তার চোখের সামনে যা আছে , সেটা যে তার ভাবনার ধারে কাছে আনতে পারেনি, খুব ভালো করে অনুভব করতে পারছে অভয়া । সে ধপ করে বসে পড়লো  ক্যানভাসের সামনে রাখা একটা চেয়ারে ।


চারিদিকে ছবির ছড়াছড়ি । দু’তিনটে ক্যানভাসের স্ট্যান্ড । দেওয়াল জুড়ে ছবি । কিন্তু একদম গোছানো না । ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা । মেঝেতে রঙের দাগ । দু’তিনটে চেয়ার ও কিছু টুল । একদিকে গাদা করে রাখা কিছু ছবি । কিছু মেয়েলি জিনিস পত্তর । বেশ কিছু বই । কিন্তু  সাজানো নয় । যেভাবে মেয়েদের রাখার স্বভাব । সেই স্বভাবের কোন চিহ্ন নেই । একদম অন্য রকম ।  অগোছালো পুরো । কিছুটা বিভ্রান্তের মতো বসে থাকতে থাকতে ছোট্ট টেবিলে রাখা সিগারেটের প্যাকেট থেকে সিগারেট বের করে ধরিয়ে ফেললো । একরাশ ধোঁয়া টেনে আবার ছেড়ে দিলো । প্রথম টানেই মাথাটা ঝিম ঝিম করে উঠলো । ক্লান্তির ডানা ছাঁটা রোদের মতো পুরো শরীরটাকে এলিয়ে দিলো চেয়ারের উপর । বহুদিনের অভ্যাস , কিন্তু সকালে উঠে প্রথম সিগারেট অভয়ার শরীরের এই রকম ক্লান্তি এনে দেয় । এই অবস্থায় অভয়া কোন চিন্তা করতে পারে না । ক্লান্তির সাথে সুখটাও অনুভব করে সে ।


মায়ের ডাক কানে আসতেই, অভয়া, সিগারেটটা নিভিয়ে উঠে পড়লো চেয়ার থেকে । মনটা ঠিক নেই । একটা যন্ত্রণা বুকের কাছে এসে আটকে আছে । ধীর পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে নীচে এসে দেখলো, তার ফোনে চারটে মিস কল জমে আছে । অভয়াকে দেখে মা বললো,’সেই কখন থেকে ফোনটা বাজছে, ডেকে তো সাড়া পাছিলাম না তোর । কি করছিলি ?’ অভয়া কিছু না বলে ফোনটা তুলে নাম্বারগুলো দেখলো । তিনটে নাম্বার পরিচিত । একটা তার কন্টাক্ট লিস্টের বাইরের নাম্বার । প্রথম সেই নাম্বারেই ডায়াল করলো । ওপার থেকে এক পুরুষ কন্ঠ ভেসে এলো । চেনা কন্ঠ ।

কিরে কেমন আছিস ?

ভালো । মে আই নো হুম ইজ অন দ্য লাইন ?

ওরে চিনতে পারলি না ? আমি অনির্বাণ ।

তুই... ?

এই মাত্র কোলকাতায় নামলাম । এখনো এয়ারপোর্টে । ট্যাক্সির জন্যে দাঁড়িয়ে আছি ।

বউ কোথায় ?

আসেনি সাথে । আর আসবে না ।

অনির্বাণ । লন্ডন প্রবাসী হয়েছে অনেকদিন, বউ নিয়ে । অভয়া কিছুটা থামলো । হঠাৎ এই রকম একটা কথা শুনতে হবে ভাবতে পারেনি ।

আর আসবে না , মানে ?

কি ভাবছিলি । আমি হেলো হেলো করে যাচ্ছি ! মানে সে আর আমার সাথে থাকতে পছন্দ করছে না । তাই আমেরিকায় চাকরি নিয়ে  চলে গেছে ।

আর ছেলে মেয়ে ? ওরা কোথায় ?

আমার সাথে । ওরাও এসেছে । তুই কোথায় কোলকাতা নাকি শিলিগুড়ি ?

শিলিগুড়িতে । কিন্তু তোর কথা গুলো ঠিক হজম করতে পারছি না ।

দেখা হলে হজম করিয়ে দেবো

কিন্তু তার জন্যে তো তোকে শিলিগুড়ি আসতে হবে ।

শোন ! ট্যাক্সি পেয়ে গেছি । তোকে পরে ফোন করবো । বাই ।


আগের স্বভাবটা এখনো যায়নি অনির্বাণের । কথার মাঝ পথেই ফোন কেটে দেবে । কিন্তু অভয়ার মনটা একটু কেমন ঘোরালো হয়ে উঠলো । ছেলে মেয়ে নিয়ে একা অনির্বাণ । আবার কোলকাতায় নেমেই ফোন, কেমন যেন অস্বস্তিদায়ক । সকালটা কেমন যেন নষ্ট হয়ে গেলো সবদিক দিয়ে । ছবির ব্যাপারটা ভাবতে পারছে না আর আবার অনির্বাণকেও ভাবতে পারছে না ।  ছবির ব্যর্থতা এতক্ষণ তার মনকে জাপ্টে ছিল, কিন্তু অনির্বাণের ফোনটা সব কিছু তছনছ করে দিলো,ভাবনা এখন বিকলাঙ্গ জীবনের মতো মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে ।


প্রথম প্রেম ব্যাপারটা অভয়ার কখন হয়নি । প্রেমের ঈশারার আগেই , শরীর বিনিময়টা হয়ে গেছিলো । শরীর বিনিময় হলে, প্রথম প্রেমের গল্প হয় না । সেটা রেপ ছিল, না শরীরের চাহিদা, এখনো ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি । শরীরে সুখ পেয়েছিল । ভালো লেগেছিল । কিন্তু মন ?  সেখানে কোন মনের কথা ছিলো না । শুধু শরীর ছিল ।  তখন সে সতেরো ।


অনির্বাণ যেদিন প্রথম চুমু খেয়েছিল । ঠোঁট থেকে ঠোঁট আলগা হবার পর অনির্বাণকে বলেছিল,’তুই হয়তো ভুল বুঝবি । কিন্তু তোর কাছে সত্যটা গোপন করতে চাই না। সত্য হলো এটা যে আমি ভার্জিন না’। মানতে পারেনি ।  দু’সপ্তাহ কথা বলেনি । সে কি রাগ । চোখমুখ লাল হয়ে উঠেছিল । মুখের কথাগুলো কেমন যেন আটকে যাচ্ছিল অনির্বাণের । অভয়া সেদিন অনির্বাণের চোখে ঘৃণা দেখেছিল । সে ঘৃণার ভাষা কি ভয়াবহ, তা সেদিন সে কোন শব্দের নিরিখে আনতে পারেনি । শুধু অনুভব করেছিল মনে, একটা যেন তরল বিষ অর্নিবাণের চোখ দিয়ে ধেয়ে এসেছিল অভয়ার দিকে । সব কিছু দেখেও অভয়া নিশ্চুপ ছিল । কথা বাড়ায় নি । ট্যাক্সিটা ছেড়ে দিয়ে , অনির্বাণ হেঁটে চলে গিয়েছিল একা একা ,পিছন ফিরে তাকায়নি একবারও  । পার্কস্ট্রীট মোড়ে একা একা দাঁড়িয়ে থেকে দেখেছিল অনির্বাণের চলে যাওয়া ।


নিজের ঘরে এসে আবার একটা সিগারেট ধরালো । কিছুটা ভাবার চেষ্টা , অন্যকিছু বা অন্য রকম । সব কিছুর থেকে আলাদা । অনির্বাণ অথবা ওই ছবিটা । কিন্তু ভাবনাতে কিছু আসছে না । শুধু সিগারেটে অনর্গল টান মুখটাক  কেমন বিস্বাদ তিতকুটে হয়ে পড়েছে । জীবটা কেমন যেন পোড়া পোড়া লাগছে । স্বাদহীন যেমন হয় ।


সকালের রান্নাটা মা করে । তাই ওই দিকে খেয়াল দিতে হয় না । সিগারেটের গন্ধ পেয়ে এরই মধ্যে মায়ের কাছ থেকে ধমকের শব্দগুলো কানে এসেছে । কিন্তু উত্তরে কিছু বলেনি । শুধু ফোনটা হাতে নেড়ে কখনো ফেসবুক অথবা হোটাসঅ্যাপের মেসেজগুলো দেখেছে , কিছু উত্তর দিয়েছে , কিছু দেয়নি ।


কলিং বেলটা বাজতেই ঘর থেকে বেরিয়ে দরজা খুলে দেখলো, দাদা । ভীষণ অবাক ভাবে তাকিয়ে । সাথে ঝরণা ও মিঠু । আর সার সার করে দাঁড়া করানো প্রচুর লাগেজ ।



কি ব্যাপার । হঠাৎ ? কোন খবর তো দিসনি যে তোরা আসবি ?

হা । হঠাৎ করেই সব কিছু হয়ে গেলো । পরে বলছি ।

বউদি কেমন আছো । আসো আসো । মিঠু তোর খবর কি ?


সবাই এক প্রকার ঘাড় নেড়ে  ভেতরে ঢুকে পড়লো । অভয়াও কথা বাড়ালো না । দেখেই বোঝা যাচ্ছে সবাই ক্লান্ত ও বিষাদগ্রস্থ । মাও ততক্ষণে রান্না ঘর থেকে বেড়িয়ে সবাইকে দেখে একদম অবাক । অবাক হলেও খুশির উজ্জ্বলতা মায়ের মুখটা বেশ ছাপিয়ে গেছে । ছেলে অন্ত প্রাণ , আর সেই ছেলেকে দুম করে চোখের সামনে দেখলে কার না মুখ উজ্জ্বল হবে ! কিন্তু অদ্ভুত ভাবে কেউ সে রকম বেশি কথা না বলেই দোতালায় চলে গেলো । মায়ের হাঁটুর ব্যথার জন্যে সিঁড়ি ভাঙতে পারে না । না হলে মাও ওদের পেছন পেছন উঠে যেতো । সিঁড়ি অব্দি গিয়ে মা ফিরে তাকালো অভয়ার দিকে । চোখের ইশারায় কিছু জানতে চাইলো । অভয়া কিছু বললো না। বলবেই বা কি, সেও তো কিছুই বুঝতে পারছে না ।


স্নান খাওয়া দাওয়া করে বেড়িয়ে যাবার সময়, দাদা ঘরে এসে ঢুকলো । চোখে মুখে একটা ক্লান্তির ছাপ, সাথে জড়িয়ে আছে বিষাদ ।

এখন বেরুবি নাকি ?

হা , আজ একটু দেরী হয়ে গেলো ।

কিন্তু তোর সাথে একটু যে কথাছিল । মানে বিষয় একটু জরুরী । বুঝতে পারছি না কোথা থেকে শুরু করবো ।

দাদার এই ভণিতা দেখে বেশ অবাক হলো অভয়া । এই রকম ভাবে কথা বলতে কখনো দেখেনি । বিশেষত মাল্টিন্যাশাল কোম্পানীতে সিনিয়র অ্যানালিসিসের চাকরি ফাইনাল হতে, দাদার অহংটা বেশ বেড়িয়ে এসেছিলো খোলস ছেড়ে ।

আজ না গেলে হবে না, বা একটু দেরীতে । কথাছিল ।

আছিস তো, রাতে না হয় কথা বলা যাবে  আরাম করে ।

জানিনা থাকবো কিনা , যে কোন সময় চলে যেতে হতে পারে ।

তুই এমন ভাবে কেন কথা বলছিস । কি হয়েছে ? খুলে বল । না বললে তো কিছুই বুঝতে পারছি না । এলি আর এসেই উপরে চলে গেলি ।

ঠিক আছে, তুই যা , যদি থাকি রাতে কথা হবে ।

কথাগুলো বলে দাদা ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে গেলো । সোজা উপরে । কোনদিকে তকালো না ।  বউদি বা মিঠু কারো দেখা নেই । গৃহ বন্দির মতো নিজেদেরকে গুটিয়ে রেখেছে দোতলার ঘরে । বেড়িয়ে যেতে যেতে অভয়ার মনে হলো, একবার দোতালায় গেলে ভালো হয় । কিন্তু গেলো না । গেটের দিকেই এগিয়ে গেলো চুপচাপ ।


বাড়ি থেকে বেরিয়েই রিকশা পেয়ে গেলো । অনেকটা দূর স্কুল । রাস্তা জ্যাম না থাকলে পনের থেকে বিশ মিনিট লেগে যায় । তবু রিকশাতেই যায় । টোটো বা অটো কোনটাই তার ভালো লাগে না । অনেক দিনের অভ্যাস ।  বেশ লাগে । কিন্তু আজ মনটা ভারাক্রান্ত । সকাল থেকে সব কিছুই কেমন উলটোপালটা হয়ে গেছে । অনির্বাণের ফোন, ছবির অপূর্ণতা । সব শেষে দাদা । দুম করে বিশাল লাগেজ নিয়ে বাড়িতে প্রবেশ । তারপর গৃহবন্দির মতো দোতলায় আশ্রয় স্ত্রীকন্যাসহ । এমনটা কোনদিন হয়নি । দাদা এসেছে । পুরো বাড়ি হইহই করে গিফট বিতরণ । তারপর সারা দুপুর আড্ডা । দাদা বউদির লোক দেখানো বিদেশী প্রেমের খুনসুটি । কত কি ! মিঠুর ইংরেজি উচ্চারণ নিয়ে বউদির গর্ব । কিন্তু আজ একদম আলাদা ।  একটু অচেনা মনে হলো ওদেরকে ।


চিরকালই স্বার্থপরের স্বভাবের দাদা সৌরভ । ছাত্র জীবন থেকেই দেখেছে । নিজের কেরিয়ার ছাড়া আর কিছু ভাবেনি কোনদিন । বাবার খুব প্রিয়ছিল । অভয়া একদম উল্টো । তবে বাবা কিছু বলতেন না কখনো । মেয়ে তো । দেখতেও তো বেশ সুন্দরী । সেই তো ঘর সংসার করবে । এই রকম একটা ভাব অভয়া লক্ষ্য করেছে বহুবার । বাবা ও মায়ের মধ্যে । কিন্তু অভয়া সেই সব চিন্তাকে কোনদিন আমল দেয়নি । ছবি নিয়ে নিজের একটা আলাদা জগত গড়েছে । যেটা তার একদম নিজের । প্রায় জেদ করেই কোলকাতায় আর্ট শিখতে গিয়েছিল । অনেক বার বারণ করেছিল সবাই । কিন্তু সে শোনেনি । তবে শেষ পর্যন্ত বাবা মেনে নিয়েছিল । ওই ‘ছবিঘর’টা বাবা নিজেই বানিয়ে দিয়েছিল অভয়ার জন্যে ।  তখনও আর্ট কলেজের পড়া শেষ হয়নি । ছুটিছাটাতে আসলে, ওই ঘরটাতেই সে তার কাজগুলো করতো । ভালো লাগতো । তবে চিরকালের ইচ্ছেটাকে সে পারেনি পরিপূর্ণ করতে । বাবার হঠাৎ মৃত্যুতে অভয়ার ইচ্ছেটা অসমাপ্ত থেকে গেলো জীবনে ।


ইচ্ছেগুলো কেমন যেন ভঙ্গুর হয়ে গেছে ।  স্কুলে এসেও চিন্তার রেশটা থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না । ছবি-অনির্বাণ-দাদা । তিনটে যেন রহস্যের মহাপ্রলয় । বেশছিল । উদভ্রান্ত সে চিরকালই । বিশেষ করে বাবা মারা যাবার পর থেকে । পরিচিত অনেকেই খেপী বলে ডাকে মাঝে মাঝে । অনির্বাণ জীবন থেকে চলে যাবার পরে যে জীবনে কোন পুরুষ আসেনি । তা নয় । কিন্তু কেউ দাগ রাখতে পারেনি । কেউ কেউ তো স্মৃতির এতো আড়ালে চলে গেছে । মনেই পড়ে না । অনির্বাণকেও তো ভুলে গিয়েছিল প্রায় । কিন্তু আজ আবার শুকিয়ে যাওয়া ঘায়ে , যেন একটা সূঁচের ফুটো ঢুকে বসলো । ছবির ঘাটা দগদগে । কিন্তু কে জানে, সেটা কিন্তু মনের মধ্যে সে রকম ক্রিয়া করছে না । তবে মনটা হতাশায় ছেয়ে যাচ্ছে ।


বাড়ি রওনা দিতে দিতে বিকেল পাঁচটা বেজেই গেলো । আসার সময় ভেবেছিল জরুরী কাজগুলো সেরে বাড়ি চলে যাবে । কিন্তু সে ভুলে গেছিলো, যে কেরালা থেকে কিছু আর্টিস্ট আসবে । আর সেই একমাত্র আর্টের টিচার এই স্কুলে । সকালে ঘটনাগুলো নিয়ে চিন্তা করতে করতে ভুলে গেছিলো বিষয়টা । বেশ কয়েকজন । প্রত্যেকেই ছবি আঁকা জগতে পরিচিত নাম । এদের মধ্যে যতক্ষণ ছিল । কিছুটা শান্তি এসেছিল । কিন্তু স্কুল থেকে বেড় হতেই, সেই চিন্তাগুলো মৌসুমী বায়ুর মতো দখল করে বসলো, মনের মধ্যে ।  স্কুল থেকে বেরিয়ে সেই রিকশা ।  দাদার কথা শুনে না আসলে, ভীষণ কেলেঙ্কারী হয়ে যেতো ।


(২)


বাড়ি ঢুকেই অভয়া কিছুটা অবাক ।  যে ভাবে এসেছিল  দাদা, বিরাট লাগেজের বোঝা নিয়ে । ঠিক সেই ভাবেই সব লাগেজ বাড়ির গেটে কাছে নামিয়ে এনেছে ।  বউদি,মিঠু ও দাদা, সবাই রেডি ।

কিরে এই এলি , আবার চলে যাচ্ছিস ।

হা ।

হঠাৎ এলি , আবার  হঠাৎ চলে যাচ্ছিস । ব্যাপারটা কি ? খুলে বলবি ?

কিছু না । আমাদের তো যেতেই হবে । তাই দেরি করে লাভ নেই । এখান থেকে কোলকাতা , কোলকাতা থেকে জার্মান ।

বেশ । কিন্তু অবাক করা কান্ড কিন্তু দেখালি । কিছু বললি না । আমেরিকার বদলে জার্মান । সব কেমন যেন গোলমেলে ।

তুই বুঝবি না । থাকিস তো শিলিগুড়িতে , পৃথিবীর খবর রাখবি কি করে ?

তুই আবার পৃথিবীর খবর নিয়ে কবে থেকে ভাবতে শুরু করলি । তোর তো একটাই মন্ত্র ছিল ‘আপন সন্তান যেন থাকে দুধেভাতে’ ।

বাদ দে তোর সাথে তর্ক করতে চাইনা । ভালো থাকিস ।


কথাগুলো শেষ করেই তিন জনে বেরিয়ে গেলো । অভয়া ওদের চলে যাবার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো অবাক দৃস্টিতে । পাশে মা, চোখে জল নিয়ে দাঁড়িয়ে । স্বাভাবিক । 


পৃথিবীতে অনেক পুরুষ দেখেছে । কিন্তু দাদার মতো স্বার্থপর মানুষ আর চোখে পড়েনি ।  সে কিনা বলে পৃথিবীর খবরের কথা । অদ্ভুত লাগলো শুনতে ।  বাবা ও দাদার স্বভাব প্রায় একি রকম । এরা দুজনেই কখনো নিজের প্রয়োজন ছাড়া কোন কাজ করেছে বলে মনে পড়ে না । দু’জনের স্বভাবের এতো মিল । অভয়াকে অবাক করেছে দিনের পর দিন । বাবার পুরো মনটা যেন দাদার মধ্যে কেউ বসিয়ে দিয়েছে ।  বউদি কিন্তু এমন ছিল না । কিন্তু একদিন আবিস্কার করলো, বউদির ভাষাতেও দাদাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে । এটা প্রেম না প্রয়োজন । কে জানে ।


অনির্বাণের স্বভাবটা প্রথমে মনে হয়েছিল একটু আলাদা । রাজনীতির সাথে যুক্তছিল । তাও আবার বাম-রাজনীতি । কিন্তু সেটা যে একটা মুখোশ বুঝতে অনেকটাই সময় লেগেছিল । শুনেছিল সত্তর দশকে অনির্বাণের বাবা আন্ডারগ্রাউন্ডে থেকেছিল বহুকাল । প্রথম সারির নেতাদের সাথে । দেখাও হয়েছিল একবার । অনির্বাণের মধ্যে অনির্বাণের বাবার কোন লক্ষণ খুঁজে পায়নি । দরাজ এক পুরুষ । রাজনীতি থেকে সমাজ জীবন । এতো সুন্দর করে তুলে ধরেছিলেন । আজো ভুলতে পারে না অভয়া । মনে মনে সেই পুরুষটাকে খুঁজেছিল অনির্বাণের মধ্যে । কিন্তু পায়নি কোনদিন । যতদিন গেছে ধীরে ধীরে অনির্বাণের মনকে বুঝতে পেরেছে । দাদা-অনির্বাণ-বাবা, তিনজনকে একি আসনে বসাতে দেরি হয়নি অভয়ার । একদিকে অনির্বাণের বাবা , আর অন্যদিকে তিনজন । মাঝখানে অভয়া । অভয়ার জীবনের গল্প । পুরুষের প্রেম পর্ব । বাকি সব পুরুষরা সব আচানক, যারা এসেছিল জীবনের খাতায় । তারা শুধুই বিছানা পর্যন্ত । প্রেমে নেই । অনির্বাণ ? প্রেম ? কে জানে? তবে এটা বুঝতে সময় লাগেনি, অভয়ার পুরুষ অনির্বাণ না । সেটা অভয়া বুঝে গেছে অনির্বাণের বাবাকে দেখার পর ।


1 comment:

  1. Khub sundar galpo ta,aneker jiboner sathe mile jabe,eto Sundar kore galpor akare lekha hoyeche..... dhannobad!

    ReplyDelete