Tuesday, April 30

দীপক মান্নার গল্প







কড়ুইগাছার বউ কথা কও


তিন মাস কলকাতায় এসে রজত যেন খুব বেশি করে কমার্শিয়াল হয়ে পড়েছে। সকাল আটটায় ঘুম থেকে উঠে চান খাওয়াদাওয়া সেরে, নটার মধ্যে অফিসে বেরিয়ে পড়ে। সারাদিন অফিসের কাজ সেরে বাড়ি ফেরার পথে দুটো টিউশন পড়িয়ে ফিরতে ফিরতে রাত প্রায় দশটা বেজে যায়। কোন কোন দিন টিউশন না থাকলে বাড়ি ফেরার পথে কফিহাউস অথবা সাহিত্যের আড্ডা সেরে আসে। ছোটবেলা থেকে অভ্যেস। সময় সুযোগ পেলেই খাতা পেন নিয়ে সবার চোখের আড়ালে চলে যায় অথবা কবিতার বই নিয়ে বসে পড়ে। এছাড়াও তার আর একটা নেশা আছে আর তা হল পাখির নেশা। এই পাখির নেশায় সে গ্রামে গঞ্জে বিভিন্ন জায়গায় ছুটে যায়। ক্যামেরা নিয়ে পাখির ছবি তোলে এবং ল্যাপটপে ভরে রাখে। কোন পাখির ছবি নেই তার কাছে- চড়াই, বুলবুলি, টিয়া থেকে শুরু করে শ্যামা, দোয়েল সবই আছে। বাড়ির কাছে কিছুটা দূরে একটা জলাশয় আছে। প্রতিবছর শীতে ভিন্ন প্রজাতির পরিযায়ী পাখি সেখানে উড়ে আসে। রজত সেখানে ছুটে গিয়ে তাদের ক্যামেরাবন্দি করে। দুঃখ একটাই সে কোনদিন ‘বউ কথা কও’ পাখি দেখেনি। মানে ছবিতে দেখেছে কিন্তু নিজের চোখে দেখেনি। সে কিছুতেই তার সীমানার মধ্যে আসে না।

বেশ কিছুদিন হল কোথাও একটু বেড়িয়ে আসার জন্য মনটা চঞ্চল হয়ে উঠছিল রজতের। অফিসেও ভীষণ কাজের চাপ থেকে একটু রেহাই পেতে চায়। তাছাড়া, সৌম্য বলেছে তাদের গ্রামে নাকি বউ কথা কও হামেশাই দেখা যায়। তাই সে কয়েকদিনের ছুটি ম্যানেজ করে সৌম্যর বাড়িতে যাবে ঠিক করে। সৌম্য তার কলেজের বন্ধু। একসাথে সুরেন্দ্রনাথ কলেজ থেকে বেরিয়েছে। সুখদুঃখে সবসময় দুজনে একসাথে থেকেছে। বাড়ি নদীয়ার প্রত্যন্ত এক গ্রামে। গ্রামের নাম কড়ুইগাছা। চারিদিকে শুধু গাছ আর গাছ। রজত গাছে বসে থাকা পাখিদের সাথে মনে মনে কথা বলে। প্রকৃতির নিবিড় ঘন ছায়ার মধ্যে নিজেকে লিপ্ত করে রাখতে ভীষণ ভালোবাসে। এই কয়েক মাসে যান্ত্রিক শহরে থেকে সেও যেন কেমন যন্ত্রের মতো হয়ে উঠেছে, তাই একটু নিরিবিলি খুঁজতে সে সৌম্যদের গ্রামই বেছে নিয়েছে। তার ওপর সৌম্য বলেছে তাকে ‘বউ কথা কও’ পাখি দেখাবে। রজত শুনেছে সৌম্যদের ওখান থেকে নাকি বাংলাদেশের বর্ডার দেখা যায়, ইছামতী নদীর ওপর। সে কোনদিন বর্ডার দেখেনি। ওর আশপাশের মানুষের জীবনযাত্রা দেখার ইচ্ছা ছিল বহুদিনের। তাই আর ভাবনা চিন্তা না করে লাগেজ নিয়ে বেড়িয়ে পড়ে।

সকাল সাতটার মধ্যে শিয়ালদায় পৌঁছে যায়। সাড়ে সাতটা নাগাদ ট্রেন। রজত উঠে জানলার ধারে একটা সিটে গিয়ে বসে। এটা ওর চিরকালের স্বভাব, ট্রেনে উঠেই জানলার ধার খোঁজা, প্রকৃতির দৃশ্য দেখা আর মনে মনে গান গাইতে গাইতে যাওয়া।

অলিখিত প্রথা অনুযায়ী ট্রেন যথারীতি বেশ কয়েক মিনিট দেরিতেই ছাড়ল। দেরিতে ছাড়লেও ট্রেন বেশ জোরেই ছুটছিল। রজত জানলা দিয়ে লাইনের ধারে পড়ে থাকা নুড়ি পাথর গুলো দেখতে থাকে। চোখের সামনে আবছা হয়ে ছুটে যাওয়া সেই পাথরগুলোকে কিসের সঙ্গে তুলনা করবে ভেবে পায় না। কখনও মনে হয়েছে এক একটা সময় যেন ছুটে চলেছে, কখনও মনে হয়েছে অত্যন্ত গভীর প্রেমও এই নুড়ি পাথরের মত জীবন থেকে দ্রুত সরে যায়, সবকিছু উপেক্ষা করে। দুটো ধারনাই রজতের মনের মধ্যে গভীর ভাবে আঁকড়ে বসে। সে ভাবতে থাকে ছোটবেলাতেই বাবা-মায়ের মায়া মমতা হারিয়েছে।, দাদা বৌদিদের ভালবাসার মধ্যে যেন ঘনত্ব ছিল না। সে জন্য অবশ্য কারোর কাছে তার কোন অভিযোগ নেই। কারণ, সে অবসর তাদের ছিল না। তাদের কাছে যেটা সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল তা হল দুমুঠো অন্ন।

এ সব ভাবতে ভাবতে ট্রেন কখন রানাঘাট স্টেশনে ঢুকে গেছে। এখানে ট্রেনটা প্রায় একঘণ্টার কাছাকাছি দাঁড়ায়। কারণ, এরপর থেকে ইলেকট্রি-ফিকেশন হয়নি। ডিজেল ইঞ্জিন ট্রেন টিকে টেনে নিয়ে যায়। রজত সেই ফাঁকে ট্রেন থেকে নেমে স্টেশন লাগোয়া পান বিড়ির দোকান থেকে একটা সিগারেট কিনে ধরায়। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এক ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করে এখান থেকে তার গন্তব্যস্থল আর কতদূর। লোকটি উত্তর দেয় – তা প্রায় ঘণ্টা খানেক হবে। রজত ভদ্রলোকটির কাছে জেনে নেয় সামনাসামনি কোন মিষ্টির দোকান আছে কিনা। তারপর, প্ল্যাটফর্ম থেকে নেমে কিছুটা দূরে একটা দোকান থেকে কিছু মিষ্টি কিনে নেয়। জায়গাটা ভীষণ জমজমাট। চারিদিকে কোলাহল আর ব্যস্ততা। রজতের মনে হয় এ যেন আর এক কলকাতা। এত দূরে এসে এখনও শুদ্ধ বাতাস তার ফুসফুসে নিতে পারছে না। ট্রেন ছাড়ার সময় হয়ে আসে। রজত গিয়ে নিজের জায়গায় বসে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই সবুজ সিগন্যাল পেয়ে ট্রেন ছেড়ে দিল। ট্রেন লাইনটা রাণাঘাট স্টেশন ছেড়েই গুলতির ডাঁপের মতো দু দিকে বেঁকে গেছে। রজতের ট্রেন ডানদিকের লাইন ধরে ছুটতে শুরু করে। মুহূর্তের মধ্যে পরিবেশটা বদলে যায়। কোথায় সেই জনাকীর্ণ কলকাতা! চারিদিকে সবুজ ধানের ক্ষেত, যেন সবুজ সমুদ্র আর সেই সমুদ্রে ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে চিৎকার, চেঁচামেচি কোলাহল। রজতের মনটা আনন্দে আত্মহারা হয়ে ওঠে। কিছুদূর যাবার পর সর্ষের ক্ষেত। হলুদ সর্ষে ফুলে সারা মাঠ ভরে গেছে আর তার ওপর দিয়ে মৌমাছির দল মধুর লোভে উড়ে বেড়াচ্ছে। আরও কিছুদূর যাবার পর সে দেখতে পায় তিল ক্ষেত। মাথায় বেতের টুপি দিয়ে কৃষকেরা মাঠে লাঙ্গল দিচ্ছে। রজত তিল ক্ষেতের সেই মনোরম দৃশ্য তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করে। তিলগুলো দেখে তার মনে হয়, এক একটা তিল যদি ভালবাসা হত, তাহলে এই পৃথিবীতে নিষ্ঠুর প্রেমহীন মানুষগুলোর বুকে বসিয়ে দেওয়া যেত।
এসব ভাবতে ভাবতে কখন ট্রেন গন্তব্যস্থল পৌঁছে গেল রজত টেরই পেল না। সে ট্রেন থেকে লোহার সিঁড়ি বেয়ে প্ল্যাটফর্মে নামে। ঠিক প্ল্যাটফর্ম বলতে যা বোঝায় তা নয়। লাইন বরাবর সরু ইটের রাস্তা। তাতেই হ্যান্ডেল ধরে কোনপ্রকারে নামতে হয়। পাশেই একটা পান গুমটির মতো টিকিট কাউন্টার। একটু দুরে একটা মিষ্টির দোকান আর পান গুমটি ছাড়া তেমন কিছু চোখে পড়ে না। রজত মিষ্টির দোকানে গিয়ে জিজ্ঞেস করে ‘দাদা এখানে সৌম্য নায়েকদের বাড়িটা কোথায় একটু বলতে পারেন?’ দোকানদারটি চট করে বুঝে যায়, তারপর বাঁহাতি একটি মাটির রাস্তা দেখিয়ে বলে –‘এই রাস্তা ধরে সোজা চলে যান, কিছুদূর যাবার পর বাঁদিকে দেখবেন কয়েকজন তাঁত চালাচ্ছে, ওখানে গিয়ে কাউকে জিজ্ঞেস করলেই বলে দেবে নায়েকদের বাড়ি কোনটা’।

রজত দেখল এখানে রিকশা নেই, ভ্যান অথবা গরুর গাড়িই ভরসা। সে হাঁটা লাগাবে মনস্থির করল। পকেট থেকে সিগারেট বের করে মুখে দেয়। হাঁটতে হাঁটতে গাছের ডালে বসে থাকা পাখিগুলোর দিকে মাঝে মাঝে তাকায়। কখনও ক্যামেরা দিয়ে দু একটার ছবিও তুলে রাখে। রজতের চোখে একটাই মাত্র পাকা দোতলা বাড়ি পড়ল। বাকি সব দরমার অথবা টিনের। কিছুদূর এগিয়ে গিয়ে দেখে মিষ্টির দোকানের লোকটির কথা ঠিক। দুজন মেয়ে এবং বছর বত্রিশের একটি যুবক তাঁত মেশিন চালাচ্ছে। লোকটিকে গিয়ে জিজ্ঞেস করাতে সে একটু দূরে একটা বাঁশঝাড় দেখিয়ে বলে – ওর পিছনের বাড়িটাই সৌম্যদের বাড়ি। রজত ঘন বাঁশবনের ফাঁক দিয়ে আবছা কয়েকটা দর্মার ঘর দেখতে পেল। ঘরের কাছে আস্তেই সৌম্যকে দেখতে পায়। সৌম্যও রজতকে দেখতে পেয়ে প্রথমটা অবাক হয়ে যায়, তারপর দৌড়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে বলে – ‘কিরে হঠাৎ এভাবে চলে এলি? একটা খবর দিয়ে আসবি তো!’ রজত বলে –‘তোকে সারপ্রাইজ দেব বলে তো জানাইনি। শোন, তোর এখানে আসার একটা মস্ত কারণ আছে’। - ‘কি কারণ?’ – ‘ভুলে গেলি? তুই বলেছিলি আমায় ‘বউ কথা কও’ পাখি দেখাবি।’ - ‘ও হ্যাঁ’, মনে পড়েছে।’- ‘আমি কিন্তু ‘বউ কথা কও’ পাখি দেখে তবেই যাব’। - ‘আচ্ছা, বেশ বেশ তুই এখন ঘরে চ।’ এই বলে সৌম্য রজতকে ভিতরে নিয়ে যায়।  মা বাবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। রজত তাদের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে। বেলা তখন প্রায় একটা বেজে গেছে।

দুপুরের খাওয়াদাওয়া সেরে দুজনে বিছানায় গিয়ে বসে, তারপর চলে জমিয়ে আড্ডা, পুরনো স্মৃতিচারণ। গল্পে গল্পে রজতের চোখে ঘুম নেমে আসে। কয়েক ঘণ্টার জার্নি তাকে ক্লান্ত করে দিয়েছে। আবহাওয়াটাও বেশ সুন্দর। গত কয়েকদিন প্রচণ্ড গরমে সবাই আইঢাই করেছে। আজ একটু মেঘলা আকাশ। ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে।

বিকেল হতেই রজত বিছানা ছেড়ে উঠে বসে। সৌম্য তখনও এক কোণে বালিশ আঁকড়ে পড়ে আছে। জানলা দিয়ে দেখা যাচ্ছে বিস্তৃত খোলা জলাভূমি। ঝিরঝিরে সুন্দর বাতাস বইছে। দূরে উঁচু বাঁধের ওপর রেললাইন পাতা। একটা ডিজেল ট্রেন তার ওপর দিয়ে ঝিক ঝিক সুর তুলে ছুটে চলেছে আর তার ধোঁয়া সাপের ফণার মতো হেলতে দুলতে আকাশে গিয়ে মিশছে। এমন মনোরম দৃশ্য এর আগে রজত কখনও দেখেনি। সে এক ছুটে জলার ধারে আসে তারপর একটা খেজুর গাছের গোড়ায় গিয়ে বসে। দূরে মাঠের মধ্যে কয়েকটা মেয়ে বউ ধান ঝাড়ছে। সে কানে হেডফোন গুঁজে গান শুনতে থাকে। হঠাৎ দেখে দূরে সেই ধান ঝাড়াই করা মেয়ে বৌগুলোর মধ্যে থেকে একটি যুবতী মেয়ে তার দিকে ছুটতে ছুটতে আসছে আর ইশারা করে কি বলছে। রজত তার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারে না। কাছে আসতে তার কানে এলো, সে বলছে - ‘বাবু, ওখানে বসিস না, কাল ওখান থেকে দুটো কেউটে বেরিয়েছে’। গ্রাম্য ভাষায় হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে সে কথাগুলো বলতে থাকে। রজত ধিড়পিড় করে সেখান থেকে উঠে পড়ে। মেয়েটি নিজের খেয়ালেই গড়গড় করে বলতে থাকে –‘এর আগেও ওখান থেকে আরও দুটো সাপ বেরিয়েছিল, আমাদের গ্রামের ছেলেরাই অগুলোকে মেরেছে। তুই আর কোনদিন ওখানে বসিস না’।

রজত সাপের কথা শুনে যত না অবাক হল তার চেয়েও বেশি অবাক হল সেই গ্রাম্য মেয়েটির কথা বলার সাবলীল ভঙ্গিমা দেখে। সে কোন কথার উত্তর না দিয়ে এক ঠায়ে তার কথা শুনতে থাকে আর তার সংক্ষিপ্ত সরু কোন এক নদীর মত ভুরুর দিকে তাকিয়ে ভাবতে থাকে এ নদী যেন তার বহু পরিচিত। সেই নদীর কূলে পানসির মত দুই চোখ হেলেদুলে উঠছে। মেয়েটির অনর্গল কথাবার্তা থামতেই রজতের তন্দ্রা কেটে যায়। তার দিকে এতক্ষণ তাকিয়ে থাকাতে মেয়েটিও কেমন যেন লজ্জা পায়। রজত হঠাৎ প্রশ্ন করে –“ তোর নাম কিরে? সে মাথা নিচু করে লাজুক স্বরে উত্তর দেয় –‘কুসুম’। ‘তোর বাড়ি কোথায়?’ – ‘ওই যে লম্বা জমিটা দেখছ, ওর ঠিক পরেই’। -তোর বাড়িতে কে কে আছে? – বাড়িতে আমি আর আমার দাদু থাকি। কথাগুলো বলতে বলতে হঠাৎ তার দুচোখ জলে ভরে আসে। রজত বিচলিত হয়ে জিজ্ঞেস করে – ‘কিরে কাঁদছিস কেন’? মেয়েটি কোন কথার উত্তর না দিয়ে ফোঁপাতে থাকে। রজত তাকে শান্ত করার চেষ্টা করে। সে কান্না থামিয়ে বলে – ‘আমার একটা ছোট্ট ভাই ছিল, একবার প্রচণ্ড ঝড় বৃষ্টিতে সে এই জমিতে আটকে পড়েছিল। আমরা সারারাত ধরে খুঁজেও তাকে পাইনি। পরদিন সকালে ওই যে দূরে একটা ডোবা দেখছ, ওই ডোবার জলে ভাইয়ের মরা দেহটা ভেসে ওঠে’। কথাগুলো বলতে বলতে কুসুম জমির ওপর বসে পড়ে। রজত দেখে ছোটো ছোটো শিশির বিন্দু কিভাবে ফুলের চিবুক বেয়ে ঝরে পড়ছে। কিভাবে ভায়ের মৃত্যু তার কোমল হৃদয়ে যন্ত্রণার রেখা টেনে গেছে। কুসুম উঠে দাঁড়ায়, তারপর বলে –‘আমি আসি, দাদু চিন্তা করবে’। এই বলে সে ছুটতে ছুটতে দূরে সেই মেয়ে বউদের দলে মিশে যায়। যেতে যেতে একবার পিছন দিকে তাকায়। রজতও তার দিকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ তারপর ঘরে ফিরে আসে।

সৌম্য বিকেলে বাজার থেকে আস্ত একটা জ্যান্ত রুইমাছ কিনে এনেছিল। রাত্রের খাওয়াটা তাই একটু ভারির ওপর দিয়েই গেল। রাতে শোবার আগে দুজনে কলেজের পুরনো কিছু স্মৃতি আওড়াতে লাগল। শোবার আগে রজত সৌম্যকে বউ কথা কও পাখির কথা একবার মনে করিয়ে দেয়। সৌম্য কথা দিয়ে চোখ বোজে। রজতের শোবার আগে বই পড়ার নেশা। ঘুম আসতে আসতে রাত প্রায় একটা বেজে যায় প্রতিদিন। আজ আর বইয়ের পাতায় তার মন বসছে না। শব্দগুলো ইঞ্জিনের ধোঁয়ার মত মিলিয়ে যাচ্ছে। সে মাথার কাছে খোলা জানলা দিয়ে দূরে আকাশটার দিকে তাকিয়ে থাকে। কি এক অদ্ভুত মায়াটান তার ওপর ভর করেছে। দূরে খোলা জমিটার দিকে তাকিয়ে ভাবে কুসুম হয়তো তার ভাইয়ের জন্য ওই ডোবাটার পাশে বসে কাঁদছে। ওর চোখের জল বড়ই বেদনাদায়ক। সে ভাবে এখুনি ছুটে গিয়ে তার চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে আসে। বলে আসে ‘ওই দ্যাখ, আকাশের দিকে তাকিয়ে, যেটা সব থেকে উজ্জ্বল তারা, ওটাই তোর ভাই।’ রজতের চোখে তন্দ্রা নেমে আসে।

পরদিন সৌম্যর বউ কথা কও পাখি দেখানোর কথা। কিন্তু ঘুম থেকে উঠে দেখে সৌম্য নেই সে জরুরি কাজে একটু বেরিয়েছে আসতে দেরি হবে। রজত ভাবল, আজও আর তার বউ কথা কও পাখি দেখা হবে না। কি আর করে, তাই সে ঠিক করে মায়াপুর যাবে। সে মাসিমার তৈরি করা চা আর টিফিন খেয়ে বেরিয়ে পড়ে। বেশ কিছুটা হাঁটার পর সে বগুলা বাসস্টপে এসে দাঁড়ায়। ঝির ঝির করে বৃষ্টি পড়ছে তখন। বাসে দু-তিন ঘণ্টার রাস্তা। মহাপ্রভুর মন্দিরের বেশ খানিকটা দূরে বাস থেকে নেমে তারপর কিছুটা হেঁটে মন্দিরে প্রবেশ করে। মন্দিরে তখন আরতি ঘণ্টা ধ্বনি হচ্ছে। রজত মন্দিরের ভিতরটা কিছুটা সময় কাটায়। তারপর, বেরিয়ে গঙ্গার দিকটা যায়। এখানের গঙ্গাটা বেশ সরু। ওপারে বেশ খানিকটা ফাঁকা জমি, তারপর সারি সারি গাছ। কিছুদূর গেলে জলঙ্গি নদী আর গঙ্গার মিলনস্থল। রজত সেই দিকে হাঁটতে থাকে। কাছে এসে দেখে জলঙ্গির সবুজ জল কিভাবে গঙ্গার ঘোলাটে জলের সাথে মিশেছে। হঠাৎ তার মনে হয় ঠিক এভাবে যদি কুসুমের সাথে তার ভাইয়ের মিল হয়ে যেত...।
ধিরে ধিরে বেলা গড়িয়ে আসে। রজত সৌম্যদের বাড়ি ফিরে আসে। আজ বিকেলেও তার একবার জলায় যেতে ইচ্ছে করছে কিন্তু সে জানে না কেন তার সেই ইচ্ছা জাগরিত হচ্ছে। হয়তো বউ কথা কও পাখি তার জন্য গাছের ডালে অপেক্ষা করছে। কখনওবা মনে হচ্ছে কি এক অসম্পূর্ণ কাজ যেন সে ফেলে এসেছে। এই মাঠ তাকে ডাকছে বার বার। অথচ দিগন্ত বিস্তৃত খোলা মাঠের থেকেও তার বেশি পছন্দ নদী, পাহাড়, পাখি আর গাছ।

সে মাঠের ধারে একটা লম্বা আলের ওপর গিয়ে বসে। সঙ্গে আনা ডাইরির পাতা উলটে একটা কবিতা লিখবে ঠিক করে। অনেকদিন কোন কবিতা লেখা হয়নি। সাহিত্যের আড্ডায় পুরনো কবিতা অনেকে শুনতে চায়না। হঠাৎ দেখে কুসুম ছুটতে ছুটতে এসে তার পায়ের কাছে বসে পড়ে তার পর প্রাণোচ্ছল ভাবে জিজ্ঞেস করে –‘কিগো বাবু! তুমি আজ আবার এসেছ? রজত উত্তর দেয় – ‘হ্যাঁ, আমি তো বেড়াতে এসেছি কদিনের জন্য’। - তোমার ঘর কোথায়? – কলকাতায়। কুসুম অবাক হয়ে বলে – ‘কলকাতায়!’ – হ্যাঁ, তুই কলকাতায় কোনদিন গিয়েছিস? কুসুম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে – ‘না গো, আমি লেখাপড়া জানিনা, শুনেছি ওখানে সব বড় লোক থাকে, ভালো জামাকাপড় পড়ে, ভালো ভালো কথা বলে। জানো! আমার খুব কলকাতায় যাবার ইচ্ছে হয় কিন্তু লোকে বলে ওখানে নাকি অনেক বাজে লোকও থাকে’। রজত বলে – ‘কি! আমাকে তোর বাজে লোক বলে মনে হয়? কুসুম রজতের মুখের দিকে তাকায়, তারপর মাথা নিচু করে লাজুক ভঙ্গিমায় বলে –‘না’। ‘তুই কলকাতায় যাবি? –‘কার সাথে যাব?’ – ‘যদি আমি নিয়ে যাই?’ কুসুম উত্তর না দিয়ে মাথা নিচু করে বসে থাকে। রজত জিজ্ঞেস করে –‘আচ্ছা, তুই সারাদিন কি করিস?’ সে বলে – ধান সেদ্দ করি, শুকোতে দিই, আনাজ কাটি এই সব। - তোর কোন বন্ধু নেই? –‘ছিল, দাদু এখন আর তাঁদের সাথে মিশতে দেয় না। বলে আমি নাকি বড় হয়ে গেছি, দুদিন পরে বিয়ে হবে, এখন আর কারোর সাথে বেশি মেলামেশা করা ঠিক নয়।’ রজত বলে- আমাকে তোর বন্ধু করবি? সে এক কথায় ঘাড় নেড়ে বলে –হ্যাঁ, তুমি খুব ভালো। বেশ সুন্দর সুন্দর কথা বল। জানো, আমার কোন সঙ্গী নেই, সারাদিন শুধু কাজ। ধান সেদ্দ করা, শুখনো করা আবার তুলে ঠিক জায়গায় রাখা। আমার আর এ সব ভালো লাগে না গো। আমার সাথে গল্প করার কেউ নেই। তুমি বন্ধু হলে আমার খুব ভালো লাগবে। হঠাৎ তার খেয়াল হয় সন্ধ্যে হয়ে এসেছে। ‘আচ্ছা বাবু, আজ আমি যাই’ – এই বলে সে এক ছুট লাগাল। কিছুদূর যাবার পর আবার ফিরে এসে তার সামনে দাঁড়ায়, এবং আঙ্গুলের মধ্যে একটা খড়কুটো পাকাতে পাকাতে মাথা নিচু করে বলে – ‘কাল আবার আসবে তো।’ রজত হ্যাঁ বলাতে সে খুশি হয়ে একছুটে দূরে মিলিয়ে যায়। রজত তার ছুটে যাওয়া পথের দিকে এক ঠায়ে তাকিয়ে থাকে।

সেদিন সকাল থেকে আকাশটা মুখ ভার করে দাঁড়িয়ে আছে। এক ফোঁটা সূর্যের আলো নেই। গরমে সকলে আইঢাই করছে। বিকেলের দিকে বৃষ্টি আসতে পারে। ঠিক তাই, চারটে বাজতে না বাজতেই আকাশটা কালো মেঘে ছেয়ে গেল। তার সাথে ঝড়ো হাওয়া বইতে লাগল। পশ্চিম আকাশে উদয় হওয়া বিশাল মেঘের কালো চাদর যেন পৃথিবীটাকে এখুনি ঢেকে দেবে। এমন সুন্দর দৃশ্য এর আগে রজত কখনও দেখেনি। তার মনে হয় যারা পরমাণু বোমা তৈরি করে পৃথিবীটাকে ধ্বংস করে দিতে চায় তারাও যদি এ দৃশ্য দেখে, তাহলে সমস্ত ফর্মুলা ভুলে যাবে। রজত ছুটে যায় খোলা মাঠের দিকে। আবছা আলোর মধ্যেই বৃষ্টি শুরু হল। তুমুল বৃষ্টি। সে সারি দেওয়া একটা খেজুর গাছের নিচে গিয়ে দাঁড়ায়। হঠাৎ দেখে ঘন বৃষ্টির মধ্যে দিয়েই কে যেন দুটো বড় মানকচুর পাতা মাথায় দিয়ে তার দিকে ছুটে আসছে। কাছে আস্তেই দেখে কুসুম। - ‘বাবু এই নাও, এটা মাথায় দাও’ এই বলে সে একটা রজতের মাথায় দেয় আর একটা নিজের। রজত দ্যাখে, কুসুমের সারা শরীর ভিজে গেছে। গায়ের কাপড় শরীরের সঙ্গে লেপটে গেছে ফলে তার নিষ্কলুষ যৌবন কাপড় ভেদ করে উঁকি দিয়ে উঠছে। এসব দেখে রজতের মনে কেমন যেন এক হিল্লোল বয়ে যায়। সে দ্যাখে তার দুই ভুরু ঝড় বৃষ্টিতে গতিপথ বদলেছে। ভেজা পাখির মতো ঠক ঠক করে সারা শরীর কাঁপছে। রজত তার দিকে দু হাত বাড়িয়ে দেয়। কুসুম বাঁধা দেয় না, রজতের মুখের দিকে কিছুক্ষণ ভেজা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তারপর অবলীলায় তার বুকের মধ্যে মিশে যায়। হঠাৎ বিদ্যুতের চমকে তন্দ্রা কেটে যায় রজতের। সে আমতা আমতা করে কুসুমকে বলে – ‘যা বাড়ি চলে যা, আর বৃষ্টিতে ভিজিস না। আর শোন, আমার ছুটি ফুরিয়ে গেছে। কালই কলকাতায় ফিরে যাচ্ছি। ভালো থাকিস।’ রজতের কথায় কুসুমের মাথায় বজ্র ভেঙে পড়ে। সে অবাক দৃষ্টিতে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। চোখ দিয়ে অঝোরে জল ঝরছে। রজত দ্যাখে, তার চোখের জলের স্রোতে জীবনের অনাস্বাদিত সমস্ত সুখও যেন ধুয়ে যাচ্ছে। সরু নদীর মতো দুই ভুরু যেন ছিন্নভিন্ন আর সেই পানসি চোখ কোন এক দুঃখের সাগরে ডুবে গেছে। কুসুম চোখ থেকে চোখ নামিয়ে একছুটে বৃষ্টির ধোঁয়ায় হারিয়ে যায়।

সৌম্য বৃষ্টি শেষে বাড়ি ফিরে আসে। এসে দ্যাখে রজত বিছানায় শুয়ে। বলে- ‘কিরে! এই ভর সন্ধ্যেয় শুয়ে। শরীর ঠিক আছে তো? রজত বলে – কেমন যেন শীত শীত লাগছে। সৌম্য কপালে হাত দিয়ে দ্যাখে গা বেশ গরম। বলে – এ কিরে! তোর গা যে পুড়ে যাচ্ছে! এক কাজ কর, তুই চুপচাপ শুয়ে থাক, আমি ওষুধ নিয়ে আসি। এই বলে যাবার উপক্রম করতেই রজত বাধা দেয়। বলে- ‘ও ঠিক হয়ে যাবে, তুই ব্যস্ত হোস না। তুই বরঞ্চ হাতমুখ ধুয়ে রেস্ট নে।’ সৌম্য বলে – ‘তোর মাথা খারাপ হল নাকি! একেই এত জ্বর তার ওপর রাত বিরেতে বাড়াবাড়ি হলে?’ এই বলে সে দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।

রাত্রে মাসিমা গরম দুধ আর রুটি করে রজতের জন্য। সে তাই খেয়ে শুলো। রাত্রি গভীর হতেই রজতের শরীরের তাপমাত্রা বাড়তে থাকে। প্রায় বেহুঁশ অবস্থা। একই ভাবে পরের দিনও কেটে গেল। এই দুদিন মাসিমা তার খুব যত্ন করেছেন, একদম নিজের মায়ের মতো। প্রায় সারারাত ধরে কপালে জলপট্টি দিয়েছেন। রজত তার কাছে চির কৃতজ্ঞ।

পরদিন, রজত সকালে ঘুম থেকে উঠেছে একটু দেরিতেই। সৌম্য তার আগে চান খাওয়া করে কাজে বেরিয়ে গেছে। আজ আর শরীরে জ্বর নেই। শুধু মনটা কেমন যেন উদাস হয়ে আছে। তার ‘বউ কথা কও’ পাখি দেখা হল না। জানলা দিয়ে দূরে ফাঁকা জমিটার দিকে তাকিয়ে থাকে। হঠাৎ কানে একটা গুঞ্জন এলো। মাসিমা কাকে যেন বলছে – ‘মেয়েটির দুর্দশার শেষ নেই। আপনজন বলতে ওই একমাত্র বুড়ো দাদুটাই ছিল, সেও গেল। মেয়েটা একেবারেই অনাথ হয়ে গেল’। রজত উঠে এসে মাসিমাকে জিজ্ঞেস করে – ‘কার কথা বলছেন মাসিমা?’ – ‘ওই যে ধান জমিটার ওপারে কুসুম বলে একটা মেয়ে থাকে। ওর দাদু গতকালের ঝড়বৃষ্টিতে কুসুমকে খুঁজতে বেরিয়েছিল। হঠাৎ একটা মোটা খিরিস গাছের ডাল এসে মাথায় পড়ে আর তখনই মারা যায় বেচারা। বছর চারেক আগে সাপের কামড়ে মা-বাবা দুজনেই মারা যায়। ভাইটাও এরকম ঝড়বৃষ্টিতে ডোবার জলে মরে পড়েছিল। এখন একা মেয়েটা কি করবে কে জানে’! রজতের বুকের ভিতরটা দুমড়ে মুচড়ে গেল। দু চোখ ছল ছল করে উঠল। কুসুমের কাছে সে-ও বোধহয় শহরের বাজে ছেলেদের মধ্যে একজন হয়ে উঠেছে। না এটা অন্যায়। এ ভুল সে কিছুতেই করতে পারে না। এই অসহায় অবস্থায় সে কিছুতেই তাকে ফেলে যেতে পাড়বে না। সে বোঝেনি যে, এই কদিন তার নাগালের মধ্যে দিয়ে ‘বউ কথা কও’ কতবার উড়ে গেছে। অথচ সে দেখেও দেখতে পায়নি। তার আর এক মুহূর্তের জন্যও তর সইছিল না। সে তড়িঘড়ি করে জামাকাপড় গুছিয়ে নিয়ে মাসিমাকে প্রণাম করে বেরিয়ে পড়ে। বলে – ‘আমাকে এখুনি যেতে হবে একটা জরুরি কাজ পড়ে গেছে।’মাসিমা তাকে দুমুঠো খাবার কথা বললে- সে বলে ‘পরে আবার একদিন আসব তখন না হয় খাব। সৌম্যকে বলে দেবেন যে আমি বউ কথা কও পাখির দেখা পেয়ে গেছি তাকে নিয়ে আজ সোজা কলকাতায় ফিরব।’ এই বলে সে ফাঁকা জমিটার ওপর দিয়ে দ্রুত পায়ে হাঁটতে হাঁটতে দূরে মিলিয়ে গেল।

No comments:

Post a Comment