Tuesday, April 30

গোবিন্দ তালুকদারের অণুগল্প




সাদাকালো


বিকেল থেকেই খাসিটা মাঠেই চরছিল, খাচ্ছিল ঘাস মনের আনন্দে। সন্ধে হলো। ধীরে ধীরে অন্ধকার এলো ঘনিয়ে কাজল মেখে।
নবানুর বৌ আদরি তার প্রিয় খাসিটাকে না দেখতে পেয়ে কাঁদতে শুরু করলো। স্বামীর তো হাট থেকে ফিরতে রাত হয়ে যাবে। কি করবে কে খুঁজবে!
ছেলেটা তো বড় হয়নি। মেয়েটা কোলে। খিদের জ্বালায় কাঁদছে। মায়ের বুকে মুখ দিয়ে আঠার মতো লেগে আছে। ঘ্যানরঘ্যানর দেখে ধপাস শব্দে বাচ্চাটাকে মাটিতে নামিয়ে রাখলো। চিলচিৎকার শুনে পাশের বাড়ির বৌ শোলোকমনি ধরমরিয়ে এলো ছুটে।
--- বেটিকোনাক্ কাঁদাছি কেনে?  শোলোকমনি কোলাত  নিল বেটিটাক। মেলায় আদর কইল্যে।
-- আর কহিস না। খাসিটো যে কুইন্যা গেইল! মোর ভাতার গেইছে হাটত্। আসি জানা পাইলে মোক বকা দিবে। বেঢঢাবা ধরিবে। মোর জিউকোনা ধরাসধরাস করিবা নাগিছে। এই আন্ধারত্ কোনপাকে যে যাম দিদি গে ! মোর আদরের খাসি।
মিশমিশে কালো রঙের খাসিটা। বেশ
তেলচুকচুকে চেহারা। ঘাড়ের কাছে  সাদা দাগ আছে ইঞ্চিখানেক।

হাট থেকে ফিরেই অঘটনের কথা জানতে পারলো নবানু। রাগে দুঃখে সে কাতর হলো। কীই বা করার আছে! খুঁজবে সকাল হলেই। খাওয়াদাওয়া মিটে গেলো। দু'মুঠ মুড়িমুড়কি খেয়েই শুয়ে পড়লো মশারি খাটিয়ে। চোপররাত নিন নাই চোখে। আধোঘুম জাগরনে মাঝেমাঝেই খাসীটার ডাক শুনতে পাচ্ছে। পাওয়া যাচ্ছেনা তার শরীরের বোঁটকা গন্ধ!  সব মায়া। খাসীটা তো ফেরে নি। সন্তানহারা শোক নবানু ও আদুরির মনে। খাওয়াদাওয়া বন্ধ। কুইন্যা গেলো! কেউ তাক কাটি খায়ি নেয়নি তো! চোরে চুরি করি পালায় নি তো! বিনিদ্র রাত এপাশ ওপাশ করেই  কাবার।  আকাশ ফর্সা হয়ে গেলো। বিহানবেলায় পান্তাপেঁয়াজ এক সানকি খেয়ে নবানু বের হলো অনুসন্ধানে।  ঠাকুরকে প্রণাম করে বললো, দয়াল ঠাকুর, মা কালী, হামার খাসিটো পাই যেন। ভোগ দিম মা তোক্। চোখে জল এসে যাচ্ছে। গামছা দিয়ে মুছে নিচ্ছে বারেবারে।  পীরসাহেবের মাজারে মনে মনে প্রণাম করে বললো, সিন্নি দেবার অঙ্গীকার করলো।

খাসিটা ঘুরতে ঘুরতে পাশের গ্রামে আস্তানা গেড়েছে মাধব মজুমদারের খলানে। কার খাসি কোন গ্রামের! মাধববাবুর নাতি ওকে গোয়ালঘরে ঠাঁই দিয়েছে। রাতে খানিক কাঁঠালপাতা চিবিয়ে খিদে নিবারণ করেছে। সকালে খলানে বাঁধা পড়েছে।  উদাসী দৃষ্টিতে চেয়ে আছে রাস্তার দিকে। ব্যা ব্যা করছে ব্যাকুল স্বরে।। মনে হয় বাড়ির কথা মনে পড়ছে খাসিটির। 

গ্রামের কয়েকজন ছেলে মন্তব্য করলো,  ফিস্ট করতে হবে। মাধববাবু বড় রসিক। কালো কুচকুচে নধর বটে খাসির শরীর! প্রশ্ন করলেন,  বলতে পারিস,  খাসিটির মাংস কয় কেজি হবে!  বলাই বললো,  কেজি দশেক তো বটেই। ফুট কাটলো তিলেখচ্চর ছেলে বল্টু। সে বললো,  আট কেজির বেশী হতেই পারেনা। মাধববাবু বুঝিয়ে বললেন,  আরে পাগলের দল। ফিতে নিয়ে আয়।  গলাটা মেপে দেখ। হিসাব বলে,  গলার বেড় যতো ইঞ্চি,  ঠিক ততো কেজি মাংসই হবে। মাংস দিয়ে তোদের  ভুচকি ভাত খাওয়ার ধান্দা নাকি রে!  বদমায়েশের দল!   হুকুম করলেন,  আলকাতরা দিয়ে গায়ের সাদা দাগটুকু  মিলিয়ে দে এখুনি।  তাহলেই এর চেহারাটা বিলকুল পাল্টে যাবে। ছেলেরা যথারীতি  তাই করলো। সাদারঙ মিলিয়ে গেলো আলকাতরার ছোপে। এবারে খাসিটা বিলকুল কুচকুচে কালো।  ছেলেরা তাজ্জব বনে গেলো তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায়। কী বুদ্ধি! চেহারায় পরিবর্তন এক্কেবারে। কালো কুচকুচে! দারুন ব্যাপার!

এপাড়া ওপাড়া খুঁজতে খুঁজতে নবানু এলো অবশেষে মাধববাবুর খলানে।  মাধববাবুকে বললো--  বাবু, আমার একটা খাসি পাছিনা। কুইন্যা যে গেইল! তোমরা কি দেখিছেন?
মাধববাবু বললেন,  কেমন খাসি! কতো বড়! রঙ কি!
----- খাসিটার দিকে আঙুল দেখিয়ে নবানু বললো, ঠিক এতোবড়ই খাসিটো বাবু। কাল থেকে পাওয়া যাছে না। ঘুরি ঘুরি বেজায় কাহিল হয়ি গেনু। সগার মন খারাপ।
---- যদি এটাই তোমার হয়, নিয়ে যাও।
----  হামার খাসিটার গলাত সাদা দাগ ছে বাবু।  এডা নহে বাবু। বিড়বিড় করে বললো, এটা নহে, কেনে কহিম এডাই হামার!

নবানু ধীর পদক্ষেপে নেমে এলো রাস্তায়। চিন্তায় ভাবনায় কিছু ভালো লাগছে না আর। হতাশার আগুন মনে।  আজ সারাদিন মাঠের কাজে যেতে পারলো না। বিশাল ক্ষতি।। দিনটা  বেগার গেলো। কামাইও হলোনা আজ।

সন্তান হারানোর ব্যথায়,অপ্রাপ্তির ধূসর আলোছায়ায়  বাড়ির পথে এগিয়ে চলেছে নবানু। হতাশার সুর বুকে নিয়ে। ফুঁপিয়ে কান্না নামলো প্রাণে। আপনমনে।

আদরি বসে আছে খাসিটার আগমনের পথ চেয়ে। বড় আদরের খাসি তার!
                     




No comments:

Post a Comment