Tuesday, April 30

শুভাশিস দাশের গল্প








সারপ্রাইজ

সকাল থেকেই আকাশের মুখটা ভার l কেমন একটা বিশ্রী পরিবর্তন ওয়েদারের
অবশ্য এখন এরকমই হয় কাল বৈশাখীর সময় তো !ছোটবেলায়ও  এমন হতো কিন্তু অকালবৈশাখী হতো না ! নিজের মনেই ভাবতে ভাবতে হাতের কাজ গুছিয়ে নিচ্ছিল সুমনা !আজ রবিবার কিন্তু হলে কী হবে ছুটি নেই রিপনের l কাগজের অফিস তার উপর ভোটপর্ব চলছে। ওদের রবিবার বলে কিছু নেই তবে রেস্ট আছে ! বেশির ভাগই কেন জানি রিপন রাতের শিফট বেছে নিচ্ছে ইদানীং !
অবশ্য কোনদিন রিপনের দায়িত্বের খামতি দেখেনি সুমনা ! ওদের বিয়ে হয়েছিল দেখে শুনেই ! বিয়ের আগে কেউ কারো মুখ দেখেইনি ! মিমি হবার পরই রিপন রাতের শিফটটে ডিউটি টা বেশি করে নিচ্ছে ! কী জানি !
কলিং বেলের শব্দে এগিয়ে গিয়ে সুমনা দরজা খুলল ,বললো -আজ এত দেরী করলে বড় ?

রিপন ঘরে ঢুকতে ঢুকতে উত্তর দিলো,  একটু কাজ ছিল তবে অফিসের না !

যাও রেষ্ট নাও আমি চা আনছি !
না না চা না ,এখন দশটা বাজে এরপর বাজারে কিছুই মিলবে না, বলে রিপন বাজারের ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে গেলো !

মিমির বয়সও দেখতে দেখতে তিনে পড়ল ! সংসারের খরচ বেড়েই চলেছে l সুমনার মনে হয় যদি সংসারের জন্য কিছু করতে পারতো l একবার প্রাইমারী স্কুলের ইন্টারভিউর কল লেটার এসেছিল ,পাড়ার পরি দা বলেছিল রিপন চিন্তা করিস না তোর বউয়ের চাকরিটা এবার করে দেব !পরিতোষ দত্ত ,ডাকসাইটে নেতা l কিচ্ছুই হয়নি উল্টে একটি সাব এডিটেরিয়াল পড়ে সম্পাদক মহাশয়কে রিপনের নামে কমপ্লেন করেছিল আসলে নেতারা চায় একটু তল্পি ধারক হোক লিখিয়েরা ! সবাই তো আর মাথা বেঁচে না আর রিপনের আদর্শ সুমনার অজানা নয় সে ভাঙ্গবে অথচ মচকাবে না l

দুপুরের খাবার টেবিলে বসে সুমনা বললো, কাল মিমির জন্মদিন মনে আছে তো ? কাল আবার রাতের শিফট  নিও না যেন !

ধুর !পাগল !আমার মায়ের জন্মদিন আর আমি রাতে ডিউটি করবো ?তোমার কি মনে হয় আমার কোন চেতনা নেই ?
রাতে ডিউটি কেন করি তা সময় এলেই টের পাবে !

রিপনের কথাগুলো শুনে সুমনা আবার বলতে শুরু করে, জানো, তোমাকে না এখন অবধি বুঝে উঠতে পারলাম না !কলেজ জীবনে শুনতাম লেখালিখির জগতের মানুষেরা একটু বোহেমিয়ান টাইপের হয় ! তুমি দেখছি সম্পূর্ণ উল্টো !

রিপন আর হাসি চেপে রাখতে পারলনা l
সুমনা বললো, হাসছো যে ?

তা হাসব না ! লিখলেই কী তাঁরা অগোছালো হয় ? আর আমি কী এমন লেখক ? করি তো একটা দৈনিক পত্রিকার আফিসে মাস মাইনের চাকরি !খবর লিখি আর দু চারটে ফিচার ! অবশ্য ছাত্র জীবনে কবি হবার ইচ্ছে ছিল কিন্তু সত্যি বলতে কি সেরকম কবিতা আজ অবধি লিখে উঠতে পারিনি !

সুমনা এবার বললো, হ্যাগো তোমাদের কাগজের অফিসে মেয়ে কর্মী নেই ?

হ্যাঁ ! আছে তো ! কেন সেদিন কাগজে দেখালে না সিএম এর ইন্টারভিউ ?
ওই সুতপা সরকারই তো আমাদের সুতপা দি ! উনি আমাদের অনেক সিনিয়র ! আমি তো ওনার কাছেই সমস্যা হলে যাই !
উচ্চ শিক্ষিতা আর খুব বিনয়ী ! একদম আমার বারাসাতের বড়দির মতো !

বাব্বা ! আমি অন্য কারণে বললাম আর তুমি একদম ইতিহাস শুরু করে দিলে !সুমনা বললো -বললাম আমাকে তোমাদের আফিসে নেবে না ? সম্পাদকের সাথে তোমার তো বেশ খাতির আছে শুনেছি !

রিপন প্রায় লাফ দিয়ে ওঠার মতো..বললো, তোমাকে ? না তুমি মিমিকে মানুষ করো তোমার মাথা থেকে চাকরির ভূত তাড়াও তো !

সুমনা বললো, তাহলে আমার এতগুলো ডিগ্রি কি কেবল ট্রাংকের ভিতর ঘুন পোকা কেটে যাবে সারা জীবন !

সে হবে ক্ষণ বলে উঠে পড়ল রিপন !


আজ ঘনঘন লোডশেডিং হচ্ছে অবশ্য আফিসে তা টের পাবার উপায় নেই l রাত বারটা বাজে ! প্রবল ঝড় শুরু হলো l কোথাও ভয়ংকর আওয়াজ করে বাজ পড়ল ! অফিসের লাইটটাও হঠাৎ নিভে গেলো কিন্তু নীচে তো জেনারেটর চলছে !রিপন হাতড়ে টেবিলে রাখা মোবাইলটা নিয়ে আলো জ্বাললো কিন্তু এরকম কখনো হয়নি উপরের পুরোটাই আলো হীন হয়ে এক ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো l কাগজ রেডি l পাশের টেবিলের মলয়দা সবে কালকের কাজ সেরে মাথা টেবিলে রেখেছেন ! হুড়মুড় করে উঠে বললো, রিপন কী হলো ?

রিপন বললো, দাদা বাইরে দুর্যোগ ! আলো নিভে গেছে !

তা নাইট গার্ড নরেশ কে ডাকো !

নিচে তো সব ঠিকঠাক চলছে ! রিপন ফোনে নরেশ কে ডাক দিলো l

নরেশ এসে রিপন কে বললো, পাশেই বাজ পড়েছে দাদা ! হয়তো আমাদের উপরের সার্কিটে কোন ফল্ট হয়েছে।  আমি নীচ থেকে ইমার্জেন্সি লাইনটা দিয়ে দিচ্ছি !

কাগজের অফিস আলো ছাড়া চলবে না দু তিন রকমের ব্যবস্থা আছে l
ভাগ্যিস মেশিন ঘরের ফল্ট হয়নি নইলে কালকের কাগজ তো মার খেয়ে যেতো l
মিনিট দশেক অন্ধকার ! যেন ভূতপুরী !
বাইরের ঝড়ের দাপট একটুও কমেনি l আলো চলে এলো ! নরেশও এলো l
নরেশ বললো, দাদা আজ আর পড়ব না !বাইরের যা অবস্থা তার উপর কাগজ রেডি হতে সময় নেবে তো !

তা তুই কি কাগজ রেডি করবি ?

হঠাৎ সুমনার ফোন এলো, রিপনের বুকটা কেমন করে উঠলো। এই ঝড় বাদলের রাতে একা একা ছোট্ট মেয়েকে নিয়ে থাকে !

অপর প্রান্ত থেকে ভেসে এলো -ঠিক আছো তো ?
হ্যাঁ তোমরা ?
ঠিক আছি ! ঝড়ের গতি বড় মারত্মক মনে হচ্ছে ! সুমনা বললো l
সাবধানে থেকো !শুভ রাত্রি !

রিপন ফোন রাখতেই নরেশ জিজ্ঞেস করলো বৌদিমণি ?

হ্যারে ! একা বাচ্চা নিয়ে থাকে !এই ঝড় বাদলের রাত একটু তো ভয় পাবে তারউপর বাড়ির মালিকরা আজ সকালেই দিল্লি গেছে !

রিপন বললো -কালকের পড়া হয়েছে ?
নরেশ উত্তর দেয় -হ্যাঁ ! তবে ভালো হয়নি !ঠিক আছে কাল তাহলে পুরো চ্যাপ্টার টা দিবি ! মনে থাকবে ?

নরেশ মাথা নেড়ে চলে যায় !

ফ্লাস্ক থেকে চা ঢেলে নিজে এককাপ আর মলয় দার দিকে এককাপ এগিয়ে দেয় রিপন l

এক চুমুক দিয়েই মলয় বোস বলে বসে আচ্ছা রিপন তুমি নরেশ কে কী পড়াচ্ছ গো ?রোজ রাতে কাজের শেষে কী সব বুঝিয়ে দাও ?শুনেছি ওতো ম্যাট্রিক মাস করেছে ?

রিপন বলে -না গো দাদা ও বি এ  পাশ !নকশাল আন্দোলনের সময় পুলিশের খাতায় লাল দাগ পড়েছিল তাই চাকরি হয়নি সরকারি আফিসে তবে আমাদের অফিসে আসার আগে ও কাগজের সম্পাদক কে সব খুলেই বলেছিল l বিভাস দা আপত্তি করেনি !তবে দেখেননি অনেক সময় ও আমার পাশে বসে খবর এডিটিং করছে ?

ওর ইচ্ছে প্রাইভেটে এম এ  দেবে তাই দেখিয়ে নেয় !

ও তাই তো তুমিও তো সেটা পাশ করা !
আর কী !কপালে যা লেখা থাকে তার বাইরে কেউ যেতে পারে না বুঝলেন দাদা ?

মলয় বাবু বললেন -তুমি ভাগ্য বিশ্বাস কর ?

হ্যাঁ !একশ ভাগ !রিপন উত্তর দেয় l জানেন ভাগ্য না সহায় হলে কেউ এক চুল নড়তে পারে না আর এর প্রমাণও আছে ভুরি ভুরি !

ভোরের পাখিরা ডাকছে !দু চোখ কচলে নিয়ে রিপন বললো, কাল তো দেখা হচ্ছে না মলয় দা !

মলয় বাবু বলেন, কেন ?
আমি একটু ইমার্জেন্সি ছুটি নিয়েছি একদিনের !

কী আছে ?
আর বলবেন না ....কাল আমার মেয়ের জন্মদিন ! গিন্নি আগেই হুঁশিয়ারি দিয়ে রেখেছে ! আর কিছুই না ! এদিন টা বাড়িতে থাকা আর কি ! ওই ঘুপচি একটু ভাড়া বাড়ি !


আজ" ভোরবেলা "দৈনিকের জন্মদিন !অফিসে অনুষ্ঠান আছে রিপন জানে আজকে একটা সারপ্রাইজ আছে সবার জন্য ! সন্ধ্যায় সবাই এলো অফিসের হল ঘরে ! আজ প্রধান সম্পাদক অমরেশ সেন আসবেন কলকাতা থেকে l

যথা সময়ে অনুষ্ঠান শুরু হলো l হল ভর্তি কাগজের কর্মী দিয়ে l নরেশ আগেই হিসেব করে প্যাকেট আনিয়ে রেখেছিল ,এসব কথা কেবল রিপন এবং সম্পাদক মহাশয়  জানত।

অনুষ্ঠান শুরু হলো l ভাষণ পর্বে অমরেশ সেন বলতে উঠলেন l উপস্থিত সবাইকে কাগজের অগ্রগতির জন্য অকুণ্ঠ ধন্যবাদ জানালেন l এইবার সেই সারপ্রাইজ !অমরেশ সেন নরেশ কে স্টেজে ডাকলেন l রিপনের চোখ দুটো চক চক করে উঠলো কেননা নরেশের এই সাফল্য যে কিছুটা তারই জন্য l অমরেশ সেন বললেন, নরেশ আমার নাইট গার্ড পদে থেকেও কাজের ফাঁকে পড়াশুনা করে আজ এম এ পাস করেছে l ওর যোগ্যতা কে মূল্য দিয়ে আমি কাল থেকে ওকে আমাদের সাব এডিটর পদে নিয়োগের নির্দেশ দিলাম আর ওর এই সাফল্য যাঁর জন্য তিনি আমাদের রিপন ল

হল ঘর করতালিতে মুখর হয়ে উঠলো l
নরেশ কিছু বলতে গেল ....কিন্তু ওর গলা ধরে এলো। রিপন পকেট থেকে রুমাল বের করে চোখের কোণে স্পর্শ করল l

No comments:

Post a Comment