Tuesday, April 30

দেবাশিস দে'র অণুগল্প








মুখে আগুন

আমার অবিবাহিত মেজ দাদুর কথা বলছি। সারা জীবন শুধু চিন্তাই করে গেল – এত টাকা রোজগার করছি , খরচ করছি কিন্তু শেষ সময়ে আমার মুখে আগুন কে দেবে !! দাদুর সঙ্গে কথা বলতে গেলে কিছুক্ষণ কথা চলার পর দাদুর সেই চিন্তা কথার মাঝ খানে ভাগ বসাতে চলে আসতো। আমরা অনেকেই মজা করবার জন্য বলতাম – আমরা সবাই মিলে আগুন দেব দাদু। দাদু বলত তোরা মুখেই বলছিস কাজের সময় তোদের টিকিও খুঁজে পাওয়া যাবে না। বোঝাতাম যতক্ষণ বেঁচে আছো ততক্ষণ জীবনটাকে ভালো ভাবে উপভোগ কর।  মারা যাওয়ার পর দেখবে একজন ঠিক যোগাড় হয়ে যাবে মুখে আগুন দেবার জন্য। তখন খুব খারাপ লাগত মানুষের এই অদ্ভুত পাগলামির কথা ভেবে -  সুন্দর শরীর।  সুন্দর মুখ, কত প্রসাধনী দিয়ে তাকে নিখুঁত করার চেষ্টা অথচ মারা গেলে তাতে আগুন দিয়ে নষ্ট করার কি প্রক্রিয়া। আর মজার কথা মানুষের সন্তানের আকাঙ্কাও এই অন্তিম কালের মুখাগ্নির জন্য।

       আজকের দৃশ্যটা দেখে দাদুর কথা খুব মনে হচ্ছে । দাদুর সময় যদি এমন জিনিস থাকত - দাদু বোধহয় নিশ্চিন্তে মরতে পারতেন। মানে এত-চিন্তা করতে হত না।  আর এটা হলে  দাদুর মুখে নিশ্চয় তৃপ্তির হাসি দেখতে পেতাম।

       আজ দুপুরে একটা অন্নপ্রাশন বাড়িতে আমার নিমন্ত্রণ ছিল । বেশ ভালো খাওয়া  দাওয়া হল।  বুফে সিস্টেমে খাওয়া।  ফিস ফ্রাই, কাতলা মাছের ঝাল, পেল্লাই সাইজের গলদা চিংড়ি, পোলাও, চাটনি, পাঁপড় পায়েস, রসগোল্লা সব এক এক পেটে সংগ্রহ করতে লাগলাম। শেষে আইসক্রিমও ছিল। কিন্তু পান নেই বা পানের মশলা নেই। বাড়িতে পান খাওয়ার  অভ্যাস নেই। কোনো অনুষ্ঠান বাড়িতে গেলে একটা মিষ্টি পান পাওনা থেকেই যায়। কিন্তু এখানে না  আছে পান না আছে পান-মশলা। একটু কিন্তু কিন্তু লাগছিল। হঠাৎ দেখি বুফে কাউন্টারের উল্টোদিকে ছোটো একটা ঘরের মধ্যে  বিশাল লাইন। ঘাবড়ে গেলাম এ আবার কি  আজকাল কি অনুষ্ঠান বাড়িতেও - ‘এখানে নতুন আধার কার্ড হইতেছে’ – জাতীয় কিছু চালু হয়েছে নাকি ? উঁকি ঝুঁকি দিয়ে চোখ খুব একটা সুবিধা করতে পারল না। এগিয়ে  গেলাম ব্যাপারটা  বোঝা দরকার ‘ওই পড়তে হয়, নাহলে পিছিয়ে পড়তে হয়’ গোছের কৌতূহলী চোখ নিয়ে লাইনের মাঝে একজন একটু বোকা বোকা লোক দেখে সাহস করে জিজ্ঞাসা করলাম – এটা কিসের লাইন দাদা ? ভদ্রলোক আমাকে বলল এখানে না ওই যে শেষে লাইন দিন। আরে যে জিনিসটা জানেইনা  সে কেন বেলাইনের সুবিধা নেবে ? লাভ হল না, অগত্যা দু’জন পরের এক ভদ্রমহিলাকে জিজ্ঞাসা করলাম যদি কিছু মনে না করেন এটা কিসের জন্য লাইন যদি বলেন – ভদ্রমহিলা আমার মাথা থেকে পা পর্যন্ত একবার দেখে নিয়ে একটা বোর্ডের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করল – আমি তাকিয়ে দেখে অবাক ‘ফায়ার পান’।  ব্যাস  পায় কে আমায়, ঠেলে ঠুলে একবারে  সামনে। পান খিদে পরিত্যাগ করে মোবাইলে প্রথমে ছবি পরে ভিডিও তুলতে লাগলাম । দেখলাম আমার মতো আরো তিনজন  মোবাইলে  ছবি তুলছে। পান কর্তা মিষ্টি  পাতায় বিভিন্ন মশলা দিয়ে সম্ভবত তাতে কর্পূর দিয়ে আগুন ধরিয়ে পানটা ভাঁজ করে একেক জনের মুখে আগুন সমেত ঢুকিয়ে দিচ্ছে। এইভাবে একের পর এক আগুন পান দিয়ে যাচ্ছে ।

       জীবিত অবস্থায় মুখাগ্নির এই অভিনব পদ্ধতি আমার অবিবাহিত মেজদাদুর  সময়ে থাকলে দাদু কতই না তৃপ্তি পেতেন। যদিও আমার মেজদাদুর  মৃত্যুর পর অনেকেই ওঁর  মুখাগ্নি করতে চেয়েছিল,  কিন্তু সেজদাদুর  ছোটো ছেলে ঐ প্রতিযোগিতায় জিতেছিল।

No comments:

Post a Comment