Friday, December 27

নীহারুল ইসলাম : যে গল্পটি আমাকে গল্প লিখতে উসকে ছিল






নীহারুল ইসলাম
যে গল্পটি আমাকে গল্প লিখতে উসকে ছিল

 
সাহিত্য পড়ার নেশা সেই স্কুলজীবন থেকে। এই নেশা আমি পেয়েছিলাম আমার আব্বার কাছ থেকে। তাঁর একটি ছোট সংগ্রহ ছিল। ‘রামায়ণ’, ‘মহাভারত’, ‘ইলিয়াড-ওডিসি’, ‘মধুসূদন রচনাবলী’, ‘রামমোহন রচনাবলী’, ‘দীনবন্ধু রচনাবলী’, ‘সৈয়দ মুজতবা আলী রচনাবলী’, কবি বিমলচন্দ্র ঘোষের অনুবাদে ‘খৈয়ামের রুবাইয়াৎ’, সেক্সপীয়ারের ‘রচনাসমগ্র’, ম্যাক্সিম গোর্কির ‘মা’, ইংরেজি কবিতার বিখ্যাত সিরিজ ‘GOLDEN TRESARY’, John Millington Synge-এর বিশ্ববন্দিত একাঙ্ক  ‘Riders to the Sea’, ‘সহস্র এক আরব্য রজনী’, বঙ্কিমচন্দ্র, শরৎচন্দ্র এবং  অবশ্যই ‘রবীন্দ্র রচনাবলী’ ছাড়াও আলাদাভাবে ছিল ‘সঞ্চয়িতা’ এবং ‘গল্পগুচ্ছ’। আরও আরও কত  বই! তার মাঝে ওই রবীন্দ্রনাথের ‘গল্পগুচ্ছ’ ও ম্যাক্সিম গোর্কির ‘মা’  ছিল আমার সবচেয়ে প্রিয় গ্রন্থ। স্কুল ছেড়ে কলেজে উঠে কবিতা লেখার চর্চা করলেও আমার প্রথম প্রেম ছিল ছোটগল্পকে কেন্দ্র করেই। রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প তো ছিলই। সঙ্গে ছিল জাতকের গল্প। পাশাপাশি সমকালের লেখকদের গল্প। ‘দেশ’, ‘কথাসাহিত্য’, ‘রবিবাসরীয় আনন্দবাজার’-এর গল্প। তাছাড়াও শারদ সংখ্যার গল্প কতক্ষণে পড়ে শেষ করব তা নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে রীতিমতো প্রতিযোগিতা চলত। আমার বিকেল কাটত লাইব্রেরিতে। যেখানে মোঁপাসা, হেমিংওয়ে, মার্ক টোয়েন ছাড়াও রাশিয়ান বিখ্যাত সব লেখকদের ছোটগল্প অনুবাদে পড়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। কিন্তু কবিতা-চর্চা ছেড়ে আমি যে গল্প লিখব, এমন ভাবনা স্বপ্নেও ছিল না।

আমি যে খুব পড়ি এটা আমার এই গঞ্জশহরে অনেকেই জানতেন। একদিন আমাদের লালগোলা বিডিও অফিসের বড়বাবু মানিকদা হঠাৎ একদিন আমাকে ধরে বললেন, নীহারুল- তুমি তো খুব পড়। আমাদের রাজ্যসরকারী কর্মচারীদের একটি মুখপত্র নিয়মিত প্রকাশিত হয়। যার শারদ সংখ্যা সদ্য প্রকাশিত হয়েছে। যদি একটি কপি নাও!

আমি বললাম, দেবেন।

সেদিন সন্ধ্যাতেই তিনি পত্রিকাটি আমাকে দিয়ে গেলেন। পত্রিকার নাম ‘সমন্বয়’। শারদ সংখ্যাটি সাজানো হয়েছে খুব সুন্দর ভাবে। কবিতা, প্রবন্ধ এবং ছোটগল্প। আগেই বলেছি সাহিত্যে আমার সবচেয়ে প্রিয় ধারাটির নাম ছোটগল্প। তো, সেখানে প্রথম যে গল্পটি পড়লাম তার নাম ‘শকুন’। লেখকের নাম হাসান আজিজুল হক।
গল্পের শুরুটা এরকম- “ কয়েকটি ছেলে বসে ছিল সন্ধ্যার পর। তেঁতুলগাছটার দিকে পিছন ফিরে। খালি গায়ে ময়লা হাফশার্টকে আসন করে। গোল হয়ে পা ছড়িয়ে গল্প করছিল। একটা আর্তনাদের মতো শব্দে সবাই ফিরে তাকাল। তেঁতুলগাছের শুকনো ডাল নাড়িয়ে, পাতা ঝরিয়ে সোঁ-সোঁ শব্দে কিছু একটা উড়ে এল ওদের মাথার ওপর। ফিকে অন্ধকারের মধ্যে গভীর নিকষ একতাল সজীব অন্ধকারের মতো প্রায় ওদের মাথা ছুঁয়ে সামনের পড়ো ভিটেটায় নামল সেটা।”

শুরুর এটুকু পড়ে আমি চমকে উঠলাম। কেন-না, আমি নিজেই তেঁতুলগাছের পাশে খালি গায়ে হাফশার্টকে আসন করে বসে থাকা ওই কয়েকটি ছেলেদেরই একজন। শৈশব-কৈশরে যে বন্ধুদের সঙ্গে আমি এরকম অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছি বহুবার। প্রসঙ্গত বলে নেওয়া ভাল, আমার শৈশব-কৈশর কেটেছিল মাতুলালয়ে। সেটা রাঢ়ভূমির সাগরদিঘী থানার হরহরি গ্রাম। তখন গরু মরে গেলে মাঠে ফেলে দেওয়াটাই ছিল নিয়ম। চর্মকার সম্প্রদায়ের মানুষেরা সেই মৃত গরুর চামড়া ছাড়িয়ে নিয়ে যেত দু’পয়সা উপার্জনের আশায়। তারপর কোথা থেকে খবর পেয়ে মরা গরুর মাংসের লোভে প্রচুর কাক-শকুন-কুকুর এসে জড় হতো সেখানে। আর আমরা জড় হতাম সেই এক-দেড় দিনের পশু-পক্ষীদের লড়ালড়ি করে ভোজ খাওয়া দেখার জন্য। যেটা ছিল আমাদের কাছে খেলা দেখার মতো একটা ব্যাপার। শুধু তাই না, আমরা অপেক্ষা করতাম আর একটা কারণে, সেটা হল- কুকুরের সঙ্গে লড়ালড়ি করতে গিয়ে শকুনের খসে পড়া পালক কুড়নো। যা দিয়ে আমরা তীর বানাতাম আদিবাসী ভাই-বন্ধুদের সঙ্গে শিকার-উৎসবে যোগ দেব বলে। এবং শেষমেশ আমরা যে খেলাটা খেলতাম তা হল, দলের সেই একটি-দু’টি বৃদ্ধ শকুন যারা বেশি খাওয়ার ফলে উড়ে নিজের আস্তানায় ফিরে যেতে পারত না, তাদের মাঠ মাঠ তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ানো।

হাসান আজিজুল হকের ‘শকুন’ গল্পটি পড়ার আগে ব্যাপারটা আমার স্মৃতি-কোঠায় খেলা হিসেবেই গচ্ছিত ছিল। কিন্তু সেটা যে এতটা নিষ্ঠুর-এতটা নির্মম ছিল, তা কখনও বুঝতে পারিনি। যদিও কখনও রফিক হয়ে, কখনও জামু হয়ে, কখনও বা এদাই হয়ে কিংবা কখনও পল্টু হয়ে এক বৃদ্ধ শকুনকে বাগে আনতে নিজের দৈনন্দিন জীবনের দুঃখ, কষ্ট, রাগ, দ্বেষ, আক্রোশ দেখাতে দেখাতে ‘আল টপকে টপকে, উঁচুনিচু জমির উপর দিয়ে ক্ষতবিক্ষত মনে আর দাগরা ঘায়ে, শেয়ালকুল আর সাঁইবাবলার বনে, লম্বা শুকনো ঘাসে, পগারে, সাপের নিশ্বাসের মতো ফাটা মাটির উষ্ণ ভ্যাপসা হাওয়ায়, আখ আর অড়হর-কাটা জমির বল্লমের মতো ছুঁচলো সরল গুঁড়ির আক্রমণে ও আর্তনাদে, একটা মাটির ঢেলার মতো গড়িয়ে, শক্তির বেদনাবোধের অতীত অবস্থায়, আচ্ছন্ন চেতনাহীন তন্দ্রার মধ্যে’ আমিও যেন চলতে চলতে হঠাৎ এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে উঠছিঃ
‘কত তারা উঠেছে দ্যাক।’
‘কিন্তুক আলো তো হচে না।’
‘চাঁদ নাইকো যি।’
‘বাতাস দিচে লয়রে?’
‘দিচে, তা শালার গরম বাতাস।’
‘আমার কিন্তুক জাড় লাগচে।’
‘তোর ভয় লেগেচে।
‘কতদূর  এ্যালোম র‍্যা?
‘উরে সব্বোনাশ, মাঝমাঠে এসে পড়িচি, মানুষমারীর মাঠ যে র‍্যা!’

যে-গল্প পাঠ শেষে আমাকে মানুষমারীর মাঠে দাঁড় করিয়ে দেয়, কিছু ভাবতে শেখায়, এমনকি খেলা শেষ করে ‘গাঁয়ে ঢুকতেই এপাশে তালগাছ ওপাশে ন্যাড়া বেলগাছের যে ছোট তোরণটি আছে তারই আবছা ছায়ায় শাদামতো কী’ দেখি, এবং সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারি ‘উ হচে জমিরুদ্দি আর কাদু শ্যাখের রাঁঢ় বুন’, সেই গল্পের লেখক কে, জানতে কৌতুহল হয়। খুব জানতে ইচ্ছে করে, কোথায় তাঁর বাড়ি? তিনি কোথায় থাকেন? কী করেন?

খোঁজ শুরু করি এবং জানতে পারি তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান। দর্শনের অধ্যাপক।

বিদেশ হলেও রাজশাহী আমার বাড়ির পাশেই। শুধু পদ্মা পেরোতে হবে। আমি পদ্মা পেরিয়ে গিয়ে হাজির হই সেই লেখকের কাছে। জিজ্ঞেস করি, আপনার ‘শকুন’ গল্পের পটভূমি রাঢ়ভূমি। অর্থাৎ ভাগীরথীর পশ্চিমপাড়। যেখানে আমার শৈশব-কৈশর কেটেছিল। আর আমি এখন যেখানে থাকি সেটা বাগড়িভূমি। আর আপনি যেখানে থাকেন সেই রাজশাহী হল পদ্মাপাড়ের বরেন্দ্রভূমি। তাহলে বরেন্দ্রভূমিতে বসে রাঢ়ভূমির পটভূমিতে এমন গল্প লিখলেন কী করে? প্রত্যক্ষ যাপন ছাড়া কি এমন গল্প লেখা সম্ভব?

আমার প্রশ্ন শুনে হাসান আজিজুল হক হাসছেন। আর আমি বলে চলেছি, আপনার ‘শকুন’ গল্পের চরিত্র, সংলাপ সব আমার চেনা। শুধু তাই না, এই গল্পের এক একটি চরিত্র যেন আমি নিজেই!
অবশেষে হাসান আজিজুল হক মুখ খুললেন। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, রাঢ়ভূমির কোথায় কেটেছিল তোমার শৈশব-কৈশর?
বললাম, সাগরদিঘী থানার হরহরি গ্রাম। মামাবাড়িতে।

তারপর তিনি যা বলেছিলেন তা হল, আদতে তিনি রাঢ়ভূমির মানুষ। বর্ধমানের যবগ্রামে তাঁর জন্ম-বেড়ে ওঠা। তাছাড়াও আমার মামার বাড়ির পাশেই একটি গ্রামে ছিল তাঁর দিদির বাড়ি। সেখানে নিয়মিত এসে থাকতেন তিনি। দিদির খুব কাছ-লাগা ছিলেন। আশপাশের গ্রামে ফুটবল খেলে বেড়াতেন। এমন কী, আমার মামার গ্রামের ফুটবল মাঠেও তিনি ফুটবল খেলেছেন।

আমি আমার প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গিয়েছিলাম। আর সেদিনের পর বাংলা সাহিত্যের কিংবদন্তী লেখক হাসান আজিজুল হক আমার শুধু অতি অন্যতম প্রিয় লেখক হয়ে ওঠেননি, কখন কিভাবে আমার অতি প্রিয় দাদা হয়ে উঠেছেন তা ভাবতেই গর্ব অনুভব করি। 
 

No comments:

Post a Comment