Thursday, May 2

বিশ্বজিৎ ধরের গল্প



সংসার


রান্নাঘরের উত্তর কোণের বাঁশের খুঁটিতে টিকটিকিটি ‘ঠিক ঠিক’ শব্দ করেই চলেছে। দুপুরবেলা অনিল রায়  আর তাঁর বড়ো ছেলে বীরকান্ত দাগলাকুরার ট্যাংরা মাছের ঝোল দিয়ে বেশ আনন্দেই খেয়ে যাচ্ছে। আজ সকাল থেকে প্রায় ঘন্টা তিনেকের পরিশ্রমে বীরকান্ত তাঁর সমবয়সী বন্ধুদের সাথে গিয়ে প্রায় কেজি দেড়েক ছোট বড়ো ট্যাংরা, পুঁটি, খলসে, পয়া ধরেছিল। বন্ধুদের কাছে আবদার  করে বীরকান্ত ট্যাংরা মাছগুলিকেই বাড়িতে নিয়ে আসে। কেননা এই মাছ যে তাঁর বাবার খুব পছন্দ।
 
অনিল রায় কেদারপুর গ্রামের একজন সামান্য চাষি। সম্পত্তি বলতে বিঘে দুই জমি আর বাস্তু ভিটে। বছর দুই আগে নিজের একমাত্র কন্যার বিবাহের ঋণ তাঁকে এখনও ভাবায়। স্থানীয় এক পরিচিত সম্পন্ন গৃহস্থ সুশীল রায়ের কাছে তাঁর যেতে এখন লজ্জা করে। অনিল ভেবেছিল এবারের ধান বিক্রি করে সে সুশীল রায়ের ঋণ মেটাবে। ধানগাছ যে ভালো চেহারার হয়েছিল তাতে সন্দেহ ছিল না। কিন্তু ছোটো ছেলে হরির প্রাইভেট খরচ আর স্ত্রীর অসুখেই ঘরের লক্ষ্মী আর ঘরে থাকেনি।

টিকটিকির ‘ঠিক ঠিক’ শব্দ শুনে খেতে বসেও আশায় বুক বাঁধে অনিল । স্ত্রী ময়নাকে  আরও  দুই হাতা ভাত আর একটু ট্যাংরা মাছের ঝোল দিতে বলে বলে ওঠে— ‘এই সন হইবে... দেনাও মেটামো আর থাকার ঘরটাতও সিমেন্টের খুঁটি লাগামো।’ ময়না স্বামীর কথা শুনে বেশ খুশিই হয় কিন্তু ভাবে , ‘তায় য্যান হয়... মুই মঙ্গল বার কালী বাড়িত  যায়া মা’ক ফুল বাতাসা মানদ করি আসিম যে হামার তামাক য্যান ঘরত আইসে।’
ময়না তাঁর স্বামীকে বলে, ‘হরিক বোল ম্যাট্রিকের পর টাউনোর স্কুলত ভরতি করিম।  উয়ার দাদু কইছে বইপত্র যা নাগে দিবে। তোমরা খালি ইস্কুলের জামা টেইলারের টে কয়া বানে আনেন। পাইসার কথা কইলে কন তামাক বেচি দেমো এলায়।’

হরি গ্রামের স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র। সংসারের অবস্থা সে জানে। পড়াশুনার ফাঁকে ফাঁকে গ্রামের ভিভিন্ন হাটে  হাটে কাচা লঙ্কা আর কিছু সব্জী বিক্রি করে যা লাভ হয় তা সে বাবার হাতে  দিয়ে দেয়। তাঁর ইচ্ছা বড়ো হয়ে গ্রামের রতন দাদার মতো বি. এড করে মাস্টারি চাকরি করবে। বাবাকে সে তাই প্রায়  সবসময় বলে বসে— ‘ ও বা, মুই বোল কলেজ পাশ করি বি এড-ওত ভরতি হইম।’ 

ভরা ফাল্গুনের দুপুরের রোদ যেন বৈশাখকেও হার মানায়। তবে এই রোদ কিন্তু অনিলের মনে খুশির আমেজ নিয়ে আসে। ভোর থেকে গামছা গলায় নিয়ে বার বার এসে তামাক খেতটাকে চোখের দেখা দেখে যায়। সকাল থেকে সামান্য জ্বরে শরীরটা দুর্বল লাগলেও অনিল ভরদুপুরে সবুজ তামাক খেতের ভেতর বসে অপ্রয়োজনীয় তামাক পাতাগুলি গাছের দেহ থেকে  ছিন্ন করে দেয়। তাঁর যে আর তর সয় না। খালি দিন গোনে আর ভাবে, ‘ এলাও যে তামাকের পাত বারতি না হয়। শিবমেলার হাট আর দুইটা পড়ি আছে। সামনে হাটত না নিবার পালে দাম কি আর পাওয়া যাইবে।’ এইসব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে অনিল আজ দুই ঝুরি গোরার দিকের তামাক  পাতা কেটে নিয়ে আসে। খুব ভালো যে শুকাবে, তা নয়। কিন্তু একটু সময় নিয়ে কষ্ট করে বেঁধে নিতে পারলে দামটা সে মন্দ পাবে না।

পড়ন্ত রোদের বিকেলে অনিল ও তাঁর পরিবার মিলে তামাক পাতা বাঁধতে বসে যায়। পাতা  যে পরিপুষ্ট হয়নি সেটি বাঁধতে বসেই সকলে বুঝতে পারে। বিষ খাওয়া রোগীর মতো পাতার   মুষড়ে পড়া দেখে স্ত্রী ময়না ক্ষেপে গিয়ে স্বামীকে বলে, ‘ এইল্যার কি আর দাম পাইবেন। দেওয়ার যে অবস্থা। কাইল যদি অইদ না হয় তো পাতা তো পচি  গোবর হয়া যাইবে।’

আকাশের বিচিত্র অবস্থাকে অনিল এবং তাঁর পরিবার ভীষণ ভয় পায়। তিল তিল করে বড়ো হয়ে ওঠা তামাক গাছের জন্য চিন্তায় তারা অস্থির হয়ে ওঠে। পাতা না শুকালেও আর সপ্তাহ খানেক হলেই পাতা পরিপুষ্ট হয়ে উঠবে। তখন আর তাদের কোনো চিন্তা থাকবে না।
হঠাৎ করে সমস্ত আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে যায়। আকাশের ভয়ঙ্কর ডাকাডাকিতে অনিল আর  তাঁর স্ত্রী পাগলের মতো হয়ে ওঠে। এই ডাক যে তাদের বহুকালের চেনা ডাক। ভর সন্ধ্যার কিছু আগেই আকাশের ডাকাডাকির মধ্যেই অনিল রায় মস্ত ঝুরি হাতে তামাক খেতের দিকে হাঁটা  শুরু করে। ছোটো ছেলে হরি বাড়ির উঠোন থেকে ডাকতে থাকে, ‘ ও বা.... চলি আয়। দেওয়ার ডাক ভাল নোয়ায় রে এ এ এ ।’
ইতিমধ্যে টপ টপ করে বড়ো বড়ো বৃষ্টির ফোঁটা পড়তে থাকে। ময়না বাড়ির হাঁস-মুরগির জন্য খাঁচা আর বকনা গোরুটাকে রান্না ঘরের পাশের একচালাতে বেঁধে রেখে স্বামী অনিলের উদ্দেশ্যে বের হয়ে যায়। পাশের বাড়ির কাকি শাশুড়িকে দেখে সে শুধু বলে ওঠে, ‘ মানষিটা কথাও না শুনে। দেওয়ার বর্ষনে কাও তামাক পাত কাটে বায়...’   এদিকে বড়ো বড়ো বৃষ্টির ফোঁটার সাথে শুরু হয় বড় বড় শিলা বৃষ্টি। অনিল পাগলের মতো  নিজের খেতের তামাকের পাতাগুলিকে আগলে রাখতে চেয়েও পেরে ওঠে না। হাতের কাটারী যেন মেশিন হয়ে উঠেছে। ছিদ্র ছিদ্র পাতাগুলিকেই যেন কাটারি দিয়ে কেটে ঝুরি ভর্তি করে। বৃষ্টির ধারা বৃদ্ধি পেয়ে পাতাগুলি যেন দলা পাকিয়ে যাচ্ছে। অবুঝ অনিল তবুও তামাক পাতা কাটাতে বিরাম দেয় না। শিলাবৃষ্টিতে শত ছিদ্র হয়ে চলেছে অগুনতি তামাকের পাতা। প্রকৃতির কাছে হার না মানা অনিল রায় বুঝে উঠতে পারছে না কেনই বা পাতাগুলি রক্তাক্ত হয়ে ক্রন্দন শুরু করেছে। দূর থেকে হরির কান্নামিশ্রিত আওয়াজ ভেসে আসে, ‘ ও বা, মুই টাউনের ইস্কুলোত পড়িম না। ও বা , চলি আইসেন, হামা বাঁচিবার চাই...।’ 


2 comments: