Thursday, December 26

তন্বী হালদারের অণুগল্প : পাষাণ কন্যার কথকতা






তন্বী হালদার
পাষাণ কন্যার কথকথা


শুনেছিলাম, কার যেন অভিশাপে আমি পাষাণ হয়ে যাব বলে, বহুদিন আগেই টেলিকাস্ট হয়ে গিয়েছিল। প্রথমটা গুজব বলে কান দিই নি - ভেবেছিলাম এমনটা তো কতই হয়। যে মহিলার গর্ভে ভ্রূণ হয়ে গুটিসুটি মেরে যখন ছিলাম তখন শুনেছিলাম সেই মহিলা খেদোক্তি করছেন – ও যদি ভূমিষ্ঠ হয়ে পাষাণ হয়েই যায় তাহলে জন্ম দিয়ে কী লাভ? ঐ মহিলার স্বামী যিনি পাবলিকলি আমার পিতা বলে স্কুলের খাতায় নাম লেখা আছে, তিনি বললেন – থাক্‌ তবুও .........। এখন তো নানারকম আধুনিক চিকিৎসা বেরিয়েছে যদি কিছু ব্যবস্থা করা যায়! এরপর যা হয় আর কি – পাষাণ, পাষাণ, পাষাণ কন্যার নামের পাশে থাকে লজ্জা, ঘেন্না, অবহেলা, অত্যাচার, লাঞ্ছনা, অপমানের সমস্ত রকম যতিচিহ্ন। ঐ মহিলা আর তার স্বামীর প্রবল ক্ষোভে এতগুলো থেরাপি দেওয়া হচ্ছে তবু পাষাণ জেগে ওঠে কই?
স্কুলে কোনোদিন প্রথম দশজনের মধ্যেও থাকা হল না। কোনও বন্ধু হল না। কেমন শক্ত শক্ত হাত পা নিয়ে জীববিজ্ঞানের ক্লাসে মানুষের হৃদয়ে রক্ত সঞ্চালনের ছবি আঁকবার পর দিদিমণি কৌতূহলে জিজ্ঞাসা করেন – হ্যাঁরে তোরও কি আমাদের মতই হৃদয় ......। আমি ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকি। পাষাণ বলেই হয়তো আমার সমস্ত অনুভূতি খুব প্রবল। গ্রীষ্মে অসম্ভব তপ্ত হয়ে উঠি। শীতে পুরো জমে যাই। বর্ষায় হাজার ভিজলেও সর্দিকাশি কিছু হয় না।
কলেজ যাওয়ার পর সে এক অভিজ্ঞতা – থার্ড ইয়ার কেমিস্ট্রি অনার্সের একটা ছেলে বললো – আচ্ছা তোমার সমস্ত অরগ্যানও কি আর সব মেয়েদের মতো। ছেলেটা অনায়াসে আমার জামার ভিতর তার হাত রেখে বলে – ছ্যাঁ – এতো পাথর! সে ছেলের বিয়েতে মেয়ের বাড়ির পরিচয় সূত্রে নিমন্ত্রণ হয়েছিল। গিয়েছিলাম।
এরপর কত আলোকবর্ষ সময় পার হয়ে আজ এখানে পৌঁছেছি। শুনেছি যে মহিলার গর্ভে ভ্রূণ হয়ে একসময় আমি ছিলাম, তার স্বামী মারা গেছেন। মহিলা এখন অ্যালঝাইমারের পেসেন্ট। সব ভুলে গেছে। এমন কি এক সময় এক পাষাণ কন্যা জন্ম দেওয়ার জন্য তার লাইমলাইটে আসার ঘটনাও। পাষাণ বলেই আমার বয়স বাড়ে নি। চোখের নীচে রিংকেল আসেনি। টোন্‌ড দেহ। শুধু একটু উজ্জ্বলতা কমে গেছে। কিছুদিন হল আমি একটা জিনিস আবিষ্কার করেছি, তা হল - আমার শক্ত বুকের নীচে নরম তলতলে কী যেন একটা আছে। কী সেটা? সেটাই কি ব্ল্যাক বোর্ডে আঁকা মানুষের হৃদয়! ইউরেকা! তার মানে –
আমাকে জন্মের পর থেকে মানবী করে তোলবার জন্য যে সমস্ত থেরাপিগুলো চলেছিল, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রত্যেকটার সম্পর্কে অনুসন্ধান চালাতে গিয়ে একটা জার্নালে জানলাম - আসল এবং প্রধান থেরাপিটাই নাকি আমার উপর প্রয়োগ করা হয়নি। তা হল ভালোবাসা। ভালোবেসে কেউ যদি আমাকে স্পর্শ করে তবেই নাকি আমি অন্যরকম হয়ে যাব। যেমনটা ত্রেতাযুগে অহল্যা হয়েছিলেন। কিন্তু এতগুলো দিন পরে আমার কি আর মানবী হয়ে বাঁচতে ইচ্ছা করবে? আমিই বা ভিক্ষুণীর মতো কারও পথ চেয়ে বসে থাকবো কেন? আমারও তো আমার মত করে বাঁচবার অধিকার আছে। তাই না?

No comments:

Post a Comment