Monday, May 6

মানিক সাহার অণুগল্প





ইঁদুরের কল

বুকের ভেতর এই বিকেল বিকেল ভাবটা খুব ভালো লাগে টগরের। সারাদিন কাজের ব্যস্ততা, চিন্তা, দুশ্চিন্তা। তার ফাঁকে এই দুপুরবেলার অবসরটুকু তার কাছে খুব প্রিয় মনে হয়। মনে হয় কোন দূর দেশের একজন বণিক এসেছে তাদের গাঁয়ে। ক্লান্তি দূর করার ঘুম আর গল্প বিক্রি করছে বাড়ি বাড়ি গিয়ে। টগরের সামর্থ কম তাই তার ঘুম আর গালগল্পের পরিমানও কম। তাতে অবশ্য তার কোন অভিযোগ নেই।

ইংরেজিস্যার বলেছিল, কাট ইয়োর কোট একোর্ডিং টু ইয়োর ক্লোথ। কথাটা ভারী মনে ধরেছিল টগরের। তারপর অবশ্য আর পড়া হল না। কণ্যাশ্রীর জন্য স্কুলে নাম আছে বটে, কিন্তু লেখাপড়ার সময় নেই। তাও মাঝে মাঝে চেষ্টা করে।  আসলে মা-টা মরে গিয়ে সব এলোমেলো করে দিয়ে গেছে। যখন ছিল তখন বাড়ির বৌয়ের, বাচ্চার মায়ের গুরুত্ব কেউ বোঝেনি।  আর কে-ই বা বুঝতে চায়!

টগর বারান্দায় ছেড়া চাদরখানা বিছিয়ে নেয়। এখানে বেশ হাওয়া আসে। উঠোনের এককোণে নিমগাছ। হাওয়া লেগে তার পাতা ঝিরঝির করে। গোয়ালঘরের পেছনে খচখচ করে শব্দ হয়। লালি কুকুরটা বাচ্চা দিয়েছে ওখানে৷ তার শব্দই হবে। তার পাশে টগরের প্রিয় দুটি গাছ গায়ে গায়ে বেয়ারে উঠেছে। একটা জারুল আর একটা অমলতাস। অমলতাসকে 'বান্দরেরনেটু' নামেই চেনে গ্রামের সবাই।

হলুদ রঙের ফুল ফুটলে মনে হয় গাছের ভেতরে হয়তো একটা দুপুর চুপ করে বসে আছে। জারুল ফুলগুলি যখন বাতাসে উড়ে উড়ে ওদের উঠোনে এসে পড়ে টগর সেই পাপড়িগুলো তুলে নিয়ে একটা প্লাস্টিকের প্যাকেটে জমা করে। ওর মনে হয় এইসব ফুল, পাতা, আলো, বাতাস সবকিছুই তার কাছে কিছু বলতে আসে।  অথচ সে তাদের ভাষা বোঝে না। অনেক কিছুই বোঝে না সে। এই যেমন ওর লেখাপড়া।

টগর পড়তে চায়। কিন্তু ওর বাবা চায়না। তাহলে বাড়ির কাজ কে করবে। কে সামলাবে ঘরদোর। টগর বাবাকে বোঝাতে চাইত লেখাপড়া চালিয়েও সে ঘর সামলাতে পারবে। বাবা মানে না, "লেহাপড়া কইরা কি জজ ব্যারিস্টার হবা ?  আজাইরা প্যাঁচাল বাদ দাও। যা কই তাই শোন। মা নাই তুমি হইলা বড়। তোমার মেলা দায়িত্ত। বুচচো? "

"তালে ইস্কুলে নাম রাখসো ক্যা? খালি ট্যাহার জইন্য? "

"মাইয়া মানুষের বেশি পড়ালেহা করা ভালা না। তোমার দুই ভাই আছে। অরা পড়ুক। তুমি মাঝে মাঝে দ্যাহায় দিবা।...বড় হইচ কিয়ের লাইগ্যা?"

টগরের কান্না পায়। রাগ পায়। কিন্তু বাবার সাথে পেরে ওঠে না। জারুল গাছে গুটগুট করে ঘুঘু ডাকে। কয়েকটা পাখি ডানা ঝাঁপটা মেরে উড়ে যায়। টগর ভাবে আকাশ কত্ত বড়! নিজের জন্য একটা জায়গা খোঁজে সে।  মায়ের কথা মনে পড়ে। মা বলতো," টগর লেহাপড়া বাদ দিবি না। কারো কথা হুনবিনা। কেউ চায়না মাইয়ারা বেশি লেহাপড়া করুক। তোর কিন্তু চাকরি করন লাগবো, কয়া দিতাছি। "

টগর মাটির দিকে তাকায়। মনে মনে বলে, "মাইয়ালোকের জায়গা নাই। কেউ জায়গা দেয়না। জায়গা কইরা নেওন লাগে।"

ঘরে গিয়ে বইখাতা বের করে। এখন তো বইখাতার জন্য বাপের কাছে টাকা চাইতে হয়না। সুতরাং...

  টগর পড়বে এবং পরীক্ষাও দেবে। স্কুলে গিয়ে হোক আর না-গিয়ে হোক।এই দুপুরটুকু, ভোরেরবেলাটুকু, রাতেরকিছুটা সময়,  টগর হিসেব করে নেয়। পড়ার সময় সে ঠিক বের করে নেবে। চাকরি করবে। একটা আলো করা ঘর থাকবে...।

বিকেল গড়িয়ে গেলে বাবা ঘরে আসে। টগরকে ডাক দেয়। "কাইল তোমারে দেখতে আসবো। একটু পরিপাটি হয়া থাইকো। তোমার কাকিরে কইছি। তোমারে সাজায় দিবেনি।"

সারা শরীর অবশ হয়ে যায় টগরের।"কী কও ইগলা? আমি তোমার কথা হুনচি। ইস্কুল বাদ দিছি। কিন্ত মাধ্যমিক..."

"আহ! যা কইছি তার যেন নড়চড় না হয়। ছেলে ভাল৷ বন্দরে পানের দোকান। ভালোই রোজগার করে। আর তোমার অতসব ভাবার কিছু নাই। যা কইলাম সেইডাই করবা।... লেহাপড়া পরেও করন যাইবো যদি তোমার শ্বশুরবাড়ি থিকা পারমিশন দেয়।"

"আর ইস্কুলে নাম? "

"নাম থাকবো। আঠারো বচ্ছর না হইলে তো আর নাম কাটানো যাবো না। ট্যাহাগুলা নষ্ট কইরা কি লাভ কও!"
ঘরের ভেতরে ঠাস করে শব্দ হয় ৷ একটা ইঁদুর মনে হয় কলে পড়ল। টগরের চোখে জল আসতে চায়। আটকে রাখে।

বাবা কল নিয়ে বাইরে আসে- " হালাডারে আইজকা পাইচি। খুব অইত্যাচার করছিস। আজ তোরে হালা জলে ডুবায়া মারুম।"

টগর নির্বাক হয়ে দাওয়ায় দাঁড়িয়ে থাকে। দম বন্ধ হয়ে আসে।



1 comment: